21-06-2021, 09:50 AM
“আমার আর কাপড় নেই সঙ্গে। নাইলে পরব কী?”
“দাঁড়া, আমার একটা থান দিই তোকে।” বলে ঠাকুমা ঘর থেকে ঠাকুমার একটা সাদা কাপড় এনে বুড়িটার কোলে আলগেছে ফেলে দিল ছোঁয়া বাঁচিয়ে। তারপর একটা ভাঙ্গা কাপে করে খানিকটা তেল এনে দিয়ে ঠাকুমা বলল, “যা, এটা মেখে নেয়ে আয়। চুলগুলোর যা অবস্থা করেছিস। আর একদিন ঐ চুল দেখেই হিংসে হত। এত চুল ছিল তোর।”
“কী করব মা। সবই অদেষ্ট। রোজ রোজ তেল পাব কোথায়?”
আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে চান করতে চলে গেলাম। দেখি বুড়িটাও আমার পিছন পিছন এসেছে চান করতে। চান করে উঠে আসার সময় দেখি সব তেলটা মেখে চান করছে। আমি ঘরে চলে এলাম। এরমধ্যেই মা আমার খাবার জন্য জল-আসন করে দিয়েছে। আমি নতুন জামা কাপড় পরে বসে পড়তেই মা নতুন থালায় ভাত, ডাল, ভাজাভুজি, তরকারী সাজিয়ে দিয়ে গেল। বুড়িটাও চলে এসেছে ততক্ষণে। ঠাকুমা একটা প্রদীপ জ্বালল। তারপর শাঁখে জোরদার তিনটে ফুঁ দিল। সেই শব্দে ভয় পেয়ে দুটো কাক কা-কা শব্দে উড়ে গেল। এবার প্রথমে ঠাকুমা তারপর মা ধান আর দূর্বাঘাস দিয়ে আশীর্বাদ করল আমাকে। হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়ল বুড়িটার মুখের দিকে। ওর মুখে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা। হয়ত কিছু বলতে চাইছে, কিন্ত ঠাকুমার ভয়ে বলতে পারছে না। আমি খাওয়া শুরু করলাম। মা এবার ঠাকুমার আর নিজের খাবার বেড়ে নিয়ে এল। অবশেষে বুড়িটার থালা নিয়ে এল। একটা কানাউঁচু অ্যালুমিনিয়ামের থালা, তাতে ভাত আর অন্যান্য তরকারী সাজনো আছে। খাবারগুলো দেখে বুড়িটার চোখেমুখে একট অদ্ভুত ভাব জেগে উঠল। সেটা লোভ হতে পারে অথবা আনন্দ। ঠিক বুঝতে পারলাম না।
সবারই খাওয়া প্রায় শেষের মুখে, এমন সময় ঠাকুমা মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “যাও বউমাকে, হাড়িবউকে পায়েস এনে দাও।” মা খাওয়া শেষ করে রান্নাঘর থেকে বাটি করে খানিকটা পায়েস এনে উঁচু করে বুড়িটার থালায় ঢালতে লাগল। ঘটনাটা ঘটল তখনই। সামান্য হাওয়ায় মায়ের কাপড়ের একট প্রান্ত উড়ে গিয়ে বুড়িটার থালায় ঠেকে গেল। ঘটনাটা ঠাকুমার দৃষ্টি এড়াল না। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “তোমার কি কখনও জ্ঞান হবেন বউমা? ওর এঁটো থালাতে কাপড় ছোঁয়ালে! যাও, আগে নেয়ে এসো, তারপর হেঁশেলে ঢুকবে। আর তোকেই বলি বউ, কি হুঁশ তোর? একটু গা বাঁচিয়ে বসবি তো। যা, খেয়ে উঠে থালাটা ধুয়ে আন। আর জায়গাটা গোবর দিয়ে নিকিয়ে দে।” ঠাকুমার কথা শুনে বুড়িটা কাঁচুমাচু মুখ করে কোনরকমে খাওয়া শেষ করে থালাটা নিয়ে পুকুরঘাটে চলে গেল। মা-ও ঠাকুমার কথা মত চান করতে চলে গেল। আমি হাতমুখ ধুয়ে, ঘরে এলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম বুড়িটা ঘাটে সে কি যেন ভাবছে। তারপর থালাটা ধুয়ে ঘরের দিকে এল। কিছুপরেই ঠাকুমার গলা শুনতে পেলাম। “বেশী করে গোবর দিয়েছিস তো?”
