08-05-2021, 04:48 AM
(This post was last modified: 08-05-2021, 04:50 AM by gamerboy. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
(ডাকটিকিট)
সাড়ে চার বছরের সম্পর্কে ইতি টেনে উদ্ভ্রান্ত পূজারিণী তখন বড়ানগরের ট্রেনে, এলোমেলো চুল উড়ছে; বছর খানেকের নির্ঘুম রাত আর চিন্তার প্রহরীরা কালশিটে এঁকেছে তার চোখের কোলে। যেই পূজারিণী, না সেজে-গুজে কোথাও যেত না আজ তাকে দেখলে কেউ চিনতেই পারবে না। এমন কোনও ছেলে ছিল না যে তার রূপে ঘায়েল হয়নি। সেই পূজারিণী কলেজ জীবন থেকেই ঋভু'র জন্য প্রায় একপ্রকার উন্মাদ, কি যে ছিলও ছেলেটির মধ্যে তা আজও পূজারিণী বুঝতে পারে নি। আর সেই সম্পর্কই পূজারিণী'র জীবনে কালবেলা ডাকলো!
অনেক চেষ্টা করেও পূজারিণী ঋভু'কে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধতে পারেনি। সে নাছোড়বান্দা, সে চলে যাবেই! অবশেষে বিদায়বেলায় পূজারিণী'র জন্য পড়ে থাকলো তিক্ত একটি বিবাহবিচ্ছেদ। অগত্যা রাজি হতেই হয় তাকে, অনেক অভিমান-রাগ একরাশ জল হয়ে তার দু-চোখ ভাসালেও; সে ঋভু'কে যেতে দেয়। কারণ, পূজারিণীর অনেক দেরি হলেও আজ সে বুঝেছে; মনের মানুষ হলেও তাকে জোর করে আটকে রাখা যায় না।
কোলে তখন সাত মাসের বিতান'কে নিয়ে আবারও এগিয়ে চলা এক অচেনা পৃথিবীর হাতছানি'তে। ঋভু অবশ্য খোরপোষ বাবদ কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলও কিন্তু কেন জানি না পূজারিণীর বড় ঘেন্না হচ্ছিল নিজের উপর, ঋভু'র উপর; হয়তো সমগ্র পরিস্থিতির উপর। যার কাছ থেকে ভালোবাসাটুকুই সে পেলো না, তার টাকা দিয়ে কীইবা হবে... বাচ্চার পুরো দায়ভার তখন পূজারিণীর উপর, ঋভু আদালতে একবার বলেও নি যে সে বাচ্চাটুকুর বাবা হিসেবে থাকতে চায় বা কেনই পূজারিণী তাদের ভালোবাসার শেষ চিহ্নের একা অংশীদার হবে; না সে কিছুই বলেনি! সে কতক্ষণে মুক্তি পাবে এই অপেক্ষায়...
মুক্তি অবশেষে... মুক্তি দিয়েও পূজারিণীর পায়ের তলাটুকু বড় অসাড়, বিশ্বাস গাছটা জড় থেকে উপড়ে গিয়েছে। একটা চাকরি জুটে গিয়েছে কোনমতে, তবে এই পৃথিবীর একাকীত্ব তাকে গ্রাস না করে। বিতানকে সে কিভাবে সকল উপেক্ষার থেকে সামলে রাখবে? বাবা-মা উভয় বড় জরুরী এই জীবনে। এই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ক্লান্ত চোখে ঘুম-পরীরা নেমে আসে। অচেনা এক স্পর্শ ঘুম ভাঙিয়ে দেয় পূজারিণীর।
"কিরে কেমন আছিস, একি অবস্থা তোর! বিয়ের পর থেকে কোথায় ছিলি, কোনও খবর নেই?"
স্মৃতি-মন্থন করেও চেনা মুখটার নাম উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে পূজারিণীর আর সেটা পূজারিণীর মুখ দেখে বুঝি বুঝতে কারুর খুব সমস্যা হতো না।
"আরে আমি উৎপল, মনে পড়েছে..."
নিছক লজ্জা আর আড়ষ্টতায় পূজারিণী বলে, "হ্যাঁ, পেরেছি..."
"তোর সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি; তাও এই লোকাল-ট্রেনে, এভাবে!"
"হ্যাঁ, আমিও..."
