16-06-2021, 08:13 PM
পরেরদিন সকাল সাতটার সময় প্রতিদিনের মতো সজলকে জাগানোর চেষ্টা করে স্নিগ্ধা। কিন্তু আজ কিছুতেই জাগাতে পারেনা। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে জাগানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয় স্নিগ্ধা। সজল যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন এগারোটা বাজে। সজল ঘুম থেকে উঠে ব্রাশে টুথ পেস্ট ভরে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে দাঁতব্রাস করতে থাকে।
"আজ অফিস নেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
সজল কোন জবাব দেয়না, একমনে দাঁতব্রাস করতে থাকে।
"কাল রাতে ড্রিংক করেছিলে?" আবারও জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
সজল এবারও কিছু বলে না। বেসিনে হাতমুখ ধোয় সে।
"আমি কিছু জিজ্ঞাসা করেছি। শুনতে পাচ্ছ না?" স্নিগ্ধা প্রায় চেঁচিয়ে বলে।
"সকাল সকাল কি শুরু করলে। সবই যখন জানোই তখন জিজ্ঞাসা করছো কেন?"
"তুমি রোজ রোজ মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে থাকবে, আমি চিন্তায় পাগল হতে থাকব, আর গোপালদা তোমাকে খুঁজে টেনে ছেঁচড়ে নিয়ে আসবে। আর তোমাকে কিছুই বলা যাবেনা!" স্নিগ্ধা বলে।
"আমার ইচ্ছা হয়েছে, আমি মদ খেয়েছি। তোমারও যা ইচ্ছা হয় তাই বল, আমি শুনছি।" সজল বলে।
"তুমি তো আগে এমন ছিলে না। কি হয়েছে খুলে বলছো না কেন? যদি অফিসে কোন প্রবলেম হয় তো চাকরিটা ছেড়েই দাও। তুমি বুয়েট গ্রাজুয়েট, একমাসের ভেতরেই চাকরি যোগাড় করতে পারবে।"
"চাকরী ছেড়ে দিলেই যদি সব প্রবলেম সল্ভ হয়ে যেত তাহলে কবেই চাকরী ছেড়ে দিতাম।"
"প্রবলেমটা কি বলবে তো।" স্নিগ্ধা বলে।
"তোমার কাছে লুকিয়ে আর লাভ নেই। আমি ফেঁসে গেছি স্নিগ্ধা, আমি খুব খারাপভাবে ফেঁসে গেছি।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সজল।
"কি হয়েছে?" উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
"তোমার তো মনে আছে কোম্পানির দুর্নীতির প্রমানপত্র সহ একটি ফাইল আমি ইরফান স্যারকে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম যে হারামি বদরুল যদি জানতে পারে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আমার সে নিয়ে চিন্তা ছিলনা তেমন একটা, ভেবেছিলাম বড়জোর চাকরি হারাবো। সে আমি তুড়ি মেরে আরেকটা যোগাড় করতে পারি। কিন্তু হারামিটা যে এমন কিছু করতে পারে আমি ধারনাও করিনি।"
