16-06-2021, 08:11 PM
পরেরদিন সজল ও স্নিগ্ধা সন্ধ্যা সাতটার সময় তাদের এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়। সজল আগেই একটি টেক্সিক্যাব ভাড়া নিয়ে রেখেছে। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিতেই সজল তার পাশের জানালা খুলে দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নেয়।
"তুমি আবার শুরু করলে?" স্নিগ্ধা বলে।
আগামী তিন চার ঘন্টা তো আর সিগারেট ধরাতে পারবনা, নো স্মোকিং জোন।" বলে সিগারেটে টান দিতে দিতে ওর পাশের অপ্সরীকে দেখতে থাকে সজল। ঠিক স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরীর মতোই লাগছে স্নিগ্ধাকে। কিন্তু এমন সাজসজ্জায় বাইরে বের হতে স্নিগ্ধার কিছুটা অস্বস্তি লাগছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারও বারবার লুকিং গ্লাসে ওকে দেখছে। সজল একবার ভাবল ড্রাইভারকে কিছু বলবে, পরের মুহুর্তে নিজেকে নিবৃত করল সে। এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তার এখন মাথা ঘামালে চলেনা।
আধা ঘন্টার মাঝে তারা গুলশান ২ চত্তরে পৌঁছে যায়। সেখানে তাদের কোম্পানির এযাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট সেরেনা টাওয়ারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। তেতাল্লিশ তলা বিশাল আকারের বিল্ডিং যা পুরোটাই আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে। একুশ তলায় সেমিনার হলে কনসার্ট আয়োজন করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু নামিদামি শিল্পী ও ব্যান্ড অংশ নিবে। এরপর টুয়েন্টি ফিফথ ফ্লোরে পার্টি। অফিসের কর্মচারী, কর্মকর্তা ও মালিক কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রিত এতে।
সজল ও স্নিগ্ধা যখন পৌঁছায় ততোক্ষনে কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। তিনঘন্টার কনসার্ট, কিন্তু স্নিগ্ধা এক ঘন্টা পরই বের হয়ে আসতে চায়। খুব ঝাঁঝালো গান স্নিগ্ধার পছন্দ নয়। বাধ্য হয়ে সজলও বের হয়ে আসে। পঁচিশ তলায় পার্টিপ্লেসে চলে আসে ওরা। সেখানে ওদের মতোই আরো বেশ কিছু কাপল এসেছে, তারা গল্প জুড়ে দিয়েছে। সজল স্নিগ্ধাকে ওর কিছু কলিগ ও তাদের স্ত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। স্নিগ্ধা এ দেখে কিছুটা স্বস্তি পায় যে আরো অনেকেই ট্রান্সপারেন্ট শাড়ি ও স্লীভলেস ব্লাউজ পরে এসেছে। কিন্তু বাকি সবাইকে ছাপিয়ে দৃষ্টিসমুহ যে তার দিকেই বারবার উঁকি দিচ্ছে তা ও ভালভাবেই বুঝতে পারে। কনসার্ট শেষ হতে হতে পার্টিপ্লেসে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। এর কিছুক্ষন পর কোম্পানির এমডি এবং চেয়ারপার্সনরা আসতে থাকে। কোমপানির এমডি কর্নেল চিরঞ্জিত অধিকারী একটি ছোট বক্তৃতা দেন কোম্পানির এই সাফল্যে সবাইকে ধন্যবাদ ও স্বাগতম জানিয়ে।
সজল বারের এক কোনায় বদরুল ভুইয়াকে দেখতে পায়। বদরুল ভুইয়া কোম্পানির এজিএম এবং এই প্রজেক্টের ইনচার্জ। তিনি একাই এসেছেন, তিন বছর আগে তার স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে, তার চরিত্র নিয়ে নানারকম দুর্নাম প্রচলিত আছে। তিনি হুইসকির গ্লাস নিয়ে বারের এক কোনায় বসে ছিলেন।
"আরে, সজল যে, এদিকে আসো।" সজলকে দেখে ডেকে নেয় বদরুল।
"ও আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা, উনি বদরুল স্যার, এজিএম এবং প্রজেক্ট ইনচার্জ।" সজল পরিচয় করিয়ে দেয়।
