16-06-2021, 07:51 PM
সজলদের আর আমাদের বাড়ি পাশাপাশি। ওদের আর আমাদের পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক ছিল সবসময়ই। সজল আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। ছোটবেলায় আমি ওকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। ওকে আমিই লিখতে পড়তে শিখিয়েছি। সজল আমার নেওটা ছিল, সবসময় আমার পিছে পিছে ঘুরে বেড়াত। তবে বরাবরই লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল ও।
যাই হোক যখনকার ঘটনা বলতে চাই তোমাকে তখন সজল সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে আর আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষে ছুটিতে গ্রামে এসেছিলাম। একদিন শুনি পাশের গ্রামের সফদর আলী ও তার ভাইয়েরা নাকি সজলকে বাড়িতে বেঁধে রেখেছে। সাথে সাথে ছুটে গেলাম। গিয়ে যা শুনলাম তাতে আমি স্তম্ভিত। সফদর আলীর বড় মেয়ে শারমিনকে সজল পড়াতো। সেই মেয়ে তিন মাসের প্রেগনেন্ট। মেয়েটি এর জন্য সজলকে দায়ী করছে, মেয়ের বাপ চাচা সজলকে বেঁধে রেখেছে, পরের দিন সালিশ ডাকবে। আমি ওনাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে বিষয়টা নিয়ে হইচই করার চেয়ে যত নিরবে সমাধান করা যায় তাতেই মঙ্গল। আমি প্রস্তাব দিলাম যে দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেই। তাতে মেয়ের বাপচাচা রাজি, কিন্তু বেঁকে বসল সজল। ও কিছুতেই বিয়ে করবে না। আমি ওকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই সে রাজি হয়না। ও বলে যে জোর করে বিয়ে দিলে ও আত্মহত্যা করবে। আমারও মনে হল যে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে ও সত্যিই তেমন কিছু করে ফেলত। আর কোন উপায় না দেখে আমি প্রস্তাব দিলাম যে আমি বিয়ে করতে চাই।
মেয়ের আত্মীয় স্বজন প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও পরে রাজি হয়ে যায়। আমার ও শারমিনের বিয়ে হয় এভাবেই। তার ছয় মাস পর আমাদের বড় ছেলের জন্ম হয়। এ নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে অনেক কথা হয়, আমি অবশ্য বিষয়টাকে চাপা দিয়েছি এই বলে যে বিয়ের আগে থেকেই শারমিনের সাথে সম্পর্ক ছিল আমার। সে যাই হোক শারমিনকে পেয়ে আমি সুখী। এই কথাগুলো আমি কখনোই কাউকে বলতাম না যদি সজল এরপর শুধরে যেত।
ঢাকায় এসে ওর নষ্টামি আরো বেড়ে গিয়েছিল। ওর এক ছাত্রী ছিল লিজা নামে, রাজুক উত্তরা মডেল কলেজে ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়তো। সেই মেয়েটি কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। পোস্টমর্টেমে জানা যায় মেয়েটি অন্তসত্বা ছিল। সেই কেসে সজল প্রায় ফেঁসেই গিয়েছিল। পুলিশ ওকে এরেস্টও করেছিল। কিন্তু ওর এক ক্লোস বন্ধু ছাত্রলিডার ছিল বলে বেঁচে যায়। পলিটিক্যাল প্রভাব খাটিয়ে ও কেসটা ধামাচাপা দিয়েছিল। শুধু লিজা নয় আরো অনেক মেয়ের জীবন ও নষ্ট করেছে। আমি চাই না তোমার জীবনটাও নষ্ট হোক। বড় ভাই হিসাবে আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি ওর সাথে সম্পর্ক রেখোনা।
কথা শেষ করে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকে সোহরাব। ওর চোখের কোণে পানি চলে এসেছে। ও কিছু বলেনা।
"আমার কথাগুলো তোমার বিশ্বাস হয়নি? তুমি চাইলে আমি প্রমান দিতে পারি।"
"তার দরকার নেই সোহরাব ভাই। আসলে এতোদিনের সম্পর্ক তো, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।"
"চল, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। সাবধানে থেকো, আর যেকোন সমস্যায় আমাকে জানিয়ো।"
পরের দিন সকাল নয়টা। সোহরাব অফিসে ঢুকে তার চেম্বারে ঢুকতেই সজলকে দেখতে পায়। সজলের চোখদুটি লাল হয়ে আছে, সম্ভবত রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি?
