21-06-2021, 11:08 AM
মাস্টারমশাই
১
আমাদের গ্রামে একটি মাত্র প্রাইমারী কলেজ ছিল। এখনও তাই আছে। শুনেছি আমার দাদু ও গ্রামের অন্যান্য মাতব্বরেরা মিলে এই কলেজটি তৈরী করেছিলেন। সেসব আজ বহুকাল আগের কথা। আমার বাবা-ই তখন তিন বছরের আর বড় পিসির তখন সবে পাঁচ। তারপর থেকেই এই কলেজে পড়াশুনা হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামের বহু ছেলেমেয়ে এমনকি আমার বাবা-পিসিও এই কলেজে পড়াশুনা করেছেন। তাই কতকটা পারিবারিক রীতি মেনেই বাবা আমাকে ঐ কলেজে ভর্তি করে দিলেন। আমি যখন ঐ কলেজে ভর্তি হই, তখন কলেজে চাকরী করতেন আমাদের গ্রামেরই মানুষ বলাইচন্দ্র মুখার্জী। কলেজে আমরা জনা ত্রিশ ছেলেমেয়ে পড়তাম। গ্রীষ্মকালে মাস্টারমশাই হাতে তালপাতার হাতপাখা নিয়ে পড়াতেন। আর কারোর পড়ায় সামান্যতম ভুল হলে বা একটু দুষ্টুমি করলেই, সেই পাখার বাঁট দিয়ে উত্তম মধ্যম মারতেন। সে মার অবশ্য আমার পিঠে না পড়লেও, মাস্টারমশাইকে বেশ ভয় পেতম আমি। তবে এটা লক্ষ্য করতাম, উনি আমার পড়াশুনার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতেন। মাস্টারমশাই ছিলেন অপুত্রক। সংসারে ওনার স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের জ্যাঠাইমা আর আদরের গরু বুধি ছাড়া তাঁর আপনার বলতে আর কেউ ছিলনা। জ্যাঠাইমা বুধির দুধ থেকে ঘি তৈরী করতেন আর উনি সেই ঘি বিক্রি করতেন। প্রায়ই দেখতাম এক বোতল ভর্তি করে ঘি নিয়ে হেলতে দুলতে আমাদের বাড়িতে এসে মাকে হাঁক পাড়তেন, “কই বউমা, চায়ের জল চাপাও।” মা-ও অমনি একগলা ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘর থেকে উত্তর দিত, “চাপিয়ে দিয়েছি দাদা, আপনি বসুন।” তারপর মায়ের তৈরী চা তার সাথে মুড়ি আর বেগুনি খেতে খেতে ঠাকুমার সাথে গল্প শুরু করে দিতেন। আর মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, “সরকার, কই কাল যে অঙ্কটা পারোনি, নিয়ে এসোতো, বুঝিয়ে দিই।” উনি আমাকে নাম ধরে না ডেকে সরকার বলে ডাকতেন। উনি যে পড়াটাই বুঝিয়ে দিতেন, সেটাই জলের মত মনে গেঁথে যেত। চা-মুড়ি খেয়ে, গল্প করে ওঠার সময় ঠাকুমাকে বলতেন, “এবার উঠি কাকীমা, অনেক রাত হল। ওদিকে আবার আপনার বউমা হয়ত চিন্তা করছে।” উনি কোনওদিন আমাদের কাছ থেকে ঘিয়ের দাম নিতেন না। কলেজ তৈরী হওয়ার পর দাদুই ওনাকে কলেজের মাস্টার করে দেন। সেই কথাটা উনি আজও ভোলেননি। ঠাকুমা যদি, “একি কথা বলাই, তুমি এত কষ্ট করে ঘি তৈরী করবে, অথচ টাকা নেবেনা, এটাতো ভাল কথা নয়” বলে টাকা দিতে যেতেন, মাস্টারমশাই অমনি খপ্ করে ঠাকুমার দু’হাত ধরে ফেলে বলতেন, “আপনাদের কাছ থেকে টাকা নিলে মহাপাতকী হবো, কাকীমা। আচ্ছা বেশ একদিন না হয় আমাকে নেমন্তন্ন করে খাইয়ে দেবেন।” উনি খেতে খুব ভালবাসতেন। তাই ঠাকুমা তাঁকে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। গরমের দিনে একটা খাটো ধুতির উপর একটা পাঞ্জাবী আর শীতকালের দিনে পাঞ্জাবীর উপর একটা মোটা খদ্দরের চাদর - এই ছিল ওনার মার্কমারা পোষাক। শুনেছি মাস্টারমশাই নিজে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তখনকার দিনের আই.এ. পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় কলেজে পড়া সম্ভব হয়নি ওনার। তাই উনি যেটা নিজে পারেননি, সেটা ওনার ছাত্রছাত্রীদের হোক, এটাই ছিল ওনার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই শীত গ্রীষ্ম-বর্ষা একদিনও কলেজে কামাই করতেন না। অনেকদিন দেখেছি ওনাকে জ্বর গায়ে বা অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের পড়াতে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন চারিদিক এত প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং সেন্টারের রমরমা ছিলনা। তাই বাবা আমাকে মাস্টারমশাইয়ের কাছেই পড়ার ব্যবস্থা করেছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি ওনাদের বাড়িতে পড়তে যেতাম। উনি পড়া বুঝিয়ে দেবার পর প্রতিদিন একটা করে গল্প বলতেন। এক-একদিন এক-একটা নতুন গল্প।
