16-06-2021, 08:12 PM
প্রায় আধাঘন্টা ধরে জ্যামে আটকে আছে সজল। তার মেজাজটা বেশ খারাপ। রাত সাড়ে আটটা বাজে, সাইট থেকে সবে ফিরছে সে, এখন অফিসে যেতে হবে তারপর ছুটি তার। নতুন কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার তার অধীনে দিয়েছে কোম্পানি, তাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিতে দিতে মাথা ব্যাথা ধরে গেছে, স্নিগ্ধার হাতের কড়া এক কাপ চা না খেলে এই ব্যাথা ছাড়বে না। জ্যামটা ছেড়ে দিতেই সজল বাইক স্টার্ট দিয়ে ফার্মগেটের সিগনালটা পার হয়ে আসে। সাথে সাথে তার পকেটে ভাইব্রেশন সহ রিংটোন বেজে ওঠে। সজল বাইকটা সাইড করে ফোনটা রিসিভ করে।
"হ্যালো সজল, কোথায় তুমি?" বদরুলের কর্কশ কন্ঠ শুনতে পায়।
"স্যার, মতিঝিলের সাইট থেকে ফিরছি, এখন ফার্মগেটের পার হলাম।"
"জরুরি কথা আছে, এক্ষুনি দেখা করতে পারবে?"
"ওকে স্যার, আমি অফিসে আসছি।"
"অফিসে নয়। আমি ঠিকানা দিচ্ছি, চলে এসো।" বদরুল বলে।
সজল কলম ও পকেট ডায়েরি বের করে ঠিকানা লিখে নেয়।
বনশ্রীর একটি ঠিকানা। মনে মনে দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে সজল, কিছুদিন আগে সেরেনা টাওয়ারের স্ক্যামের রিপোর্ট ও যাবতীয় প্রমান জেনারেল ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়েছে। সে কথা তার কানে যায়নি তো। দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সজল বাইক চালানোর দিকে মন দেয়।
বনশ্রীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সজলের আরো আধা ঘন্টা লেগে যায়। সজল বাইকটা থামিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে, স্নিগ্ধার তিনটি মিসডকল। সজল কল ব্যাক করে।
"স্নিগ্ধা, আমার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হতে পারে।" সজল বলে।
"কেন?"
"একটি জরুরি মিটিং রয়েছে, রাখি।" বলে সজল ফোন কেটে দেয়।
তারপর সামনের ছয়তলা বাড়িটার দিকে যায় সজল। গেটের পাশে শ্বেতপাথরে খোদাই করে বাড়ির নাম ও মালিকের নাম লেখা। মালিকের নাম দেখে অবাক হয়ে যায় সজল। আগে জানত ঢাকা শহরে বদরুল ভুঁইয়ার দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে, ধানমন্ডিতে একটি, অন্যটি তেজগাঁ। কিন্তু বনশ্রীতে আস্ত ছয় তলা বাড়ি! আরো কত কি আছে কে জানে!
সজল দারোয়ানকে গিয়ে নিজের নাম ও কার কাছে এসেছে তা বলতেই গেট খুলে দেয় এবং বলে ফিফ্থ ফ্লোরে যেতে। সজল ফ্ল্যাটটির সামনে এসে কলিংবেল চাপতেই খুলে যায় দরজা। দরজার সামনে এক মহিলা দাঁড়িয়ে, সম্ভবত গৃহকর্মী।
"বদরুল স্যার আছেন?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
মহিলাটি ভেতরে আসতে বলে, তারপর অন্যপাশে একটি রুম দেখিয়ে দেয়। সজল সেদিকে যায়। রুমে বদরুল সোফায় বসে আছে, বদরুল ওকে পাশে বসতে বলে।
"কি খবর? কেমন চলছে কাজকর্ম?"
"স্যার, ভালই। এইমাত্র পরিবাগের সাইট থেকে ফিরছি, সেখানে সুপারভাইজারদের আগামি দিনের কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়েছি।"
"গুড, আর বাসাবোর সাইটের কি খবর।"
"ওটার এখন পেইন্ট ও টাইলসের কাজ চলছে।" সজল বলে।
"ডিনার করেছ?"
