01-05-2021, 01:22 AM
-------------
দ্বৈত যুদ্ধের সময় বিশাল রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গনে অতুল জনসমাবেশ। মহারাজা ও মহারানী উপর থেকে যুদ্ধ দেখতে আগ্রহী। মহারানীর চোখে জলধারা। মহারাজা ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু কেন জানিনা আশার আলো কিছু টা হলেও দেখতে পাচ্ছেন উনি। যে ভাবে গত দুটি ভয়ঙ্কর বিপদ ভগবানের আশীর্বাদ এ টলে গেছিল। হয়ত এই বিপদ থেকেও মহারাজ উদ্ধার পাবেন। মহারানী কেদেই চলেছেন। নিজের প্রানপ্রিয় পুত্র কে হারানোর আশঙ্কায়। মৈথিলী প্রাঙ্গনের প্রান্তে যুবরাজের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে। নিজে যুবরাজের পিছনে এই জন্য দাঁড়িয়ে যাতে বিপদ বুঝলে শার্দূল কে বধ করতে সময় না যায়।ভানুপ্রতাপ মহারাজের পাশে স্মিত হাস্যে দাঁড়িয়ে। মৈথিলীর চোখ খুঁজছিল বালি কে। কিন্তু এই সবে বালির কোন উতসাহ নেই। প্রভুত পরিমান খাবার দাবার ওকে, ওর প্রিয় খেলা “যুদ্ধ” থেকেও সরিয়ে রাখে। খাবার পেলে ওর কোন কাণ্ড জ্ঞান থাকে না।
শার্দূল হাতের তরবারি নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকল যুবরাজের দিকে। মৈথিলী লক্ষ্য করছে যুবরাজ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে। বিশাল তলোয়ার টা মাটিতে স্পর্শ করিয়ে তলোয়ার টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে যুবরাজ নিশ্চল হয়ে। চোয়াল শক্ত হচ্ছে ততই যত শার্দূল মত্ত হস্তীর মতন এগিয়ে আসছে যুবরাজের দিকে। শার্দূল ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে এসে তলোয়ার চালাতেই যুবরাজ সরে গেলেন অত্যন্ত দ্রুত গতি তে। ঝুঁকে গেল শার্দূল অনেক টা সামনের দিকে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মৈথিলীর অভ্যস্ত হাত নিশপিশ করে উঠল। ঝুঁকে পরা শার্দূলের মোটা গর্দান টা যেন ডাকছিল মৈথিলী কে তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য। আর ঠিক তখনি যুবরাজ নিজের ভারি তলোয়ার টা ক্ষিপ্র গতিতে তুলে অত্যন্ত শিক্ষিত ভঙ্গী তে চালালেন শার্দূলের গলা লক্ষ্য করে……… ইশ!!!!!! বড্ড হাল্কা ভাবে নিয়েছিল শার্দূল, যুবরাজ কে।
মৈথিলীর সামনে পরে থাকা রক্ত মাখা কাটা মুণ্ডু টা মৈথিলী অনেকবার দেখল। বিশ্বাস হচ্ছিল না এটা শার্দূলের পরে থাকা কাটা মুণ্ডু। বার বার মৈথিলী দেখছিল পরে থাকা মুণ্ডু টা কে। সেদিনের বলা কাহিনীর সাথে আজ যুবরাজের যুদ্ধ……। মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল সুন্দরি মৈথিলীর। একবার, জন সাধারনের কাঁধে চড়ে থাকা যুবরাজের দিকে তাকিয়ে মৈথিলী চলে এলো প্রাসাদের অন্তঃপুর এ। আজকে তার বড় আনন্দের দিন। যুবরাজের মধ্যেকার যোদ্ধা টা বেড়িয়ে এসেছে সঠিক সময়েই।
আমি নিশ্চিত যে যুবরাজ তোমার প্রেমে পড়েছে জিষ্ণু”। মৈথিলী রুপী জিষ্ণু আর ভানু প্রতাপ কথোপকথনে রত ছিল ভানুপ্রতাপের প্রাসাদের পিছনে একটি মন্দিরের ভিতরে। লোকচক্ষুর আড়ালে এই ভাবে তারা প্রথম দেখা করল। উপরোক্ত কথা টা শুনেই মৈথিলী তাকিয়ে দেখল প্রাণপ্রিয় ভাই বালি দাঁড়িয়ে। মৈথিলী থাকতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে আলিঙ্গন করল নিজের দাদা কে। বালির অস্বস্তি হল কারন জীবনে কোন নারী কে আলিঙ্গন করে নি মাতা ছাড়া।
– উঁহু, তুমি আমাকে আলিঙ্গন কোর না ছোট কুমার। তুমি এখন ভাই নেই আমাদের। কোন এক অজানা নারী, হাহাহা।
– দাদা তুমি জ্বালিও না আমাকে। একে তো এই নারী বেশে আমার ভাল লাগছে না তারপরে তুমি এমনি করলে আমি কিন্তু যুবরাজ কে বলে দেব।
– হ্যাঁ তোমার যুবরাজ তো এখন তোমার কথায় আমার গর্দান ও নিতে পারে।
– হাহা, আমি আমার যুবরাজের কথা বলিনি আমি আমাদের যুবরাজের কথা বলেছি”। বলে মৈথিলী ভানুপ্রতাপ এর আলিঙ্গনে নিজেকে সপে দিল।
– উম্ম এতদিন পরে দেখা আর আমার আলিঙ্গনে নেই আমার ছোট্ট ভাই?
এমনি ভাবেই চলতে থাকল সেই সন্ধ্যে বেলায় তিন ভাই এর খুনসুটি।
রাত্রে মৈথিলী ছোট রাজকুমারের পাশেই শুয়েছিল। এটাই মহারানীর নির্দেশ ছিল। ছোটকুমার কে দ্বাদশ বর্ষ অব্দি একা শুতে দেওয়া যাবে না। একটা আওয়াজে মৈথিলী উঠে বসে দেখল পূর্ণিমার দিন চাঁদের আলোতে যুবরাজ দাঁড়িয়ে আছেন জানালার পাশেই। জিষ্ণুর নারী মন মৈথিলী রূপে যুবরাজের স্পর্শ পাবার জন্য ছটফট করছিল। শয্যা থেকে উঠে যুবরাজের পাশে দাঁড়াল মৈথিলী। ধিরে ধিরে পিছনে গিয়ে যুবরাজ কে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল মৈথিলী। যুবরাজ ঘুরে মৈথিলী কে বক্ষলগ্না করে প্রায় আঁকড়ে ধরলেন বলা চলে মৈথিলী কে। মৈথিলীর কেশ উন্মুক্ত করে ঘ্রান নিলেন যুবরাজ। মৈথিলীর কণ্ঠ দেশে গভীর চুম্বন আঁকলেন অনভ্যস্ত ভাবে। মৈথিলী হারিয়ে যাচ্ছিল যেন। এ যে ভোগ নয়, গভীর প্রেম – সেটা আবার ও বুঝল মৈথিলী। যুবরাজ অনুমতি নেবেন কিনা মৈথিলীর কাছে সেটা ভাবার আগেই মৈথিলী যেন পড়ে নিল যুবরাজের মানসিক ঝঞ্ঝা। যুবরাজের প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ফেলে বিড়বিড় করে বলে উঠল মৈথিলী – “ প্রেম এ অনুমতি লাগে না যুবরাজ, আমি শুধু আপনার, আর কারোর না”।
“আআহহহহহ” মৈথিলীর আর্ত চীৎকার যুবরাজের মনে কামনার আগুন জ্বালিয়ে দিল যেন। একটা মাখনের মতন শরীর কে মথিত করতে করতে, যুবরাজ আওয়াজ টা শুনতে পেলেন। নিজের বলশালী শিশ্ন মৈথিলীর গহ্বরে প্রবেশ করিয়ে যুবরাজ অপেক্ষা করলেন। নিজের বলশালী শরীরের নীচে মৈথিলীর ছটফটানি যেন যুবরাজ কে কামনার আগুনে অন্ধ করে দিলো। নিজের নারী কে ভোগের নেশায় পাগল হয়ে উঠলেন যুবরাজ। মৈথিলীর ফুলের পাপড়ির মতন নরম পিঠে কামনার কামড় বসালেন যুবরাজ। সহ্য করতে না পেরে মৈথিলী যুবরাজের বাহুতে আবদ্ধ নিজের হাতে শয্যার চাদর মুঠো করে ধরে ব্যাথা মিশ্রিত কামনার শীৎকার করে উঠল। প্রথম মিলন দুজনের ই। যুবরাজের যেন তর সইছে না। প্রথম মিলনেই যেন মৈথিলী কে সম্পূর্ন নিজের করে নেবার তাগিদ। মৈথিলীর আর্ত চিৎকার যুবরাজের গর্জনে অনেক আগেই চাপা পরে গিয়েছে…
রেড়ির তেলের আলোয় যুবরাজ দেখলেন যুবরাজের বক্ষলগ্না মৈথিলীর চোখে জল। মৈথিলী কে নিজের বক্ষে সজোরে আকর্ষন করে কাছে টেনে নিলএন যুবরাজ। জিজ্ঞাসা করলেন
– আমি কি তোমাকে জোর করে ভোগ করলাম মৈথিলী?
