16-06-2021, 08:10 PM
তৃতীয় পর্বঃ অপূর্নতার গল্প
স্নিগ্ধা ক্লাসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। তখন শুভংকর স্যার ম্যাথ ক্লাস নিচ্ছিলেন, স্নিগ্ধার সেদিকে মনযোগ নেই। জানালার ওপাশে কৃষ্ণচুড়া গাছ টকটকে লাল ফুলে ছেয়ে গেছে, তার একটি ডালে দুটি শালিক পাখি বসে কিচির মিচির করছে। স্নিগ্ধার দৃষ্টিটা সে দিকে, কিন্তু মনটা সম্ভবত সেদিকেও নেই।
স্নিগ্ধাকে অমনোযোগী দেখে শুভংকর তাকে ডাকেন। কিন্তু স্নিগ্ধা কোন সাড়া দেয়না। পাশ থেকে শিল্পী ওর কাঁধে হাত রাখে। তখন স্নিগ্ধা ফিরে তাকায়, শুভংকর স্যার তাকে ডেকেছেন তা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লেগে যায় তার। স্নিগ্ধা তখন উঠে দাড়ায়।
"দাড়াতে হবেনা, বসো। অংকটা বুঝেছ? পারবে করতে", ব্লাকবোর্ডে করে দেয়া রিগোরাস উপপাদ্যের অংকটার দিকে নির্দেশ করে স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞাসা করেন শুভংকর স্যার।
"জি স্যার।" আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দেয় স্নিগ্ধা।
"স্নিগ্ধা, তুমি মেধাবী ছাত্রী, পরীক্ষায় সবসময় ভাল কর। ক্লাসেও তো মনোযোগী ছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি তুমি ক্লাসে মনযোগী নও। কোন সমস্যা?"
"না স্যার, তেমন কিছু নয়।" স্নিগ্ধা বলে।
"পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হও। শেষ পর্বে এসে মনোযোগ হারিয়ে ফেলো না।" শুভংকর স্যার স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে বলেন। তারপর কন্ঠ আরেকটু উচ্চ করে বলেন "তোমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি, বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, 'শেষ ভাল যার, সব ভাল তার'। তোমরা এই শেষ পর্বে তোমাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবে। আজকে ক্লাস এই পর্যন্তই।"
প্রফেসর শুভংকর দাশগুপ্ত ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই সব ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসে, স্নিগ্ধা ও শিল্পী একসাথে বের হয়।
"স্যার ঠিকই বলেছেন, তুই কেমন যেন বদলে গেছিস। শুধু কিছু দিন থেকে নয়, তোর বিয়ের পর থেকেই দেখছি সারাক্ষন কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকিস।" ক্যামপাস দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিল্পী বলে।
"কই নাতো।" স্নিগ্ধা বলে।
"একদম লুকাবি না। তোদের মধ্যে কোন ঝামেলা চলছে নাকি?" শিল্পী বলে।
"কই, কোন ঝামেলা নেই।" উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে নিশ্চয়ই তোর বর তোকে সুখ দিতে পারেনা।" ফিস ফিস করে কৌতুকের সুরে বলে শিল্পী।
"একটা থাপ্পড় খাবি।" রাগত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
ততক্ষনে ক্যাম্পাসের গেটে চলে এসেছে ওরা।
"বাসায় গিয়ে কি করবি এখন? তারচেয়ে চল না মেসে গিয়ে আড্ডা দেই।" শিল্পী প্রস্তাব দেয়।
"আজ না, অন্য কোন দিন।"
"কেন? আজ কি তোর বর তাড়াতাড়ি ফিরবে?"
"সেই সম্ভাবনা খুব কম। ও খুব ব্যাস্ত, প্রতিদিনই ওর ফিরতে ফিরতে রাত দশটা এগারোটা বেজে যায়।"
"তাহলে এখন গিয়ে কি করবি?"
