16-06-2021, 07:52 PM
বনানী পৌঁছাতে আরো একঘন্টার মতো লাগে ওদের। সজলের ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল টেপে স্নিগ্ধা, প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে যায়, অন্যপাশে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে জাহিদা।
"এসো মা, ভেতরে এসো।" হাসি মুখে বলে জাহিদা।
"ভাল আছেন, আন্টি?" স্নিগ্ধা ভেতরে আসতে আসতে বলে।
"এইতো ভালই আছি।" জাহিদা বলে।
"আরে তুই বাইরে দাড়িয়ে কেন? ভেতরে আয়।" কবিরকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে স্নিগ্ধা।
"ও কবির, আমার বন্ধু। আর উনি জাহিদা আন্টি, সজলের মা।" স্নিগ্ধা পরিচয় করিয়ে দেয়।
"ও, তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? বসো। আমি চা বানিয়ে আনি।"
"ডাক্তার আপনাকে বিছানা থেকে উঠতেই মানা করেছে। আপনি বসুন, আমি চা আনি, তোমরা গল্প কর।" বলে স্নিগ্ধা উঠে কিচেনের দিকে যায়।
"তুমি আর স্নিগ্ধা একই ক্লাসে পড়?" কবিরকে জিজ্ঞাসা করে জাহেদা।
"না, তবে একই ইউনিভার্সিটিতে। ও ফিজিক্সে আর আমি ম্যানেজমেন্টে।" কবির উত্তর দেয়।
"ও আচ্ছা। তুমি সজলকে চেন?"
"তেমন একটা না, কয়েকবার দেখা হয়েছে।"
"তোমার বাড়ি কোথায়?"
"বগুড়া।"
"স্নিগ্ধাদেরও বাড়ি তো বগুড়ায়, তাই না?"
"হ্যাঁ।"
"তুমি স্নিগ্ধাকে আগে থেইকাই চেনো?"
"হ্যাঁ, ও আর আমি তো একই কলেজে পড়তাম, কলেজেও একই ক্লাসে ছিলাম।" কবির বলে।
"ও তাই বল। তোমরা তাহলে অনেক দিনের পরিচিত।" জাহিদা বলে।
কবির মাথা নেড়ে সায় দেয়। ততোক্ষনে স্নিগ্ধা ট্রেতে করে তিন কাপ চা নিয়ে চলে এসেছে।
"সেদিন না কি সুন্দর মা বলে ডাকছিলে, আজকে পর করে দিলে?" চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে জাহিদা।
"না মানে আসলে ভুল করে বলেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"মা বলেই ডাকো না, শুনে মনটা জুড়িয়ে যায়।"
"ঠিক আছে মা।"
"তোমার আর সজলের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে নাকি? ছেলেটা ইদানিং কেমন যেন উদাস উদাস থাকে, জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে না।"
"না মা, তেমন কিছু হয় নি।" স্নিগ্ধা বলে।
ঠিক তখন কলিংবেল বেজে ওঠে।
"সজল এসেছে মনে হয়।" জাহিদা বলে।
"আপনি বসুন, আমি খুলে দিচ্ছি।" বলে স্নিগ্ধা দরজাটা খুলে দেয়।
"সরি, আমি ভেবেছি তুমি চলে গেছ। আমি নাহয় পরে আসি" বলে সজল চলে যেতে উদ্যত হয়।
"যেও না, প্লিজ ভেতরে এস। আর তাছাড়া আমি এক্ষুনি চলে যাব।"
"তুমি এখনি যাবে কেন? আমি এসেছি বলে?" সজল বলে।
"তুমি না এলেও আমি চলে যেতাম, পড়তে হবে, সামনে পরীক্ষা আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
সজল ঢুকে সোজা নিজের রুমে ঢুকে গেল।
"মা, আমরা যাই, সামনে পরীক্ষা তো।"
"এখনই যাবে?"
