21-06-2021, 09:46 AM
এতক্ষণে সব মুড়িগুলো খেয়ে নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে টিপে আঁচলাভরে জল খেল বুড়ীটা। তারপর আবার এসে বসল দুয়ারের এককোণে। এমন সময় ঠাকুমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বুড়িটাকে বলল, “হাড়িবউ চলে যাসনি যেন। আজ সোনার জন্মদিন। দুপুরে ভাত খেয়ে যাস।” বুড়িটা আনন্দে ঘাড় নেড়ে আনন্দিত গলায় বলল, “ ওমা, তাই নাকি! আমার শ্বশুরখেকোর জন্মদিন! আজ অনেকদিন পর পেটপুরে খাব মা।” তারপর বলল, “তোমাকে আশীব্বাদ করি, বাপধন আমার। শতায়ু হও। মাথার যত চুল আছে, তত তোমার আয়ু হোক।” বলে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আমার মাথাটা ছোঁয়ার চেষ্টা করল। এমন সময় ঠাকুমা চেঁচিয়ে বলল, “ও কী করছিস বউ! সোনাকে ছুঁবি যে!” সঙ্গে সঙ্গে বজ্রাহতের মত হাতটা সরিয়ে নিল বুড়িটা। “সরে বোস্ বাপু। ছুঁয়ে একসা করিসনি যেন।” বলে ঠাকুমা রান্নাঘরে ঢুকে গেল। হঠাৎ বিড়বিড় করতে শুরু করল সে, “এত্তটুকু ছিলে বাপ তুমি। তোমার মা তোমাকে নিতে পারত নি। আমিই তোমাকে নাইয়েছি, গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। তোমার জন্য কতদিন রাত্তিরে ঘুমোতে পারিনি। ঠায় কোলে করে নিয়ে বসে থাকতুম।” আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম বুড়িটা কে? আমাকে স্নান করিয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে বলছে, অথচ এর আগে কখনও ওকে দেখিনি। বুড়িটা হঠাৎই বিড়বিড়ানি থামিয়ে দিয়ে ঝিমোতে লাগল। ঘাড়টা ঝুঁকে পড়েছে বুকের কাছে। বেঁকা পিঠটা দুয়ারের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ঝিমোতে লেগেছে। নিঃশ্বাসের তালে তালে বুকটা ক্রমাগত ওঠানামা করছে। এইটুকুই যেন ওর বেঁচে থাকার সাক্ষ্য দিচ্ছে। পাশে রাখা ময়লা ঝোলাটার ভিতর উঁকি মেরে দেখলাম। খানিকটা চাল আর গোটা ছয়েক আলু রয়েছে তাতে। এই হল ওর আজকের উপার্জন। হয়তো রাতে এগুলোই ফুটিয়ে খাবে। তারপর কাল সকাল থেকে আবার বের হবে উপার্জনের সন্ধানে।
এদিকে বেলা বাড়ছে। জৈষ্ঠ্যের দুপুরের গরমের তাত লাগছে গায়ে। আমি উঠে পড়লাম। বাবলু আজকে সকালে ওদের বাড়ি যেতে বলেছিল। কিন্তু এই রোদে আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছা করছে না। রোদ কমলে ওবেলা যাব ভেবে ঘরে এলাম। এই ঘরের জানালা দিয়ে খিড়কি পুকুরের খানিকটা দেখা যায়। এই পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা পায়ে চলা মাটির রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে গেলে একে একে বামুনপাড়া, কায়েতপাড়া, তেলীপাড়া, কলুপাড়া, বাগদীপাড়া, আর গ্রামের একদম শেষপ্রান্তে মুচিপাড়া আর হাড়িপাড়া। তারপর ধূ ধূ মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে একটা পুকুর। সেই পুকুরের দু’পাশে দুটো শ্মশান। এই দুটো শ্মশানেই আমাদের গ্রামের প্রত্যেক বাড়িরই মৃতদেহ দাহ করা হয়। একটা