16-06-2021, 07:55 PM
কবিরের যখন ঘুম ভেঙে গেল তখন সকাল সাড়ে দশটা। পাশের বিছানাটার দিকে তাকাতেই মনটা ব্যাথায় ভরে গেল কবিরের। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এই বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়তেন সোহরাব ভাই। বিছানাটা এখনো আছে কিন্তু মানুষটি আর নেই। সোহরাবের মৃত্যু হয়েছে এক সপ্তাহ হল। কবর হয়েছে গ্রামে। কবির সহ মেসের সাত আট জন গিয়েছিল কুষ্টিয়ায়, গত পরশু ফিরেছে তারা। কবির বিছানা ছেড়ে উঠে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে যায়। এপার্টমেন্টের সামনে একটি মোবাইলের দোকানে গিয়ে ছাব্বিশ হাজার টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেয় সোহরাবের স্ত্রী শারমিনের নাম্বারে, তারপর নিজের মোবাইল থেকে কল করে শারমিনকে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো ভাবি, আমি কবির।" কবির বলে।
"হ্যাঁ কবির, বল।" ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলে শারমিন।
"ভাবি, আমি আপনার নাম্বারে ছাব্বিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। পেয়েছেন?"
"হ্যাঁ পেয়েছি, কিন্তু এটা কিসের টাকা?"
"এটা সোহরাব ভাইয়ের বেতনের টাকা। গতকাল ম্যানেজার ডেকে এনে টাকাটা পাঠিয়ে দিতে বললেন।" কবির বলে।
"মিথ্যা কথা বলছ কেন কবির? সোহরাব সেইদিনই বেতনের টাকা তুলেছিল। আমি এ টাকা নিতে পারিনা। আমি তোমার টাকা ফেরত পাঠিয়ে দেব।"
"প্লিজ ভাবি টাকাটা রাখুন। আমি যদি সোহরাব ভাইয়ের আপন ভাই হতাম তবে কি টাকাটা নিতেন না? সোহরাব ভাই আমার আপন ভাইয়ের চেয়েও আপন।"
হঠাত ফুঁপিয়ে কেদে ওঠে শারমিন।
"প্লিজ ভাবি কাঁদবেন না। আপনার এখন ভেঙে পড়া যাবে না, আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব, ছেলে মেয়েদেরকে মানুষ করতে হবে। প্লিজ টাকাটা উঠিয়ে নিবেন। ছেলে মেয়েদের যত্ন নিবেন, ওদের কলেজে যাওয়া যেন বন্ধ না হয়। আর যেকোন সমস্যায় আমাকে জানাবেন।"
"ঠিক আছে, কবির, রাখি।" বলে শারমিন ফোনটা কেটে দেয়।
মোবাইলটা পকেটে রেখে কবির আবার মেসের দিকে ফিরে যায়।
সোহরাব সেদিন বেতনের টাকা তুলেই বের হয়েছিল। এক্সিডেন্টের পর সোহরাবের মানিব্যাগ আর অফিস ব্যাগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কবির টাকাটা নিজের ব্যাংক একাউন্ট থেকে তুলেছে। বহুদিন পর মা বাবার রেখে যাওয়া তার নামের একাউন্ট থেকে টাকা তুলল সে। ইন্টারেস্ট জমা হতে হতে চৌদ্দ থেকে বিশ লাখ টাকায় পরিনত হয়েছে তাতে।
কবির তার মেসে ফিরে আসতেই মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই স্নিগ্ধার মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসে "কবির, কোথায় তুই?"
"মেসেই আছি।" কবির বলে।
"আমার এপার্টমেন্টের নিচে চায়ের দোকানে চলে আয়। একসাথে চা খাব।"
"ঠিক আছে। আসছি।" বলে ফোন কেটে দেয় কবির, তারপর আবারও বেরিয়ে যায় মেস থেকে। চায়ের দোকানে এসে দেখে স্নিগ্ধা বসে আছে। কবিরকে দেখে পাশে বসতে বলে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে দেয় স্নিগ্ধা।
"কিরে ব্রেকফাস্ট করেছিস?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"না রে, কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।" কবির বলে।
"তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রাতেও কিছু খাসনি তাই না?"
