01-05-2021, 01:21 AM
--
মহারানী যুবরাজের পাশে বসে যুবরাজ কে খাওয়াচ্ছেন। মৈথিলী পাশেই থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে। যুবরাজ যেন উঠে এসেছেন কোন মৃত্যুর অতল থেকে। প্রাণপ্রিয় সন্তানের শারীরিক অবস্থার উন্নতি রাজ বৈদ্য ও বিশ্বাস করতে পারেন নি।কিন্তু মহারানীর কেন জানিনা মনে হয়েছে এই সবের পিছনে কোন দৈবী শক্তি আছে।যুবরাজ কে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা আর যুবরাজের শারীরিক অবস্থার এই অভূতপূর্ব উন্নতি র পিছনে তিনি কোন রাজবৈদ্য নয় দেখছেন বাড়ির কূলদেবতা সূর্য দেব কে।সকাল বিকেল কূলদেবতার পুজো তে বেশ কিছু সময় ব্যয় করছেন তিনি সেই কারনে। আর মৈথিলীর তৎপরতায় যুবরাজের জীবন প্রাপ্তি কেও অস্বীকার করছেন না।
তার স্থির বিশ্বাস এই আশ্রিতা দীর্ঘাঙ্গি নারী টি কোন সাধারন নারী নয়। শাস্ত্রজ্ঞান এ পারদর্শী এই নারীকে তিনি কখনই নিজের কাছ ছাড়া করবেন না। আজকে তিনি আর ও নিশ্চিত যে তার দুই সন্তানের দায়িত্ব তিনি সঠিক নারীর কাছেই দিয়েছেন।মহারানী চলে যেতেই মৈথিলী যুবরাজ কে শুইয়ে দিল।
– আমি শোব না মৈথিলী” মৈথিলী যুবরাজের শয্যা প্রস্তুত করছিল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের মেঘের ঘনঘটায় নিজেকে যেন সত্যি নারী মনে হল মৈথিলীর। সে যুবরাজের দিকে তাকিয়ে যুবরাজ কে বলল
– যুবরাজ ঘুমতে হবে না আপনাকে, কিন্তু আপনি বিশ্রাম নিন।
– বেশ তবে তুমিও থাক আমার কাছে” যুবরাজের কথা শুনে মৈথিলী কেমন টলে উঠল। যুবরাজের গলায় কেমন যেন একটা অদ্ভুত মাদকতা ছিল।
– কিন্তু আপনি কালকে আমার বারন সত্বেও গেলেন কেন? আর গেলেন যদি অতো কম সেনা নিয়ে গেলেন কেন?
– কেন তুমি তো আমাকে জিষ্ণুর কাহিনী শুনিয়েছ? ও যদি একা একটা বিশাল সেনাবাহিনী কে সেশ করতে পারে আমি কেন পারব না”? যুবরাজ শয্যা তে উঠে এসে মৈথিলীর কোলে মাথা রেখে শুল। মৈথিলীর যুবরাজের কথায় না হেসে থাকতে পারল না। যুবরাজের নরম কেশে নিজের মোমের মতন নরম হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
– যুবরাজ, জিষ্ণু আর আপনি কি এক হলেন? আর জিষ্ণু একটা কাহিনী মাত্র। একজন হেরে যাওয়া যোদ্ধা। কিন্তু আমি খুব খুশি যে মাত্র সাতজন সেনা নিয়ে আপনি এক প্রহর কাল অতো গুলো সেনার সাথে যুদ্ধ করে আটকে রেখেছিলেন। আপনি অনেক বড় জিষ্ণুর থেকে”। মৈথিলীর প্রশংশায় যুবরাজ যেন একটু গলে গেল। নিজেকে মৈথিলীর কোলে আর ও ঢুকে এসে বলল
– কেন আমি জিষ্ণুর থেকে বড় হলাম কি করে?
– হি হি কেন নন আপনি? জিষ্ণু তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে যুবরাজ। মনে আছে কাহিনির সেশের ভাগে বলেছিলাম যে জিষ্ণু তার দুই ভাই কে নিয়ে নিজের মা কে বন্দী অবস্থায় রেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে। কিন্তু আপনি যুবরাজ, নিজেকেই সেশ করে দিচ্ছিলেন নিজের দেশ কে বাঁচাতে গিয়ে”
কাহিনী মৈথিলীর হলেও যুবরাজ নিজেকে জিষ্ণু ই ভাবেন। জিষ্ণু যুবরাজের আদর্শ। জিষ্ণুর অধ্যাবসায়, জিষ্ণুর বীরত্ব, জিষ্ণুর দুঃখ সব কিছুতেই যুবরাজ নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তাই মৈথিলীর মুখে জিষ্ণুর থেকে যুবরাজ কে বড় বলাতেই যুবরাজ খেপে উঠলেন যেন।মৈথিলীর রক্তাভ কেশ সজোরে নিজের হাতে আকর্ষণ করে যুবরাজ বলে উঠলেন
– জিষ্ণু কত দুঃখ সহ্য করে বড় হয়েছে। আজকে সে তার মা কে বন্দী অবস্থায় রেখে পালালেও আর কি কোন রাস্তা খোলা ছিল?
– আআআহহহহহ যুবরাজ , ব্যাথা পাচ্ছি আমি”। মৈথিলী যুবরাজের কেশ আকরশনের জন্য নিজের মাথা টা পিছনে করেই ছিল। কিন্তু মন টা একটা অপারথিব আনন্দে ভরে যাচ্ছিল। কারন একটি অষ্টাদশ বর্ষীয় পুরুষ জিষ্ণুর পালিয়ে বেড়ান টা কে সমর্থন করছে। এর অর্থ হল এটাই যে জিষ্ণু নিজে যে নিজের চোখে ছোট হয়ে গেছিল, সেটা ভুল। “যুবরাজ, আআহহহহ ব্যাথা পাচ্ছি আমি, আমাকে ক্ষমা করুন”।
যুবরাজ এর যেন ক্রোধ প্রশমিত হছছিল না। আর বয়সে অনেকটা বড় মৈথিলীর কেশ স্পর্শ করার পড়ে কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছিল শরীরে। চোখের সামনে মৈথিলীর মুখমণ্ডল এ ব্যাথার রেশ। কারন এখনো যুবরাজ মৈথিলীর কেশ নিজের হাত থেকে মুক্ত করেন নি।
যুবরাজের মনে হল অমন সুন্দর মুখ হয়ত তিনি আর কোনদিন দেখতে পাবেন না। তারপরে ব্যাথায় তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠ দেখে যুবক যুবরাজের মানসিক স্খলন অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিজের কাম বেগের কাছে ক্রোধ প্রশমিত হতে সময় লাগলো না যুবরাজের। দুটি নয়ন মৈথিলীর অরধন্মিলিত। দিরঘাঙ্গি, অদ্ভুত স্বল্প পুরুষালি, ভীষণ সুন্দরি মৈথিলীর এই আহ্বান অষ্টাদশ বর্ষীয় যুবরাজের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হল না। সরাসরি চুম্বন এঁকে দিলেন যুবরাজ, মৈথিলীর নরম ওষ্ঠে। নিজের নারী শরীর টা কেপে উঠল মৈথিলীর। ভীষণ একটা ভাল লাগা। কিন্তু মুহূর্তেই নিজের পরিচয় ভেবে সামলাতে উদ্যোগী হল মৈথিলী। যুবরাজ কে আলতো করে নরম হাতে সরানর চেষ্টা