16-06-2021, 08:16 PM
রাত একটা বাজে, কবির তার সাইডব্যাগটা মাথার নিচে গুঁজে দিয়ে বেঞ্চে শুয়ে ছিল নাম না জানা এক বাস স্টপে। প্রায় এক সপ্তাহ হল সে কক্সবাজারে এসেছে। টাকাপয়সা যা ছিল তা ইতিমধ্যে শেষ, কবির চেষ্টা করছিল একটা কাজ জুটিয়ে নেয়ার। আসেপাশে অনেকগুলো হোটেল রয়েছে, কবির চেষ্টা করছে সেগুলোর কোনটিতে কাজ যোগাড় করার। কিন্তু একজন অচেনা অজানা লোককে কেউ কাজে রাখতে চায়না। কবির শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে কি করা যায়। এমন সময় হঠাত বাসের আওয়াজ পায় কবির, স্টপেজে কোন বাস থেমেছে, সম্ভবত কোন যাত্রী নেমেছে। কবির ওপাশ হয়ে শোয় এবং আড়চোখে নেমে পড়া যাত্রীকে দেখতে থাকে। একজন মধ্যবয়স্ক লোক, নিম্ন মধ্যবিত্ত গোছের। কবির অনুমান করে লোকটি আসেপাশে কোন হোটেলে বাবুর্চি কিংবা ওয়েটার হিসাবে কাজ করে। লোকর্টি কয়েক মিনিট এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজে, সম্ভবত রিক্সা খোঁজে, তারপর ডান দিকের রাস্তাটি ধরে হাঁটতে শুরু করে। কবির অনেকটাই নিশ্চিত যে লোকটি বিপদে পড়বে। আধাঘন্টা আগে কবির ঐ রাস্তাতে দুজন ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিল, অবশ্য টাকা পয়সা কিছুই ছিলনা কবিরের কাছে। মিনিট খানেক পর কবির উঠে ডান দিকের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। খানিকটা হাঁটতেই কিছু ফিসফিস আওয়াজ পায় রাস্তার পাশে গলি থেকে। নিশ্চয়ই হিরোইনখোর দুটো লোকটাকে চাকুর ভয় দেখিয়ে পাশের গলিতে নিয়ে গেছে। আরেকটু এগুতে স্পষ্ট কথার আওয়াজ শুনতে।
"দয়া করো ভাই, আইজকাই বেতন পাইছি, বাসাতেও টাকা পাঠাতে পারি নাই ভাই। অন্তত দুই হাজার টাকা ফেরত দেন ভাই। বাসায় বউ বাচ্চা না খেয়ে থাকবে ভাই।" লোকটি এক ছিনতাইকারীর পা জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে বলে।
"পা ছাড় বলছি, পা ছাড়। নাহলে দিমু কিন্তু শ্বাসী কাইটা।" পা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলে।
"দে না কাইটা, বহুদিন হল খুন খারাপি করি না।" পাশ থেকে অন্যজন বলে।
লোকটা এতো করে কাকুতি মিনতি করছে, কিছু টাকা তো ফেরত দে।" কবির গলির সামনে দাড়িয়ে বলে।
"ঐ ভিখারীর বাচ্চা, তুই আবার আইছস? তোর কি মরার সাধ হইছে?" বলে একজন চাকু নিয়ে কবিরের দিকে ধেয়ে আসে।
এরকম পরিস্থিতি কবিরের জন্য নতুন নয়, কবির ঘাবড়ে না গিয়ে সতর্কতার সাথে ধেয়ে আসা লোকটার গতিবিধি লক্ষ করে। লোকটা তার ছুরি দিয়ে কবিরকে ফ্যাঁস দেয়ার ভঙ্গিতে আঘাত করার চেষ্টা করে। কবির দ্রুত পেছনে সরে যায়। আবারও আঘাত করার চেষ্টা করলে তার হাতটা বাঁ হাত দিয়ে ধরে মুচড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে চাকুটি নিয়ে প্রায় বিদ্যুতগতিতে লোকটির উরুতে গেঁথে দেয়। সাথে সাথে গগনবিদারী চিতকার দিয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে ছিনতাইকারী।
"কিরে শালা, তোর দোস্ত ব্যাথায় মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর তুই দাড়িয়ে দাড়িয়ে তামাশা দেখছিস? দুইজন একসাথে এলে তাও চান্স ছিল তোদের। তোর দোস্ত তো বাম পাছায় চাকু নিয়েছে, তুই কোন পাছায় নিবি?" বলে অন্যজনের দিকে হাত নেড়ে এগিয়ে আসতে ইশারা করে কবির।
কবিরের দিকে তেড়ে আসার বদলে উল্টো দিকে দৌড় দেয় সে।
"আপনার টাকা নিয়্যা ভাগছে নাকি?" মধ্য বয়স্ক লোকটির উদ্দেশ্যে বলে কবির।
"না ভাই, টাকা অর কাছে।" বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া লোকটির দিকে ইশারা করে।
কবির লোকটির প্যান্ট হাতিয়ে মানিব্যাগটা খুঁজে পায়। লোকটাকে তা ফেরত দেয়।
"ভাই! আপনারে কি বইলা যে ধইন্যবাদ দিব। আপনে না থাকলে কি যে হইত!"
