16-06-2021, 06:02 PM
পর্ব ৪।
_______________
পরপর তিন রাত টানা নিশিকান্ত জেগেই ছিল, তার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম ছিলও না। এই তিন দিন সে থানাতেও যায়নি আর ঘর থেকেও বেরোয়নি, শুধু সিগারেট খেয়ে গেছে আর চারটে মানুষের ফাইল খুঁটিনাটি ভাবে পরে গেছে। লালু যে নিশিকান্তের সঙ্গে প্রায় তার চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই আছে সেও তার বাবুর এইরকম থমথমে রূপ আগে দেখেনি, লালু বার দুয়েক চেষ্টা করেছিলো খাবার কথা বলতে কিন্তু নিশিকান্তের মুখ চোখ দেখে সে আর সাহস পায়নি। নিশিকান্তের ঘরটা ধোয়ায় একদম ভর্তি ছিল তবুও নিশিকান্তের কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না, সে নিজের মনেই বসে বসে একটা অঙ্ক মেলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো।
তবে অঙ্কটা খুবই দুষ্ট ছিল সেটা ধরা দিতে দিতেও যেন ধরা দিচ্ছিলো না, নিশিকান্ত এইবার আস্তে আস্তে বিরক্ত হয়ে উঠছিলো তবুও কোনও ভাবেই সে অঙ্কটাকে মেলাতে পারছিলো না। নিশিকান্ত অতীত অভিজ্ঞতায় জানতো যে বেশী জোরজার করলে হয়তো অঙ্কটা কোনভাবেই মিলবে না।
তাই বাধ্য হয়েই নিশিকান্ত ঘর থেকে বের হয় যাতে তার মাথায় একটু তাজা হাওয়া লাগে আর বুদ্ধিগুলো ভালো করে খেলতে পারে। লালু নিশিকান্ত কে বারান্দায় দাঁড়াতে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে কিছু দরকারে লাগতে পারে ভেবে , কিন্তু নিশিকান্ত লালুকে হাত তুলে নিরস্ত করে নিজের মনেই বারান্দায় দাড়িয়ে নানা কথা ভেবে যাচ্ছিলো।
আর উদাস চোখে দেখে যে একটা কুকুর কে কীভাবে দুটো কাক মিলে বোকা বানাচ্ছিলো, কুকুরটার সামনে একটা রুটি পড়েছিল আর কাক দুটোর খিদে পেয়েছিলো তবে কুকুরটার সামনে যাওয়া যাচ্ছিলো না গেলেই দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসছিলো। নিশিকান্ত মজার দৃষ্টিতেই দৃশ্যটা দেখছিলো, তখনই সে দেখে কাকগুলো একটু যেন অন্যভাবে তাদের প্ল্যান সাজালো। একটা কাক এইবার ক্রমাগত কুকুরটার মাথার উপরে উড়ে তাকে বিরক্ত করতে শুরু করলো আর আরেকটা কাক দুরে বসে দেখতে লাগলো, সেই কুকুরটা রেগে গিয়ে প্রথম কাকটাকে ধরার জন্য তেড়ে নিয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কাকটা এসে রুটির টুকরোটা মুখে নিয়ে উড়ে গেল।
কাক দুটোর এই বুদ্ধি দেখে নিশিকান্ত তিনদিন পরে খোলা মনে হো হো করে হেসে উঠে, হাসতে হাসতেই আচমকা একটা কি যেন তার মাথার ভেতরে ঝিলিক দিয়ে উঠে আর সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘরের ভিতরে গিয়ে ভৈরব হাজরার ফাইলটা নিয়ে একটা কিছু দেখেই নিজের ফোনটা তুলে সোজা সহায় সাহেব কে ফোন করে। কিন্তু সহায় সাহেব ফোনটা রিসিভ করে না। তাঁর মনের মধ্য যে সূত্রটার ঝলকানি সে দেখতে পেয়েছিল, সেটার প্রবল টানে তখন তাঁর মনের ছটফটানি এতটাই বেড়ে গেছিলো যে তাঁর আর ফোন করার তর সইলো না, তাই সে সোজা সহায় সাহেবের খোঁজে হাতে ফাইলগুলো নিয়ে সোজা উনার বাংলোর দিকে তার বুলেটটা হাওয়ার বেগে ছুটিয়ে দেয় তবে তার মন্দ ভাগ্য এখানেও তাকে তাড়া করে, কারন সহায় সাহেব ততক্ষণে অফিসের দিকে চলে গেছিলেন ।
