16-06-2021, 07:49 PM
শিরিন কবিরের ফোনটা কেটে দিয়ে জামানকে ফোন দেয়।
"হ্যালো, তুমি কোথায়?"
"এইতো, অফিস থেকে বের হয়েছি।" জামান জবাব দেয়।
"এতো দেরি হল কেন?"
"অফিসে অডিট আসবে কালকে। ফাইলপত্র গোছাতে গোছাতে দেরি হয়ে গেল।"
"ছেলেমেয়েদের টাকা পাঠিয়েছ?" শিরিন জিজ্ঞাসা করে।
"ওহো ভুলে গেছি, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
"সাবধানে এসো, রাখি।" বলে কেটে দেয় ফোন। তারপর বাংলা সিরিয়াল দেখতে বসে যায় শিরিন। জামানের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় নয়টা বেজে যায়।
"টাকা পাঠিয়েছ?" শিরিন জিজ্ঞাসা করে।
"এইতো পাঠালাম?" জামান বেডের উপর বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে জবাব দেয়।
"কতো পাঠালে?"
"দুজনকেই আট হাজার টাকা।"
"ভাল করেছ। আমি খাবার গরম করতে দেই?" শিরিন বলে।
"এতো তাড়াতাড়ি খাব না। তুমি একটু বসতো।" বলে শিরিনের পাশে বসে জামান।
"স্নিগ্ধা পড়তে ঢাকা চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িটা এখন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তাই না শিরিন?" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে জামান।
"তোমার আর কি! তুমি তো সারাদিন অফিসেই থাক। আমার দিন কিভাবে কাটে সে খবর রাখো? কতোবার তোমাকে বলেছি ঢাকায় ট্রান্সফার হতে। তুমি আমার একটা কথাও শোন না।" অভিযোগের সুরে বলে শিরিন।
"আমি কি চেষ্টা কম করেছি নাকি? অনভিজ্ঞ কাউকে ফ্যাক্টরির দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেনা কোম্পানি।" একটু থেমে স্ত্রীর কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলে "তার চেয়ে চলনা একটা বাচ্চা নেই। তোমার সময় তো কাটবে।"
"তোমার কি ভীমরতি হল নাকি? কয়েকদিন পর মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, নাতি নাতনি হবে আর তুমি কিনা এই বুড়ো বয়সে বাচ্চা নেয়ার কথা বল?"
"আমি না হয় বুড়ো হয়ে গেছি কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরিয়ে তোমাকে চব্বিশ পঁচিশের তরুনি হিসাবে চালিয়ে দেয়া যাবে।" বলতে বলতে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয় স্ত্রীকে।
"ছাড়ো তো, আমি আর পঁচিশের তরুনি নেই। আমার বয়স চল্লিশ আর তোমার সাতচল্লিশ, এই বয়সে এতো রোমান্টিক হওয়া ভাল না।" বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় শিরিন।
"তবে তুমি ঠিকই বলেছ, মেয়ে আমাদের বড় হয়ে গেছে।" বলে উঠে শোকেসের উপর থেকে স্নিগ্ধার বাঁধাই করা একটি ছবি এক হাতে নিয়ে অন্য হাত বুলাতে বুলাতে বলে "এই সেদিনই পিংক রংয়ের টেডিবিয়ারের বায়না ধরেছিল, আনতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে ঠোঁট ফুলিয়ে সে কি কান্না। আজ সেই মেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে! ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, কিছুদিন পর বিয়ে দিতে হবে, আমাদের ছেড়ে শশুরবাড়ি চলে যাবে, ঘরসংসার করবে। তার চেয়ে বরং এখন থেকেই ওকে ছাড়া থাকার অভ্যাস করো।"
"বিয়ে তো দেবই, কিন্তু বিয়ে দিলেই যে মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠাতে হবে তা কিন্তু না।"
"তারমানে ঘরজামাই রাখবে?"
