16-06-2021, 08:17 PM
কবির স্নিগ্ধাকে নিয়ে হোটেলের বাগান ধরে ছুটতে থাকে, মেইন গেইটের দিকে না গিয়ে ওরা স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে এগোয়। স্টাফ কোয়ার্টারের পেছন দিকে একটা গেইট রয়েছে, যাতে কোন গার্ড থাকে না। কবির ও স্নিগ্ধা সেই গেইট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। গেইটের ওপাশে সমুদ্র সৈকত, ওরা সৈকত বরাবর হাঁটতে থাকে। আরো কিছুদুর পর একটি ঝাউবন দেখতে পায়, দুপুরের এই সময় যা একেবারেই নির্জন, ওরা সেদিকেই যায়।
"তুই এখান থেকে চলে যা, দুরে কোথাও চলে যা, আমি সব সামলে নেব।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তোকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারি না।" কবির বলে।
"আমাকে ছেড়ে চলে যাসনি তুই? বেঁচে আছি না মরে গেছি কখনো খোঁজ নিয়েছিস? আমি তো তোকে কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু আম্মু তো তোকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসে, কখনো তার খোঁজ নিয়েছিস?" অভিমানের সুরে বলে স্নিগ্ধা।
"আমি মানছি যে আমি অপরাধ করেছি। তার যা শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নেব, কিন্তু এভাবে তোকে ছেড়ে যেতে পারবনা আমি।" কবির বলে।
"তুই বুঝতে পারছিস না কবির, ওরা কতো ভয়ংকর। ওরা তোকে খুঁজে পেলে মেরে ফেলবে।" স্নিগ্ধা বলে।
"এইতো, এই মুহুর্তটির জন্য আমি বেঁচে আছি। তোকে আরেকটিবার দেখব, তোর চেখে চোখ রেখে তোর নিশ্বাসের সুবাস নিব মন ভরে।" বলতে বলতে স্নিগ্ধাকে একটি গাছের সাথে চেপে ধরে কবির, চোখে চোখ রেখে প্রাণ ভরে ওর নিশ্বাসের ঘ্রাণ নেয়। স্নিগ্ধার মিষ্টি মুখটিকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে খুব ইচ্ছে করে ওর, কিন্তু নিজেকে সংবরন করে কবির, ওকে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে দিয়ে সরে যেতে চায় কবির কিন্তু স্নিগ্ধা ওকে জড়িয়ে ধরে।
"তোকে হারানোর পর বুঝেছি তোকে কতোটা ভালবাসি আমি। আমি তোকে আবার হারাতে চাই না। ওরা তোকে খুঁজে পেলে মেরে ফেলবে। ওরা কতো ভয়ংকর তুই জানিস না। প্লিজ তুই কোথাও পালিয়ে যা।" কবিরকে জড়িয়ে ধরে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে তুই ও চল আমার সাথে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা আর।"
"সে হয় না কবির।"
"কেন হয় না?"
স্নিগ্ধা তার কোন উত্তর দিতে পারে না। কবির ওর হাতটি বাড়িয়ে দেয়। স্নিগ্ধা ওর হাতে হাতটি রাখে।
ছোট মিনিবাস, তাতে গাদাগাদি লোক, যেন একটি সুঁই রাখারও যায়গা নেই। বাসটি আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলছে। স্নিগ্ধা জানালার পাশে একটি সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পাশের সিটে কবির, মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কবিরের কাছে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঘুম ভেঙে যাবে আর উঠে দেখবে কোন অচেনা বাস স্টপের বেঞ্চে শুয়ে আছে সে একাকি।
"আমরা কোথায় যাচ্ছি?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে। এই প্রথমবার স্নিগ্ধা কিছু বলল।
"সেটা একটা সারপ্রাইজ, খুব সুন্দর যায়গা, তোর খুব পছন্দ হবে।"
"তুই যা, কিছুদিন লুকিয়ে থাক। আমি সামনে স্টপেজে নেমে যাই।" স্নিগ্ধা বলে।
কবির কিছু বলে না। ওর মুখে হতাশার ছাপ পড়ে।
কয়েক মিনিট পরই একটি বাস স্টপেজে বাস থেমে যায়। স্নিগ্ধার সাথে কবিরও নেমে যায়।
"তুই নেমে গেলি কেন?" কবিরকে জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
"চল, তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোকে আমি এভাবে একা ছাড়তে পারি না।"
"তুই কেন বুঝতে পারছিস না ওরা তোকে মেরে ফেলবে।"
"মেরে ফেলুক আমাকে, তবু এভাবে তোকে একা ছাড়তে পারব না।"
স্নিগ্ধা কবিরের হাতটি ধরে টেনে আনে যাত্রী ছাউনির দিকে, কবিরকে বেঞ্চে বসতে দিয়ে নিজে ওর পাশে বসে।
"আমি জানি তোর মনে অনেক প্রশ্ন জমা রয়েছে, সব প্রশ্নের উত্তর পাবি। তুই কি জানতে চাস হোটেলে ঐ লোকটার সাথে কেন আমি? তবে শোন, আমার স্বামী আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে ঐ লোকটার কাছে।" বলতে বলতে গলা ধরে আসে স্নিগ্ধার।
"কি বলছিস তুই!"
