16-06-2021, 08:11 PM
"চলনা কয়েকদিনের জন্য বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।" স্নিগ্ধা বলে।
"এখন ছুটি পাব না গো, সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টটা শেষ হলে ছুটি পেতে পারি।" সজল বলে।
"কবে শেষ হবে?" স্নিগ্ধা বলে।
"এই মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। দুই তারিখে শুভ উদ্বোধন।" বলে স্নিগ্ধাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে ওর গলায় ঠোঁট ঘষতে থাকে সজল।
"ছাড়ো আমায়, দুষ্টুমি কোরোনা প্লিজ, অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। সকালে অফিস যেতে হবেনা? " স্নিগ্ধা বলে।
"অন্তত একবার না করলে আমার ঘুমই আসবে না।"
স্নিগ্ধার ঘুম ভাঙে খুব ভোরে, এলার্মের শব্দে। ছটার এলার্ম দিয়ে রেখেছে মোবাইলে। স্নিগ্ধা প্রথমে এলার্মটা অফ করে, তারপর নগ্ন দেহে বিছানা থেকে নেমে আসে। আলনা থেকে সালোয়ার কামিজ নিয়ে বাথরুমে যায় সে। চটপট স্নান সেরে রান্না করতে লেগে যায় স্নিগ্ধা, স্বামীকে টিফিন দিতে হবে। চুলোয় রান্না চড়িয়ে দিয়ে স্নিগ্ধা বেডরুমে যায়, সজল তখনও চাদর মুড়ে নিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে।
"ওঠো ওঠো, অফিসে যাবে না?" গায়ে হাত দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করে বলে স্নিগ্ধা।
"আর একটু ঘুমাতে দাওনা।" ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে অন্য পাশ হয় সজল। স্নিগ্ধা তখন হাত ধরে টেনে তোলে সজলকে।
"সকাল সাতটা বাজে, উঠে গোসল করতে যাও।" শাসনের ভঙ্গিতে বলে স্নিগ্ধা।
সজল উঠে বাথরুমে যায়, স্নিগ্ধা আবারও রান্নায় মনযোগ দেয়।
সকালের নাস্তা সেরে সজল যখন অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে।
আজকে স্নিগ্ধার ক্লাস নেই। যেদিন ক্লাস থাকেনা সেদিন ওর সময় কাটতে চায়না। স্নিগ্ধা টিভি দেখতে বসে যায়। কিছুক্ষন এ চ্যানেল ও চ্যানেল পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে তারপর অফ করে দেয়। ঠিক তখনই ওর মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। স্নিগ্ধা ফোনটি হাতে নিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। কবিরের হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে অচেনা নাম্বার থেকে কল এলেই ওর হৃদস্পন্দন কিছুটা বেড়ে যায়।
"হ্যালো, কে বলছেন?" ফোন রিসিভ করে বলে স্নিগ্ধা।
"আপনি কি স্নিগ্ধা?" মেয়ে কন্ঠে ভেসে আসে।
"জি। আপনি কে বলছেন?"
"আমার নাম শারমিন। আমাকে আপনি চিনবেন না হয়তো। আপনি শাহরিয়ার কবিরকে চেনেন?"
"হ্যাঁ অবশ্যই, কবির আমার বন্ধু। ওকে কি খুঁজে পাওয়া গেছে? ও ঠিক আছে তো?" স্নিগ্ধা নিজের কন্ঠে উত্তেজনাকে লুকানোর চেষ্টা করেনা।
"আপনাকে নিরাশ করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি ওর খোঁজ সেভাবে জানিনা। কবির আর আমার স্বামী একই মেসে থাকত। সেই সুত্রে ওর সাথে পরিচয়।"
"ও, আপনি কি সোহরাব ভাইয়ার স্ত্রী?"
"আপনি চিনতেন ওকে?"