"ধইন্যবাদ দিয়ে কি প্যাট ভরে নাকি? যদি পারেন এক বেলা পেট ভইরা খাইতে দেন, আইজ সারাদিন কিচ্ছু খাই নাই।" কবির বলে।
লোকটা তার মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে দেয়।
"আমারে কি আপনার কাছে ছিনতাইকারী মনে হইতেছে?" গলি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে কবির বলে।
"আরে না ভাই। আমি এইটা খুশি মনে দিচ্ছি!" লোকটা একটু ইতস্তত করে বলে।
"আপনারে দেইখা কিন্তু সেই মাপের বড়লোক মনে হইতাছে না যে আপনি খুশি মনে এক হাজার টাকার নোট দিবেন। তারচেয়ে চলেন সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে। দুইজন বইসা কিছু খাই। মনে হচ্ছে আপনিও রাতে কিছু খান নাই।" কবির বলে
"চলেন তাইলে।" বলে লোকটি কবিরের সাথে রওনা দেয়।
"আপনি তো সাংঘাতিক মানুষ, ক্যামনে ঐ দুইটারে ধরাসাই করলেন!" রেস্টুরেন্টে বসে খাবার অর্ডার দিয়ে লোকটা বলে।
"ওসব হিরোইনখোরদের গায়ে শক্তি থাকে নাকি? আপনিই পারতেন যদি আপনার মনে ভয় না থাকতো। আপনার কিছু হলে আপনার বউয়ের কি হবে! ছেলে মেয়ের কি হবে! আমার এসব ভয় নাই।"
"কেন? ও আপনের তো নামই শোনা হয় নাই।"
"আমার নাম করিম। আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হমু।" কবির বলে।
"আমি মনসুর আলী। এইখানে সী সেল রেস্টুরেন্টে কাজ করি। অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছিলাম, ফিরতে রাত হইল।" লোকটি বলে।
ততোক্ষনে খাবার চলে এসেছে। মনসুর খেতে খেতে বলে "আপনি মানে তুমি কিন্তু তোমার বিষয়ে কিছু কইলা না। কই থাকো? কি কর?"
"আমার বাড়ি বান্দরবানে, গ্রামের নাম অনসুং। বাপ জন্মের আগেই মইরা গেছে, এক মা-ই ছিল। তাও মরল এক বছর আগে। মা মরার পর গ্রামে আর মন টিঁকে না, তাই শহরে চইলা আইলাম।" কবির বলে। যেকোন যায়গায় গেলে কবির সাধারণত এরকম গল্প বানিয়ে বলে।
"আহারে! মা মারা গেল ক্যামনে?"
"জানিনা চাচা। একদিন উঠান ঝাড় দিতে গিয়া মাথা ঘুইরা পইড়া গেছে, তারপর শেষ।" কবির বলে
"স্টোক করছে। আমার বাপেও একইভাবে মারা গেছে। তয় তুমি আমারে চাচাই ডাইকো, ভাল লাগে। তুমি এখানে কই থাক আর কি কর?"