"না স্যার।"
"আজকে আমার সাথে ডিনার করবে।" বদরুল বলে।
"না স্যার।"
সজলের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে শামিমা নামের গৃহকর্মীকে ডেকে খাবার দিতে বলে বদরুল।
খাবার শেষে বদরুল আর সজল আবারও ড্রয়িংরুমে ফিরে আসে।
"কি খাবে বলো, হুইস্কি, ভোদকা নাকি ব্রান্ডি? আমার আবার ডিনারের পর দু এক পেগ গলায় না ঢাললে রাতে ঘুম আসে না।" টেবিলের উপর স্তরে স্তরে সাজানো মদের বোতল ও গ্লাস, সেখান থেকে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস টেনে আনতে আনতে বলে বদরুল।
"না স্যার।" ভদ্রতামুলক আপত্তি জানায় সজল।
"আরে, লজ্জা কোরো না। হুইস্কি চলবে তো?" বদরুল বলে।
সজল আর আপত্তি করেনা।
"খবর শুনেছ?" বদরুল বলে।
"কি খবর, স্যার?"
"আমার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টে অনিয়ম আর দুর্নিতির অভিযোগ উঠেছে আমার বিরুদ্ধে।" এক চুমুকে এক পেগ শেষ করে আবার হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলে বদরুল।
"কি বলছেন স্যার!" অবাক হওয়ার ভান করে বলে সজল।
"ইরফানটা শালা বিশাল জোচ্চোর! বললাম এক কোটি দেব। উল্টো আমাকে চোর বলে, বলে কিনা আমাকে জেলে পুরবে।" একটু থেমে আবার বলতে থাকে বদরুল।
"আমি ওর চেয়ে কমসে কম পাঁচ বছরের সিনিয়র। শ্যালা চেয়ারম্যানদের চামচামি করে আমার চেয়ে আগে চলে গেছে, আর এখন আমাকেই হুমকি দেয়। শালা বজ্জাত! আমাকে চেনেনি ও। আমি ওকে ছাড়ব না। শালাকে আমি খুন করব।" আরো এক পেগ গলায় ঢালার পর কন্ঠটা গম্ভীর করে বলে "তোমাকে যে কারনে ডেকেছি তা হল, আমার সিক্স সেন্স বলছে কেউ আমার সাথে বেইমানি করেছে, আমার ডিপার্টমেন্টেরই কেউ।"
"আরে না স্যার, তা হবে কেন?" সজল কন্ঠটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে।
"কেউ বেইমানি না করলে ইরফানটা এতো সহজে বোঝার কথা না। কেউ আমার নামে কম্প্লেইন করেছে, শুধু কম্প্লেইনই করেনি অনেক গোপন ডকুমেন্ট হাতে তুলে দিয়েছে। তোমার কি মনে হয়, কে করতে পারে কাজটা?"
"আমি তো নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, কিন্তু গোপাল হতে পারে। ও তো শালা জিএমের চামচা।" সজল বলে।
"জিএমের চামচা ঠিক আছে, কিন্তু জিএমের কাছে যেসব ডকুমেন্ট দেখেছি সেগুলো গোপালের হাতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।" একটু থেমে বদরুল আবার বলে "সজল, তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। আমার বিশ্বাস তুমি এমনটা করতে পারোনা। খোঁজ নাও, কে করেছে এটা। আমি বেইমানদের কখনো ক্ষমা করিনা।"
"জি স্যার, আমি দেখছি। আসি স্যার।" সজল বলে।
"আচ্ছা, এসো।"
এরপর একটি মাস কেটে যায়। এই একমাসে স্নিগ্ধা ও সজলের পারিবারিক জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন না এলেও সজলের অফিসের চিত্র পুরো ১৮০ ডিগ্রী পরিবর্তন হয়ে যায়। বদরুলের সাথে সজলের সেই মিটিংয়ের তিনদিন পরই একটি দুর্ঘটনায় জেনারেল ম্যানেজার ইরফান আহমেদের মৃত্যু হয়। পরের দিন বোর্ড মিটিংয়ে দুর্নীতির তদন্তের রিপোর্ট পেশ করার কথা, তারই ডকুমেন্ট রেডি করতে করতে ইরফান সাহেবের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। যখন