"হ্যাঁ। উনি আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন, আপনি আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হব।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে। তোমার সাথে দেখা করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু উপায় নেই," কথা শেষ না হতেই ফোনটা কেটে যায়। স্নিগ্ধা সাথে সাথে কলব্যাক করে।
"স্যরি, আমার ফোনে ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে।" শারমিন বলে।
"আমার ফোনে প্রচুর ব্যালেন্স, বলুন ভাবি।"
"পুরো বিষয়টা খুলে না বললে হয়তো তুমি বুঝবে না, যদি তুমি ব্যাস্ত হও তাহলে পরেই বলি।" শারমিন বলে।
"নিশ্চিন্তে বলুন, আমার এখন কোন কাজ নেই।"
"সোহরাবের মৃত্যুর পর পর অমি বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসি। আমার তো শশুর, শাশুড়ি কেউ নেই। ভাসুর আর দেবরদের কাঁধে বোঝা হতে চাইনি। কিন্তু কয়েকমাস পরই বাবা ও ভাইরা আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আমি আবারও বিয়ে করতে চাইনি। একসময় এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল যে আমি বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে আবার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠলাম। তখন আমার পরিস্থিতি খুব খারাপ। বাচ্চাদেরকে দুবেলা খেতে দিতেও পারছিলাম না, না পারতাম কারো কাছে চাইতে। কয়েকদিন পর আমার বিকাশ একাউন্টে কিছু টাকা এলো, ষোল হাজার টাকা। কে পাঠালো জানিনা। আমার মনে হয়েছে আমার ভাইদের কেউ টাকাটা পাঠিয়েছে। আমি অবশ্য বাবা ও ভাইদের ওপর অভিমান করে এসেছিলাম। তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি। কিন্তু আমার অভিমান এতোটাও গভীর ছিল না যে ঐ অবস্থায় টাকাগুলো নিবনা বা ফিরিয়ে দিব। এরপর থেকে প্রতি মাসেই দশ থেকে আঠারো তারিখের ভেতর টাকা আসতো। সেই টাকা দিয়েই বাচ্চাদের নিয়ে কোনভাবে বেঁচে ছিলাম। এক বছরের ভেতর নিজের চেষ্টায় একটি চাকরি যোগাড় করেছি। রাজবাড়ি জেলায় একটি কলেজে পড়াই, পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে বেশ ভালই চলে যায়। কিন্তু এখনো প্রতিমাসে সেই টাকাটা এসেই চলেছে। অনেক আগেই ভাইদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি, ওরা সবাই অস্বীকার করেছে। আমার এক কলিগের স্বামী বিকাশের কাস্টমার কেয়ারে কাজ করে। এই মাসের বারো তারিখে টাকা পাওয়ার পর আমি ওনাকে দিয়ে খোঁজ করি যে টাকাটা পাঠাচ্ছে কে। উনি জানান যে টাকাটা এসেছে যশোর বেনাপোল বর্ডার এলাকার এক এজেন্ট নাম্বার থেকে। কিন্তু ঐ এলাকায় আমার কোন আত্মীয় থাকার কথা না। আমি আগের ট্রানজেকশনগুলোরও খোঁজ নিয়েছি। প্রথম দিককার নাম্বারগুলো সিলেট অঞ্চলের, তারপর কুড়িগ্রাম, রংপুর, পঞ্চগর অঞ্চলের, এরপর খুলনা, যশোর, বাগেরহাট অঞ্চলের নাম্বার। সবগুলোই এজেন্ট নাম্বার।" একটু বিরতি নেয় শারমিন তারপর আবার বলে "আমি শিওর না, কিন্তু আমার মনে হয় টাকাগুলো কবির পাঠাচ্ছে।"
"আপনি এতোদিন বলেন নি কেন?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি খুব লজ্জিত। আমি ভেবেছিলাম আমার ভাইদের কেউ পাঠাচ্ছে টাকাটা। আর তাছাড়া কবিরের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছি মাত্র কয়েকমাস আগে।" শারমিন বলে।
"স্যরি ভাবি, ওভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি জানেন না ভাবি, এরকম একটি খবরের জন্য আম্মু কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"কবির আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ওকে খুঁজে পেতে যদি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।" একটু থেমে আবার বলে, "শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছ।"
"জি।"
"তোমার স্বামীর নাম কি সজল হাসান?"