"কিরে সজল, এতো সকাল সকাল কি মনে করে?" নিজের চেয়ারে বসে অবাক হওয়ার ভান করে বলে সোহরাব।
"নাটক কোরোনা, তুমি খুব ভাল করে জান যে আমি কেন এসেছি। এরকম কেন করলে সোহরাব ভাই? স্নিগ্ধাকে ওসব কেন বলতে গেলে?" অভিযোগ করে বলে সজল।
"দেখ, স্নিগ্ধা খুব সহজ সরল মেয়ে। ও তোর টাইপের নয়, তুই তোর টাইপের কাউকে খুঁজে নে।" শান্ত স্বরে বলে সোহরাব।
"পাঁচ বছর ধরে রিলেশন আমাদের, আজ পর্যন্ত আমি ওকে ছুঁইও নি। আমি স্নিগ্ধাকে সত্যি সত্যি ভালবাসি, বিয়ে করতে চাই ওকে। আর তুমি কিনা ভেঙে দিতে চাও আমাদের সম্পর্ক? আমি তোমাকে বড় ভাই বলে মানি, শ্রদ্ধা করি। আর তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে?"
"তুই আমার আপন ভাই হলেও এটাই করতাম। কেমন সত্যিকারের ভালবাসা তোর, একজনকে ভালবাসিস অন্য মেয়েকে বিছানায় তুলিস। বহু মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিস তুই। আর আমাকে বলিস বিশ্বাসঘাতক, বিশ্বাসঘাতক তো তুই।"
"ও বুঝতে পেরেছি, প্রতিশোধ নিতে চাও তুমি। আমার এঁটো করা মেয়েকে তোমার বিয়ে করতে হয়েছে বলে তার প্রতিশোধ নিতে চাও আমার রিলেশন ভেঙে দিয়ে?" হিসহিসিয়ে বলে সজল।
"কি বললি শুয়োর! এক্ষুনি বেরিয়ে যা। সিকিউরিটি ডেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার আগে চলে যা।" প্রায় চেঁচিয়ে বলে সোহরাব।
"যাচ্ছি, কিন্তু শুনে রাখ, স্নিগ্ধা শুধু আমার, আমি স্নিগ্ধাকে বিয়ে করবই। আর যে আমাদের ভেতর কাঁটা হয়ে দাড়াবে তাকে আমি উপড়ে ফেলব।" আঙুল তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে সজল, তারপর হনহন করে বেরিয়ে যায় সোহরাবের অফিস থেকে।
ফুটপাতে নেমে সজল কল দেয় স্নিগ্ধাকে, তখনও ব্যাস্ত দেখাচ্ছে। রাত থেকেই স্নিগ্ধার নাম্বার বিজি দেখাচ্ছে, অর্থাৎ তার দুটি নাম্বারই স্নিগ্ধা ব্ল্যাকলিস্ট করে রেখেছে। সজল একটি মোবাইলের দোকানে যেয়ে নতুন সিম কিনে নেয়, একটিভেট করেই স্নিগ্ধাকে কল দেয়।
কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো, কে বলছেন?" স্নিগ্ধার মিষ্টি কন্ঠে ভেসে আসে।
"স্নিগ্ধা, আমি সজল।"
"তোমাকে না মানা করেছি আমার সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করবে না? তোমার মতো লম্পট চরিত্রহীনের সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।" তীক্ষ্ন কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"দেখ, একজন ফাঁসির আসামীকেও চুড়ান্ত রায় শুনিয়ে দেয়ার আগে নিজের স্বপক্ষে কিছু বলার সুযোগ দেয়। তুমি আমাকে সেই সুযোগটাও কি দেবে না? প্লিজ শুধু একবার দেখা করো। এরপর যদি আর না চাও তো আমি আর কখনো তোমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো না।"
কয়েক সেকেন্ড পর জবাব আসে-
"ঠিক আছে। একবার দেখা করব। এরপর আর আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। বল কখন দেখা করবে?"
