16-06-2021, 08:14 PM
চতুর্থ পর্বঃ রুপকথার দেশে
কবিরের ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরে, মোটরের আওয়াজে। সম্ভবত কাছে দিয়ে কোন নৌকা গেছে। কবির তার নিমের ডালের মেসোয়াকটি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, বাইরে ঝলমলে দিন। কবির দাঁতে মেসওয়াক ঘষতে ঘষতে চারিদিকে দেখে। যমুনা নদীর একটি ছোট চর, তার মাঝামাঝিতে একটি খড়ের ছাউনির ঘর। ঘরটি কবির নিজের হাতে বানিয়েছে। কবির হেঁটে হেঁটে নদীর কিনারায় যায়।
"কিরে কবির, কি দেখছিস?"
"আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে, হালকা ফুরফুরে বাতাস বইছে, নদীর স্রোতও তেমন একটা নেই, নৌকা ভাসানোর জন্য পারফেক্ট দিন।"
"নৌকা ভাসাবি নাকি?"
"এখন না পরে।"
কবির নিজের সাথেই কথা বলে। এখানে তার সাথে কথা বলার কেউ নেই, এই পুরো চরে সে একা।
কবির নদীর পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ঘাসের উপর বসে দুর দিগন্তের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
"একসময় যমুনা ব্রীজের উপর দিয়ে বাসে করে যাওয়ার সময় নিচের এই চরগুলোর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম।" উদাস কন্ঠে বলে কবির।
"এখন কি সেই মুগ্ধতা আর নেই?" নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কবির।
"মুগ্ধতা এখনো আছে কিন্তু সাথে কেমন যেন বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবীর।
"চৈত্র মাসের তো প্রায় শেষের দিকে, এখন এই চর ছেড়ে না বের হলে কি পরিণতি হতে পারে জানিস? এখানে কালবৈশাখী কতো ভয়ংকর হতে পারে জানা আছে?" আবারও নিজেকে প্রশ্ন করে কবির।
"জানি। যদি কালবৈশাখী থেকে বেঁচেও যাই, এই চর ডুবে গেলে বাঁচতে পারব না।" আবারও নিজেই উত্তর দেয়।
"চর ডুবে যাবে?"
"হ্যাঁ প্রতিবছর হেমন্ত-শীতে এই চর জেগে ওঠে আর গ্রীষ্ম-বর্ষায় ডুবে যায়।"
"তাহলে তো শিঘ্রই এই চর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।"
"কেন যাব? আমার জীবনের সমাপ্তি যদি এখানেই হয় তবে এ জগতে কার বা কি এসে যাবে?" বলতে বলতে কবির উঠে নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
কবির তার ঘরে গিয়ে মাছ ধরার জাল নিয়ে আসে। ঘরের উত্তর দিকে নদীর পানি জমে একটি পুকুরের মত সৃষ্টি হয়েছে। সেই পুকুরটায় জাল ফেলে কবির।
"তোর জীবনটা তো এমন নাও হতে পারতো। আর দশটা মানুষের মতো সুখে ঘর সংসার করতে পারতি। স্নিগ্ধা না হল, ঐশী তো তোকে খুব ভালবাসত।" জাল ফেলতে ফেলতে ভাবে।
"ওটাকে ভালবাসা বলে না, ওটা ছিল কৈশোরের পাগলামি। এতোদিনে হয়তো আমাকে ভুলেই গেছে।" কবির বলে।
"আর স্নিগ্ধা? ওরটাও কি কৈশোরের পাগলামি ছিল? এতোদিনে ও কি তোকে ভুলে গেছে?"