"কি করেছে সে?" আবারও উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"বলছি শোনো। ইরফান স্যারের মৃত্যুর দুইদিন আগে বদরুল আমাকে তার চেম্বারে ডেকে নেয়। আমার হাতে একটি ব্রিফকেস ধরিয়ে দিয়ে বলে যে ওটাতে পঁচিশ লাখ টাকা আছে তা একটা ঠিকানায় পৌঁছাতে হবে। আমি কারন জিজ্ঞাসা করি। ও বলে যে পঞ্চাশ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য ক্লায়েন্ট কোম্পানির জিএমকে টাকাটা দেয়া হচ্ছে। আমি জানতাম যে এইধরনের দুইনাম্বারি হরহামেশাই হয়ে থাকে, কিন্তু সেসব ডিল করে মার্কেটিং অফিসাররা। সেই প্রশ্ন করাতে আমাকে বলে যে সব মার্কেটিং অফিসাররা অন্যান্য ডিল নিয়ে ব্যাস্ত। তারপর আমি টাকাটা নিয়ে যাই। আমাকে বলা হয়েছিল ক্লায়েন্ট কোম্পানির জিএমের ড্রাইভার টাকাটা নিতে আসবে। একটি রেস্টুরেন্টের ঠিকানা। আমি টাকাটা দিয়ে আসি। কিন্তু আমি জানতাম না যে ওটা কোন প্রজেক্টের ডিল ছিলনা বরং জিএম স্যারের হত্যার ডীল আর ওইখানে লুকানো ক্যামেরা ছিল যাতে স্পষ্ট রেকর্ড হয়েছে যে আমি ঘাতক ট্রাক ড্রাইভারকে টাকাটা দিয়েছি।"
"কি বলছ তুমি!" অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"গত বুধবার আমাকে ডেকে নিয়ে রেকর্ডটা দেখিয়েছে। শুধু ভিডিও ক্লিপ নয়। দুর্নিতির রিপোর্টটা এমনভাবে সাজিয়েছে যে সব চুরি ও দুর্নীতির জন্য দায়ী আমি।" সজল বলে।
"ও পুলিশকে বলার আগেই তুমি সবকিছু খুলে বলে দাও পুলিশকে।" স্নিগ্ধা বলে।
"লাভ নেই তাতে। জানোয়ারটার হাতে এতো পোক্ত প্রমান যে তাতে লাভ নেই। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সজল।
একটু থেমে আবার বলে "আগামীকাল পুলিশ আসবে আমাকে নিতে। তারপর থেকে আমার স্বাধীন জীবন শেষ। হয় ফাঁসি হবে নয়তো যাবজ্জীবন কারাদন্ড।"
"না এ আমি হতে দিবনা।" সজলকে জড়িয়ে ধরে বলে স্নিগ্ধা।
একটু থেমে আবার বলে "কিন্তু জানোয়ারটা তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিল কেন? ও কি তোমাকে ব্লাকমেইল করছে?"
সজল হ্যাঁ বোধকভাবে মাথা নাড়ে সজল।
"কি চায় ও?"
"তোমাকে চায়, চব্বিশ ঘন্টার জন্য।"
"কি বলছ তুমি!" ভীষনভাবে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা, সাথে সাথে বদরুলের নোংরা দৃষ্টির কথা মনে পড়ে যায়।
তিন মিনিট নিরবতায় কেটে যায়।
"আচ্ছা, মনে কর আমি ওর শর্তে রাজি হলাম। কিন্তু কি নিশ্চয়তা আছে যে শয়তানটা তোমাকে ফাঁসিয়ে দেবে না?" শীতল কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কোন নিশ্চয়তা নেই। শুয়রের বাচ্চাটা যা কিছু করতে পারে। আমি গত এক সপ্তাহ ধরে একটি রিভলবার খুঁজছিলাম, পাইনি। তবে একটা জিনিস পেয়েছি।" বলে নিজের ব্যাগের পকেট থেকে ছোট একটা শিশি বের করে বলে "এই দেখ, পটাশিয়াম সাইনাইড"।
"এই কি পাগলামো করো!" স্নিগ্ধা আঁতকে উঠে বলে।
"ভয় পেয়ো না। আত্মহত্যা করব না। দেখাচ্ছি।" বলে রান্নাঘরে যায় সবজি কাটার নিতে। তারপর বলে "এখনই অফিসে যাব, গিয়ে শুয়োরটার ভুঁড়ি এটা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেব। আমার হয়তো ফাঁসি হবে কিন্তু শুয়োরটাও বাঁচবে না।"
স্নিগ্ধা সজলের হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে।
"কি পাগলামো করছো!"