যুবরাজের বক্ষে স্থিত হয়েই, আনত চোখে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো মৈথিলী
– উঁহু
– তবে তুমি কাঁদছ যে?
যুবরাজ কে আরো সজোরে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই মৈথিলী উত্তর দিলো
– এ কান্না খুশীর যুবরাজ……
এদিকে অনেক দূরে বল্লভপুরের দেবতুল্য প্রাসাদে বসে আছেন ইন্দ্রজিৎ, ওর ভাই শত্রুজিৎ। মিত্র হংস। আর তাত রবিনন্দন। এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে রত সকলেই। বল্লভপুরের অজেয় সেনাবাহিনী কে উল্লম রাজ্যে আক্রমনের কথা পেরেছিলেন হংস। হংসের এই এক বড় বাজে স্বভাব। ভয়ঙ্কর বীর তিনি কোন সন্দেহই নেই তাতে। কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধা যুদ্ধ কে আহ্বান করেন না। এড়িয়েই চলেন। কিন্তু ইনি যুদ্ধ আহ্বান করতে বিশেষ আগ্রহী। জিষ্ণু নিহত অথবা নিখোঁজ এর পড়ে হংস সম বীর আর সত্যি করেই কেউ নেই, আর সেটা তিনি সর্ব সমুখে প্রমান না করে থাকতে পারছেন না।যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ বন্ধুর এই স্বভাব টি কে বিশেষ লালন পালন করেন। স্নেহ করেন বন্ধু কে বিশেষ। নিজের ভগিনী কনকমঞ্জরীর সাথে বিবাহ দিয়েছেন বন্ধু হংসের। এবং সেটা হংসের বীরত্বের জন্যই। জিষ্ণুর সাথে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করতে পারে এদের মধ্যে একমাত্র হংস ই। আর যুবরাজ সেই কারনেই হংসের ওপরে ভীষণ রকমের দুর্বল। যাই হোক এখন হংসের ইচ্ছে নিজের বীরত্ব দেখানোর সেটাও উল্লম রাজ্যের ওপরে। ওরা চারজনে যুক্তিতে মেতে ছিল কি ভাবে আক্রমন সাজানো যায় সেই ব্যাপারেই। শার্দূল কে নিয়ে বিশেষ ভাবনা চলছিল চারজনের মধ্যে।
ঠিক সেই সময়ে একজন গুপ্তচর এসে পাশে দাঁড়াতেই যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ ইশারায় জানতে চাইলেন সংবাদ।
– যুবরাজ একটি খবর আছে। ভাল বা খারাপ সেটা যুবরাজের বিচারাধীন।
– বল কি খবর?
– যুবরাজ উল্লম রাজ্যের মহাসেনাপতির পতন হয়েছে। যুবরাজ বিজয় ওনার মাথা দেহ থেকে আলাদা করে দিয়েছেন গত কাল সকালে দ্বৈত যুদ্ধে। আর একটি খবর হল তোমর রাজ্যের রাজা উল্লম দেশ আক্রমন তো করেছিলেন কিন্তু নীল নামে একটি স্থানীয় বীরের বীরত্বে তোমর রাজা পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছেন”। এই কথা বলার পরে চর টি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করল দুজনের দ্বৈত যুদ্ধ।
এই সংবাদের হয়ত কোন মুল্য ছিল না তেমন কিন্তু যাকে নিয়ে আলোচনা তার মৃত্যুর খবরে সবাই একটু চমকাল বইকি। আর খবরের মধ্যে চমক ও ছিল। কারন জতদুর খবর তাতে যুবরাজের বয়স অষ্টাদশ বৎসর মাত্র। এই বয়সেই শার্দূলের মতন এক ভয়ানক বীর কে দ্বিখণ্ডিত করা মুখের কথা নয়। বরং একটু অবাস্তব ই। যুবরাজ ইন্দ্রজিতের যেন মনে পড়ে গেল আজ থেকে বেশ কিছু বৎসর আগে এক দ্বৈত যুদ্ধে নিজের সব থেকে প্রিয় সেনাপতির পতন একটি অষ্টাদশ বৎসরের বালকের হাতে হয়েছিল।
– যুবরাজ কি ভাবছ? ইন্দ্রজিৎ প্রথমে ইশারায় গুপ্তচর কে বিদায় দিলেন। তারপরে হংসের দিকে ঘুরে বললেন – “ একটু অদ্ভুত ব্যাপার টা”।
– কেন অদ্ভুত কেন? হংসের প্রশ্ন সোজা ধেয়ে এলো যুবরাজের দিকে। কিন্তু যুবরাজ উত্তর দেবার আগেই শত্রুজিৎ এই প্রথম কথা বলল। -“ আসলে আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে একটি অষ্টাদশ বয়সী বালক এমনি ভাবেই একটি ভয়ঙ্কর খুনে সেনাপতি কে চোখের পলক ফেলার আগেই দ্বিখণ্ডিত করেছিল, যুবরাজ সেই কথাই ভাবছেন। বিশাল দেহি মানুশের সাথে যুদ্ধ করার রীতি কিছু সিমিত যোদ্ধা ই জানেন। আর এই রকম যুদ্ধ আমাদের মতন দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের যোদ্ধা রাই করে থাকেন। উত্তরের যোদ্ধা রা এই রকম গরিলা যুদ্ধ করতে পটু নয়। উত্তরের যোদ্ধা রা রথে চড়ে ধনুক এবং তরবারির সাহাজ্যে যুদ্ধে পটু।যুদ্ধের বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে উল্লম রাজ্যের যুবরাজ দক্ষিনের যুদ্ধ রীতি তে বিশেষ পটু”। কথা সেশ হবার আগেই অহং বোধে পরিপূর্ণ হংস বলে উঠলেন,
– হ্যাঁ তাতে কি হয়েছে। পটু হতেই পারেন ও দেশের যুবরাজ। কিন্তু আমরাই বা কম কিসের”?