"রাখলে দোষ কোথায়? দশটা নয় পাঁচটা নয় একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। আর আমি শুধু নিজের জন্যই বলছি না, মেসে থাকা কষ্টের। দুজনই একেবারে শুকিয়ে গেছে।" একটু থেমে শিরিন আবার যোগ করে "আমি বলি কি, দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেই। ওরা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাক।"
জামান কয়েক সেকেন্ড স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বোঝার চেষ্টা করে ঠাট্টা করছে কিনা। তবে শিরিনের মুখে ঠাট্টার কোন সংকেত পায়না।
"মানে তুমি বলতে চাইছো কবিরের সাথে..." বলতে গিয়ে থেমে যায় জামান।
"হ্যাঁ কবিরের সাথে বিয়ে দেব স্নিগ্ধাকে।" শিরিন বলে।
"তা কি হয়?"
"কেন? তোমার কি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ ব্যারিস্টার জামাই ছাড়া চলবে না?"
"সব বাবা মাই চায় মেয়েকে বড় ঘরে ও প্রতিষ্ঠিত জামাইয়ের হাতে তুলে দিতে।"
"চেনা নাই জানা শুধু বড় ঘর আর পেশা দেখেই মেয়ে যে কারো হাতে তুলে দেবে। এতিম ছেলেটি তো আমাদের কাছেই বড় হয়েছে। ওকে তো আমরা খুব ভাল করেই চিনি। আর কবিরই বা কম কিসের? ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভাল ছাত্র, অনার্সের পর ভাল চাকরি যোগাড় করে নেবে দেখো।" একটু থেমে আরো যোগ করে শিরিন "আর সবচেয়ে বড় কথা হল ওরা একে অপরকে ছেড়ে একটুও থাকতে পারে না। দেখলে না, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবার পরও তোমার মেয়ে এসে জাহাঙ্গিরনগর উনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেল, সে তো কবিরের জন্যেই।"
"আচ্ছা, ভেবে দেখব। এখন খাবার গরম করো, খিদে পেয়েছে।" জামান বলে।
শিরিন উঠে রান্না ঘরে চলে যায়।
"জরুরী কথা আছে বলে আমাকে ডেকে আনলি এখন কিছু বলছিসই না সেই কখন থেকে হেসেই চলেছিস!" অধৈর্য হয়ে বলে কবির।
স্নিগ্ধা কোনভাবে হাসি থামিয়ে বলে "আম্মুর না মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বলে কিনা তোকে আর আমাকে..." কথা শেষ করতে পারে না স্নিগ্ধা, হাসতে হাসতে আবারও সবুজ ঘাসে লুটিয়ে পড়ে।
"তুই হাসতেই থাক, তিনটা থেকে টিউশনি আছে, আমি গেলাম।" বলে কবির উঠে দাড়ায়।
"এখন তো কেবল বারোটা বাজে, একটু বস না।" বলে কবিরকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয় স্নিগ্ধা। তারপর আবার বলতে থাকে "যে কথা বলছিলাম, আম্মু বলে কিনা, তোকে আর আমাকে বিয়ে দেবে। বিয়ে করে যেন ঢাকাতেই একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাই।" বলে আবারও খিল খিল করে হাসতে থাকে স্নিগ্ধা।
কবির বুঝতে পারে যে তারও হাসিতে যোগ দেয়া উচিত, কিন্তু হাসির অভিনয় করা বেশ কঠিন, তার বদলে মুখে কৌতুকভাব টেনে এনে জিজ্ঞাসা করে "তুই কি বললি?"
"কি আবার বলব! রাজি হয়ে গেলাম।" বলে আবার খিলখিল করে হাসতে থাকে।
"চুপ! একদম ফাইজলামি করবি না!"