"হ্যাঁ মা, সন্ধ্যা হয়ে এল।"
"ঠিক আছে, তাহলে যাওয়ার আগে সজলকে ডাকো তো।"
স্নিগ্ধা গিয়ে সজলকে ডেকে আনে।
"তোর মোবাইলটা দে তো।" সজলের উদ্দেশ্যে বলে। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে কবিরের দিকে দিয়ে বলে "তুমি ছবি তোলো তো কয়েকটা।" তারপর স্নিগ্ধাকে নিজের একপাশে ও সজলকে অন্যপাশে দাঁড় করায়। কবির দুটি ছবি তোলে। তারপর সজল ও স্নিগ্ধাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আবার ছবি তোলায় কবিরকে দিয়ে।
"দেখি দেখি, কেমন হয়েছে।" বলে কবিরের হাত থেকে মোবাইলটা নেয়।
"বাহ! এই ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে। দুজনকে কি সুন্দর মানায়! এই ছবিটা বড় করে বাঁধাই করে দিস তো।" সজলকে উদ্দেশ্য করে বলে জাহিদা।
সোহরাব তার অফিসের চেম্বারে বসে মনেযোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গত মাসের মোট সেলস ও আয় ব্যায়ের হিসাব এখন অব্দি এন্ট্রি করা হয়নি, অথচ শনিবারই অডিট আসবে। যদিও কাজটা তার নয় বরং ম্যানেজারের। নতুন ম্যানেজার ভীষণ অলস, নিজের কাজ সোহরাবের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। এরকম অলস মানুষ প্রাইভেট কোম্পানিতে কিভাবে টিঁকে আছে কে জানে? উত্তরটা অবশ্য সোহরাব নিজেও জানে, নিশ্চয়ই তার মতো কলুর বলদদের কাঁধে ভর দিয়েই টিঁকে আছে ওরা। সোহরাবের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ করে খেতে।
হঠাত রিংটোন বেজে ওঠে সোহরাবের মোবাইলে।
রিসিভ করতেই শারমিনের মধুর কন্ঠে ভেসে আসে "কিগো কতোদুর?"
"আমি এখন অফিসেই।"
"এখনো রওনা দেওনি? তবে কি কালকে আসবে?"
"এ সপ্তাহে আর যাওয়া হবে না গো। শনিবার এমডি স্যার আসবেন অডিটে।" সোহরাব বলে।
"তুমি আসবেনা? ওদিকে ছেলেমেয়েরা না খেয়ে বসে আছে বাবার সাথে খাবে বলে।" শারমিন বলে।
"ওদেরকে বোঝাও, আমি সামনে সপ্তাহেই যাব।"
"আমি পারবনা, তুমি বোঝাও। ওরা আমার কোন কথা শোনে?" বলে নিজের ছেলের কাছে মোবাইল দেয়।
"আব্বু তুমি এখনো খাওনি?" সোহরাব বলে।
"তোমার সাথে খাব। আব্বু তুমি আসবে না?" রনি বলে।
"আসলে তুমি যে রিমোট কন্ট্রোল উড়তে পারা প্লেইন আনতে বলেছিলে সেটা তো এখনো খুঁজে পাইনি আব্বু। ওটা পেলেই নিয়ে আসব, ঠিক আছে?"
"রিমোট কন্ট্রোল প্লেইন লাগবে না। তুমি এসো আব্বু।" রনি বলে।
"আমি আসব আব্বু, সামনে মঙ্গল বারেই আসব। আর তোমার জন্য রিমোট কন্ট্রোল এরোপ্লেন নিয়ে আসব। এখন খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, ঠিক আছে?"
