18-06-2021, 03:03 PM
(This post was last modified: 06-03-2023, 08:41 AM by Bumba_1. Edited 22 times in total. Edited 22 times in total.)
হাল ছেড়ো না বন্ধু
কণ্ঠ ছাড়ো জোরে
লেখা :- বুম্বা
প্রচ্ছদ :- ব্যক্তিগত পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
আমার জীবনের প্রথম স্টেজ পারফরম্যান্স। তখন আমার নয় বছর বয়স। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল চন্দননগর নৃত্যগোপাল স্মৃতিমন্দিরে (যেখানে পরবর্তীকালে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের জাতিস্মরের কিছু অংশের শুটিং হয়েছিল)।
ছোটবেলাতে যে আমার গানবাজনার খুব আগ্রহ ছিল তা নয়। একপ্রকার জোর করেই আট বছর বয়সে আমাকে গানের দিদিমণির কাছে ভর্তি করে দেয় আমার মা। অশ্রুকণা পাল সেই সময়ের খুব নাম করা একজন উচ্চাঙ্গসংগীতের বেতার-শিল্পী .. তিনিই আমার প্রথম সঙ্গীতের গুরু।
গানের গলা যে আমার সেইসময় একেবারে মধুমাখা ছিলো তা হয়তো নয়, তবে দিদিমণি এবং সেই সময়কার সমসাময়িক কিছু মানুষ বলতেন আমার "তাল সেন্স" নাকি খুব ভালো। তার মানে হলো তবলার ঠেকা শুনে আমি যখন খুশী গান ধরতে পারতাম।
দিদিমণির কাছে যারা গান শিখতো তাদের কাছে সেটা দুর্বোধ্য ব্যাপার ছিল। তাই কিছুদিনের মধ্যেই অনেকেরই চক্ষুশূল হয়ে উঠলাম আমি। বিশেষত মৃত্তিকা নামের একজন মেয়ের কাছে তো বটেই, সে কথাই বলবো আজ তোমাদের।
তবে দিদিমণি আমাকে খুবই ভালোবাসতেন (এখনও বাসেন)। যাইহোক এবার অনুষ্ঠানের দিনের কথায় আসি..
দিনটি ছিল ১৮ই নভেম্বর .. প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী নলিনীকান্ত বাগচীর জন্মদিন। উনি দিদিমণির গুরু ছিলেন তো বটেই, সেই সঙ্গে চন্দননগরের সংগীত জগৎ এর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। উনার সম্মানার্থেই সেদিনের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল।
সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন আরো কয়েকজন গুনি মানুষ। তনিমা ঠাকুর, কুমার রায়, বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত (এদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই, এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সেরা) ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কিছু নমস্য ব্যক্তি। এক কথায় সেদিন ওখানে চাঁদের হাট বসেছিল।
দিদিমণির এতটাই প্রিয় ছাত্র ছিলাম, উনি বলেছিলেন "উদ্বোধনি সংগীত তুই গাইবি।" যেহেতু সন্ধ্যেবেলার অনুষ্ঠান তাই ত্রিতালের উপর ইমনরাগের একটা খেয়াল ঠিক করে দিয়েছিলেন আমার জন্য। আমিও খুব খুশী, এতো গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসছেন তাদের সামনে গান গাওয়ার একটা সুযোগ পাবো এটা ভেবে।
বিকেল পাঁচ'টা তে পৌছনোর কথা ছিল আমার। আমার তাড়নার চোটে বিকেল চার'টে তেই মা আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
গ্রিনরুমে এ বসে অপেক্ষা করছি কখন শুরু হবে অনুষ্ঠান, কখন ডাকবে আমাকে। সন্ধ্যে ছ'টা তে অনুষ্ঠান শুরু হলো, কিন্তু কই আমাকে তো ডাকলো না। মা দৌড়ে গেল দিদিমণির কাছে, জানতে চাইলো 'কি হলো'.. দিদিমণি বললেন, "এই তো পরের বারে বুম্বাকেই বসানো হবে" ..