“হ্যাঁ মা।”
“ঠিক আছে। ওখানটা নিকিয়ে নে। আঃ, কি করিস। ঐখানে ভাত পড়ে আছে, এখনও দেখতে পাচ্ছিস নি? ওখানটা আরেকবার নিকিয়ে নে।” আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম বুড়িটা কে? এমন সময় মা ভিজে কাপড়ে ঘরে ঢুকল। মাকে জিজ্ঞাসা করাম, “মা, ঐ বুড়িটা কে?”
“ওমা, তুই ওকে চিনতে পারিসনি! অবশ্য তোরও কোন দোষ নেই। ও যখন শে়ষবার আসে, তখন তুই এতটুকু। ও হচ্ছে তোর ধাই মা। তুই যখন হোস, ও তখন আমার সঙ্গে আঁতুড়ঘরে ছিল। একুশ দিন তোর কোন ঝক্কি নিতে দেয়নি আমায়। সব নিজে হাতে করেছে। তোকে চান করিয়েছে, গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। কি মিষ্টি গানের গলা ছিল ওর। আর তুমিও কিছু কম ছিলেনা। ওকে সারারাত ঘুমোতে দিতে না। সারারাত তোকে কোলে করে ঠায় বসে থাকত।”
মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শুনতে পেলাম মাকে বুড়িটা বলছে, “আমি এবার আসি বউ।”
“এত রোদে যাবে, হাড়িদি?”
“আমাদের আবার রোদ বউ। আসি”
“দাঁড়াও, তোমার চালটা দিয়ে দিই।”
তারপর সব চুপচাপ। ভাবছি বুড়িটা হয়ত চলে গেছে। হঠাৎ খিড়কির দিকের জানালায় নজর পড়তে দেখি, ও আমাকে হাত নেড়ে ইশারায় ডাকছে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি মা রান্নাঘরে কাজ করছে। ঠাকুমা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে। আমি আস্তে আস্তে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি বুড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতে আঁচল থেকে কতকগুলো খুচরো পয়সা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “এই পয়সা ক’টা নাও বাপ। তোমার জন্মদিনে আর কিছু দিতে পারছি নি। অনেক বড় হও। বাপ-ঠাকুদ্দার নাম উজ্জল করো।” আমি স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করব, কি বলব বুঝতে পারছি না। বুড়িটা বলল, “এবার আসি বাপ্। অনেক বেলা হয়ে গেল। ভাল থেকো।” হঠাৎ কি মনে হল জানিনা, আমি ওকে একটা প্রণাম করলাম। বুড়িটা চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতটা আমার মাথা আর মুখে বুলিয়ে দিয়ে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল। আমার চোখের সামনে দিয়ে একটা নুব্জ্যদেহী বুড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। তার কাঁধে একটা ঝোলা। তাতে আছে কিছু ভিক্ষে করা চাল আর গোটা ছয়েক আলু। সে এইভাবে অন্যের বাড়িতে সামান্য ভাতের জন্য অস্পৃশ্যতার অপমান কুড়াবে। আবার পরক্ষণেই তার পরের বাড়িতে যাবে খাবারের সন্ধানে, ভিক্ষের সন্ধানে। এইভাবেই চলতে থাকবে ওর বাদবাকী জীবন। আর এইভাবেই একদিন সে হারিয়ে যাবে সবার বিস্মৃতির অন্তরালে। পনেরোতম জন্মদিনটা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার মনে থাকবে। কারণ এইদিনেই আমি খু্ঁজে পেয়েছি আমার এক পরমাত্মীয়াকে। সে আর কে়উ নয়, আমার আরেক মা। আমার ধাত্রী-মাতা।
সমাপ্ত
বি.দ্র.- এই কাহিনীতে কোন একটি বিশেষ জাতি বা সম্প্রদায়কে ছোট করে দেখানো হয়নি। গল্পের প্রয়োজনে কেবল মাত্র নামোল্লেখ করা হয়েছে। তবুও কারোর মনে এই বিষয়ে ব্যথা লাগলে, আমি সর্বান্তকরণে ক্ষমাপ্রার্থী। -নীললোহিত
“দাঁড়া, আমার একটা থান দিই তোকে।” বলে ঠাকুমা ঘর থেকে ঠাকুমার একটা সাদা কাপড় এনে বুড়িটার কোলে আলগেছে ফেলে দিল ছোঁয়া বাঁচিয়ে। তারপর একটা ভাঙ্গা কাপে করে খানিকটা তেল এনে দিয়ে ঠাকুমা বলল, “যা, এটা মেখে নেয়ে আয়। চুলগুলোর যা অবস্থা করেছিস। আর একদিন ঐ চুল দেখেই হিংসে হত। এত চুল ছিল তোর।”
“কী করব মা। সবই অদেষ্ট। রোজ রোজ তেল পাব কোথায়?”
আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে চান করতে চলে গেলাম। দেখি বুড়িটাও আমার পিছন পিছন এসেছে চান করতে। চান করে উঠে আসার সময় দেখি সব তেলটা মেখে চান করছে। আমি ঘরে চলে এলাম। এরমধ্যেই মা আমার খাবার জন্য জল-আসন করে দিয়েছে। আমি নতুন জামা কাপড় পরে বসে পড়তেই মা নতুন থালায় ভাত, ডাল, ভাজাভুজি, তরকারী সাজিয়ে দিয়ে গেল। বুড়িটাও চলে এসেছে ততক্ষণে। ঠাকুমা একটা প্রদীপ জ্বালল। তারপর শাঁখে জোরদার তিনটে ফুঁ দিল। সেই শব্দে ভয় পেয়ে দুটো কাক কা-কা শব্দে উড়ে গেল। এবার প্রথমে ঠাকুমা তারপর মা ধান আর দূর্বাঘাস দিয়ে আশীর্বাদ করল আমাকে। হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়ল বুড়িটার মুখের দিকে। ওর মুখে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা। হয়ত কিছু বলতে চাইছে, কিন্ত ঠাকুমার ভয়ে বলতে পারছে না। আমি খাওয়া শুরু করলাম। মা এবার ঠাকুমার আর নিজের খাবার বেড়ে নিয়ে এল। অবশেষে বুড়িটার থালা নিয়ে এল। একটা কানাউঁচু অ্যালুমিনিয়ামের থালা, তাতে ভাত আর অন্যান্য তরকারী সাজনো আছে। খাবারগুলো দেখে বুড়িটার চোখেমুখে একট অদ্ভুত ভাব জেগে উঠল। সেটা লোভ হতে পারে অথবা আনন্দ। ঠিক বুঝতে পারলাম না।
সবারই খাওয়া প্রায় শেষের মুখে, এমন সময় ঠাকুমা মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “যাও বউমাকে, হাড়িবউকে পায়েস এনে দাও।” মা খাওয়া শেষ করে রান্নাঘর থেকে বাটি করে খানিকটা পায়েস এনে উঁচু করে বুড়িটার থালায় ঢালতে লাগল। ঘটনাটা ঘটল তখনই। সামান্য হাওয়ায় মায়ের কাপড়ের একট প্রান্ত উড়ে গিয়ে বুড়িটার থালায় ঠেকে গেল। ঘটনাটা ঠাকুমার দৃষ্টি এড়াল না। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “তোমার কি কখনও জ্ঞান হবেন বউমা? ওর এঁটো থালাতে কাপড় ছোঁয়ালে! যাও, আগে নেয়ে এসো, তারপর হেঁশেলে ঢুকবে। আর তোকেই বলি বউ, কি হুঁশ তোর? একটু গা বাঁচিয়ে বসবি তো। যা, খেয়ে উঠে থালাটা ধুয়ে আন। আর জায়গাটা গোবর দিয়ে নিকিয়ে দে।” ঠাকুমার কথা শুনে বুড়িটা কাঁচুমাচু মুখ করে কোনরকমে খাওয়া শেষ করে থালাটা নিয়ে পুকুরঘাটে চলে গেল। মা-ও ঠাকুমার কথা মত চান করতে চলে গেল। আমি হাতমুখ ধুয়ে, ঘরে এলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম বুড়িটা ঘাটে সে কি যেন ভাবছে। তারপর থালাটা ধুয়ে ঘরের দিকে এল। কিছুপরেই ঠাকুমার গলা শুনতে পেলাম। “বেশী করে গোবর দিয়েছিস তো?”