"ঠিক আছে আব্বু" রনি বলে।
"তোমার মেয়ের সাথে কথা বল।" বলে লাউড স্পীকারে দেয় শারমিন।
"আব্বু তুমি আথবে না?" বিথী বলে।
"আসব মামনি, কয়েকদিন পর আসব।"
"কথা বলা পুতুল এনো আমার জন্য।" বিথী বলে।
"ঠিক আছে আম্মু, তুমি খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়।"
"ঠিক আছে আব্বু।" বিথী বলে।
"তাহলে রাখি, নিজের যত্ন নিও।" শারমিনের কন্ঠ ভেসে আসে।
"শোন, বেতন পেয়েছি, কালকে টাকা পাঠিয়ে দেব। তুমি মনে করে রনির কলেজের বেতন আর বিদ্যুতবিল দিয়ে দিও।"
"ঠিক আছে" বলে কেটে দেয় শারমিন।
সোহরাব মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখে, ওয়াল পেপারে ওর পরিবারের ছবি। স্ত্রী ও দুই সন্তান, এ নিয়েই জগত যেন ওর। ছেলের বয়স আট বছর, মেয়ের ছয়। প্রতি মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহে সোহরাব বাড়ি যায়, স্ত্রী সন্তানরা ওর আশায় পথ চেয়ে থাকে। কিন্তু এ সপ্তাহে যেতে পারবে না বাড়িতে।
হঠাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি পড়ে সোহরাবের, সাড়ে দশটা বাজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহরাব, শুক্রবারেও অফিসে আসতে হবে তাকে বাকি কাজ সারতে।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে ফাইলপত্র গোছাতে থাকে সোহরাব। ফাইল গোছাতে গোছাতে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে। এই সপ্তাহেই রেজিগনিশন দিবে সে। অযথা এতোদুর পড়ে থেকে নিজেকে কষ্ট দিয়ে স্ত্রী সন্তানদের ভালবাসা বঞ্চিত করছে কেন সে? জীবিকার জন্য? সে তো গ্রামে গিয়েও কোনভাবে জোগাড় করা যাবে। গঞ্জে বেশ কিছু নতুন কলেজ মাদ্রাসা হয়েছে কিন্তু একটাও স্টেশনারীর দোকান নেই সেখানে। যদি কিছু টাকা যোগাড় করে একটি স্টেশনারির দোকান দেয়া যায় তো ভালই চলবে। তবে রেজিগনেশন সাবমিট করার আগে শারমিনের সাথে কথা বলতে হবে। মনে মনে পরিকল্পনা করে সোহরাব। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মনটা হালকা ও ফুরফুরে লাগে সোহরাবের।
অফিস থেকে বেরিয়ে সোহরাব তার মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মোটর সাইকেলটি কোম্পানির দেয়া, চাকরিটা ছেড়ে দিলে এই বাইকটাকে খুব মিস করবে সে। আরো মিস করবে কলিগ রফিক ভাই আর সুব্রতদাকে। আরো মিস করবে মেসে কবির, তপু, প্রদীপ, স্বপনদেরকে, বিশেষ করে কবিরকে। অল্প কিছুদিনের ভেতরেই ছেলেটা খুব আপন হয়ে গেছে।
রাত এগারোটা বাজে, রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। সোহরাব মতিঝিল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে মিরপুর রোডে উঠতেই একটি বালির ট্রাক নজরে পড়ে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে ত্রিশ কিলোমিটার বেগে চলছে।