কবির কোন জবাব দেয়না।
"ওঠ, চল এক্ষুনি" বলে হাত ধরে টেনে তোলে কবিরকে।
"কোথায় যাব আবার? এখানেই কলা পাঁউরুটি দিয়েই নাস্তা সেরে নেই।" কবির বলে।
"না চল বলছি" বলে কবিরকে প্রায় টেনে নিয়ে যায়। কাছে একটি রেস্টুরেন্টে যায় ওরা।
একটি টেবিলে বসে স্নিগ্ধা কবিরকে জিজ্ঞাসা করে "কি খাবি? খিচুড়ি নাকি পরোটা?"
"পরোটা।"
স্নিগ্ধা পরোটার অর্ডার দিয়ে দেয়।
"তুইও খা" কবির বলে।
"না, আমি মেসেই খেয়ে এসেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"জানিস, প্রতিদিন এই রেস্টুরেন্টে বসেই সোহরাব ভাই আর আমি নাস্তা করতাম? আর আজ মানুষটা নেই।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে কবির।
"ট্রাকটাকে কি ধরতে পেরেছে পুলিশ?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"না, এখনো ধরতে পারেনি, ধরতে পারবে বলে মনেও হয়না।" কবির জবাব দেয়।
"খুব ভাল মানুষ ছিল গো, একেবারে ফেরেস্তার মতো মানুষ" স্নিগ্ধা আরো যোগ করে, "জানিস আমার নানি কি বলতো?" জবাবের অপেক্ষা না করে বলে "যারা খুব ভাল মানুষ তাদেরকে আল্লাহ নিজের কাছে নিয়ে নেয় আর তাদের ফেরেস্তা বানিয়ে দেয়। তাদের আলোর তৈরী পাখা থাকে, তারা যেখানে খুশি উড়ে বেড়ায় আর ভাল মানুষদের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে।"
"আমার চিন্তা হচ্ছে ভাবি আর ছেলেমেয়েদের জন্য। একেবারে ছোট ছোট দুটো বাচ্চা, এই বয়সে এতিম হয়ে গেল।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে কবির।
"ওদের তো তাও মা আছে। তোর তো তাও নেই।" স্নিগ্ধা বলে।
"তাতে কি? আন্টি তো আছে। আন্টি আছে, আঙ্কেল আছে, তুই আছিস।"
"তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আম্মু আমার চেয়েও তোকে বেশি ভালবাসে।" একটু থেমে আবার বলে "ওহো বলতে ভুলেই গেছি, আম্মু তো তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।"
"কোথায়?" কবির জিজ্ঞাসা করে।
"কোথায় আবার, বাড়িতে। আমার পরীক্ষা তো কালকেই শেষ। তোর পরীক্ষা শেষ হবে কবে?"
"আমার পরীক্ষা তো শেষ। কিন্তু শেষ দুটো পরীক্ষা দিতে পারিনি।"
"ওতে সমস্যা নেই, রিটেক দিয়ে দিস। তাহলে চল কালকেই বাড়ি যাই।" স্নিগ্ধা বলে।
"না রে। টিউশনি আছে। এমনিতেই অনেকদিন মিস দিয়েছি।" কবির বলে।
"ওসব টিউশনি বাদ দিয়ে দে, তিন মাস হল বাড়ি যাস না। বাড়ি থেকে ঘুরে আয় ভাল লাগবে।"
"ঠিক আছে, ভেবে দেখছি।"
"ভাবাভাবির কিছু নেই, যেতেই হবে।"
ততক্ষনে কবিরের নাস্তা শেষ। ওরা বিল মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।
পরের দিন কবির ও স্নিগ্ধা ঢাকা থেকে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওরা বাসে রওনা দেয় বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু পথে ভীষন জ্যামে পড়ে যায় ওরা, ওদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত এগারোটা বেজে যায়। বাস স্ট্যান্ডে নেমে রিক্সা নিয়ে নেয় ওরা।
"যাক বাবা, অবশেষে পৌঁছাতে পারলাম। যেরকম জ্যাম পড়েছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল আজকে আর পৌঁছাতেই পারবোনা।" একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করে "আচ্ছা, এতো জ্যাম ছিল কেন?"
