21-06-2021, 11:12 AM
২
সময় কারোর জন্যই থেমে থাকেনা। সে তার নিজের ছন্দে বয়ে যায় নিরন্তর। একসময় আমার গ্রামের কলেজের পড়া শেষ হয়ে গেল। বাবা আমাকে বারাসতে মামাবাড়ির কাছের একটা কলেজে ভর্তি করে দিল। আমি মামাবাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করতে লাগলাম। প্রথম কয়েক বছর ছুটিতে গ্রামে যেতাম। তখন প্রায়ই মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা হত। আমি ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই, উনি দুটো হাত আমার মাথায় রেখে আশীর্বাদ করে বলতেন, “বেঁচে থাকো। আশীর্বাদ করি তুমি আরোও অনেক বড় হও।” তারপরেই আমার পড়াশুনার কথা, নতুন কলেজের কথা, নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা, নতুন বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। এরপর পড়াশুনার চাপে ধীরে ধীরে আমার গ্রামে যাওয়া কমে আসতে লাগল। অবশেষে বছরে একবার কি দু’বার গ্রামে যেতাম। গ্রামে গেলেও থাকতাম না। তাই মাস্টারমশাইয়ের সাথে ক্কচিৎ কদাচিৎ দেখা হত। হায়ার সেকেণ্ডারীতে পড়ার সময় ঠাকুমা মারা গেল। বাবা গ্রামেই শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করল। আমি গিয়েছিলাম। সঙ্গে দু’চারজন বন্ধুও ছিল। শ্রাদ্ধের দিন বাবা গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছিল। আমি বন্ধুদেরকে নিয়ে খেতে বসেছি, হঠাৎ নজরে এল আমাদের সামনের সারিতেই মাস্টারমশাই খেতে বসেছেন। শীতকালের দিন। তাই ওনার দেহে সেই চিরপরিচিত খাটো ধুতি আর পাঞ্জাবীর উপর খদ্দরের চাদরটি জড়ানো আছে। তবে এতগুলো বছরে সেই চাদরের অবস্থা দীর্ণ হয়ে পড়েছে। কয়েকটা জায়গায় তাপ্পিও পড়েছে দেখলাম। উনি যে চিরদিনই খেতে ভালবাসেন, এটা আগেই বলেছি। কিন্তু আমার শহুরে বন্ধুদের কাছে সেটা রীতিমত “রাক্ষুসে খাওয়া” বলে মনে হল। সেদিন বন্ধুদের নানান টিপ্পনী শুনে আমার কান জ্বলতে লাগল। সেদিন আমার বলা উচিত ছিল, “উনি আমার মাস্টারমশাই”। কিন্তু বন্ধুদের কাছে “প্রেস্টিজ” হারাবার ভয়ে আমি মুখ খুললাম না। উনি সেদিন হয়তো আমার বন্ধুদের টিপ্পনী শুনে থাকবেন। আমার নীরবতাও হয়ত ওনার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু কারোকে কিচ্ছু না বলে, খাওয়া শেষ করেই একপ্রকার দৌড়ে চলে গেলেন। এ ঘটনাও বেশীদিন লাগল না আমার মন থেকে মুছে যেতে। আস্তে আস্তে পড়াশুনার মধ্যে হারিয়ে গেলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলাম। হায়ার সেকেণ্ডারীতে লেটার মার্কস পাওয়ায় এবং জয়েন্টে মেডিকেলে ভাল ব়্যাঙ্ক করার সুবাদে আর মেজমামার পরিচিতির জোরে কলকাতার এক নামী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। কলকাতাতেই একটা মেসে ভাড়া থেকে পড়াশুনা করতে লাগলাম। গ্রামে যাওয়া একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেল। এরপর পরপর দু’বছরে বাবা আর তারপর মায়ের মৃত্যু আমার মন থেকে গ্রামটাকে একপ্রকার মুছিয়ে দিল। এরপর আমি মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্কলারশিপ সহ গ্রাজুয়েট হয়ে বিদেশে চলে যাই পড়তে। সেখান থেকে বছর কয়েক পর ফিরে এসে কলকাতায় স্থায়ী হই। এখন আমি, ডা. নবকুমার সরকার, ডাক্তারমহলে একটি পরিচিত নাম। কলকাতার এক নামকরা বেসরকারী নার্সিংহোমে উচ্চপদে নিযুক্ত আছি। সল্টলেকে নিজের ফ্ল্যাট, সাথে চেম্বার, স্ত্রী-কন্যা সহ সুখের সংসার। বেশ ভালভাবেই দিন কাটছিল, হঠাৎ খবরের কাগজের পাতায় নিজের গ্রামের নামটা পড়ে চমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত কিছু পুরানো কথা মনে পড়ে গেল। বিধ্বংসী ঝড়ে আমাদের গ্রামের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। বহু মানুষ আহত হয়েছে। বেশকিছু মানুষ মারাও গেছে। গ্রামে আমার পরিবারের আর কেউ নেই ঠিকই, তবে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত টান অনুভব করলাম। আর বহুবছর গ্রামে যাইনি। গ্রামটার কেমন অবস্থা তাও জানিনা। তবে আমাদের বাড়িটা এখনও আছে। আর আছে কিছু জমি। সেই জমি চাষ করে আর বাড়িঘর দেখাশোনা করে বিপত্নীক নিবারণকাকা। মাঝে মাঝে আসে কলকাতায়। ওর মুখ থেকেই শুনি গ্রামের কথা। নিবারণকাকা অনেকবার বলেছে গ্রামে যেতে। কিন্তু কাজের চাপে হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ গ্রামে যাবার একটা প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্য টের পেলাম।