সোহরাব তিন চারবার হর্ন দেয়ার পর সাইড দেয়, ওভারটেক করার পর পরই ট্রাকটা গতি বাড়িয়ে দেয় এবং সোহরাবের বাইকের পিছে সমান গতিতে আসতে থাকে। ঢাকা কলেজের সামনে স্পিডব্রেকার দেখে সোহরাব গতি কমিয়ে দেয়, তখনই পেছনের ট্রাকটি সজোরে ধাক্কা দেয় বাইকের পেছনে। ট্রাকের ও স্পিডব্রেকারের ধাক্কা খেয়ে সোহরাব বাইকসহ শুন্যে লাফিয়ে ওঠে। তারপর ট্রাকের গ্লাসের সাথে সজোরে বাড়ি খেয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে যায় সোহরাব।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে কবির, স্বপন, তপু, প্রদীপসহ মেসের সকলেই। প্রত্যেকেই প্রার্থনারত ইশ্বরের কাছে, যেন তিনি সোহরাব ভাইকে বাঁচিয়ে দেন। প্রায় দেড় ঘন্টা পর ডাক্তার বের হয়ে আসে। ডাক্তারকে বেরিয়ে আসতে দেখেই ওরা ঘিরে ধরে।
"দু:খিত অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি।" ডাক্তার জবাব দিল।
"সোহরাব ভাই! ভাইরে!" বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে কবির।
"এসো মা, ভেতরে এসো।" হাসি মুখে বলে জাহিদা।
"ভাল আছেন, আন্টি?" স্নিগ্ধা ভেতরে আসতে আসতে বলে।
"এইতো ভালই আছি।" জাহিদা বলে।
"আরে তুই বাইরে দাড়িয়ে কেন? ভেতরে আয়।" কবিরকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে স্নিগ্ধা।
"ও কবির, আমার বন্ধু। আর উনি জাহিদা আন্টি, সজলের মা।" স্নিগ্ধা পরিচয় করিয়ে দেয়।
"ও, তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? বসো। আমি চা বানিয়ে আনি।"
"ডাক্তার আপনাকে বিছানা থেকে উঠতেই মানা করেছে। আপনি বসুন, আমি চা আনি, তোমরা গল্প কর।" বলে স্নিগ্ধা উঠে কিচেনের দিকে যায়।
"তুমি আর স্নিগ্ধা একই ক্লাসে পড়?" কবিরকে জিজ্ঞাসা করে জাহেদা।
"না, তবে একই ইউনিভার্সিটিতে। ও ফিজিক্সে আর আমি ম্যানেজমেন্টে।" কবির উত্তর দেয়।
"ও আচ্ছা। তুমি সজলকে চেন?"
"তেমন একটা না, কয়েকবার দেখা হয়েছে।"
"তোমার বাড়ি কোথায়?"
"বগুড়া।"
"স্নিগ্ধাদেরও বাড়ি তো বগুড়ায়, তাই না?"
"হ্যাঁ।"
"তুমি স্নিগ্ধাকে আগে থেইকাই চেনো?"
"হ্যাঁ, ও আর আমি তো একই কলেজে পড়তাম, কলেজেও একই ক্লাসে ছিলাম।" কবির বলে।
"ও তাই বল। তোমরা তাহলে অনেক দিনের পরিচিত।" জাহিদা বলে।
কবির মাথা নেড়ে সায় দেয়। ততোক্ষনে স্নিগ্ধা ট্রেতে করে তিন কাপ চা নিয়ে চলে এসেছে।
"সেদিন না কি সুন্দর মা বলে ডাকছিলে, আজকে পর করে দিলে?" চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে জাহিদা।
"না মানে আসলে ভুল করে বলেছি।" স্নিগ্ধা বলে।
"মা বলেই ডাকো না, শুনে মনটা জুড়িয়ে যায়।"
"ঠিক আছে মা।"
"তোমার আর সজলের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে নাকি? ছেলেটা ইদানিং কেমন যেন উদাস উদাস থাকে, জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে না।"
"না মা, তেমন কিছু হয় নি।" স্নিগ্ধা বলে।
ঠিক তখন কলিংবেল বেজে ওঠে।
"সজল এসেছে মনে হয়।" জাহিদা বলে।
"আপনি বসুন, আমি খুলে দিচ্ছি।" বলে স্নিগ্ধা দরজাটা খুলে দেয়।
"সরি, আমি ভেবেছি তুমি চলে গেছ। আমি নাহয় পরে আসি" বলে সজল চলে যেতে উদ্যত হয়।
"যেও না, প্লিজ ভেতরে এস। আর তাছাড়া আমি এক্ষুনি চলে যাব।"
"তুমি এখনি যাবে কেন? আমি এসেছি বলে?" সজল বলে।
"তুমি না এলেও আমি চলে যেতাম, পড়তে হবে, সামনে পরীক্ষা আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
সজল ঢুকে সোজা নিজের রুমে ঢুকে গেল।
"মা, আমরা যাই, সামনে পরীক্ষা তো।"
"এখনই যাবে?"