"আপনি ওকে চেনেন? " অবাক হওয়ার ভান করে বলে স্নিগ্ধা।
"ওনার বাড়ি তো আমার শশুর বাড়ির পাশে। তাছাড়া উনি একসময় আমাকে টিউশনি পড়াতেন। এখন তাহলে রাখি, পরে কথা হবে।"
স্নিগ্ধা তার ব্যালকনিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে তখন লালচে ও গোলাপি রঙের মেঘের মেলা চলছে। কিছুদিন আগেও ওর জীবনটা ঐ রঙিন মেঘগুলোর মতোই ছিল, কিন্তু আজ যেন সবকিছু বর্নহীন। কবিরের সন্ধানের আভাস পেয়ে শিরিন ও জামান ছুটে গিয়েছিল যশোর বেনাপোল এলাকায়। যদিও জামান কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু স্ত্রীর জিদের কাছে তা ধোপে টেঁকেনি। প্রায় দু' সপ্তাহ ধরে অনেক খোঁজাখোঁজির পর নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে তারা। স্নিগ্ধার এ কটা দিন কেটেছে খুব অস্থিরতার মাঝে। যদিও ও জানত যে ধরা দিতে চায় না, তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু ওর মন বলতো যে কবিরকে এবার খুঁজে পাওয়া যাবেই।
স্নিগ্ধা ব্যালকনি ছেড়ে তার রুমে চলে আসে, রুমে এসে কলিংবেলের শব্দ শুনতে পায় । স্নিগ্ধা দরজা খুলে দেয়। সেখানে সজল দাড়িয়ে।
কখন থেকে দাড়িয়ে আছি, এতোক্ষন লাগে দরজা খুলতে?" রাগত স্বরে বলে সজল।
"স্যরি। ব্যালকনিতে বসে ছিলাম, কলিংবেল শুনতে পাইনি।" নরম স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"ঠিক আছে। তুমি দেখি এখনো রেডি হওনি। বলেছিলাম না রেডি হয়ে থাকতে, একসাথে শপিং করতে যাব?" ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সজল বলে।
"আমি কোথাও যাব না। আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"তা বললে হবে? কাল পার্টিতে কি পরে যাবে?" সজল বলে।
"আমি পার্টিতে যাবই না।" স্নিগ্ধা বলে।
"যাবে না মানে? অফিসের প্রত্যেক বিবাহিত স্টাফ তাদের স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে আসবে। তাদের সামনে কি আমাকে অপমান করতে চাও?" ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বলে সজল।
"কালকে পার্টিতে নাহয় গেলাম, কিন্তু আজ নয়। যা আছে তার ভেতরেই কিছু একটা পরে যাব।" স্নিগ্ধা বলে।
"তা বললে হয়? পার্টিতে পরে যাওয়ার মতো কোন পোশাকই তো নেই তোমার।" সজল বলে।
"আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে, সম্ভবত মাইগ্রেন।" স্নিগ্ধা বলে।
"সেকি! ওষুধ খেয়েছ?" উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে সজল।
"ওষুধ খেয়ে নিয়েছি। তুমি বরং শপিংয়ে একাই যাও।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে। কিন্তু আমার পছন্দ তো তোমার সাথে মেলে না। আমি যা আনব তা কি তুমি পরবে?" সজল বলে।
"কেন পরব না? অবশ্যই পরব।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। তুমি বিশ্রাম নাও, আজ আর রান্নাবান্না করতে যেও না, আমি আসার সময় খাবার নিয়ে আসব।" বলে সজল বের হয়ে যায়।
স্নিগ্ধা মিথ্যা বলেছে, তার মাথা ব্যাথা করছে না। তবে আজ ওর জন্য একটি বিশেষ দিন, এই সময়টা সে শপিংয়ে কাটাতে চায় না। আজ কবিরের জন্ম দিন। স্নিগ্ধা তার বেডরুমে গিয়ে আলমারী খুলে একটি এ্যালবাম বের করে নেয়। বিছানায় বসে ছবি দেখতে থাকে। কতো স্মৃতি কবিরকে নিয়ে, শৈশবের যতোটুকু মনে পড়ে ওর তাতেও আছে কবির। ওরা পুতুলের বিয়ে খেলতো, তার কিছু ছবি আছে তাতে। স্নিগ্ধার কৈশোর জুড়েও আছে ওর স্মৃতি। ওদের জন্মদিনে ওদের প্রিয় খেলা ছিল একে অন্যের মুখে কেকের ক্রীম মাখিয়ে দেয়া। ক্রীমে মাখামাখি অবস্থায় বেশ কিছু ছবি আছে এ্যালবামটিতে। সেগুলো দেখতে দেখতে ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, সাথে চোখে অশ্রু।
সজল যখন ফিরে আসে তখন রাত নটা বাজে। হাতে দুটি শপিং ব্যাগ। স্নিগ্ধা সেগুলো দেখতে চাইলে সজল মানা করে, আগে খাওয়াদাওয়া সেরে ফেলতে চায় সে। রাতের খাবার সেরে ব্যাগ খুলে দেখায় সজল। সজল নিজের জন্য একজোড়া জুতা, হাতঘড়ি আর টাই কিনেছে। স্নিগ্ধার জন্য শাড়ি, একজোড়া হিল, একজোড়া এয়ার রিং আর নেকলেস কিনেছে।
"এগুলো কি ইমিটেশন?" জুয়েলরি নির্দেশ করে বলে স্নিগ্ধা।
"নাহ, গোল্ড, ২২ ক্যারেট।" সজল বলে।
"এতো টাকা কোথায় পেলে?" চিন্তিত কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"আগে বলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা।"
"পছন্দ তো হয়েছে, কিন্তু....."