"হাই, গর্জিয়াস।" স্নিগ্ধাকে উপর থেকে নিচ অব্দি একবার পর্যবেক্ষন করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে।
স্নিগ্ধা কি করবে বুঝতে পারেনা, অনিশ্চিত ভাবে হাত বাড়িয়ে দেয়। বদরুল স্নিগ্ধার হাতটা ধরে ব্রিটিশ কায়দায় চুমু দেয় হাতে। হঠাত গায়ে তেলাপোকা উড়ে এসে পড়লে যেমনিভাবে শিউরে ওঠে মেয়েরা, তেমনি শিউরে ওঠে স্নিগ্ধা। কিন্তু তা প্রকাশ হতে না দিয়ে ঠোঁটে হাসি ধরে রাখে স্নিগ্ধা।
"কি খাবে বিউটিফুল লেডি, হুইস্কি নাকি ব্রান্ডি?" আড়চোখে ওর শরীরটা মাপতে মাপতে বলে বদরুল।
"না না ওসব কিছু খাইনা আমি।" স্নিগ্ধা বলে। বদরুলের নোংরা দৃষ্টির সামনে খুব অস্বস্তি লাগে স্নিগ্ধার, কোনভাবে সরে পড়তে পারলে বেঁচে যায়।
"তুমি নাও সজল। কি খাবে? হুইস্কি?" সজলকে উদ্দেশ্য করে বলে।
"না স্যার।" ভদ্রতামুলক আপত্তি করে সজল।
"আরে নাও তো।" বলে নিজ হাতে সজলের জন্য পেগ বানায় বদরুল।
সজল গ্লাসটি হাতে নিয়ে ছোট চুমুক দেয়।
"এই কি হচ্ছে এটা?" স্নিগ্ধা ফিসফিস করে বলে।
"তোমার জন্য জুস কিংবা কোল্ড ড্রিংক অর্ডার দিব?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
"দরকার নেই। আগে জানলে তোমার সাথে আসতামই না।" বলে স্নিগ্ধা হন হন করে হেঁটে চলে যায়। কিন্তু সজল এবার ওর পিছু নেয়না বরং বদরুলের সাথে আলাপ চালিয়ে যায়।
তখন হলরুম ভর্তি মানুষের অধিকাংশের হাতেই মদের গ্লাস। শুধু পুরুষরা নয়, মহিলাদের অনেকেই ড্রিংক করছে। স্নিগ্ধা ব্যালকনির দিকে যায়। সেদিকটা কিছুটা নির্জন।
ব্যালকনির দিকটাকে যতটা নির্জন ভেবেছিল স্নিগ্ধা সেটা তার চেয়েও বেশি নির্জন। মাত্র একজন ব্যাক্তি ব্যালকনিতে পাতা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও এই পরিস্থিতিও কিছুটা অস্বস্তিকর, কিন্তু এখন পার্টিপ্লেসে ফিরে যেতে চায়না। স্নিগ্ধা একবার পেছনে ফিরে তাকায়, সজলকে দেখতে পায় হাতে ড্রিংকের গ্লাস নিয়ে বদরুল সহ আরো কয়েকজনের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধার ভীষন রাগ হয় স্বামীর প্রতি। স্নিগ্ধা সেখানে একটি চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে ঝলমলে শহর আর তার উপরে আকাশে একফালি চাঁদ ও কিছু তারা দেখতে ভালই লাগে স্নিগ্ধার।
"এক্সকিউজ মি ম্যাম, যদি আপনার আপত্তি না থাকে আপনার পাশে বসতে পারি?" ব্যালকনির অন্যপাশে বসে থাকা লোকটি স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্যে বলে। স্নিগ্ধা উপর থেকে নিচ অব্দি একবার দেখে নেয়। লম্বা চওড়া, শক্তসমর্থ পুরুষ, মুখে ভদ্রতামুলক হাসি, মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো শুধু বয়সের জানান দেয়।
"নিশ্চয়ই, বসুন।" স্নিগ্ধা বলে।
"আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার সজল হাসানের ওয়াইফ?" লোকটি স্নিগ্ধার পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করে।
"জি। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"আমার নাম ইরফান আহমেদ।" লোকটি বলে।
"ও, স্যার আপনি! সজল আমাকে আপনার সম্পর্কে অনেক বলেছে।" স্নিগ্ধা বলে।
ইরফান আহমেদ কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। নম্র, ভদ্র, সৎ এবং নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসাবে তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে।
"স্যার আপনি কি একা এসেছেন?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ।" ইরফান বলে।
"আপনার স্ত্রী আসেননি?"