আরো এক মিনিট নিরবতায় কেটে যায়।
"শয়তানটার রাগ আছে তোমার প্রতি, সেই রাগ হয়তো আমার ওপর মেটাবে। ও হয়তো চাইবে না যে কেইস এক্সিডেন্ট কেস হিসাবে চাপা পড়ে গেছে তা পুনরায় জেগে উঠুক। তাতে ওর ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে।" শান্ত স্বরে বলে স্নিগ্ধা। ওর ফর্সা গালদুটি অশ্রুজলে ভিজে গেছে।
বিকেল চারটা বাজে, স্নিগ্ধা ও সজল বদরুলের বনশ্রীর বাড়িটির সামনে এসে দাড়িয়েছে। ওরা বদরুলের কথা মতো এখানে এসেছে।
"স্নিগ্ধা, প্লিজ, কথা শোন, এ আমি হতে দিতে পারিনা।" স্নিগ্ধার হাতটা টেনে ধরে সজল বলে।
"এ ছাড়া কোন উপায় নেই। তুমি চলে যাও সজল, তুমি থাকলে জানোয়ারটা তোমাকে অপমান করবে।" বলে সজলের কাছে থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
লিফটে করে ফিফথ ফ্লোরে এসে স্নিগ্ধা কলিংবেল টেপে, এক মিনিট পর দরজা খুলে যায়। দরজার ওপাশে চওড়া হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে বদরুল। সেই হাসির সামনে নিজেকে খুব অসহায় লাগে স্নিগ্ধার।
"এসো স্নিগ্ধা, তোমারই অপেক্ষায় আছি অনেক্ষন ধরে।" মুখে হাসি ধরে রেখে বলে বদরুল। স্নিগ্ধা ভেতরে আসে।
"সজল আসেনি? না এনে ভালই করেছ।" পেছনে উঁকি দিয়ে বলে বদরুল।
স্নিগ্ধাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসতে বলে বদরুল। স্নিগ্ধা এগিয়ে যায় ড্রয়িংরুমের দিকে। দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে পেছন থেকে স্নিগ্ধাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে বদরুল। গোলাপি একটি কামিজ পরে এসেছে স্নিগ্ধা, মুখে মেকাপের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া, দীঘল কালো রেশমী চুল সারা পিঠ জুড়ে।
দরজা লাগিয়ে দিয়ে বদরুল স্নিগ্ধার পাশে এসে বসে।
"কি খাবে বলো? চা নাকি কফি?" বদরুল বলে।
"কিছু না।" স্নিগ্ধা যতোটা সম্ভব শান্ত স্বরে বলে।
"তুমি চাইলেও এনে দিতে পারতাম না। চাকরবাকর সবাইকে তো ছুটি দিয়ে দিয়েছি।" বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বদরুল।
হাসি থামিয়ে আবার বলে "তবে ড্রিংকস বানাতে পারি। কি খাবে বল? হুইস্কি নাকি ব্র্যান্ডি?"
"আমি ওসব খাইনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"আগে খাওনি, ভাল কথা, অন্তত ওয়াইন নাও। শরীরের জন্য খুব ভাল।"
স্নিগ্ধা মাথা নেড়ে আপত্তি জানায়।
"তাহলে তোমার পাশে বসে ড্রিংক করলে কোন আপত্তি নেই তো।" বদরুল বলে।
স্নিগ্ধা কোন জবাব দেয়না। বদরুল জবাবের অপেক্ষা না করে টেবিলের অন্যপাশ থেকে হুইস্কি আর সোডার বোতল টেনে নেয়। এমনিতে সে সাধারনত দিনের বেলা ড্রিংক করেনা। কিন্তু আজ আর দশটা দিনের মতো নয়। আজ তার অধীনস্থ কর্মচারীর সুন্দরী স্ত্রী তার পাশে বসে আছে, সে চায় তাকে মন ভরে ভোগ করতে। দু পেগ স্কচ পেটে না ঢাললে ঠিক মুড আসবে না।
"জানো স্নিগ্ধা, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তুমি। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমাকে একটু কাছে পাবার জন্য কেমন যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু আমি নয়, আমার যায়গায় যেকোন পুরুষ থাকলে তাই করতো যা আমি করেছি।" এক পেগ স্কচ পেটে চালান করে দিয়ে বলে বদরুল।