করতেই যুবরাজ মৈথিলীর কেশ ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে মৈথিলী কে নিজের বুকে টেনে আর ও সজোরে চুম্বনে রত হলেন। আসতে আসতে শুইয়ে দিলেন মৈথিলী কে। মৈথিলীর দুটি হাত নিজের দুই সবল হস্তে ধরে মৈথিলীর সুন্দর ঠোঁট দুটো কে যেন খেয়েই ফেলবেন এমন ভাবেই মথিত করছিলেন যুবরাজ। ঠিক সেই সময়ে ছোট যুবরাজের আওয়াজে যুবরাজ ছেড়ে দিলেন মৈথিলী কে। মৈথিলী সময় নষ্ট না করে দৌড়ে চলে এলো বাইরে। প্রাসাদের এক কোনায় নিজেকে নিয়ে পাগলের মতন মুছতে থাকল নিজের ঠোঁটে একে দেওয়া যুবরাজের চুম্বন। সে নিজে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বীর। আজ সেই কিনা পুরুষ দ্বারা আকর্ষিত? আর সুধু তাই নয় নিজের থেকে স্বল্প বয়সী পুরুষের ভোগ্যা? ভোগ্যা, নাকি এটা প্রেম? যুবরাজ ওর প্রেমে পড়েন নি তো? কোনে একটি বড় দর্পণে নিজেকে দেখে, জিষ্ণু হিসাবে মৈথিলীর প্রশংশাই করল মৈথিলী।
যুবরাজের কাছে যেতেই লজ্জা পাচ্ছে মৈথিলী। ছোট্ট যুবরাজ কে সে নিজেই শস্ত্র বিদ্যা শিখিয়েছে, আজকে সে পুরুষ। ভয় পায় না মৃত্যু কে। এগিয়ে যায় দেশের সেবায়, নিজের প্রজাদের সেবায় যুদ্ধক্ষেত্রে। দিনের আলোতে চুম্বনের আগে অবধি মৈথিলী যুবরাজ কে বুক দিয়েই আগলাত মাতৃ সম যত্নে। কিন্তু এখন কেমন যেন একটা আড়ষ্টতা। দেখলেই লজ্জা কান অবধি লাল করে দিচ্ছে। যুবরাজ ও যেন বদলে গেছেন। মৈথিলী কে যেন দেখতেই থাকছেন মাঝে মাঝে। মৈথিলী এড়িয়েই চলছে যুবরাজ কে। কিন্তু জানে বেশিক্ষন পারবে না এড়িয়ে থাকতে, কারন যুবরাজ কে না দেখে মৈথিলী নিজেও থাকতে পারবে না।
সন্ধ্যে বেলায় মহারাজ যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিয়ে এসেছেন। বালি যুদ্ধে গিয়ে তোমর রাজ কে বন্দী করতেই যুদ্ধ সেশ হয়ে যায় মুহূর্তেই। মৈথিলী জানে না রাজসভায় কি হচ্ছে এখন। কিন্তু খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল ছোড়দা কে। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী সর্ব শস্ত্রে পারদর্শী ওর ছোড়দা কে ও দেখেনি দুই বৎসর। আহা বড় নরম মনে মানুষ ওর ছোড়দা। ইসস খুব ভাল হয় যদি মহারাজ বালি কে সভায় কোন কাজ দেন। ও ছোট যুবরাজ কে নিজের কোলে বসিয়ে এই সব ভেবে চলেছিল।ঠিক সেই সময়েই মহারানী আর যুবরাজ এলেন কক্ষে।
– মৈথিলী, সাজা সাজা সব সাজা, আজকে মহারাজ বিজয়ী হয়ে ফিরেছেন” মৈথিলী দাঁড়িয়ে পড়ল, মহারানীর সামনে। – হ্যাঁ রানিমা, আজকে বড়ই খুশির দিন আমাদের”। যুবরাজ বলে উঠলেন,
– জান মৈথিলী, নীল নামে এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী যোদ্ধা আমাদের পিতা মহারাজ এর বিজয়ে সব থেকে বড় ভুমিকা নিয়েছিলেন”। মৈথিলী জানে যে নীল ছদ্মনামেই তার ছোড়দা বালি থাকেন এই রাজ্যেই। এদিকে যুবরাজ বলেই চলেছেন “ সেই মহামতি কে পিতা মহারাজ এই প্রাসাদে মহা পাচকের পদ দিয়েছেন”। খুশিতে যেন উছলে পড়ল মৈথিলী। ও খুব খুব চাইছিল যে ওর ছোড়দা যেন এখানেই থাকে। মৈথিলীর লজ্জা করলেও ছোড়দা কে দেখার লোভ সামলাতে পারল না। ও সরাসরি যুবরাজ কে বলেই বসল
– যুবরাজ , যে মহামতি আমাদের এই রাজ্য কে রক্ষা করলেন, তাকে কি একবার দর্শন করতে পারি”?।
– হা হা হা নিশ্চয়ই।
– না এখন না। যুবরাজ, এখন শুধু তুমি রাজ সভায় যাবে। তোমার বীরত্বের কথা মহারাজ বলবেন সর্ব সম্মুখে” এই কথা বলে মহারানী বেড়িয়ে গেলেন নিজের কক্ষে। মৈথিলীর ওপরে ভার দুই রাজ কুমার কে তৈরি করে রাজসভায় পাঠানো।
—————–
রাতে মৈথিলী শুয়ে আছে ছোট কুমারের পাশেই। গত দুইদিনের মেঘের ঘনঘটা যেন মহারাজের বিজয় সংবাদের পরেই উড়ে পালিয়েছে। আকাশে চাঁদের আলো যেন থই থই করছে। জানালা দিয়ে বিছানার ওপরে পরা আলো তে মৈথিলী যেন একটু উদ্বেলিত। যুবরাজ এখনো আসেন নি। যদিও শয্যা মৈথিলী বানিয়েই রেখেছে। ছোট থেকেই রাজপুত্র হলেও নিজের শয্যা বানানো টা গুরুদেব এবং মা দুজনাই শিখিয়েছিলেন। আর রাতে জিষ্ণু ঘুমত কখন? অন্ধকারে বান চালানোর অভ্যাস না ঘুমিয়েই করত জিষ্ণু। গুরুদেব বলতেন “জিষ্ণু ক্লান্তি আর অহং এই দুই মানুশের সব থেকে বড় শত্রু, এই দুই এর উপরেই যে জয় লাভ করে সে অপরাজেয়”।আজকে গুরুদেবের কৃপায় জিষ্ণু অনন্ত বিজয়। সমুখ সমরে জিষ্ণু কে কেউ হারাতেও পারে নি আর না কেউ পারবে। অহং বোধ কোন কালেই ছিল না জিষ্ণুর তাই অনায়াসেই আজকে রাজ পরিবারের দাসী হয়ে থাকতে কোন রূপ অসুবিধার সম্মুখীন হয় নি জিষ্ণু। নিজের অসম্ভব সুন্দর রূপ এর ওপরে ভরসা করে আর দাদা ভানুপ্রতাপের কৃপা তে ওর নারীবেশ তাবড় পুরুষের মন ও বিগলিত করে দেয়। ওর দাদা ভানুপ্রতাপ যুবরাজ হয়েও শরীর বিদ্যা তে বিশেষ পারদর্শী। শাস্ত্র বিদ্যায় অপরাজেয়। বিশাল বলশালী বালি ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। হস্তীর বল নিয়ে বালির সাথে যুদ্ধ করলেও টেকা যায় না। আর ও নিজে বিশ্বের সব থেকে বড় বীর। একদিনে হয় নি ও আজকের জিষ্ণু। বছরের পর বছর অভ্যাস করে ও ধনুর্বিদ্যা, অসি চালনা, এবং গরিলা যুদ্ধে অপরাজেয় হয়েছে। লোকে বলে জিষ্ণু যখন বান চালায় তখন নিক্ষেপিত দুটি বানের মাঝে কেশ সম স্থান ও থাকে না। ভুল কিছু বলে না সাধারন মানুষে। এমন বীরত্ব দেবদেবী রাও কল্পনা করতে পারেন না। ওর ধনুক হস্তীর দাঁত থেকে বানানো। দেখতে সামান্য হলেও সেই ধনুক তুলে তাতে গুন পরানো মুখের কথা নয়। কিন্তু সে সব ই জিষ্ণুর কাছে পালক তুলে ফেলার সমান মাত্র। অভ্যাস। একমাত্র অভ্যাস ই পারে মানুষ কে এমন নিখুত খুনে যোদ্ধা বানাতে।