"এক্ষুনি।"
"আমার ক্লাস আছে। বিকেল চারটায় লা এরিস্টন ক্যাফে, মিরপুর।"
"ঠিক আছে।"
সাথে সাথেই কেটে দেয় স্নিগ্ধা।
সোহরাবের অফিস থেকে বেরিয়ে সজল নিজের অফিসে ফিরে আসে। মাকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে অর্ধেক দিন ছুটি নিয়ে নেয় সে। দুপুরে মিরপুরে একটি রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেয় সজল, এখানেই স্নিগ্ধার সাথে দেখা হওয়ার কথা। সজল বসে বসে ভাবতে থাকে কিভাবে স্নিগ্ধাকে মানাবে সে।
স্নিগ্ধা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে চারটা বাজে।
"কি খাবে বল? চা নাকি কফি?" সজল বলে।
"চা কিংবা কফি খাওয়ার জন্য আমি আসিনি। কি বলতে চাও বল।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই তোমার অভিযোগ কি, আর আমার অপরাধটাই বা কি?" সজল বলে।
"আমি তোমার সাথে তর্ক করতে আসিনি। যদি তোমার কিছু বলার থাকে তো বল, নাহলে আমি চললাম, আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা কোরো না।"
"পাঁচ বছরের সম্পর্ক আমাদের, এতো সহজে কি ভাঙা যায়? কোন কারণ নেই, ব্রেকআপ বললেই ব্রেকআপ হয়ে যায়?"
"তুমি একটা লম্পট, চরিত্রহীন, প্রতারক, ছোটলোক; এটা কি যথেষ্ট নয় ব্রেকআপ হওয়ার জন্য। যদি তুমি জানতে পারতে যে আমি তোমার মতো নষ্টামি করে বেড়াই, তবে কি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে? তোমরা পুরুষ বলে যা ইচ্ছা করে বেড়াবে তবুও তোমরা ধোয়া তুলসি পাতা? আমি মানিনা। আমি তোমার মতো লম্পটের সাথে কোন রিলেশন রাখতে চাইনা।" তীক্ষ্ন কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কে বলেছে আমি নষ্টামি করে বেড়াই? সোহরাব ভাই?"
স্নিগ্ধা কোন জবাব দেয়না।
সজল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে "সোহরাব ভাই অনেকটা ঠিকই বলেছে। একটা সময় আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক মেয়ের সাথেই আমার রিলেশন ছিল আমার। কিন্তু বিশ্বাস কর তোমার প্রেম আমাকে বদলে দিয়েছে। বিশ্বাস কর, তোমার সাথে রিলেশন হওয়ার পর আমি অন্য কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাইও নি।"
"মিথ্যা কথা। আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি অস্বীকার করতে পার, তুমি আমার সাথে রিলেশন রাখার পরও লিজা নামের মেয়েটির সর্বনাশ করোনি? মেয়েটির মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী। তুমি শুধু চরিত্রহীন, লম্পটই না, প্রতারক আর খুনিও।"
"বিশ্বাস কর, লিজা আমার শুধুই ছাত্রী ছিল। ওর সাথে আমার ওরকম কিছু ছিলনা। পুলিশ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য, কয়েকটা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেয়। যদি আমি দোষী হতাম তবে কি এখানে থাকতাম? হয় ফাঁসি হতো, নয় তো জেলে পচে মরতাম।"
"আমি বিশ্বাস করিনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"তাহলে কি বিশ্বাস করো? আমিই লিজার মৃত্যুর জন্য দায়ী? আচ্ছা মেনেই নিলাম। তাহলে তো আমার শাস্তি প্রাপ্য। বল কি শাস্তি হওয়া উচিত আমার? মৃত্যুদন্ড?" দাঁতে দাঁত চেপে প্রায় চেঁচিয়ে বলে সজল।
যদিও রেস্টুরেন্টটা প্রায় একেবারে ফাঁকা, তবুও সজলের প্রায় চেঁচিয়ে বলাতে আশেপাশের লোকজন ওদের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে।
"পাগলামী কোরোনা প্লিজ।" স্নিগ্ধা অনুরোধ করে বলে।
"পাগলামী কেন বলছ? আমি তো খুনি, আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আমি বেঁচে থাকলে লিজার আত্মা তো শান্তি পাবেনা। এই বিল্ডিং তো সাত তলা, প্রতি তলা বারো ফুট হলে চুরাশি ফুট, কংক্রিটের উপর পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা নেই।" বলে; তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে "ভাল থেকো, বিদায়।"
স্নিগ্ধা হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বলে "কি তামাশা করছো?"