স্বামীকে বাঁচানোর জন্য যেকোন ধরনের নির্যাতন, লাঞ্ছনা সহ্য করার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করছিল স্নিগ্ধা, কিন্তু বাবার বয়সী এক নোংরা পুরুষের মুখে এমন কিশোরসুলভ ফ্লার্ট শুনে স্নিগ্ধার গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। এবার আর চুপ থাকতে পারল না সে।
"অধীনস্থ কর্মচারীকে ব্ল্যাকমেইল করে তার স্ত্রীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ''. করতে চাইছেন, আর মুখে মিষ্টি মিষ্টি বুলি! আপনার ঐ নোংরা মুখে প্রেমের মতো পবিত্র শব্দ মানায় না।" তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কি বলছ এসব? আমি ব্ল্যাকমেইল করেছি?" ভীষন অবাক হয়ে বলে বদরুল।
"আপনি সজলকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন নি?" স্নিগ্ধা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
"সজল তোমাকে এ কথা বলেছে?" বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সজলকে কল দেয়।
"সজল, কোথায় তুমি? এক্ষুনি আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো।" বলে ফোন কেটে দেয় বদরুল।
সজলের পৌঁছাতে আরো আধা ঘন্টা লেগে যায়।
"সজল, কি বলেছ স্নিগ্ধাকে আমার নামে? আমাকে তুমি বি-গ্রেড সিনেমার ভিলেন বানিয়ে দিলে? আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছি?" রাগত স্বরে বলে বদরুল।
"আসলে স্যার, ও তো রাজি হতো না।" সজল আমতা আমতা করে বলে।
"ওকে সব সত্যি সত্যি বলে দাও, আমার সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু আমি ধর্ষক হতে চাই না।" একটু থেমে বদরুল বলে "আমিই বলছি। সজল আর আমার মধ্যে একটি ডিল হয়েছে। আমি ওর প্রমোশনের ব্যবস্থা করে দেব, আর ও তার বিনিময়ে একটা দিনের জন্য। ডিলটা একেবারেই খারাপ নয়, মাত্র দুই তিন বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে কেউ এজিএম হতে পারে এমনটা কখনো দেখেছ?"
একটু থেমে আবার বলে "আমি কিছু ভুল বললাম, সজল?"
স্নিগ্ধা ওখানেই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। ওর গাল বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে।
"স্নিগ্ধা প্লিজ লেট মি এক্সপ্লেইন।" সজল অনুরোধের সুরে বলে।
"আমাকে কিচ্ছু বোঝাতে হবেনা তোমার। আমি সব বুঝে গেছি। তোমার মতো নিচ, নরকের কীটকে যে আমি ভালবেসেছিলাম, ভেবে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে।" বলে স্নিগ্ধা হন হন করে হেঁটে যেতে চায়।
"প্লিজ, দাড়াও।" বলে সজল ওর হাত টেনে ধরে। স্নিগ্ধা অন্য হাত দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দেয় সজলের গালে। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে "আমাকে ছোঁবেনা তুমি। তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।" তারপর ফ্লাট থেকে বেরিয়ে যায়।
"আজ অফিস নেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
সজল কোন জবাব দেয়না, একমনে দাঁতব্রাস করতে থাকে।
"কাল রাতে ড্রিংক করেছিলে?" আবারও জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
সজল এবারও কিছু বলে না। বেসিনে হাতমুখ ধোয় সে।
"আমি কিছু জিজ্ঞাসা করেছি। শুনতে পাচ্ছ না?" স্নিগ্ধা প্রায় চেঁচিয়ে বলে।
"সকাল সকাল কি শুরু করলে। সবই যখন জানোই তখন জিজ্ঞাসা করছো কেন?"