"না। ওর চোখে আমি সবসময় আমার জন্য ভালবাসা দেখেছি।"
"ও কি তোকে ভুলে গেছে?" নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কবির।
"আমি জানি না। তবে জানতে চাই। অন্তত আর একটিবার ওর সাথে দেখা করতে চাই।"
"তো সোজা গিয়ে দেখা কর।"
"না এভাবে নয়। আমি ওর সাথে দেখা করতে যাব না। পৃথিবীটা গোল, কোন না কোনভাবে, পথে চলতে চলতে দেখা হয়েই যাবে। সেই দিনটি পর্যন্ত আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।"
জালে শুধু কিছু টেংরা, পুঁটি আর খলসা উঠেছে। সেগুলোকে নিয়ে কবির তার ঘরে ফিরে যায়। কেটে কুটে মাছগুলো লবন আর গুঁড়ো মরিচ দিয়ে মাখিয়ে আগুনে ঝলসিয়ে নেয়। চাল, ডাল, তেল মসলা সহ অনেক কিছুই এনেছিল কবির। দুই মাসের মধ্যে সব ফুরিয়ে গেছে। একমাস হল শুধু ঝলসানো মাছ খেয়ে বেঁচে আছে সে। কবির খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে এই চরে আর নয়। কিন্তু কোথাও যেতে হলে টাকার প্রয়োজন যা কবিরের কাছে নেই।
কবির উঠে তার জালটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে। এবার তীরে খুঁটির সাথে বাঁধা তার ডিঙি নৌকাটা নিয়ে মাছ ধরতে খোলা নদীতে বেরিয়ে পড়ে।
মাথার উপর গনগনে সুর্য যেন আগুন ঝরাচ্ছে, কবিরের গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। কবির তার পানির মগ দিয়ে নদী থেকে এক মগ পানি তুলে মাথায় ঢেলে দেয়। তারপর নৌকাতে গুটিয়ে রাখা জালটি দুহাতে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে কবির। জাল ফেলাটাও একটি আর্ট, একে রপ্ত করতে কবিরের বেশ সময় লেগেছে। মিনিটখানেক পর কবির জাল গোটানো শুরু করে। কয়েকটা পাবদা, টেংরা আর কায়াকাটা উঠেছে জালে।
"তোর ভাগ্য আজ ভাল না কবির।" নিজেই নিজেকে বলে কবির।
"খুব খারাপও না। মাত্র চার পাঁচ ঘন্টায় ভালই মাছ উঠেছে। তবে বড় মাছ ওঠেনি এখন অব্দি।" জবাব দেয় কবির।
"মাত্র এটুকু ছোট মাছ বিক্রি করে কতো টাকা পাবি? তোর তো অনেক টাকার প্রয়োজন। কমপক্ষ এক দেড় হাজার টাকা তো লাগবেই।"
"দেখা যাক কি হয়। মাত্র কয়েক ঘন্টায় হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না।"
"দুপুর হয়ে গেছে, চল কিছু খেয়ে আসা যাক।"
"হ্যাঁ ফিরব। তবে আরেকটু সামনে গিয়ে দুএকবার জাল ফেলে আসি।" বলে কবির দাঁড় বাইতে থাকে।
"ইচ্ছে হলে হারিয়ে যাও ব্যাস্ততার দেশে,
ঘর সংসার বাড়ি গাড়ির জানালার ওপাশে।
কথা দাও আসবে ফিরে, ফিরবে অবশেষে,
তোমায় নিয়ে উড়াল দেব রুপকথার দেশে।"
নৌকা বাইতে বাইতে আনমনে গেয়ে ওঠে কবির। কয়েক দিন আগে এই চরে বসে বসে কবির কবিতাটি লিখেছিল, কিন্তু এখন সেই কবিতাটি গানে পরিনত হল। তবে সুরটি কবিরের বেশ পছন্দ হল। কবির বাকি অংশটিও একই সুরে গাইতে থাকে।
"ইঁট পাথরের জঞ্জাল ছেড়ে যমুনা নদীর চর,
সেথায় হবে খড়ের ছাউনির তোমার আমার ঘর।
নদীর বুকে নাও ভাসিয়ে কাটবে বিকেল বেলা,
জোসনা রাতে উঠোন পারে বসবে স্মৃতির মেলা।"