ঠিক তখনি খি খি করে একটা অদ্ভুত খনা গলায় অনেক্কখন ধরে চুপ করে বসে থাকা রবিনন্দন হেসে উঠলেন। বললেন – যুবরাজ, হংস বুঝতে পারেন নি এর তাৎপর্য। এর তাৎপর্য হল কেউ তো আছে যে শিখিয়েছে উল্লম যুবরাজ কে এই যুদ্ধ পদ্ধতি। আর সব থেকে যেটা তাৎপর্যময় এই ঘটনা তে সেটা হল, জিষ্ণু দের এখান থেকে শেষ খবর পাওয়ার আগে অবধি উত্তর দিকে যেতেই দেখা গেছিল”।
কথা টা এতদুর তলিয়ে দেখেনি হংস। নিজের শক্তি গর্বে মাঝে মাঝে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতেই ভুলে যায় হংস সেটা সে নিজেও বোঝে। পুরো ব্যাপার টি অনুধাবন করে যুবরাজ কে বলল হংস- যুবরাজ তবে তো উল্লম রাজ্য আক্রমণের আর কোন কারন থাকার প্রয়োজন নেই”।
– কেন?
– কারন, ওরা তিন ভাই যদি ওই রাজ্যেই আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে ওদের যুদ্ধ করতেই হবে। আর সৈন্য বল তো এখন ওদের নেই বললেই চলে।
– হুম্ম সেটা ঠিক, কিন্তু ভুলে যেও না মিত্র , মহাসখা ওদের বিশেষ স্নেহ করেন। আর আমি নিশ্চিত যে মহাসখা জানেন ওরা কোথায় আছে। সেই ক্ষেত্রে মহা সখা ওদের সাহাজ্যে এগিয়ে এলে আখেরে আমাদের ই ক্ষতি।
– কিন্তু আমরা তো ওদের আক্রমন করতে যাচ্ছি না। আমরা তো উল্লম রাজ্য কে আক্রমন করতে যাচ্ছি, নিজেদের অর্থনৈতিক ভরসা জোরদার করতে। ভুলে যেও না কৃষি তে ওদের সমকক্ষ রাজ্য এই ভূভারতে আর নেই”। কথা টা বলে পুনর্বার খিনখিনে আওয়াজে, মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলে উঠলেন রবিনন্দন।
বিশাল কক্ষে তিন বৃদ্ধ বসে আছেন তিন টি আসনে। একটি আসনে বসে আছেন পক্ক কেশী মহামতি জীমূতবাহন। এই বৃদ্ধ বয়সেও বিশেষ খমতার অধিকারী সেটি এক নজরেই বোঝা যায়। এখনো ঋজু দেহের পেশীর সঞ্চালনে প্রতীত হয় যুদ্ধে ওনার সমকক্ষ বোধহয় না কেউ আছে। উনি নিজের মাথা নিচু করে বসে আছেন উষ্ণীষ ছাড়াই। অন্য আসনে বসে আছেন অর্ধ পক্ক কেশী মহামতি পরাঞ্জয়। উনি জিমুতবাহনের বিশেষ মিত্র। শৌর্যে উনি জিবুতবাহনের সমকক্ষ সে এক নজরেই প্রতীত হয়। অন্য আরেক টি আসনে বসে আছেন ধির স্থির শান্ত হয়ে মহামন্ত্রি পুরুষোত্তম। তিনজনেই যে কোন একটি বিশেষ কারনে ভয়ানক চিন্তিত সেটি বুঝতে বিলম্ব হয় না। মহামতি জীমূত বলে উঠলেন –“ ঠিক এই ভয় টাই আমি পেয়েছিলাম পুরু। আমি জানি ওরা বেঁচে আছে। কিন্তু আমি নিজেও ওদের খোঁজ নিই নি। কারন আমি জানি ওরা জেখানেই থাকবে সেখান টা ওরা নিজেদের মতন করেই গড়ে নেবে। আমি খোঁজ নিই নি কারন আমি চাই নি ওরা এখানে আসুক আর পুনর্বার যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হোক”।
– কিন্তু কি এমন হল যে আপনি এতো টা উত্তেজিত তাত”?পুরু প্রশ্ন টা না করে থাকতে পারল না মহামতি জীমূত কে। মহামতি আসন থেকে উঠে জানালার দাহ্রে গিয়ে পাশে বয়ে চলা বিশাল গোদাবরী কে দেখতে দেখতে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন – “ পুরু, ওরা উল্লম দেশ আক্রমনে যাচ্ছে। আর আমি জানি কেন ওই দেশ ই আক্রমন করছে”।
– কেন করছে আক্রমন? পরাঞ্জয় প্রশ্ন করতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে মহামতি বললেন
– আমি খবর পেয়েছি উল্লম দেশের মহাবলশালী শার্দূল নিহত হয়েছে, আর তোমর বাহিনি কে পরাজিত করেছে উল্লম রাজ কোন এক নীল বলে যোদ্ধার বলে। আর আমি এও জানি যে ওই নীল বলে যোদ্ধা আর কেউ নয় আমাদের প্রিয় বালি।
– সে কি!!!
– হুম্ম, আমার সব থেকে বিশ্বস্ত গুপ্তচর সেই যুদ্ধ সামনে থেকেই দেখেছে। ওই রকম মুগুর ঘুরিয়ে শত্রুর মাথা গুঁড়িয়ে দেবার পদ্ধতি যে বালির সেটা আমার গুপ্তচর নিশ্চিত করেছে আমাকে। বড় বড় পাথরের টুকরা তুলে শত্রু সেনার ভিতরে ছুঁড়ে ছত্র ভঙ্গ করতে আমরা বালিকেই দেখেছি পদ্মাগড়ের সাথে যুদ্ধে।
– হুম তার মানে এই যে এই খবর ইন্দ্রজিৎ ও পেয়েছে, আর নির্বল যুবরাজ জয় কে হত্যা করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করতেই উল্লম রাজ্য আক্রমন” পরাঞ্জয় এর কোথায় বেশ জোরে হেসে উঠলেন মহামতি।
“হা হা হা হা হা। ভয় আমার ওদের প্রান নিয়ে নেই মহামতি পরাঞ্জয়। ভয় আমার ইন্দ্রজিৎ এর প্রান সংশয় সেই জন্য। আমার ক্রোধ বাড়ছে মহামতি। যে ওই কিছু জানে না “হংস” তার ভরসায় যুবরাজ উল্লম রাজ্য আক্রমন করছে। মহামতি পরাঞ্জয়, আপনি কি শোনেন নি জিষ্ণুর বসুন্ধরার টঙ্কার? সে আওয়াজে মনে হয় মর্ত্য বুঝি এই দ্বিধা বিভক্ত হল। আপনি কি দেখেন নি ওর শর সন্ধান? ওর শরের খোঁজ কি আপনার মতন বীর ও পায়? ওর অসি চালনা দেখলে মনে হয় শত শত জিষ্ণু যুদ্ধ করছে রণোন্মত্ত হয়ে। মহামতি পরাঞ্জয়, জিষ্ণু, ক্রোধ, লোভ, ক্লান্তি, অহং এই সবেতেই বিজয় প্রাপ্তি করেছে হেলায়।ও যে অনন্ত বিজয়। ও একাই শেষ করে দিতে পারে আমার এই সাধের বিশাল বল্লভপুরের ভয়ঙ্কর মহাসেনা কে সকল সেনাপতি সহ”। পুরু দেখল মহামতি পরাঞ্জয় যেন একটু ক্ষুণ্ণ হলেন। সেই ক্ষুণ্ণতা পরাঞ্জয় এর মতন মহাবীর কে কিছুটা হলেও উপেক্ষা করার জন্য। যদিও স্নেহের বশে মহামতি জীমূত একটু বেশি বলেন জিষ্ণু কে নিয়ে, কিন্তু কথাটা ততটাই সত্যি যতটা মহামতি বলেছেন জিষ্ণুর সম্পর্কে। জিষ্ণু এমন একজন যোদ্ধা যে ঠিক ততটাই লড়তে পারে যতটা লড়লে ও বিজয়ী হবে। নিজেকে শেষ সময় অবধি টেনে নিয়ে যায় প্রয়োজন অনুসারে। এই গুন কারোর মধ্যে নেই বললেই চলে। শত্রু কে এক লহমা তেই মেপে নেয় জিষ্ণু। তাই তাত যে উপরোক্ত প্রশংসা করলেন জিষ্ণু কে নিয়ে সেটা সামান্য তম বাড়িয়ে বলেন নি।তারপরে বালি যুদ্ধে যোগ দিলে তো সব সম্ভাবনাই শেষ। এদকে কথা বলতে বলতে নিজের জোড়া মুঠি মাথায় ঠেকিয়ে ক্রন্দন রত অবস্থায় বৃদ্ধ জীমূত বলে চললেন – “ পুরু তুমি আমার পরিবার ফিরিয়ে দাও, আমার পরিবার ফিরিয়ে দাও”।