"আমি মজা করছি না। সজলকে আমি চিনতে পারিনি কবির, ও কোন মানুষ নয়, পশু একটা। আমি ওকে চিনতে পেরেছি তিন মাস আগে। ও আমাকে মিথ্যা বলে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল ওর বসের বিছানায় যেতে, ওর প্রমোশনের জন্য। যখন ওর আসল রুপটা আমার সামনে আসে আমি চেয়েছিলাম ওর থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু মুক্তি আমার মেলেনি।"
"সেদিন আমি রওনা দিয়েছিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে, বাসায় পৌঁছে শুনলাম আব্বু ফেরেনি অফিস থেকে। মাঝরাতে ফোন পেলাম সজলের। ও বলে যে ওর ভাড়াটে গুন্ডারা আব্বুকে কিডনাপ করেছে। আমি যদি ওর কথা মতো না চলি তাহলে ও আব্বুকে খুন করবে। আমি ওর শর্তে রাজি হয়ে যাই। পরের দিন সকালে আব্বুর খোঁজ পাওয়া যায়, মেডিকেল হসপিটালে তিনি। রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় অফিসের সামনে কয়েকজন যুবক ঘিরে ধরে তাকে, তাদের একজন উনার মুখে রুমাল চেপে ধরে অজ্ঞান করে ফেলে।"
"পুলিশকে জানাসনি বিষয়টা?" কবির জিজ্ঞাসা করে।
"লাভ ছিল না। ও কাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে আমি জানি। ওর এক বন্ধু স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতা। নাম শুনেছিস হয়তো, লিটু জাকের। ওর নামে এমনিতেই চার পাঁচটা চাঁদাবাজি আর খুনের মামলা ঝুলে আছে। একটা কিডন্যাপিংয়ের মামলা যোগ হলেও তাতে ওর কিছু হতো না। আর আসলে আমি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি ওর কথা মতো ফিরে গিয়েছিলাম ওর কাছে, আম্মু আব্বুকে কিচ্ছু জানাইনি। আব্বু আম্মু হয়তো এখনো মনে করে আমি সুখেই আছি।"
"তারপর।"
"ওর বসের আর সাহস হয়নি আমাকে ছোঁয়ার। তবে সজল যা চেয়েছিল তা ওর বস বদরুল ভুঁইয়া করেছিল, সাইমন রহমানের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সাইমন রহমানের বাবা জিল্লুর রহমান কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। কিভাবে কিভাবে যেন সজল সাইমনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। সাইমনের মাধ্যমে সজল প্রোমশনটাও পেয়ে যায়। তবে সজল শুধু সেই প্রমোশনটা পেয়ে খুশি থাকেনি। ওর লোভের কোন সীমা পরিসীমা নেই। ও শুরু থেকেই সাইমনের সামনে আমাকে সেজেগুজে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে নিজেকে পরিবেশন করতে বাধ্য করে। ঐ লম্পট লোকটিও যখন তখন চলে আসত বাড়িতে, আমি যতোটা সম্ভব নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমি পারিনি। একদিন ঐ লোকটা বাসায় একলা পেয়ে..." বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। কবির ওকে জড়িয়ে নেয় বাহুডোরে, "আমি বুঝে গেছি, আর কিছু বলতে হবে না তোকে।"
"না কবির, আমাকে সবটা বলতে দে। ;., আমার জন্য কোন নতুন বিষয় নয়। সজলের আসল রুপ প্রকাশিত হবার পর ওর সাথে শুতে আমার ঘৃণা হত। ওর সাথে শুতে না চাওয়াতে ও রোজ আমাকে মারধোর করতো, জোরপুর্বক ;., করতো। কিন্তু সেদিনের ঐ ঘটনার পর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ঝুলে পড়তে পারিনি, আমার মনে জ্বলতে থাকা ঘৃণার আগুন আমাকে মরতে দেয়নি। যতক্ষন পর্যন্ত পশুটাকে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করতে না দেখব, আমি মরেও শান্তি পাব না। সাইমনের প্রতি আমার রাগ নেই, এ সবই সজলের চাল।
ঐ ঘটনাটির পর সজল কৃত্রিম রাগের অভিনয় শুরু করল। সাইমন তার বন্ধুর মান ভাঙানোর জন্য আরেকটি প্রস্তাব দেয়। রোয়ান রিয়েল এস্টেট থেকে রোয়ান কন্স্ট্রাকশন নামক একটি পৃথক কোম্পানি খোলার কথা হচ্ছে, সজলকে সেই কোম্পানির চিফ অব এক্সিকিউটিভ করার প্রতিশ্রুতি দেয় সে। সাথে আবদার করে আমাকে নিয়ে সাত দিনের জন্য কক্সেসবাজার ট্যুরে আসতে চায় সে। সজল রাজি হয়ে যায়। আমি পরিকল্পনায় ছিলাম সাইমনকে হাতে রেখে সজলের উপর প্রতিশোধ তুলব। কিন্তু এর মাঝে তুই চলে এলি।"
"তুই যে আগুন নিয়ে খেলতে চাইছিস তাতে তুই নিজেও পুড়ে যাবি।" কবির বলে।
"জানি আমি, কিন্তু উপায় নেই কোন।"
"তোকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকতে যে খুব সাধ জাগে এই বুকে। আর পাঁচটা সাধারন মানুষের মতো, যেখানে কোন ঘৃণার আগুন নেই, প্রতিশোধের আগুন নেই, শুধু ভালবাসা।"
"সেটা সম্ভব নয় কবির। ওরা আমাদেরকে বাঁচতে দিবে না।"
"সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। তুই আর আমি মিলে কোন উপায় বের করে নেব।" কবির বলে।
"আব্বু আম্মুর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে আমার, সজল যদি কোন ক্ষতি করে।"
"আমি তোর কাছে থেকে শুনে যেটুকু বুঝলাম তাতে সজল যা কিছু করে ভেবে চিন্তে করে। যতোক্ষন না ও তোর সাথে যোগাযোগ করতে না পারছে ততোক্ষন আংকেল আন্টির কোন ক্ষতি করবে না। যখন তোর সাথে যোগাযোগ করবে তখন তোকে ব্ল্যাকমেইল করবে।
আমাদেরকে কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হবে। এরমধ্যে কোন উপায় খুঁজে বের করবই আমরা।"
কবির বিছানায় শুয়ে জানালার দিকে কাত হয়ে ছিল, জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে। স্নিগ্ধা একই বিছানায় অন্যপাশ হয়ে শুয়েছিল। ওরা ভীষন ক্লান্ত, পাহাড়ি রাস্তায় চার পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে এসেছে। সন্ধ্যার সময় পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা সহজ কাজ নয়, খুব সাবধানে চলতে হয়েছে ওদের।
স্নিগ্ধা অন্য পাশ হয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। হঠাত কিছু একটার হাঁটা চলার শব্দ পায় সে।
"কবির, ঘুমিয়েছিস তুই?" স্নিগ্ধা অন্যপাশ হয়ে বলে।
"নাহ, এখনো ঘুমাইনি। কেন কি হয়েছে?" ওপাশ হয়েই বলে কবির।
"ঘরে কিছু একটা আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"ইঁদুর হবে হয়তো। পাহাড়ি ইঁদুর, বেশ বড়সড় হয়। তবে চিন্তা করিস না, বিছানায় ওঠার সাহস পাবে না।" কবির বলে।
স্নিগ্ধা এগিয়ে আসে কবিরের দিকে, পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ওকে।
"আমার কথা তো সবই শুনলি, তোর সম্পর্কে বল, কোথায় ছিলি এতোদিন?"