"তোর কি মনে হয় স্নিগ্ধা ওর ঘর সংসার ছেড়ে তোর কাছে আসবে এই ডুবন্ত চরে মরার জন্য!" জাল ফেলতে ফেলতে কবির বলে।
"এখানে না হল অন্য কোথাও। নাইবা এলো ও, নাইবা হল দেখা। এই ইচ্ছেকে বয়ে বেড়াবো চিরকাল।" বলতে বলতে কবির জাল গুটাতে থাকে। এবার জালটা অনেক ভারী মনে হয়, নদীর তলদেশের কোন লতা পাতায় আটকে গেছে নাকি! কবির জালটা টেনে নদী পৃষ্ঠের কাছাকাছি তুলতে বুঝতে পারে জালে ভারী এবং ছটফটে কিছু একটা উঠেছে। কবীর সর্বশক্তি দিয়ে জাল টেনে তোলে। জালে বেশ বড়সর একটি আইড় মাছ উঠেছে, ওজন পাঁচ থেকে ছয় কেজি হবে। কবির মাছটাকে নৌকার ছইয়ের নিচে রেখে যতটা সম্ভব দ্রুত কিনারার দিকে ছুটতে থাকে। চরে পৌঁছে কবির তার ঘর থেকে একটি কোদাল এনে একটি গর্ত খুঁড়ে ফেলে, তাতে নদী থেকে পানি এনে ঢেলে দিয়ে ছোট একটি পুকুরের মতো তৈরী করে। তাতে মাছটিকে এনে ছেড়ে দেয়। মাছটা জ্যান্ত রাখতে পারলে বেশ ভাল দাম পাবে।
সারাদিন নদীতে মাছ ধরা শেষে কবির শীতলপাটি বিছিয়ে নদীর ধারে শুয়ে থাকে।
আকাশের মাঝামাঝি একফালি চাঁদ, আর সমগ্র আকাশ জুড়ে অজস্র তারা। তারা বা চাঁদ কারো সাথেই আজ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না কবিরের। কবির পাশ ফিরে নদীটির দিকে তাকায়। নদীটি জোছনার আলোয় চিক চিক করছে।
"কেমন আছেন যমুনা ম্যাডাম?" নদীর উদ্দেশ্য বলে।
"ভাল আছেন তো?"
"কথা বলছেন না কেন?"
"আপনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন?"
"আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে?"
"সত্যিই আমি খুব অকৃতজ্ঞ। এতোগুলো দিন আপনার আশ্রয়ে থাকলাম আর আপনাকে একটিবার ধন্যবাদ পর্যন্ত জানালাম না।"
"না ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোট করব না ম্যাডাম। নিন এ জীবন আপনাকে উত্সর্গ করে দিলাম। আপনি এই কুল ভেঙে কিংবা বড় কোন স্রোত এনে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যান।"
"একটাই রিকোয়েস্ট এ দেহটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভেসে তুলবেন না। তার চেয়ে বরং আপনার স্নেহের মাছদের খাইয়ে তাদের প্রাপ্য প্রতিশোধ মিটিয়ে দিবেন।"
"নিন, এই রাতটি আমি এখানেই আছি।"
একটু আগে হু হু করে বয়ে চলা বাতাসটি বদলে গেল ঝিরিঝিরি বাতাসে। কবির তাতে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরের দিন কবির ঘুম থেকে ওঠে খুব ভোরে। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আগেরদিন সারাদিন মাছ ধরে সে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের ছোট ও মাঝারি মাছ, একটি পাঁচ থেকে ছয় কেজি ওজনের আইড় মাছে এবং দুই থেকে তিন কেজি ওজনের একটি রুই মাছ যোগাড় করেছে। কবির মাছগুলোকে তার ডিঙি নৌকায় তোলে, তারপর ঘর থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ব্যাগে তুলে রওনা দিয়ে দেয়। প্রথমে সে নদীর কিনারায় একটি মাছের আড়তে গিয়ে ছোট ও মাঝারি মাছগুলো বিক্রি করে। বড় মাছ এখানে বিক্রি করেনা, কারন তাতে ভাল দাম পাবেনা সে। এরপর