"তা, তুই এখানে। আরে এটা বুঝি তোর ছোট্ট বাবুটা, কি মিষ্টি রে, পুরো তোর মতন হয়েছে।"
পূজারিণীর ভাঙা কাঁচের পাঁজরে কেউ যেন আলতো করে আবার হাত রাখতে চাইছিল, কিন্তু সেও তো অনেক বছর আগের কথা। সেদিন সে উৎপলকে ফিরিয়ে দিয়েছিল মন-আঙিনা হতে। কিছু বলার মতো সঠিক কথা খুঁজে বলতে পারছিল না পূজারিণী...
"হ্যাঁ, আমার মতনই যেন হয়..." এটুকু বলেই পূজারিণী মুখটা ফিরিয়ে নেয়, না হলে তার চোখের নোনায় যেই ব্যথাগুলো লুকিয়ে আছে সেগুলো ধরা পরে যেত; আপন বলতে যে এইটুকুই তার আপন। তার একান্ত নিজের!
উৎপল হয়তো আঁচ করতে পারে, যেমন সেদিন পেরেছিল পূজারিণীর মনে, সে নেই। ঠিক যেমন আজ সে বুঝতে পারছে, তার পাশের সিটে বসে থাকা মানুষটি বুকের মাঝে একটা সুনামির অবস্থান।
"আমার থেকে লুকচ্ছিস, বলনা কি হয়েছে! আমি তো এতটাও পর হয়ে যায় নি যে কিছুই বলা যায় না?"
ট্রেনের দুর্বার গতি যেন পিস্টনের মতো হাপর চালায় পূজারিণী বুকে, একসময় কান্না আর বাক্যরা সন্ধি করে। তারা সবাই জানান দেয় উৎপলের জামার নীলচে সুতোয়, তারা সবাই স্বস্থি পায় অন্তত কাউকে বলতে পেরে সকল জমে থাকে কালো অভিমানগুলো।"
"এতকিছু হয়ে গেছে আর... এবার আর নয়, আমি তোকে আর হারিয়ে যেতে দেব না পূজারিণী..."
"কিন্তু আমিতো..."
"কোনও কিন্তু নয়, এখন চুপটি করে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমো.."
পূজারিণী ভাবতে থাকে এটা কি ঠিক হবে, আবার বিশ্বাস, মড়াগাছেও কি মায়া জোনাকি বাসা বাঁধে। সে উৎপলের কাঁধে মাথা রেখে এক অদ্ভুত দুনিয়ায় কথা ভাবতে থাকে।
অনাদিবাবুকে কেউ পছন্দ করতো না কলেজে কারণ তিনি দর্শনের ক্লাসে পড়াতেন কম, বিশ্লেষণ বেশি করতেন। আজ তার একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো, "দেখো জীবন একটা রহস্য, কেউ জানে না পরের মূহুর্তে কি আছে... তাই সাহস করে এগিয়ে যাও। আঁধার না পেরলে ঊষা'র সম্মুখীন হবে কি করে!"
পূজারিণীও বুঝি, সেইরূপ এক জীবন-জুয়ায় মেতেছে।
নীরবতা ভেঙে পূজারিণী জিজ্ঞেস করে, "তুই এখনোও ডাকটিকিট জমাস?"
"না..."
"কেন, তোর তো কত সুন্দর-সুন্দর সব ডাকটিকিট ছিলো.. খুব সযত্নে জমাতিস ওগুলো!"
"জমিয়ে কি করতাম বল, চিঠি লেখার মানুষটাই তো হারিয়ে গিয়েছিলো..."
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন পূজারিণীর, তাই সে হালকা সরে বসে উৎপলের থেকে। হয়তো এটাই নিয়তি, সে জানে? একসময় যেই ছেলেটা তার সকল ঘুম, সকল চিন্তায় তাকেই রেখেছিলো। তাকে সে কষ্ট দিয়েছে, গোলাপের আদর পেতে গেলে পূজারিণী'কে একটা-দুটো কাটার সম্মুখীন তো হতেই হবে, হতেই হয়।
উৎপল জবুথুবু পূজারিণী'কে কাছে টেনে নিয়ে তার দুচোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হেসে বলে, "এবার মনে হয় আবার জমানো শুরু করতে হবে।"
পূজারিণী ম্লান হেসে তার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বোজে। এখন শুধুই ট্রেনের বেমানান যান্ত্রিক "ঘটাং ঘটাং" শব্দ তুলে, রেল ছুটে চলেছে স্বপ্নের দিশায়। একটি জগত যেটা পূজারিণী আর বিতানের, একটি সুখের জগত...