"ভাবছিলাম শহরে আইসা কোন একটা কাজ জুটাইয়া নিমু, এক সপ্তাহ হইল এখানে ওখানে ঘুরতাছি কিন্তু কাজ পাই নাই। আর থাকি যেখানে যায়গা পাই। আজ রাতে বাস স্ট্যান্ডে আছি।"
"বাস স্ট্যান্ড থাকার যায়গা হইল? তুমি আমার সাথে চল, আমি যে হোটেলে কাজ করি এইখানে তোমার একটা কাজের ব্যাবস্থা কইরা দিমু। বেতন বেশী পাইবা না, কিন্তু থাকা খাওয়া কোম্পানির।" মনসুর বলে।
ততক্ষনে কবিরের খাওয়া হয়ে গেছে, হাত ধুতে উঠে যায় সে, মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কবির ও মনসুর হেঁটেই রওনা দেয়। পথে মনসুরের সাথে কবিরের অনেক কথা হয়, যার অধিকাংশই কবির বানিয়ে বলে। অবশেষে যখন ওরা হোটেলটাতে পৌঁছায় তখন রাত তিনটে বাজে। কবির ভেবেছিল ছোটখাট কোন হোটেল হবে হয়তো, কিন্তু সেটি বিশাল আলিশান একটি ফাইভ স্টার হোটেল।
মনসুর গেটের সামনে গিয়ে চেক পোস্টের দিকে টর্চ লাইট দিয়ে সিগনাল দেয়, সাথে সাথে একজন গার্ড চলে আসে।
"আরে মনসুর মিয়া! ফিরতে এতো রাত হইল যে! তোমার সাথে ঐটা কে?" গার্ড গেইট খুলে দিতে দিতে বলে।
"এ আমার ভাইস্তা। দেখি কোন কাজে লাগাইয়া দিতে পারি কি না।"
"পথে আবার ভাইস্তা পাইলা কই থেইকা?" মিচকি হেসে বলে দারোয়ান।
"আমার সেই ভাই চট্টগ্রামেই থাকে, অফিসের কাজে যখন আইছি ভাবলাম ভাইয়ের সাথে দেখা কইরা যাই।"
"ও বুঝছি। আসার সময় সাথে কইরা ভাইস্তারে নিয়া আইছ।" বলে গেট খুলে দেয় সিকিউরিটি গার্ড।
মনসুর ভেতরে ঢোকে, পিছে পিছে কবির। হোটেলের একপাশে স্টাফদের কোয়ার্টার, মনসুর ও কবির সেদিকেই হাঁটতে থাকে।
"কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় আর নামিদামি হোটেল এইটা। এর মালিক কে জানো? জিল্লুর রহমান। রোয়ান গ্রুপের মালিক, ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র।" হোটেলের সামনে বাগান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে মনসুর। কবির কোন জবাব দেয়না।
"আমাদের ম্যানেজার সাহেব খুব ভাল মানুষ, তারে বইলা একটা কাজে লাগাইয়া দিতে পারি কিনা দেখি।"
"তুমি লেখা পড়া কতদুর করছো?" আবারও জিজ্ঞাসা করে মনসুর।
"গ্রামের ইকলেজে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ছি।" কবির বলে।
"এইখানে অনেক বড় বড় মানুষ আসে, তাদের সাথে সবসময় ভদ্রভাবে কথা বলতে হয়, আমি তোমারে সব শিখাইয়া দিমুনি।"
ততোক্ষনে স্টাফ কোয়ার্টার চলে এসেছে। মনসুর তার রুমের দিক যায়, পিছে পিছে কবিরও। সেদিন রাতটি কবির সেখানেই কাটিয়ে দেয়। পরের দিন মনসুর কবিরকে নিয়ে হোটেল ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যায়। মনসুর মিয়া হোটেলের অনেক পুরনো স্টাফ, হোটেলের শুরু থেকে সে আছে। তাই তার সুপারিশে সহজেই চাকরী হয়ে গেল কবিরের, ওয়েটার হিসাবে।
আবারও কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে আসে কবির। কখনো ডে শিফট, কখনো নাইট শিফট, কিন্তু কোন ছুটি নেই। এরমাঝে যেটুকু সময় পাওয়া যায় কবির সমুদ্র সৈকতে কাটিয়ে। তবে একঘেয়ে কর্মব্যস্ততা কবিরের ভাল লাগে না। আবারও পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো কবির, কিন্তু কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছিল না।