"তুই বুঝবিনা। তোর তো আর রান্নাবান্না করা লাগে না, মেসের বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। আমার অনেক কাজ আছে। আমি এখন যাই।" বলে স্নিগ্ধা একটি রিক্সা নিয়ে নেয়। রিক্সা করে বাস স্টপেজে আসে সে। বাসের জন্য বেশী অপেক্ষা করতে হয় না স্নিগ্ধার, প্রায় সাথে সাথেই বাস পেয়ে যায়। বাসের একটি সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল, এর মাঝে স্নিগ্ধার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। হঠাত করে ওর আর সজলের বিয়ে হয়ে গেল। এরপর কবিরের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। স্নিগ্ধার বাবা মা ও শাফাকাত আঙ্কেল অনেক খুঁজেছেন কবিরকে, যত বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সবার কাছে খোঁজ নেয়া হয়েছে, পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে মাস খানেক ধরে। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি কবিরের। এরপর স্নিগ্ধার শাশুড়ি জাহেদা বেগমের মৃত্যু। অপারেশন থিয়েটারেই জাহেদা বেগমের মৃত্যু হয়, খুব ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন ছিল, ডাক্তাররা তাকে বাঁচাতে পারেনি।
স্নিগ্ধা যখন তার বাসায় পৌঁছে তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। স্নিগ্ধা ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে সেখানে তিনটি মিসড কল। একটি সজলের আর দুটি ওর বাবার। স্নিগ্ধা ওর বাবাকে কল দেয়। একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো মামনি, ভাল আছ?" জামান বলে।
"হ্যাঁ আব্বু, তোমরা কেমন আছ?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তো ভালই আছি, কিন্তু তোমার আম্মুর প্রেশার একটু বেড়েছে।" জামান বলে।
"তাই? ডাক্তার দেখিয়েছ আব্বু?"
"আমি নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু তোমার আম্মু রাজি হলনা। অবশ্য সামান্য বেড়েছে, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না আম্মু।" একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে জামান "জামাই ফিরেছে?"
"এখনো ফেরেনি। ও তো খুব ব্যাস্ত, প্রতিদিনই দেরি করে ফেরে।"
"জামাইয়ের ব্যাস্ততা একটু কমলে একদিন সময় করে চলে এসো জামাইকে সাথে নিয়ে। তোমাকে কতোদিন দেখি না মামনি।" জামান বলে।
"তোমার জামাইয়ের যা চাকরি, ও ছুটি পাবেনা। তার চেয়ে বরং তুমি আম্মুকে নিয়েই চলে এসো না।" স্নিগ্ধা বলে।
"আচ্ছা দেখি ছুটি পাই কিনা।"
"আম্মুকে দাওতো।" স্নিগ্ধা বলে।
জামান সেলফোনটা শিরিনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
"হ্যালো আম্মু, কেমন আছ?" স্নিগ্ধা বলে।
"ভাল আছি মা, তুই কেমন আছিস?" শিরিন বলে।
"আমি ভাল আছি। কিন্তু শুনলাম তোমার শরীর খারাপ।" স্নিগ্ধা বলে।
"এখন ভাল আছি মা, চিন্তা করিস না।" একটু থেমে শিরিন আবার জিজ্ঞাসা করে "কবিরের কোন খোঁজ পেলি?" বলতে গিয়ে শিরিনের কন্ঠ কেঁপে ওঠে।
"না মা।" একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে স্নিগ্ধা।
"তুমি ওকে নিয়ে একদমই চিন্তা কোরোনা, ও যেখানে আছি নিশ্চয়ই ভাল আছে। ওকে নিয়ে টেনশন করে করেই তুমি অসুখ বাঁধিয়ে ফেলছ।" স্নিগ্ধা বলে।
"তুই যদি মা হতি তাহলে আমার অবস্থানটা বুঝতে পারতি। সন্তান যদি একপলক চোখের আড়াল হয় তাহলেই মায়ের আত্মা উড়ে যেতে চায়। সেখানে দুই দুটো বছর হল, ছেলেটা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, কিছু জানিনা।" বলতে বলতে শিরিনের গলা ধরে আসে।