নিশিকান্ত তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছে দেখে যে সহায় সাহেবের ঘরের সামনে দুটো সেন্ট্রি পাহারায় ছিল, তবে তাঁর মনের তখন যেরকম অবস্থা ছিল তাতে তার কোন ভাবেই আর দেরি সহ্য করার ক্ষমতা ছিলনা।
সেন্ট্রিরা তাঁকে সহায় সাহেবের কাছের লোক বলে ভালো ভাবেই চিনতেন , তাই তারা ভালভাবেই তাকে বলে যে সার মিটিঙে ব্যস্ত আছেন '' আপনি প্লিস একটু অপেক্ষা করুন '' কিন্তু নিশিকান্ত এই সামান্য কথাতেই তার মেজাজ হারিয়ে ফেলে আর চিৎকার করেই বলে ''আমি এখনই সহায় সাহেবের সঙ্গে দেখা করবো, পারলে আটকে দেখাও'' বলেই ওই সেন্ট্রিদের প্রায় ধাক্কা দিয়েই সে সহায় সাহেবের ঘরে ঢুকে যায়।
সহায় সাহেব বাইরের চিৎকার চেঁচামিচির আওয়াজ ভালো ভাবেই পাচ্ছিলেন এইবার চোখে বিরক্তি নিয়ে তিনি দেখেন যে নিশিকান্ত তিন চারদিনের না কামানো দাড়ি নিয়ে, ঘরের নোংরা পাজামা পাঞ্জাবি পরে হাতে ফাইলের স্তূপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাঁর যে চোখের নাম শুনলে বড়বড় অপরাধীরা প্যান্টে পেচ্ছাব করে ফেলে, সেই দুটো বাঘের মত চোখে এখন একটা বাচ্চা ছেলের মত উত্তেজনা আর অস্থিরতা। সহায় সাহেব যতই নিশিকান্তকে ভালবাসুক তাঁর কাজ পাগলামির জন্য, তবে অফিসের একটা ডেকোরাম বলে ব্যাপার ছিল, তাঁর নিজস্ব সম্মানের ব্যাপার ছিল। সেখানে এই রকম অবাধ্যতা তিনি মানতে পারেন না।
তাই তিনি এইবার একটু রেগেই নিশিকান্তকে বলে '' নিশিকান্ত এটা কি হচ্ছে? তুমি কি দেখছ না যে আমি একটা জরুরী মিটিঙে কতটা ব্যাস্ত আছি?''
নিশিকান্ত উত্তেজনার চোটে খেয়ালই করেনি যে সহায় সাহেব কতটা বিরক্ত হয়ে তাকে ''নিশি'' না বলে নিশিকান্ত বলে সম্বোধন করলো, নিশিকান্ত তড়বড় তড়বড় করে বলে '' সার আমি কেসটায় একটা ব্রেক থ্রু মনে হয় পেয়ে গেছি, আপনি প্লিস একটু সময় দেন তাথলে আমি... '' বলতে বলতেই সে সহায় সাহেবের হাতের ইশারায় থেমে যায়।
সহায় সাহেব এইবার তার ভরাট গলায় বলে '' সরি নিশিকান্ত আমি আর কেসটা পুরোপুরি তোমার কাছে রাখতে পারিনি, এটা জানাতে আমি তোমাকে গত তিন দিনে অন্তত বার কুড়ি ফোনও করেছি তবে তোমার ফোন সুইচ অফ ছিল, এমনকি আমি তোমার বাড়ীতে চারবার লোক ও পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি এত ব্যস্ত ছিলে যে তাঁদের সঙ্গে দেখা করার সময় পর্যন্ত ছিল না তোমার কাছে। আমাকেও উপরে জবাবদিহি করতে হয় মিঃ ঘোষ। তাই বাধ্য হয়েই ওপরমহল থেকে যে অর্ডার ছিল এই কেসে আই বির অফিসারের হাতে সপে দেবার আমি সেটা মেনে নিয়েছি । কারন মাস পাঁচেক সময় পেয়েও তুমি আমাকে কোন ফ্রুটফুল রেজাল্ট দিয়ে উঠতে পারোনি। তাই তুমি এইবার এই কেসে শুধু ওই অফিসারকে সাহায্য করবে, নাউ লেট মি ইন্ট্রডিউস ইউ তো মিস শালিনী শর্মা। এই কেসের আমাদের নতুন ইনভেস্টিগেটিং অফিসার''