দেখতে দেখতে তিনটি মাস কেটে গেল। কবির হোটেল সী সেলে ওয়েটার হিসাবে কাজ করছে। এর মাঝে মনসুর চাচা ছাড়াও রফিক, তুহিন, বাচ্চু, শিপন সহ অনেক স্টাফের সাথে কবিরের ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারো সাথে যে বৈরী সম্পর্ক হয়নি এমনও নয়, তবে কবির চেষ্টা করে তাদেরকে যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলার।
দুপুর একটা বাজে, কবির একটি রুম থেকে লাঞ্চ সার্ভ করে ফিরছিল। করিডরে বাচ্চুর সাথে দেখা হয় তার। বাচ্চুকে কেমন যেন বিব্রত দেখায়।
"করিম ভাই, প্লিজ লাঞ্চটা তিনশ চার নাম্বার রুমে সার্ভ করে দিয়ে এসো।" অনুরোধের সুরে নিচু স্বরে বলে বাচ্চু।
"না ভাই, আমার ডিউটি শেষ, এখন নিজের লাঞ্চ টাইম।" কবির বলে।
"ছোট সাহেব এসেছেন, কিছুক্ষন আগে। তুমি তো জানোই, গতবার ড্রিংকসের সাথে আইস কিউব আনতে ভুলে গেছিলাম বলে উনি আমাকে ভীষন মেরেছেন। পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে চাকরিটা বাঁচিয়েছি। আমাকে আবার দেখলে উনি আবার চটে যাবেন।" বাচ্চু বলে।
"এবার যদি আমার উপর চটে যান?" কবির বলে।
"আজ পর্যন্ত তোমার উপর কখনো চটেননি উনি। তুমি খুব ভাল ম্যানেজ করতে পার ওনাকে।" একটু থেমে বাচ্চু আবারও ফিসফিস করে বলে "আর তাছাড়া ছোট সাহেবের সাথে কচি, মিষ্টি, পরীর মতো এক মেম সাহেবা আছে। যাওনা, ভালই লাগবে তোমার।" বলে চোখ টিপে দিয়ে সরে পড়ে বাচ্চু।
ছোট সাহেব অর্থাত হোটেলের মালিক জিল্লুর রহমানের একমাত্র ছেলে সাইমন রহমান। বয়স ত্রিশ/ পঁয়ত্রিশ। শিল্পপতির ছেলে হলেও ব্যাবসা বানিজ্যের প্রতি মনোযোগ নেই তার। তার কাছে লাইফ মানে ফুর্তি, মদ আর নারী। মাঝে মাঝেই সময় কাটাতে এই হোটেলে চলে আসে সে। তার জন্য তিনশ চার নাম্বার রুমটা সবসময় বুক করা থাকে। যদিও সে এখনো অবিবাহিত, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তার সাথে কোন মেয়ে থাকে। তাদের মাঝে কে কে তার গার্লফ্রেন্ড আর কে কে হাই সোসাইটি কলগার্ল তা বলা মুশকিল।
কবির তিনশ চার নাম্বার রুমের দরজায় নক করে। এক মিনিট পর দরজাটা খুলে যায়, সামনে এক মেয়ে দাড়িয়ে যাকে দেখে কবিরের রক্ত হিম হয়ে আসে। কোন দিন স্নিগ্ধার সাথে দেখা হবে তার, হয়তো সেই মুহুর্তটির অপেক্ষায় সে বেঁচে আছে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে সে এভাবে দেখবে, কখনো কল্পনাও করতে পারেনি কবির। কবিরের বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটি যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে স্নিগ্ধার চোখ অশ্রুজলে টলমল করছিল, তা গাল বেয়ে ঝরে পড়ার আগেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কবিরকে।
"কবির! কোথায় ছিলি এতোদিন!" কবিরের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
কবির কিছু বলে না, তার দৃষ্টিটা ঘরের ভেতরে দাড়িয়ে ক্রোধে ফুঁসতে থাকা লোকটির দিকে।
সাইমন ছুটে এসে স্নিগ্ধাকে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিয়ে কবিরকে পেছনের দেয়ালে চেপে ধরে ওর মুখে ঘুসি দিতে থাকে আর রাগে গর্জাতে থাকে, "স্কাউন্ড্রেল, সামান্য ওয়েটার হয়ে তোর সাহস কি করে হল আমার জিএফের দিকে হাত বাড়ানোর?"
