20-04-2021, 04:34 PM
স্নেহ ঝোরা
আজ শনিবার, শ্রীময়ের অফিসে 'ছুটি'। এই লক ডাউনের সময়ে ছুটিছাটার তেমন কদর থাকবে না, ভেবেছিল রূপাঞ্জনা। আর ভেবেছিল ওকে বোধহয় আজ অন্তত একটু কাজে হেল্প করবে শ্রীময়! কিন্তু সে গুড়ে বালি! শ্রীময় আজ উঠল ই সাড়ে দশটায়। তারপর চা খেয়ে গড়িমসি করে ওয়েব সিরিজ নিয়ে বসল। ও একটু মুখ ঝামটা দেওয়ায় বলল 'আহ্, আজ আমার ছুটি, সারা সপ্তাহ খুব মাথার খাটনি গেছে গো...প্লিজ একটু মাথা ছাড়াতে দাও!' তা সেই 'মাথা ছাড়ানোর' বহর এখনো চলছে! দুপুর দুপুর তিনি একবার উঠে, নিরামিষ খাবার দেখে মুখ ভেটকে লাঞ্চ করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন! ধন্য বাবা!
টেনে ঝগড়া করবে ভেবেছিল রূপাঞ্জনা। সারাদিন একা একা খাটতে হচ্ছে ওকে। প্রথম দিকে তবু ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন বিরক্তি লাগছে ওর। ক্লান্ত ও লাগছে। সকাল থেকে ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা...আজ নিরামিষ বলে দুটো পদ এক্সট্রা করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে কোমর টা ধরে গেছে একদম। কিন্তু, শোয়া যাবে না। তাহলেই বিকেলে শরীর ম্যাজম্যাজ করবে। খানিকক্ষণ টিভি দেখল...কিন্তু ভাল লাগছে না আর। তাই 'কি করা যায়..' ভাবতে ভাবতে দেওয়ালে টাঙানো ওর আর শ্রীময়ের বিয়ের ছবিটার দিকে চোখ গেল ওর। আর কি মনে হতে খুব ইচ্ছে করল সেই দিন টাকে একবার ফিরে দেখতে।
আর যেই না ভাবা... শো কেস থেকে গাবদা এলবাম টা বের করে নিয়ে এলো ও। প্রথমে গতানুগতিক ছবি... কাকিমা জেঠিমাদের জল সইতে যাওয়া, দধিমঙ্গল...দেখতে দেখতে রূপাঞ্জনা যেন ফিরে যাচ্ছিল ওর সেই পুরোনো দিন গুলোতে। তিন তিনটে বছর কেটে গেছে, তাও মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা...। মা বিধবা বলে কিছুতেই ওর বিয়েতে থাকবেন না ঠিক করেছিলেন, আর ও ও ছাড়বে না! বিয়েতেই বসবে না ঠিক করেছিল।।শেষমেষ ওর জেদের কাছে মা কে হার মানতেই হয়েছিল।
এলবাম উল্টোতে উল্টোতে চোখে পড়ল ওর গায়ে হলুদের ছবি গুলো। হাসি মুখের ছবি। ইস, তখন কি জানত বিয়ে মানেই খেটে মরা! উফ, তখন তো জানত না,ওর বর টা এমনি কুঁড়ের হদ্দ হবে!
গায়ে হলুদের একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল ওর। শেফালি মাসির ছবি। অনেক মহিলার মাঝে, হাতে যেন কি একটা ধরা। একটা লাল তাঁতের শাড়ি পরা...। কালো শীর্ণ চেহারা, হি হি করে হাসছে, দাঁতের সামনে টা একটু ভাঙা...। কিন্তু সেই হাসিতে একটুও মালিন্য নেই। একদম প্রান খোলা খুশির হাসি।
দেখেই,মন টা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রায় ওর জন্মের সময় থেকেই শেফালি মাসি ওদের বাড়িতে কাজ করেন। ওর মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ও বলা যায়, আবার মায়ের মেন ডিটেকটিভ ও। এমনকি, শ্রীময়ের সাথে ওর রোজ ফোনে গুজগুজের খবর শেফালি মাসি ই মা কে দিয়েছিল! তারপর তো ইতিহাস! নামে রান্না বান্নার কাজ হলেও, শেফালি মাসি আসলে ওদের বাড়ির ম্যানেজার। আর ও কি কম জ্বালিয়েছে ওঁকে!