"কেন, আমি কি তোর স্ত্রী হওয়ার যোগ্য নই?" বলতে বলতে ওড়নাটাকে ঘোমটার মতো করে মাথায় দিয়ে বলে। তারপর আবার খিল খিল করে হাসতে থাকে। ওর হাসিটা অপুর্ব, হাসলে যেন ওর মুখ থেকে রুপালি আভা ছড়াতে থাকে। কবির কিছুক্ষন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, বুকের ভেতর যেন সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করে সে।
"কিরে, কি ভাবছিস?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে।
"ভাবছি, তোর বয়ফ্রেন্ডের বিষয়ে আন্টিকে কিছু জানাসনি?"
"না, জানাই নি।"
"এতোদিন ধরে প্রেম করছিস, একটুও সন্দেহ করেনি?"
"সন্দেহ যে করে নি তা নয়। প্রায় প্রতি রাতেই সজলের সাথে কথা বলতাম সেজন্যে আম্মু সন্দেহ করতো, মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমার মোবাইল ঘেঁটে দেখতো। তবে আম্মু চলে ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। সজলের নাম্বার ক্যাপিটালে কবির লিখে রেখেছিলাম।"
"তবে রে পাজি মেয়ে, সেই জন্যই তো উনি ভাবছেন তোর আর আমার মাঝে ইটিশ পিটিশ চলছে।" কবির বলে।
"ভাবলে ভাবতে দে, আমার তাতে কিছু যায় আসেনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"কিন্তু আমার অনেক কিছুই যায় আসে। আন্টিকে কবে সত্যিটা জানাবি বল।" কবির বলে।
"সত্যি তো জানিয়েছিই, বলেছি তোর আর আমার মধ্য ওরকম কিছু নেই।" স্নিগ্ধা বলে।
"বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে কবে বলবি?" কবির বলে।
"পরে বলব, এখন বললে আম্মু অযথাই টেনশন করবে।"
"আচ্ছা তুই বিয়ে করবি কবে?"
"অনার্স শেষ হবে, তারপর বিসিএস দেব, চাকরীতে ঢুকব, তারপর। সব মিলিয়ে আরো তো চার পাঁচ বছর লাগবে। কিন্তু তোর খবর বল, প্রোপোজ করার মতো কাউকে পেলি?"
"ধুর! ওসবের ভেতর আমি নেই।"
"তুই না বললি সেদিন?"
"এমনিই বলেছিলাম। আমি যাই, তুই থাক।" বলে উঠে দাড়ায় কবির।
"চল একসাথেই যাই।" বলে স্নিগ্ধাও উঠে দাড়ায়।
"তোর না ক্লাস আছে?"
"ক্লাস করতে ইচ্ছা করছে না আজ।"
স্নিগ্ধা ও কবির ক্যাম্পাসের গেট পেরিয়ে যেতেই সজলকে দেখতে পায় ওরা। সজল তার বাইকটাকে ওদের সামনে থামায়।
"স্নিগ্ধা ডার্লিং উঠে পড়।" সজল বলে।
"এই অবেলায় তুমি? তোমার অফিস নেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"আজকে ছুটি নিয়েছি।" সজল বলে।
"হঠাত ছুটি নিলে কেন?"
"চল যেতে যেতে বলছি।"
"আমি এখন কোথাও যাব না, সোজা বাসায় যাব।"
"তাহলে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।"
"প্রয়োজন নেই, আমি বাসেই যাব।"
"প্লিজ, জিদ কোরোনা।" সজল অনুরোধের সুরে বলে।
স্নিগ্ধা কবিরের উদ্দেশ্য বলে "তুই যা, আমি আসছি।" তারপর সজলের বাইকের পিছে ওঠে।
সজল তার বাইকটা তার এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড় করায়।
"আবারও এখানে। তোমার ফ্ল্যাটে আমি যাবনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে একটুও ছোঁবনা, প্লিজ চলনা।" অনুরোধের সুরে বলে সজল।
স্নিগ্ধা আর আপত্তি করেনা। সজল তার ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিং বেল বাজায়, প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে যায়। দরজার সামনে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা দাড়িয়ে আছে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে।
সজল পরিচয় করিয়ে দেয় "আমার মা, আর ও হচ্ছে স্নিগ্ধা, তোমার হবু পুত্রবধু।"
"দাড়িয়ে কেন ভেতরে আইসো মা, ভেতরে আইসো।" জাহিদা বেগম উচ্ছসিত কন্ঠে বলে। স্নিগ্ধার হাত ধরে নিয়ে যেয়ে সোফায় বসিয়ে দেয়। জাহিদা নিজেও পাসে বসে।
"সজল যখন তোমার ছবি দেখাইছিল আমার বিশ্বাসই হয়নি এমন পরীর মতন মেয়ে আমার ঘরের বউ হবে। এখন তো দেখছি শুধু পরী না, এ তো চাঁদের টুকরা!"