স্নিগ্ধা সাইমনের পা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে "ওকে প্লিজ মেরো না, ওর কোন দোষ নেই।"
কবিরকে ছেড়ে দিয়ে সাইমন স্নিগ্ধার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বলে "বারোভাতারী খানকি মাগী" বলে অন্য হাত সপাটে চড় বসিয়ে দিতে চায় সে, কিন্তু তার আগেই কবির হাতটি ধরে নেয় এবং অন্য হাত দিয়ে ওর কনুইতে প্রচন্ড আঘাত করে, সাথে সাথে মৃদু মড়মড় শব্দে সাইমনের হাত ভেঙে যায় কিন্তু সেই শব্দকে ছাপিয়ে যায় গগনবিদারী চিতকারে। মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকা সাইমনের গলায় পাড়া দিয়ে বলে কবির "ইচ্ছে করছে তোর জিভটাও টেনে ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু আমি ছুঁচো মেরে হাত নষ্ট করতে চাই না।"
তারপর স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় কবির। লোকসমাগম হওয়ার আগেই এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যেতে চায় তারা।
"দয়া করো ভাই, আইজকাই বেতন পাইছি, বাসাতেও টাকা পাঠাতে পারি নাই ভাই। অন্তত দুই হাজার টাকা ফেরত দেন ভাই। বাসায় বউ বাচ্চা না খেয়ে থাকবে ভাই।" লোকটি এক ছিনতাইকারীর পা জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে বলে।
"পা ছাড় বলছি, পা ছাড়। নাহলে দিমু কিন্তু শ্বাসী কাইটা।" পা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলে।
"দে না কাইটা, বহুদিন হল খুন খারাপি করি না।" পাশ থেকে অন্যজন বলে।
লোকটা এতো করে কাকুতি মিনতি করছে, কিছু টাকা তো ফেরত দে।" কবির গলির সামনে দাড়িয়ে বলে।
"ঐ ভিখারীর বাচ্চা, তুই আবার আইছস? তোর কি মরার সাধ হইছে?" বলে একজন চাকু নিয়ে কবিরের দিকে ধেয়ে আসে।
এরকম পরিস্থিতি কবিরের জন্য নতুন নয়, কবির ঘাবড়ে না গিয়ে সতর্কতার সাথে ধেয়ে আসা লোকটার গতিবিধি লক্ষ করে। লোকটা তার ছুরি দিয়ে কবিরকে ফ্যাঁস দেয়ার ভঙ্গিতে আঘাত করার চেষ্টা করে। কবির দ্রুত পেছনে সরে যায়। আবারও আঘাত করার চেষ্টা করলে তার হাতটা বাঁ হাত দিয়ে ধরে মুচড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে চাকুটি নিয়ে প্রায় বিদ্যুতগতিতে লোকটির উরুতে গেঁথে দেয়। সাথে সাথে গগনবিদারী চিতকার দিয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে ছিনতাইকারী।
"কিরে শালা, তোর দোস্ত ব্যাথায় মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর তুই দাড়িয়ে দাড়িয়ে তামাশা দেখছিস? দুইজন একসাথে এলে তাও চান্স ছিল তোদের। তোর দোস্ত তো বাম পাছায় চাকু নিয়েছে, তুই কোন পাছায় নিবি?" বলে অন্যজনের দিকে হাত নেড়ে এগিয়ে আসতে ইশারা করে কবির।
কবিরের দিকে তেড়ে আসার বদলে উল্টো দিকে দৌড় দেয় সে।
"আপনার টাকা নিয়্যা ভাগছে নাকি?" মধ্য বয়স্ক লোকটির উদ্দেশ্যে বলে কবির।
"না ভাই, টাকা অর কাছে।" বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া লোকটির দিকে ইশারা করে।
কবির লোকটির প্যান্ট হাতিয়ে মানিব্যাগটা খুঁজে পায়। লোকটাকে তা ফেরত দেয়।
"ভাই! আপনারে কি বইলা যে ধইন্যবাদ দিব। আপনে না থাকলে কি যে হইত!"