নিশিকান্ত তার আঘাত তখনো ভালো করে সামলাতে পারেনি তারই মধ্য সে চোখ তুলে দেখলো সহায় সাহেবের পাশেই একটি ফর্সা, ছোট চুলের মহিলা বসে রয়েছেন। তবে তাকে চট করে কেউই মহিলা হয়তো ভাবতে পারবেনা কারন তার পোশাক আশাক থেকে শুরু করে হাবভাব সবই পুরুষ মানুষের মত,
শুধু তাঁর চাবুকের মত শরীরটা স্পষ্ট করে যে তিনি মহিলা আর যৌবনবতী মহিলা । নিশিকান্ত শুধু একটা জিনিষ লক্ষ্য করলো যে সহায় সাহেব যখন তাকে শালিনী শর্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো , তখন শালিনী শর্মার চোখে একটা উপেক্ষা ছাড়া কিছুই ছিল না।
হতাশ নিশিকান্ত ঠিকই বুঝেছিল যে ডিপার্টমেন্ট চোখে এখন তিনি ল্যাংড়া ঘোড়া, তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সহায় সাহেব কে একটা স্যালুট দিয়ে থমথমে মুখে মাথা নামিয়ে বেরিয়ে গেল । লালু অবাক হয়ে দেখে যে তার বাবু সেদিন সকালে ফিরে কেমন গুম হয়ে বসেছিলো, তার থমথমে মুখ যেন একটা ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিলো। সহায় সাহেবের অফিস থেকে ফিরে নিশিকান্ত ঠাই তার বারান্দায় বসে ছিল, লালু বারদুয়েক খাবার কথা বলতে এসেও সাহস পায়নি।
বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো তখনো যখন বাবু উঠলো না লালুর পক্ষে আর সহ্য হল না। কারন বাবুই তাঁর সবকিছু, লালুর নিজের সংসার বলতে কিছুই নেই আর করার কোন ইচ্ছেও নেই। তাঁর বাঁচা মড়া, সুখ দুঃখ সবটাই বাবু কে ঘিরে । তাই চোখের সামনে সে এটা দেখতে পারবে না যে তাঁর টাইগারের মত বাবু এমনি ভাঙাচোরা হয়ে বসে থাকুক।
কপালে যাই থাকুক এটা ভেবে সে এবার সোজা নিশিকান্তের পেছনে দাড়িয়ে মৃদু গলায় ডাকে ''বাবু ঘরে চলুন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আপনি গত কদিন তো ভালো করে কিছু খাননি, এবার চলুন কিছু খেয়ে নেবেন''
লালুর ডাকে নিশিকান্ত যেন ঘুম থেকে উঠে আর ভারী গলায় একটু থেমে থেমে বলে '' যা আমার দেরাজ থেকে একটা ওল্ড মঙ্ক এর বোতল নিয়ে আয় তো, আর আমাকে একটু স্যালাড কেটে দিয়ে যা । পারলে একবার বাজার থেকে কিছু মাছ নিয়ে আয় যা ''
লালু আজ অব্দি কোনদিন তার মালিককে এই রকম মুডে মদ খেতে দেখেননি। তা ওল্ড মঙ্ক ! বাবু যখন জিতে আসে তখন তো বাবু ব্ল্যাক লেবেল ছাড়া অন্য বোতল ছুয়েও দেখে না, কিন্তু ওল্ড মঙ্ক মানে বাবুর কোথাও খুব লেগেছে। কারন লালু জানে এমন অনেক দিনের কথা যখন সারারাত বাবু ওল্ড মঙ্কে ডুবে থেকে, সকালে নিজের বমির ওপর জ্ঞ্যান ফিরে পেতেন। সে সব কষ্টের দিনের কথা বাবু আর সে দুজনেই পেছনে ফেলে এসেছে বহুবছর আগেই, তাহলে আজ আবার ওল্ড মঙ্ক কেন ? প্রশ্নটা সে নিজের মনেই করে, কারন বাবুর সামনে এ প্রশ্ন করার মত সাহস তাঁর আজও হয়ে উঠেনি। বাবু এখন অনেক্ষানি পাল্টে গেছেন, সে নিজেই দেখেছে যখন তার মালিক এখন মদ খায় তার অন্তত একদিন আগে থেকেই সব বন্দোবস্ত করতে আরম্ভ করে দেয়।