"যাও তাহলে এগুলো পরে এসো।" স্নিগ্ধাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে সজল।
স্নিগ্ধা শাড়ি গহনা নিয়ে অন্য রুমে যায়। নেভী ব্লু অর্ধস্বচ্ছ শাড়ি, সাথে ম্যাচিং করে স্লীভলেস লোকাট ব্লাউজ। ব্লাউজ এতোটাই টাইট ও লোকাট যে অর্ধস্বচ্ছ শাড়ি ভেদ করে বুকের খাঁজ স্পষ্ট বোঝা যায়।
"তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এটা কেমন শাড়ি কিনেছ? এই শাড়ি পরে আমি বাইরে বেরোব কিভাবে?" রাগত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"কি সমস্যা, ডার্লিং?"
"কি সমস্যা, বুঝছ না। ঠিক আছে, এই শাড়ীও আমি পরব না, আর না তোমার অফিসের পার্টিতে আমি যাব।"
"রাগ করছো কেন? পার্টিতে মেয়েরা এরকম পোশাকেই যায়। এদিকে এসো।" বলে স্নিগ্ধাকে হাত ধরে টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পেছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে বলে "দেখোতো, আমার বউকে কি কোন বলিউড সেলেব্রিটির চেয়ে কম লাগছে? আমার এতো সুন্দর বউ, তাকে কি ঘরের কোনে লুকিয়ে রেখে মন ভরে? আমি চাই তোমার রুপের আগুনে সবার বুক পু্ড়ে ছারখার হয়ে যাক।"
"এখন ছুটি পাব না গো, সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টটা শেষ হলে ছুটি পেতে পারি।" সজল বলে।
"কবে শেষ হবে?" স্নিগ্ধা বলে।
"এই মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। দুই তারিখে শুভ উদ্বোধন।" বলে স্নিগ্ধাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে ওর গলায় ঠোঁট ঘষতে থাকে সজল।
"ছাড়ো আমায়, দুষ্টুমি কোরোনা প্লিজ, অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। সকালে অফিস যেতে হবেনা? " স্নিগ্ধা বলে।
"অন্তত একবার না করলে আমার ঘুমই আসবে না।"
স্নিগ্ধার ঘুম ভাঙে খুব ভোরে, এলার্মের শব্দে। ছটার এলার্ম দিয়ে রেখেছে মোবাইলে। স্নিগ্ধা প্রথমে এলার্মটা অফ করে, তারপর নগ্ন দেহে বিছানা থেকে নেমে আসে। আলনা থেকে সালোয়ার কামিজ নিয়ে বাথরুমে যায় সে। চটপট স্নান সেরে রান্না করতে লেগে যায় স্নিগ্ধা, স্বামীকে টিফিন দিতে হবে। চুলোয় রান্না চড়িয়ে দিয়ে স্নিগ্ধা বেডরুমে যায়, সজল তখনও চাদর মুড়ে নিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে।
"ওঠো ওঠো, অফিসে যাবে না?" গায়ে হাত দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করে বলে স্নিগ্ধা।
"আর একটু ঘুমাতে দাওনা।" ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে অন্য পাশ হয় সজল। স্নিগ্ধা তখন হাত ধরে টেনে তোলে সজলকে।
"সকাল সাতটা বাজে, উঠে গোসল করতে যাও।" শাসনের ভঙ্গিতে বলে স্নিগ্ধা।
সজল উঠে বাথরুমে যায়, স্নিগ্ধা আবারও রান্নায় মনযোগ দেয়।
সকালের নাস্তা সেরে সজল যখন অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে।
আজকে স্নিগ্ধার ক্লাস নেই। যেদিন ক্লাস থাকেনা সেদিন ওর সময় কাটতে চায়না। স্নিগ্ধা টিভি দেখতে বসে যায়। কিছুক্ষন এ চ্যানেল ও চ্যানেল পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে তারপর অফ করে দেয়। ঠিক তখনই ওর মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। স্নিগ্ধা ফোনটি হাতে নিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। কবিরের হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে অচেনা নাম্বার থেকে কল এলেই ওর হৃদস্পন্দন কিছুটা বেড়ে যায়।
"হ্যালো, কে বলছেন?" ফোন রিসিভ করে বলে স্নিগ্ধা।
"আপনি কি স্নিগ্ধা?" মেয়ে কন্ঠে ভেসে আসে।
"জি। আপনি কে বলছেন?"
