16-06-2021, 08:08 PM
কবির ছাদের মেঝেতে শুয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ ভরা তারার মেলা। আজ কবিরের মনটা খুব বিক্ষিপ্ত, বারবার কষ্টে ভরে উঠছে বুকটা। বিগত কিছু দিন ধরে কবির চেষ্টা করছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। অনেকটা ফিরেও গেছে, টিউশনি পড়াচ্ছিল নিয়মিত, ক্লাসও করছিল, পড়াশোনার দিকেও মন দিচ্ছিল। গতকাল সন্ধায় ওর শিরিন আন্টির সাথে ফোনে কথা বলে জানতে পেরেছে যে কালকে স্নিগ্ধার বিয়ে হবে, আপাতত রেজিস্ট্রি করে রাখবে, পরে অনুষ্ঠান। এরপর থেকেই ওর দিনকাল ওলটপালট হয়ে গেছে। আজকে ও ক্লাসেও যায়নি, টিউশনি পড়াতেও যায়নি, সারাটা দিন মেসেই কাটিয়েছে। কবির ওর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে, রাত দুইটা বাজে।
কবির হঠাত কি মনে করে স্নিগ্ধাকে কল করে। একবার রিং হয়েই রিসিভ হয়।
"হ্যালো কবির। কেমন আছিস তুই?" স্নিগ্ধার মিষ্টি কন্ঠে ভেসে আসে।
"হ্যালো কবির, কথা বলছিস না কেন?"
কবির কোন জবাব দেয়না, মন ভরে ওর মিষ্টি কন্ঠ শুনতে চায়।
"কিরে, এতো রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেন?" কয়েক সেকেন্ড পর বলে কবির।
"ঘুম আসছিল না রে।" স্নিগ্ধা বলে।
"আন্টির কাছে শুনলাম তোর বিয়ে কালকে?"
"হ্যাঁ।"
"আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আমি কালকে চলে আসব, তুই সবার সামনে বিয়ের আসর ছেড়ে আমার হাত ধরবি। আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নেব।"
"কিসব বলছিস এসব? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?" স্নিগ্ধা বলে।
"হ্যাঁ রে, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাকিটা জীবন হয়তো পাগলাগারদে কাটাতে হবে।"
"প্লিজ কবির, কোন পাগলামী করিস না। আমার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা কর।"
"আমি বুঝি রে। একটু ইয়ার্কি করছিলাম, কিছু মনে করিস না। আসলে তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল খুব, কি নিয়ে কথা বলব বুঝতে পারছিলাম না।" কবির বলে।
"যখন মন চায় কল দিবি, কোনরকম ইতস্তত করবি না। আর আমার কল কেটে দিবিনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"যদি এই মুহুর্তে তোর পাশে তোর স্বামী শুয়ে থাকতো, পারতি আমার সাথে এভাবে ফোনে কথা বলতে?" কবির প্রশ্ন করে।
"অবশ্যই কথা বলতাম। কেন পারতাম না?" স্নিগ্ধা বলে।
"তোর স্বামী হিংসা করতো না?"
"হয়তো করতো, কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। ওকে আমাদের বন্ধুত্বের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। তুই যখন ইচ্ছা ফোন করবি, যখন খুশি বাসায় চলে আসবি। আমি ডাকলে চলে আসবি, মানা করবি না।"
"আর যদি তোকে চুমু খেতে ইচ্ছে করে? তোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে?" কবির বলে।
এক সেকেন্ড নিরবতায় কেটে যায়।
"কিসব উল্টাপাল্টা বলছি আমি। আমি আসলেই পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমায় ক্ষমা কর। রাত জাগিস না, এখনই ঘুমিয়ে পড়। রাখি" বলে ফোন কেটে দেয় কবির।
সাথে সাথে আবার ফোন আসে কবিরের মোবাইলে। কবির কেটে দেয়, তারপর ফোন সুইচ অফ করে রাখে। আবারও মনোযোগ দেয় আকাশের দিকে। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করে আকাশে একফালি চাঁদ। কবিরের স্পষ্ট মনে আছে আকাশে কোন চাঁদ ছিলনা, আর আকাশে একবিন্দুও মেঘও নেই। আর তাছাড়া আজ অমাবস্যা, আকাশে চাঁদ থাকার কথা না। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার চাঁদটা ধিরে ধিরে আরো বড় হচ্ছে। আরো বড় হওয়ার পর বোঝা গেল যে ওটি চাঁদ নয়, উজ্জল কিছু ধিরে ধিরে নিচে নেমে আসছে। খানিকটা নিচে আসার পর মানুষের আকৃতি স্পষ্ট বোঝা গেল। উজ্জল রুপালী মানুষের মতো আকৃতির বস্তুটি তার রুপালী ডানা মেলে একটা চক্কর দিয়ে ছাদে নেমে আসে।
"কবির, কেমন আছ?"