"তোমার মনে হচ্ছে আমি তামাশা করছি? আমি সিরিয়াস না?"
"প্লিজ পাগলামি কোরোনা। তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার মায়ের কি হবে?"
"আমার মাকে নিয়ে চিন্তা হয় তোমার? মা অনেক আশা নিয়ে আছে তুমি ঘরের বউ হবে। যদি জানতে পারেন যে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেছে তাহলে কি হবে? আম্মার হার্টের যা কন্ডিশন তাতে তিনি মারাও যেতে পারেন।" মোক্ষম সময়ে তার ব্রহ্মাস্ত্র চালিয়ে দেয় সজল। ওর মাকে যে স্নিগ্ধার খুব মনে ধরেছে তা জানত সজল।
কিছুক্ষন নিরবতা চলে।
"কি হল কিছু বলছ না যে?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
"আমাকে ভাবতে দাও সজল, আমাকে কিছুদিন সময় দাও। এর মাঝে তুমি কোন পাগলামি কোরোনা প্লিজ।" শান্ত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।"
"না, আমি রিক্সায় যাব।" বলে উঠে বেরিয়ে যায় স্নিগ্ধা।
যাই হোক যখনকার ঘটনা বলতে চাই তোমাকে তখন সজল সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে আর আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষে ছুটিতে গ্রামে এসেছিলাম। একদিন শুনি পাশের গ্রামের সফদর আলী ও তার ভাইয়েরা নাকি সজলকে বাড়িতে বেঁধে রেখেছে। সাথে সাথে ছুটে গেলাম। গিয়ে যা শুনলাম তাতে আমি স্তম্ভিত। সফদর আলীর বড় মেয়ে শারমিনকে সজল পড়াতো। সেই মেয়ে তিন মাসের প্রেগনেন্ট। মেয়েটি এর জন্য সজলকে দায়ী করছে, মেয়ের বাপ চাচা সজলকে বেঁধে রেখেছে, পরের দিন সালিশ ডাকবে। আমি ওনাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে বিষয়টা নিয়ে হইচই করার চেয়ে যত নিরবে সমাধান করা যায় তাতেই মঙ্গল। আমি প্রস্তাব দিলাম যে দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেই। তাতে মেয়ের বাপচাচা রাজি, কিন্তু বেঁকে বসল সজল। ও কিছুতেই বিয়ে করবে না। আমি ওকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই সে রাজি হয়না। ও বলে যে জোর করে বিয়ে দিলে ও আত্মহত্যা করবে। আমারও মনে হল যে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে ও সত্যিই তেমন কিছু করে ফেলত। আর কোন উপায় না দেখে আমি প্রস্তাব দিলাম যে আমি বিয়ে করতে চাই।