"দশ বছর আগে একটি কার এক্সিডেন্টে ও মারা গেছে।" ইরফান বলে।
"আমি খুব দুঃখিত।"
"ইট্স ওকে।"
কাছ দিয়ে এক ওয়েটার যাবার সময় ইরফান তাকে হাত নেড়ে এদিকে আসার জন্য ইশারা করে।
"কি খাবেন? জুস নাকি সফ্ট ড্রিংক?" স্নিগ্ধার উদ্দেশ্য বলে ইরফান বলে।
"সফ্ট ড্রিংক।" স্নিগ্ধা বলে।
ইরফান দুটি নন-এলকোহল বিয়ার অর্ডার দিয়ে দেয়।
"স্যার, আপনি কিন্তু আমাকে সেই কখন থেকে আপনি করে বলছেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়, আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হব।"
"তুমিও তো আমাকে স্যার স্যার করে বলছ। তাতে মনে হচ্ছে তুমি আমার অফিস স্টাফ। আমি আমার অফিস স্টাফদের সবসময় আপনি করেই বলি, হোক সে পিওন, ওয়ার্কার কিংবা ক্লিনার।" ইরফান বলে।
"তাহলে আপনাকে কি বলব?"
"তোমার বয়সী আমার এক ছেলে আছে, সে হিসাবে আঙ্কেল বলতেই পার। কিন্তু তোমার মতো গর্জিয়াস লেডির কাছে থেকে আঙ্কেল শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগবে না, তারচেয়ে বরং স্যারই ঠিক আছে।" ইরফান বলে।
স্নিগ্ধা তাতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। স্নিগ্ধা ঠিক মনে করতে পারবেনা কতোদিন পর ও এমন প্রান খুলে হেসেছে।
তখন ওয়েটার চলে আসে দুটি বিয়ারের মগ নিয়ে। ইরফান স্নিগ্ধার হাতে একটি মগ ধরিয়ে দেয় ও নিজে একটি মগ নেয়।
"ওয়াও! চকোলেট ফ্লেভার! আমার ফেভারিট।" বিয়ারে চুমুক দিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
"আরো আছে বানানা ফ্লেভার, অরেঞ্জ ফ্লেভার। চাইলে টেস্ট করে দেখতে পারো।" ইরফান বলে।
"দরকার নেই। স্যার আপনি কি ড্রিংক করেন না? নাকি আমি আছি বলেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"তুমিও একটা কারন, আরেকটি কারন হল আজ আমার ড্রাইভার আসেনি। ড্রিংক করে ড্রাইভিং করা উচিত হবেনা।" ইরফান বলে।
"তোমার হাজবেন্ড তোমাকে খুঁজছে সম্ভবত। চল ভেতরে যাই।" একটু থেমে আবার বলে ইরফান। ততোক্ষনে পার্টি হল অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। দেয়াল ঘড়িতে দেখতে পায় রাত সাড়ে বারোটা বাজে।
স্নিগ্ধাকে দেখে সজল এগিয়ে আসে।
"কোথায় ছিলে এতোক্ষন।" সজল বলে।
"আমি যেখানেই থাকি তাতে তোমার কি? তুমি আমার একটা কথাও শোন?" নিচু স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
সজল কিছু একটা বলতো কিন্তু তখন জেনারেল ম্যানেজার ইরফান আহমেদকে এগিয়ে আসতে দেখে চেপে যায় সজল।
"স্যার ও আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা, আর উনি....."