একটা আওয়াজ এ মৈথিলী উঠে যুবরাজের কক্ষে উপস্থিত হল। দুই কক্ষের মাঝে একটি বড় দরজা খোলাই থাকত। দুই কুমারের দেখাশনার ভার যেহেতু মৈথিলীর ওপরে ছিল তাই এই দরজা টা মৈথিলী খুলেই রাখত। দেখল যুবরাজ টলছেন। বুঝল জিবনের প্রথম বার সোমরস পান করেছেন যুবরাজ। হেসে ফেলল মৈথিলী। সে নিজেও রাজপুত্র। যুবরাজ। দাদা ভানুপ্রতাপ কে লুকিয়ে সোমরস সেও পান করেছিল জ্ঞাতি ভাই দের সাথে। মৈথিলী আর কাছে গেল না। দুপুরে যুবরাজের কাণ্ড ওকে এখনো ভাবাচ্ছে………
– “আচ্ছা মৈথিলী, আমি এখনো বুঝতে পারছি না সেদিন আমাকে কে বাঁচাল? তুমি এখানে বলেছ, তুমি আমাকে সবাই কে হত্যা করে অচেতন অবস্থায় দেখেছিলে, এখানে সবাই এটাই ভাবছে যে আমি ওই ভয়ঙ্কর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলাম, কিন্তু আমি জানি এক দেব এসে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। জতক্ষন না আমি তাঁকে খুঁজে বের করতে পারব ততক্ষন আমি শান্তি পাচ্ছি না”। মৈথিলী কথাটা শুনে একটু চুপ করে গেল। ব্যাপার টা যে লোকের ভাবনার বিশয় হবে ভাবেনি ও নিজেই। সত্যি তো একটা সেনার টুকরি কে এক লহমায় সেশ করে দেবার ক্ষমতা দেবতাদের ই থাকে। ও তাও একবার চেষ্টা করল।
———————
– “যুবরাজ আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় সেদিন লড়াই টা আপনি নিজেই করেছিলেন”।
যুদ্ধের কিছুদিন বাদে এক প্রভাতে মৈথিলীর সাথে বাগানে ঘুরতে ঘুরতে যুবরাজের এই কথোপকথন চলছিল। যুবরাজ এখন মৈথিলীর সাথে কথপকথনের সুযোগ হাতছাড়া করেন না।মৈথিলীর অস্বস্তি হলেও যুবরাজ কে মৈথিলী নিজের থেকেও বেশী ভালবাসে। তাই অজান্তেই যুবরাজের চাওয়া কে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে মৈথিলী।
– না আমি লড়াই করিনি, আর অমন লড়াই আমি দেখিনি কোনদিন ও। অমন বিদ্যুতের থেকেও দ্রুত অসি চালনা আমি কল্পনাতেও আনতে পারছি না মৈথিলী। আমাকেও পারতে হবে অমন।
– যুবরাজ আপনিও পারবেন। অভ্যাস যুবরাজ অভ্যাস।
– জান মৈথিলী আমি যখন পিতা মহারাজ কে বলছিলাম ওই দেবতার কথা উনি বিড়বিড় করে দুবার যেন জিষ্ণুর নাম নিলেন”।“ আচ্ছা তুমি তো বলেছিলে জিষ্ণু একটা কাহিনী মাত্র”। ধরা পড়ে জাবার অপার ভয়ে মৈথিলী যুবরাজের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে একটি পুস্পের কাছে গিয়ে বলল- যুবরাজ আমি কোন দিন জিষ্ণু নামের মহান যোদ্ধা কে দেখিনি, তাই আমার কাছে উনি কাহিনীর নায়ক ছাড়া কিছুই নয়, বরং আপনি আমার কাছে ওর থেকে বড় নায়ক, কারন আপনার বীরত্ব আমি দেখেছি আমার চোখে”। যুবরাজ এর চোখ যেন খুশিতে ভরে উঠল। পিছন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৈথিলীর কাঁধে হাত রাখলেন যুবরাজ। অনায়াসে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকে টেনে নিলেন মৈথিলী কে। মৈথিলী প্রথমে একটু আবেগেই যুবরাজের বুকে মাথা দিয়েছিল। পরক্ষনেই তার মনে হল যে এটা যুবরাজের একান্ত উদ্যান হলেও মহারানীর অবাধ গতি সর্বত্র। – যুবরাজ আমাকে এবারে ছাড়ুন, মহারানী দেখতে পেলে আমাকে কেটে ভাসিয়ে দেবেন মা গঙ্গায়”। মৈথিলীর এই কথায় যে কোন পুরুষ ই জেগে উঠবে। এই কথাটায় ছিল এক সাথে অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর। এমন উত্তর জার প্রশ্ন যুবরাজের মাথাতেও আসেনি এখনো। বুদ্ধিমান যুবরাজ মৈথিলী কে বুকে আর ও টেনে নিয়ে একটি পাথরের ওপরে বসে মৈথিলীর শরীরের সুঘ্রাণ নিতে থাকলেন। আর ও কাছে টেনে নিয়ে মৈথিলী কে যুবরাজ বোঝালেন “ আমি তোমাকে ভালবাসি অনেক বেশি”। “তোমাকে ছাড়তে পারব না”। “তুমি অসহায়া নউ” আর “ তোমাকে কেটে ভাসিয়ে দেবার আগে আমি আছি আমার মাতা মহারানীর সামনে”।
হায় রে মৈথিলী, যুবরাজ কে ভয় দেখিয়ে নিজের থেকে দূরে সরাতে গিয়ে যুবরাজ কে উল্টে সাহসি করে দিল মৈথিলীর ওই অসহায় উক্তি। মৈথিলী ভুলেই যায় প্রায় যে জিষ্ণু কে যুবরাজ নিজের আদর্শ করেছে। কিন্তু অদ্ভুত, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বীরের মধ্যে নারী লুকিয়ে আছে, আর সেই নারী এক পুরুষ কে ভাল ও বেসে ফেলেছে। আর সেই পুরুষ বয়সে বেশ ছোট। অদ্ভুত। মহাসখার লীলা বোঝা বড় দায়। সখা বলেন “ ভেব না সখা অতো, যা হচ্ছে সেটা আমার ইচ্ছের বাইরে নয়”। কিন্তু এ কোন খেলা? কেন যুবরাজের ওপরে এতো ভালবাসা, অনুরাগ তার জন্মাল? কতক্ষন যে ছিল মৈথিলী যুবরাজের বাহু বন্ধনে জানে না। কিন্তু মৈথিলীর ওই একটি উক্তি যুবরাজ কে পুরুষ বানিয়ে দিয়ে গেল মানসিক ভাবে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই।