মেয়ের আত্মীয় স্বজন প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও পরে রাজি হয়ে যায়। আমার ও শারমিনের বিয়ে হয় এভাবেই। তার ছয় মাস পর আমাদের বড় ছেলের জন্ম হয়। এ নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে অনেক কথা হয়, আমি অবশ্য বিষয়টাকে চাপা দিয়েছি এই বলে যে বিয়ের আগে থেকেই শারমিনের সাথে সম্পর্ক ছিল আমার। সে যাই হোক শারমিনকে পেয়ে আমি সুখী। এই কথাগুলো আমি কখনোই কাউকে বলতাম না যদি সজল এরপর শুধরে যেত।
ঢাকায় এসে ওর নষ্টামি আরো বেড়ে গিয়েছিল। ওর এক ছাত্রী ছিল লিজা নামে, রাজুক উত্তরা মডেল কলেজে ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়তো। সেই মেয়েটি কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। পোস্টমর্টেমে জানা যায় মেয়েটি অন্তসত্বা ছিল। সেই কেসে সজল প্রায় ফেঁসেই গিয়েছিল। পুলিশ ওকে এরেস্টও করেছিল। কিন্তু ওর এক ক্লোস বন্ধু ছাত্রলিডার ছিল বলে বেঁচে যায়। পলিটিক্যাল প্রভাব খাটিয়ে ও কেসটা ধামাচাপা দিয়েছিল। শুধু লিজা নয় আরো অনেক মেয়ের জীবন ও নষ্ট করেছে। আমি চাই না তোমার জীবনটাও নষ্ট হোক। বড় ভাই হিসাবে আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি ওর সাথে সম্পর্ক রেখোনা।
কথা শেষ করে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকে সোহরাব। ওর চোখের কোণে পানি চলে এসেছে। ও কিছু বলেনা।
"আমার কথাগুলো তোমার বিশ্বাস হয়নি? তুমি চাইলে আমি প্রমান দিতে পারি।"
"তার দরকার নেই সোহরাব ভাই। আসলে এতোদিনের সম্পর্ক তো, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।"
"চল, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। সাবধানে থেকো, আর যেকোন সমস্যায় আমাকে জানিয়ো।"
পরের দিন সকাল নয়টা। সোহরাব অফিসে ঢুকে তার চেম্বারে ঢুকতেই সজলকে দেখতে পায়। সজলের চোখদুটি লাল হয়ে আছে, সম্ভবত রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি?
"কিরে সজল, এতো সকাল সকাল কি মনে করে?" নিজের চেয়ারে বসে অবাক হওয়ার ভান করে বলে সোহরাব।
"নাটক কোরোনা, তুমি খুব ভাল করে জান যে আমি কেন এসেছি। এরকম কেন করলে সোহরাব ভাই? স্নিগ্ধাকে ওসব কেন বলতে গেলে?" অভিযোগ করে বলে সজল।
"দেখ, স্নিগ্ধা খুব সহজ সরল মেয়ে। ও তোর টাইপের নয়, তুই তোর টাইপের কাউকে খুঁজে নে।" শান্ত স্বরে বলে সোহরাব।
"পাঁচ বছর ধরে রিলেশন আমাদের, আজ পর্যন্ত আমি ওকে ছুঁইও নি। আমি স্নিগ্ধাকে সত্যি সত্যি ভালবাসি, বিয়ে করতে চাই ওকে। আর তুমি কিনা ভেঙে দিতে চাও আমাদের সম্পর্ক? আমি তোমাকে বড় ভাই বলে মানি, শ্রদ্ধা করি। আর তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে?"