কবির হতবিহ্বল হয়ে যায়।
"চিনতে পারছো না? আমি সোহরাব।"
"সোহরাব ভাই, তুমি!" অবাক হয়ে বলে কবির।
"কেমন লাগছে আমাকে ফেরেস্তার গেটআপে?"
"ভালই। কিন্তু একটু বেশিই ঝকমকে।" কবির বলে।
সোহরাব তার বুকের কাছে বোতাম স্পর্শ করতেই পোশাক বদলে গেল। শার্ট প্যান্ট কোট টাই বুট দিয়ে একেবারে অফিসিয়াল লুক।
"এখন ঠিক আছে?" সোহরাব বলে।
"তা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি...."
"আমি কি? মরে গেছি? মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। পরে বুঝলাম দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তা তোমার কি খবর? কেমন আছ?"
"এইতো ভালই আছি" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে কবির, "আপনি কেমন আছেন?"
"ভালই আছি, তবে খুব ব্যাস্ত। চাঁদের গতিপথ নিয়ন্ত্রনের ভার পড়েছে আমার কাঁধে। কাজটা সহজ না, অনেক সুক্ষ হিসাব নিকাশের ব্যাপার রয়েছে। আমার এখনো ট্রেইনিং পিরিয়ড চলছে, ট্রেইনিং শেষে নিহিলিন নক্ষত্রে পোস্টিং হবে। ওটা পৃথিবী থেকে আট হাজার আলোকবর্ষ দুরে।"
একটু থেমে সোহরাব আবার বলে "কিন্তু আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি ভাল নেই বরং কষ্টে আছো। কেন কষ্টে আছ তাও আমি জানি। প্রথম প্রথম আমিও কষ্টে ছিলাম, স্ত্রী সন্তানদের কথা ভেবে। কিন্তু এই মহাবিশ্ব অনেক বিশাল, সেই বিশালতার তুলনায় নিজের ব্যক্তিগত কষ্টও তুচ্ছ।"
কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজে গটগট করে কথা বলে যাওয়া সোহরাব ভাইয়ের চিরায়ত স্বভাব, এখনো বদলায় নি, মনে মনে ভাবে কবির।
"কি ভাবছো কবির? আমি চাইলে তোমার মাইন্ড রিড করতে পারি। কিন্তু তা করব না। যাই হোক আমি এসেছি তোমাকে একটি প্রস্তাব দিতে।"
"প্রস্তাব?!" অবাক হয়ে বলে কবির।
"হ্যাঁ প্রস্তাব। ইউজিএর পক্ষ থেকে ফেরেস্তা পদে নিয়োজিত হওয়ার প্রস্তাব। তুমি রাজি হলে তোমার ট্রেনিং আর পোস্টিং দুটোই এই পৃথিবীতেই হবে। তোমার কাজ হবে বিপদগ্রস্ত ভাল মানুষ খুঁজে বের করা ও তাদের উদ্ধার করা। খুব ইন্টারেস্টিং কাজ।"
"কিন্তু সোহরাব ভাই...." কবিরকে কথা শেষ করতে দেয়না সোহরাব, "তুমি ভেবে দেখ। একদিন সময় পেলে। আমি কাল এই সময় আসব। এখন যাই, আমার হাতে আর সময় নেই। চাঁদকে অটোড্রাইভে দিয়ে এসেছি। একঘন্টার বেশি অটোড্রাইভে রাখা নিষেধ।" বলে সোহরাব বুকের কাছে বোতামে স্পর্শ করে এবং সাথে সাথে ফেরেস্তা গেটআপে ফিরে যায়। একবার ডানা ঝাপটাতেই কয়েক মিটার উপরে উঠে যায় সোহরাব। আরকবার ডানা ঝাপটাতেই তীব্র আলোক ঝলকানি দিয়ে শুন্যে মিলিয়ে যায় সে।