"হ্যাঁ মা, সন্ধ্যা হয়ে এল।"
"ঠিক আছে, তাহলে যাওয়ার আগে সজলকে ডাকো তো।"
স্নিগ্ধা গিয়ে সজলকে ডেকে আনে।
"তোর মোবাইলটা দে তো।" সজলের উদ্দেশ্যে বলে। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে কবিরের দিকে দিয়ে বলে "তুমি ছবি তোলো তো কয়েকটা।" তারপর স্নিগ্ধাকে নিজের একপাশে ও সজলকে অন্যপাশে দাঁড় করায়। কবির দুটি ছবি তোলে। তারপর সজল ও স্নিগ্ধাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আবার ছবি তোলায় কবিরকে দিয়ে।
"দেখি দেখি, কেমন হয়েছে।" বলে কবিরের হাত থেকে মোবাইলটা নেয়।
"বাহ! এই ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে। দুজনকে কি সুন্দর মানায়! এই ছবিটা বড় করে বাঁধাই করে দিস তো।" সজলকে উদ্দেশ্য করে বলে জাহিদা।
সোহরাব তার অফিসের চেম্বারে বসে মনেযোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গত মাসের মোট সেলস ও আয় ব্যায়ের হিসাব এখন অব্দি এন্ট্রি করা হয়নি, অথচ শনিবারই অডিট আসবে। যদিও কাজটা তার নয় বরং ম্যানেজারের। নতুন ম্যানেজার ভীষণ অলস, নিজের কাজ সোহরাবের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। এরকম অলস মানুষ প্রাইভেট কোম্পানিতে কিভাবে টিঁকে আছে কে জানে? উত্তরটা অবশ্য সোহরাব নিজেও জানে, নিশ্চয়ই তার মতো কলুর বলদদের কাঁধে ভর দিয়েই টিঁকে আছে ওরা। সোহরাবের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ করে খেতে।
হঠাত রিংটোন বেজে ওঠে সোহরাবের মোবাইলে।
রিসিভ করতেই শারমিনের মধুর কন্ঠে ভেসে আসে "কিগো কতোদুর?"
"আমি এখন অফিসেই।"
"এখনো রওনা দেওনি? তবে কি কালকে আসবে?"
"এ সপ্তাহে আর যাওয়া হবে না গো। শনিবার এমডি স্যার আসবেন অডিটে।" সোহরাব বলে।
"তুমি আসবেনা? ওদিকে ছেলেমেয়েরা না খেয়ে বসে আছে বাবার সাথে খাবে বলে।" শারমিন বলে।
"ওদেরকে বোঝাও, আমি সামনে সপ্তাহেই যাব।"
"আমি পারবনা, তুমি বোঝাও। ওরা আমার কোন কথা শোনে?" বলে নিজের ছেলের কাছে মোবাইল দেয়।
"আব্বু তুমি এখনো খাওনি?" সোহরাব বলে।
"তোমার সাথে খাব। আব্বু তুমি আসবে না?" রনি বলে।
"আসলে তুমি যে রিমোট কন্ট্রোল উড়তে পারা প্লেইন আনতে বলেছিলে সেটা তো এখনো খুঁজে পাইনি আব্বু। ওটা পেলেই নিয়ে আসব, ঠিক আছে?"
"রিমোট কন্ট্রোল প্লেইন লাগবে না। তুমি এসো আব্বু।" রনি বলে।
"আমি আসব আব্বু, সামনে মঙ্গল বারেই আসব। আর তোমার জন্য রিমোট কন্ট্রোল এরোপ্লেন নিয়ে আসব। এখন খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, ঠিক আছে?"