উল্লম দেশের বিশাল সভায় মহারাজ চিন্তিত হয়েই বসে আছেন সভাসদ দের মাঝে। এই মাত্র গুপ্তচর খবর দিয়ে গেল যে বল্লভ পুরের মহাসেনা উল্লম রাজ্য আক্রমণের জন্য কুচ করেছে। সেনা মহারাজার ও কম নেই, কিন্তু সেটা সাগর মধ্যে বিন্দু সম। এই ভূভারতে বল্লবপুরের সেনা সব থেকে লড়াকু আর বিশাল। অপরাজেয় এই সেনার মুখ্য ভাগে থাকেন মহানতম বীর জীমূতবাহন। ওনার মিত্র এবং ওনার সমকক্ষ বীর পরাঞ্জয়। এর সাথে যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ। রাজকুমার শত্রুজিৎ। আর দুই মহাবীর এবং রাজকুমার। সাথে হংস। উফফফফ কি যে হবে কে জানে। এই সুবিশাল সেনানীর সাথে মিত্রতা ই করা যায়। যুদ্ধ করা একদম ই উচিৎ নয়। কিন্তু এতদিনের পুরনো মিত্রতা ছিল বল্লভপুরের সাথে। কিন্তু কি হল যে ওরা উল্লম রাজ আক্রমন করছে? এতো ভাবার সময় নেই এখন। উনি প্রহরী কে ডেকে নির্দেশ দিলেন যুবরাজ কে তার কাছে আসবার জন্য।
– পিতা মহারাজ! আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
– হ্যাঁ যুবরাজ, একটি খারাপ সংবাদ আছে”। যুবরাজ মহারাজের কথা শুনে একটু বিভ্রান্ত হলেন বলে চলে। খারাপ কি সংবাদ থাকতে পারে সেই নিয়ে মন উথাল পাথাল হতে লাগলো। কিন্তু নিজেকে বেশ শান্ত রাখার চেষ্টা করে মহারাজ কে জিজ্ঞাসা করলেন যুবরাজ,
– কি খারাপ সংবাদ মহারাজ?
– এখনি গুপ্তচর এসে সংবার দিল, বল্লভ পুরের মহাসেনা আক্রমন এর জন্য কুচ করেছে আমাদের বিপক্ষে”। সংবাদ টা যুবরাজ কে তেমন নড়াতে পারল না। কারন উনি সদ্য বিশালাকায় মহাবীর শার্দূল কে বধ করে টগবগ করে ফুটছেন। বল্লভ পুরের সেনার সাথে বেশ বড় রকমের যুদ্ধ হবে আন্দাজ করেই বেশ শিহরিত হলেন যুবরাজ।
– তুমি ছাড়া এখন আমার রাজ্যে বড় বীর বলতে কেউ নেই। মহাবীর শার্দূল কে বধ করার পরে আমি তুমি ছাড়া আর কার ওপরেই বা ভরসা করব”?
– মহারাজ আমি আমার সেনার দায়িত্ব গ্রহন করলাম। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে যে আমি বল্লভপুর কে মেরে তাড়াব আমার রাজ্য থেকে”।
চারিদিকে সেনার প্রস্তুতি, তলোয়ার, ঢাল, তীর ধনুকের ঝনঝনানি। রাজ্যের বাইরে বিশাল গো চারন ভুমি তেই সম্মুখ সমরে লিপ্ত হবে দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ। ঠিক সেই সময়েই তিন ভাই গুপ্ত ভাবে বসে নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ এ রত ছিল। জয়, বালি আর জিষ্ণু।
– এটা তো নিশ্চিত যে ইন্দ্রজিৎ বুঝে গেছে আমরা এখানে, না হলে এই রাজ্যেই আক্রমন করত না ওরা।
– হ্যাঁ এটা নিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন হল আমাদের করনীয় কি হবে”? জিষ্ণুর কথায় জয় বেশ যেন চিন্তায় পরে গেল। বালি উত্তর করল
– আমাদের আবার করনীয় কি হবে? আমরা যে রাজ্যে আছি সেই রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করবই। যে রাজ্য আমাদের আশ্রয় দিয়েছে সেই রাজ্যের দুর্দিনে পাশে থাকব না?
– বোকার মতন কথা বোল না বালি” !! দাদার ধমক খেয়ে বালি চুপ করে গেল। একশ হাতির বল নিয়েও দাদার সামনে জিষ্ণুর মতই মাথা ঝুকিয়ে থাকে বালি। আর সেটাই এই পরিবারের শিক্ষা।
– আমাদের চিন্তা করতে হবে অনেক। সমগ্র বল্লভ পুর কুচ করেছে। তার অর্থ হল একা বালির পক্ষে এদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জিষ্ণু কেও সামনে আসতে হবে”। উপরোক্ত কথায় বালির বোধকরি অভিমান হল। সেও যে সমগ্র বল্লভপুর কে শেষ করতে পারে এই ভরসা দেবার জন্যেই বালি বলে উঠল
– না জিষ্ণু কে আসতে হবে না। আমি একাই পারব।
– পাগলামো কোর না বালি।যদি দ্বৈত যুদ্ধে নিষ্পত্তি করতে হয় তবে জিষ্ণু কে লাগবেই।
– হুম্ম সেটা ঠিক”। বালি সম্মতি তে ঘাড় নাড়ল।
– কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না যে , বল্লভ পুর কেন আক্রমন করছে? শুধু কি আমাদের জন্য”? জিষ্ণু প্রশ্ন করল জয় কে।
– না, বুঝতে পারছ না? বল্লভপুরের উত্তরে মহাসখার রাজ্য নীলাচল। নীলাচলের উত্তরে উল্লম রাজ্য। যদি উল্লম রাজ্য কে বাগে আনা যায় তবে নীলাচলের ওপরে একটা চাপ তৈরি হবে। ইন্দ্রজিৎ যদি সত্যি কাউকে ভয় পায় তবে সে মহাসখা কেই পায়। অত্যন্ত বোকা হলেও মহাসখা কে হাল্কা ভাবে না নিয়ে ও এখানে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আর সত্যি বলতে এই বুদ্ধি ওর নয়। এই বুদ্ধি আমাদের প্রিয়তম তাত রবিনন্দনের।
– হুম্মম্ম ঠিক কথা। এই বুদ্ধি ইন্দ্রজিৎ এর হতে পারে না”। বালি সম্মতি প্রকাশ করল যুবরাজ জয়ের কথায়।
– তাহলে আমাদের কি করনীয় এখানে”? জিষ্ণু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল জয় কে
– হুম্ম তোমাকে বেড়িয়ে আসতে হবে। আর লুকিয়ে থাকা চলবে না। উল্লম রাজ্য কে আমাদের মিত্রতার বন্ধনেই রাখতে হবে। কারন মহাসখার অপরাজেয় সেনা আর উল্লম রাজের সেনাই আমাদের ভরসা।
দ্বৈত যুদ্ধের সময় বিশাল রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গনে অতুল জনসমাবেশ। মহারাজা ও মহারানী উপর থেকে যুদ্ধ দেখতে আগ্রহী। মহারানীর চোখে জলধারা। মহারাজা ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু কেন জানিনা আশার আলো কিছু টা হলেও দেখতে পাচ্ছেন উনি। যে ভাবে গত দুটি ভয়ঙ্কর বিপদ ভগবানের আশীর্বাদ এ টলে গেছিল। হয়ত এই বিপদ থেকেও মহারাজ উদ্ধার পাবেন। মহারানী কেদেই চলেছেন। নিজের প্রানপ্রিয় পুত্র কে হারানোর আশঙ্কায়। মৈথিলী প্রাঙ্গনের প্রান্তে যুবরাজের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে। নিজে যুবরাজের পিছনে এই জন্য দাঁড়িয়ে যাতে বিপদ বুঝলে শার্দূল কে বধ করতে সময় না যায়।ভানুপ্রতাপ মহারাজের পাশে স্মিত হাস্যে দাঁড়িয়ে। মৈথিলীর চোখ খুঁজছিল বালি কে। কিন্তু এই সবে বালির কোন উতসাহ নেই। প্রভুত পরিমান খাবার দাবার ওকে, ওর প্রিয় খেলা “যুদ্ধ” থেকেও সরিয়ে রাখে। খাবার পেলে ওর কোন কাণ্ড জ্ঞান থাকে না।