তিনি অফিস থেকে বের হন তখন রাত একটা বাজে। উত্তরায় একটি স্পিডব্রেকারের কাছে একটি কার্গো ট্রাক তার গাড়িকে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে তার গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে যায়, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ইরফান সাহেবের মৃত্যু হয়। ঘাতক কার্গো ট্রাক আর তার ড্রাইভারকে পুলিশ আটক করে। পুলিশ অনেক তদন্তের পর ঘটনাটিকে এক্সিডেন্ট হিসাবে রিপোর্ট দিয়েছে। পুলিশের ধারনা স্পিডব্রেকারের অবস্থান বুঝতে না পারায় ট্রাকটি ইরফান সাহেবের গাড়িতে আঘাত করেছে। ইরফান সাহেবের মৃত্যুর সাথে সাথে সেরেনা টাওয়ার দুর্নীতির তদন্তের রিপোর্ট ফাইলগুলো গায়েব হয়ে যায়। শুধু তাই নয় একমাসের ভেতর জেনারেল ম্যানেজার পদে প্রমোশন পায় বদরুল ভুইয়া। এর পেছনে কোম্পানির চেয়ারম্যানদের একজন এবং পনেরো পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার জিল্লুর রহমানের হাত আছে বলে অনেকে মনে করে। জিল্লুর রহমান বদরুল ভুঁইয়ার দুর সম্পর্কের আত্মীয়। জিল্লুর সাহেবের সাথে বদরুলের বেশ দহরম মহরম চলে, তেল মালিশের কোন সুযোগ মিস করেনা সে। সে যাই হোক বর্তমানে ফিরে আসা যাক।
রাত বারোটা বাজে অথচ সজল বাসায় ফেরেনি। স্নিগ্ধা উদ্বিগ্নভাবে সজলের মোবাইলে কল করেই যাচ্ছে। এতোক্ষন রিং হচ্ছিল, রিসিভ হচ্ছিল না, শেষবার নাম্বার বন্ধ পেল। স্নিগ্ধার চিন্তাটা আরো বেড়ে গেল। আবারও কল দেয় স্নিগ্ধা, আবারও বন্ধ। মিনিট খানেক পর স্নিগ্ধার মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে, সাথে সাথে রিসিভ করে ও।
"হ্যালো গোপালদা, কোন খোঁজ পেলেন সজলের?" স্নিগ্ধা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে।
"হ্যাঁ বৌদি, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সজল ভাইকে নিয়ে ফিরছি।" গোপাল বলে।
"আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব!" একটু থেমে স্নিগ্ধা আবার বলে "ও কি আবারও মদ খেয়ে মাতলামো করছিল?"
"আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাব, আপনি টেনশন করবেন না।" প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলে গোপাল।
গোপাল সজলের একজন সহকর্মী। সজল ফিরতে দেরি করছিল আর ফোন ধরছিল না বলে স্নিগ্ধা গোপালকে কল করে। গোপাল সজলকে গুলশান ২ এর একটি বারে খুঁজে পায় মাতাল অবস্থায়। এটাই প্রথম নয়, এক সপ্তাহ আগেও একই ঘটনা ঘটেছিল।
গোপাল সজলকে নিয়ে একটি সিএনজিতে করে সজলের ফ্ল্যাটের সামনে আসে। সজলকে ধরাধরি করে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেয়।
"গোপালদা, আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না। আপনি আমাদের জন্য এতো কষ্ট করলেন!" স্নিগ্ধা বলে।
"কি বলছেন বৌদি, এ তো আমার কর্তব্য।" বিনয়ের সাথে বলে গোপাল।
"ওকে নিয়ে যে কি করি! এক সপ্তাহ হল দেখছি ও সবসময় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে, জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলতো না। আমি নিশ্চিত অফিসে কোন সমস্যা হয়েছে। আপনি কিছু বলতে পারেন?"