"তুমি আবার শুরু হলে?" ওর বাবার কন্ঠে শুনতে পায় স্নিগ্ধা।
"রাখি মা।" বলে ফোনটা কেটে দেয় শিরিন।
স্নিগ্ধা আরো মিনিট খানেক মোবাইলটা কানে ধরে রাখে। ওর চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করছে। বিগত দুটি বছর ধরে ও ভেতরে ভেতরে কেঁদে যাচ্ছে। ওর মনের কষ্ট প্রকাশ করার মতো কেউ নেই।
বাবা মার সাথে কথা বলার পর স্নিগ্ধা সজলকে ফোন করে। একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো জান, কি করো?" সজল বলে।
"কিছু না। এখন রান্না করব। কি খাবে বল?" স্নিগ্ধা বলে।
"আজকে পাবদা মাছ চচ্চড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।" সজল বলে।
"ফ্রিজে তো পাবদা মাছ নেই। তাহলে তুমি আসার সময় কিনে এনো।"
"আমার ফিরতে দেরি হবে। যা আছে তা দিয়েই কিছু একটা রেঁধে ফেল।"
"ঠিক আছে। বেশি দেরি কোরো না যেন।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে জান। চেষ্টা করব তাড়াতাড়ি ফেরার।"
স্নিগ্ধা ফোন কেটে দিয়ে, রান্নাবান্না শুরু করে। এক ঘন্টার মধ্যে রান্নাবান্না শেষ করে স্নিগ্ধা, এরপর ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখতে থাকে।
সজল যখন ফেরে তখন রাত এগারোটা বাজে।
"ফ্রেস হয়ে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।" স্নিগ্ধা বলে।
সজল বেডরুমে গিয়ে কাপড় বদলায়, তারপর ওয়াসরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে। ততোক্ষনে স্নিগ্ধা ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়েছে। দুজন একসাথে খেতে বসে।
"বুঝলে জান, পুরো কোম্পানিটাই চোর ছ্যাঁচর দিয়ে ভরে গেছে, যে যেমন করে পারে লুটেপুটে খাচ্ছে।" খেতে খেতে বলে সজল।
"কেন, কি হল আবার?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"তুমি তো জানই, সেরিনা টাওয়ার প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ, এখন শুধু ফিনিশিং চলছে। ঐ প্রজেক্টের জন্য কেনা তিন হাজার পঁয়ত্রিশ বস্তা সিমেন্ট বেঁচে গিয়েছে। আমি চেক করে দেখেছি সিমেন্টের কোয়ালিটি এখনো যথেষ্ট ভাল আছে। কিন্তু প্রজেক্ট ইনচার্জ পুরো সিমেন্টটাকেই ওয়েসটেজ দেখিয়ে একাই হাতিয়ে নিয়েছে। পুরো ষোল লক্ষ টাকার সিমেন্ট।"
"তুমি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানাও।" স্নিগ্ধা বলে।
"তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই প্রজেক্টের ইনচার্জ হলেন এজিএম স্যার নিজেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ওনার সাথে ঝামেলায় জড়াবো?" সজল বলে।
"চুপ করে থেকেও তো তুমি ঝামেলায় জড়িয়ে যেতে পারো। ধর তুমি কিছু বললে না, কিন্তু তারপরও কর্তৃপক্ষ কোনভাবে জেনে গেল। তখন কি হবে ভেবে দেখেছ? ওনারা কিন্তু ভেবে নেবেন যে এই চুরির সাথে তুমিও জড়িত।"
"তুমি ঠিকই বলেছ জান। আমি জিনিসটা এভাবে তো ভেবে দেখিনি।" সজল বলে।
"তুমি বিষয়টা কর্তৃপক্ষকে জানাও, তবে এমন কাউকে জানাবে যিনি যথেষ্ট সৎ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাখেন।" স্নিগ্ধা বলে। কিন্তু সজল শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না, গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে সে।
স্নিগ্ধা ওর কাঁধে হাত রেখে সম্বিত ফেরায়।
"কি ভাবছো অতো?" স্নিগ্ধা বলে।
"কিছু না, জান।" বলে খাওয়ার দিকে মন দেয় সজল।