"ধইন্যবাদ দিয়ে কি প্যাট ভরে নাকি? যদি পারেন এক বেলা পেট ভইরা খাইতে দেন, আইজ সারাদিন কিচ্ছু খাই নাই।" কবির বলে।
লোকটা তার মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে দেয়।
"আমারে কি আপনার কাছে ছিনতাইকারী মনে হইতেছে?" গলি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে কবির বলে।
"আরে না ভাই। আমি এইটা খুশি মনে দিচ্ছি!" লোকটা একটু ইতস্তত করে বলে।
"আপনারে দেইখা কিন্তু সেই মাপের বড়লোক মনে হইতাছে না যে আপনি খুশি মনে এক হাজার টাকার নোট দিবেন। তারচেয়ে চলেন সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে। দুইজন বইসা কিছু খাই। মনে হচ্ছে আপনিও রাতে কিছু খান নাই।" কবির বলে
"চলেন তাইলে।" বলে লোকটি কবিরের সাথে রওনা দেয়।
"আপনি তো সাংঘাতিক মানুষ, ক্যামনে ঐ দুইটারে ধরাসাই করলেন!" রেস্টুরেন্টে বসে খাবার অর্ডার দিয়ে লোকটা বলে।
"ওসব হিরোইনখোরদের গায়ে শক্তি থাকে নাকি? আপনিই পারতেন যদি আপনার মনে ভয় না থাকতো। আপনার কিছু হলে আপনার বউয়ের কি হবে! ছেলে মেয়ের কি হবে! আমার এসব ভয় নাই।"
"কেন? ও আপনের তো নামই শোনা হয় নাই।"
"আমার নাম করিম। আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হমু।" কবির বলে।
"আমি মনসুর আলী। এইখানে সী সেল রেস্টুরেন্টে কাজ করি। অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছিলাম, ফিরতে রাত হইল।" লোকটি বলে।
ততোক্ষনে খাবার চলে এসেছে। মনসুর খেতে খেতে বলে "আপনি মানে তুমি কিন্তু তোমার বিষয়ে কিছু কইলা না। কই থাকো? কি কর?"
"আমার বাড়ি বান্দরবানে, গ্রামের নাম অনসুং। বাপ জন্মের আগেই মইরা গেছে, এক মা-ই ছিল। তাও মরল এক বছর আগে। মা মরার পর গ্রামে আর মন টিঁকে না, তাই শহরে চইলা আইলাম।" কবির বলে। যেকোন যায়গায় গেলে কবির সাধারণত এরকম গল্প বানিয়ে বলে।
"আহারে! মা মারা গেল ক্যামনে?"
"জানিনা চাচা। একদিন উঠান ঝাড় দিতে গিয়া মাথা ঘুইরা পইড়া গেছে, তারপর শেষ।" কবির বলে
"স্টোক করছে। আমার বাপেও একইভাবে মারা গেছে। তয় তুমি আমারে চাচাই ডাইকো, ভাল লাগে। তুমি এখানে কই থাক আর কি কর?"
"ভাবছিলাম শহরে আইসা কোন একটা কাজ জুটাইয়া নিমু, এক সপ্তাহ হইল এখানে ওখানে ঘুরতাছি কিন্তু কাজ পাই নাই। আর থাকি যেখানে যায়গা পাই। আজ রাতে বাস স্ট্যান্ডে আছি।"
"বাস স্ট্যান্ড থাকার যায়গা হইল? তুমি আমার সাথে চল, আমি যে হোটেলে কাজ করি এইখানে তোমার একটা কাজের ব্যাবস্থা কইরা দিমু। বেতন বেশী পাইবা না, কিন্তু থাকা খাওয়া কোম্পানির।" মনসুর বলে।
ততক্ষনে কবিরের খাওয়া হয়ে গেছে, হাত ধুতে উঠে যায় সে, মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কবির ও মনসুর হেঁটেই রওনা দেয়। পথে মনসুরের সাথে কবিরের অনেক কথা হয়, যার অধিকাংশই কবির বানিয়ে বলে। অবশেষে যখন ওরা হোটেলটাতে পৌঁছায় তখন রাত তিনটে বাজে। কবির ভেবেছিল ছোটখাট কোন হোটেল হবে হয়তো, কিন্তু সেটি বিশাল আলিশান একটি ফাইভ স্টার হোটেল।
মনসুর গেটের সামনে গিয়ে চেক পোস্টের দিকে টর্চ লাইট দিয়ে সিগনাল দেয়, সাথে সাথে একজন গার্ড চলে আসে।
"আরে মনসুর মিয়া! ফিরতে এতো রাত হইল যে! তোমার সাথে ঐটা কে?" গার্ড গেইট খুলে দিতে দিতে বলে।