সাময়িক বিজয়ে রাজ্যে খুশির জোয়ার বয়ে গেলেও, অলক্ষ্যে বাঁধছিল ভয়ঙ্কর কুটিল শ্বাপদের ষড়যন্ত্র। রাজ্যের ভিতরেও রাজ্যের বাইরেও। ভানুপ্রতাপের মহারাজ কে বার বার বোঝানো দেখে এটাই মনে হয় যে ভানুপ্রতাপ আশঙ্কা করছেন কিছু বড় বিপদের। আসলে জম্বুদ্বীপের এই অঞ্চল কৃষি এবং পশুপালনে সর্বোত্তম। কাজেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে অনেক বড় রাজ্যের ই লক্ষ এই উল্লম দেশ। কাজেই তোমর রাজ্য যখন আক্রমন করেছে উল্লম কে তখন বড় বড় রাজ্য গুলো যেমন, বল্লভপুর, অবন্তিনগর, এই সমস্ত বড় রাজ্য গুলো শক্তি নিয়েই আসবে আক্রমন করতে। উল্লম রাজ্যের মহারাজ মহাবলশালী রাজা সূর্যশেখর তাই দেকে পাঠিয়েছেন রাজ্যের সব থেকে বড় বীর এবং ওনার ভাই বীর শার্দূল কে। উনি সেনাপতি। কিন্তু বছর তিনেক আগে রানিদের নিয়ে প্রমোদ ভ্রমনে গেছিলেন। এখন মহারাজের আহ্বানে রাজ্যে এসেছেন। মহা বলশালী, কিন্তু নারী পিপাসু। উনি আসার সাথে সাথেই সেনা দের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। উল্লম রাজ্য নিজের সেনা বল বাড়ানোর দিকে নজর দিল সভাসদ ভানুপ্রতাপের পরামর্শে।
“ মহারাজ আপনি কি যুবরাজ কে দেখছেন? ও কিন্তু বড় হচ্ছে, আর ভগবানের কৃপা তে বেশ বড় বীর ও”
– হ্যাঁ মহারানী, তুমি ঠিক বলেছ। আমি দেখেছি ওর অসি চালনা। মহারানী আমি জিষ্ণু কে দেখেছি যুদ্ধ করতে। তুমি হয়ত বললে খুব খুশি হবে, ওর অসি চালনা দেখে মনে হয় অবিকল জিষ্ণু যুদ্ধ করছে।
– কি বলছেন মহারাজ? কিন্তু মহাবীর জিষ্ণুর সাথে তো ওর কোন রকম যোগ ই নেই।
– সেই টাই তো চিন্তার ব্যাপার মহারানী। গত তিন বৎসর, জয় , জিষ্ণু আর বালি নিখোঁজ। আর তারপরে যুবরাজের কথায় সেদিন যে দেব পুরুষ যুবরাজ এর হয়ে যুদ্ধ করেছিল মহারানী আমি নিশ্চিত সে আর কেউ নয় স্বয়ং জিষ্ণু।
– সেটা কি করে হয় মহারাজ? অমন বিশাল দেবতুল্য শরীর নিয়ে জিষ্ণু এখানে থাকলে তাকে আমরা চিনতে পারব না?
– সেইটাই তো বড় চিন্তার বিষয়। তোমর রা আক্রমন করল, কোথা থেকে এক নীল নামে মানুষ এসে তোমর রাজের মতন অতো মহাপরাক্রমি বীর কে গলা ধাক্কা দিতে দিতে আমার পায়ের সামনে এসে ফেলল। কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মহারানী! যুবরাজের দেখভাল কেমন চলছে মহারানী?
– ভালই মহারাজ। অতি ভাল। দেখেন নি মৈথিলী কে আপনি? দিরঘাঙ্গি , ভীষণ সুন্দরি ওই পঞ্ছবিংশতি বৎসরের এক নারী। নিজের জীবন দিয়ে আমার পুত্রদের সেবা করে মহারাজ।
– অদ্ভুত। আমি দেখছি, মেয়েটির রূপ যেন ফেটে পড়ে। অথচ কৃষ্ণাঙ্গই। আবার যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মহারানী। যুবরাজ কে আমি বড় ওই মেয়েটির সাথে সময় কাটাতে দেখি। ভয় হয়, কিছু গোলমাল না হয়ে যায়।
ঠিক সেই সময়েই একজন দাররক্ষী এসে মহারাজ কে প্রনাম করে জানাল যে যুবরাজ, মৈথিলীর সাথে একসাথে মহারাজের দর্শন প্রার্থী। মহারাজের সম্মতি পেয়েই দ্বাররক্ষী ফিরে গেল। মহারাজ একবার মহারানীর দিকে তাকিয়ে সামনে দেখলেন সুদর্শন যুবরাজ আর যুবরাজের থেকেও লম্বা এক নারী যুবরাজের পিছন পিছন মহারাজের সামনে এসে দাঁড়াল। যুবরাজ প্রনাম করার পরেই মেয়েটি ও প্রনাম করল মহারাজ ও মহারানী কে।
– বল পুত্র, কি কামনায় দর্শন।
– পিতা আমি ধনুর্বিদ্যা শিখতে হিমালয়ের পাদদেশেই আমাদের ই রাজ্যের একটি অংশে যেতে চাই। জিষ্ণু আমার গুরু। ওনার মূর্তি সামনে রেখে আমি শিখতে চাই ধনুর্বিদ্যা।
– কিন্তু পুত্র এখানে তো অনেক নামকরা গুরু আছেন , তুমি সেখানেও শিখতে পার।
সে তো আমি শিখেছি মহারাজ, কিন্তু জিষ্ণুর সমকক্ষ হতে গেলে একান্তে তপস্যার প্রয়োজন। একজন তাপস হয়েই ওই রকম বীরত্ব অর্জন করতে চাই আমি পিতা।
– পুত্র, আমি খুব খুশি তুমি এমন একজনের নাম নিলে জাকে আমি অন্তর দিয়ে স্নেহ করি। কিন্তু জিষ্ণু যুগপুরুষ পুত্র। ওর সমকক্ষ তো স্বয়ং ইন্দ্রদেব ও নন।
– তাও আমি আমার তপস্যা থেকে বিরত থাকব না পিতা। ওনার কৃপা নিয়ে আমি ওনার নিকট থেকেই ধনুর্বিদ্যা শিখব।
মহারাজ বড়ই বিপদে পড়লেন। পুত্রের এ হেন অদ্ভুত আর্তি কে না মঞ্জুর করেও থাকা যায় না আর মঞ্জুরি দেওয়া মানে প্রাণপ্রিয় পুত্র বেশ কয়েক মাস হিমালয়ের কোন এক অঞ্চলে তপস্যায় রত থাকবে। তিনি বার বার ই তাকাচ্ছেন মহারানীর দিকে, আর মৈথিলীর দিকে। মৈথিলীর উন্নত গ্রীবা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার নিশ্চল ভঙ্গী যেন আবার মহারাজার সমস্ত অঙ্ক গুলিয়ে দিচ্ছিল। সেদিন তিনিও উপস্থিত ছিলেন, বল্লভপুরের রাজসভায়। ওই ঘটনার ঘনঘটায় সবাই যখন নিজের নিজের মতামত জানাচ্ছিল তখন একজনকেই ঠিক এইরকম ভাবে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিলেন তিনি। নাহ সে কি করে হবে। জিষ্ণু একজন ভয়ঙ্কর পেশাদার যোদ্ধা। যে যুদ্ধক্ষেত্রে দারালে শত্রু রা মিত্রতা করতে সময় নেয় না। আর এ তো একজন সামান্যা নারী। কিন্তু কি ভয়ঙ্কর তেজা এই নারী। কি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পাতলা রেশমের ওড়নায় ঢেকে রাখা ভীষণ সুন্দর মুখ টা যেন বার বার জানান দিচ্ছিল, সামান্যা দাসী নয় এই নারী টি।