মালিকের শখের পাল্লায় পরে তাকেও তো কত ধরনের রান্না শিখতে হয়েছে, এইবার লালু বাজার যাওয়ার আগে ভুল করেই বলে ফেলে ''বাবু কিন্তু এখন তো ভেটকি মাছ পাবো না''।
এই সামান্য কথার প্রতিক্রিয়া যে এমন হবে লালু তা আগে জানলে হয়তো কথাটা স্বপ্নেও কোনদিন বলতো না, ভেটকি মাছের কথায় নিশিকান্ত যেন একটা ঝটকা খেয়ে উঠে আর লালুর সামনে দাড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে হিমশীতল গলায় বলে '' তুইও কি আমাকে নিয়ে মজা করছিস নাকি রে? মজা আমি করতে পছন্দ করি, মজার পাত্র হতে নয় সেটা তো তুই ভালো করেই জানিস লালু, যা বাজার যা'' ।
লালু আর একদণ্ড না দাড়িয়ে সোজা বাজারের দিকে ছুটতে আরম্ভ করে, পথে যেতে যেতে অনেক পুরনো কথা তার মনে পরে। লালু তখন একদম বাচ্চা ছেলে ছিল , অনাথ । তবুও খারাপ সঙ্গে পরে একটা মার্ডার কেসে ফেঁসে গেছিলো আর নিশিকান্তই সেই কেসটার ইনচার্জ ছিল। সে নিজের চোখে দেখেছিলো তাঁর বাবুর দাপট সেবার প্রথমবারের মত । তাঁর আগে সে নিশিকান্ত ঘোষের নাম অব্দি শোনে নি ।
তাদের দলের সর্দার ছিল একটা নেতার চামচা আর তার দাপটে তখন গোটা দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলা কাঁপত, সেই সর্দারকে নিশিকান্ত পুছতাছ করতে গেছিলো ওই কেসটা নিয়ে। কারন সর্দার নিজের হাতে কোন কেস তো করতো না, তাঁর জন্য বিভিন্ন দল রাখা ছিল। আর সেরকমই একটা দলের সদস্য ছিল লালু। সর্দার পাল্টে নিশিকান্ত কে মন্ত্রীর নাম দিয়ে অল্প চমকাতে গেছিলো আর সেই চমকানোর ফল লালু একাই নয়, গোটা বাজার সেদিন দেখেছিল । সবাই অবাক হয়ে দেখেছিল যে সর্দার কে কেমন কুকুরের মত বাজারের মধ্য মারতে মারতে নিয়ে এসেছিলো নিশিকান্ত ঘোষ । নিজের বেল্টের দাগ যতক্ষণ না নিশিকান্ত সর্দারের গোটা পিঠে এঁকে দিয়েছিলো ততক্ষণ সে থামে নি। বাচ্চা লালু এটাও দেখেছিলো যে সেই নেতা যার দমে তাদের সর্দার তড়পাতো,তাকে তার ঘরে ঢুকে কীভাবে মুখের ভিতরে পিস্তল ভরে নিশিকান্ত বাবু চমকে এসেছিলো লালু আর তাদের পুরো দলবলের সামনে একাই বিনা ইউনিফর্মে।
তাঁর ফল ফলেছিল দুদিনের মধ্যই নিশিকান্ত ঘোষের ট্রান্সফারের অর্ডারে, কিন্তু সেদিন থেকেই লালু মনে মনে তাঁর বাবু কে টাইগার বলেই সম্বোধন করে। নিজের গোটা জীবনটা সে বাবুর পায়েই উৎসর্গ করে দিয়েছিল । লালু এটা ভালো করেই জানে তার বাবুকে যদি কেউ অসম্মান করে তবে বাবু ক্ষেপে যায় আর তখন উনি সবই করতে পারেন সব! কারন বাবুর জীবনে খুব সোজা সরল নিয়ম '' ইট মারলে পাটকেল, পাটকেল মারলে দানা '' !
ধৃতরাষ্ট্র - দা বস !