শার্দূল হাতের তরবারি নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকল যুবরাজের দিকে। মৈথিলী লক্ষ্য করছে যুবরাজ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে। বিশাল তলোয়ার টা মাটিতে স্পর্শ করিয়ে তলোয়ার টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে যুবরাজ নিশ্চল হয়ে। চোয়াল শক্ত হচ্ছে ততই যত শার্দূল মত্ত হস্তীর মতন এগিয়ে আসছে যুবরাজের দিকে। শার্দূল ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে এসে তলোয়ার চালাতেই যুবরাজ সরে গেলেন অত্যন্ত দ্রুত গতি তে। ঝুঁকে গেল শার্দূল অনেক টা সামনের দিকে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মৈথিলীর অভ্যস্ত হাত নিশপিশ করে উঠল। ঝুঁকে পরা শার্দূলের মোটা গর্দান টা যেন ডাকছিল মৈথিলী কে তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য। আর ঠিক তখনি যুবরাজ নিজের ভারি তলোয়ার টা ক্ষিপ্র গতিতে তুলে অত্যন্ত শিক্ষিত ভঙ্গী তে চালালেন শার্দূলের গলা লক্ষ্য করে……… ইশ!!!!!! বড্ড হাল্কা ভাবে নিয়েছিল শার্দূল, যুবরাজ কে।
মৈথিলীর সামনে পরে থাকা রক্ত মাখা কাটা মুণ্ডু টা মৈথিলী অনেকবার দেখল। বিশ্বাস হচ্ছিল না এটা শার্দূলের পরে থাকা কাটা মুণ্ডু। বার বার মৈথিলী দেখছিল পরে থাকা মুণ্ডু টা কে। সেদিনের বলা কাহিনীর সাথে আজ যুবরাজের যুদ্ধ……। মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল সুন্দরি মৈথিলীর। একবার, জন সাধারনের কাঁধে চড়ে থাকা যুবরাজের দিকে তাকিয়ে মৈথিলী চলে এলো প্রাসাদের অন্তঃপুর এ। আজকে তার বড় আনন্দের দিন। যুবরাজের মধ্যেকার যোদ্ধা টা বেড়িয়ে এসেছে সঠিক সময়েই।
আমি নিশ্চিত যে যুবরাজ তোমার প্রেমে পড়েছে জিষ্ণু”। মৈথিলী রুপী জিষ্ণু আর ভানু প্রতাপ কথোপকথনে রত ছিল ভানুপ্রতাপের প্রাসাদের পিছনে একটি মন্দিরের ভিতরে। লোকচক্ষুর আড়ালে এই ভাবে তারা প্রথম দেখা করল। উপরোক্ত কথা টা শুনেই মৈথিলী তাকিয়ে দেখল প্রাণপ্রিয় ভাই বালি দাঁড়িয়ে। মৈথিলী থাকতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে আলিঙ্গন করল নিজের দাদা কে। বালির অস্বস্তি হল কারন জীবনে কোন নারী কে আলিঙ্গন করে নি মাতা ছাড়া।
– উঁহু, তুমি আমাকে আলিঙ্গন কোর না ছোট কুমার। তুমি এখন ভাই নেই আমাদের। কোন এক অজানা নারী, হাহাহা।
– দাদা তুমি জ্বালিও না আমাকে। একে তো এই নারী বেশে আমার ভাল লাগছে না তারপরে তুমি এমনি করলে আমি কিন্তু যুবরাজ কে বলে দেব।
– হ্যাঁ তোমার যুবরাজ তো এখন তোমার কথায় আমার গর্দান ও নিতে পারে।
– হাহা, আমি আমার যুবরাজের কথা বলিনি আমি আমাদের যুবরাজের কথা বলেছি”। বলে মৈথিলী ভানুপ্রতাপ এর আলিঙ্গনে নিজেকে সপে দিল।
– উম্ম এতদিন পরে দেখা আর আমার আলিঙ্গনে নেই আমার ছোট্ট ভাই?
এমনি ভাবেই চলতে থাকল সেই সন্ধ্যে বেলায় তিন ভাই এর খুনসুটি।
রাত্রে মৈথিলী ছোট রাজকুমারের পাশেই শুয়েছিল। এটাই মহারানীর নির্দেশ ছিল। ছোটকুমার কে দ্বাদশ বর্ষ অব্দি একা শুতে দেওয়া যাবে না। একটা আওয়াজে মৈথিলী উঠে বসে দেখল পূর্ণিমার দিন চাঁদের আলোতে যুবরাজ দাঁড়িয়ে আছেন জানালার পাশেই। জিষ্ণুর নারী মন মৈথিলী রূপে যুবরাজের স্পর্শ পাবার জন্য ছটফট করছিল। শয্যা থেকে উঠে যুবরাজের পাশে দাঁড়াল মৈথিলী। ধিরে ধিরে পিছনে গিয়ে যুবরাজ কে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল মৈথিলী। যুবরাজ ঘুরে মৈথিলী কে বক্ষলগ্না করে প্রায় আঁকড়ে ধরলেন বলা চলে মৈথিলী কে। মৈথিলীর কেশ উন্মুক্ত করে ঘ্রান নিলেন যুবরাজ। মৈথিলীর কণ্ঠ দেশে গভীর চুম্বন আঁকলেন অনভ্যস্ত ভাবে। মৈথিলী হারিয়ে যাচ্ছিল যেন। এ যে ভোগ নয়, গভীর প্রেম – সেটা আবার ও বুঝল মৈথিলী। যুবরাজ অনুমতি নেবেন কিনা মৈথিলীর কাছে সেটা ভাবার আগেই মৈথিলী যেন পড়ে নিল যুবরাজের মানসিক ঝঞ্ঝা। যুবরাজের প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ফেলে বিড়বিড় করে বলে উঠল মৈথিলী – “ প্রেম এ অনুমতি লাগে না যুবরাজ, আমি শুধু আপনার, আর কারোর না”।
“আআহহহহহ” মৈথিলীর আর্ত চীৎকার যুবরাজের মনে কামনার আগুন জ্বালিয়ে দিল যেন। একটা মাখনের মতন শরীর কে মথিত করতে করতে, যুবরাজ আওয়াজ টা শুনতে পেলেন। নিজের বলশালী শিশ্ন মৈথিলীর গহ্বরে প্রবেশ করিয়ে যুবরাজ অপেক্ষা করলেন। নিজের বলশালী শরীরের নীচে মৈথিলীর ছটফটানি যেন যুবরাজ কে কামনার আগুনে অন্ধ করে দিলো। নিজের নারী কে ভোগের নেশায় পাগল হয়ে উঠলেন যুবরাজ। মৈথিলীর ফুলের পাপড়ির মতন নরম পিঠে কামনার কামড় বসালেন যুবরাজ। সহ্য করতে না পেরে মৈথিলী যুবরাজের বাহুতে আবদ্ধ নিজের হাতে শয্যার চাদর মুঠো করে ধরে ব্যাথা মিশ্রিত কামনার শীৎকার করে উঠল। প্রথম মিলন দুজনের ই। যুবরাজের যেন তর সইছে না। প্রথম মিলনেই যেন মৈথিলী কে সম্পূর্ন নিজের করে নেবার তাগিদ। মৈথিলীর আর্ত চিৎকার যুবরাজের গর্জনে অনেক আগেই চাপা পরে গিয়েছে…
রেড়ির তেলের আলোয় যুবরাজ দেখলেন যুবরাজের বক্ষলগ্না মৈথিলীর চোখে জল। মৈথিলী কে নিজের বক্ষে সজোরে আকর্ষন করে কাছে টেনে নিলএন যুবরাজ। জিজ্ঞাসা করলেন
– আমি কি তোমাকে জোর করে ভোগ করলাম মৈথিলী?