"আজ না, অন্য কোন দিন বলব। তুই খুব ক্লান্ত, ঘুমানোর চেষ্টা কর।" স্নিগ্ধার দিকে পাশ ফিরে বলে কবির।
কিছুক্ষন নিরবতায় কেটে যায়।
"কি অতো ভাবছিস, কবির?" স্নিগ্ধা আবারও বলে।
"ওরা এই মুহুর্তে কি করছে, কি ভাবছে সেটাই ভাবছি।" ভাবুক কন্ঠে জবাব দেয় কবির।
"কি করছে ওরা?"
"ওরা আমাদেরকে খোঁজার চেষ্টা করছে। হয়তো পুলিশে জানিয়েছে, কিডন্যাপিং কেস হিসাবেই হয়তো দেখছে তারা।" কবির বলে।
"কিডন্যাপ!" অবাক হয়ে বলে স্নিগ্ধা।
"তোর কিডন্যাপ।" কবির বলে।
"যদি আমরা পুলিশকে সবকিছু খুলে বলে দেই?" স্নিগ্ধা বলে।
"ভাল আইডিয়া। কিন্তু তোর কি মনে হয় পুলিশকে সবকিছু বলে দেয়ার পর ওদের কি ক্ষমতা নেই সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার?" কবির বলে।
"তা তো আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"আর তাছাড়া আমরা তো নিশ্চিত নই যে ওরা পুলিশকে জানিয়েছে নাকি অন্য কোনভাবে আমাদের খোঁজ করছে।"
"আমার মনে হয় আমাদের কোন নিস্তার নেই। যে কটা দিন তোর সাথে আছি আমি মন প্রান ভরে উপভোগ করতে চাই। "বলে স্নিগ্ধা কবিরকে আরো ভালভাবে বাহুডোরে জড়িয়ে নেয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। বাহুডোরে স্নিগ্ধার উষ্ণ নরম দেহটি কবিরের দেহেও উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে থাকে। কবির নিজেকে কন্ট্রোল করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।
"তুই এখান থেকে চলে যা, দুরে কোথাও চলে যা, আমি সব সামলে নেব।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তোকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারি না।" কবির বলে।
"আমাকে ছেড়ে চলে যাসনি তুই? বেঁচে আছি না মরে গেছি কখনো খোঁজ নিয়েছিস? আমি তো তোকে কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু আম্মু তো তোকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসে, কখনো তার খোঁজ নিয়েছিস?" অভিমানের সুরে বলে স্নিগ্ধা।
"আমি মানছি যে আমি অপরাধ করেছি। তার যা শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নেব, কিন্তু এভাবে তোকে ছেড়ে যেতে পারবনা আমি।" কবির বলে।
"তুই বুঝতে পারছিস না কবির, ওরা কতো ভয়ংকর। ওরা তোকে খুঁজে পেলে মেরে ফেলবে।" স্নিগ্ধা বলে।
"এইতো, এই মুহুর্তটির জন্য আমি বেঁচে আছি। তোকে আরেকটিবার দেখব, তোর চেখে চোখ রেখে তোর নিশ্বাসের সুবাস নিব মন ভরে।" বলতে বলতে স্নিগ্ধাকে একটি গাছের সাথে চেপে ধরে কবির, চোখে চোখ রেখে প্রাণ ভরে ওর নিশ্বাসের ঘ্রাণ নেয়। স্নিগ্ধার মিষ্টি মুখটিকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে খুব ইচ্ছে করে ওর, কিন্তু নিজেকে সংবরন করে কবির, ওকে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে দিয়ে সরে যেতে চায় কবির কিন্তু স্নিগ্ধা ওকে জড়িয়ে ধরে।
"তোকে হারানোর পর বুঝেছি তোকে কতোটা ভালবাসি আমি। আমি তোকে আবার হারাতে চাই না। ওরা তোকে খুঁজে পেলে মেরে ফেলবে। ওরা কতো ভয়ংকর তুই জানিস না। প্লিজ তুই কোথাও পালিয়ে যা।" কবিরকে জড়িয়ে ধরে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে তুই ও চল আমার সাথে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা আর।"
"সে হয় না কবির।"
"কেন হয় না?"