স্নিগ্ধা কিছু বলতে পারেনা, লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে।
"আমার অনেক সখ, ছেলেকে বিয়ে দেব, নাতী নাত্নির মুখ দেখব। সে ভাগ্য মনে হয় আল্লাহ দেয়নি।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে জাহিদা বেগম।
"ওভাবে বলছেন কেন মা?" প্রথম স্নিগ্ধা মুখ খোলে।
"কঠিন অসুখরে মা, বুকে প্রচন্ড ব্যাথা। ডাক্তার বলছে অপারেশন করতে। শুনছি সেই অপারেশন করলে খুব কমই বাঁচে।" জাহিদা বেগম বলে।
"স্নিগ্ধা, মাকে একটু বোঝাও তো। কতো মানুষ বায়োপসি করে সুস্থ্য হচ্ছে, এ নিয়ে এতো ভেঙে পড়লে চলে।" সজল বলে।
"খোদার উপর ভরসা রাখুন মা, আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ হবেন।"
"তোমার মুখে মা ডাক শুনে মনটা ভরে যাচ্ছে মা। তোমাদের বিয়েটা দেখে যেতে পারলেও শান্তি পেতাম।" জাহিদা বেগম বলেন।
"অতো যাওয়ার কথা বোলোনা তো। তোমাকে সহজে যেতে দিচ্ছিনা। এখন চলো একসাথে খাব। খিদে পেয়েছে।" সজল বলে।
"হ্যালো, তুমি কোথায়?"
"এইতো, অফিস থেকে বের হয়েছি।" জামান জবাব দেয়।
"এতো দেরি হল কেন?"
"অফিসে অডিট আসবে কালকে। ফাইলপত্র গোছাতে গোছাতে দেরি হয়ে গেল।"
"ছেলেমেয়েদের টাকা পাঠিয়েছ?" শিরিন জিজ্ঞাসা করে।
"ওহো ভুলে গেছি, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
"সাবধানে এসো, রাখি।" বলে কেটে দেয় ফোন। তারপর বাংলা সিরিয়াল দেখতে বসে যায় শিরিন। জামানের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় নয়টা বেজে যায়।
"টাকা পাঠিয়েছ?" শিরিন জিজ্ঞাসা করে।
"এইতো পাঠালাম?" জামান বেডের উপর বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে জবাব দেয়।
"কতো পাঠালে?"
"দুজনকেই আট হাজার টাকা।"
"ভাল করেছ। আমি খাবার গরম করতে দেই?" শিরিন বলে।
"এতো তাড়াতাড়ি খাব না। তুমি একটু বসতো।" বলে শিরিনের পাশে বসে জামান।
"স্নিগ্ধা পড়তে ঢাকা চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িটা এখন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তাই না শিরিন?" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে জামান।
"তোমার আর কি! তুমি তো সারাদিন অফিসেই থাক। আমার দিন কিভাবে কাটে সে খবর রাখো? কতোবার তোমাকে বলেছি ঢাকায় ট্রান্সফার হতে। তুমি আমার একটা কথাও শোন না।" অভিযোগের সুরে বলে শিরিন।
"আমি কি চেষ্টা কম করেছি নাকি? অনভিজ্ঞ কাউকে ফ্যাক্টরির দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেনা কোম্পানি।" একটু থেমে স্ত্রীর কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলে "তার চেয়ে চলনা একটা বাচ্চা নেই। তোমার সময় তো কাটবে।"
"তোমার কি ভীমরতি হল নাকি? কয়েকদিন পর মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, নাতি নাতনি হবে আর তুমি কিনা এই বুড়ো বয়সে বাচ্চা নেয়ার কথা বল?"