"তার চেয়ে বরং তুমি চাকরিটাই ছেড়ে দাও। তুমি তো চাইলে যেকোন মুহুর্তেই চাকরি যোগাড় করতে পারবে।" স্নিগ্ধা বলে।
"যেখানে যাব সেখানে যে এমন চোরবাটপার থাকবে না তার গ্যারান্টি কি? জীবনে উন্নতি করতে হলে একটি যায়গা ধরে রাখতে হবে।" সজল বলে।
ততক্ষনে ওদের খাওয়া হয়ে গেছে। এরপর ওরা শুতে যায়।
স্নিগ্ধা ক্লাসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। তখন শুভংকর স্যার ম্যাথ ক্লাস নিচ্ছিলেন, স্নিগ্ধার সেদিকে মনযোগ নেই। জানালার ওপাশে কৃষ্ণচুড়া গাছ টকটকে লাল ফুলে ছেয়ে গেছে, তার একটি ডালে দুটি শালিক পাখি বসে কিচির মিচির করছে। স্নিগ্ধার দৃষ্টিটা সে দিকে, কিন্তু মনটা সম্ভবত সেদিকেও নেই।
স্নিগ্ধাকে অমনোযোগী দেখে শুভংকর তাকে ডাকেন। কিন্তু স্নিগ্ধা কোন সাড়া দেয়না। পাশ থেকে শিল্পী ওর কাঁধে হাত রাখে। তখন স্নিগ্ধা ফিরে তাকায়, শুভংকর স্যার তাকে ডেকেছেন তা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লেগে যায় তার। স্নিগ্ধা তখন উঠে দাড়ায়।
"দাড়াতে হবেনা, বসো। অংকটা বুঝেছ? পারবে করতে", ব্লাকবোর্ডে করে দেয়া রিগোরাস উপপাদ্যের অংকটার দিকে নির্দেশ করে স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞাসা করেন শুভংকর স্যার।
"জি স্যার।" আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দেয় স্নিগ্ধা।
"স্নিগ্ধা, তুমি মেধাবী ছাত্রী, পরীক্ষায় সবসময় ভাল কর। ক্লাসেও তো মনোযোগী ছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি তুমি ক্লাসে মনযোগী নও। কোন সমস্যা?"
"না স্যার, তেমন কিছু নয়।" স্নিগ্ধা বলে।
"পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হও। শেষ পর্বে এসে মনোযোগ হারিয়ে ফেলো না।" শুভংকর স্যার স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে বলেন। তারপর কন্ঠ আরেকটু উচ্চ করে বলেন "তোমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি, বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, 'শেষ ভাল যার, সব ভাল তার'। তোমরা এই শেষ পর্বে তোমাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবে। আজকে ক্লাস এই পর্যন্তই।"
প্রফেসর শুভংকর দাশগুপ্ত ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই সব ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসে, স্নিগ্ধা ও শিল্পী একসাথে বের হয়।
"স্যার ঠিকই বলেছেন, তুই কেমন যেন বদলে গেছিস। শুধু কিছু দিন থেকে নয়, তোর বিয়ের পর থেকেই দেখছি সারাক্ষন কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকিস।" ক্যামপাস দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিল্পী বলে।
"কই নাতো।" স্নিগ্ধা বলে।
"একদম লুকাবি না। তোদের মধ্যে কোন ঝামেলা চলছে নাকি?" শিল্পী বলে।
"কই, কোন ঝামেলা নেই।" উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে নিশ্চয়ই তোর বর তোকে সুখ দিতে পারেনা।" ফিস ফিস করে কৌতুকের সুরে বলে শিল্পী।
"একটা থাপ্পড় খাবি।" রাগত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
ততক্ষনে ক্যাম্পাসের গেটে চলে এসেছে ওরা।
"বাসায় গিয়ে কি করবি এখন? তারচেয়ে চল না মেসে গিয়ে আড্ডা দেই।" শিল্পী প্রস্তাব দেয়।
"আজ না, অন্য কোন দিন।"
"কেন? আজ কি তোর বর তাড়াতাড়ি ফিরবে?"
"সেই সম্ভাবনা খুব কম। ও খুব ব্যাস্ত, প্রতিদিনই ওর ফিরতে ফিরতে রাত দশটা এগারোটা বেজে যায়।"
"তাহলে এখন গিয়ে কি করবি?"