যুবরাজের বক্ষে স্থিত হয়েই, আনত চোখে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো মৈথিলী
– উঁহু
– তবে তুমি কাঁদছ যে?
যুবরাজ কে আরো সজোরে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই মৈথিলী উত্তর দিলো
– এ কান্না খুশীর যুবরাজ……
এদিকে অনেক দূরে বল্লভপুরের দেবতুল্য প্রাসাদে বসে আছেন ইন্দ্রজিৎ, ওর ভাই শত্রুজিৎ। মিত্র হংস। আর তাত রবিনন্দন। এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে রত সকলেই। বল্লভপুরের অজেয় সেনাবাহিনী কে উল্লম রাজ্যে আক্রমনের কথা পেরেছিলেন হংস। হংসের এই এক বড় বাজে স্বভাব। ভয়ঙ্কর বীর তিনি কোন সন্দেহই নেই তাতে। কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধা যুদ্ধ কে আহ্বান করেন না। এড়িয়েই চলেন। কিন্তু ইনি যুদ্ধ আহ্বান করতে বিশেষ আগ্রহী। জিষ্ণু নিহত অথবা নিখোঁজ এর পড়ে হংস সম বীর আর সত্যি করেই কেউ নেই, আর সেটা তিনি সর্ব সমুখে প্রমান না করে থাকতে পারছেন না।যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ বন্ধুর এই স্বভাব টি কে বিশেষ লালন পালন করেন। স্নেহ করেন বন্ধু কে বিশেষ। নিজের ভগিনী কনকমঞ্জরীর সাথে বিবাহ দিয়েছেন বন্ধু হংসের। এবং সেটা হংসের বীরত্বের জন্যই। জিষ্ণুর সাথে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করতে পারে এদের মধ্যে একমাত্র হংস ই। আর যুবরাজ সেই কারনেই হংসের ওপরে ভীষণ রকমের দুর্বল। যাই হোক এখন হংসের ইচ্ছে নিজের বীরত্ব দেখানোর সেটাও উল্লম রাজ্যের ওপরে। ওরা চারজনে যুক্তিতে মেতে ছিল কি ভাবে আক্রমন সাজানো যায় সেই ব্যাপারেই। শার্দূল কে নিয়ে বিশেষ ভাবনা চলছিল চারজনের মধ্যে।
ঠিক সেই সময়ে একজন গুপ্তচর এসে পাশে দাঁড়াতেই যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ ইশারায় জানতে চাইলেন সংবাদ।
– যুবরাজ একটি খবর আছে। ভাল বা খারাপ সেটা যুবরাজের বিচারাধীন।
– বল কি খবর?
– যুবরাজ উল্লম রাজ্যের মহাসেনাপতির পতন হয়েছে। যুবরাজ বিজয় ওনার মাথা দেহ থেকে আলাদা করে দিয়েছেন গত কাল সকালে দ্বৈত যুদ্ধে। আর একটি খবর হল তোমর রাজ্যের রাজা উল্লম দেশ আক্রমন তো করেছিলেন কিন্তু নীল নামে একটি স্থানীয় বীরের বীরত্বে তোমর রাজা পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছেন”। এই কথা বলার পরে চর টি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করল দুজনের দ্বৈত যুদ্ধ।
এই সংবাদের হয়ত কোন মুল্য ছিল না তেমন কিন্তু যাকে নিয়ে আলোচনা তার মৃত্যুর খবরে সবাই একটু চমকাল বইকি। আর খবরের মধ্যে চমক ও ছিল। কারন জতদুর খবর তাতে যুবরাজের বয়স অষ্টাদশ বৎসর মাত্র। এই বয়সেই শার্দূলের মতন এক ভয়ানক বীর কে দ্বিখণ্ডিত করা মুখের কথা নয়। বরং একটু অবাস্তব ই। যুবরাজ ইন্দ্রজিতের যেন মনে পড়ে গেল আজ থেকে বেশ কিছু বৎসর আগে এক দ্বৈত যুদ্ধে নিজের সব থেকে প্রিয় সেনাপতির পতন একটি অষ্টাদশ বৎসরের বালকের হাতে হয়েছিল।
– যুবরাজ কি ভাবছ? ইন্দ্রজিৎ প্রথমে ইশারায় গুপ্তচর কে বিদায় দিলেন। তারপরে হংসের দিকে ঘুরে বললেন – “ একটু অদ্ভুত ব্যাপার টা”।
– কেন অদ্ভুত কেন? হংসের প্রশ্ন সোজা ধেয়ে এলো যুবরাজের দিকে। কিন্তু যুবরাজ উত্তর দেবার আগেই শত্রুজিৎ এই প্রথম কথা বলল। -“ আসলে আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে একটি অষ্টাদশ বয়সী বালক এমনি ভাবেই একটি ভয়ঙ্কর খুনে সেনাপতি কে চোখের পলক ফেলার আগেই দ্বিখণ্ডিত করেছিল, যুবরাজ সেই কথাই ভাবছেন। বিশাল দেহি মানুশের সাথে যুদ্ধ করার রীতি কিছু সিমিত যোদ্ধা ই জানেন। আর এই রকম যুদ্ধ আমাদের মতন দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের যোদ্ধা রাই করে থাকেন। উত্তরের যোদ্ধা রা এই রকম গরিলা যুদ্ধ করতে পটু নয়। উত্তরের যোদ্ধা রা রথে চড়ে ধনুক এবং তরবারির সাহাজ্যে যুদ্ধে পটু।যুদ্ধের বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে উল্লম রাজ্যের যুবরাজ দক্ষিনের যুদ্ধ রীতি তে বিশেষ পটু”। কথা সেশ হবার আগেই অহং বোধে পরিপূর্ণ হংস বলে উঠলেন,
– হ্যাঁ তাতে কি হয়েছে। পটু হতেই পারেন ও দেশের যুবরাজ। কিন্তু আমরাই বা কম কিসের”?