"তুমি রোজ রোজ মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে থাকবে, আমি চিন্তায় পাগল হতে থাকব, আর গোপালদা তোমাকে খুঁজে টেনে ছেঁচড়ে নিয়ে আসবে। আর তোমাকে কিছুই বলা যাবেনা!" স্নিগ্ধা বলে।
"আমার ইচ্ছা হয়েছে, আমি মদ খেয়েছি। তোমারও যা ইচ্ছা হয় তাই বল, আমি শুনছি।" সজল বলে।
"তুমি তো আগে এমন ছিলে না। কি হয়েছে খুলে বলছো না কেন? যদি অফিসে কোন প্রবলেম হয় তো চাকরিটা ছেড়েই দাও। তুমি বুয়েট গ্রাজুয়েট, একমাসের ভেতরেই চাকরি যোগাড় করতে পারবে।"
"চাকরী ছেড়ে দিলেই যদি সব প্রবলেম সল্ভ হয়ে যেত তাহলে কবেই চাকরী ছেড়ে দিতাম।"
"প্রবলেমটা কি বলবে তো।" স্নিগ্ধা বলে।
"তোমার কাছে লুকিয়ে আর লাভ নেই। আমি ফেঁসে গেছি স্নিগ্ধা, আমি খুব খারাপভাবে ফেঁসে গেছি।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সজল।
"কি হয়েছে?" উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
"তোমার তো মনে আছে কোম্পানির দুর্নীতির প্রমানপত্র সহ একটি ফাইল আমি ইরফান স্যারকে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম যে হারামি বদরুল যদি জানতে পারে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আমার সে নিয়ে চিন্তা ছিলনা তেমন একটা, ভেবেছিলাম বড়জোর চাকরি হারাবো। সে আমি তুড়ি মেরে আরেকটা যোগাড় করতে পারি। কিন্তু হারামিটা যে এমন কিছু করতে পারে আমি ধারনাও করিনি।"
"কি করেছে সে?" আবারও উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"বলছি শোনো। ইরফান স্যারের মৃত্যুর দুইদিন আগে বদরুল আমাকে তার চেম্বারে ডেকে নেয়। আমার হাতে একটি ব্রিফকেস ধরিয়ে দিয়ে বলে যে ওটাতে পঁচিশ লাখ টাকা আছে তা একটা ঠিকানায় পৌঁছাতে হবে। আমি কারন জিজ্ঞাসা করি। ও বলে যে পঞ্চাশ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য ক্লায়েন্ট কোম্পানির জিএমকে টাকাটা দেয়া হচ্ছে। আমি জানতাম যে এইধরনের দুইনাম্বারি হরহামেশাই হয়ে থাকে, কিন্তু সেসব ডিল করে মার্কেটিং অফিসাররা। সেই প্রশ্ন করাতে আমাকে বলে যে সব মার্কেটিং অফিসাররা অন্যান্য ডিল নিয়ে ব্যাস্ত। তারপর আমি টাকাটা নিয়ে যাই। আমাকে বলা হয়েছিল ক্লায়েন্ট কোম্পানির জিএমের ড্রাইভার টাকাটা নিতে আসবে। একটি রেস্টুরেন্টের ঠিকানা। আমি টাকাটা দিয়ে আসি। কিন্তু আমি জানতাম না যে ওটা কোন প্রজেক্টের ডিল ছিলনা বরং জিএম স্যারের হত্যার ডীল আর ওইখানে লুকানো ক্যামেরা ছিল যাতে স্পষ্ট রেকর্ড হয়েছে যে আমি ঘাতক ট্রাক ড্রাইভারকে টাকাটা দিয়েছি।"
"কি বলছ তুমি!" অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"গত বুধবার আমাকে ডেকে নিয়ে রেকর্ডটা দেখিয়েছে। শুধু ভিডিও ক্লিপ নয়। দুর্নিতির রিপোর্টটা এমনভাবে সাজিয়েছে যে সব চুরি ও দুর্নীতির জন্য দায়ী আমি।" সজল বলে।
"ও পুলিশকে বলার আগেই তুমি সবকিছু খুলে বলে দাও পুলিশকে।" স্নিগ্ধা বলে।
"লাভ নেই তাতে। জানোয়ারটার হাতে এতো পোক্ত প্রমান যে তাতে লাভ নেই। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সজল।
একটু থেমে আবার বলে "আগামীকাল পুলিশ আসবে আমাকে নিতে। তারপর থেকে আমার স্বাধীন জীবন শেষ। হয় ফাঁসি হবে নয়তো যাবজ্জীবন কারাদন্ড।"
"না এ আমি হতে দিবনা।" সজলকে জড়িয়ে ধরে বলে স্নিগ্ধা।
একটু থেমে আবার বলে "কিন্তু জানোয়ারটা তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিল কেন? ও কি তোমাকে ব্লাকমেইল করছে?"
সজল হ্যাঁ বোধকভাবে মাথা নাড়ে সজল।
"কি চায় ও?"