মহারানী যুবরাজের পাশে বসে যুবরাজ কে খাওয়াচ্ছেন। মৈথিলী পাশেই থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে। যুবরাজ যেন উঠে এসেছেন কোন মৃত্যুর অতল থেকে। প্রাণপ্রিয় সন্তানের শারীরিক অবস্থার উন্নতি রাজ বৈদ্য ও বিশ্বাস করতে পারেন নি।কিন্তু মহারানীর কেন জানিনা মনে হয়েছে এই সবের পিছনে কোন দৈবী শক্তি আছে।যুবরাজ কে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা আর যুবরাজের শারীরিক অবস্থার এই অভূতপূর্ব উন্নতি র পিছনে তিনি কোন রাজবৈদ্য নয় দেখছেন বাড়ির কূলদেবতা সূর্য দেব কে।সকাল বিকেল কূলদেবতার পুজো তে বেশ কিছু সময় ব্যয় করছেন তিনি সেই কারনে। আর মৈথিলীর তৎপরতায় যুবরাজের জীবন প্রাপ্তি কেও অস্বীকার করছেন না।
তার স্থির বিশ্বাস এই আশ্রিতা দীর্ঘাঙ্গি নারী টি কোন সাধারন নারী নয়। শাস্ত্রজ্ঞান এ পারদর্শী এই নারীকে তিনি কখনই নিজের কাছ ছাড়া করবেন না। আজকে তিনি আর ও নিশ্চিত যে তার দুই সন্তানের দায়িত্ব তিনি সঠিক নারীর কাছেই দিয়েছেন।মহারানী চলে যেতেই মৈথিলী যুবরাজ কে শুইয়ে দিল।
– আমি শোব না মৈথিলী” মৈথিলী যুবরাজের শয্যা প্রস্তুত করছিল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের মেঘের ঘনঘটায় নিজেকে যেন সত্যি নারী মনে হল মৈথিলীর। সে যুবরাজের দিকে তাকিয়ে যুবরাজ কে বলল
– যুবরাজ ঘুমতে হবে না আপনাকে, কিন্তু আপনি বিশ্রাম নিন।
– বেশ তবে তুমিও থাক আমার কাছে” যুবরাজের কথা শুনে মৈথিলী কেমন টলে উঠল। যুবরাজের গলায় কেমন যেন একটা অদ্ভুত মাদকতা ছিল।
– কিন্তু আপনি কালকে আমার বারন সত্বেও গেলেন কেন? আর গেলেন যদি অতো কম সেনা নিয়ে গেলেন কেন?
– কেন তুমি তো আমাকে জিষ্ণুর কাহিনী শুনিয়েছ? ও যদি একা একটা বিশাল সেনাবাহিনী কে সেশ করতে পারে আমি কেন পারব না”? যুবরাজ শয্যা তে উঠে এসে মৈথিলীর কোলে মাথা রেখে শুল। মৈথিলীর যুবরাজের কথায় না হেসে থাকতে পারল না। যুবরাজের নরম কেশে নিজের মোমের মতন নরম হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
– যুবরাজ, জিষ্ণু আর আপনি কি এক হলেন? আর জিষ্ণু একটা কাহিনী মাত্র। একজন হেরে যাওয়া যোদ্ধা। কিন্তু আমি খুব খুশি যে মাত্র সাতজন সেনা নিয়ে আপনি এক প্রহর কাল অতো গুলো সেনার সাথে যুদ্ধ করে আটকে রেখেছিলেন। আপনি অনেক বড় জিষ্ণুর থেকে”। মৈথিলীর প্রশংশায় যুবরাজ যেন একটু গলে গেল। নিজেকে মৈথিলীর কোলে আর ও ঢুকে এসে বলল
– কেন আমি জিষ্ণুর থেকে বড় হলাম কি করে?
– হি হি কেন নন আপনি? জিষ্ণু তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে যুবরাজ। মনে আছে কাহিনির সেশের ভাগে বলেছিলাম যে জিষ্ণু তার দুই ভাই কে নিয়ে নিজের মা কে বন্দী অবস্থায় রেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে। কিন্তু আপনি যুবরাজ, নিজেকেই সেশ করে দিচ্ছিলেন নিজের দেশ কে বাঁচাতে গিয়ে”
কাহিনী মৈথিলীর হলেও যুবরাজ নিজেকে জিষ্ণু ই ভাবেন। জিষ্ণু যুবরাজের আদর্শ। জিষ্ণুর অধ্যাবসায়, জিষ্ণুর বীরত্ব, জিষ্ণুর দুঃখ সব কিছুতেই যুবরাজ নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তাই মৈথিলীর মুখে জিষ্ণুর থেকে যুবরাজ কে বড় বলাতেই যুবরাজ খেপে উঠলেন যেন।মৈথিলীর রক্তাভ কেশ সজোরে নিজের হাতে আকর্ষণ করে যুবরাজ বলে উঠলেন
– জিষ্ণু কত দুঃখ সহ্য করে বড় হয়েছে। আজকে সে তার মা কে বন্দী অবস্থায় রেখে পালালেও আর কি কোন রাস্তা খোলা ছিল?
– আআআহহহহহ যুবরাজ , ব্যাথা পাচ্ছি আমি”। মৈথিলী যুবরাজের কেশ আকরশনের জন্য নিজের মাথা টা পিছনে করেই ছিল। কিন্তু মন টা একটা অপারথিব আনন্দে ভরে যাচ্ছিল। কারন একটি অষ্টাদশ বর্ষীয় পুরুষ জিষ্ণুর পালিয়ে বেড়ান টা কে সমর্থন করছে। এর অর্থ হল এটাই যে জিষ্ণু নিজে যে নিজের চোখে ছোট হয়ে গেছিল, সেটা ভুল। “যুবরাজ, আআহহহহ ব্যাথা পাচ্ছি আমি, আমাকে ক্ষমা করুন”।
যুবরাজ এর যেন ক্রোধ প্রশমিত হছছিল না। আর বয়সে অনেকটা বড় মৈথিলীর কেশ স্পর্শ করার পড়ে কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছিল শরীরে। চোখের সামনে মৈথিলীর মুখমণ্ডল এ ব্যাথার রেশ। কারন এখনো যুবরাজ মৈথিলীর কেশ নিজের হাত থেকে মুক্ত করেন নি।
যুবরাজের মনে হল অমন সুন্দর মুখ হয়ত তিনি আর কোনদিন দেখতে পাবেন না। তারপরে ব্যাথায় তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠ দেখে যুবক যুবরাজের মানসিক স্খলন অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিজের কাম বেগের কাছে ক্রোধ প্রশমিত হতে সময় লাগলো না যুবরাজের। দুটি নয়ন মৈথিলীর অরধন্মিলিত। দিরঘাঙ্গি, অদ্ভুত স্বল্প পুরুষালি, ভীষণ সুন্দরি মৈথিলীর এই আহ্বান অষ্টাদশ বর্ষীয় যুবরাজের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হল না। সরাসরি চুম্বন এঁকে দিলেন যুবরাজ, মৈথিলীর নরম ওষ্ঠে। নিজের নারী শরীর টা কেপে উঠল মৈথিলীর। ভীষণ একটা ভাল লাগা। কিন্তু মুহূর্তেই নিজের পরিচয় ভেবে সামলাতে উদ্যোগী হল মৈথিলী। যুবরাজ কে আলতো করে নরম হাতে সরানর চেষ্টা করতেই যুবরাজ মৈথিলীর কেশ ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে মৈথিলী কে নিজের বুকে টেনে আর ও সজোরে চুম্বনে রত হলেন। আসতে আসতে শুইয়ে দিলেন মৈথিলী কে। মৈথিলীর দুটি হাত নিজের দুই সবল হস্তে ধরে মৈথিলীর সুন্দর ঠোঁট দুটো কে যেন খেয়েই ফেলবেন এমন ভাবেই মথিত করছিলেন যুবরাজ। ঠিক সেই সময়ে ছোট যুবরাজের আওয়াজে যুবরাজ ছেড়ে দিলেন মৈথিলী কে। মৈথিলী সময় নষ্ট না করে দৌড়ে চলে এলো বাইরে। প্রাসাদের এক কোনায় নিজেকে নিয়ে পাগলের মতন মুছতে থাকল নিজের ঠোঁটে একে দেওয়া যুবরাজের চুম্বন। সে নিজে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বীর। আজ সেই কিনা পুরুষ দ্বারা আকর্ষিত? আর সুধু তাই নয় নিজের থেকে স্বল্প বয়সী পুরুষের ভোগ্যা? ভোগ্যা, নাকি এটা প্রেম? যুবরাজ ওর প্রেমে পড়েন নি তো? কোনে একটি বড় দর্পণে নিজেকে দেখে, জিষ্ণু হিসাবে মৈথিলীর প্রশংশাই করল মৈথিলী।
যুবরাজের কাছে যেতেই লজ্জা পাচ্ছে মৈথিলী। ছোট্ট যুবরাজ কে সে নিজেই শস্ত্র বিদ্যা শিখিয়েছে, আজকে সে পুরুষ। ভয় পায় না মৃত্যু কে। এগিয়ে যায় দেশের সেবায়, নিজের প্রজাদের সেবায় যুদ্ধক্ষেত্রে। দিনের আলোতে চুম্বনের আগে অবধি মৈথিলী যুবরাজ কে বুক দিয়েই আগলাত মাতৃ সম যত্নে। কিন্তু এখন কেমন যেন একটা আড়ষ্টতা। দেখলেই লজ্জা কান অবধি লাল করে দিচ্ছে। যুবরাজ ও যেন বদলে গেছেন। মৈথিলী কে যেন দেখতেই থাকছেন মাঝে মাঝে। মৈথিলী এড়িয়েই চলছে যুবরাজ কে। কিন্তু জানে বেশিক্ষন পারবে না এড়িয়ে থাকতে, কারন যুবরাজ কে না দেখে মৈথিলী নিজেও থাকতে পারবে না।
সন্ধ্যে বেলায় মহারাজ যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিয়ে এসেছেন। বালি যুদ্ধে গিয়ে তোমর রাজ কে বন্দী করতেই যুদ্ধ সেশ হয়ে যায় মুহূর্তেই। মৈথিলী জানে না রাজসভায় কি হচ্ছে এখন। কিন্তু খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল ছোড়দা কে। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী সর্ব শস্ত্রে পারদর্শী ওর ছোড়দা কে ও দেখেনি দুই বৎসর। আহা বড় নরম মনে মানুষ ওর ছোড়দা। ইসস খুব ভাল হয় যদি মহারাজ বালি কে সভায় কোন কাজ দেন। ও ছোট যুবরাজ কে নিজের কোলে বসিয়ে এই সব ভেবে চলেছিল।ঠিক সেই সময়েই মহারানী আর যুবরাজ এলেন কক্ষে।
– মৈথিলী, সাজা সাজা সব সাজা, আজকে মহারাজ বিজয়ী হয়ে ফিরেছেন” মৈথিলী দাঁড়িয়ে পড়ল, মহারানীর সামনে। – হ্যাঁ রানিমা, আজকে বড়ই খুশির দিন আমাদের”। যুবরাজ বলে উঠলেন,
– জান মৈথিলী, নীল নামে এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী যোদ্ধা আমাদের পিতা মহারাজ এর বিজয়ে সব থেকে বড় ভুমিকা নিয়েছিলেন”। মৈথিলী জানে যে নীল ছদ্মনামেই তার ছোড়দা বালি থাকেন এই রাজ্যেই। এদিকে যুবরাজ বলেই চলেছেন “ সেই মহামতি কে পিতা মহারাজ এই প্রাসাদে মহা পাচকের পদ দিয়েছেন”। খুশিতে যেন উছলে পড়ল মৈথিলী। ও খুব খুব চাইছিল যে ওর ছোড়দা যেন এখানেই থাকে। মৈথিলীর লজ্জা করলেও ছোড়দা কে দেখার লোভ সামলাতে পারল না। ও সরাসরি যুবরাজ কে বলেই বসল
– যুবরাজ , যে মহামতি আমাদের এই রাজ্য কে রক্ষা করলেন, তাকে কি একবার দর্শন করতে পারি”?।
– হা হা হা নিশ্চয়ই।
– না এখন না। যুবরাজ, এখন শুধু তুমি রাজ সভায় যাবে। তোমার বীরত্বের কথা মহারাজ বলবেন সর্ব সম্মুখে” এই কথা বলে মহারানী বেড়িয়ে গেলেন নিজের কক্ষে। মৈথিলীর ওপরে ভার দুই রাজ কুমার কে তৈরি করে রাজসভায় পাঠানো।
—————–
রাতে মৈথিলী শুয়ে আছে ছোট কুমারের পাশেই। গত দুইদিনের মেঘের ঘনঘটা যেন মহারাজের বিজয় সংবাদের পরেই উড়ে পালিয়েছে। আকাশে চাঁদের আলো যেন থই থই করছে। জানালা দিয়ে বিছানার ওপরে পরা আলো তে মৈথিলী যেন একটু উদ্বেলিত। যুবরাজ এখনো আসেন নি। যদিও শয্যা মৈথিলী বানিয়েই রেখেছে। ছোট থেকেই রাজপুত্র হলেও নিজের শয্যা বানানো টা গুরুদেব এবং মা দুজনাই শিখিয়েছিলেন। আর রাতে জিষ্ণু ঘুমত কখন? অন্ধকারে বান চালানোর অভ্যাস না ঘুমিয়েই করত জিষ্ণু। গুরুদেব বলতেন “জিষ্ণু ক্লান্তি আর অহং এই দুই মানুশের সব থেকে বড় শত্রু, এই দুই এর উপরেই যে জয় লাভ করে সে অপরাজেয়”।আজকে গুরুদেবের কৃপায় জিষ্ণু অনন্ত বিজয়। সমুখ সমরে জিষ্ণু কে কেউ হারাতেও পারে নি আর না কেউ পারবে। অহং বোধ কোন কালেই ছিল না জিষ্ণুর তাই অনায়াসেই আজকে রাজ পরিবারের দাসী হয়ে থাকতে কোন রূপ অসুবিধার সম্মুখীন হয় নি জিষ্ণু। নিজের অসম্ভব সুন্দর রূপ এর ওপরে ভরসা করে আর দাদা ভানুপ্রতাপের কৃপা তে ওর নারীবেশ তাবড় পুরুষের মন ও বিগলিত করে দেয়। ওর দাদা ভানুপ্রতাপ যুবরাজ হয়েও শরীর বিদ্যা তে বিশেষ পারদর্শী। শাস্ত্র বিদ্যায় অপরাজেয়। বিশাল বলশালী বালি ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। হস্তীর বল নিয়ে বালির সাথে যুদ্ধ করলেও টেকা যায় না। আর ও নিজে বিশ্বের সব থেকে বড় বীর। একদিনে হয় নি ও আজকের জিষ্ণু। বছরের পর বছর অভ্যাস করে ও ধনুর্বিদ্যা, অসি চালনা, এবং গরিলা যুদ্ধে অপরাজেয় হয়েছে। লোকে বলে জিষ্ণু যখন বান চালায় তখন নিক্ষেপিত দুটি বানের মাঝে কেশ সম স্থান ও থাকে না। ভুল কিছু বলে না সাধারন মানুষে। এমন বীরত্ব দেবদেবী রাও কল্পনা করতে পারেন না। ওর ধনুক হস্তীর দাঁত থেকে বানানো। দেখতে সামান্য হলেও সেই ধনুক তুলে তাতে গুন পরানো মুখের কথা নয়। কিন্তু সে সব ই জিষ্ণুর কাছে পালক তুলে ফেলার সমান মাত্র। অভ্যাস। একমাত্র অভ্যাস ই পারে মানুষ কে এমন নিখুত খুনে যোদ্ধা বানাতে।
