21-06-2021, 01:04 PM
৩
বাসটা যখন আমায় গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল, তখন হাতঘড়ি জানাচ্ছে রাত পৌনে দশটা বাজে। বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা। আকাশে এখন মেঘ সরে গিয়ে চতুর্থীর আধখাওয়া চাঁদ উঠেছে। সেই আলোতেই পথ চলতে শুরু করলাম। সঙ্গের ব্যাগেতে টর্চ ছিল। কিন্তু তাড়াতাড়িতে সেটা গাড়িতেই ফেলে এসেছি। তাই অগত্যা চাঁদই ভরসা। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর গ্রামে ঢোকার ঠিক মুখে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ আছে। সেই বটগাছের গুঁড়ির চারিদিকে বেদী করে গ্রামের মানুষেরা সন্ধ্যার পর এসে বসত। এখানেই আমাদের গ্রামের হাট বসত সপ্তাহে একদিন। রথের আর গাজনের মেলাও বসত এখানেই। আমি সেই মেলাতে যাবার জন্য বাবার কাছে বায়না করতাম। তারপর বাবার হাত ধরে আসতাম মেলাতে। আর ফেরার সময় সাথে মাটির পুতুল, খেলনা, মুঠো ভর্তি জিভেগজা আর পাঁপড়ভাজা থাকত। সেসব যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি! একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দূর থেকে দেখলাম বটগাছটা এখনও আছে। বিধ্বংসী ঝড় এই মহীরুহকে উপড়ে ফেলতে না পারলেও, কিছু মোটা মোটা ডালকে ভেঙ্গে দিয়ে তাকে বেশ জখম করে দিয়েছে। আরো কিছুটা এগোতেই দেখতে পেলাম একজন মানুষ বটগাছের বেদীতে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘাড় হেঁট করে বসে আছে। আরেকটু এগোতেই চাঁদের আবছা আলোতে মানুষটাকে চিনতে পেরে চমকে গেলাম। মানুষটার কাছে গিয়ে বললাম, “একি মাস্টারমশাই, এত রাতে এখানে বসে আছেন, কি ব্যাপার!?” উনি চমকে উঠে আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর কষ্ট করে চোখদুটোকে কুঁচকে যেন আমাকে চেনার চেষ্টা করলেন। তারপর ভাঙ্গা গলায় বললেন, “তুমি কে বলো তো? ঠিক চিনতে পারছি না।” উত্তর দিলাম, “আমি সরকার পাড়ার নব, সমরেন্দ্র সরকারের ছেলে। আজ কাগজে গ্রামের খবরটা দেখলাম। তাই ভাবলাম একবার ঘুরে দেখে যাই।” মাস্টারমশাই বললেন, “ভালো করেছো বাবা, ভাল করেছো। কিন্তু কি দেখবে বাবা? সব তছনছ হয়ে গেছে। কত বাড়ি ভেঙ্গেছে, কত মানুষ যে আহত হয়েছে, তার কোন হিসাব নেই। কত মানুষ যে মারা গেছে, তার সব কথা কি তোমাদের কাগজে দিয়েছে?” বুঝলাম মানুষটা অভিমান করে এসব কথা বলছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করতে গেলাম। উনি চট করে পা দুটোকে টেনে নিয়ে বললেন, “থাক বাবা, রাস্তাঘাটে আর প্রণাম করতে হবেনা। তোমাকে আর কি বলব বাবা। অনেক বড় হয়েছ, নামডাক হয়েছে, বাবা-দাদুর মুখ উজ্জ্বল করেছো। তোমরাই তো এই গ্রামের গর্ব।” বললাম, “সবই আপনাদের আশীর্বাদে মাস্টারমশাই।” উনি বললেন, “তুমি বাড়িতে যাচ্ছো তো? চলো তোমার সঙ্গে কিছুটা যাই। অনেকদিন তোমার দেখা পাইনি। চলো তোমার সাথে কথা বলতে বলতে একটু যাই।” ওনার কথার উত্তর দিত দিতে হাঁটতে লাগলাম। ওনাকে দেখে কেমন যেন অসুস্থ বলে মনে হল। আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছেন। গালদুটোও