সময় কারোর জন্যই থেমে থাকেনা। সে তার নিজের ছন্দে বয়ে যায় নিরন্তর। একসময় আমার গ্রামের কলেজের পড়া শেষ হয়ে গেল। বাবা আমাকে বারাসতে মামাবাড়ির কাছের একটা কলেজে ভর্তি করে দিল। আমি মামাবাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করতে লাগলাম। প্রথম কয়েক বছর ছুটিতে গ্রামে যেতাম। তখন প্রায়ই মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা হত। আমি ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই, উনি দুটো হাত আমার মাথায় রেখে আশীর্বাদ করে বলতেন, “বেঁচে থাকো। আশীর্বাদ করি তুমি আরোও অনেক বড় হও।” তারপরেই আমার পড়াশুনার কথা, নতুন কলেজের কথা, নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা, নতুন বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। এরপর পড়াশুনার চাপে ধীরে ধীরে আমার গ্রামে যাওয়া কমে আসতে লাগল। অবশেষে বছরে একবার কি দু’বার গ্রামে যেতাম। গ্রামে গেলেও থাকতাম না। তাই মাস্টারমশাইয়ের সাথে ক্কচিৎ কদাচিৎ দেখা হত। হায়ার সেকেণ্ডারীতে পড়ার সময় ঠাকুমা মারা গেল। বাবা গ্রামেই শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করল। আমি গিয়েছিলাম। সঙ্গে দু’চারজন বন্ধুও ছিল। শ্রাদ্ধের দিন বাবা গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছিল। আমি বন্ধুদেরকে নিয়ে খেতে বসেছি, হঠাৎ নজরে এল আমাদের সামনের সারিতেই মাস্টারমশাই খেতে বসেছেন। শীতকালের দিন। তাই ওনার দেহে সেই চিরপরিচিত খাটো ধুতি আর পাঞ্জাবীর উপর খদ্দরের চাদরটি জড়ানো আছে। তবে এতগুলো বছরে সেই চাদরের অবস্থা দীর্ণ হয়ে পড়েছে। কয়েকটা জায়গায় তাপ্পিও পড়েছে দেখলাম। উনি যে চিরদিনই খেতে ভালবাসেন, এটা আগেই বলেছি। কিন্তু আমার শহুরে বন্ধুদের কাছে সেটা রীতিমত “রাক্ষুসে খাওয়া” বলে মনে হল। সেদিন বন্ধুদের নানান টিপ্পনী শুনে আমার কান জ্বলতে লাগল। সেদিন আমার বলা উচিত ছিল, “উনি আমার মাস্টারমশাই”। কিন্তু বন্ধুদের কাছে “প্রেস্টিজ” হারাবার ভয়ে আমি মুখ খুললাম না। উনি সেদিন হয়তো আমার বন্ধুদের টিপ্পনী শুনে থাকবেন। আমার নীরবতাও হয়ত ওনার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু কারোকে কিচ্ছু না বলে, খাওয়া শেষ করেই একপ্রকার দৌড়ে চলে গেলেন। এ ঘটনাও বেশীদিন লাগল না আমার মন থেকে মুছে যেতে। আস্তে আস্তে পড়াশুনার মধ্যে হারিয়ে গেলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলাম। হায়ার সেকেণ্ডারীতে লেটার মার্কস পাওয়ায় এবং জয়েন্টে মেডিকেলে ভাল ব়্যাঙ্ক করার সুবাদে আর মেজমামার পরিচিতির জোরে কলকাতার এক নামী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। কলকাতাতেই একটা মেসে ভাড়া থেকে পড়াশুনা করতে লাগলাম। গ্রামে যাওয়া একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেল। এরপর পরপর দু’বছরে বাবা আর তারপর মায়ের মৃত্যু আমার মন থেকে গ্রামটাকে একপ্রকার মুছিয়ে দিল। এরপর আমি মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্কলারশিপ সহ গ্রাজুয়েট হয়ে বিদেশে চলে যাই পড়তে। সেখান থেকে বছর কয়েক পর ফিরে এসে কলকাতায় স্থায়ী হই। এখন আমি, ডা. নবকুমার সরকার, ডাক্তারমহলে একটি পরিচিত নাম। কলকাতার এক নামকরা বেসরকারী নার্সিংহোমে উচ্চপদে নিযুক্ত আছি। সল্টলেকে নিজের ফ্ল্যাট, সাথে চেম্বার, স্ত্রী-কন্যা সহ সুখের সংসার। বেশ ভালভাবেই দিন কাটছিল, হঠাৎ খবরের কাগজের পাতায় নিজের গ্রামের নামটা পড়ে চমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত কিছু পুরানো কথা মনে পড়ে গেল। বিধ্বংসী ঝড়ে আমাদের গ্রামের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। বহু মানুষ আহত হয়েছে। বেশকিছু মানুষ মারাও গেছে। গ্রামে আমার পরিবারের আর কেউ নেই ঠিকই, তবে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত টান অনুভব করলাম। আর বহুবছর গ্রামে যাইনি। গ্রামটার কেমন অবস্থা তাও জানিনা। তবে আমাদের বাড়িটা এখনও আছে। আর আছে কিছু জমি। সেই জমি চাষ করে আর বাড়িঘর দেখাশোনা করে বিপত্নীক নিবারণকাকা। মাঝে মাঝে আসে কলকাতায়। ওর মুখ থেকেই শুনি গ্রামের কথা। নিবারণকাকা অনেকবার বলেছে গ্রামে যেতে। কিন্তু কাজের চাপে হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ গ্রামে যাবার একটা প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্য টের পেলাম।