17-05-2021, 10:00 PM
২
ক্লাস করে সোজা বাড়ি আসে বাবাই. মা বলে দিয়েছে. কারোর সাথে কোথাও চলে না যেতে. আকুল শেষে সোজা বাড়ি ফিরতে. আর কারোর হাত থেকে কিছু না নিতে. আসলে বাবাই এখনো ছোট. এই সেদিন অব্দি ওর মাই কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো ওর জন্য. অন্যান্য মায়েদের সাথে গল্প করতো. কিন্তু এই কিছুদিন হলো ওনার শাশুড়ি মায়ের খুব শরীর খারাপ. তাই অনিল বাবু অর্থাৎ বাবাইয়ের বাবা বলেছে মাকে ছেড়ে না যেতে. ছেলে বড়ো হচ্ছে... একাই ফিরে আসতে পারবে.
অনিল বাবু ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল - কি বাবাই.... একা পারবিনা ফিরতে?
মাথা পুরো ওপর নিচে নাড়িয়ে বাবাই বলেছিলো - হ্যা রাস্তা আমার মুখস্ত হয়ে গেছে.
সেই চেনা রাস্তা ধরেই এখন সে বাড়ি ফেরে. প্রায় একাই. কারণ মৈনাক, কুন্তল, আবিরের বাড়ি উল্টো দিকে. তাই ওদের সাথে আর ফেরার পথে গল্প হয়না. শুরুতে বাচ্চা ছেলেটার ভয় ভয় করতো কিন্তু পরে অভ্যাস হয়ে গেলো. প্রথম দিন ফিরেই আনন্দে ঠাম্মির কাছে গিয়ে বলেছিলো - ঠাম্মি... দেখো আজ নিজে একা ফিরেছি!!
ঠাম্মি আনন্দে নাতিকে জড়িয়ে বলেছিলেন - আমার সোনা বাবা..... এইতো কত বড়ো হয়ে গেছো....দেখেছো বৌমা?
সুপ্রিয়া অর্থাৎ বাবাইয়ের মা ছেলের ব্যাগ হাতে নিয়ে মুচকি হেসে ছেলের গাল টিপে দিয়েছিলো.
সেই বাবাই আজও একা ফিরছে. সোজা পাকা রাস্তা ছেড়ে একটা গলি ধরলো. ওর বাড়ি এই গলি ধরে গিয়ে ডান দিকে একটা পুকুর পার করে শেষ একতলা বাড়ি. বাড়িটার পেছনে নারকেল গাছের সারি আর কিছুটা দূরে একটা ভাঙা দোতলা পোড়ো বাড়ি. বাবাই জীবনে ওই বাড়ির দিকে যায়নি. শুধু ছাদ দিয়ে দেখে. ওর আবার ভুতের ভয়ানক ভয়.
গলি ধরে পুকুর পেরিয়ে বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকে বেল বাজালো বাবাই. উফফফফ পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে বেল টিপতে হয়. বেল টেপার কিছু পরে দরজা খুলে দিলো মা.
আয়.... বলে মা সরে দাঁড়ালো. বাবাই ঢুকলো. মা দরজা দিয়ে দিলো. ছেলের থেকে ব্যাগ নিয়ে বললো - যা...... জামা প্যান্ট খুলে হাত পা ধুয়ে আয়... আমি খেতে দিচ্ছি.
বাবাই একবার ঘুরে মাকে দেখলো. মা ব্যাগ নিয়ে ওর পেছনেই আসছে. একবার ভাবলো মাকে বলবে আজ যা হয়েছে... কিন্তু.... কিন্তু......
কিরে? দাঁড়িয়ে পড়লি?... মা জিজ্ঞেস করলো.
হ্যা মা যাচ্ছি.
হাত পা মুখ ধুয়ে বাড়ির স্যান্ডো গেঞ্জি আর প্যান্ট পড়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলো ও. মা ওর সামনে খাবারের থালা আর মাছের প্লেট রেখে একবার শাশুড়ির ঘরে গেলো. বাবাই শুনলো ওর মা বলছে - হ্যা মা ও ফিরলো..... খেতে দিলাম... আপনি ঘুমোন মা.
বাবাই খেতে লাগলো. মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্না.
কিরে পারবি বাছতে? নাকি আমি করে দি দে. এইবলে একটা মাছ নিয়ে সুপ্রিয়া ওটা ভেঙে ভেতর থেকে মাছের কাঁটা বের করে থালার পাশে রাখতে লাগলো.
নে এবারে খা.... এই বলে মা পাশের চেয়ারে বসলো. বাবাইকে খেতে দিয়ে বিশেষ করে মাছ রান্না হলে ছেলের খাওয়া হওয়া পর্যন্ত ওর মা ওখানেই থাকে. খাওয়া হয়ে গেলে তারপরে থালা নিয়ে যান. কারণ ছোটবেলায় বাবাইয়ের গলায় বড়ো কাঁটা আটকে সে যে কি বিশ্রী ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়েছিল. তাই মায়ের মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে. বাবাই খেতে লাগলো.
মা - তোর ক্লাস ঠিক মতো চলছে তো বাবু?
হ্যা মা.
মন দিয়ে অংক টা বুজছিস তো? আগের বারের মতো হবে না তো?
না মা..... স্যার আমাদের ধরে ধরে করান. এই স্যারটা আগের বিক্রম স্যারের থেকে অনেক ভালো.