"তুই বুঝবিনা। তোর তো আর রান্নাবান্না করা লাগে না, মেসের বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। আমার অনেক কাজ আছে। আমি এখন যাই।" বলে স্নিগ্ধা একটি রিক্সা নিয়ে নেয়। রিক্সা করে বাস স্টপেজে আসে সে। বাসের জন্য বেশী অপেক্ষা করতে হয় না স্নিগ্ধার, প্রায় সাথে সাথেই বাস পেয়ে যায়। বাসের একটি সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল, এর মাঝে স্নিগ্ধার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। হঠাত করে ওর আর সজলের বিয়ে হয়ে গেল। এরপর কবিরের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। স্নিগ্ধার বাবা মা ও শাফাকাত আঙ্কেল অনেক খুঁজেছেন কবিরকে, যত বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সবার কাছে খোঁজ নেয়া হয়েছে, পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে মাস খানেক ধরে। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি কবিরের। এরপর স্নিগ্ধার শাশুড়ি জাহেদা বেগমের মৃত্যু। অপারেশন থিয়েটারেই জাহেদা বেগমের মৃত্যু হয়, খুব ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন ছিল, ডাক্তাররা তাকে বাঁচাতে পারেনি।
স্নিগ্ধা যখন তার বাসায় পৌঁছে তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। স্নিগ্ধা ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে সেখানে তিনটি মিসড কল। একটি সজলের আর দুটি ওর বাবার। স্নিগ্ধা ওর বাবাকে কল দেয়। একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো মামনি, ভাল আছ?" জামান বলে।
"হ্যাঁ আব্বু, তোমরা কেমন আছ?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তো ভালই আছি, কিন্তু তোমার আম্মুর প্রেশার একটু বেড়েছে।" জামান বলে।
"তাই? ডাক্তার দেখিয়েছ আব্বু?"
"আমি নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু তোমার আম্মু রাজি হলনা। অবশ্য সামান্য বেড়েছে, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না আম্মু।" একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে জামান "জামাই ফিরেছে?"
"এখনো ফেরেনি। ও তো খুব ব্যাস্ত, প্রতিদিনই দেরি করে ফেরে।"
"জামাইয়ের ব্যাস্ততা একটু কমলে একদিন সময় করে চলে এসো জামাইকে সাথে নিয়ে। তোমাকে কতোদিন দেখি না মামনি।" জামান বলে।
"তোমার জামাইয়ের যা চাকরি, ও ছুটি পাবেনা। তার চেয়ে বরং তুমি আম্মুকে নিয়েই চলে এসো না।" স্নিগ্ধা বলে।
"আচ্ছা দেখি ছুটি পাই কিনা।"
"আম্মুকে দাওতো।" স্নিগ্ধা বলে।
জামান সেলফোনটা শিরিনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
"হ্যালো আম্মু, কেমন আছ?" স্নিগ্ধা বলে।
"ভাল আছি মা, তুই কেমন আছিস?" শিরিন বলে।
"আমি ভাল আছি। কিন্তু শুনলাম তোমার শরীর খারাপ।" স্নিগ্ধা বলে।
"এখন ভাল আছি মা, চিন্তা করিস না।" একটু থেমে শিরিন আবার জিজ্ঞাসা করে "কবিরের কোন খোঁজ পেলি?" বলতে গিয়ে শিরিনের কন্ঠ কেঁপে ওঠে।
"না মা।" একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে স্নিগ্ধা।
"তুমি ওকে নিয়ে একদমই চিন্তা কোরোনা, ও যেখানে আছি নিশ্চয়ই ভাল আছে। ওকে নিয়ে টেনশন করে করেই তুমি অসুখ বাঁধিয়ে ফেলছ।" স্নিগ্ধা বলে।
"তুই যদি মা হতি তাহলে আমার অবস্থানটা বুঝতে পারতি। সন্তান যদি একপলক চোখের আড়াল হয় তাহলেই মায়ের আত্মা উড়ে যেতে চায়। সেখানে দুই দুটো বছর হল, ছেলেটা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, কিছু জানিনা।" বলতে বলতে শিরিনের গলা ধরে আসে।
"তুমি আবার শুরু হলে?" ওর বাবার কন্ঠে শুনতে পায় স্নিগ্ধা।