বসে গেছে। গলাটাও কেমন যেন ধরা ধরা লাগছে। বললাম, “আপনার কি শরীর খারাপ নাকি?” মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “আর শরীর। চোখে ভাল দেখতে পাই না আজকাল। জ্বরটাও ক’দিন থেকে ছাড়ছে না।” বললাম, “তাহলে এতরাতে বটতলায় বসেছিলেন কেন? শরীর তো আরো খারাপ হবে।” “ধুর। শরীর ভাবলেই শরীর। না ভাবলে কিছু নয়। শুয়ে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। তাই ভাবলাম যাই একবার বটতলায় গিয়ে বসি। তবে এসে ভালোই করেছিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখন তো গ্রামে আসা বন্ধই করে দিয়েছো।” বুঝলাম এখনও উনি অভিমান করে আছেন আমার উপর। কোন উত্তর দিলাম না। চুপচাপ ওনার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম এটুকু হাঁটার কারণে হাঁফাচ্ছেন। জ্বরের ফলে বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ চলার পর মাস্টারমশাই হঠাৎ বললেন, “চলো, তোমাকে তোমার কলেজটা দেখিয়ে আনি।” অত রাতে কলেজ দেখতে যাবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ওনার গলার স্বরে এমন একটা ভাব ছিল যে আমি আর না করতে পারলাম না। যাব না বললে হয়ত মনে দুঃখ পাবেন। তাই ওনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম। যেতে যেতে বলতে লাগলেন, “জানো সরকার, কলেজটার অবস্থা খুবই খারাপ। বর্ষাকালে ঘরগুলোতে জল পড়ে। ছেলেমেয়েগুলোর খুব অসুবিধা হয় জানো। করোগেটগুলো পাল্টালে ভাল হয়। আর মাটির দেওয়ালগুলো.........”
বাসটা যখন আমায় গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল, তখন হাতঘড়ি জানাচ্ছে রাত পৌনে দশটা বাজে। বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা। আকাশে এখন মেঘ সরে গিয়ে চতুর্থীর আধখাওয়া চাঁদ উঠেছে। সেই আলোতেই পথ চলতে শুরু করলাম। সঙ্গের ব্যাগেতে টর্চ ছিল। কিন্তু তাড়াতাড়িতে সেটা গাড়িতেই ফেলে এসেছি। তাই অগত্যা চাঁদই ভরসা। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর গ্রামে ঢোকার ঠিক মুখে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ আছে। সেই বটগাছের গুঁড়ির চারিদিকে বেদী করে গ্রামের মানুষেরা সন্ধ্যার পর এসে বসত। এখানেই আমাদের গ্রামের হাট বসত সপ্তাহে একদিন। রথের আর গাজনের মেলাও বসত এখানেই। আমি সেই মেলাতে যাবার জন্য বাবার কাছে বায়না করতাম। তারপর বাবার হাত ধরে আসতাম মেলাতে। আর ফেরার সময় সাথে মাটির পুতুল, খেলনা, মুঠো ভর্তি জিভেগজা আর পাঁপড়ভাজা থাকত। সেসব যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি! একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দূর থেকে দেখলাম বটগাছটা এখনও আছে। বিধ্বংসী ঝড় এই মহীরুহকে উপড়ে ফেলতে না পারলেও, কিছু মোটা মোটা ডালকে ভেঙ্গে দিয়ে তাকে বেশ জখম করে দিয়েছে। আরো কিছুটা এগোতেই দেখতে পেলাম একজন মানুষ বটগাছের বেদীতে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘাড় হেঁট করে বসে আছে। আরেকটু এগোতেই চাঁদের আবছা আলোতে মানুষটাকে