"আমি না হয় বুড়ো হয়ে গেছি কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরিয়ে তোমাকে চব্বিশ পঁচিশের তরুনি হিসাবে চালিয়ে দেয়া যাবে।" বলতে বলতে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয় স্ত্রীকে।
"ছাড়ো তো, আমি আর পঁচিশের তরুনি নেই। আমার বয়স চল্লিশ আর তোমার সাতচল্লিশ, এই বয়সে এতো রোমান্টিক হওয়া ভাল না।" বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় শিরিন।
"তবে তুমি ঠিকই বলেছ, মেয়ে আমাদের বড় হয়ে গেছে।" বলে উঠে শোকেসের উপর থেকে স্নিগ্ধার বাঁধাই করা একটি ছবি এক হাতে নিয়ে অন্য হাত বুলাতে বুলাতে বলে "এই সেদিনই পিংক রংয়ের টেডিবিয়ারের বায়না ধরেছিল, আনতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে ঠোঁট ফুলিয়ে সে কি কান্না। আজ সেই মেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে! ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, কিছুদিন পর বিয়ে দিতে হবে, আমাদের ছেড়ে শশুরবাড়ি চলে যাবে, ঘরসংসার করবে। তার চেয়ে বরং এখন থেকেই ওকে ছাড়া থাকার অভ্যাস করো।"
"বিয়ে তো দেবই, কিন্তু বিয়ে দিলেই যে মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠাতে হবে তা কিন্তু না।"
"তারমানে ঘরজামাই রাখবে?"
"রাখলে দোষ কোথায়? দশটা নয় পাঁচটা নয় একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। আর আমি শুধু নিজের জন্যই বলছি না, মেসে থাকা কষ্টের। দুজনই একেবারে শুকিয়ে গেছে।" একটু থেমে শিরিন আবার যোগ করে "আমি বলি কি, দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেই। ওরা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাক।"
জামান কয়েক সেকেন্ড স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বোঝার চেষ্টা করে ঠাট্টা করছে কিনা। তবে শিরিনের মুখে ঠাট্টার কোন সংকেত পায়না।
"মানে তুমি বলতে চাইছো কবিরের সাথে..." বলতে গিয়ে থেমে যায় জামান।
"হ্যাঁ কবিরের সাথে বিয়ে দেব স্নিগ্ধাকে।" শিরিন বলে।
"তা কি হয়?"
"কেন? তোমার কি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ ব্যারিস্টার জামাই ছাড়া চলবে না?"