"এ আমার ভাইস্তা। দেখি কোন কাজে লাগাইয়া দিতে পারি কি না।"
"পথে আবার ভাইস্তা পাইলা কই থেইকা?" মিচকি হেসে বলে দারোয়ান।
"আমার সেই ভাই চট্টগ্রামেই থাকে, অফিসের কাজে যখন আইছি ভাবলাম ভাইয়ের সাথে দেখা কইরা যাই।"
"ও বুঝছি। আসার সময় সাথে কইরা ভাইস্তারে নিয়া আইছ।" বলে গেট খুলে দেয় সিকিউরিটি গার্ড।
মনসুর ভেতরে ঢোকে, পিছে পিছে কবির। হোটেলের একপাশে স্টাফদের কোয়ার্টার, মনসুর ও কবির সেদিকেই হাঁটতে থাকে।
"কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় আর নামিদামি হোটেল এইটা। এর মালিক কে জানো? জিল্লুর রহমান। রোয়ান গ্রুপের মালিক, ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র।" হোটেলের সামনে বাগান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে মনসুর। কবির কোন জবাব দেয়না।
"আমাদের ম্যানেজার সাহেব খুব ভাল মানুষ, তারে বইলা একটা কাজে লাগাইয়া দিতে পারি কিনা দেখি।"
"তুমি লেখা পড়া কতদুর করছো?" আবারও জিজ্ঞাসা করে মনসুর।
"গ্রামের ইকলেজে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ছি।" কবির বলে।
"এইখানে অনেক বড় বড় মানুষ আসে, তাদের সাথে সবসময় ভদ্রভাবে কথা বলতে হয়, আমি তোমারে সব শিখাইয়া দিমুনি।"
ততোক্ষনে স্টাফ কোয়ার্টার চলে এসেছে। মনসুর তার রুমের দিক যায়, পিছে পিছে কবিরও। সেদিন রাতটি কবির সেখানেই কাটিয়ে দেয়। পরের দিন মনসুর কবিরকে নিয়ে হোটেল ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যায়। মনসুর মিয়া হোটেলের অনেক পুরনো স্টাফ, হোটেলের শুরু থেকে সে আছে। তাই তার সুপারিশে সহজেই চাকরী হয়ে গেল কবিরের, ওয়েটার হিসাবে।
আবারও কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে আসে কবির। কখনো ডে শিফট, কখনো নাইট শিফট, কিন্তু কোন ছুটি নেই। এরমাঝে যেটুকু সময় পাওয়া যায় কবির সমুদ্র সৈকতে কাটিয়ে। তবে একঘেয়ে কর্মব্যস্ততা কবিরের ভাল লাগে না। আবারও পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো কবির, কিন্তু কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছিল না।
দেখতে দেখতে তিনটি মাস কেটে গেল। কবির হোটেল সী সেলে ওয়েটার হিসাবে কাজ করছে। এর মাঝে মনসুর চাচা ছাড়াও রফিক, তুহিন, বাচ্চু, শিপন সহ অনেক স্টাফের সাথে কবিরের ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারো সাথে যে বৈরী সম্পর্ক হয়নি এমনও নয়, তবে কবির চেষ্টা করে তাদেরকে যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলার।
দুপুর একটা বাজে, কবির একটি রুম থেকে লাঞ্চ সার্ভ করে ফিরছিল। করিডরে বাচ্চুর সাথে দেখা হয় তার। বাচ্চুকে কেমন যেন বিব্রত দেখায়।
"করিম ভাই, প্লিজ লাঞ্চটা তিনশ চার নাম্বার রুমে সার্ভ করে দিয়ে এসো।" অনুরোধের সুরে নিচু স্বরে বলে বাচ্চু।
"না ভাই, আমার ডিউটি শেষ, এখন নিজের লাঞ্চ টাইম।" কবির বলে।
"ছোট সাহেব এসেছেন, কিছুক্ষন আগে। তুমি তো জানোই, গতবার ড্রিংকসের সাথে আইস কিউব আনতে ভুলে গেছিলাম বলে উনি আমাকে ভীষন মেরেছেন। পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে চাকরিটা বাঁচিয়েছি। আমাকে আবার দেখলে উনি আবার চটে যাবেন।" বাচ্চু বলে।