আবারও নদীর কুল বরাবর নৌকা বেয়ে কিছুদুর এগিয়ে একটি ফার্নিচারের দোকানে যায় কবির। সেখানে ফার্নিচারের পাশাপাশি নৌকাও তৈরী হয়। কবির নৌকাটি দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করে, অথচ চারমাস আগেই একই মিস্ত্রির কাছে থেকে নৌকাটি কিনেছিল ছয় হাজার টাকায়। কবির মাছের ডালাটি মাথায় নিয়ে রওনা দিয়ে দেয়। কিছুদুর হেঁটে, তারপর বাসে করে টাঙ্গাইল শহরে চলে আসে। টাঙ্গাইল বড়বাজারের রাস্তার পাশে তার মাছের ডালাটা নিয়ে বসে পড়ে। তবে কবিরকে মাছের ডালা নিয়ে বেশিক্ষন বসে থাকতে হয়না। দুঘন্টা পরই গাড়ি থামিয়ে একজন মহিলা দুটি মাছই কিনে নেয়। ততোক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে, কবির তার টাকা গুনে নেয়। তার রোজগার আট হাজার পাঁচশ টাকা। এরপর সে একটি সস্তা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেয়। কবির খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে সে এরপর কক্সবাজার যাবে। এমনিতে সমুদ্রের প্রতি টান কবিরের কখনোই ছিল না। এর আগে বান্দরবনের পাহাড়ে ছয় মাস থেকে এলেও কাছে কক্সবাজারে যায়নি সে। কিন্তু হঠাত কেন যেন নীলিমার প্রতি টানের সৃষ্টি হল তার।
কবিরের ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরে, মোটরের আওয়াজে। সম্ভবত কাছে দিয়ে কোন নৌকা গেছে। কবির তার নিমের ডালের মেসোয়াকটি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, বাইরে ঝলমলে দিন। কবির দাঁতে মেসওয়াক ঘষতে ঘষতে চারিদিকে দেখে। যমুনা নদীর একটি ছোট চর, তার মাঝামাঝিতে একটি খড়ের ছাউনির ঘর। ঘরটি কবির নিজের হাতে বানিয়েছে। কবির হেঁটে হেঁটে নদীর কিনারায় যায়।
"কিরে কবির, কি দেখছিস?"
"আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে, হালকা ফুরফুরে বাতাস বইছে, নদীর স্রোতও তেমন একটা নেই, নৌকা ভাসানোর জন্য পারফেক্ট দিন।"
"নৌকা ভাসাবি নাকি?"
"এখন না পরে।"
কবির নিজের সাথেই কথা বলে। এখানে তার সাথে কথা বলার কেউ নেই, এই পুরো চরে সে একা।
কবির নদীর পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ঘাসের উপর বসে দুর দিগন্তের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
"একসময় যমুনা ব্রীজের উপর দিয়ে বাসে করে যাওয়ার সময় নিচের এই চরগুলোর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম।" উদাস কন্ঠে বলে কবির।
"এখন কি সেই মুগ্ধতা আর নেই?" নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কবির।
"মুগ্ধতা এখনো আছে কিন্তু সাথে কেমন যেন বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবীর।
"চৈত্র মাসের তো প্রায় শেষের দিকে, এখন এই চর ছেড়ে না বের হলে কি পরিণতি হতে পারে জানিস? এখানে কালবৈশাখী কতো ভয়ংকর হতে পারে জানা আছে?" আবারও নিজেকে প্রশ্ন করে কবির।
"জানি। যদি কালবৈশাখী থেকে বেঁচেও যাই, এই চর ডুবে গেলে বাঁচতে পারব না।" আবারও নিজেই উত্তর দেয়।
"চর ডুবে যাবে?"