স্নিগ্ধা তার কোন উত্তর দিতে পারে না। কবির ওর হাতটি বাড়িয়ে দেয়। স্নিগ্ধা ওর হাতে হাতটি রাখে।
ছোট মিনিবাস, তাতে গাদাগাদি লোক, যেন একটি সুঁই রাখারও যায়গা নেই। বাসটি আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলছে। স্নিগ্ধা জানালার পাশে একটি সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পাশের সিটে কবির, মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কবিরের কাছে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঘুম ভেঙে যাবে আর উঠে দেখবে কোন অচেনা বাস স্টপের বেঞ্চে শুয়ে আছে সে একাকি।
"আমরা কোথায় যাচ্ছি?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে। এই প্রথমবার স্নিগ্ধা কিছু বলল।
"সেটা একটা সারপ্রাইজ, খুব সুন্দর যায়গা, তোর খুব পছন্দ হবে।"
"তুই যা, কিছুদিন লুকিয়ে থাক। আমি সামনে স্টপেজে নেমে যাই।" স্নিগ্ধা বলে।
কবির কিছু বলে না। ওর মুখে হতাশার ছাপ পড়ে।
কয়েক মিনিট পরই একটি বাস স্টপেজে বাস থেমে যায়। স্নিগ্ধার সাথে কবিরও নেমে যায়।
"তুই নেমে গেলি কেন?" কবিরকে জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
"চল, তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোকে আমি এভাবে একা ছাড়তে পারি না।"
"তুই কেন বুঝতে পারছিস না ওরা তোকে মেরে ফেলবে।"
"মেরে ফেলুক আমাকে, তবু এভাবে তোকে একা ছাড়তে পারব না।"
স্নিগ্ধা কবিরের হাতটি ধরে টেনে আনে যাত্রী ছাউনির দিকে, কবিরকে বেঞ্চে বসতে দিয়ে নিজে ওর পাশে বসে।
"আমি জানি তোর মনে অনেক প্রশ্ন জমা রয়েছে, সব প্রশ্নের উত্তর পাবি। তুই কি জানতে চাস হোটেলে ঐ লোকটার সাথে কেন আমি? তবে শোন, আমার স্বামী আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে ঐ লোকটার কাছে।" বলতে বলতে গলা ধরে আসে স্নিগ্ধার।
"কি বলছিস তুই!"
"আমি মজা করছি না। সজলকে আমি চিনতে পারিনি কবির, ও কোন মানুষ নয়, পশু একটা। আমি ওকে চিনতে পেরেছি তিন মাস আগে। ও আমাকে মিথ্যা বলে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল ওর বসের বিছানায় যেতে, ওর প্রমোশনের জন্য। যখন ওর আসল রুপটা আমার সামনে আসে আমি চেয়েছিলাম ওর থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু মুক্তি আমার মেলেনি।"
"সেদিন আমি রওনা দিয়েছিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে, বাসায় পৌঁছে শুনলাম আব্বু ফেরেনি অফিস থেকে। মাঝরাতে ফোন পেলাম সজলের। ও বলে যে ওর ভাড়াটে গুন্ডারা আব্বুকে কিডনাপ করেছে। আমি যদি ওর কথা মতো না চলি তাহলে ও আব্বুকে খুন করবে। আমি ওর শর্তে রাজি হয়ে যাই। পরের দিন সকালে আব্বুর খোঁজ পাওয়া যায়, মেডিকেল হসপিটালে তিনি। রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় অফিসের সামনে কয়েকজন যুবক ঘিরে ধরে তাকে, তাদের একজন উনার মুখে রুমাল চেপে ধরে অজ্ঞান করে ফেলে।"
"পুলিশকে জানাসনি বিষয়টা?" কবির জিজ্ঞাসা করে।