"তুই আমার আপন ভাই হলেও এটাই করতাম। কেমন সত্যিকারের ভালবাসা তোর, একজনকে ভালবাসিস অন্য মেয়েকে বিছানায় তুলিস। বহু মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিস তুই। আর আমাকে বলিস বিশ্বাসঘাতক, বিশ্বাসঘাতক তো তুই।"
"ও বুঝতে পেরেছি, প্রতিশোধ নিতে চাও তুমি। আমার এঁটো করা মেয়েকে তোমার বিয়ে করতে হয়েছে বলে তার প্রতিশোধ নিতে চাও আমার রিলেশন ভেঙে দিয়ে?" হিসহিসিয়ে বলে সজল।
"কি বললি শুয়োর! এক্ষুনি বেরিয়ে যা। সিকিউরিটি ডেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার আগে চলে যা।" প্রায় চেঁচিয়ে বলে সোহরাব।
"যাচ্ছি, কিন্তু শুনে রাখ, স্নিগ্ধা শুধু আমার, আমি স্নিগ্ধাকে বিয়ে করবই। আর যে আমাদের ভেতর কাঁটা হয়ে দাড়াবে তাকে আমি উপড়ে ফেলব।" আঙুল তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে সজল, তারপর হনহন করে বেরিয়ে যায় সোহরাবের অফিস থেকে।
ফুটপাতে নেমে সজল কল দেয় স্নিগ্ধাকে, তখনও ব্যাস্ত দেখাচ্ছে। রাত থেকেই স্নিগ্ধার নাম্বার বিজি দেখাচ্ছে, অর্থাৎ তার দুটি নাম্বারই স্নিগ্ধা ব্ল্যাকলিস্ট করে রেখেছে। সজল একটি মোবাইলের দোকানে যেয়ে নতুন সিম কিনে নেয়, একটিভেট করেই স্নিগ্ধাকে কল দেয়।
কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো, কে বলছেন?" স্নিগ্ধার মিষ্টি কন্ঠে ভেসে আসে।
"স্নিগ্ধা, আমি সজল।"
"তোমাকে না মানা করেছি আমার সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করবে না? তোমার মতো লম্পট চরিত্রহীনের সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।" তীক্ষ্ন কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"দেখ, একজন ফাঁসির আসামীকেও চুড়ান্ত রায় শুনিয়ে দেয়ার আগে নিজের স্বপক্ষে কিছু বলার সুযোগ দেয়। তুমি আমাকে সেই সুযোগটাও কি দেবে না? প্লিজ শুধু একবার দেখা করো। এরপর যদি আর না চাও তো আমি আর কখনো তোমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো না।"
কয়েক সেকেন্ড পর জবাব আসে-
"ঠিক আছে। একবার দেখা করব। এরপর আর আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। বল কখন দেখা করবে?"
"এক্ষুনি।"
"আমার ক্লাস আছে। বিকেল চারটায় লা এরিস্টন ক্যাফে, মিরপুর।"
"ঠিক আছে।"
সাথে সাথেই কেটে দেয় স্নিগ্ধা।
সোহরাবের অফিস থেকে বেরিয়ে সজল নিজের অফিসে ফিরে আসে। মাকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে অর্ধেক দিন ছুটি নিয়ে নেয় সে। দুপুরে মিরপুরে একটি রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেয় সজল, এখানেই স্নিগ্ধার সাথে দেখা হওয়ার কথা। সজল বসে বসে ভাবতে থাকে কিভাবে স্নিগ্ধাকে মানাবে সে।
স্নিগ্ধা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে চারটা বাজে।
"কি খাবে বল? চা নাকি কফি?" সজল বলে।
"চা কিংবা কফি খাওয়ার জন্য আমি আসিনি। কি বলতে চাও বল।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই তোমার অভিযোগ কি, আর আমার অপরাধটাই বা কি?" সজল বলে।
"আমি তোমার সাথে তর্ক করতে আসিনি। যদি তোমার কিছু বলার থাকে তো বল, নাহলে আমি চললাম, আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা কোরো না।"
"পাঁচ বছরের সম্পর্ক আমাদের, এতো সহজে কি ভাঙা যায়? কোন কারণ নেই, ব্রেকআপ বললেই ব্রেকআপ হয়ে যায়?"