ঠিক তখনি খি খি করে একটা অদ্ভুত খনা গলায় অনেক্কখন ধরে চুপ করে বসে থাকা রবিনন্দন হেসে উঠলেন। বললেন – যুবরাজ, হংস বুঝতে পারেন নি এর তাৎপর্য। এর তাৎপর্য হল কেউ তো আছে যে শিখিয়েছে উল্লম যুবরাজ কে এই যুদ্ধ পদ্ধতি। আর সব থেকে যেটা তাৎপর্যময় এই ঘটনা তে সেটা হল, জিষ্ণু দের এখান থেকে শেষ খবর পাওয়ার আগে অবধি উত্তর দিকে যেতেই দেখা গেছিল”।
কথা টা এতদুর তলিয়ে দেখেনি হংস। নিজের শক্তি গর্বে মাঝে মাঝে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতেই ভুলে যায় হংস সেটা সে নিজেও বোঝে। পুরো ব্যাপার টি অনুধাবন করে যুবরাজ কে বলল হংস- যুবরাজ তবে তো উল্লম রাজ্য আক্রমণের আর কোন কারন থাকার প্রয়োজন নেই”।
– কেন?
– কারন, ওরা তিন ভাই যদি ওই রাজ্যেই আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে ওদের যুদ্ধ করতেই হবে। আর সৈন্য বল তো এখন ওদের নেই বললেই চলে।
– হুম্ম সেটা ঠিক, কিন্তু ভুলে যেও না মিত্র , মহাসখা ওদের বিশেষ স্নেহ করেন। আর আমি নিশ্চিত যে মহাসখা জানেন ওরা কোথায় আছে। সেই ক্ষেত্রে মহা সখা ওদের সাহাজ্যে এগিয়ে এলে আখেরে আমাদের ই ক্ষতি।
– কিন্তু আমরা তো ওদের আক্রমন করতে যাচ্ছি না। আমরা তো উল্লম রাজ্য কে আক্রমন করতে যাচ্ছি, নিজেদের অর্থনৈতিক ভরসা জোরদার করতে। ভুলে যেও না কৃষি তে ওদের সমকক্ষ রাজ্য এই ভূভারতে আর নেই”। কথা টা বলে পুনর্বার খিনখিনে আওয়াজে, মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলে উঠলেন রবিনন্দন।
বিশাল কক্ষে তিন বৃদ্ধ বসে আছেন তিন টি আসনে। একটি আসনে বসে আছেন পক্ক কেশী মহামতি জীমূতবাহন। এই বৃদ্ধ বয়সেও বিশেষ খমতার অধিকারী সেটি এক নজরেই বোঝা যায়। এখনো ঋজু দেহের পেশীর সঞ্চালনে প্রতীত হয় যুদ্ধে ওনার সমকক্ষ বোধহয় না কেউ আছে। উনি নিজের মাথা নিচু করে বসে আছেন উষ্ণীষ ছাড়াই। অন্য আসনে বসে আছেন অর্ধ পক্ক কেশী মহামতি পরাঞ্জয়। উনি জিমুতবাহনের বিশেষ মিত্র। শৌর্যে উনি জিবুতবাহনের সমকক্ষ সে এক নজরেই প্রতীত হয়। অন্য আরেক টি আসনে বসে আছেন ধির স্থির শান্ত হয়ে মহামন্ত্রি পুরুষোত্তম। তিনজনেই যে কোন একটি বিশেষ কারনে ভয়ানক চিন্তিত সেটি বুঝতে বিলম্ব হয় না। মহামতি জীমূত বলে উঠলেন –“ ঠিক এই ভয় টাই আমি পেয়েছিলাম পুরু। আমি জানি ওরা বেঁচে আছে। কিন্তু আমি নিজেও ওদের খোঁজ নিই নি। কারন আমি জানি ওরা জেখানেই থাকবে সেখান টা ওরা নিজেদের মতন করেই গড়ে নেবে। আমি খোঁজ নিই নি কারন আমি চাই নি ওরা এখানে আসুক আর পুনর্বার যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হোক”।
– কিন্তু কি এমন হল যে আপনি এতো টা উত্তেজিত তাত”?পুরু প্রশ্ন টা না করে থাকতে পারল না মহামতি জীমূত কে। মহামতি আসন থেকে উঠে জানালার দাহ্রে গিয়ে পাশে বয়ে চলা বিশাল গোদাবরী কে দেখতে দেখতে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন – “ পুরু, ওরা উল্লম দেশ আক্রমনে যাচ্ছে। আর আমি জানি কেন ওই দেশ ই আক্রমন করছে”।
– কেন করছে আক্রমন? পরাঞ্জয় প্রশ্ন করতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে মহামতি বললেন
– আমি খবর পেয়েছি উল্লম দেশের মহাবলশালী শার্দূল নিহত হয়েছে, আর তোমর বাহিনি কে পরাজিত করেছে উল্লম রাজ কোন এক নীল বলে যোদ্ধার বলে। আর আমি এও জানি যে ওই নীল বলে যোদ্ধা আর কেউ নয় আমাদের প্রিয় বালি।
– সে কি!!!
– হুম্ম, আমার সব থেকে বিশ্বস্ত গুপ্তচর সেই যুদ্ধ সামনে থেকেই দেখেছে। ওই রকম মুগুর ঘুরিয়ে শত্রুর মাথা গুঁড়িয়ে দেবার পদ্ধতি যে বালির সেটা আমার গুপ্তচর নিশ্চিত করেছে আমাকে। বড় বড় পাথরের টুকরা তুলে শত্রু সেনার ভিতরে ছুঁড়ে ছত্র ভঙ্গ করতে আমরা বালিকেই দেখেছি পদ্মাগড়ের সাথে যুদ্ধে।
– হুম তার মানে এই যে এই খবর ইন্দ্রজিৎ ও পেয়েছে, আর নির্বল যুবরাজ জয় কে হত্যা করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করতেই উল্লম রাজ্য আক্রমন” পরাঞ্জয় এর কোথায় বেশ জোরে হেসে উঠলেন মহামতি।
“হা হা হা হা হা। ভয় আমার ওদের প্রান নিয়ে নেই মহামতি পরাঞ্জয়। ভয় আমার ইন্দ্রজিৎ এর প্রান সংশয় সেই জন্য। আমার ক্রোধ বাড়ছে মহামতি। যে ওই কিছু জানে না “হংস” তার ভরসায় যুবরাজ উল্লম রাজ্য আক্রমন করছে। মহামতি পরাঞ্জয়, আপনি কি শোনেন নি জিষ্ণুর বসুন্ধরার টঙ্কার? সে আওয়াজে মনে হয় মর্ত্য বুঝি এই দ্বিধা বিভক্ত হল। আপনি কি দেখেন নি ওর শর সন্ধান? ওর শরের খোঁজ কি আপনার মতন বীর ও পায়? ওর অসি চালনা দেখলে মনে হয় শত শত জিষ্ণু যুদ্ধ করছে রণোন্মত্ত হয়ে। মহামতি পরাঞ্জয়, জিষ্ণু, ক্রোধ, লোভ, ক্লান্তি, অহং এই সবেতেই বিজয় প্রাপ্তি করেছে হেলায়।ও যে অনন্ত বিজয়। ও একাই শেষ করে দিতে পারে আমার এই সাধের বিশাল বল্লভপুরের ভয়ঙ্কর মহাসেনা কে সকল সেনাপতি সহ”। পুরু দেখল মহামতি পরাঞ্জয় যেন একটু ক্ষুণ্ণ হলেন। সেই ক্ষুণ্ণতা পরাঞ্জয় এর মতন মহাবীর কে কিছুটা হলেও উপেক্ষা করার জন্য। যদিও স্নেহের বশে মহামতি জীমূত একটু বেশি বলেন জিষ্ণু কে নিয়ে, কিন্তু কথাটা ততটাই সত্যি যতটা মহামতি বলেছেন জিষ্ণুর সম্পর্কে। জিষ্ণু এমন একজন যোদ্ধা যে ঠিক ততটাই লড়তে পারে যতটা লড়লে ও বিজয়ী হবে। নিজেকে শেষ সময় অবধি টেনে নিয়ে যায় প্রয়োজন অনুসারে। এই গুন কারোর মধ্যে নেই বললেই চলে। শত্রু কে এক লহমা তেই মেপে নেয় জিষ্ণু। তাই তাত যে উপরোক্ত প্রশংসা করলেন জিষ্ণু কে নিয়ে সেটা সামান্য তম বাড়িয়ে বলেন নি।তারপরে বালি যুদ্ধে যোগ দিলে তো সব সম্ভাবনাই শেষ। এদকে কথা বলতে বলতে নিজের জোড়া মুঠি মাথায় ঠেকিয়ে ক্রন্দন রত অবস্থায় বৃদ্ধ জীমূত বলে চললেন – “ পুরু তুমি আমার পরিবার ফিরিয়ে দাও, আমার পরিবার ফিরিয়ে দাও”।