"আমার নাম শারমিন। আমাকে আপনি চিনবেন না হয়তো। আপনি শাহরিয়ার কবিরকে চেনেন?"
"হ্যাঁ অবশ্যই, কবির আমার বন্ধু। ওকে কি খুঁজে পাওয়া গেছে? ও ঠিক আছে তো?" স্নিগ্ধা নিজের কন্ঠে উত্তেজনাকে লুকানোর চেষ্টা করেনা।
"আপনাকে নিরাশ করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি ওর খোঁজ সেভাবে জানিনা। কবির আর আমার স্বামী একই মেসে থাকত। সেই সুত্রে ওর সাথে পরিচয়।"
"ও, আপনি কি সোহরাব ভাইয়ার স্ত্রী?"
"আপনি চিনতেন ওকে?"
"হ্যাঁ। উনি আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন, আপনি আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হব।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে। তোমার সাথে দেখা করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু উপায় নেই," কথা শেষ না হতেই ফোনটা কেটে যায়। স্নিগ্ধা সাথে সাথে কলব্যাক করে।
"স্যরি, আমার ফোনে ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে।" শারমিন বলে।
"আমার ফোনে প্রচুর ব্যালেন্স, বলুন ভাবি।"
"পুরো বিষয়টা খুলে না বললে হয়তো তুমি বুঝবে না, যদি তুমি ব্যাস্ত হও তাহলে পরেই বলি।" শারমিন বলে।
"নিশ্চিন্তে বলুন, আমার এখন কোন কাজ নেই।"
"সোহরাবের মৃত্যুর পর পর অমি বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসি। আমার তো শশুর, শাশুড়ি কেউ নেই। ভাসুর আর দেবরদের কাঁধে বোঝা হতে চাইনি। কিন্তু কয়েকমাস পরই বাবা ও ভাইরা আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আমি আবারও বিয়ে করতে চাইনি। একসময় এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল যে আমি বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে আবার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠলাম। তখন আমার পরিস্থিতি খুব খারাপ। বাচ্চাদেরকে দুবেলা খেতে দিতেও পারছিলাম না, না পারতাম কারো কাছে চাইতে। কয়েকদিন পর আমার বিকাশ একাউন্টে কিছু টাকা এলো, ষোল হাজার টাকা। কে পাঠালো জানিনা। আমার মনে হয়েছে আমার ভাইদের কেউ টাকাটা পাঠিয়েছে। আমি অবশ্য বাবা ও ভাইদের ওপর অভিমান করে এসেছিলাম। তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি। কিন্তু আমার অভিমান এতোটাও গভীর ছিল না যে ঐ অবস্থায় টাকাগুলো নিবনা বা ফিরিয়ে দিব। এরপর থেকে প্রতি মাসেই দশ থেকে আঠারো তারিখের ভেতর টাকা আসতো। সেই টাকা দিয়েই বাচ্চাদের নিয়ে কোনভাবে বেঁচে ছিলাম। এক বছরের ভেতর নিজের চেষ্টায় একটি চাকরি যোগাড় করেছি। রাজবাড়ি জেলায় একটি কলেজে পড়াই, পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে বেশ ভালই চলে যায়। কিন্তু এখনো প্রতিমাসে সেই টাকাটা এসেই চলেছে। অনেক আগেই ভাইদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি, ওরা সবাই অস্বীকার করেছে। আমার এক কলিগের স্বামী বিকাশের কাস্টমার কেয়ারে কাজ করে। এই মাসের বারো তারিখে টাকা পাওয়ার পর আমি ওনাকে দিয়ে খোঁজ করি যে টাকাটা পাঠাচ্ছে কে। উনি জানান যে টাকাটা এসেছে যশোর বেনাপোল বর্ডার এলাকার এক এজেন্ট নাম্বার থেকে। কিন্তু ঐ এলাকায় আমার কোন আত্মীয় থাকার কথা না। আমি আগের ট্রানজেকশনগুলোরও খোঁজ নিয়েছি। প্রথম দিককার নাম্বারগুলো সিলেট অঞ্চলের, তারপর কুড়িগ্রাম, রংপুর, পঞ্চগর অঞ্চলের, এরপর খুলনা, যশোর, বাগেরহাট অঞ্চলের নাম্বার। সবগুলোই এজেন্ট নাম্বার।" একটু বিরতি নেয় শারমিন তারপর আবার বলে "আমি শিওর না, কিন্তু আমার মনে হয় টাকাগুলো কবির পাঠাচ্ছে।"