"হ্যাঁ প্রতিবছর হেমন্ত-শীতে এই চর জেগে ওঠে আর গ্রীষ্ম-বর্ষায় ডুবে যায়।"
"তাহলে তো শিঘ্রই এই চর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।"
"কেন যাব? আমার জীবনের সমাপ্তি যদি এখানেই হয় তবে এ জগতে কার বা কি এসে যাবে?" বলতে বলতে কবির উঠে নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
কবির তার ঘরে গিয়ে মাছ ধরার জাল নিয়ে আসে। ঘরের উত্তর দিকে নদীর পানি জমে একটি পুকুরের মত সৃষ্টি হয়েছে। সেই পুকুরটায় জাল ফেলে কবির।
"তোর জীবনটা তো এমন নাও হতে পারতো। আর দশটা মানুষের মতো সুখে ঘর সংসার করতে পারতি। স্নিগ্ধা না হল, ঐশী তো তোকে খুব ভালবাসত।" জাল ফেলতে ফেলতে ভাবে।
"ওটাকে ভালবাসা বলে না, ওটা ছিল কৈশোরের পাগলামি। এতোদিনে হয়তো আমাকে ভুলেই গেছে।" কবির বলে।
"আর স্নিগ্ধা? ওরটাও কি কৈশোরের পাগলামি ছিল? এতোদিনে ও কি তোকে ভুলে গেছে?"
"না। ওর চোখে আমি সবসময় আমার জন্য ভালবাসা দেখেছি।"
"ও কি তোকে ভুলে গেছে?" নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কবির।
"আমি জানি না। তবে জানতে চাই। অন্তত আর একটিবার ওর সাথে দেখা করতে চাই।"
"তো সোজা গিয়ে দেখা কর।"
"না এভাবে নয়। আমি ওর সাথে দেখা করতে যাব না। পৃথিবীটা গোল, কোন না কোনভাবে, পথে চলতে চলতে দেখা হয়েই যাবে। সেই দিনটি পর্যন্ত আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।"
জালে শুধু কিছু টেংরা, পুঁটি আর খলসা উঠেছে। সেগুলোকে নিয়ে কবির তার ঘরে ফিরে যায়। কেটে কুটে মাছগুলো লবন আর গুঁড়ো মরিচ দিয়ে মাখিয়ে আগুনে ঝলসিয়ে নেয়। চাল, ডাল, তেল মসলা সহ অনেক কিছুই এনেছিল কবির। দুই মাসের মধ্যে সব ফুরিয়ে গেছে। একমাস হল শুধু ঝলসানো মাছ খেয়ে বেঁচে আছে সে। কবির খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে এই চরে আর নয়। কিন্তু কোথাও যেতে হলে টাকার প্রয়োজন যা কবিরের কাছে নেই।
কবির উঠে তার জালটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে। এবার তীরে খুঁটির সাথে বাঁধা তার ডিঙি নৌকাটা নিয়ে মাছ ধরতে খোলা নদীতে বেরিয়ে পড়ে।
মাথার উপর গনগনে সুর্য যেন আগুন ঝরাচ্ছে, কবিরের গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। কবির তার পানির মগ দিয়ে নদী থেকে এক মগ পানি তুলে মাথায় ঢেলে দেয়। তারপর নৌকাতে গুটিয়ে রাখা জালটি দুহাতে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে কবির। জাল ফেলাটাও একটি আর্ট, একে রপ্ত করতে কবিরের বেশ সময় লেগেছে। মিনিটখানেক পর কবির জাল গোটানো শুরু করে। কয়েকটা পাবদা, টেংরা আর কায়াকাটা উঠেছে জালে।