"আপনার স্ত্রীর সাথে পরিচয় আগেই হয়ে গেছে। আপনারা তো এখন বাসায় ফিরবেন?" ইরফান বলে।
"জি স্যার।"
"এতো রাতে আপনারা ট্যাক্সি পাবেন না। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে, আমি আপনাদের পৌঁছে দেই।"
"কিন্তু স্যার, আপনি অযথা কষ্ট করবেন।" সজল বলে।
"কোন কষ্ট নয়। আপনারা তো বনানিতে থাকেন। আমাকে তো ওদিক দিয়েই যেতে হবে।"
সজল আর আপত্তি করেনা।
ইরফান আহমেদ তার মারসিডিজ বেঞ্জ জিএলএ গাড়িটি সজলের এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড় করায়।
স্নিগ্ধা ও সজল নেমে যায়।
"স্যার অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি স্যার আরেকটি রিকুয়েস্ট রাখেন।"
"হ্যাঁ, বলুন।"
"যদি এক্ষুনি আমার বাসায় আসেন।"
"তা সম্ভব নয় আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।"
"তাহলে স্যার যদি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেন। আমি আপনাকে একটি জিনিস দেখাতে চাই, যাষ্ট পাঁচ মিনিট।" সজল বলে।
"ঠিক আছে।"
সজল দ্রুত তার ফ্ল্যাটে গিয়ে আলমারি থেকে একটি ফাইল বের করে আনে। তারপর সেটা ইরফানের হাতে তুলে দিয়ে বলে,
"স্যার এই ফাইলে সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টের যাবতীয় চুরির বিবরন প্রমান সহকারে আছে।"
"কি বলছেন আপনি!" চমকে উঠে বলে ইরফান।
"আপনি ফাইলটা খুলে দেখলেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু দয়া করে কাউকে বলবেন না যে এটি আমি আপনাকে দিয়েছি।" সজল বলে।
"অবশ্যই, এবং আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।" বলে ইনজিন স্টার্ট দেয় ইরফান।
"তুমি আবার শুরু করলে?" স্নিগ্ধা বলে।
আগামী তিন চার ঘন্টা তো আর সিগারেট ধরাতে পারবনা, নো স্মোকিং জোন।" বলে সিগারেটে টান দিতে দিতে ওর পাশের অপ্সরীকে দেখতে থাকে সজল। ঠিক স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরীর মতোই লাগছে স্নিগ্ধাকে। কিন্তু এমন সাজসজ্জায় বাইরে বের হতে স্নিগ্ধার কিছুটা অস্বস্তি লাগছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারও বারবার লুকিং গ্লাসে ওকে দেখছে। সজল একবার ভাবল ড্রাইভারকে কিছু বলবে, পরের মুহুর্তে নিজেকে নিবৃত করল সে। এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তার এখন মাথা ঘামালে চলেনা।
আধা ঘন্টার মাঝে তারা গুলশান ২ চত্তরে পৌঁছে যায়। সেখানে তাদের কোম্পানির এযাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট সেরেনা টাওয়ারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। তেতাল্লিশ তলা বিশাল আকারের বিল্ডিং যা পুরোটাই আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে। একুশ তলায় সেমিনার হলে কনসার্ট আয়োজন করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু নামিদামি শিল্পী ও ব্যান্ড অংশ নিবে। এরপর টুয়েন্টি ফিফথ ফ্লোরে পার্টি। অফিসের কর্মচারী, কর্মকর্তা ও মালিক কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রিত এতে।