"দেখলি না টাঙ্গাইলে এক্সিডেন্ট হয়েছে, দুটি ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষ।" কবির জবাব দেয়।
"এদেশে এতোই রোড এক্সিডেন্ট হয়। প্রতিদিন খবরের কাগজে কমপক্ষে একটি রোড এক্সিডেন্টের খবর থাকেই।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে স্নিগ্ধা।
তখনই কল আসে স্নিগ্ধার মোবাইলে।
"স্নিগ্ধা, কোথায় তোরা" মায়ের কন্ঠ ভেসে আসে।
"এখন রিক্সায়, প্রায় পৌঁছে গেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"কবিরকে কিন্তু যেতে দিবিনা এতরাতে।" শিরিন বলে।
"সে তোমাকে বলে দিতে হতো না মা। এইতো এসেই গেছি।" বলে স্নিগ্ধা কেটে দেয়।
"মামা, বাঁয়ে থামান" রিক্সাওলার উদ্দেশ্যে বলে কবির। রিক্সা থামতেই স্নিগ্ধা নেমে যায়।
"তুই এখনো বসে আছিস কেন? নাম", কবিরকে রিক্সায় বসে থাকতে দেখে বলে স্নিগ্ধা।
"আমি বাড়ি যাই।"
"এখন বাড়ি গিয়ে কি করবি? কালকে যাস, আজ রাত আমাদের বাড়িতেই থাক।" স্নিগ্ধা বলে। কবির আর আপত্তি করেনা, রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাভাড়া মিটিয়ে দেয়।
দোতলায় উঠে কলিংবেল টিপতেই খুলে যায় দরজা। ওপাশে মুখে হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে জামান। স্নিগ্ধা প্রায় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তার বাবাকে।
"এতো দেরি হল কেন মামনি?" মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে জিজ্ঞাসা করে জামান।
"রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল আব্বু।"
"কোন সমস্যা হয়নি তো মামনি?"
"না আব্বু।"
"তোমরা সরোতো", স্বামী ও মেয়ের উদ্দেশ্য বলে শিরিন; তারপর মুখে হাসি টেনে এনে কবিরের উদ্দেশ্যে বলে "এসো বাবা ভেতরে এসো।"
কবির তার সাইড ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ভেতরে যায়।
"তোমরা ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।" শিরিন বলে।
"না মা, আমরা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"তাহলে তোমরা হাতমুখ ধুয়ে ঘুমোতে যাও। অনেক রাত হয়েছে।" শিরিন বলে।
স্নিগ্ধা তার নিজের রুমে আর কবির গেস্টরুমে ঘুমোতে যায়।
কবির রুমের লাইট অফ করে শুয়ে থাকে, কিন্তু সহজে ঘুম আসে না। যদিও বেশ ক্লান্ত, শোওয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসার কথা কিন্তু কেন যেন ঘুম আসে না।
ঠিক রাত একটার দিকে দরজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ পায় কবির, দরজার কাছে ছায়ামুর্তি দেখতে পায় কবির। শিরিন কখনো কখনো রাতের বেলা স্নিগ্ধা ও কবিরের রুমে এসে দেখে যায় ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়েছে কিনা কিংবা গায়ের চাদর সরে গেছে কিনা। কবির চোখ বুজে ঘুমের ভান করে থাকে।
"হ্যালো ভাবি, আমি কবির।" কবির বলে।
"হ্যাঁ কবির, বল।" ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলে শারমিন।
"ভাবি, আমি আপনার নাম্বারে ছাব্বিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। পেয়েছেন?"
"হ্যাঁ পেয়েছি, কিন্তু এটা কিসের টাকা?"
"এটা সোহরাব ভাইয়ের বেতনের টাকা। গতকাল ম্যানেজার ডেকে এনে টাকাটা পাঠিয়ে দিতে বললেন।" কবির বলে।
"মিথ্যা কথা বলছ কেন কবির? সোহরাব সেইদিনই বেতনের টাকা তুলেছিল। আমি এ টাকা নিতে পারিনা। আমি তোমার টাকা ফেরত পাঠিয়ে দেব।"
"প্লিজ ভাবি টাকাটা রাখুন। আমি যদি সোহরাব ভাইয়ের আপন ভাই হতাম তবে কি টাকাটা নিতেন না? সোহরাব ভাই আমার আপন ভাইয়ের চেয়েও আপন।"
হঠাত ফুঁপিয়ে কেদে ওঠে শারমিন।
"প্লিজ ভাবি কাঁদবেন না। আপনার এখন ভেঙে পড়া যাবে না, আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব, ছেলে মেয়েদেরকে মানুষ করতে হবে। প্লিজ টাকাটা উঠিয়ে নিবেন। ছেলে মেয়েদের যত্ন নিবেন, ওদের কলেজে যাওয়া যেন বন্ধ না হয়। আর যেকোন সমস্যায় আমাকে জানাবেন।"
"ঠিক আছে, কবির, রাখি।" বলে শারমিন ফোনটা কেটে দেয়।
মোবাইলটা পকেটে রেখে কবির আবার মেসের দিকে ফিরে যায়।
সোহরাব সেদিন বেতনের টাকা তুলেই বের হয়েছিল। এক্সিডেন্টের পর সোহরাবের মানিব্যাগ আর অফিস ব্যাগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কবির টাকাটা নিজের ব্যাংক একাউন্ট থেকে তুলেছে। বহুদিন পর মা বাবার রেখে যাওয়া তার নামের একাউন্ট থেকে টাকা তুলল সে। ইন্টারেস্ট জমা হতে হতে চৌদ্দ থেকে বিশ লাখ টাকায় পরিনত হয়েছে তাতে।
কবির তার মেসে ফিরে আসতেই মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই স্নিগ্ধার মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসে "কবির, কোথায় তুই?"