কবিরের ঘুম ভেঙে যায় যখন ততক্ষনে ঝলমলে সকাল। ওর মুখে সোনালী রোদ পড়েছে, সম্ভবত সে কারনেই ঘুম ভেঙে গেছে। কবির ওর মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে সাড়ে আটটা বাজে। কবির উঠে দাঁড়ায়, রাতের স্বপ্নটির কথা মনে পড়তেই ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায়। খুব আজব ও হাস্যকর স্বপ্ন ছিল। একটু পরই চিন্তার ভাঁজ পড়ে ওর কপালে। ওটা নিশ্চয়ই কোন সাধারন স্বপ্ন ছিল না। কারন স্বপ্নে দেখা রং মনে থাকে না। কিন্তু সোহরাবের রুপালি পোশাক আর খয়েরি টাইয়ের রং মনে করতে পারছে সে। তবে কি আবারও সিজোফ্রেনিয়া ফিরে আসছে?
কবিরের মা বাবার মৃত্যুর পর সে তাদেরকে দেখতে পেত। একদিন সে স্নিগ্ধাকে সেকথা জানিয়েছিল। স্নিগ্ধা তার মা বাবাকে বিষয়টা জানায়। শিরিন ও জামান কবিরকে স্থানীয় এক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে কবিরকে নিয়ে যায়। তার ধারনা এটি অদ্ভুত ধরনের সিজোফ্রেনিয়া। ছয়মাস চিকিতসার পর কবির সুস্থ হয়েছিল। অসুখটা কি আবার ফিরে এল? আজকে স্নিগ্ধার বিয়ে সে কথা মনে পড়তেই ওর মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। "আমি মরে গেলেও কারো কিছু যায় আসেনা, পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেও কারো কিছু আসবে যাবে না। তাই এ নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে।" মনে মনে বলে কবির। কবির হেঁটে হেঁটে তার রুমে ঢোকে, সেখানে সবুজ নামের সেই বিশালদেহী মানুষটা তখনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
দশ তারিখ বিকেল পাঁচটা বাজে। সবুজ তার রুমে একা বসে আছে, কবির টিউশনিতে গেছে, ফিরতে ফিরতে সন্ধা হয়ে যাবে। সবুজ রুমটা লক করে দিয়ে এসে সাইডব্যাগের পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করে নেয়। কবিরের সুইসাইড নোট, গত পরশুদিন সজল ওর হাতে দিয়েছে। কবিরের টেবিল থেকে ওর একটা খাতা খুলে চিঠিটার সাথে মিলিয়ে দেখে। একেবারে হুবহু কবিরের লেখা। শয়তানটার শয়তানি প্রতিভা অঢেল।" মনে মনে ভাবে সবুজ। ছোট একটি সুইসাইড নোট, পুরোটা একবার পড়ে নেয় সবুজ।
"প্রিয় স্নিগ্ধা,
পত্রের শুরুতেই তোকে জানাচ্ছি বিয়ের আন্তরিক শুভেচ্ছা। দোয়া করি তোর বৈবাহিক জীবন সুখের হোক। ভেবেছি তোকে ভুলে যেয়ে নতুন করে জীবন শুরু করব। কিন্তু তোকে ছাড়া বেঁচে থাকা যে এতো কষ্টের হবে তা আমি ভাবতে পারিনি। অনেক ভেবেও এতো কষ্ট সাথে নিয়ে বেঁচে থাকার কোন কারন খুঁজে পাইনি। ভাল থাকিস। পারলে আমাকে ক্ষমা করিস।
ইতি
তোর প্রিয় বন্ধু
কবির"
চিঠিটা পড়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেয় সবুজ। কিন্তু বিষয়টা পুরোপুরি তার মাথায় ঢোকেনা। কেন সজল ছেলেটাকে খুন করতে চায়? আর তার প্রেমিকার ব্যাপারটাই বা সজল কিভাবে জানে? তবে কি মেয়েটাই এ দুজনের মাঝের কানেকশন, মেয়েটিই কি এর কারন? সবুজ এ নিয়ে আর মাথা খাটায় না। কাজটা সেরে দিতে পারলে হাতে কিছু টাকা আসবে সে নিয়েই তার চিন্তা। সবুজ রুম থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে যায় সেখানে রায়হান জানালার পাশে বসে সিগারেট টানছে।