"তোমাকে চায়, চব্বিশ ঘন্টার জন্য।"
"কি বলছ তুমি!" ভীষনভাবে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা, সাথে সাথে বদরুলের নোংরা দৃষ্টির কথা মনে পড়ে যায়।
তিন মিনিট নিরবতায় কেটে যায়।
"আচ্ছা, মনে কর আমি ওর শর্তে রাজি হলাম। কিন্তু কি নিশ্চয়তা আছে যে শয়তানটা তোমাকে ফাঁসিয়ে দেবে না?" শীতল কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কোন নিশ্চয়তা নেই। শুয়রের বাচ্চাটা যা কিছু করতে পারে। আমি গত এক সপ্তাহ ধরে একটি রিভলবার খুঁজছিলাম, পাইনি। তবে একটা জিনিস পেয়েছি।" বলে নিজের ব্যাগের পকেট থেকে ছোট একটা শিশি বের করে বলে "এই দেখ, পটাশিয়াম সাইনাইড"।
"এই কি পাগলামো করো!" স্নিগ্ধা আঁতকে উঠে বলে।
"ভয় পেয়ো না। আত্মহত্যা করব না। দেখাচ্ছি।" বলে রান্নাঘরে যায় সবজি কাটার নিতে। তারপর বলে "এখনই অফিসে যাব, গিয়ে শুয়োরটার ভুঁড়ি এটা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেব। আমার হয়তো ফাঁসি হবে কিন্তু শুয়োরটাও বাঁচবে না।"
স্নিগ্ধা সজলের হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে।
"কি পাগলামো করছো!"
আরো এক মিনিট নিরবতায় কেটে যায়।
"শয়তানটার রাগ আছে তোমার প্রতি, সেই রাগ হয়তো আমার ওপর মেটাবে। ও হয়তো চাইবে না যে কেইস এক্সিডেন্ট কেস হিসাবে চাপা পড়ে গেছে তা পুনরায় জেগে উঠুক। তাতে ওর ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে।" শান্ত স্বরে বলে স্নিগ্ধা। ওর ফর্সা গালদুটি অশ্রুজলে ভিজে গেছে।
বিকেল চারটা বাজে, স্নিগ্ধা ও সজল বদরুলের বনশ্রীর বাড়িটির সামনে এসে দাড়িয়েছে। ওরা বদরুলের কথা মতো এখানে এসেছে।
"স্নিগ্ধা, প্লিজ, কথা শোন, এ আমি হতে দিতে পারিনা।" স্নিগ্ধার হাতটা টেনে ধরে সজল বলে।
"এ ছাড়া কোন উপায় নেই। তুমি চলে যাও সজল, তুমি থাকলে জানোয়ারটা তোমাকে অপমান করবে।" বলে সজলের কাছে থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
লিফটে করে ফিফথ ফ্লোরে এসে স্নিগ্ধা কলিংবেল টেপে, এক মিনিট পর দরজা খুলে যায়। দরজার ওপাশে চওড়া হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে বদরুল। সেই হাসির সামনে নিজেকে খুব অসহায় লাগে স্নিগ্ধার।
"এসো স্নিগ্ধা, তোমারই অপেক্ষায় আছি অনেক্ষন ধরে।" মুখে হাসি ধরে রেখে বলে বদরুল। স্নিগ্ধা ভেতরে আসে।
"সজল আসেনি? না এনে ভালই করেছ।" পেছনে উঁকি দিয়ে বলে বদরুল।
স্নিগ্ধাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসতে বলে বদরুল। স্নিগ্ধা এগিয়ে যায় ড্রয়িংরুমের দিকে। দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে পেছন থেকে স্নিগ্ধাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে বদরুল। গোলাপি একটি কামিজ পরে এসেছে স্নিগ্ধা, মুখে মেকাপের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া, দীঘল কালো রেশমী চুল সারা পিঠ জুড়ে।
দরজা লাগিয়ে দিয়ে বদরুল স্নিগ্ধার পাশে এসে বসে।
"কি খাবে বলো? চা নাকি কফি?" বদরুল বলে।
"কিছু না।" স্নিগ্ধা যতোটা সম্ভব শান্ত স্বরে বলে।
"তুমি চাইলেও এনে দিতে পারতাম না। চাকরবাকর সবাইকে তো ছুটি দিয়ে দিয়েছি।" বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বদরুল।
হাসি থামিয়ে আবার বলে "তবে ড্রিংকস বানাতে পারি। কি খাবে বল? হুইস্কি নাকি ব্র্যান্ডি?"