একটা আওয়াজ এ মৈথিলী উঠে যুবরাজের কক্ষে উপস্থিত হল। দুই কক্ষের মাঝে একটি বড় দরজা খোলাই থাকত। দুই কুমারের দেখাশনার ভার যেহেতু মৈথিলীর ওপরে ছিল তাই এই দরজা টা মৈথিলী খুলেই রাখত। দেখল যুবরাজ টলছেন। বুঝল জিবনের প্রথম বার সোমরস পান করেছেন যুবরাজ। হেসে ফেলল মৈথিলী। সে নিজেও রাজপুত্র। যুবরাজ। দাদা ভানুপ্রতাপ কে লুকিয়ে সোমরস সেও পান করেছিল জ্ঞাতি ভাই দের সাথে। মৈথিলী আর কাছে গেল না। দুপুরে যুবরাজের কাণ্ড ওকে এখনো ভাবাচ্ছে………
– “আচ্ছা মৈথিলী, আমি এখনো বুঝতে পারছি না সেদিন আমাকে কে বাঁচাল? তুমি এখানে বলেছ, তুমি আমাকে সবাই কে হত্যা করে অচেতন অবস্থায় দেখেছিলে, এখানে সবাই এটাই ভাবছে যে আমি ওই ভয়ঙ্কর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলাম, কিন্তু আমি জানি এক দেব এসে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। জতক্ষন না আমি তাঁকে খুঁজে বের করতে পারব ততক্ষন আমি শান্তি পাচ্ছি না”। মৈথিলী কথাটা শুনে একটু চুপ করে গেল। ব্যাপার টা যে লোকের ভাবনার বিশয় হবে ভাবেনি ও নিজেই। সত্যি তো একটা সেনার টুকরি কে এক লহমায় সেশ করে দেবার ক্ষমতা দেবতাদের ই থাকে। ও তাও একবার চেষ্টা করল।
———————
– “যুবরাজ আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় সেদিন লড়াই টা আপনি নিজেই করেছিলেন”।
যুদ্ধের কিছুদিন বাদে এক প্রভাতে মৈথিলীর সাথে বাগানে ঘুরতে ঘুরতে যুবরাজের এই কথোপকথন চলছিল। যুবরাজ এখন মৈথিলীর সাথে কথপকথনের সুযোগ হাতছাড়া করেন না।মৈথিলীর অস্বস্তি হলেও যুবরাজ কে মৈথিলী নিজের থেকেও বেশী ভালবাসে। তাই অজান্তেই যুবরাজের চাওয়া কে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে মৈথিলী।
– না আমি লড়াই করিনি, আর অমন লড়াই আমি দেখিনি কোনদিন ও। অমন বিদ্যুতের থেকেও দ্রুত অসি চালনা আমি কল্পনাতেও আনতে পারছি না মৈথিলী। আমাকেও পারতে হবে অমন।
– যুবরাজ আপনিও পারবেন। অভ্যাস যুবরাজ অভ্যাস।
– জান মৈথিলী আমি যখন পিতা মহারাজ কে বলছিলাম ওই দেবতার কথা উনি বিড়বিড় করে দুবার যেন জিষ্ণুর নাম নিলেন”।“ আচ্ছা তুমি তো বলেছিলে জিষ্ণু একটা কাহিনী মাত্র”। ধরা পড়ে জাবার অপার ভয়ে মৈথিলী যুবরাজের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে একটি পুস্পের কাছে গিয়ে বলল- যুবরাজ আমি কোন দিন জিষ্ণু নামের মহান যোদ্ধা কে দেখিনি, তাই আমার কাছে উনি কাহিনীর নায়ক ছাড়া কিছুই নয়, বরং আপনি আমার কাছে ওর থেকে বড় নায়ক, কারন আপনার বীরত্ব আমি দেখেছি আমার চোখে”। যুবরাজ এর চোখ যেন খুশিতে ভরে উঠল। পিছন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৈথিলীর কাঁধে হাত রাখলেন যুবরাজ। অনায়াসে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকে টেনে নিলেন মৈথিলী কে। মৈথিলী প্রথমে একটু আবেগেই যুবরাজের বুকে মাথা দিয়েছিল। পরক্ষনেই তার মনে হল যে এটা যুবরাজের একান্ত উদ্যান হলেও মহারানীর অবাধ গতি সর্বত্র। – যুবরাজ আমাকে এবারে ছাড়ুন, মহারানী দেখতে পেলে আমাকে কেটে ভাসিয়ে দেবেন মা গঙ্গায়”। মৈথিলীর এই কথায় যে কোন পুরুষ ই জেগে উঠবে। এই কথাটায় ছিল এক সাথে অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর। এমন উত্তর জার প্রশ্ন যুবরাজের মাথাতেও আসেনি এখনো। বুদ্ধিমান যুবরাজ মৈথিলী কে বুকে আর ও টেনে নিয়ে একটি পাথরের ওপরে বসে মৈথিলীর শরীরের সুঘ্রাণ নিতে থাকলেন। আর ও কাছে টেনে নিয়ে মৈথিলী কে যুবরাজ বোঝালেন “ আমি তোমাকে ভালবাসি অনেক বেশি”। “তোমাকে ছাড়তে পারব না”। “তুমি অসহায়া নউ” আর “ তোমাকে কেটে ভাসিয়ে দেবার আগে আমি আছি আমার মাতা মহারানীর সামনে”।
হায় রে মৈথিলী, যুবরাজ কে ভয় দেখিয়ে নিজের থেকে দূরে সরাতে গিয়ে যুবরাজ কে উল্টে সাহসি করে দিল মৈথিলীর ওই অসহায় উক্তি। মৈথিলী ভুলেই যায় প্রায় যে জিষ্ণু কে যুবরাজ নিজের আদর্শ করেছে। কিন্তু অদ্ভুত, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বীরের মধ্যে নারী লুকিয়ে আছে, আর সেই নারী এক পুরুষ কে ভাল ও বেসে ফেলেছে। আর সেই পুরুষ বয়সে বেশ ছোট। অদ্ভুত। মহাসখার লীলা বোঝা বড় দায়। সখা বলেন “ ভেব না সখা অতো, যা হচ্ছে সেটা আমার ইচ্ছের বাইরে নয়”। কিন্তু এ কোন খেলা? কেন যুবরাজের ওপরে এতো ভালবাসা, অনুরাগ তার জন্মাল? কতক্ষন যে ছিল মৈথিলী যুবরাজের বাহু বন্ধনে জানে না। কিন্তু মৈথিলীর ওই একটি উক্তি যুবরাজ কে পুরুষ বানিয়ে দিয়ে গেল মানসিক ভাবে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই।