"কি খবর সবুজ, কেমন আছ?" বলে রায়হান সিগারেটটা বাড়িয়ে দেয়।
"এইতো বস, ভালই আছি। তপু কোথায়?" সিগারেটে টান দিতে দিতে বলে সবুজ।
"বাইরে গেছে, কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরবে।"
"আসলে বস, আজকে আমার জন্মদিন।"
"তাই নাকি! কংগ্রেচুলেশন। ম্যানি ম্যানি রিটার্ন অফ দা ডে।"
"সেই উপলক্ষে ভাবছি মেসের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব। টিকিটও কেটে রেখেছি। নতুন সিনেমা, 'প্রেম পরশ', আজকেই রিলিজ হচ্ছে।"
"তাই নাকি। তুমি টিকিট পেলে কোথায়? আমি অনেক চেষ্টা করেও পাইনি।" রায়হান বলে।
"আমার এক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে যোগাড় করেছি।" সবুজ বলে। তারপর দুটি সিনেমার টিকিট তুলে দেয়।
"সাতটায় মুভি, রেডি হন। একটা আপনার অন্যটা তপুর।"
মেসের সবার কাছে টিকিট বিতরন করে সবুজ তার রুমে ফিরে আসে। ততক্ষনে কবির ফিরে এসেছে। কবির বিছানায় বসে উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
"আরে কবির, কখন ফিরলে?" সবুজ বলে।
"এইতো এখনই।"
"আমরা মেসের সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। তুমি যাবে নাকি?"
"না ভাই। আপনারা যান।"
সবুজ আর জোরাজুরি করেনা। রাজি হয়ে গেলে প্ল্যান ভেস্তে যেতে পারে।
সোয়া ছয়টার ভেতরে ওরা সিনেমাহলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এবং পৌনে সাতটার মধ্যে ওরা সিনেমাহলে পৌঁছে যায়। বাকি সবার টিকিট ফাস্ট ক্লাস আর সবুজেরটা সেকেন্ড ক্লাস। সিনেমা শুরুর দশ মিনিট পর সবুজ হল থেকে বের হয়ে একটি সিএনজি নিয়ে ফিরে আসে মেসে। ফেরার পথে সে দুটো এনারজি ড্রিংক কেনে। সিঁড়িতে বসে একটি এনারজিড্রিংকে ঘুমের ওষুধের গুঁড়া মিশিয়ে দেয়। আগেই গুঁড়া করে রেখেছিল সে। এখন পর্যন্ত সবকিছু প্লান মোতাবেক হয়েছে, শুধু এই এনার্জি ড্রিংকটা খাওয়াতে পারলেই হয়। সবুজ লিফ্টে করে উপরে উঠে আসে। কিন্তু রুমে কবিরকে খুঁজে পায়না সে। রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে কবিরকে দেখতে পায় সবুজ। কবির ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে। সবুজ চারিদিক চোখ বুলিয়ে নেয়, কেউ নেই। তারপর পা টিপে টিপে যতোটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোতে থাকে। অর্ধেকটা পথ এগোগেই কবির ফিরে তাকায়।
"সবুজ ভাই, সিনেমা দেখতে যান নাই? " কবির জিজ্ঞাসা করে।
"তোমাকে একা রেখে সিনেমা দেখতে ভাল লাগছিল না। তাই ফিরে এলাম। তা তুমি এখানে কি কর? ঘরে চলো।" সবুজ বলে।
কবির ঘরে ফিরে আসে। সবুজ ওর হাতে একটি এনার্জি ড্রিংকের বোতল তুলে দেয়।
"না ভাই, আমি খাব না। খুব ঠান্ডা লেগেছে।" কবির বলে।
"এক চুমুক খাও, কিছু হবেনা।"
"না ভাই।"
"তাহলে চা খাও।" সবুজ বলে।
"ঠিক আছে, চলেন যাই।" কবির বলে।
"আমার চা স্টলের পরিবেশ ভাল লাগেনা। তার চেয়ে বরং আমি চা এনে দেই।" সবুজ বলে।
"সে কি করে হয়?"