"এবার যদি আমার উপর চটে যান?" কবির বলে।
"আজ পর্যন্ত তোমার উপর কখনো চটেননি উনি। তুমি খুব ভাল ম্যানেজ করতে পার ওনাকে।" একটু থেমে বাচ্চু আবারও ফিসফিস করে বলে "আর তাছাড়া ছোট সাহেবের সাথে কচি, মিষ্টি, পরীর মতো এক মেম সাহেবা আছে। যাওনা, ভালই লাগবে তোমার।" বলে চোখ টিপে দিয়ে সরে পড়ে বাচ্চু।
ছোট সাহেব অর্থাত হোটেলের মালিক জিল্লুর রহমানের একমাত্র ছেলে সাইমন রহমান। বয়স ত্রিশ/ পঁয়ত্রিশ। শিল্পপতির ছেলে হলেও ব্যাবসা বানিজ্যের প্রতি মনোযোগ নেই তার। তার কাছে লাইফ মানে ফুর্তি, মদ আর নারী। মাঝে মাঝেই সময় কাটাতে এই হোটেলে চলে আসে সে। তার জন্য তিনশ চার নাম্বার রুমটা সবসময় বুক করা থাকে। যদিও সে এখনো অবিবাহিত, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তার সাথে কোন মেয়ে থাকে। তাদের মাঝে কে কে তার গার্লফ্রেন্ড আর কে কে হাই সোসাইটি কলগার্ল তা বলা মুশকিল।
কবির তিনশ চার নাম্বার রুমের দরজায় নক করে। এক মিনিট পর দরজাটা খুলে যায়, সামনে এক মেয়ে দাড়িয়ে যাকে দেখে কবিরের রক্ত হিম হয়ে আসে। কোন দিন স্নিগ্ধার সাথে দেখা হবে তার, হয়তো সেই মুহুর্তটির অপেক্ষায় সে বেঁচে আছে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে সে এভাবে দেখবে, কখনো কল্পনাও করতে পারেনি কবির। কবিরের বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটি যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে স্নিগ্ধার চোখ অশ্রুজলে টলমল করছিল, তা গাল বেয়ে ঝরে পড়ার আগেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কবিরকে।
"কবির! কোথায় ছিলি এতোদিন!" কবিরের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
কবির কিছু বলে না, তার দৃষ্টিটা ঘরের ভেতরে দাড়িয়ে ক্রোধে ফুঁসতে থাকা লোকটির দিকে।
সাইমন ছুটে এসে স্নিগ্ধাকে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিয়ে কবিরকে পেছনের দেয়ালে চেপে ধরে ওর মুখে ঘুসি দিতে থাকে আর রাগে গর্জাতে থাকে, "স্কাউন্ড্রেল, সামান্য ওয়েটার হয়ে তোর সাহস কি করে হল আমার জিএফের দিকে হাত বাড়ানোর?"
স্নিগ্ধা সাইমনের পা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে "ওকে প্লিজ মেরো না, ওর কোন দোষ নেই।"
কবিরকে ছেড়ে দিয়ে সাইমন স্নিগ্ধার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বলে "বারোভাতারী খানকি মাগী" বলে অন্য হাত সপাটে চড় বসিয়ে দিতে চায় সে, কিন্তু তার আগেই কবির হাতটি ধরে নেয় এবং অন্য হাত দিয়ে ওর কনুইতে প্রচন্ড আঘাত করে, সাথে সাথে মৃদু মড়মড় শব্দে সাইমনের হাত ভেঙে যায় কিন্তু সেই শব্দকে ছাপিয়ে যায় গগনবিদারী চিতকারে। মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকা সাইমনের গলায় পাড়া দিয়ে বলে কবির "ইচ্ছে করছে তোর জিভটাও টেনে ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু আমি ছুঁচো মেরে হাত নষ্ট করতে চাই না।"
তারপর স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় কবির। লোকসমাগম হওয়ার আগেই এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যেতে চায় তারা।