21-06-2021, 11:09 AM
কোনদিন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার কোনদিন মহাত্মা গান্ধী বা স্বামী বিবেকানন্দ বা সুভাষচন্দ্রের জীবনী, কোনদিন বা ক্যাপ্টেন স্কটের দক্ষিণ মেরু অভিযান। ওনার ঘরে অনেক বই থাকত। উনি সেইসব বই থেকে পড়ে শোনাতেন আমাকে। হ্যারিকেনের ক্ষয়াটে, হলদে আলোয় ওনার চোখদুটো অসম্ভব জ্বলজ্বল করত। দেখলে ভয় পেত, গায়ে কাঁটা দিত। সেই জ্বলজ্বলে চোখদুটোর দিকে তাকাতে পারতাম না। মাস্টারমশাই বলতেন, “জীবনে সফল নয়, বরং একজন ভাল মানুষ, সত্যিকারের মানুষ হওয়ার চেষ্টা কোরো সরকার। সফল তো অনেকেই হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যিকারের মানুষ ক’জন, তা কি কেউ বলতে পারে?” ঐ বয়সে ওনার সব কথা হয়তো বুঝত পারতাম না কিন্তু ওনার বলা প্রত্যেকটা কথা শুনতে খুব ভাল লাগত। গল্প শুনতে শুনতে প্রতিদিনই রাত্রি হয়ে যেত। আর জ্যাঠাইমা আমাকে জোর করে, হাত গড়া দুটো গরম রুটি আর একবাটি সরওঠা দুধ খাইয়ে দিতেন। বাবা আমাকে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি খেকে আনতে যেত। প্রথম প্রথম আমাকে দুধ-রুটি খেতে দেখে বাবা আপত্তি তুলত। “একি বৌদি, প্রতিদিন ওকে এইভাবে খেতে দেবেন না।” জ্যাঠাইমা নরম স্বরে বলতেন, “সেকী কথা সমর, নব আমার ছেলের মত। ও খেলে কী হবে?” বাবা তাও বলত, “তা হোক, কাল থেকে আর দেবেন না।” কিন্তু পরের দিন জ্যাঠাইমা ঠিক পড়ার শেষে আমার বরাদ্দ দুটো রুটি আর একবাটি দুধ আমার সামনে এনে রাখতেন। আর সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেও জ্যাঠাইমার হাতে গড়া রুটি আর দুধটুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। পরে জীবনে অনেক ভাল ভাল জিনিস খেয়েছি, কিন্তু ছোটবেলার জ্যাঠাইমার হাতের মোটা রুটি আর মোটা সরওয়ালা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধের দুধের স্বাদ এখনও আমার মুখে লেগে আছে। বাবা একবার আমার পড়ানোর বাবদ কিছু টাকা মাস্টারমশাইকে দিতে গেছিল। কিন্তু উনি সেই টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি সরকারকে এমনিই পড়াই। আর ওর জ্যাঠাইমা ওকে ভালবেসে দুটো খেতে দেয়। এর জন্য আমি তোমার কাছে টাকা নিতে পারবোনা, সমর।”