উল্লম দেশের বিশাল সভায় মহারাজ চিন্তিত হয়েই বসে আছেন সভাসদ দের মাঝে। এই মাত্র গুপ্তচর খবর দিয়ে গেল যে বল্লভ পুরের মহাসেনা উল্লম রাজ্য আক্রমণের জন্য কুচ করেছে। সেনা মহারাজার ও কম নেই, কিন্তু সেটা সাগর মধ্যে বিন্দু সম। এই ভূভারতে বল্লবপুরের সেনা সব থেকে লড়াকু আর বিশাল। অপরাজেয় এই সেনার মুখ্য ভাগে থাকেন মহানতম বীর জীমূতবাহন। ওনার মিত্র এবং ওনার সমকক্ষ বীর পরাঞ্জয়। এর সাথে যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ। রাজকুমার শত্রুজিৎ। আর দুই মহাবীর এবং রাজকুমার। সাথে হংস। উফফফফ কি যে হবে কে জানে। এই সুবিশাল সেনানীর সাথে মিত্রতা ই করা যায়। যুদ্ধ করা একদম ই উচিৎ নয়। কিন্তু এতদিনের পুরনো মিত্রতা ছিল বল্লভপুরের সাথে। কিন্তু কি হল যে ওরা উল্লম রাজ আক্রমন করছে? এতো ভাবার সময় নেই এখন। উনি প্রহরী কে ডেকে নির্দেশ দিলেন যুবরাজ কে তার কাছে আসবার জন্য।
– পিতা মহারাজ! আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
– হ্যাঁ যুবরাজ, একটি খারাপ সংবাদ আছে”। যুবরাজ মহারাজের কথা শুনে একটু বিভ্রান্ত হলেন বলে চলে। খারাপ কি সংবাদ থাকতে পারে সেই নিয়ে মন উথাল পাথাল হতে লাগলো। কিন্তু নিজেকে বেশ শান্ত রাখার চেষ্টা করে মহারাজ কে জিজ্ঞাসা করলেন যুবরাজ,
– কি খারাপ সংবাদ মহারাজ?
– এখনি গুপ্তচর এসে সংবার দিল, বল্লভ পুরের মহাসেনা আক্রমন এর জন্য কুচ করেছে আমাদের বিপক্ষে”। সংবাদ টা যুবরাজ কে তেমন নড়াতে পারল না। কারন উনি সদ্য বিশালাকায় মহাবীর শার্দূল কে বধ করে টগবগ করে ফুটছেন। বল্লভ পুরের সেনার সাথে বেশ বড় রকমের যুদ্ধ হবে আন্দাজ করেই বেশ শিহরিত হলেন যুবরাজ।
– তুমি ছাড়া এখন আমার রাজ্যে বড় বীর বলতে কেউ নেই। মহাবীর শার্দূল কে বধ করার পরে আমি তুমি ছাড়া আর কার ওপরেই বা ভরসা করব”?
– মহারাজ আমি আমার সেনার দায়িত্ব গ্রহন করলাম। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে যে আমি বল্লভপুর কে মেরে তাড়াব আমার রাজ্য থেকে”।
চারিদিকে সেনার প্রস্তুতি, তলোয়ার, ঢাল, তীর ধনুকের ঝনঝনানি। রাজ্যের বাইরে বিশাল গো চারন ভুমি তেই সম্মুখ সমরে লিপ্ত হবে দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ। ঠিক সেই সময়েই তিন ভাই গুপ্ত ভাবে বসে নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ এ রত ছিল। জয়, বালি আর জিষ্ণু।
– এটা তো নিশ্চিত যে ইন্দ্রজিৎ বুঝে গেছে আমরা এখানে, না হলে এই রাজ্যেই আক্রমন করত না ওরা।
– হ্যাঁ এটা নিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন হল আমাদের করনীয় কি হবে”? জিষ্ণুর কথায় জয় বেশ যেন চিন্তায় পরে গেল। বালি উত্তর করল
– আমাদের আবার করনীয় কি হবে? আমরা যে রাজ্যে আছি সেই রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করবই। যে রাজ্য আমাদের আশ্রয় দিয়েছে সেই রাজ্যের দুর্দিনে পাশে থাকব না?
– বোকার মতন কথা বোল না বালি” !! দাদার ধমক খেয়ে বালি চুপ করে গেল। একশ হাতির বল নিয়েও দাদার সামনে জিষ্ণুর মতই মাথা ঝুকিয়ে থাকে বালি। আর সেটাই এই পরিবারের শিক্ষা।
– আমাদের চিন্তা করতে হবে অনেক। সমগ্র বল্লভ পুর কুচ করেছে। তার অর্থ হল একা বালির পক্ষে এদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জিষ্ণু কেও সামনে আসতে হবে”। উপরোক্ত কথায় বালির বোধকরি অভিমান হল। সেও যে সমগ্র বল্লভপুর কে শেষ করতে পারে এই ভরসা দেবার জন্যেই বালি বলে উঠল
– না জিষ্ণু কে আসতে হবে না। আমি একাই পারব।
– পাগলামো কোর না বালি।যদি দ্বৈত যুদ্ধে নিষ্পত্তি করতে হয় তবে জিষ্ণু কে লাগবেই।
– হুম্ম সেটা ঠিক”। বালি সম্মতি তে ঘাড় নাড়ল।
– কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না যে , বল্লভ পুর কেন আক্রমন করছে? শুধু কি আমাদের জন্য”? জিষ্ণু প্রশ্ন করল জয় কে।
– না, বুঝতে পারছ না? বল্লভপুরের উত্তরে মহাসখার রাজ্য নীলাচল। নীলাচলের উত্তরে উল্লম রাজ্য। যদি উল্লম রাজ্য কে বাগে আনা যায় তবে নীলাচলের ওপরে একটা চাপ তৈরি হবে। ইন্দ্রজিৎ যদি সত্যি কাউকে ভয় পায় তবে সে মহাসখা কেই পায়। অত্যন্ত বোকা হলেও মহাসখা কে হাল্কা ভাবে না নিয়ে ও এখানে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আর সত্যি বলতে এই বুদ্ধি ওর নয়। এই বুদ্ধি আমাদের প্রিয়তম তাত রবিনন্দনের।
– হুম্মম্ম ঠিক কথা। এই বুদ্ধি ইন্দ্রজিৎ এর হতে পারে না”। বালি সম্মতি প্রকাশ করল যুবরাজ জয়ের কথায়।
– তাহলে আমাদের কি করনীয় এখানে”? জিষ্ণু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল জয় কে
– হুম্ম তোমাকে বেড়িয়ে আসতে হবে। আর লুকিয়ে থাকা চলবে না। উল্লম রাজ্য কে আমাদের মিত্রতার বন্ধনেই রাখতে হবে। কারন মহাসখার অপরাজেয় সেনা আর উল্লম রাজের সেনাই আমাদের ভরসা।