যাক ভালো তাহলে. মন দিয়ে ওটা কর... বাকি গুলোতে তোকে নিয়ে চিন্তা নেই.
হুমম মা.....
সন্ধেবেলা বাবা ফিরে এলো. ঠাম্মিও ঘুম থেকে উঠে নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছে. বৌমাই চালিয়ে দিয়েছে. প্রায় ফোকলা মুখে ঠোঁট নাড়তে নাড়তে টিভি দেখছেন উনি. পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো বাবাই. ঠাম্মার পাশে গিয়ে বসে রিমোট নিয়ে কার্টুন চালিয়ে দিলো. ঠাম্মি এসব বোঝেনা কিন্তু মাঝে মাঝে নাতির সাথে তিনিও দেখেন.
কিরে? আবার ঠাম্মার ঘরে ঢুকে কার্টুন চালিয়ে দিয়েছিস? উফফফ পারিনা তোকে নিয়ে.... যা না বাবা পড়তে বসে একটু.
থাকনা বৌমা..... দেখুক একটু. সারাদিনই তো পড়া পড়া পড়া..... একটু দেখতে দাও তো.
মা.... আপনার জন্যই বিগরোচ্ছে বাবাই. 10 মিনিট... ব্যাস.... তারপর সোজা টেবিলে গিয়ে পড়তে বসবি.... আমি দেখবো.... মা... আপনার চা....
ওদিকে অনিল বাবুর অভ্যেস ফিরে স্নান করতেই হবে ওনাকে. উনি স্নান করে টাওয়াল জড়িয়ে বেরিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে পড়লেন ধপাস করে. মোটা শরীর তাই অনেকটা জায়গা নিয়ে বসলেন.
দাও দাও চা দাও... উফফফফ যা কাজের চাপ যাচ্ছে না...... উফফফ....
বাবাইয়ের মা রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন. একটু পরে চা এনে স্বামীকে দিয়ে নিজেও একটা চায়ের কাপ নিয়ে ছেলের পাশে বোসলেন.
কিছুক্ষন পারিবারিক গল্প টিভি দেখা হচ্ছিলো এমন সময় ঠাম্মির কাঁশি শুরু হলো. সেই খ্যাক খ্যাক কাঁশি. সুপ্রিয়া শাশুড়ির সেবায় আবার ব্যাস্ত হয়ে গেলেন.
রাতে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সুপ্রিয়া একবার স্বামীর দিকে তাকালো. লোকটা চোখে চশমা পড়ে সেই যে অফিসের কাগজ নিয়ে বসেছে এখন শুতে এসেও সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন.
উফফফফফ... এবার ওগুলো রাখোনা. হালকা রাগী গলায় বললেন বাবাইয়ের মা.
হুমমম... এই আরেকটু.....
আর না..... উফফফফ মাইনে পাও তো ওই.... তাতেই যা কাজের নমুনা দেখাও যেন তুমিই বস. এদিকে মাইনে তো আর বাড়ে না ...রাখো....
তারপরে নিজেই একটু শান্ত কণ্ঠে ছেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন - ওতো নজর কাজের সাথে নিজের বৌ ছেলে আর নিজের মায়ের দিকেও তো দিতে পারো. সারাদিনই তো অফিসে বসে থাকো.
কাজে পাগলা হয়ে থাকি সুপ্রিয়া....আর তাছাড়া ওদের জন্য তুমি তো আছো...... ছেলেকে, মাকে ভালোই তো দেখছো...তাইতো আমার কাজেই ডুবে থাকতে পারি. তুমি তো জানো আমি..
থাক.... আর বলতে হবেনা... সেটা বিয়ের পর থেকেই দেখছি. তারপরে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো - আমি তো সব খেয়াল রাখছি.... তুমি তো কোনো খেয়ালই রাখছোনা.
অফিসের কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই বাবাইয়ের বাবা জিজ্ঞেস করলেন - মানে?
সুপ্রিয়া নিজের মুখের সামনে আসা অবাদ্ধ চুল গুলে সরিয়ে বললেন - আমি কেন সব বলবো...? নিজেই ভাবো?
এই শোনো... এই চাপের মধ্যে আর চাপ বাড়িওনাতো..... একেই ওই বস দুটো বাড়তি ফাইল আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো.... নেহাত একটা প্রমোশান হতে পারে বলে সব সহ্য করে যাচ্ছি... এর মধ্যে আর কুইজ আরম্ভ করোনা. আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি. তুমি ওকে ঘুম পারাও.....
বাবাইয়ের বাবা সব ফাইল কাগজ নিয়ে চলে গেলেন. ববাবাই এর মা স্বামীর চলে যাওয়া দেখলো. তারপরে তার চোখ গেলো একটু আগে যেখানে বাবাইয়ের বাবা বসে ছিলেন. এখন স্থানটা শুন্য. শেষে সুপ্রিয়া একবার দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে তাকালো. বিয়ের পর পরই ওটা তোলা. একটা নিঃস্বাস ছাড়লো সুপ্রিয়া. তারপরে ছেলের পাশে শুয়ে হাত বোলাতে লাগলো ছেলের গায়ে. বাবাই ঘুমিয়ে পড়েছে কখন.
চলবে.......
ভালো লাগলে কমেন্ট করে জানাবেন বন্ধুরা.