ভাবতে ভাবতেই কেমন চোখে জল এলো ওর। বিয়ের আগে ওজন কমাতে হবে বলে হরেক রকম ডায়েট শুরু করেছিল ও। ঘন্টায় ঘন্টায় তার যোগান দেওয়া থেকে শুরু করে, মাথায় হট অয়েল ম্যাসাজ...কি না করিয়েছে ও মাসিকে দিয়ে!
অথচ কখনো ধন্যবাদ দেয়নি।
না, মুখের 'থ্যাংকইউ' না...সত্যিকারের মন থেকে আসা ধন্যবাদ!
উলটে মেজাজ ও দেখিয়েছে কত!
আর এখন বাড়ির উনকোটি চৌষট্টি কাজ করতে করতে ও বুঝতে পারছে, সংসারের সবার কাজ করা, ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে, কতটা কঠিন! তাও নিজের সংসার না, অন্যের সংসার...অন্যের সন্তানের জন্য...।
তাড়াতাড়ি সোফা থেকে উঠে পড়ল রূপাঞ্জনা। এক্ষুনি ফোন করতে হবে, শেফালি মাসিকে। না বরাবরের মতো মা কে ফোন করে এক আধদিন যেমন ভাবে কথা বলে তেমনি ভাবে না, শুধু মাসির সাথেই গল্প করার জন্য ফোন করবে...। বলবে...'শোনো না, তোমার বানানো ঝিঙে পোস্ত টা খুব মিস করছি! ওটা মায়ের থেকেও ভালো বানাও তুমি। এই করোনা দৈত্য হেরে গেলে, আমরা যখন সবাই ভাল থাকব, আমাকে শিখিয়ে দেবে তুমি, ওটা? আমি নিজে রাঁধব তোমার জন্য'। আর বলবে 'কোনোদিন বলিনি মাসি...কিন্তু ভাগ্যিস তুমি ছিলে? তাই তো বাবা ছিলেন না, তাও স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বড় হয়েছি আমি...মা তোমার কাছে আমাকে নিশ্চিন্তে রেখে কলেজে পড়াতে যেতে পারতেন...অথচ সেই আমি বিয়ের সময় মা কে কাছে রেখেছিলাম, নিজে নিজেকে বাহবা দিয়েছিলাম...সংস্কার ভাঙছি বলে...অথচ...তোমাকে একবার ও ডাকিনি...আমাকে ক্ষমা করে দিও মাসি...তিনবছর পরে হলেও...আর এবছর মায়ের সাথে তুমিও আমার জন্য ষষ্ঠী রেখো, রাখবে তো?'