"মেসেই আছি।" কবির বলে।
"আমার এপার্টমেন্টের নিচে চায়ের দোকানে চলে আয়। একসাথে চা খাব।"
"ঠিক আছে। আসছি।" বলে ফোন কেটে দেয় কবির, তারপর আবারও বেরিয়ে যায় মেস থেকে। চায়ের দোকানে এসে দেখে স্নিগ্ধা বসে আছে। কবিরকে দেখে পাশে বসতে বলে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে দেয় স্নিগ্ধা।
"কিরে ব্রেকফাস্ট করেছিস?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"না রে, কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।" কবির বলে।
"তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রাতেও কিছু খাসনি তাই না?"
কবির কোন জবাব দেয়না।
"ওঠ, চল এক্ষুনি" বলে হাত ধরে টেনে তোলে কবিরকে।
"কোথায় যাব আবার? এখানেই কলা পাঁউরুটি দিয়েই নাস্তা সেরে নেই।" কবির বলে।
"না চল বলছি" বলে কবিরকে প্রায় টেনে নিয়ে যায়। কাছে একটি রেস্টুরেন্টে যায় ওরা।
একটি টেবিলে বসে স্নিগ্ধা কবিরকে জিজ্ঞাসা করে "কি খাবি? খিচুড়ি নাকি পরোটা?"
"পরোটা।"
স্নিগ্ধা পরোটার অর্ডার দিয়ে দেয়।
"তুইও খা" কবির বলে।
"না, আমি মেসেই খেয়ে এসেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"জানিস, প্রতিদিন এই রেস্টুরেন্টে বসেই সোহরাব ভাই আর আমি নাস্তা করতাম? আর আজ মানুষটা নেই।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে কবির।
"ট্রাকটাকে কি ধরতে পেরেছে পুলিশ?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"না, এখনো ধরতে পারেনি, ধরতে পারবে বলে মনেও হয়না।" কবির জবাব দেয়।
"খুব ভাল মানুষ ছিল গো, একেবারে ফেরেস্তার মতো মানুষ" স্নিগ্ধা আরো যোগ করে, "জানিস আমার নানি কি বলতো?" জবাবের অপেক্ষা না করে বলে "যারা খুব ভাল মানুষ তাদেরকে আল্লাহ নিজের কাছে নিয়ে নেয় আর তাদের ফেরেস্তা বানিয়ে দেয়। তাদের আলোর তৈরী পাখা থাকে, তারা যেখানে খুশি উড়ে বেড়ায় আর ভাল মানুষদের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে।"
"আমার চিন্তা হচ্ছে ভাবি আর ছেলেমেয়েদের জন্য। একেবারে ছোট ছোট দুটো বাচ্চা, এই বয়সে এতিম হয়ে গেল।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে কবির।
"ওদের তো তাও মা আছে। তোর তো তাও নেই।" স্নিগ্ধা বলে।
"তাতে কি? আন্টি তো আছে। আন্টি আছে, আঙ্কেল আছে, তুই আছিস।"
"তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আম্মু আমার চেয়েও তোকে বেশি ভালবাসে।" একটু থেমে আবার বলে "ওহো বলতে ভুলেই গেছি, আম্মু তো তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।"
"কোথায়?" কবির জিজ্ঞাসা করে।
"কোথায় আবার, বাড়িতে। আমার পরীক্ষা তো কালকেই শেষ। তোর পরীক্ষা শেষ হবে কবে?"