"রাখি মা।" বলে ফোনটা কেটে দেয় শিরিন।
স্নিগ্ধা আরো মিনিট খানেক মোবাইলটা কানে ধরে রাখে। ওর চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করছে। বিগত দুটি বছর ধরে ও ভেতরে ভেতরে কেঁদে যাচ্ছে। ওর মনের কষ্ট প্রকাশ করার মতো কেউ নেই।
বাবা মার সাথে কথা বলার পর স্নিগ্ধা সজলকে ফোন করে। একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো জান, কি করো?" সজল বলে।
"কিছু না। এখন রান্না করব। কি খাবে বল?" স্নিগ্ধা বলে।
"আজকে পাবদা মাছ চচ্চড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।" সজল বলে।
"ফ্রিজে তো পাবদা মাছ নেই। তাহলে তুমি আসার সময় কিনে এনো।"
"আমার ফিরতে দেরি হবে। যা আছে তা দিয়েই কিছু একটা রেঁধে ফেল।"
"ঠিক আছে। বেশি দেরি কোরো না যেন।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে জান। চেষ্টা করব তাড়াতাড়ি ফেরার।"
স্নিগ্ধা ফোন কেটে দিয়ে, রান্নাবান্না শুরু করে। এক ঘন্টার মধ্যে রান্নাবান্না শেষ করে স্নিগ্ধা, এরপর ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখতে থাকে।
সজল যখন ফেরে তখন রাত এগারোটা বাজে।
"ফ্রেস হয়ে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।" স্নিগ্ধা বলে।
সজল বেডরুমে গিয়ে কাপড় বদলায়, তারপর ওয়াসরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে। ততোক্ষনে স্নিগ্ধা ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়েছে। দুজন একসাথে খেতে বসে।
"বুঝলে জান, পুরো কোম্পানিটাই চোর ছ্যাঁচর দিয়ে ভরে গেছে, যে যেমন করে পারে লুটেপুটে খাচ্ছে।" খেতে খেতে বলে সজল।
"কেন, কি হল আবার?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"তুমি তো জানই, সেরিনা টাওয়ার প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ, এখন শুধু ফিনিশিং চলছে। ঐ প্রজেক্টের জন্য কেনা তিন হাজার পঁয়ত্রিশ বস্তা সিমেন্ট বেঁচে গিয়েছে। আমি চেক করে দেখেছি সিমেন্টের কোয়ালিটি এখনো যথেষ্ট ভাল আছে। কিন্তু প্রজেক্ট ইনচার্জ পুরো সিমেন্টটাকেই ওয়েসটেজ দেখিয়ে একাই হাতিয়ে নিয়েছে। পুরো ষোল লক্ষ টাকার সিমেন্ট।"
"তুমি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানাও।" স্নিগ্ধা বলে।
"তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই প্রজেক্টের ইনচার্জ হলেন এজিএম স্যার নিজেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ওনার সাথে ঝামেলায় জড়াবো?" সজল বলে।
"চুপ করে থেকেও তো তুমি ঝামেলায় জড়িয়ে যেতে পারো। ধর তুমি কিছু বললে না, কিন্তু তারপরও কর্তৃপক্ষ কোনভাবে জেনে গেল। তখন কি হবে ভেবে দেখেছ? ওনারা কিন্তু ভেবে নেবেন যে এই চুরির সাথে তুমিও জড়িত।"
"তুমি ঠিকই বলেছ জান। আমি জিনিসটা এভাবে তো ভেবে দেখিনি।" সজল বলে।
"তুমি বিষয়টা কর্তৃপক্ষকে জানাও, তবে এমন কাউকে জানাবে যিনি যথেষ্ট সৎ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাখেন।" স্নিগ্ধা বলে। কিন্তু সজল শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না, গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে সে।
স্নিগ্ধা ওর কাঁধে হাত রেখে সম্বিত ফেরায়।
"কি ভাবছো অতো?" স্নিগ্ধা বলে।
"কিছু না, জান।" বলে খাওয়ার দিকে মন দেয় সজল।
"তার চেয়ে বরং তুমি চাকরিটাই ছেড়ে দাও। তুমি তো চাইলে যেকোন মুহুর্তেই চাকরি যোগাড় করতে পারবে।" স্নিগ্ধা বলে।
"যেখানে যাব সেখানে যে এমন চোরবাটপার থাকবে না তার গ্যারান্টি কি? জীবনে উন্নতি করতে হলে একটি যায়গা ধরে রাখতে হবে।" সজল বলে।
ততক্ষনে ওদের খাওয়া হয়ে গেছে। এরপর ওরা শুতে যায়।