দ্রুত হাতে অপরিচিত অথচ অনেকদিন ধরে স্টোর করা নাম্বার টা ডায়াল করতে থাকে রূপাঞ্জনা।
ও জানে, হিন্দি ছবিতে নায়ক-নায়িকার ঝুটো কষ্ট দেখে কেঁদে ভাসানো শেফালি মাসি আজ ওর কথা শুনেও কাঁদবে...কিন্তু চোখের জলের মাঝে হীরের কুঁচির মতো হাসিও লেগে থাকবে...মেয়ের ফোন যাচ্ছে যে...।
করোনার বিধিবদ্ধ সতর্কীকরনের পর ফোনটা বাজছে এবার...পাহাড়ি ঝোরার বাঁধ ভেঙে দেবার অপেক্ষায়...।
আজ শনিবার, শ্রীময়ের অফিসে 'ছুটি'। এই লক ডাউনের সময়ে ছুটিছাটার তেমন কদর থাকবে না, ভেবেছিল রূপাঞ্জনা। আর ভেবেছিল ওকে বোধহয় আজ অন্তত একটু কাজে হেল্প করবে শ্রীময়! কিন্তু সে গুড়ে বালি! শ্রীময় আজ উঠল ই সাড়ে দশটায়। তারপর চা খেয়ে গড়িমসি করে ওয়েব সিরিজ নিয়ে বসল। ও একটু মুখ ঝামটা দেওয়ায় বলল 'আহ্, আজ আমার ছুটি, সারা সপ্তাহ খুব মাথার খাটনি গেছে গো...প্লিজ একটু মাথা ছাড়াতে দাও!' তা সেই 'মাথা ছাড়ানোর' বহর এখনো চলছে! দুপুর দুপুর তিনি একবার উঠে, নিরামিষ খাবার দেখে মুখ ভেটকে লাঞ্চ করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন! ধন্য বাবা!
টেনে ঝগড়া করবে ভেবেছিল রূপাঞ্জনা। সারাদিন একা একা খাটতে হচ্ছে ওকে। প্রথম দিকে তবু ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন বিরক্তি লাগছে ওর। ক্লান্ত ও লাগছে। সকাল থেকে ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা...আজ নিরামিষ বলে দুটো পদ এক্সট্রা করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে কোমর টা ধরে গেছে একদম। কিন্তু, শোয়া যাবে না। তাহলেই বিকেলে শরীর ম্যাজম্যাজ করবে। খানিকক্ষণ টিভি দেখল...কিন্তু ভাল লাগছে না আর। তাই 'কি করা যায়..' ভাবতে ভাবতে দেওয়ালে টাঙানো ওর আর শ্রীময়ের বিয়ের ছবিটার দিকে চোখ গেল ওর। আর কি মনে হতে খুব ইচ্ছে করল সেই দিন টাকে একবার ফিরে দেখতে।
আর যেই না ভাবা... শো কেস থেকে গাবদা এলবাম টা বের করে নিয়ে এলো ও। প্রথমে গতানুগতিক ছবি... কাকিমা জেঠিমাদের জল সইতে যাওয়া, দধিমঙ্গল...দেখতে দেখতে রূপাঞ্জনা যেন ফিরে যাচ্ছিল ওর সেই পুরোনো দিন গুলোতে। তিন তিনটে বছর কেটে গেছে, তাও মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা...। মা বিধবা বলে কিছুতেই ওর বিয়েতে থাকবেন না ঠিক করেছিলেন, আর ও ও ছাড়বে না! বিয়েতেই বসবে না ঠিক করেছিল।।শেষমেষ ওর জেদের কাছে মা কে হার মানতেই হয়েছিল।
এলবাম উল্টোতে উল্টোতে চোখে পড়ল ওর গায়ে হলুদের ছবি গুলো। হাসি মুখের ছবি। ইস, তখন কি জানত বিয়ে মানেই খেটে মরা! উফ, তখন তো জানত না,ওর বর টা এমনি কুঁড়ের হদ্দ হবে!
গায়ে হলুদের একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল ওর। শেফালি মাসির ছবি। অনেক মহিলার মাঝে, হাতে যেন কি একটা ধরা। একটা লাল তাঁতের শাড়ি পরা...। কালো শীর্ণ চেহারা, হি হি করে হাসছে, দাঁতের সামনে টা একটু ভাঙা...। কিন্তু সেই হাসিতে একটুও মালিন্য নেই। একদম প্রান খোলা খুশির হাসি।
দেখেই,মন টা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রায় ওর জন্মের সময় থেকেই শেফালি মাসি ওদের বাড়িতে কাজ করেন। ওর মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ও বলা যায়, আবার মায়ের মেন ডিটেকটিভ ও। এমনকি, শ্রীময়ের সাথে ওর রোজ ফোনে গুজগুজের খবর শেফালি মাসি ই মা কে দিয়েছিল! তারপর তো ইতিহাস! নামে রান্না বান্নার কাজ হলেও, শেফালি মাসি আসলে ওদের বাড়ির ম্যানেজার। আর ও কি কম জ্বালিয়েছে ওঁকে!