"না বৌদি, আমাকে তো কিছু বলেনি। কিংবা অফিসে কারো সাথে কোন ঝামেলা চোখে পড়েনি।" গোপাল বলে।
"আমি আসি, বৌদি।" বলে গোপাল বের হয়ে যায়। স্নিগ্ধা দরজাটা বন্ধ করে তাদের বেডরুমে ফিরে আসে। সেখানে তার স্বামী বিছানায় উপর হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। স্নিগ্ধা লাইট নিভিয়ে দিয়ে পাশের রুমে ঘুমাতে যায়।
"হ্যালো সজল, কোথায় তুমি?" বদরুলের কর্কশ কন্ঠ শুনতে পায়।
"স্যার, মতিঝিলের সাইট থেকে ফিরছি, এখন ফার্মগেটের পার হলাম।"
"জরুরি কথা আছে, এক্ষুনি দেখা করতে পারবে?"
"ওকে স্যার, আমি অফিসে আসছি।"
"অফিসে নয়। আমি ঠিকানা দিচ্ছি, চলে এসো।" বদরুল বলে।
সজল কলম ও পকেট ডায়েরি বের করে ঠিকানা লিখে নেয়।
বনশ্রীর একটি ঠিকানা। মনে মনে দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে সজল, কিছুদিন আগে সেরেনা টাওয়ারের স্ক্যামের রিপোর্ট ও যাবতীয় প্রমান জেনারেল ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়েছে। সে কথা তার কানে যায়নি তো। দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সজল বাইক চালানোর দিকে মন দেয়।
বনশ্রীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সজলের আরো আধা ঘন্টা লেগে যায়। সজল বাইকটা থামিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে, স্নিগ্ধার তিনটি মিসডকল। সজল কল ব্যাক করে।
"স্নিগ্ধা, আমার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হতে পারে।" সজল বলে।
"কেন?"
"একটি জরুরি মিটিং রয়েছে, রাখি।" বলে সজল ফোন কেটে দেয়।
তারপর সামনের ছয়তলা বাড়িটার দিকে যায় সজল। গেটের পাশে শ্বেতপাথরে খোদাই করে বাড়ির নাম ও মালিকের নাম লেখা। মালিকের নাম দেখে অবাক হয়ে যায় সজল। আগে জানত ঢাকা শহরে বদরুল ভুঁইয়ার দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে, ধানমন্ডিতে একটি, অন্যটি তেজগাঁ। কিন্তু বনশ্রীতে আস্ত ছয় তলা বাড়ি! আরো কত কি আছে কে জানে!
সজল দারোয়ানকে গিয়ে নিজের নাম ও কার কাছে এসেছে তা বলতেই গেট খুলে দেয় এবং বলে ফিফ্থ ফ্লোরে যেতে। সজল ফ্ল্যাটটির সামনে এসে কলিংবেল চাপতেই খুলে যায় দরজা। দরজার সামনে এক মহিলা দাঁড়িয়ে, সম্ভবত গৃহকর্মী।
"বদরুল স্যার আছেন?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
মহিলাটি ভেতরে আসতে বলে, তারপর অন্যপাশে একটি রুম দেখিয়ে দেয়। সজল সেদিকে যায়। রুমে বদরুল সোফায় বসে আছে, বদরুল ওকে পাশে বসতে বলে।
"কি খবর? কেমন চলছে কাজকর্ম?"
"স্যার, ভালই। এইমাত্র পরিবাগের সাইট থেকে ফিরছি, সেখানে সুপারভাইজারদের আগামি দিনের কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়েছি।"
"গুড, আর বাসাবোর সাইটের কি খবর।"
"ওটার এখন পেইন্ট ও টাইলসের কাজ চলছে।" সজল বলে।
"ডিনার করেছ?"