সাড়ে চার বছরের সম্পর্কে ইতি টেনে উদ্ভ্রান্ত পূজারিণী তখন বড়ানগরের ট্রেনে, এলোমেলো চুল উড়ছে; বছর খানেকের নির্ঘুম রাত আর চিন্তার প্রহরীরা কালশিটে এঁকেছে তার চোখের কোলে। যেই পূজারিণী, না সেজে-গুজে কোথাও যেত না আজ তাকে দেখলে কেউ চিনতেই পারবে না। এমন কোনও ছেলে ছিল না যে তার রূপে ঘায়েল হয়নি। সেই পূজারিণী কলেজ জীবন থেকেই ঋভু'র জন্য প্রায় একপ্রকার উন্মাদ, কি যে ছিলও ছেলেটির মধ্যে তা আজও পূজারিণী বুঝতে পারে নি। আর সেই সম্পর্কই পূজারিণী'র জীবনে কালবেলা ডাকলো!
অনেক চেষ্টা করেও পূজারিণী ঋভু'কে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধতে পারেনি। সে নাছোড়বান্দা, সে চলে যাবেই! অবশেষে বিদায়বেলায় পূজারিণী'র জন্য পড়ে থাকলো তিক্ত একটি বিবাহবিচ্ছেদ। অগত্যা রাজি হতেই হয় তাকে, অনেক অভিমান-রাগ একরাশ জল হয়ে তার দু-চোখ ভাসালেও; সে ঋভু'কে যেতে দেয়। কারণ, পূজারিণীর অনেক দেরি হলেও আজ সে বুঝেছে; মনের মানুষ হলেও তাকে জোর করে আটকে রাখা যায় না।
কোলে তখন সাত মাসের বিতান'কে নিয়ে আবারও এগিয়ে চলা এক অচেনা পৃথিবীর হাতছানি'তে। ঋভু অবশ্য খোরপোষ বাবদ কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলও কিন্তু কেন জানি না পূজারিণীর বড় ঘেন্না হচ্ছিল নিজের উপর, ঋভু'র উপর; হয়তো সমগ্র পরিস্থিতির উপর। যার কাছ থেকে ভালোবাসাটুকুই সে পেলো না, তার টাকা দিয়ে কীইবা হবে... বাচ্চার পুরো দায়ভার তখন পূজারিণীর উপর, ঋভু আদালতে একবার বলেও নি যে সে বাচ্চাটুকুর বাবা হিসেবে থাকতে চায় বা কেনই পূজারিণী তাদের ভালোবাসার শেষ চিহ্নের একা অংশীদার হবে; না সে কিছুই বলেনি! সে কতক্ষণে মুক্তি পাবে এই অপেক্ষায়...
মুক্তি অবশেষে... মুক্তি দিয়েও পূজারিণীর পায়ের তলাটুকু বড় অসাড়, বিশ্বাস গাছটা জড় থেকে উপড়ে গিয়েছে। একটা চাকরি জুটে গিয়েছে কোনমতে, তবে এই পৃথিবীর একাকীত্ব তাকে গ্রাস না করে। বিতানকে সে কিভাবে সকল উপেক্ষার থেকে সামলে রাখবে? বাবা-মা উভয় বড় জরুরী এই জীবনে। এই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ক্লান্ত চোখে ঘুম-পরীরা নেমে আসে। অচেনা এক স্পর্শ ঘুম ভাঙিয়ে দেয় পূজারিণীর।
"কিরে কেমন আছিস, একি অবস্থা তোর! বিয়ের পর থেকে কোথায় ছিলি, কোনও খবর নেই?"
স্মৃতি-মন্থন করেও চেনা মুখটার নাম উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে পূজারিণীর আর সেটা পূজারিণীর মুখ দেখে বুঝি বুঝতে কারুর খুব সমস্যা হতো না।
"আরে আমি উৎপল, মনে পড়েছে..."
নিছক লজ্জা আর আড়ষ্টতায় পূজারিণী বলে, "হ্যাঁ, পেরেছি..."
"তোর সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি; তাও এই লোকাল-ট্রেনে, এভাবে!"
"হ্যাঁ, আমিও..."