“হ্যাঁ মা।”
“ঠিক আছে। ওখানটা নিকিয়ে নে। আঃ, কি করিস। ঐখানে ভাত পড়ে আছে, এখনও দেখতে পাচ্ছিস নি? ওখানটা আরেকবার নিকিয়ে নে।” আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম বুড়িটা কে? এমন সময় মা ভিজে কাপড়ে ঘরে ঢুকল। মাকে জিজ্ঞাসা করাম, “মা, ঐ বুড়িটা কে?”
“ওমা, তুই ওকে চিনতে পারিসনি! অবশ্য তোরও কোন দোষ নেই। ও যখন শে়ষবার আসে, তখন তুই এতটুকু। ও হচ্ছে তোর ধাই মা। তুই যখন হোস, ও তখন আমার সঙ্গে আঁতুড়ঘরে ছিল। একুশ দিন তোর কোন ঝক্কি নিতে দেয়নি আমায়। সব নিজে হাতে করেছে। তোকে চান করিয়েছে, গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। কি মিষ্টি গানের গলা ছিল ওর। আর তুমিও কিছু কম ছিলেনা। ওকে সারারাত ঘুমোতে দিতে না। সারারাত তোকে কোলে করে ঠায় বসে থাকত।”
মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শুনতে পেলাম মাকে বুড়িটা বলছে, “আমি এবার আসি বউ।”
“এত রোদে যাবে, হাড়িদি?”
“আমাদের আবার রোদ বউ। আসি”
“দাঁড়াও, তোমার চালটা দিয়ে দিই।”
তারপর সব চুপচাপ। ভাবছি বুড়িটা হয়ত চলে গেছে। হঠাৎ খিড়কির দিকের জানালায় নজর পড়তে দেখি, ও আমাকে হাত নেড়ে ইশারায় ডাকছে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি মা রান্নাঘরে কাজ করছে। ঠাকুমা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে। আমি আস্তে আস্তে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি বুড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতে আঁচল থেকে কতকগুলো খুচরো পয়সা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “এই পয়সা ক’টা নাও বাপ। তোমার জন্মদিনে আর কিছু দিতে পারছি নি। অনেক বড় হও। বাপ-ঠাকুদ্দার নাম উজ্জল করো।” আমি স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করব, কি বলব বুঝতে পারছি না। বুড়িটা বলল, “এবার আসি বাপ্। অনেক বেলা হয়ে গেল। ভাল থেকো।” হঠাৎ কি মনে হল জানিনা, আমি ওকে একটা প্রণাম করলাম। বুড়িটা চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতটা আমার মাথা আর মুখে বুলিয়ে দিয়ে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল। আমার চোখের সামনে দিয়ে একটা নুব্জ্যদেহী বুড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। তার কাঁধে একটা ঝোলা। তাতে আছে কিছু ভিক্ষে করা চাল আর গোটা ছয়েক আলু। সে এইভাবে অন্যের বাড়িতে সামান্য ভাতের জন্য অস্পৃশ্যতার অপমান কুড়াবে। আবার পরক্ষণেই তার পরের বাড়িতে যাবে খাবারের সন্ধানে, ভিক্ষের সন্ধানে। এইভাবেই চলতে থাকবে ওর বাদবাকী জীবন। আর এইভাবেই একদিন সে হারিয়ে যাবে সবার বিস্মৃতির অন্তরালে। পনেরোতম জন্মদিনটা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার মনে থাকবে। কারণ এইদিনেই আমি খু্ঁজে পেয়েছি আমার এক পরমাত্মীয়াকে। সে আর কে়উ নয়, আমার আরেক মা। আমার ধাত্রী-মাতা।
সমাপ্ত
বি.দ্র.- এই কাহিনীতে কোন একটি বিশেষ জাতি বা সম্প্রদায়কে ছোট করে দেখানো হয়নি। গল্পের প্রয়োজনে কেবল মাত্র নামোল্লেখ করা হয়েছে। তবুও কারোর মনে এই বিষয়ে ব্যথা লাগলে, আমি সর্বান্তকরণে ক্ষমাপ্রার্থী। -নীললোহিত