সজল ও স্নিগ্ধা যখন পৌঁছায় ততোক্ষনে কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। তিনঘন্টার কনসার্ট, কিন্তু স্নিগ্ধা এক ঘন্টা পরই বের হয়ে আসতে চায়। খুব ঝাঁঝালো গান স্নিগ্ধার পছন্দ নয়। বাধ্য হয়ে সজলও বের হয়ে আসে। পঁচিশ তলায় পার্টিপ্লেসে চলে আসে ওরা। সেখানে ওদের মতোই আরো বেশ কিছু কাপল এসেছে, তারা গল্প জুড়ে দিয়েছে। সজল স্নিগ্ধাকে ওর কিছু কলিগ ও তাদের স্ত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। স্নিগ্ধা এ দেখে কিছুটা স্বস্তি পায় যে আরো অনেকেই ট্রান্সপারেন্ট শাড়ি ও স্লীভলেস ব্লাউজ পরে এসেছে। কিন্তু বাকি সবাইকে ছাপিয়ে দৃষ্টিসমুহ যে তার দিকেই বারবার উঁকি দিচ্ছে তা ও ভালভাবেই বুঝতে পারে। কনসার্ট শেষ হতে হতে পার্টিপ্লেসে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। এর কিছুক্ষন পর কোম্পানির এমডি এবং চেয়ারপার্সনরা আসতে থাকে। কোমপানির এমডি কর্নেল চিরঞ্জিত অধিকারী একটি ছোট বক্তৃতা দেন কোম্পানির এই সাফল্যে সবাইকে ধন্যবাদ ও স্বাগতম জানিয়ে।
সজল বারের এক কোনায় বদরুল ভুইয়াকে দেখতে পায়। বদরুল ভুইয়া কোম্পানির এজিএম এবং এই প্রজেক্টের ইনচার্জ। তিনি একাই এসেছেন, তিন বছর আগে তার স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে, তার চরিত্র নিয়ে নানারকম দুর্নাম প্রচলিত আছে। তিনি হুইসকির গ্লাস নিয়ে বারের এক কোনায় বসে ছিলেন।
"আরে, সজল যে, এদিকে আসো।" সজলকে দেখে ডেকে নেয় বদরুল।
"ও আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা, উনি বদরুল স্যার, এজিএম এবং প্রজেক্ট ইনচার্জ।" সজল পরিচয় করিয়ে দেয়।
"হাই, গর্জিয়াস।" স্নিগ্ধাকে উপর থেকে নিচ অব্দি একবার পর্যবেক্ষন করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে।
স্নিগ্ধা কি করবে বুঝতে পারেনা, অনিশ্চিত ভাবে হাত বাড়িয়ে দেয়। বদরুল স্নিগ্ধার হাতটা ধরে ব্রিটিশ কায়দায় চুমু দেয় হাতে। হঠাত গায়ে তেলাপোকা উড়ে এসে পড়লে যেমনিভাবে শিউরে ওঠে মেয়েরা, তেমনি শিউরে ওঠে স্নিগ্ধা। কিন্তু তা প্রকাশ হতে না দিয়ে ঠোঁটে হাসি ধরে রাখে স্নিগ্ধা।
"কি খাবে বিউটিফুল লেডি, হুইস্কি নাকি ব্রান্ডি?" আড়চোখে ওর শরীরটা মাপতে মাপতে বলে বদরুল।
"না না ওসব কিছু খাইনা আমি।" স্নিগ্ধা বলে। বদরুলের নোংরা দৃষ্টির সামনে খুব অস্বস্তি লাগে স্নিগ্ধার, কোনভাবে সরে পড়তে পারলে বেঁচে যায়।
"তুমি নাও সজল। কি খাবে? হুইস্কি?" সজলকে উদ্দেশ্য করে বলে।
"না স্যার।" ভদ্রতামুলক আপত্তি করে সজল।
"আরে নাও তো।" বলে নিজ হাতে সজলের জন্য পেগ বানায় বদরুল।
সজল গ্লাসটি হাতে নিয়ে ছোট চুমুক দেয়।
"এই কি হচ্ছে এটা?" স্নিগ্ধা ফিসফিস করে বলে।
"তোমার জন্য জুস কিংবা কোল্ড ড্রিংক অর্ডার দিব?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
"দরকার নেই। আগে জানলে তোমার সাথে আসতামই না।" বলে স্নিগ্ধা হন হন করে হেঁটে চলে যায়। কিন্তু সজল এবার ওর পিছু নেয়না বরং বদরুলের সাথে আলাপ চালিয়ে যায়।
