24-04-2021, 12:14 AM
সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গল সরযূর। দুচোখ বন্ধ রেখেই হাত বাড়াল নবীনকে ছুঁতে। কিন্তু পেল না। না পেয়ে চোখ খুলল সে, চোখ ত নয় যেন একজোড়া খঞ্জনপাখি ডানা মেলল একসাথে!
বিছানায় নেই নবীন, ঘরেও না...
তাড়াতাড়ি উঠে বসলো সরযূ। আধখোলা জানলা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে নরম বিছানায়। শেষ কার্তিকের হিমেল পরশে ঘর যথেষ্ট ঠান্ডা। চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলো সরযূ। তারপর লঘু পায়ে নেমে এল বিছানা থেকে। বিছানার কোণায় কুন্ডুলি পাকানো গতরাতের শাড়ী-জামা টেনে নিয়ে পরল সে। বিসস্ত্র বিছানার দিকে তাকিয়ে সুখের একটা শিরশিরানি তার দেহ-মন আচ্ছন্ন করলো ক্ষনিকের জন্য। তারপরেই অভিমানে তার টুলটুলে মুখ আরক্ত হয়ে উঠল।
আমাকে না জানিয়ে তুমি যাও কোন অধিকারে.....? তোমার যাত্রার জন্য সরযূ কি তোমাকে প্রস্তুত করে দিত না? সরযূর মন খারাপ হবে? তা তো হবেই, কিন্তু তাই বলে তুমি বাড়ী থেকে বেরোনোর আগে তাকে বলে যাবে না? কেন কেন.....???
নিতল চোখ ছলছলে হয়ে ওঠে তার।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শোবার ঘরের দরজা খুলে বাইরে পা দিয়েই নিশ্চল হয়ে গেল সরযূ। দেরাজের ঘরে দাঁড়িয়ে জামা-কাপড় পরছে নবীন। সাত সকালেই স্নান করে একদম প্রস্তুত।
মুহূর্তে সব অভিমান গলে জল হয়ে গেল সরযূর, সোজা ছুটে গিয়ে পেছন থেকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরলো নবীনকে।
"তুমি ঘুমচ্ছিলে, তাই আর জাগাইনি।" শান্ত স্বরে জবাব দেয় নবীন।
নবীনকে তার দিকে ঘুরিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে নবীনের বুকে মাথা রাখল সরযূ। অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করলো সে।
নারীকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে তার মুখের কাছে মুখ নামালো নবীন। গভীর আবেগে চুমু খেল তার ঠোঁটে, কপালে, গালে। সর্বসত্তা দিয়ে শুষে নিল যেন সরযূ তার পুরুষের সোহাগ। তারপর আরো নিবিড়ভাবে নবীনকে বাহুবন্ধন করে জিজ্ঞেস করলো - "তুমি যেখানে যাচ্ছ সেটা কি অনেকদিনের পথ?"
"তা, খানিকদূর ত বটেই।" উত্তর দিল নবীন।
"দিনে দিনে গিয়ে ফিরে আসা যায় না?"
"না।"
"কেন?"
হেসে ফেলল নবীন। এই কথার কি উত্তর দেবে সে?
কিন্তু সরযূর মুখে কোন হাসি নেই। নবীনকে ছেড়ে একঘণ্টাও থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই মানুষটা তার শ্বাস প্রশ্বাস, ভালবাসা, সোহাগ, আশ্রয়...... সব কিছু। অথচ তাকে ছেড়ে এই বাড়ীতে.... একলা... সেটা একরাত হতে পারে, দুরাত বা তার বেশি হতে পারে, কোন চিন্তার কারণ অবশ্যই নেই, কিন্তু এই কটাদিন তাকে ছেড়ে থাকা...?
নবীন দেখল সরযূর দুচোখে জল টলটল করছে। অপাপবিদ্ধ কুসুমকোমল মুখখানি অত্যন্ত করুণ। এক দীর্ঘশ্বাস বেরলো তার বুক থেকে। আলতো করে সরযূর চোখের জল মুছিয়ে দিল সে। তারপর তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল - "শোনো। বুড়ো সর্দার বড় দুঃখ পাবে আমি একবার তার সঙ্গে দেখা না করলে। হয়ত তোমার আমার কথা তার কানে গেছে। হয়ত সেজন্যই আমার দেখা পেতে চায়। এক্ষেত্রে তাকে এড়িয়ে যাওয়া কি ঠিক? ঠাকুরমশাই দেবীকে সাক্ষী রেখে আমাদের আশীর্বাদ করেছেন স্বামী-স্ত্রী রূপে।সবাই জানে যে তিনি আজ পর্যন্ত কোন অন্যায় বা কোন অন্যায় সম্পর্ক প্রশ্রয় দেননি। সুতরাং এ খবরটা হয়ত সর্দার আমার কাছ থেকেই জানতে চায়। শুধুমাত্র দুদিন বই ত নয়।আমি যাব আর আসব। নিতাই আছে... পরমা আছে... তোমার ভয়ের কি আছে? আমি বলে দিয়েছি, রাতে পরমা তোমার কাছে থাকবে, কেমন? নাও মুখ তোল। চোখের জলে বিদায় দিতে নেই। তাতে অকল্যাণ হয়।"
মুখ তুলে একমনে নবীনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল সরযূ। তারপর - "তুমি একটু দাঁড়াও," বলেই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
এখান থেকে গোপীবল্লভপুর, সেখান থেকে ঠাকুরানির চর পেরিয়ে কুসুমগঞ্জের ঘাট... এবার নদী পেরোতে হয় তাকে কুসুমগঞ্জ থেকে নৌকো ধরতে হবে... নয়ত আরো এগিয়ে পীরের ঘাট থেকে। তাতে সময় প্রায় একই লাগবে বীরগঞ্জ পৌঁছতে। এখন প্রশ্নটা হলো যে তার বাহনকে রাখবে কোথায়? ঘোড়া নিয়ে ত আর নৌকোতে ওঠা যাবে না! এক যদি নিলু হারামজাদার কাছে রাখা যায়! কিন্তু তাতে শুয়োরটা সঙ্গে যেতে চাইবে...! শালা এত্তবড় ন্যাওটা!!! হুমমম...
