Thread Rating:
  • 11 Vote(s) - 3.18 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Non-erotic সমাহার by নীললোহিত
#19
মাস্টারমশাই হঠাৎ চুপ করে গেলেন। বললাম, “মাটির দেওয়ালে কি হয়েছে?” উনি ফ্যাকাশে দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কি হয়েছে নিজের চোখেই দেখবে চলো। প্রায় এসেই গেছি।এসে যে গেছি সেটা আমিও বুঝতে পারছিলাম। দূর থেকে কলেজবাড়িটার পাশের বিশাল বড় আমগাছটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। টিফিনের সময় আমগাছের তলাতেই আমরা সবাই মিলে খেলতাম। সবাই বলতে আমি, রাজু, বাবু, তনু, অভি আরো অনেকে। গ্রীষ্মকালে গাছ থেকেই আম পেড়ে সবাই মিলে ভাগ করে খেতাম। আবার হয়তো নিজের অজান্তেই দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। আর সেটা শুনেই মাস্টারমশাই বললেন, “পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তো! বুঝলে সরকার, স্মৃতি সবসময়ই বড় ব্যথার। যত ভাববে ততই যন্ত্রণা বাড়বে। এবার একটু দেখে এসো। রাস্তাটা খারাপ।শেষের কথাগুলো উনি রাস্তার দিকে চেয়ে বললেন। আমরা ততক্ষণে কলেজবাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি কলেজবাড়ির দিকে মানে আগে যেখানে কলেজবাড়িটা ছিল সেদিকে চেয়ে চমকে উঠলাম। ছিল বলছি তার কারণ কলেজবাড়িটা এখন একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মাটির দেওয়ালগুলো ভেঙ্গে এদিক ওদিকে ছিটকে পড়েছে। ছাউনির করোগেট টিনগুলো দুমড়ে মুচড়ে বেঁকে গেছে। সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা হল আমগাছটার সবচেয়ে মোটা ডালটা ভেঙ্গে পড়েছে কলেজবাড়িটার উপরেই। আমি অবাক হয়ে এসব দেখছি, এমন সময় মাস্টারমশাই বললেন, “সবই তো নিজের চোখে দেখছো, সরকার। এই কলেজটাকে আবার নতুন করে তৈরী করতে অনেক খরচা লাগবে। সেসব ব্যবস্থা আমি একলা কি করে.....” হঠাৎ উনি চুপ করে গেলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, “একটা অনুরোধ করব, সরকার?” আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “অনুরোধ বলছেন কেন? বলুন কি বলবেন।মাস্টারমশাই আমার হাতদুটো শক্ত করে বললেন, “তোমার কাছে কোনোদিন কিছু চাইনি, আজ চাইছি। তুমি উদ্যোগ নিয়ে এই গ্রামে একটা নতুন কলেজ গড়ে তোলো। যাতে সেই কলেজে পড়ে আরোও অনেক ডা. নবকুমার সরকার তৈরী হতে পারে। বলো, তুমি একাজ করবে। আমার অনুরোধ রাখবে। আমার গা ছুঁয়ে শপথ করো, সরকার।বললাম, “আপনি উত্তেজিত হবেন না, মাস্টারমশাই। আচ্ছা, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই গ্রামে একটা নতুন কলেজ তৈরী করার ব্যবস্থা করে দেবো। এখন ঘরে চলুন, অনেক রাত হল।উনি বললেন, “এখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলাম, সরকার। চলো, তোমাকে কিছুটা এগিয়ে দিই।আমি বারণ করলেও, মাস্টারমশাই আমার সঙ্গে যেতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কিছুদিন আছো তো, সরকার?” বললাম, “না, মাস্টারমশাই। কাল সকালেই আমি চলে যাব। আপনি ভাববেন না। আমি কাল যাবার আগে একবার জ্যাঠাইমার সাথে দেখা করে যাব। অনেকদিন দেখা হয়নি জ্যাঠাইমার সঙ্গে।উনি বললেন, “যেও। এখনও তোমার কথা বলে। তুমি গেলে খুশী হবে।তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, “আমি আর যাবো না। আমাকে এখন অনেক দূর যেতে হবে। আমি এখন আসি।বলে মাস্টারমশাই অন্ধকারের মধ্যেই হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। আমি বাড়ির কাছেই চলে এসেছিলাম। হাতঘড়িতে দেখলাম এগারোটা বাজতে যাচ্ছে। দরজার কড়া নাড়তেই নিবারণকাকা দরজা খুলল। এতরাতে আমাকে দেখে উপর্যপরি অবাক আর আনন্দিত হয়ে গেল। আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল। বলল আগে থেকে খবর দিয়ে এলে তৈরী হয়ে থাকতে পারত। দেখলাম নিবারণকাকা একলা মানুষ হলেও বাড়িটার যত্ন নেয়। ঝড়ে বাড়িটার ক্ষতি হয়েছে, তবে মারাত্মক কিছু নয়। বারণ করা সত্ত্বেও নিবারণকাকা অতরাতে আমার জন্য রুটি-তরকারী তৈরী করল। হাত পা ধুয়ে খেতে বসেছি এমন সময় দূর থেকে ক্ষীণ একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। নিবারণকাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে কাঁদছে বলো তো?” নিবারণকাকা বলল, “আবার কেউ হয়তো মারা গেল। ঝড়ে অনেকেই আহত হয়েছে।আমি আর কিছু বললাম না। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাস্টারমশাইয়ের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। আশ্চর্য মানুষ বটে! অসুস্থ শরীর নিয়েও বাইরে বেরিয়ে পড়েছেন। তবে একট কথা মানতেই হবে কলেজটাকে উনি অসম্ভব ভালবাসেন। কলকাতায় গিয়ে ভাবতে হবে নতুন কলেজবাড়িটা কোথায়, কিভাবে তৈরী করা যায়। তবে তার আগে মাস্টারমশাইকে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। বলছিলেন চোখে ভাল দেখতে পান না। আমার একজন চক্ষু-চিকিৎসক বন্ধু আছে। তার কাছে মাস্টারমশাইকে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে ওনার। এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই জানিনা। ঘুম ভাঙ্গল নিবারণকাকার ডাকে। দেখি সকাল হয়ে গেছে। মুখ হাত ধুয়ে, চা খেয়ে পাড়ায় বেরোলাম। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করলাম। সবাই খুশী হল আমাকে দেখে। তবে প্রত্যেকেই অভিযোগ করল কেন আমি এতদিন গ্রামে আসিনি। তারপর বাড়ি ফিরে স্নান করে জলখাবার খেয়ে নিবারণকাকা কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অতনু এখনও আসেনি। ওকে আমাদের বাড়ি রাস্তা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। হয়ত এখানেই আসবে। তাই নিবারণকাকাকে বলে এলাম অতনু এলে যেন ওকে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িটা দেখিয়ে দেয়। আমি ওখানেই থাকব। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি বাড়ির সামনে একটা ছোটখাট জটলা হচ্ছে। আর বাড়ির ভিতর থেকে জ্যাঠাইমার গলায় কান্নার আওয়াজ পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি ভীড় ঠেলে বাড়ির ভিতর ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাড়ির উঠানে মাস্টারমশাইয়ের দেহটাকে শোয়ানো আছে। আর ওনারই সেই খদ্দরের চাদরটা দিয়ে ওনার সারা দেহ ঢাকা আছে। জ্যাঠাইমা মাস্টারমশাইয়ের পায়ের কাছে সে কাঁদছেন। আমি জ্যাঠাইমার কাছে গিয়ে বললাম, “জ্যাঠাইমা, আমার দিকে তাকান। আমায় চিনতে পারছেন। আমি সরকারপাড়ার নব। কি করে এসব হল?” জ্যাঠাইমা আমায় চিনতে পেরে আমার হাতদুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সবই আমার অদৃষ্ট, বাবা। সেদিন ঝড় থেমে যাওয়ার পর অতরাতে হ্যারিকেন নিয়ে কলেজ দেখতে বেরিয়ে গেলেন। গায়ে ধুম জ্বর। চোখে ভাল দেখতে পাননা। কত করে বারণ করলাম। শুনল না বেরিয়ে গেল। কলেজের কাছে যেতেই আমগাছটা ভেঙ্গে ওনার মাথায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। পাড়ার ছেলেরাই তুলে ঘরে নিয়ে এল। ডাক্তার দেখে বলল, বাঁচবে না। কাল সন্ধ্যে পর্যন্ত ভালই ছিল। হঠাৎ সাড়ে টার পর কথা বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তারকে খবর দিলাম। এগারোটায় ডাক্তার এল। ডাক্তার দেখে বলল, উনি আর নেই।জ্যাঠাইমার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। পা দুটো টলতে লাগল। আমি ধপ্ করে বসে পড়লাম। আমার আশেপাশের লোকগুলো বলাবলি করতে লাগল, “ইকলেজের জন্য যেন পাগল হয়ে গেছিল মানুষটা। ইকলেজটা সারানোর জন্য এমন কেউ নেই, যার কাছে হাত পাতেনি। ইকলেজটাই ওকে শেষ করে দিল।এমন সময় দেখি অতনু আমার খোঁজ করে হাজির হয়েছে। অতনুকে গাড়ি রেডি করতে বলে আমি উঠে পড়লাম। স্থানীয় কয়েকটি ছেলের সঙ্গে কথা বলে মাস্টারমশাইয়ের দাহকার্যের ব্যবস্থা করলাম। তারপর জ্যাঠাইমার কাছে বিদায় নিয়ে, মাস্টারমশাইয়ের পাদুটোতে শেষ প্রণাম জানিয়ে ওখান থেকে চলে এলাম। পথে আসতে আসতে গাড়িতে ভাবতে লাগলাম, মাস্টারমশাইয়ের শেষ অনুরোধ আমাকে রাখতেই হবে। আমি যে ওনার গা ছুঁয়ে কথা দিয়েছি। ঠিক করে নিলাম আমি একাই নতুন পাকা কলেজবাড়ি গড়ে তুলব। সেই কলেজের নাম হবেবলাইচন্দ্র মেমোরিয়াল কলেজ যেখান থেকে পড়ে আরো অনেক ডা. নবকুমার সরকার তৈরী না হোক, অন্তত একটা বলাইচন্দ্র মুখার্জী তৈরী হবে। যে হবে একজন সত্যিকারের ভাল মানুষ এবং কর্তব্যপরায়ণ। কারণ আমার মাস্টারমশাই ছিলেন একজন কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ, যিনি মৃত্যুর পরেও নিজের কর্তব্য সমাধা করে গেছেন।


সমাপ্ত



বি.দ্র.- এই গল্পের মাধ্যমে সেইসব মাস্টারমশাইদের প্রতি সম্মান জানালাম, যাঁরা নিজেদের জীবনের অধিকাংশ সময় ধরে চুপচাপ কেবল নিজেদের কর্তব্য করে গেছেন।-নীললোহিত
[+] 6 users Like ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সমাহার by নীললোহিত - by ddey333 - 21-06-2021, 01:05 PM



Users browsing this thread: 3 Guest(s)