"লাভ ছিল না। ও কাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে আমি জানি। ওর এক বন্ধু স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতা। নাম শুনেছিস হয়তো, লিটু জাকের। ওর নামে এমনিতেই চার পাঁচটা চাঁদাবাজি আর খুনের মামলা ঝুলে আছে। একটা কিডন্যাপিংয়ের মামলা যোগ হলেও তাতে ওর কিছু হতো না। আর আসলে আমি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি ওর কথা মতো ফিরে গিয়েছিলাম ওর কাছে, আম্মু আব্বুকে কিচ্ছু জানাইনি। আব্বু আম্মু হয়তো এখনো মনে করে আমি সুখেই আছি।"
"তারপর।"
"ওর বসের আর সাহস হয়নি আমাকে ছোঁয়ার। তবে সজল যা চেয়েছিল তা ওর বস বদরুল ভুঁইয়া করেছিল, সাইমন রহমানের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সাইমন রহমানের বাবা জিল্লুর রহমান কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। কিভাবে কিভাবে যেন সজল সাইমনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। সাইমনের মাধ্যমে সজল প্রোমশনটাও পেয়ে যায়। তবে সজল শুধু সেই প্রমোশনটা পেয়ে খুশি থাকেনি। ওর লোভের কোন সীমা পরিসীমা নেই। ও শুরু থেকেই সাইমনের সামনে আমাকে সেজেগুজে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে নিজেকে পরিবেশন করতে বাধ্য করে। ঐ লম্পট লোকটিও যখন তখন চলে আসত বাড়িতে, আমি যতোটা সম্ভব নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমি পারিনি। একদিন ঐ লোকটা বাসায় একলা পেয়ে..." বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। কবির ওকে জড়িয়ে নেয় বাহুডোরে, "আমি বুঝে গেছি, আর কিছু বলতে হবে না তোকে।"
"না কবির, আমাকে সবটা বলতে দে। ;., আমার জন্য কোন নতুন বিষয় নয়। সজলের আসল রুপ প্রকাশিত হবার পর ওর সাথে শুতে আমার ঘৃণা হত। ওর সাথে শুতে না চাওয়াতে ও রোজ আমাকে মারধোর করতো, জোরপুর্বক ;., করতো। কিন্তু সেদিনের ঐ ঘটনার পর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ঝুলে পড়তে পারিনি, আমার মনে জ্বলতে থাকা ঘৃণার আগুন আমাকে মরতে দেয়নি। যতক্ষন পর্যন্ত পশুটাকে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করতে না দেখব, আমি মরেও শান্তি পাব না। সাইমনের প্রতি আমার রাগ নেই, এ সবই সজলের চাল।
ঐ ঘটনাটির পর সজল কৃত্রিম রাগের অভিনয় শুরু করল। সাইমন তার বন্ধুর মান ভাঙানোর জন্য আরেকটি প্রস্তাব দেয়। রোয়ান রিয়েল এস্টেট থেকে রোয়ান কন্স্ট্রাকশন নামক একটি পৃথক কোম্পানি খোলার কথা হচ্ছে, সজলকে সেই কোম্পানির চিফ অব এক্সিকিউটিভ করার প্রতিশ্রুতি দেয় সে। সাথে আবদার করে আমাকে নিয়ে সাত দিনের জন্য কক্সেসবাজার ট্যুরে আসতে চায় সে। সজল রাজি হয়ে যায়। আমি পরিকল্পনায় ছিলাম সাইমনকে হাতে রেখে সজলের উপর প্রতিশোধ তুলব। কিন্তু এর মাঝে তুই চলে এলি।"
"তুই যে আগুন নিয়ে খেলতে চাইছিস তাতে তুই নিজেও পুড়ে যাবি।" কবির বলে।
"জানি আমি, কিন্তু উপায় নেই কোন।"
"তোকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকতে যে খুব সাধ জাগে এই বুকে। আর পাঁচটা সাধারন মানুষের মতো, যেখানে কোন ঘৃণার আগুন নেই, প্রতিশোধের আগুন নেই, শুধু ভালবাসা।"
"সেটা সম্ভব নয় কবির। ওরা আমাদেরকে বাঁচতে দিবে না।"
"সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। তুই আর আমি মিলে কোন উপায় বের করে নেব।" কবির বলে।