ভাবতে ভাবতেই কেমন চোখে জল এলো ওর। বিয়ের আগে ওজন কমাতে হবে বলে হরেক রকম ডায়েট শুরু করেছিল ও। ঘন্টায় ঘন্টায় তার যোগান দেওয়া থেকে শুরু করে, মাথায় হট অয়েল ম্যাসাজ...কি না করিয়েছে ও মাসিকে দিয়ে!
অথচ কখনো ধন্যবাদ দেয়নি।
না, মুখের 'থ্যাংকইউ' না...সত্যিকারের মন থেকে আসা ধন্যবাদ!
উলটে মেজাজ ও দেখিয়েছে কত!
আর এখন বাড়ির উনকোটি চৌষট্টি কাজ করতে করতে ও বুঝতে পারছে, সংসারের সবার কাজ করা, ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে, কতটা কঠিন! তাও নিজের সংসার না, অন্যের সংসার...অন্যের সন্তানের জন্য...।
তাড়াতাড়ি সোফা থেকে উঠে পড়ল রূপাঞ্জনা। এক্ষুনি ফোন করতে হবে, শেফালি মাসিকে। না বরাবরের মতো মা কে ফোন করে এক আধদিন যেমন ভাবে কথা বলে তেমনি ভাবে না, শুধু মাসির সাথেই গল্প করার জন্য ফোন করবে...। বলবে...'শোনো না, তোমার বানানো ঝিঙে পোস্ত টা খুব মিস করছি! ওটা মায়ের থেকেও ভালো বানাও তুমি। এই করোনা দৈত্য হেরে গেলে, আমরা যখন সবাই ভাল থাকব, আমাকে শিখিয়ে দেবে তুমি, ওটা? আমি নিজে রাঁধব তোমার জন্য'। আর বলবে 'কোনোদিন বলিনি মাসি...কিন্তু ভাগ্যিস তুমি ছিলে? তাই তো বাবা ছিলেন না, তাও স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বড় হয়েছি আমি...মা তোমার কাছে আমাকে নিশ্চিন্তে রেখে কলেজে পড়াতে যেতে পারতেন...অথচ সেই আমি বিয়ের সময় মা কে কাছে রেখেছিলাম, নিজে নিজেকে বাহবা দিয়েছিলাম...সংস্কার ভাঙছি বলে...অথচ...তোমাকে একবার ও ডাকিনি...আমাকে ক্ষমা করে দিও মাসি...তিনবছর পরে হলেও...আর এবছর মায়ের সাথে তুমিও আমার জন্য ষষ্ঠী রেখো, রাখবে তো?'
দ্রুত হাতে অপরিচিত অথচ অনেকদিন ধরে স্টোর করা নাম্বার টা ডায়াল করতে থাকে রূপাঞ্জনা।
ও জানে, হিন্দি ছবিতে নায়ক-নায়িকার ঝুটো কষ্ট দেখে কেঁদে ভাসানো শেফালি মাসি আজ ওর কথা শুনেও কাঁদবে...কিন্তু চোখের জলের মাঝে হীরের কুঁচির মতো হাসিও লেগে থাকবে...মেয়ের ফোন যাচ্ছে যে...।
করোনার বিধিবদ্ধ সতর্কীকরনের পর ফোনটা বাজছে এবার...পাহাড়ি ঝোরার বাঁধ ভেঙে দেবার অপেক্ষায়...।