"না স্যার।"
"আজকে আমার সাথে ডিনার করবে।" বদরুল বলে।
"না স্যার।"
সজলের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে শামিমা নামের গৃহকর্মীকে ডেকে খাবার দিতে বলে বদরুল।
খাবার শেষে বদরুল আর সজল আবারও ড্রয়িংরুমে ফিরে আসে।
"কি খাবে বলো, হুইস্কি, ভোদকা নাকি ব্রান্ডি? আমার আবার ডিনারের পর দু এক পেগ গলায় না ঢাললে রাতে ঘুম আসে না।" টেবিলের উপর স্তরে স্তরে সাজানো মদের বোতল ও গ্লাস, সেখান থেকে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস টেনে আনতে আনতে বলে বদরুল।
"না স্যার।" ভদ্রতামুলক আপত্তি জানায় সজল।
"আরে, লজ্জা কোরো না। হুইস্কি চলবে তো?" বদরুল বলে।
সজল আর আপত্তি করেনা।
"খবর শুনেছ?" বদরুল বলে।
"কি খবর, স্যার?"
"আমার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টে অনিয়ম আর দুর্নিতির অভিযোগ উঠেছে আমার বিরুদ্ধে।" এক চুমুকে এক পেগ শেষ করে আবার হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলে বদরুল।
"কি বলছেন স্যার!" অবাক হওয়ার ভান করে বলে সজল।
"ইরফানটা শালা বিশাল জোচ্চোর! বললাম এক কোটি দেব। উল্টো আমাকে চোর বলে, বলে কিনা আমাকে জেলে পুরবে।" একটু থেমে আবার বলতে থাকে বদরুল।
"আমি ওর চেয়ে কমসে কম পাঁচ বছরের সিনিয়র। শ্যালা চেয়ারম্যানদের চামচামি করে আমার চেয়ে আগে চলে গেছে, আর এখন আমাকেই হুমকি দেয়। শালা বজ্জাত! আমাকে চেনেনি ও। আমি ওকে ছাড়ব না। শালাকে আমি খুন করব।" আরো এক পেগ গলায় ঢালার পর কন্ঠটা গম্ভীর করে বলে "তোমাকে যে কারনে ডেকেছি তা হল, আমার সিক্স সেন্স বলছে কেউ আমার সাথে বেইমানি করেছে, আমার ডিপার্টমেন্টেরই কেউ।"
"আরে না স্যার, তা হবে কেন?" সজল কন্ঠটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে।
"কেউ বেইমানি না করলে ইরফানটা এতো সহজে বোঝার কথা না। কেউ আমার নামে কম্প্লেইন করেছে, শুধু কম্প্লেইনই করেনি অনেক গোপন ডকুমেন্ট হাতে তুলে দিয়েছে। তোমার কি মনে হয়, কে করতে পারে কাজটা?"
"আমি তো নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, কিন্তু গোপাল হতে পারে। ও তো শালা জিএমের চামচা।" সজল বলে।
"জিএমের চামচা ঠিক আছে, কিন্তু জিএমের কাছে যেসব ডকুমেন্ট দেখেছি সেগুলো গোপালের হাতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।" একটু থেমে বদরুল আবার বলে "সজল, তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। আমার বিশ্বাস তুমি এমনটা করতে পারোনা। খোঁজ নাও, কে করেছে এটা। আমি বেইমানদের কখনো ক্ষমা করিনা।"
"জি স্যার, আমি দেখছি। আসি স্যার।" সজল বলে।
"আচ্ছা, এসো।"
এরপর একটি মাস কেটে যায়। এই একমাসে স্নিগ্ধা ও সজলের পারিবারিক জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন না এলেও সজলের অফিসের চিত্র পুরো ১৮০ ডিগ্রী পরিবর্তন হয়ে যায়। বদরুলের সাথে সজলের সেই মিটিংয়ের তিনদিন পরই একটি দুর্ঘটনায় জেনারেল ম্যানেজার ইরফান আহমেদের মৃত্যু হয়। পরের দিন বোর্ড মিটিংয়ে দুর্নীতির তদন্তের রিপোর্ট পেশ করার কথা, তারই ডকুমেন্ট রেডি করতে করতে ইরফান সাহেবের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। যখন তিনি অফিস থেকে বের হন তখন রাত একটা বাজে। উত্তরায় একটি স্পিডব্রেকারের কাছে একটি কার্গো ট্রাক তার গাড়িকে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে তার গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে যায়, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ইরফান সাহেবের মৃত্যু হয়। ঘাতক কার্গো ট্রাক আর তার ড্রাইভারকে পুলিশ আটক করে। পুলিশ অনেক তদন্তের পর ঘটনাটিকে এক্সিডেন্ট হিসাবে রিপোর্ট দিয়েছে। পুলিশের ধারনা স্পিডব্রেকারের অবস্থান বুঝতে না পারায় ট্রাকটি ইরফান সাহেবের গাড়িতে আঘাত করেছে। ইরফান সাহেবের মৃত্যুর সাথে সাথে সেরেনা টাওয়ার দুর্নীতির তদন্তের রিপোর্ট ফাইলগুলো গায়েব হয়ে যায়। শুধু তাই নয় একমাসের ভেতর জেনারেল ম্যানেজার পদে প্রমোশন পায় বদরুল ভুইয়া। এর পেছনে কোম্পানির চেয়ারম্যানদের একজন এবং পনেরো পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার জিল্লুর রহমানের হাত আছে বলে অনেকে মনে করে। জিল্লুর রহমান বদরুল ভুঁইয়ার দুর সম্পর্কের আত্মীয়। জিল্লুর সাহেবের সাথে বদরুলের বেশ দহরম মহরম চলে, তেল মালিশের কোন সুযোগ মিস করেনা সে। সে যাই হোক বর্তমানে ফিরে আসা যাক।
রাত বারোটা বাজে অথচ সজল বাসায় ফেরেনি। স্নিগ্ধা উদ্বিগ্নভাবে সজলের মোবাইলে কল করেই যাচ্ছে। এতোক্ষন রিং হচ্ছিল, রিসিভ হচ্ছিল না, শেষবার নাম্বার বন্ধ পেল। স্নিগ্ধার চিন্তাটা আরো বেড়ে গেল। আবারও কল দেয় স্নিগ্ধা, আবারও বন্ধ। মিনিট খানেক পর স্নিগ্ধার মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে, সাথে সাথে রিসিভ করে ও।
"হ্যালো গোপালদা, কোন খোঁজ পেলেন সজলের?" স্নিগ্ধা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে।
"হ্যাঁ বৌদি, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সজল ভাইকে নিয়ে ফিরছি।" গোপাল বলে।
"আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব!" একটু থেমে স্নিগ্ধা আবার বলে "ও কি আবারও মদ খেয়ে মাতলামো করছিল?"
"আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাব, আপনি টেনশন করবেন না।" প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলে গোপাল।
গোপাল সজলের একজন সহকর্মী। সজল ফিরতে দেরি করছিল আর ফোন ধরছিল না বলে স্নিগ্ধা গোপালকে কল করে। গোপাল সজলকে গুলশান ২ এর একটি বারে খুঁজে পায় মাতাল অবস্থায়। এটাই প্রথম নয়, এক সপ্তাহ আগেও একই ঘটনা ঘটেছিল।
গোপাল সজলকে নিয়ে একটি সিএনজিতে করে সজলের ফ্ল্যাটের সামনে আসে। সজলকে ধরাধরি করে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেয়।
"গোপালদা, আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না। আপনি আমাদের জন্য এতো কষ্ট করলেন!" স্নিগ্ধা বলে।
"কি বলছেন বৌদি, এ তো আমার কর্তব্য।" বিনয়ের সাথে বলে গোপাল।
"ওকে নিয়ে যে কি করি! এক সপ্তাহ হল দেখছি ও সবসময় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে, জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলতো না। আমি নিশ্চিত অফিসে কোন সমস্যা হয়েছে। আপনি কিছু বলতে পারেন?"
"না বৌদি, আমাকে তো কিছু বলেনি। কিংবা অফিসে কারো সাথে কোন ঝামেলা চোখে পড়েনি।" গোপাল বলে।
"আমি আসি, বৌদি।" বলে গোপাল বের হয়ে যায়। স্নিগ্ধা দরজাটা বন্ধ করে তাদের বেডরুমে ফিরে আসে। সেখানে তার স্বামী বিছানায় উপর হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। স্নিগ্ধা লাইট নিভিয়ে দিয়ে পাশের রুমে ঘুমাতে যায়।