জামা কাপড় পরতে পরতে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো নবীন।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যদি রওনা হওয়া যায় তাহলে কুসুমগঞ্জ পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যাবে। তাতে করে যেটা হবে যে ঠাকুরানির চর পেরোতে হবে সন্ধ্যেবেলা। সেক্ষেত্রে......
ভিজে কাপড়ে ঘরে ঢুকল সরযূ। এর মধ্যে ঘাটে গিয়ে একডুব দিয়ে এসেছে সে।
"সেকি তুমি চান করলে যে?" অবাক হয় নবীন।
"ও কিছু না।" বলে দেরাজ হাঁটকে একটা লালপাড় ডুরে শাড়ী বার করলো সরযূ। তার সাথে জামা আর সায়া।
"একটু ধরো ত..." বলে নবীনের হাতে শাড়ী জামা ধরিয়ে দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েই ভিজে শাড়ীটা গা থেকে খুলে ফেলল সরযূ। সকালের আলোয় বিশ্বপ্রকৃতির সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য শিল্পনিদর্শন যেন নবীনের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো স্বমহিমায়।
সরযূকে ল্যাংটো অবস্থায় দেখেছে নবীন। শুধু দেখা নয়, প্রাণভরে গ্রহন করেছে সে রূপঐশ্বর্য্যের রসমাধুর্য্য নিজের হাড়ে-মজ্জায়, নিজের সমস্ত সত্ত্বা সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে। হৃদয় উজাড় করে আত্মদান করেছে নিজেকে এই নারীর কাছে। তবু যেন তার চোখও ঝলসে গেল এই বহ্নিসম রূপদর্শনে। তার মনে হল যেন বর্ষার কালোমেঘের থেকে উৎপন্ন বিজলী কোন অমোঘ মন্ত্রবলে স্তব্ধ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
নবীন তখন নেহাতই বালক। তাদের বাড়ীর কাছেই থাকতো রাখালদাদু। আসল নাম রাখাল চন্দ্র পাল। প্রতিমাশিল্পী ছিল রাখালদাদু। জনশ্রুতি যে রাখাল পালের মতো মৃৎশিল্পী শুধু উত্তরবঙ্গ বা বাংলাদেশ কেন আসমুদ্র ভারতবর্ষ খুঁজলেও আর দ্বিতীয় পাওয়া যাবে না। লোকে সেকালে বলাবলি করত যে রাখাল পাল প্রতিমা গড়ার সময় স্বর্গের দেব-দেবীরা স্বয়ং এসে তার সাহায্যকারী হয়। আট কি নয় বছরের নবীনের একটা অভ্যাস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শরৎকালের ভোরবেলায় একছুট্টে রাখালদাদুর বাড়ী গিয়ে দু'চোখ সার্থক করে তাঁর প্রতিমানির্মাণ দেখা। চোখে ভালো দেখতে পেত না রাখালদাদু, কিন্তু তাঁর আঙ্গুলগুলো সামান্যমাটির তাল নিয়ে যে সুর মূর্ছনা তুলত তা বালক নবীনের কাছে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময়। কতদিন হয়েছে যে মা অথবা বাপ গিয়ে তার কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে না আসা পর্যন্ত সে সেখানে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়ে থেকেছে।
আজ এতকাল পরে সরযূর সদ্যস্নাত রূপমঞ্জরী তাকে যেন সেই সুদূর অতীতের বাল্যকালে নিয়ে চলে গেল এক লহমায়।
সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে গামছা দিয়ে নিজের চুল মুছছিলো সরযূ। নবীনের দিকে তাকিয়ে তার চুল মোছা থেমে গেল।
অদ্ভুত স্বপ্নালুচোখে তাকে দেখছে নবীন। সে দৃষ্টিতে কাম নেই, নেই বিন্দুমাত্র লোভ বা লালসা, যেন এক ঝটকায় কালের আবর্ত ছুঁড়ে ফেলে কোন অজানা অমৃতলোকের সান্নিধ্যপিপাসু এক আত্মবিস্মৃত আত্মনিবেদিত প্রাণ।
এক অজানা বিহ্ববলতায় ভেসে গেল সরযূ। সানাই তাদের বাজে নি, শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথে গাঁটছড়া বেঁধে একপাকও হাঁটেনি তারা দুজনে অগ্নিসাক্ষী রেখে....! সবরকম সামাজিকতা লৌকিকতার বিধি নিষেধ লঙ্ঘন করে পরস্পর শুধুমাত্র একে অপোরের মধ্যে একে অপরকে খুঁজে নেওয়ার চিনে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নিমজ্জিত। কে এ...?