"সব বাবা মাই চায় মেয়েকে বড় ঘরে ও প্রতিষ্ঠিত জামাইয়ের হাতে তুলে দিতে।"
"চেনা নাই জানা শুধু বড় ঘর আর পেশা দেখেই মেয়ে যে কারো হাতে তুলে দেবে। এতিম ছেলেটি তো আমাদের কাছেই বড় হয়েছে। ওকে তো আমরা খুব ভাল করেই চিনি। আর কবিরই বা কম কিসের? ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভাল ছাত্র, অনার্সের পর ভাল চাকরি যোগাড় করে নেবে দেখো।" একটু থেমে আরো যোগ করে শিরিন "আর সবচেয়ে বড় কথা হল ওরা একে অপরকে ছেড়ে একটুও থাকতে পারে না। দেখলে না, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবার পরও তোমার মেয়ে এসে জাহাঙ্গিরনগর উনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেল, সে তো কবিরের জন্যেই।"
"আচ্ছা, ভেবে দেখব। এখন খাবার গরম করো, খিদে পেয়েছে।" জামান বলে।
শিরিন উঠে রান্না ঘরে চলে যায়।
"জরুরী কথা আছে বলে আমাকে ডেকে আনলি এখন কিছু বলছিসই না সেই কখন থেকে হেসেই চলেছিস!" অধৈর্য হয়ে বলে কবির।
স্নিগ্ধা কোনভাবে হাসি থামিয়ে বলে "আম্মুর না মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বলে কিনা তোকে আর আমাকে..." কথা শেষ করতে পারে না স্নিগ্ধা, হাসতে হাসতে আবারও সবুজ ঘাসে লুটিয়ে পড়ে।
"তুই হাসতেই থাক, তিনটা থেকে টিউশনি আছে, আমি গেলাম।" বলে কবির উঠে দাড়ায়।
"এখন তো কেবল বারোটা বাজে, একটু বস না।" বলে কবিরকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয় স্নিগ্ধা। তারপর আবার বলতে থাকে "যে কথা বলছিলাম, আম্মু বলে কিনা, তোকে আর আমাকে বিয়ে দেবে। বিয়ে করে যেন ঢাকাতেই একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাই।" বলে আবারও খিল খিল করে হাসতে থাকে স্নিগ্ধা।
কবির বুঝতে পারে যে তারও হাসিতে যোগ দেয়া উচিত, কিন্তু হাসির অভিনয় করা বেশ কঠিন, তার বদলে মুখে কৌতুকভাব টেনে এনে জিজ্ঞাসা করে "তুই কি বললি?"
"কি আবার বলব! রাজি হয়ে গেলাম।" বলে আবার খিলখিল করে হাসতে থাকে।
"চুপ! একদম ফাইজলামি করবি না!"
"কেন, আমি কি তোর স্ত্রী হওয়ার যোগ্য নই?" বলতে বলতে ওড়নাটাকে ঘোমটার মতো করে মাথায় দিয়ে বলে। তারপর আবার খিল খিল করে হাসতে থাকে। ওর হাসিটা অপুর্ব, হাসলে যেন ওর মুখ থেকে রুপালি আভা ছড়াতে থাকে। কবির কিছুক্ষন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, বুকের ভেতর যেন সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করে সে।
"কিরে, কি ভাবছিস?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে।
"ভাবছি, তোর বয়ফ্রেন্ডের বিষয়ে আন্টিকে কিছু জানাসনি?"
"না, জানাই নি।"
"এতোদিন ধরে প্রেম করছিস, একটুও সন্দেহ করেনি?"
"সন্দেহ যে করে নি তা নয়। প্রায় প্রতি রাতেই সজলের সাথে কথা বলতাম সেজন্যে আম্মু সন্দেহ করতো, মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমার মোবাইল ঘেঁটে দেখতো। তবে আম্মু চলে ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। সজলের নাম্বার ক্যাপিটালে কবির লিখে রেখেছিলাম।"
"তবে রে পাজি মেয়ে, সেই জন্যই তো উনি ভাবছেন তোর আর আমার মাঝে ইটিশ পিটিশ চলছে।" কবির বলে।
"ভাবলে ভাবতে দে, আমার তাতে কিছু যায় আসেনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"কিন্তু আমার অনেক কিছুই যায় আসে। আন্টিকে কবে সত্যিটা জানাবি বল।" কবির বলে।
"সত্যি তো জানিয়েছিই, বলেছি তোর আর আমার মধ্য ওরকম কিছু নেই।" স্নিগ্ধা বলে।
"বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে কবে বলবি?" কবির বলে।
"পরে বলব, এখন বললে আম্মু অযথাই টেনশন করবে।"
"আচ্ছা তুই বিয়ে করবি কবে?"
"অনার্স শেষ হবে, তারপর বিসিএস দেব, চাকরীতে ঢুকব, তারপর। সব মিলিয়ে আরো তো চার পাঁচ বছর লাগবে। কিন্তু তোর খবর বল, প্রোপোজ করার মতো কাউকে পেলি?"
"ধুর! ওসবের ভেতর আমি নেই।"
"তুই না বললি সেদিন?"