তখন হলরুম ভর্তি মানুষের অধিকাংশের হাতেই মদের গ্লাস। শুধু পুরুষরা নয়, মহিলাদের অনেকেই ড্রিংক করছে। স্নিগ্ধা ব্যালকনির দিকে যায়। সেদিকটা কিছুটা নির্জন।
ব্যালকনির দিকটাকে যতটা নির্জন ভেবেছিল স্নিগ্ধা সেটা তার চেয়েও বেশি নির্জন। মাত্র একজন ব্যাক্তি ব্যালকনিতে পাতা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও এই পরিস্থিতিও কিছুটা অস্বস্তিকর, কিন্তু এখন পার্টিপ্লেসে ফিরে যেতে চায়না। স্নিগ্ধা একবার পেছনে ফিরে তাকায়, সজলকে দেখতে পায় হাতে ড্রিংকের গ্লাস নিয়ে বদরুল সহ আরো কয়েকজনের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধার ভীষন রাগ হয় স্বামীর প্রতি। স্নিগ্ধা সেখানে একটি চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে ঝলমলে শহর আর তার উপরে আকাশে একফালি চাঁদ ও কিছু তারা দেখতে ভালই লাগে স্নিগ্ধার।
"এক্সকিউজ মি ম্যাম, যদি আপনার আপত্তি না থাকে আপনার পাশে বসতে পারি?" ব্যালকনির অন্যপাশে বসে থাকা লোকটি স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্যে বলে। স্নিগ্ধা উপর থেকে নিচ অব্দি একবার দেখে নেয়। লম্বা চওড়া, শক্তসমর্থ পুরুষ, মুখে ভদ্রতামুলক হাসি, মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো শুধু বয়সের জানান দেয়।
"নিশ্চয়ই, বসুন।" স্নিগ্ধা বলে।
"আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার সজল হাসানের ওয়াইফ?" লোকটি স্নিগ্ধার পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করে।
"জি। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"আমার নাম ইরফান আহমেদ।" লোকটি বলে।
"ও, স্যার আপনি! সজল আমাকে আপনার সম্পর্কে অনেক বলেছে।" স্নিগ্ধা বলে।
ইরফান আহমেদ কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। নম্র, ভদ্র, সৎ এবং নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসাবে তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে।
"স্যার আপনি কি একা এসেছেন?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ।" ইরফান বলে।
"আপনার স্ত্রী আসেননি?"
"দশ বছর আগে একটি কার এক্সিডেন্টে ও মারা গেছে।" ইরফান বলে।
"আমি খুব দুঃখিত।"
"ইট্স ওকে।"
কাছ দিয়ে এক ওয়েটার যাবার সময় ইরফান তাকে হাত নেড়ে এদিকে আসার জন্য ইশারা করে।
"কি খাবেন? জুস নাকি সফ্ট ড্রিংক?" স্নিগ্ধার উদ্দেশ্য বলে ইরফান বলে।
"সফ্ট ড্রিংক।" স্নিগ্ধা বলে।
ইরফান দুটি নন-এলকোহল বিয়ার অর্ডার দিয়ে দেয়।
"স্যার, আপনি কিন্তু আমাকে সেই কখন থেকে আপনি করে বলছেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়, আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হব।"
"তুমিও তো আমাকে স্যার স্যার করে বলছ। তাতে মনে হচ্ছে তুমি আমার অফিস স্টাফ। আমি আমার অফিস স্টাফদের সবসময় আপনি করেই বলি, হোক সে পিওন, ওয়ার্কার কিংবা ক্লিনার।" ইরফান বলে।
"তাহলে আপনাকে কি বলব?"