"ঠিক আছে আব্বু" রনি বলে।
"তোমার মেয়ের সাথে কথা বল।" বলে লাউড স্পীকারে দেয় শারমিন।
"আব্বু তুমি আথবে না?" বিথী বলে।
"আসব মামনি, কয়েকদিন পর আসব।"
"কথা বলা পুতুল এনো আমার জন্য।" বিথী বলে।
"ঠিক আছে আম্মু, তুমি খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়।"
"ঠিক আছে আব্বু।" বিথী বলে।
"তাহলে রাখি, নিজের যত্ন নিও।" শারমিনের কন্ঠ ভেসে আসে।
"শোন, বেতন পেয়েছি, কালকে টাকা পাঠিয়ে দেব। তুমি মনে করে রনির কলেজের বেতন আর বিদ্যুতবিল দিয়ে দিও।"
"ঠিক আছে" বলে কেটে দেয় শারমিন।
সোহরাব মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখে, ওয়াল পেপারে ওর পরিবারের ছবি। স্ত্রী ও দুই সন্তান, এ নিয়েই জগত যেন ওর। ছেলের বয়স আট বছর, মেয়ের ছয়। প্রতি মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহে সোহরাব বাড়ি যায়, স্ত্রী সন্তানরা ওর আশায় পথ চেয়ে থাকে। কিন্তু এ সপ্তাহে যেতে পারবে না বাড়িতে।
হঠাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি পড়ে সোহরাবের, সাড়ে দশটা বাজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহরাব, শুক্রবারেও অফিসে আসতে হবে তাকে বাকি কাজ সারতে।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে ফাইলপত্র গোছাতে থাকে সোহরাব। ফাইল গোছাতে গোছাতে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে। এই সপ্তাহেই রেজিগনিশন দিবে সে। অযথা এতোদুর পড়ে থেকে নিজেকে কষ্ট দিয়ে স্ত্রী সন্তানদের ভালবাসা বঞ্চিত করছে কেন সে? জীবিকার জন্য? সে তো গ্রামে গিয়েও কোনভাবে জোগাড় করা যাবে। গঞ্জে বেশ কিছু নতুন কলেজ মাদ্রাসা হয়েছে কিন্তু একটাও স্টেশনারীর দোকান নেই সেখানে। যদি কিছু টাকা যোগাড় করে একটি স্টেশনারির দোকান দেয়া যায় তো ভালই চলবে। তবে রেজিগনেশন সাবমিট করার আগে শারমিনের সাথে কথা বলতে হবে। মনে মনে পরিকল্পনা করে সোহরাব। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মনটা হালকা ও ফুরফুরে লাগে সোহরাবের।
অফিস থেকে বেরিয়ে সোহরাব তার মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মোটর সাইকেলটি কোম্পানির দেয়া, চাকরিটা ছেড়ে দিলে এই বাইকটাকে খুব মিস করবে সে। আরো মিস করবে কলিগ রফিক ভাই আর সুব্রতদাকে। আরো মিস করবে মেসে কবির, তপু, প্রদীপ, স্বপনদেরকে, বিশেষ করে কবিরকে। অল্প কিছুদিনের ভেতরেই ছেলেটা খুব আপন হয়ে গেছে।
রাত এগারোটা বাজে, রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। সোহরাব মতিঝিল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে মিরপুর রোডে উঠতেই একটি বালির ট্রাক নজরে পড়ে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে ত্রিশ কিলোমিটার বেগে চলছে।
সোহরাব তিন চারবার হর্ন দেয়ার পর সাইড দেয়, ওভারটেক করার পর পরই ট্রাকটা গতি বাড়িয়ে দেয় এবং সোহরাবের বাইকের পিছে সমান গতিতে আসতে থাকে। ঢাকা কলেজের সামনে স্পিডব্রেকার দেখে সোহরাব গতি কমিয়ে দেয়, তখনই পেছনের ট্রাকটি সজোরে ধাক্কা দেয় বাইকের পেছনে। ট্রাকের ও স্পিডব্রেকারের ধাক্কা খেয়ে সোহরাব বাইকসহ শুন্যে লাফিয়ে ওঠে। তারপর ট্রাকের গ্লাসের সাথে সজোরে বাড়ি খেয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে যায় সোহরাব।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে কবির, স্বপন, তপু, প্রদীপসহ মেসের সকলেই। প্রত্যেকেই প্রার্থনারত ইশ্বরের কাছে, যেন তিনি সোহরাব ভাইকে বাঁচিয়ে দেন। প্রায় দেড় ঘন্টা পর ডাক্তার বের হয়ে আসে। ডাক্তারকে বেরিয়ে আসতে দেখেই ওরা ঘিরে ধরে।
"দু:খিত অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি।" ডাক্তার জবাব দিল।
"সোহরাব ভাই! ভাইরে!" বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে কবির।