"তুমি একটা লম্পট, চরিত্রহীন, প্রতারক, ছোটলোক; এটা কি যথেষ্ট নয় ব্রেকআপ হওয়ার জন্য। যদি তুমি জানতে পারতে যে আমি তোমার মতো নষ্টামি করে বেড়াই, তবে কি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে? তোমরা পুরুষ বলে যা ইচ্ছা করে বেড়াবে তবুও তোমরা ধোয়া তুলসি পাতা? আমি মানিনা। আমি তোমার মতো লম্পটের সাথে কোন রিলেশন রাখতে চাইনা।" তীক্ষ্ন কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কে বলেছে আমি নষ্টামি করে বেড়াই? সোহরাব ভাই?"
স্নিগ্ধা কোন জবাব দেয়না।
সজল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে "সোহরাব ভাই অনেকটা ঠিকই বলেছে। একটা সময় আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক মেয়ের সাথেই আমার রিলেশন ছিল আমার। কিন্তু বিশ্বাস কর তোমার প্রেম আমাকে বদলে দিয়েছে। বিশ্বাস কর, তোমার সাথে রিলেশন হওয়ার পর আমি অন্য কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাইও নি।"
"মিথ্যা কথা। আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি অস্বীকার করতে পার, তুমি আমার সাথে রিলেশন রাখার পরও লিজা নামের মেয়েটির সর্বনাশ করোনি? মেয়েটির মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী। তুমি শুধু চরিত্রহীন, লম্পটই না, প্রতারক আর খুনিও।"
"বিশ্বাস কর, লিজা আমার শুধুই ছাত্রী ছিল। ওর সাথে আমার ওরকম কিছু ছিলনা। পুলিশ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য, কয়েকটা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেয়। যদি আমি দোষী হতাম তবে কি এখানে থাকতাম? হয় ফাঁসি হতো, নয় তো জেলে পচে মরতাম।"
"আমি বিশ্বাস করিনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"তাহলে কি বিশ্বাস করো? আমিই লিজার মৃত্যুর জন্য দায়ী? আচ্ছা মেনেই নিলাম। তাহলে তো আমার শাস্তি প্রাপ্য। বল কি শাস্তি হওয়া উচিত আমার? মৃত্যুদন্ড?" দাঁতে দাঁত চেপে প্রায় চেঁচিয়ে বলে সজল।
যদিও রেস্টুরেন্টটা প্রায় একেবারে ফাঁকা, তবুও সজলের প্রায় চেঁচিয়ে বলাতে আশেপাশের লোকজন ওদের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে।
"পাগলামী কোরোনা প্লিজ।" স্নিগ্ধা অনুরোধ করে বলে।
"পাগলামী কেন বলছ? আমি তো খুনি, আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আমি বেঁচে থাকলে লিজার আত্মা তো শান্তি পাবেনা। এই বিল্ডিং তো সাত তলা, প্রতি তলা বারো ফুট হলে চুরাশি ফুট, কংক্রিটের উপর পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা নেই।" বলে; তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে "ভাল থেকো, বিদায়।"
স্নিগ্ধা হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বলে "কি তামাশা করছো?"
"তোমার মনে হচ্ছে আমি তামাশা করছি? আমি সিরিয়াস না?"
"প্লিজ পাগলামি কোরোনা। তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার মায়ের কি হবে?"
"আমার মাকে নিয়ে চিন্তা হয় তোমার? মা অনেক আশা নিয়ে আছে তুমি ঘরের বউ হবে। যদি জানতে পারেন যে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেছে তাহলে কি হবে? আম্মার হার্টের যা কন্ডিশন তাতে তিনি মারাও যেতে পারেন।" মোক্ষম সময়ে তার ব্রহ্মাস্ত্র চালিয়ে দেয় সজল। ওর মাকে যে স্নিগ্ধার খুব মনে ধরেছে তা জানত সজল।
কিছুক্ষন নিরবতা চলে।
"কি হল কিছু বলছ না যে?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
"আমাকে ভাবতে দাও সজল, আমাকে কিছুদিন সময় দাও। এর মাঝে তুমি কোন পাগলামি কোরোনা প্লিজ।" শান্ত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।"
"না, আমি রিক্সায় যাব।" বলে উঠে বেরিয়ে যায় স্নিগ্ধা।