১
আমাদের গ্রামে একটি মাত্র প্রাইমারী কলেজ ছিল। এখনও তাই আছে। শুনেছি আমার দাদু ও গ্রামের অন্যান্য মাতব্বরেরা মিলে এই কলেজটি তৈরী করেছিলেন। সেসব আজ বহুকাল আগের কথা। আমার বাবা-ই তখন তিন বছরের আর বড় পিসির তখন সবে পাঁচ। তারপর থেকেই এই কলেজে পড়াশুনা হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামের বহু ছেলেমেয়ে এমনকি আমার বাবা-পিসিও এই কলেজে পড়াশুনা করেছেন। তাই কতকটা পারিবারিক রীতি মেনেই বাবা আমাকে ঐ কলেজে ভর্তি করে দিলেন। আমি যখন ঐ কলেজে ভর্তি হই, তখন কলেজে চাকরী করতেন আমাদের গ্রামেরই মানুষ বলাইচন্দ্র মুখার্জী। কলেজে আমরা জনা ত্রিশ ছেলেমেয়ে পড়তাম। গ্রীষ্মকালে মাস্টারমশাই হাতে তালপাতার হাতপাখা নিয়ে পড়াতেন। আর কারোর পড়ায় সামান্যতম ভুল হলে বা একটু দুষ্টুমি করলেই, সেই পাখার বাঁট দিয়ে উত্তম মধ্যম মারতেন। সে মার অবশ্য আমার পিঠে না পড়লেও, মাস্টারমশাইকে বেশ ভয় পেতম আমি। তবে এটা লক্ষ্য করতাম, উনি আমার পড়াশুনার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতেন। মাস্টারমশাই ছিলেন অপুত্রক। সংসারে ওনার স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের জ্যাঠাইমা আর আদরের গরু বুধি ছাড়া তাঁর আপনার বলতে আর কেউ ছিলনা। জ্যাঠাইমা বুধির দুধ থেকে ঘি তৈরী করতেন আর উনি সেই ঘি বিক্রি করতেন। প্রায়ই দেখতাম এক বোতল ভর্তি করে ঘি নিয়ে হেলতে দুলতে আমাদের বাড়িতে এসে মাকে হাঁক পাড়তেন, “কই বউমা, চায়ের জল চাপাও।” মা-ও অমনি একগলা ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘর থেকে উত্তর দিত, “চাপিয়ে দিয়েছি দাদা, আপনি বসুন।” তারপর মায়ের তৈরী চা তার সাথে মুড়ি আর বেগুনি খেতে খেতে ঠাকুমার সাথে গল্প শুরু করে দিতেন। আর মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, “সরকার, কই কাল যে অঙ্কটা পারোনি, নিয়ে এসোতো, বুঝিয়ে দিই।” উনি আমাকে নাম ধরে না ডেকে সরকার বলে ডাকতেন। উনি যে পড়াটাই বুঝিয়ে দিতেন, সেটাই জলের মত মনে গেঁথে যেত। চা-মুড়ি খেয়ে, গল্প করে ওঠার সময় ঠাকুমাকে বলতেন, “এবার উঠি কাকীমা, অনেক রাত হল। ওদিকে আবার আপনার বউমা হয়ত চিন্তা করছে।” উনি কোনওদিন আমাদের কাছ থেকে ঘিয়ের দাম নিতেন না। কলেজ তৈরী হওয়ার পর দাদুই ওনাকে কলেজের মাস্টার করে দেন। সেই কথাটা উনি আজও ভোলেননি। ঠাকুমা যদি, “একি কথা বলাই, তুমি এত কষ্ট করে ঘি তৈরী করবে, অথচ টাকা নেবেনা, এটাতো ভাল কথা নয়” বলে টাকা দিতে যেতেন, মাস্টারমশাই অমনি খপ্ করে ঠাকুমার দু’হাত ধরে ফেলে বলতেন, “আপনাদের কাছ থেকে টাকা নিলে মহাপাতকী হবো, কাকীমা। আচ্ছা বেশ একদিন না হয় আমাকে নেমন্তন্ন করে খাইয়ে দেবেন।” উনি খেতে খুব ভালবাসতেন। তাই ঠাকুমা তাঁকে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। গরমের দিনে একটা খাটো ধুতির উপর একটা পাঞ্জাবী আর শীতকালের দিনে পাঞ্জাবীর উপর একটা মোটা খদ্দরের চাদর - এই ছিল ওনার মার্কমারা পোষাক। শুনেছি মাস্টারমশাই নিজে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তখনকার দিনের আই.এ. পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় কলেজে পড়া সম্ভব হয়নি ওনার। তাই উনি যেটা নিজে পারেননি, সেটা ওনার ছাত্রছাত্রীদের হোক, এটাই ছিল ওনার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই শীত গ্রীষ্ম-বর্ষা একদিনও কলেজে কামাই করতেন না। অনেকদিন দেখেছি ওনাকে জ্বর গায়ে বা অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের পড়াতে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন চারিদিক এত প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং সেন্টারের রমরমা ছিলনা। তাই বাবা আমাকে মাস্টারমশাইয়ের কাছেই পড়ার ব্যবস্থা করেছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি ওনাদের বাড়িতে পড়তে যেতাম। উনি পড়া বুঝিয়ে দেবার পর প্রতিদিন একটা করে গল্প বলতেন। এক-একদিন এক-একটা নতুন গল্প।