"কোন সমস্যা নেই। তুমি কি খাবে, দুধ চা নাকি রং চা?"
"আদা দিয়ে রং চা, কড়া লিকার।" কবির বলে।
সবুজ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
কবির হঠাত কি মনে করে স্নিগ্ধাকে কল করে। একবার রিং হয়েই রিসিভ হয়।
"হ্যালো কবির। কেমন আছিস তুই?" স্নিগ্ধার মিষ্টি কন্ঠে ভেসে আসে।
"হ্যালো কবির, কথা বলছিস না কেন?"
কবির কোন জবাব দেয়না, মন ভরে ওর মিষ্টি কন্ঠ শুনতে চায়।
"কিরে, এতো রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেন?" কয়েক সেকেন্ড পর বলে কবির।
"ঘুম আসছিল না রে।" স্নিগ্ধা বলে।
"আন্টির কাছে শুনলাম তোর বিয়ে কালকে?"
"হ্যাঁ।"
"আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আমি কালকে চলে আসব, তুই সবার সামনে বিয়ের আসর ছেড়ে আমার হাত ধরবি। আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নেব।"
"কিসব বলছিস এসব? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?" স্নিগ্ধা বলে।
"হ্যাঁ রে, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাকিটা জীবন হয়তো পাগলাগারদে কাটাতে হবে।"
"প্লিজ কবির, কোন পাগলামী করিস না। আমার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা কর।"
"আমি বুঝি রে। একটু ইয়ার্কি করছিলাম, কিছু মনে করিস না। আসলে তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল খুব, কি নিয়ে কথা বলব বুঝতে পারছিলাম না।" কবির বলে।
"যখন মন চায় কল দিবি, কোনরকম ইতস্তত করবি না। আর আমার কল কেটে দিবিনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"যদি এই মুহুর্তে তোর পাশে তোর স্বামী শুয়ে থাকতো, পারতি আমার সাথে এভাবে ফোনে কথা বলতে?" কবির প্রশ্ন করে।
"অবশ্যই কথা বলতাম। কেন পারতাম না?" স্নিগ্ধা বলে।
"তোর স্বামী হিংসা করতো না?"
"হয়তো করতো, কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। ওকে আমাদের বন্ধুত্বের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। তুই যখন ইচ্ছা ফোন করবি, যখন খুশি বাসায় চলে আসবি। আমি ডাকলে চলে আসবি, মানা করবি না।"
"আর যদি তোকে চুমু খেতে ইচ্ছে করে? তোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে?" কবির বলে।
এক সেকেন্ড নিরবতায় কেটে যায়।
"কিসব উল্টাপাল্টা বলছি আমি। আমি আসলেই পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমায় ক্ষমা কর। রাত জাগিস না, এখনই ঘুমিয়ে পড়। রাখি" বলে ফোন কেটে দেয় কবির।
সাথে সাথে আবার ফোন আসে কবিরের মোবাইলে। কবির কেটে দেয়, তারপর ফোন সুইচ অফ করে রাখে। আবারও মনোযোগ দেয় আকাশের দিকে। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করে আকাশে একফালি চাঁদ। কবিরের স্পষ্ট মনে আছে আকাশে কোন চাঁদ ছিলনা, আর আকাশে একবিন্দুও মেঘও নেই। আর তাছাড়া আজ অমাবস্যা, আকাশে চাঁদ থাকার কথা না। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার চাঁদটা ধিরে ধিরে আরো বড় হচ্ছে। আরো বড় হওয়ার পর বোঝা গেল যে ওটি চাঁদ নয়, উজ্জল কিছু ধিরে ধিরে নিচে নেমে আসছে। খানিকটা নিচে আসার পর মানুষের আকৃতি স্পষ্ট বোঝা গেল। উজ্জল রুপালী মানুষের মতো আকৃতির বস্তুটি তার রুপালী ডানা মেলে একটা চক্কর দিয়ে ছাদে নেমে আসে।
"কবির, কেমন আছ?"