"তোর ভাগ্য আজ ভাল না কবির।" নিজেই নিজেকে বলে কবির।
"খুব খারাপও না। মাত্র চার পাঁচ ঘন্টায় ভালই মাছ উঠেছে। তবে বড় মাছ ওঠেনি এখন অব্দি।" জবাব দেয় কবির।
"মাত্র এটুকু ছোট মাছ বিক্রি করে কতো টাকা পাবি? তোর তো অনেক টাকার প্রয়োজন। কমপক্ষ এক দেড় হাজার টাকা তো লাগবেই।"
"দেখা যাক কি হয়। মাত্র কয়েক ঘন্টায় হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না।"
"দুপুর হয়ে গেছে, চল কিছু খেয়ে আসা যাক।"
"হ্যাঁ ফিরব। তবে আরেকটু সামনে গিয়ে দুএকবার জাল ফেলে আসি।" বলে কবির দাঁড় বাইতে থাকে।
"ইচ্ছে হলে হারিয়ে যাও ব্যাস্ততার দেশে,
ঘর সংসার বাড়ি গাড়ির জানালার ওপাশে।
কথা দাও আসবে ফিরে, ফিরবে অবশেষে,
তোমায় নিয়ে উড়াল দেব রুপকথার দেশে।"
নৌকা বাইতে বাইতে আনমনে গেয়ে ওঠে কবির। কয়েক দিন আগে এই চরে বসে বসে কবির কবিতাটি লিখেছিল, কিন্তু এখন সেই কবিতাটি গানে পরিনত হল। তবে সুরটি কবিরের বেশ পছন্দ হল। কবির বাকি অংশটিও একই সুরে গাইতে থাকে।
"ইঁট পাথরের জঞ্জাল ছেড়ে যমুনা নদীর চর,
সেথায় হবে খড়ের ছাউনির তোমার আমার ঘর।
নদীর বুকে নাও ভাসিয়ে কাটবে বিকেল বেলা,
জোসনা রাতে উঠোন পারে বসবে স্মৃতির মেলা।"
"তোর কি মনে হয় স্নিগ্ধা ওর ঘর সংসার ছেড়ে তোর কাছে আসবে এই ডুবন্ত চরে মরার জন্য!" জাল ফেলতে ফেলতে কবির বলে।
"এখানে না হল অন্য কোথাও। নাইবা এলো ও, নাইবা হল দেখা। এই ইচ্ছেকে বয়ে বেড়াবো চিরকাল।" বলতে বলতে কবির জাল গুটাতে থাকে। এবার জালটা অনেক ভারী মনে হয়, নদীর তলদেশের কোন লতা পাতায় আটকে গেছে নাকি! কবির জালটা টেনে নদী পৃষ্ঠের কাছাকাছি তুলতে বুঝতে পারে জালে ভারী এবং ছটফটে কিছু একটা উঠেছে। কবীর সর্বশক্তি দিয়ে জাল টেনে তোলে। জালে বেশ বড়সর একটি আইড় মাছ উঠেছে, ওজন পাঁচ থেকে ছয় কেজি হবে। কবির মাছটাকে নৌকার ছইয়ের নিচে রেখে যতটা সম্ভব দ্রুত কিনারার দিকে ছুটতে থাকে। চরে পৌঁছে কবির তার ঘর থেকে একটি কোদাল এনে একটি গর্ত খুঁড়ে ফেলে, তাতে নদী থেকে পানি এনে ঢেলে দিয়ে ছোট একটি পুকুরের মতো তৈরী করে। তাতে মাছটিকে এনে ছেড়ে দেয়। মাছটা জ্যান্ত রাখতে পারলে বেশ ভাল দাম পাবে।
সারাদিন নদীতে মাছ ধরা শেষে কবির শীতলপাটি বিছিয়ে নদীর ধারে শুয়ে থাকে।
আকাশের মাঝামাঝি একফালি চাঁদ, আর সমগ্র আকাশ জুড়ে অজস্র তারা। তারা বা চাঁদ কারো সাথেই আজ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না কবিরের। কবির পাশ ফিরে নদীটির দিকে তাকায়। নদীটি জোছনার আলোয় চিক চিক করছে।
"কেমন আছেন যমুনা ম্যাডাম?" নদীর উদ্দেশ্য বলে।
"ভাল আছেন তো?"