"তা, তুই এখানে। আরে এটা বুঝি তোর ছোট্ট বাবুটা, কি মিষ্টি রে, পুরো তোর মতন হয়েছে।"
পূজারিণীর ভাঙা কাঁচের পাঁজরে কেউ যেন আলতো করে আবার হাত রাখতে চাইছিল, কিন্তু সেও তো অনেক বছর আগের কথা। সেদিন সে উৎপলকে ফিরিয়ে দিয়েছিল মন-আঙিনা হতে। কিছু বলার মতো সঠিক কথা খুঁজে বলতে পারছিল না পূজারিণী...
"হ্যাঁ, আমার মতনই যেন হয়..." এটুকু বলেই পূজারিণী মুখটা ফিরিয়ে নেয়, না হলে তার চোখের নোনায় যেই ব্যথাগুলো লুকিয়ে আছে সেগুলো ধরা পরে যেত; আপন বলতে যে এইটুকুই তার আপন। তার একান্ত নিজের!
উৎপল হয়তো আঁচ করতে পারে, যেমন সেদিন পেরেছিল পূজারিণীর মনে, সে নেই। ঠিক যেমন আজ সে বুঝতে পারছে, তার পাশের সিটে বসে থাকা মানুষটি বুকের মাঝে একটা সুনামির অবস্থান।
"আমার থেকে লুকচ্ছিস, বলনা কি হয়েছে! আমি তো এতটাও পর হয়ে যায় নি যে কিছুই বলা যায় না?"
ট্রেনের দুর্বার গতি যেন পিস্টনের মতো হাপর চালায় পূজারিণী বুকে, একসময় কান্না আর বাক্যরা সন্ধি করে। তারা সবাই জানান দেয় উৎপলের জামার নীলচে সুতোয়, তারা সবাই স্বস্থি পায় অন্তত কাউকে বলতে পেরে সকল জমে থাকে কালো অভিমানগুলো।"
"এতকিছু হয়ে গেছে আর... এবার আর নয়, আমি তোকে আর হারিয়ে যেতে দেব না পূজারিণী..."
"কিন্তু আমিতো..."
"কোনও কিন্তু নয়, এখন চুপটি করে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমো.."
পূজারিণী ভাবতে থাকে এটা কি ঠিক হবে, আবার বিশ্বাস, মড়াগাছেও কি মায়া জোনাকি বাসা বাঁধে। সে উৎপলের কাঁধে মাথা রেখে এক অদ্ভুত দুনিয়ায় কথা ভাবতে থাকে।
অনাদিবাবুকে কেউ পছন্দ করতো না কলেজে কারণ তিনি দর্শনের ক্লাসে পড়াতেন কম, বিশ্লেষণ বেশি করতেন। আজ তার একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো, "দেখো জীবন একটা রহস্য, কেউ জানে না পরের মূহুর্তে কি আছে... তাই সাহস করে এগিয়ে যাও। আঁধার না পেরলে ঊষা'র সম্মুখীন হবে কি করে!"
পূজারিণীও বুঝি, সেইরূপ এক জীবন-জুয়ায় মেতেছে।
নীরবতা ভেঙে পূজারিণী জিজ্ঞেস করে, "তুই এখনোও ডাকটিকিট জমাস?"
"না..."
"কেন, তোর তো কত সুন্দর-সুন্দর সব ডাকটিকিট ছিলো.. খুব সযত্নে জমাতিস ওগুলো!"
"জমিয়ে কি করতাম বল, চিঠি লেখার মানুষটাই তো হারিয়ে গিয়েছিলো..."
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন পূজারিণীর, তাই সে হালকা সরে বসে উৎপলের থেকে। হয়তো এটাই নিয়তি, সে জানে? একসময় যেই ছেলেটা তার সকল ঘুম, সকল চিন্তায় তাকেই রেখেছিলো। তাকে সে কষ্ট দিয়েছে, গোলাপের আদর পেতে গেলে পূজারিণী'কে একটা-দুটো কাটার সম্মুখীন তো হতেই হবে, হতেই হয়।
উৎপল জবুথুবু পূজারিণী'কে কাছে টেনে নিয়ে তার দুচোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হেসে বলে, "এবার মনে হয় আবার জমানো শুরু করতে হবে।"
পূজারিণী ম্লান হেসে তার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বোজে। এখন শুধুই ট্রেনের বেমানান যান্ত্রিক "ঘটাং ঘটাং" শব্দ তুলে, রেল ছুটে চলেছে স্বপ্নের দিশায়। একটি জগত যেটা পূজারিণী আর বিতানের, একটি সুখের জগত...