সাময়িক বিজয়ে রাজ্যে খুশির জোয়ার বয়ে গেলেও, অলক্ষ্যে বাঁধছিল ভয়ঙ্কর কুটিল শ্বাপদের ষড়যন্ত্র। রাজ্যের ভিতরেও রাজ্যের বাইরেও। ভানুপ্রতাপের মহারাজ কে বার বার বোঝানো দেখে এটাই মনে হয় যে ভানুপ্রতাপ আশঙ্কা করছেন কিছু বড় বিপদের। আসলে জম্বুদ্বীপের এই অঞ্চল কৃষি এবং পশুপালনে সর্বোত্তম। কাজেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে অনেক বড় রাজ্যের ই লক্ষ এই উল্লম দেশ। কাজেই তোমর রাজ্য যখন আক্রমন করেছে উল্লম কে তখন বড় বড় রাজ্য গুলো যেমন, বল্লভপুর, অবন্তিনগর, এই সমস্ত বড় রাজ্য গুলো শক্তি নিয়েই আসবে আক্রমন করতে। উল্লম রাজ্যের মহারাজ মহাবলশালী রাজা সূর্যশেখর তাই দেকে পাঠিয়েছেন রাজ্যের সব থেকে বড় বীর এবং ওনার ভাই বীর শার্দূল কে। উনি সেনাপতি। কিন্তু বছর তিনেক আগে রানিদের নিয়ে প্রমোদ ভ্রমনে গেছিলেন। এখন মহারাজের আহ্বানে রাজ্যে এসেছেন। মহা বলশালী, কিন্তু নারী পিপাসু। উনি আসার সাথে সাথেই সেনা দের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। উল্লম রাজ্য নিজের সেনা বল বাড়ানোর দিকে নজর দিল সভাসদ ভানুপ্রতাপের পরামর্শে।
“ মহারাজ আপনি কি যুবরাজ কে দেখছেন? ও কিন্তু বড় হচ্ছে, আর ভগবানের কৃপা তে বেশ বড় বীর ও”
– হ্যাঁ মহারানী, তুমি ঠিক বলেছ। আমি দেখেছি ওর অসি চালনা। মহারানী আমি জিষ্ণু কে দেখেছি যুদ্ধ করতে। তুমি হয়ত বললে খুব খুশি হবে, ওর অসি চালনা দেখে মনে হয় অবিকল জিষ্ণু যুদ্ধ করছে।
– কি বলছেন মহারাজ? কিন্তু মহাবীর জিষ্ণুর সাথে তো ওর কোন রকম যোগ ই নেই।
– সেই টাই তো চিন্তার ব্যাপার মহারানী। গত তিন বৎসর, জয় , জিষ্ণু আর বালি নিখোঁজ। আর তারপরে যুবরাজের কথায় সেদিন যে দেব পুরুষ যুবরাজ এর হয়ে যুদ্ধ করেছিল মহারানী আমি নিশ্চিত সে আর কেউ নয় স্বয়ং জিষ্ণু।
– সেটা কি করে হয় মহারাজ? অমন বিশাল দেবতুল্য শরীর নিয়ে জিষ্ণু এখানে থাকলে তাকে আমরা চিনতে পারব না?
– সেইটাই তো বড় চিন্তার বিষয়। তোমর রা আক্রমন করল, কোথা থেকে এক নীল নামে মানুষ এসে তোমর রাজের মতন অতো মহাপরাক্রমি বীর কে গলা ধাক্কা দিতে দিতে আমার পায়ের সামনে এসে ফেলল। কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মহারানী! যুবরাজের দেখভাল কেমন চলছে মহারানী?
– ভালই মহারাজ। অতি ভাল। দেখেন নি মৈথিলী কে আপনি? দিরঘাঙ্গি , ভীষণ সুন্দরি ওই পঞ্ছবিংশতি বৎসরের এক নারী। নিজের জীবন দিয়ে আমার পুত্রদের সেবা করে মহারাজ।
– অদ্ভুত। আমি দেখছি, মেয়েটির রূপ যেন ফেটে পড়ে। অথচ কৃষ্ণাঙ্গই। আবার যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মহারানী। যুবরাজ কে আমি বড় ওই মেয়েটির সাথে সময় কাটাতে দেখি। ভয় হয়, কিছু গোলমাল না হয়ে যায়।
ঠিক সেই সময়েই একজন দাররক্ষী এসে মহারাজ কে প্রনাম করে জানাল যে যুবরাজ, মৈথিলীর সাথে একসাথে মহারাজের দর্শন প্রার্থী। মহারাজের সম্মতি পেয়েই দ্বাররক্ষী ফিরে গেল। মহারাজ একবার মহারানীর দিকে তাকিয়ে সামনে দেখলেন সুদর্শন যুবরাজ আর যুবরাজের থেকেও লম্বা এক নারী যুবরাজের পিছন পিছন মহারাজের সামনে এসে দাঁড়াল। যুবরাজ প্রনাম করার পরেই মেয়েটি ও প্রনাম করল মহারাজ ও মহারানী কে।
– বল পুত্র, কি কামনায় দর্শন।
– পিতা আমি ধনুর্বিদ্যা শিখতে হিমালয়ের পাদদেশেই আমাদের ই রাজ্যের একটি অংশে যেতে চাই। জিষ্ণু আমার গুরু। ওনার মূর্তি সামনে রেখে আমি শিখতে চাই ধনুর্বিদ্যা।
– কিন্তু পুত্র এখানে তো অনেক নামকরা গুরু আছেন , তুমি সেখানেও শিখতে পার।
সে তো আমি শিখেছি মহারাজ, কিন্তু জিষ্ণুর সমকক্ষ হতে গেলে একান্তে তপস্যার প্রয়োজন। একজন তাপস হয়েই ওই রকম বীরত্ব অর্জন করতে চাই আমি পিতা।
– পুত্র, আমি খুব খুশি তুমি এমন একজনের নাম নিলে জাকে আমি অন্তর দিয়ে স্নেহ করি। কিন্তু জিষ্ণু যুগপুরুষ পুত্র। ওর সমকক্ষ তো স্বয়ং ইন্দ্রদেব ও নন।
– তাও আমি আমার তপস্যা থেকে বিরত থাকব না পিতা। ওনার কৃপা নিয়ে আমি ওনার নিকট থেকেই ধনুর্বিদ্যা শিখব।
মহারাজ বড়ই বিপদে পড়লেন। পুত্রের এ হেন অদ্ভুত আর্তি কে না মঞ্জুর করেও থাকা যায় না আর মঞ্জুরি দেওয়া মানে প্রাণপ্রিয় পুত্র বেশ কয়েক মাস হিমালয়ের কোন এক অঞ্চলে তপস্যায় রত থাকবে। তিনি বার বার ই তাকাচ্ছেন মহারানীর দিকে, আর মৈথিলীর দিকে। মৈথিলীর উন্নত গ্রীবা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার নিশ্চল ভঙ্গী যেন আবার মহারাজার সমস্ত অঙ্ক গুলিয়ে দিচ্ছিল। সেদিন তিনিও উপস্থিত ছিলেন, বল্লভপুরের রাজসভায়। ওই ঘটনার ঘনঘটায় সবাই যখন নিজের নিজের মতামত জানাচ্ছিল তখন একজনকেই ঠিক এইরকম ভাবে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিলেন তিনি। নাহ সে কি করে হবে। জিষ্ণু একজন ভয়ঙ্কর পেশাদার যোদ্ধা। যে যুদ্ধক্ষেত্রে দারালে শত্রু রা মিত্রতা করতে সময় নেয় না। আর এ তো একজন সামান্যা নারী। কিন্তু কি ভয়ঙ্কর তেজা এই নারী। কি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পাতলা রেশমের ওড়নায় ঢেকে রাখা ভীষণ সুন্দর মুখ টা যেন বার বার জানান দিচ্ছিল, সামান্যা দাসী নয় এই নারী টি।