কবির হতবিহ্বল হয়ে যায়।
"চিনতে পারছো না? আমি সোহরাব।"
"সোহরাব ভাই, তুমি!" অবাক হয়ে বলে কবির।
"কেমন লাগছে আমাকে ফেরেস্তার গেটআপে?"
"ভালই। কিন্তু একটু বেশিই ঝকমকে।" কবির বলে।
সোহরাব তার বুকের কাছে বোতাম স্পর্শ করতেই পোশাক বদলে গেল। শার্ট প্যান্ট কোট টাই বুট দিয়ে একেবারে অফিসিয়াল লুক।
"এখন ঠিক আছে?" সোহরাব বলে।
"তা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি...."
"আমি কি? মরে গেছি? মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। পরে বুঝলাম দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তা তোমার কি খবর? কেমন আছ?"
"এইতো ভালই আছি" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে কবির, "আপনি কেমন আছেন?"
"ভালই আছি, তবে খুব ব্যাস্ত। চাঁদের গতিপথ নিয়ন্ত্রনের ভার পড়েছে আমার কাঁধে। কাজটা সহজ না, অনেক সুক্ষ হিসাব নিকাশের ব্যাপার রয়েছে। আমার এখনো ট্রেইনিং পিরিয়ড চলছে, ট্রেইনিং শেষে নিহিলিন নক্ষত্রে পোস্টিং হবে। ওটা পৃথিবী থেকে আট হাজার আলোকবর্ষ দুরে।"
একটু থেমে সোহরাব আবার বলে "কিন্তু আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি ভাল নেই বরং কষ্টে আছো। কেন কষ্টে আছ তাও আমি জানি। প্রথম প্রথম আমিও কষ্টে ছিলাম, স্ত্রী সন্তানদের কথা ভেবে। কিন্তু এই মহাবিশ্ব অনেক বিশাল, সেই বিশালতার তুলনায় নিজের ব্যক্তিগত কষ্টও তুচ্ছ।"
কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজে গটগট করে কথা বলে যাওয়া সোহরাব ভাইয়ের চিরায়ত স্বভাব, এখনো বদলায় নি, মনে মনে ভাবে কবির।
"কি ভাবছো কবির? আমি চাইলে তোমার মাইন্ড রিড করতে পারি। কিন্তু তা করব না। যাই হোক আমি এসেছি তোমাকে একটি প্রস্তাব দিতে।"
"প্রস্তাব?!" অবাক হয়ে বলে কবির।
"হ্যাঁ প্রস্তাব। ইউজিএর পক্ষ থেকে ফেরেস্তা পদে নিয়োজিত হওয়ার প্রস্তাব। তুমি রাজি হলে তোমার ট্রেনিং আর পোস্টিং দুটোই এই পৃথিবীতেই হবে। তোমার কাজ হবে বিপদগ্রস্ত ভাল মানুষ খুঁজে বের করা ও তাদের উদ্ধার করা। খুব ইন্টারেস্টিং কাজ।"
"কিন্তু সোহরাব ভাই...." কবিরকে কথা শেষ করতে দেয়না সোহরাব, "তুমি ভেবে দেখ। একদিন সময় পেলে। আমি কাল এই সময় আসব। এখন যাই, আমার হাতে আর সময় নেই। চাঁদকে অটোড্রাইভে দিয়ে এসেছি। একঘন্টার বেশি অটোড্রাইভে রাখা নিষেধ।" বলে সোহরাব বুকের কাছে বোতামে স্পর্শ করে এবং সাথে সাথে ফেরেস্তা গেটআপে ফিরে যায়। একবার ডানা ঝাপটাতেই কয়েক মিটার উপরে উঠে যায় সোহরাব। আরকবার ডানা ঝাপটাতেই তীব্র আলোক ঝলকানি দিয়ে শুন্যে মিলিয়ে যায় সে।
কবিরের ঘুম ভেঙে যায় যখন ততক্ষনে ঝলমলে সকাল। ওর মুখে সোনালী রোদ পড়েছে, সম্ভবত সে কারনেই ঘুম ভেঙে গেছে। কবির ওর মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে সাড়ে আটটা বাজে। কবির উঠে দাঁড়ায়, রাতের স্বপ্নটির কথা মনে পড়তেই ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায়। খুব আজব ও হাস্যকর স্বপ্ন ছিল। একটু পরই চিন্তার ভাঁজ পড়ে ওর কপালে। ওটা নিশ্চয়ই কোন সাধারন স্বপ্ন ছিল না। কারন স্বপ্নে দেখা রং মনে থাকে না। কিন্তু সোহরাবের রুপালি পোশাক আর খয়েরি টাইয়ের রং মনে করতে পারছে সে। তবে কি আবারও সিজোফ্রেনিয়া ফিরে আসছে?