"এমনিই বলেছিলাম। আমি যাই, তুই থাক।" বলে উঠে দাড়ায় কবির।
"চল একসাথেই যাই।" বলে স্নিগ্ধাও উঠে দাড়ায়।
"তোর না ক্লাস আছে?"
"ক্লাস করতে ইচ্ছা করছে না আজ।"
স্নিগ্ধা ও কবির ক্যাম্পাসের গেট পেরিয়ে যেতেই সজলকে দেখতে পায় ওরা। সজল তার বাইকটাকে ওদের সামনে থামায়।
"স্নিগ্ধা ডার্লিং উঠে পড়।" সজল বলে।
"এই অবেলায় তুমি? তোমার অফিস নেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"আজকে ছুটি নিয়েছি।" সজল বলে।
"হঠাত ছুটি নিলে কেন?"
"চল যেতে যেতে বলছি।"
"আমি এখন কোথাও যাব না, সোজা বাসায় যাব।"
"তাহলে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।"
"প্রয়োজন নেই, আমি বাসেই যাব।"
"প্লিজ, জিদ কোরোনা।" সজল অনুরোধের সুরে বলে।
স্নিগ্ধা কবিরের উদ্দেশ্য বলে "তুই যা, আমি আসছি।" তারপর সজলের বাইকের পিছে ওঠে।
সজল তার বাইকটা তার এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড় করায়।
"আবারও এখানে। তোমার ফ্ল্যাটে আমি যাবনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে একটুও ছোঁবনা, প্লিজ চলনা।" অনুরোধের সুরে বলে সজল।
স্নিগ্ধা আর আপত্তি করেনা। সজল তার ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিং বেল বাজায়, প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে যায়। দরজার সামনে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা দাড়িয়ে আছে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে।
সজল পরিচয় করিয়ে দেয় "আমার মা, আর ও হচ্ছে স্নিগ্ধা, তোমার হবু পুত্রবধু।"
"দাড়িয়ে কেন ভেতরে আইসো মা, ভেতরে আইসো।" জাহিদা বেগম উচ্ছসিত কন্ঠে বলে। স্নিগ্ধার হাত ধরে নিয়ে যেয়ে সোফায় বসিয়ে দেয়। জাহিদা নিজেও পাসে বসে।
"সজল যখন তোমার ছবি দেখাইছিল আমার বিশ্বাসই হয়নি এমন পরীর মতন মেয়ে আমার ঘরের বউ হবে। এখন তো দেখছি শুধু পরী না, এ তো চাঁদের টুকরা!"
স্নিগ্ধা কিছু বলতে পারেনা, লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে।
"আমার অনেক সখ, ছেলেকে বিয়ে দেব, নাতী নাত্নির মুখ দেখব। সে ভাগ্য মনে হয় আল্লাহ দেয়নি।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে জাহিদা বেগম।
"ওভাবে বলছেন কেন মা?" প্রথম স্নিগ্ধা মুখ খোলে।
"কঠিন অসুখরে মা, বুকে প্রচন্ড ব্যাথা। ডাক্তার বলছে অপারেশন করতে। শুনছি সেই অপারেশন করলে খুব কমই বাঁচে।" জাহিদা বেগম বলে।
"স্নিগ্ধা, মাকে একটু বোঝাও তো। কতো মানুষ বায়োপসি করে সুস্থ্য হচ্ছে, এ নিয়ে এতো ভেঙে পড়লে চলে।" সজল বলে।
"খোদার উপর ভরসা রাখুন মা, আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ হবেন।"
"তোমার মুখে মা ডাক শুনে মনটা ভরে যাচ্ছে মা। তোমাদের বিয়েটা দেখে যেতে পারলেও শান্তি পেতাম।" জাহিদা বেগম বলেন।
"অতো যাওয়ার কথা বোলোনা তো। তোমাকে সহজে যেতে দিচ্ছিনা। এখন চলো একসাথে খাব। খিদে পেয়েছে।" সজল বলে।