"আপনি এতোদিন বলেন নি কেন?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি খুব লজ্জিত। আমি ভেবেছিলাম আমার ভাইদের কেউ পাঠাচ্ছে টাকাটা। আর তাছাড়া কবিরের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছি মাত্র কয়েকমাস আগে।" শারমিন বলে।
"স্যরি ভাবি, ওভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি জানেন না ভাবি, এরকম একটি খবরের জন্য আম্মু কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"কবির আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ওকে খুঁজে পেতে যদি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।" একটু থেমে আবার বলে, "শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছ।"
"জি।"
"তোমার স্বামীর নাম কি সজল হাসান?"
"আপনি ওকে চেনেন? " অবাক হওয়ার ভান করে বলে স্নিগ্ধা।
"ওনার বাড়ি তো আমার শশুর বাড়ির পাশে। তাছাড়া উনি একসময় আমাকে টিউশনি পড়াতেন। এখন তাহলে রাখি, পরে কথা হবে।"
স্নিগ্ধা তার ব্যালকনিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে তখন লালচে ও গোলাপি রঙের মেঘের মেলা চলছে। কিছুদিন আগেও ওর জীবনটা ঐ রঙিন মেঘগুলোর মতোই ছিল, কিন্তু আজ যেন সবকিছু বর্নহীন। কবিরের সন্ধানের আভাস পেয়ে শিরিন ও জামান ছুটে গিয়েছিল যশোর বেনাপোল এলাকায়। যদিও জামান কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু স্ত্রীর জিদের কাছে তা ধোপে টেঁকেনি। প্রায় দু' সপ্তাহ ধরে অনেক খোঁজাখোঁজির পর নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে তারা। স্নিগ্ধার এ কটা দিন কেটেছে খুব অস্থিরতার মাঝে। যদিও ও জানত যে ধরা দিতে চায় না, তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু ওর মন বলতো যে কবিরকে এবার খুঁজে পাওয়া যাবেই।
স্নিগ্ধা ব্যালকনি ছেড়ে তার রুমে চলে আসে, রুমে এসে কলিংবেলের শব্দ শুনতে পায় । স্নিগ্ধা দরজা খুলে দেয়। সেখানে সজল দাড়িয়ে।
কখন থেকে দাড়িয়ে আছি, এতোক্ষন লাগে দরজা খুলতে?" রাগত স্বরে বলে সজল।
"স্যরি। ব্যালকনিতে বসে ছিলাম, কলিংবেল শুনতে পাইনি।" নরম স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"ঠিক আছে। তুমি দেখি এখনো রেডি হওনি। বলেছিলাম না রেডি হয়ে থাকতে, একসাথে শপিং করতে যাব?" ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সজল বলে।
"আমি কোথাও যাব না। আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"তা বললে হবে? কাল পার্টিতে কি পরে যাবে?" সজল বলে।
"আমি পার্টিতে যাবই না।" স্নিগ্ধা বলে।
"যাবে না মানে? অফিসের প্রত্যেক বিবাহিত স্টাফ তাদের স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে আসবে। তাদের সামনে কি আমাকে অপমান করতে চাও?" ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বলে সজল।
"কালকে পার্টিতে নাহয় গেলাম, কিন্তু আজ নয়। যা আছে তার ভেতরেই কিছু একটা পরে যাব।" স্নিগ্ধা বলে।
"তা বললে হয়? পার্টিতে পরে যাওয়ার মতো কোন পোশাকই তো নেই তোমার।" সজল বলে।
"আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে, সম্ভবত মাইগ্রেন।" স্নিগ্ধা বলে।
"সেকি! ওষুধ খেয়েছ?" উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে সজল।
"ওষুধ খেয়ে নিয়েছি। তুমি বরং শপিংয়ে একাই যাও।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে। কিন্তু আমার পছন্দ তো তোমার সাথে মেলে না। আমি যা আনব তা কি তুমি পরবে?" সজল বলে।
"কেন পরব না? অবশ্যই পরব।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। তুমি বিশ্রাম নাও, আজ আর রান্নাবান্না করতে যেও না, আমি আসার সময় খাবার নিয়ে আসব।" বলে সজল বের হয়ে যায়।
স্নিগ্ধা মিথ্যা বলেছে, তার মাথা ব্যাথা করছে না। তবে আজ ওর জন্য একটি বিশেষ দিন, এই সময়টা সে শপিংয়ে কাটাতে চায় না। আজ কবিরের জন্ম দিন। স্নিগ্ধা তার বেডরুমে গিয়ে আলমারী খুলে একটি এ্যালবাম বের করে নেয়। বিছানায় বসে ছবি দেখতে থাকে। কতো স্মৃতি কবিরকে নিয়ে, শৈশবের যতোটুকু মনে পড়ে ওর তাতেও আছে কবির। ওরা পুতুলের বিয়ে খেলতো, তার কিছু ছবি আছে তাতে। স্নিগ্ধার কৈশোর জুড়েও আছে ওর স্মৃতি। ওদের জন্মদিনে ওদের প্রিয় খেলা ছিল একে অন্যের মুখে কেকের ক্রীম মাখিয়ে দেয়া। ক্রীমে মাখামাখি অবস্থায় বেশ কিছু ছবি আছে এ্যালবামটিতে। সেগুলো দেখতে দেখতে ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, সাথে চোখে অশ্রু।
সজল যখন ফিরে আসে তখন রাত নটা বাজে। হাতে দুটি শপিং ব্যাগ। স্নিগ্ধা সেগুলো দেখতে চাইলে সজল মানা করে, আগে খাওয়াদাওয়া সেরে ফেলতে চায় সে। রাতের খাবার সেরে ব্যাগ খুলে দেখায় সজল। সজল নিজের জন্য একজোড়া জুতা, হাতঘড়ি আর টাই কিনেছে। স্নিগ্ধার জন্য শাড়ি, একজোড়া হিল, একজোড়া এয়ার রিং আর নেকলেস কিনেছে।
"এগুলো কি ইমিটেশন?" জুয়েলরি নির্দেশ করে বলে স্নিগ্ধা।
"নাহ, গোল্ড, ২২ ক্যারেট।" সজল বলে।
"এতো টাকা কোথায় পেলে?" চিন্তিত কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"আগে বলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা।"
"পছন্দ তো হয়েছে, কিন্তু....."
"যাও তাহলে এগুলো পরে এসো।" স্নিগ্ধাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে সজল।
স্নিগ্ধা শাড়ি গহনা নিয়ে অন্য রুমে যায়। নেভী ব্লু অর্ধস্বচ্ছ শাড়ি, সাথে ম্যাচিং করে স্লীভলেস লোকাট ব্লাউজ। ব্লাউজ এতোটাই টাইট ও লোকাট যে অর্ধস্বচ্ছ শাড়ি ভেদ করে বুকের খাঁজ স্পষ্ট বোঝা যায়।
"তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এটা কেমন শাড়ি কিনেছ? এই শাড়ি পরে আমি বাইরে বেরোব কিভাবে?" রাগত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"কি সমস্যা, ডার্লিং?"
"কি সমস্যা, বুঝছ না। ঠিক আছে, এই শাড়ীও আমি পরব না, আর না তোমার অফিসের পার্টিতে আমি যাব।"
"রাগ করছো কেন? পার্টিতে মেয়েরা এরকম পোশাকেই যায়। এদিকে এসো।" বলে স্নিগ্ধাকে হাত ধরে টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পেছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে বলে "দেখোতো, আমার বউকে কি কোন বলিউড সেলেব্রিটির চেয়ে কম লাগছে? আমার এতো সুন্দর বউ, তাকে কি ঘরের কোনে লুকিয়ে রেখে মন ভরে? আমি চাই তোমার রুপের আগুনে সবার বুক পু্ড়ে ছারখার হয়ে যাক।"