জিনিস ভেবে আমার খুব আশ্চর্য লাগে, এই জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, শুচিবায়ুগ্রস্থতা মৃত্যুর পরেও সমান ভাবে বহাল আছে। আমি বামুন, তুই দুলে। তুই অস্পৃশ্য। তোকে ছুঁলে আমার জাত যাবে। মৃত্যুর পর শিবনারায়ণ মুখার্জীকে দাহ করা হয় পুবপাড়ের শ্মশানে আর হারু ঘড়ুইকে দাহ করা হয় পশ্চিমপাড়ের শ্মশানে। মৃত্যুর পরেও জাতের ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা সমান তালে রয়ে যায় * ধর্মের অভ্যন্তরে। এমন সময় কাকের চিৎকারে ঘোর কাটল। কাকটা আমাদের উঠোনেই ডাকছে। বেলা বেড়েছে অনেক। রোদের তাতও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ঘরের ভিতর বসেও সেই তাত ভালমতই টের পাওয়া যাচ্ছে। এমন সময় মা ঘরে ঢুকে বলল, “একিরে, তুই এখনও বসে আছিস! যা চান করে আয়, রান্না হয়ে গেছে।” মা চলে যেতেই আমি গামছা নিয়ে স্নান করতে বের হলাম। দেখি ঠাকুমা বুড়িটাকে বলছে, “যারে বউ, নেয়ে আয় পুকুর থেকে। তারপরে খেতে দেব।”
এদিকে বেলা বাড়ছে। জৈষ্ঠ্যের দুপুরের গরমের তাত লাগছে গায়ে। আমি উঠে পড়লাম। বাবলু আজকে সকালে ওদের বাড়ি যেতে বলেছিল। কিন্তু এই রোদে আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছা করছে না। রোদ কমলে ওবেলা যাব ভেবে ঘরে এলাম। এই ঘরের জানালা দিয়ে খিড়কি পুকুরের খানিকটা দেখা যায়। এই পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা পায়ে চলা মাটির রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে গেলে একে একে বামুনপাড়া, কায়েতপাড়া, তেলীপাড়া, কলুপাড়া, বাগদীপাড়া, আর গ্রামের একদম শেষপ্রান্তে মুচিপাড়া আর হাড়িপাড়া। তারপর ধূ ধূ মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে একটা পুকুর। সেই পুকুরের দু’পাশে দুটো শ্মশান। এই দুটো শ্মশানেই আমাদের গ্রামের প্রত্যেক বাড়িরই মৃতদেহ দাহ করা হয়। একটা জিনিস ভেবে আমার খুব আশ্চর্য লাগে, এই জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, শুচিবায়ুগ্রস্থতা মৃত্যুর পরেও সমান ভাবে বহাল আছে। আমি বামুন, তুই দুলে। তুই অস্পৃশ্য। তোকে ছুঁলে আমার জাত যাবে। মৃত্যুর পর শিবনারায়ণ মুখার্জীকে দাহ করা হয় পুবপাড়ের শ্মশানে আর হারু ঘড়ুইকে দাহ করা হয় পশ্চিমপাড়ের শ্মশানে। মৃত্যুর পরেও জাতের ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা সমান তালে রয়ে যায় * ধর্মের অভ্যন্তরে। এমন সময় কাকের চিৎকারে ঘোর কাটল। কাকটা আমাদের উঠোনেই ডাকছে। বেলা বেড়েছে অনেক। রোদের তাতও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ঘরের ভিতর বসেও সেই তাত ভালমতই টের পাওয়া যাচ্ছে। এমন সময় মা ঘরে ঢুকে বলল, “একিরে, তুই এখনও বসে আছিস! যা চান করে আয়, রান্না হয়ে গেছে।” মা চলে যেতেই আমি গামছা নিয়ে স্নান করতে বের হলাম। দেখি ঠাকুমা বুড়িটাকে বলছে, “যারে বউ, নেয়ে আয় পুকুর থেকে। তারপরে খেতে দেব।”