কিন্তু পরের বারেও যে সুযোগ এলো না .. একটার পর একটা গান হয়ে যাচ্ছে আমার ডাক আর আসছে না। রাত আট'টা বেজে গিয়েছে তখনো কোনো খবর নেই। মা আবার গেলেন দিদিমণির কাছে, থমথমে মুখে দিদিমণি যা বললেন তার মানে এই আজ আর আমার গান গাওয়া হবে না। মৃত্তিকা যে আমাকে সবথেকে বেশি ঘেন্না করতো দিদিমণির ক্লাসে, তার বাবা ওখানকার তৎকালীন রুলিং পার্টির লোকাল কাউন্সিলর ছিলেন আর সেই নাকি পুরো অনুষ্ঠানটি স্পন্সর করছে। তাই তিনি আর তার মেয়ে চায় না আমি গান গাই।
পাবলিক প্লেসে মা'কে সেদিন প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম। সাড়ে আট'টা বেজে গেলো। অনুষ্ঠান ন'টায় শেষ হবে। আমি সেই যে দুপুরবেলা ভাত খেয়েছিলাম তারপর থেকে কিছুই আর খাইনি। ক্ষিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে। শরীর আর বইছে না, সারাদিনের উৎসাহ, সারাদিনের পরিকল্পনা.. সব শেষ।
মা বললো "চল আমরা চলে যাই, অপেক্ষা করার আর কোনো মানেই হয়ে না।"
আমরা বেরিয়ে যাওয়ার মুখে দিদিমণি হঠাৎ এসে মা'র হাত টা চেপে ধরে বললেন "বৌদি, মৃত্তিকার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে, উনি বুম্বাকে গাইতে দিতে রাজি হয়েছেন, তবে সময় মাত্র পনেরো মিনিট পাবে"।
মা বললো "আজ আর ও গাইতে পারবে না, সেই দুপুরের পর থেকে কিছুই খায়নি ছেলেটা, তার উপর এতক্ষণ অপেক্ষা করে সব এনার্জি শেষ। আমরা এখন যাব।"
দিদিমণি বললেন "ওকে গাইতে দিন বৌদি, আজ না গাইলে কোনোদিন পারবে না, ওকে বুঝতে দিন বাস্তবটা বড়ই কঠিন, সব কিছু লড়াই করেই পেতে হয়, কি রে বুম্বা পারবি না? সবাইকে দেখিয়ে দিতে হবে তো তুই আমার সেরা ছাত্র, কিরে পারবি তো বল!"
আমি কি বুঝলাম জানি না, "হ্যাঁ পারবো" বলে দিলাম।
পৌনে ন'টায় আমার গান শুরু হল। হাতে মাত্র পনেরো মিনিট সময়। আলাপ শুরু করলাম, পাঁচ মিনিট করার পর থেমে গেলাম, কারণ পনেরো মিনিটে পুরো গান'টা তো শেষ করতে হবে। দর্শক আসন থেকে নলিনীবাবু হাত নাড়িয়ে নির্দেশ দিলেন আলাপটা চালিয়ে যেতে, আলাপ যখন শেষ হলো ঘড়িতে দেখলাম কুড়ি মিনিট হয়ে গিয়েছে। এরপর আরোহণ-অবরোহণ, তারপর প্রধান রাগ, সব শেষে তান-সারগাম। আমার গান যখন শেষ হলো ঘড়িতে সাড়ে ন'টা বেজে গিয়েছে।
হাততালি তে ফেটে পড়লো গোটা হল। স্টেজের একপাশে দেখলাম মা আর দিদিমণি দাঁড়িয়ে আছেন, দুজনের চোখেই জল। আর একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন মৃত্তিকার বাবা, পাংশুটে মুখে কি যেন বিড়বিড় করছেন।
অনুষ্ঠান শেষে নলিনীবাবু আমাকে গ্রিনরুমে ডেকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। শ্রদ্ধেয়া তনিমা ঠাকুর আমাকে একটা কলম উপহার দিয়েছিলেন। সেটা এখনও যত্ন করে রাখা আছে আমার কাছে।
জীবনে অনেক খারাপ সময় আসবে, সেটাকে আঁকড়ে না থেকে, জীবনে যা কিছু ভালো .. সেটাকে পাথেয় করে চলতে পারলে তবেই সাফল্য আসবে।