কবিরের মা বাবার মৃত্যুর পর সে তাদেরকে দেখতে পেত। একদিন সে স্নিগ্ধাকে সেকথা জানিয়েছিল। স্নিগ্ধা তার মা বাবাকে বিষয়টা জানায়। শিরিন ও জামান কবিরকে স্থানীয় এক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে কবিরকে নিয়ে যায়। তার ধারনা এটি অদ্ভুত ধরনের সিজোফ্রেনিয়া। ছয়মাস চিকিতসার পর কবির সুস্থ হয়েছিল। অসুখটা কি আবার ফিরে এল? আজকে স্নিগ্ধার বিয়ে সে কথা মনে পড়তেই ওর মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। "আমি মরে গেলেও কারো কিছু যায় আসেনা, পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেও কারো কিছু আসবে যাবে না। তাই এ নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে।" মনে মনে বলে কবির। কবির হেঁটে হেঁটে তার রুমে ঢোকে, সেখানে সবুজ নামের সেই বিশালদেহী মানুষটা তখনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
দশ তারিখ বিকেল পাঁচটা বাজে। সবুজ তার রুমে একা বসে আছে, কবির টিউশনিতে গেছে, ফিরতে ফিরতে সন্ধা হয়ে যাবে। সবুজ রুমটা লক করে দিয়ে এসে সাইডব্যাগের পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করে নেয়। কবিরের সুইসাইড নোট, গত পরশুদিন সজল ওর হাতে দিয়েছে। কবিরের টেবিল থেকে ওর একটা খাতা খুলে চিঠিটার সাথে মিলিয়ে দেখে। একেবারে হুবহু কবিরের লেখা। শয়তানটার শয়তানি প্রতিভা অঢেল।" মনে মনে ভাবে সবুজ। ছোট একটি সুইসাইড নোট, পুরোটা একবার পড়ে নেয় সবুজ।
"প্রিয় স্নিগ্ধা,
পত্রের শুরুতেই তোকে জানাচ্ছি বিয়ের আন্তরিক শুভেচ্ছা। দোয়া করি তোর বৈবাহিক জীবন সুখের হোক। ভেবেছি তোকে ভুলে যেয়ে নতুন করে জীবন শুরু করব। কিন্তু তোকে ছাড়া বেঁচে থাকা যে এতো কষ্টের হবে তা আমি ভাবতে পারিনি। অনেক ভেবেও এতো কষ্ট সাথে নিয়ে বেঁচে থাকার কোন কারন খুঁজে পাইনি। ভাল থাকিস। পারলে আমাকে ক্ষমা করিস।
ইতি
তোর প্রিয় বন্ধু
কবির"
চিঠিটা পড়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেয় সবুজ। কিন্তু বিষয়টা পুরোপুরি তার মাথায় ঢোকেনা। কেন সজল ছেলেটাকে খুন করতে চায়? আর তার প্রেমিকার ব্যাপারটাই বা সজল কিভাবে জানে? তবে কি মেয়েটাই এ দুজনের মাঝের কানেকশন, মেয়েটিই কি এর কারন? সবুজ এ নিয়ে আর মাথা খাটায় না। কাজটা সেরে দিতে পারলে হাতে কিছু টাকা আসবে সে নিয়েই তার চিন্তা। সবুজ রুম থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে যায় সেখানে রায়হান জানালার পাশে বসে সিগারেট টানছে।
"কি খবর সবুজ, কেমন আছ?" বলে রায়হান সিগারেটটা বাড়িয়ে দেয়।
"এইতো বস, ভালই আছি। তপু কোথায়?" সিগারেটে টান দিতে দিতে বলে সবুজ।
"বাইরে গেছে, কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরবে।"
"আসলে বস, আজকে আমার জন্মদিন।"