"তোমার বয়সী আমার এক ছেলে আছে, সে হিসাবে আঙ্কেল বলতেই পার। কিন্তু তোমার মতো গর্জিয়াস লেডির কাছে থেকে আঙ্কেল শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগবে না, তারচেয়ে বরং স্যারই ঠিক আছে।" ইরফান বলে।
স্নিগ্ধা তাতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। স্নিগ্ধা ঠিক মনে করতে পারবেনা কতোদিন পর ও এমন প্রান খুলে হেসেছে।
তখন ওয়েটার চলে আসে দুটি বিয়ারের মগ নিয়ে। ইরফান স্নিগ্ধার হাতে একটি মগ ধরিয়ে দেয় ও নিজে একটি মগ নেয়।
"ওয়াও! চকোলেট ফ্লেভার! আমার ফেভারিট।" বিয়ারে চুমুক দিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
"আরো আছে বানানা ফ্লেভার, অরেঞ্জ ফ্লেভার। চাইলে টেস্ট করে দেখতে পারো।" ইরফান বলে।
"দরকার নেই। স্যার আপনি কি ড্রিংক করেন না? নাকি আমি আছি বলেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"তুমিও একটা কারন, আরেকটি কারন হল আজ আমার ড্রাইভার আসেনি। ড্রিংক করে ড্রাইভিং করা উচিত হবেনা।" ইরফান বলে।
"তোমার হাজবেন্ড তোমাকে খুঁজছে সম্ভবত। চল ভেতরে যাই।" একটু থেমে আবার বলে ইরফান। ততোক্ষনে পার্টি হল অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। দেয়াল ঘড়িতে দেখতে পায় রাত সাড়ে বারোটা বাজে।
স্নিগ্ধাকে দেখে সজল এগিয়ে আসে।
"কোথায় ছিলে এতোক্ষন।" সজল বলে।
"আমি যেখানেই থাকি তাতে তোমার কি? তুমি আমার একটা কথাও শোন?" নিচু স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
সজল কিছু একটা বলতো কিন্তু তখন জেনারেল ম্যানেজার ইরফান আহমেদকে এগিয়ে আসতে দেখে চেপে যায় সজল।
"স্যার ও আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা, আর উনি....."
"আপনার স্ত্রীর সাথে পরিচয় আগেই হয়ে গেছে। আপনারা তো এখন বাসায় ফিরবেন?" ইরফান বলে।
"জি স্যার।"
"এতো রাতে আপনারা ট্যাক্সি পাবেন না। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে, আমি আপনাদের পৌঁছে দেই।"
"কিন্তু স্যার, আপনি অযথা কষ্ট করবেন।" সজল বলে।
"কোন কষ্ট নয়। আপনারা তো বনানিতে থাকেন। আমাকে তো ওদিক দিয়েই যেতে হবে।"
সজল আর আপত্তি করেনা।
ইরফান আহমেদ তার মারসিডিজ বেঞ্জ জিএলএ গাড়িটি সজলের এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড় করায়।
স্নিগ্ধা ও সজল নেমে যায়।
"স্যার অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি স্যার আরেকটি রিকুয়েস্ট রাখেন।"
"হ্যাঁ, বলুন।"
"যদি এক্ষুনি আমার বাসায় আসেন।"
"তা সম্ভব নয় আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।"
"তাহলে স্যার যদি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেন। আমি আপনাকে একটি জিনিস দেখাতে চাই, যাষ্ট পাঁচ মিনিট।" সজল বলে।
"ঠিক আছে।"
সজল দ্রুত তার ফ্ল্যাটে গিয়ে আলমারি থেকে একটি ফাইল বের করে আনে। তারপর সেটা ইরফানের হাতে তুলে দিয়ে বলে,
"স্যার এই ফাইলে সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টের যাবতীয় চুরির বিবরন প্রমান সহকারে আছে।"
"কি বলছেন আপনি!" চমকে উঠে বলে ইরফান।
"আপনি ফাইলটা খুলে দেখলেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু দয়া করে কাউকে বলবেন না যে এটি আমি আপনাকে দিয়েছি।" সজল বলে।
"অবশ্যই, এবং আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।" বলে ইনজিন স্টার্ট দেয় ইরফান।