"আব্বু আম্মুর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে আমার, সজল যদি কোন ক্ষতি করে।"
"আমি তোর কাছে থেকে শুনে যেটুকু বুঝলাম তাতে সজল যা কিছু করে ভেবে চিন্তে করে। যতোক্ষন না ও তোর সাথে যোগাযোগ করতে না পারছে ততোক্ষন আংকেল আন্টির কোন ক্ষতি করবে না। যখন তোর সাথে যোগাযোগ করবে তখন তোকে ব্ল্যাকমেইল করবে।
আমাদেরকে কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হবে। এরমধ্যে কোন উপায় খুঁজে বের করবই আমরা।"
কবির বিছানায় শুয়ে জানালার দিকে কাত হয়ে ছিল, জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে। স্নিগ্ধা একই বিছানায় অন্যপাশ হয়ে শুয়েছিল। ওরা ভীষন ক্লান্ত, পাহাড়ি রাস্তায় চার পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে এসেছে। সন্ধ্যার সময় পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা সহজ কাজ নয়, খুব সাবধানে চলতে হয়েছে ওদের।
স্নিগ্ধা অন্য পাশ হয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। হঠাত কিছু একটার হাঁটা চলার শব্দ পায় সে।
"কবির, ঘুমিয়েছিস তুই?" স্নিগ্ধা অন্যপাশ হয়ে বলে।
"নাহ, এখনো ঘুমাইনি। কেন কি হয়েছে?" ওপাশ হয়েই বলে কবির।
"ঘরে কিছু একটা আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"ইঁদুর হবে হয়তো। পাহাড়ি ইঁদুর, বেশ বড়সড় হয়। তবে চিন্তা করিস না, বিছানায় ওঠার সাহস পাবে না।" কবির বলে।
স্নিগ্ধা এগিয়ে আসে কবিরের দিকে, পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ওকে।
"আমার কথা তো সবই শুনলি, তোর সম্পর্কে বল, কোথায় ছিলি এতোদিন?"
"আজ না, অন্য কোন দিন বলব। তুই খুব ক্লান্ত, ঘুমানোর চেষ্টা কর।" স্নিগ্ধার দিকে পাশ ফিরে বলে কবির।
কিছুক্ষন নিরবতায় কেটে যায়।
"কি অতো ভাবছিস, কবির?" স্নিগ্ধা আবারও বলে।
"ওরা এই মুহুর্তে কি করছে, কি ভাবছে সেটাই ভাবছি।" ভাবুক কন্ঠে জবাব দেয় কবির।
"কি করছে ওরা?"
"ওরা আমাদেরকে খোঁজার চেষ্টা করছে। হয়তো পুলিশে জানিয়েছে, কিডন্যাপিং কেস হিসাবেই হয়তো দেখছে তারা।" কবির বলে।
"কিডন্যাপ!" অবাক হয়ে বলে স্নিগ্ধা।
"তোর কিডন্যাপ।" কবির বলে।
"যদি আমরা পুলিশকে সবকিছু খুলে বলে দেই?" স্নিগ্ধা বলে।
"ভাল আইডিয়া। কিন্তু তোর কি মনে হয় পুলিশকে সবকিছু বলে দেয়ার পর ওদের কি ক্ষমতা নেই সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার?" কবির বলে।
"তা তো আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"আর তাছাড়া আমরা তো নিশ্চিত নই যে ওরা পুলিশকে জানিয়েছে নাকি অন্য কোনভাবে আমাদের খোঁজ করছে।"
"আমার মনে হয় আমাদের কোন নিস্তার নেই। যে কটা দিন তোর সাথে আছি আমি মন প্রান ভরে উপভোগ করতে চাই। "বলে স্নিগ্ধা কবিরকে আরো ভালভাবে বাহুডোরে জড়িয়ে নেয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। বাহুডোরে স্নিগ্ধার উষ্ণ নরম দেহটি কবিরের দেহেও উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে থাকে। কবির নিজেকে কন্ট্রোল করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।