"কথা বলছেন না কেন?"
"আপনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন?"
"আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে?"
"সত্যিই আমি খুব অকৃতজ্ঞ। এতোগুলো দিন আপনার আশ্রয়ে থাকলাম আর আপনাকে একটিবার ধন্যবাদ পর্যন্ত জানালাম না।"
"না ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোট করব না ম্যাডাম। নিন এ জীবন আপনাকে উত্সর্গ করে দিলাম। আপনি এই কুল ভেঙে কিংবা বড় কোন স্রোত এনে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যান।"
"একটাই রিকোয়েস্ট এ দেহটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভেসে তুলবেন না। তার চেয়ে বরং আপনার স্নেহের মাছদের খাইয়ে তাদের প্রাপ্য প্রতিশোধ মিটিয়ে দিবেন।"
"নিন, এই রাতটি আমি এখানেই আছি।"
একটু আগে হু হু করে বয়ে চলা বাতাসটি বদলে গেল ঝিরিঝিরি বাতাসে। কবির তাতে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরের দিন কবির ঘুম থেকে ওঠে খুব ভোরে। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আগেরদিন সারাদিন মাছ ধরে সে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের ছোট ও মাঝারি মাছ, একটি পাঁচ থেকে ছয় কেজি ওজনের আইড় মাছে এবং দুই থেকে তিন কেজি ওজনের একটি রুই মাছ যোগাড় করেছে। কবির মাছগুলোকে তার ডিঙি নৌকায় তোলে, তারপর ঘর থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ব্যাগে তুলে রওনা দিয়ে দেয়। প্রথমে সে নদীর কিনারায় একটি মাছের আড়তে গিয়ে ছোট ও মাঝারি মাছগুলো বিক্রি করে। বড় মাছ এখানে বিক্রি করেনা, কারন তাতে ভাল দাম পাবেনা সে। এরপর আবারও নদীর কুল বরাবর নৌকা বেয়ে কিছুদুর এগিয়ে একটি ফার্নিচারের দোকানে যায় কবির। সেখানে ফার্নিচারের পাশাপাশি নৌকাও তৈরী হয়। কবির নৌকাটি দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করে, অথচ চারমাস আগেই একই মিস্ত্রির কাছে থেকে নৌকাটি কিনেছিল ছয় হাজার টাকায়। কবির মাছের ডালাটি মাথায় নিয়ে রওনা দিয়ে দেয়। কিছুদুর হেঁটে, তারপর বাসে করে টাঙ্গাইল শহরে চলে আসে। টাঙ্গাইল বড়বাজারের রাস্তার পাশে তার মাছের ডালাটা নিয়ে বসে পড়ে। তবে কবিরকে মাছের ডালা নিয়ে বেশিক্ষন বসে থাকতে হয়না। দুঘন্টা পরই গাড়ি থামিয়ে একজন মহিলা দুটি মাছই কিনে নেয়। ততোক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে, কবির তার টাকা গুনে নেয়। তার রোজগার আট হাজার পাঁচশ টাকা। এরপর সে একটি সস্তা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেয়। কবির খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে সে এরপর কক্সবাজার যাবে। এমনিতে সমুদ্রের প্রতি টান কবিরের কখনোই ছিল না। এর আগে বান্দরবনের পাহাড়ে ছয় মাস থেকে এলেও কাছে কক্সবাজারে যায়নি সে। কিন্তু হঠাত কেন যেন নীলিমার প্রতি টানের সৃষ্টি হল তার।