"আমি ওসব খাইনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"আগে খাওনি, ভাল কথা, অন্তত ওয়াইন নাও। শরীরের জন্য খুব ভাল।"
স্নিগ্ধা মাথা নেড়ে আপত্তি জানায়।
"তাহলে তোমার পাশে বসে ড্রিংক করলে কোন আপত্তি নেই তো।" বদরুল বলে।
স্নিগ্ধা কোন জবাব দেয়না। বদরুল জবাবের অপেক্ষা না করে টেবিলের অন্যপাশ থেকে হুইস্কি আর সোডার বোতল টেনে নেয়। এমনিতে সে সাধারনত দিনের বেলা ড্রিংক করেনা। কিন্তু আজ আর দশটা দিনের মতো নয়। আজ তার অধীনস্থ কর্মচারীর সুন্দরী স্ত্রী তার পাশে বসে আছে, সে চায় তাকে মন ভরে ভোগ করতে। দু পেগ স্কচ পেটে না ঢাললে ঠিক মুড আসবে না।
"জানো স্নিগ্ধা, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তুমি। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমাকে একটু কাছে পাবার জন্য কেমন যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু আমি নয়, আমার যায়গায় যেকোন পুরুষ থাকলে তাই করতো যা আমি করেছি।" এক পেগ স্কচ পেটে চালান করে দিয়ে বলে বদরুল।
স্বামীকে বাঁচানোর জন্য যেকোন ধরনের নির্যাতন, লাঞ্ছনা সহ্য করার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করছিল স্নিগ্ধা, কিন্তু বাবার বয়সী এক নোংরা পুরুষের মুখে এমন কিশোরসুলভ ফ্লার্ট শুনে স্নিগ্ধার গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। এবার আর চুপ থাকতে পারল না সে।
"অধীনস্থ কর্মচারীকে ব্ল্যাকমেইল করে তার স্ত্রীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ''. করতে চাইছেন, আর মুখে মিষ্টি মিষ্টি বুলি! আপনার ঐ নোংরা মুখে প্রেমের মতো পবিত্র শব্দ মানায় না।" তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কি বলছ এসব? আমি ব্ল্যাকমেইল করেছি?" ভীষন অবাক হয়ে বলে বদরুল।
"আপনি সজলকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন নি?" স্নিগ্ধা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
"সজল তোমাকে এ কথা বলেছে?" বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সজলকে কল দেয়।
"সজল, কোথায় তুমি? এক্ষুনি আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো।" বলে ফোন কেটে দেয় বদরুল।
সজলের পৌঁছাতে আরো আধা ঘন্টা লেগে যায়।
"সজল, কি বলেছ স্নিগ্ধাকে আমার নামে? আমাকে তুমি বি-গ্রেড সিনেমার ভিলেন বানিয়ে দিলে? আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছি?" রাগত স্বরে বলে বদরুল।
"আসলে স্যার, ও তো রাজি হতো না।" সজল আমতা আমতা করে বলে।
"ওকে সব সত্যি সত্যি বলে দাও, আমার সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু আমি ধর্ষক হতে চাই না।" একটু থেমে বদরুল বলে "আমিই বলছি। সজল আর আমার মধ্যে একটি ডিল হয়েছে। আমি ওর প্রমোশনের ব্যবস্থা করে দেব, আর ও তার বিনিময়ে একটা দিনের জন্য। ডিলটা একেবারেই খারাপ নয়, মাত্র দুই তিন বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে কেউ এজিএম হতে পারে এমনটা কখনো দেখেছ?"
একটু থেমে আবার বলে "আমি কিছু ভুল বললাম, সজল?"
স্নিগ্ধা ওখানেই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। ওর গাল বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে।
"স্নিগ্ধা প্লিজ লেট মি এক্সপ্লেইন।" সজল অনুরোধের সুরে বলে।
"আমাকে কিচ্ছু বোঝাতে হবেনা তোমার। আমি সব বুঝে গেছি। তোমার মতো নিচ, নরকের কীটকে যে আমি ভালবেসেছিলাম, ভেবে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে।" বলে স্নিগ্ধা হন হন করে হেঁটে যেতে চায়।
"প্লিজ, দাড়াও।" বলে সজল ওর হাত টেনে ধরে। স্নিগ্ধা অন্য হাত দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দেয় সজলের গালে। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে "আমাকে ছোঁবেনা তুমি। তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।" তারপর ফ্লাট থেকে বেরিয়ে যায়।