চিনতে পেরে চমকে গেলাম। মানুষটার কাছে গিয়ে বললাম, “একি মাস্টারমশাই, এত রাতে এখানে বসে আছেন, কি ব্যাপার!?” উনি চমকে উঠে আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর কষ্ট করে চোখদুটোকে কুঁচকে যেন আমাকে চেনার চেষ্টা করলেন। তারপর ভাঙ্গা গলায় বললেন, “তুমি কে বলো তো? ঠিক চিনতে পারছি না।” উত্তর দিলাম, “আমি সরকার পাড়ার নব, সমরেন্দ্র সরকারের ছেলে। আজ কাগজে গ্রামের খবরটা দেখলাম। তাই ভাবলাম একবার ঘুরে দেখে যাই।” মাস্টারমশাই বললেন, “ভালো করেছো বাবা, ভাল করেছো। কিন্তু কি দেখবে বাবা? সব তছনছ হয়ে গেছে। কত বাড়ি ভেঙ্গেছে, কত মানুষ যে আহত হয়েছে, তার কোন হিসাব নেই। কত মানুষ যে মারা গেছে, তার সব কথা কি তোমাদের কাগজে দিয়েছে?” বুঝলাম মানুষটা অভিমান করে এসব কথা বলছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করতে গেলাম। উনি চট করে পা দুটোকে টেনে নিয়ে বললেন, “থাক বাবা, রাস্তাঘাটে আর প্রণাম করতে হবেনা। তোমাকে আর কি বলব বাবা। অনেক বড় হয়েছ, নামডাক হয়েছে, বাবা-দাদুর মুখ উজ্জ্বল করেছো। তোমরাই তো এই গ্রামের গর্ব।” বললাম, “সবই আপনাদের আশীর্বাদে মাস্টারমশাই।” উনি বললেন, “তুমি বাড়িতে যাচ্ছো তো? চলো তোমার সঙ্গে কিছুটা যাই। অনেকদিন তোমার দেখা পাইনি। চলো তোমার সাথে কথা বলতে বলতে একটু যাই।” ওনার কথার উত্তর দিত দিতে হাঁটতে লাগলাম। ওনাকে দেখে কেমন যেন অসুস্থ বলে মনে হল। আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছেন। গালদুটোও বসে গেছে। গলাটাও কেমন যেন ধরা ধরা লাগছে। বললাম, “আপনার কি শরীর খারাপ নাকি?” মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “আর শরীর। চোখে ভাল দেখতে পাই না আজকাল। জ্বরটাও ক’দিন থেকে ছাড়ছে না।” বললাম, “তাহলে এতরাতে বটতলায় বসেছিলেন কেন? শরীর তো আরো খারাপ হবে।” “ধুর। শরীর ভাবলেই শরীর। না ভাবলে কিছু নয়। শুয়ে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। তাই ভাবলাম যাই একবার বটতলায় গিয়ে বসি। তবে এসে ভালোই করেছিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখন তো গ্রামে আসা বন্ধই করে দিয়েছো।” বুঝলাম এখনও উনি অভিমান করে আছেন আমার উপর। কোন উত্তর দিলাম না। চুপচাপ ওনার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম এটুকু হাঁটার কারণে হাঁফাচ্ছেন। জ্বরের ফলে বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ চলার পর মাস্টারমশাই হঠাৎ বললেন, “চলো, তোমাকে তোমার কলেজটা দেখিয়ে আনি।” অত রাতে কলেজ দেখতে যাবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ওনার গলার স্বরে এমন একটা ভাব ছিল যে আমি আর না করতে পারলাম না। যাব না বললে হয়ত মনে দুঃখ পাবেন। তাই ওনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম। যেতে যেতে বলতে লাগলেন, “জানো সরকার, কলেজটার অবস্থা খুবই খারাপ। বর্ষাকালে ঘরগুলোতে জল পড়ে। ছেলেমেয়েগুলোর খুব অসুবিধা হয় জানো। করোগেটগুলো পাল্টালে ভাল হয়। আর মাটির দেওয়ালগুলো.........”