"আমার পরীক্ষা তো শেষ। কিন্তু শেষ দুটো পরীক্ষা দিতে পারিনি।"
"ওতে সমস্যা নেই, রিটেক দিয়ে দিস। তাহলে চল কালকেই বাড়ি যাই।" স্নিগ্ধা বলে।
"না রে। টিউশনি আছে। এমনিতেই অনেকদিন মিস দিয়েছি।" কবির বলে।
"ওসব টিউশনি বাদ দিয়ে দে, তিন মাস হল বাড়ি যাস না। বাড়ি থেকে ঘুরে আয় ভাল লাগবে।"
"ঠিক আছে, ভেবে দেখছি।"
"ভাবাভাবির কিছু নেই, যেতেই হবে।"
ততক্ষনে কবিরের নাস্তা শেষ। ওরা বিল মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।
পরের দিন কবির ও স্নিগ্ধা ঢাকা থেকে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওরা বাসে রওনা দেয় বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু পথে ভীষন জ্যামে পড়ে যায় ওরা, ওদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত এগারোটা বেজে যায়। বাস স্ট্যান্ডে নেমে রিক্সা নিয়ে নেয় ওরা।
"যাক বাবা, অবশেষে পৌঁছাতে পারলাম। যেরকম জ্যাম পড়েছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল আজকে আর পৌঁছাতেই পারবোনা।" একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করে "আচ্ছা, এতো জ্যাম ছিল কেন?"
"দেখলি না টাঙ্গাইলে এক্সিডেন্ট হয়েছে, দুটি ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষ।" কবির জবাব দেয়।
"এদেশে এতোই রোড এক্সিডেন্ট হয়। প্রতিদিন খবরের কাগজে কমপক্ষে একটি রোড এক্সিডেন্টের খবর থাকেই।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে স্নিগ্ধা।
তখনই কল আসে স্নিগ্ধার মোবাইলে।
"স্নিগ্ধা, কোথায় তোরা" মায়ের কন্ঠ ভেসে আসে।
"এখন রিক্সায়, প্রায় পৌঁছে গেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"কবিরকে কিন্তু যেতে দিবিনা এতরাতে।" শিরিন বলে।
"সে তোমাকে বলে দিতে হতো না মা। এইতো এসেই গেছি।" বলে স্নিগ্ধা কেটে দেয়।
"মামা, বাঁয়ে থামান" রিক্সাওলার উদ্দেশ্যে বলে কবির। রিক্সা থামতেই স্নিগ্ধা নেমে যায়।
"তুই এখনো বসে আছিস কেন? নাম", কবিরকে রিক্সায় বসে থাকতে দেখে বলে স্নিগ্ধা।
"আমি বাড়ি যাই।"
"এখন বাড়ি গিয়ে কি করবি? কালকে যাস, আজ রাত আমাদের বাড়িতেই থাক।" স্নিগ্ধা বলে। কবির আর আপত্তি করেনা, রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাভাড়া মিটিয়ে দেয়।
দোতলায় উঠে কলিংবেল টিপতেই খুলে যায় দরজা। ওপাশে মুখে হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে জামান। স্নিগ্ধা প্রায় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তার বাবাকে।
"এতো দেরি হল কেন মামনি?" মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে জিজ্ঞাসা করে জামান।
"রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল আব্বু।"
"কোন সমস্যা হয়নি তো মামনি?"
"না আব্বু।"
"তোমরা সরোতো", স্বামী ও মেয়ের উদ্দেশ্য বলে শিরিন; তারপর মুখে হাসি টেনে এনে কবিরের উদ্দেশ্যে বলে "এসো বাবা ভেতরে এসো।"
কবির তার সাইড ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ভেতরে যায়।
"তোমরা ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।" শিরিন বলে।
"না মা, আমরা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"তাহলে তোমরা হাতমুখ ধুয়ে ঘুমোতে যাও। অনেক রাত হয়েছে।" শিরিন বলে।
স্নিগ্ধা তার নিজের রুমে আর কবির গেস্টরুমে ঘুমোতে যায়।
কবির রুমের লাইট অফ করে শুয়ে থাকে, কিন্তু সহজে ঘুম আসে না। যদিও বেশ ক্লান্ত, শোওয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসার কথা কিন্তু কেন যেন ঘুম আসে না।
ঠিক রাত একটার দিকে দরজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ পায় কবির, দরজার কাছে ছায়ামুর্তি দেখতে পায় কবির। শিরিন কখনো কখনো রাতের বেলা স্নিগ্ধা ও কবিরের রুমে এসে দেখে যায় ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়েছে কিনা কিংবা গায়ের চাদর সরে গেছে কিনা। কবির চোখ বুজে ঘুমের ভান করে থাকে।