ডাকাত? তাহলে শুধুমাত্র এই ডাকাতের বৌ হতে, এই ডাকাতের ভবিষ্যৎ সন্তানের গর্বিত জননী হতে শত সহস্রবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে রাজী সরযূ!!!
“কি দেখছ অমন করে?” শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো সে।
"তোমাকে" শান্ত নীচু স্বরে উত্তর দিল নবীন।
"আমাকে দেখ নি?" কাছে এসে দুই বাহুতে তার গলা আবদ্ধ করে নবীনের মুখের কাছে মুখ তুলে বলল সরযূ।
"হ্যাঁ" নারীকে বাহুমধ্যে বেঁধে অষ্ফুটস্বরে উত্তর দেয় নবীন।
"তাহলে?" গদগদ গলায় বলে সরযূ। মোহময় চোখে সামান্য চটুলতার আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় যেন।
"আমি জানি না" ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল নবীন।
ছোট্টো একটা নিঃশ্বাস ফেলে নবীনের মুখের একেবারে কাছে নিজের মুখটা তুলে ধরলো সরযূ। তারপর দুই হাতে নবীনের মাথাটা নিজের দিকে টেনে গভীরভাবে তার চোখে চোখ রাখল।
"অনেকদূরের রাস্তা যাচ্ছ। হয়ত বা চার পাঁচ দিন অথবা তার বেশি সময় লাগবে বাড়ী ফিরতে। আমি কিন্তু পথ চেয়ে বসে থাকব। আর একটা কথা, বিদেশ-বিঁভুই যাই হোক কথা দাও এই জন্মে কোনদিন অন্য কোন মেয়েমানুষের দিকে চোখ তুলে চাইবে না?"
"না।"
"কথা দাও।"
"দিলাম।"
"মনে থাকে যেন।"
"থাকবে।"
নবীনের সামনে দাঁড়িয়ে সায়া জামা শাড়ী পরল সরযূ। তারপর একগলা ঘোমটা টেনে পা ছুঁয়ে প্রনাম করলো নবীনকে।
নারীকে দুই বাহু ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে নিবিড়ভাবে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো নবীন। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো তার মুখখানি।
আদুরে মুখে স্বামীর ভালবাসা গ্রহন করলো সরযূ। হৃদয় উজাড় করে দীর্ঘ বিলম্বিত চুম্বন করলো নবীনের ঠোঁটে।
"কত্তা?" সামান্য উচ্চস্বরের ডাক ভেসে আসে নিতাইয়ের, বাড়ীর বাইরে থেকে।
ডাকটা কানে যেতেই সম্বিত ফেরে নবীন সরযূর। পরস্পরের বাহুমুক্ত হয় তারা।
বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে আসে নবীন। বাহনকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে ফেলেছে নিতাই। প্রভুভক্ত অশ্ব কেশর ঝাঁকিয়ে মৃদু হ্রেশ্বাধ্বনি করে ওঠে।
"শোন নেত্য! চোখ-কান খোলা রাখবি, আমি বেশি দেরি করব না ফিরতে। আর হ্যাঁ, কটা দিন ধরে দেখছি তোর বড় তামাকের মাত্রাটা আবার বেড়েছে! ওটাকে এবার জিরেন দে!!!"
লজ্জায় মুখ নীচু করে নিতাই। কত্তা জানলো কি করে..? সে তাড়াতাড়ি দু'কানে হাত ঠেকিয়ে নীচু হয়ে প্রনাম করে নবীনকে।
ছোট্টো একটা পুঁটুলি হাতে করে ঘর থেকে বেরচ্ছিল সরযূ। নিতাইয়ের অবস্থা দেখে সেও হাসি চাপতে তাড়াতাড়ি মুখে আঁচল চাপা দিল।
"কিছু বলবে?" সরযূর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে নবীন।
"এটা ধরো। সামান্য কিছু খাবার আছে এতে, খিদে পেলে খেও[b]।" বলে পুঁটুলিটা নবীনের হাতে দেয় সরযূ।[/b]
"ঠিক আছে," তারপর ঘোড়ার বল্গা ধরে বাড়ীর বাইরে নিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে চড়ে বসে তার পীঠে।
পূর্ণদৃষ্টিতে ফিরে তাকায় নবীন সরযূর দিকে। কুসুমের মতো মুখখানি সামান্য ব্যাথিত, অতল চোখে তাকিয়ে নবীনের দিকে।
"আসছি..." বলেই দ্রুত অশ্বচালনা করে নবীন। ওই চোখে যে কি আছে আর কি নেই.....!!!
***