"তাই নাকি! কংগ্রেচুলেশন। ম্যানি ম্যানি রিটার্ন অফ দা ডে।"
"সেই উপলক্ষে ভাবছি মেসের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব। টিকিটও কেটে রেখেছি। নতুন সিনেমা, 'প্রেম পরশ', আজকেই রিলিজ হচ্ছে।"
"তাই নাকি। তুমি টিকিট পেলে কোথায়? আমি অনেক চেষ্টা করেও পাইনি।" রায়হান বলে।
"আমার এক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে যোগাড় করেছি।" সবুজ বলে। তারপর দুটি সিনেমার টিকিট তুলে দেয়।
"সাতটায় মুভি, রেডি হন। একটা আপনার অন্যটা তপুর।"
মেসের সবার কাছে টিকিট বিতরন করে সবুজ তার রুমে ফিরে আসে। ততক্ষনে কবির ফিরে এসেছে। কবির বিছানায় বসে উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
"আরে কবির, কখন ফিরলে?" সবুজ বলে।
"এইতো এখনই।"
"আমরা মেসের সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। তুমি যাবে নাকি?"
"না ভাই। আপনারা যান।"
সবুজ আর জোরাজুরি করেনা। রাজি হয়ে গেলে প্ল্যান ভেস্তে যেতে পারে।
সোয়া ছয়টার ভেতরে ওরা সিনেমাহলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এবং পৌনে সাতটার মধ্যে ওরা সিনেমাহলে পৌঁছে যায়। বাকি সবার টিকিট ফাস্ট ক্লাস আর সবুজেরটা সেকেন্ড ক্লাস। সিনেমা শুরুর দশ মিনিট পর সবুজ হল থেকে বের হয়ে একটি সিএনজি নিয়ে ফিরে আসে মেসে। ফেরার পথে সে দুটো এনারজি ড্রিংক কেনে। সিঁড়িতে বসে একটি এনারজিড্রিংকে ঘুমের ওষুধের গুঁড়া মিশিয়ে দেয়। আগেই গুঁড়া করে রেখেছিল সে। এখন পর্যন্ত সবকিছু প্লান মোতাবেক হয়েছে, শুধু এই এনার্জি ড্রিংকটা খাওয়াতে পারলেই হয়। সবুজ লিফ্টে করে উপরে উঠে আসে। কিন্তু রুমে কবিরকে খুঁজে পায়না সে। রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে কবিরকে দেখতে পায় সবুজ। কবির ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে। সবুজ চারিদিক চোখ বুলিয়ে নেয়, কেউ নেই। তারপর পা টিপে টিপে যতোটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোতে থাকে। অর্ধেকটা পথ এগোগেই কবির ফিরে তাকায়।
"সবুজ ভাই, সিনেমা দেখতে যান নাই? " কবির জিজ্ঞাসা করে।
"তোমাকে একা রেখে সিনেমা দেখতে ভাল লাগছিল না। তাই ফিরে এলাম। তা তুমি এখানে কি কর? ঘরে চলো।" সবুজ বলে।
কবির ঘরে ফিরে আসে। সবুজ ওর হাতে একটি এনার্জি ড্রিংকের বোতল তুলে দেয়।
"না ভাই, আমি খাব না। খুব ঠান্ডা লেগেছে।" কবির বলে।
"এক চুমুক খাও, কিছু হবেনা।"
"না ভাই।"
"তাহলে চা খাও।" সবুজ বলে।
"ঠিক আছে, চলেন যাই।" কবির বলে।
"আমার চা স্টলের পরিবেশ ভাল লাগেনা। তার চেয়ে বরং আমি চা এনে দেই।" সবুজ বলে।
"সে কি করে হয়?"
"কোন সমস্যা নেই। তুমি কি খাবে, দুধ চা নাকি রং চা?"
"আদা দিয়ে রং চা, কড়া লিকার।" কবির বলে।
সবুজ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।