10-04-2021, 06:56 AM
(This post was last modified: 10-04-2021, 06:57 AM by modhon. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
১৩
রাকা ফোন টা রেখে জাল টানা দেখছিল। নাহ পুকুরে নেই। মোহিত বলল – স্যার পুকুরে নেই আমি সিওর।
– হুম্ম আমিও সিওর। পুকুরে নেই।
– স্যার কিছুদিন আগে বারুইপুরের একটি বাড়িতে চুরি হয়েছিল। আমাদের থানার আন্ডার এ নয়। সেখানেও ওই হাজার পাঁচেক টাকা চুরি হয়েছিল, কিন্তু ওদের বাড়ির বড় বউ পরের দিন সকাল থেকে মিসিং হয়ে যায়”। রাকা শুনেছিল ঘটনা টা। কিন্তু দুটো ঘটনায় অনেক সামঞ্জস্য থাকলেও দুটো কে এক করার সময় আসে নি এখনো। যদি এক রকম হয় ও তার মানে একটাই হয় যে চুরি করা কোন উদ্দেশ্য নয়। বাড়ির দুজন বয়স্কা মহিলার গায়েব হয়ে যাওয়া টা খুব একটা সমাপতন নয়। রাকা মোহিত কে বলল “ ঠিক আছে তুমি একটা মিসিং ডায়রি নাও এদের কাছ থেকে”।
– ওকে স্যার, স্যার আরেক টা কথা, জানিনা এই ঘটনার সাথে এই মিসিং গুলোর কোন রিলেশন আছে কিনা, কিন্তু কথা টা না বলেও পারছি না
– কি? রাকা চুপ করে গেল , মোহিতের কথা টার জন্য ওয়েট করতে লাগলো।
– স্যার, আমাদের খাদ্য মন্ত্রীর ছেলে, রকি ।
– হুম্ম ওর কি?
– ওকে আমি ওদের ফার্ম হাউস এ প্রতি রাতে যেতে দেখি ওর প্রাইভেট গাড়ি করে।
– তাতে কি হয়েছে?
– স্যার সেদিন যে মহিলা টি মিসিং হয়েছিল, তার ডেড বডি ওই ফার্ম হাউসের পিছনে যে নদি টা আছে সেই নদির একটা খাড়ি তে ফার্ম হাউস থেকে ঠিক এক কিমি দূরে পাওয়া গেছিল। আর মহিলাকে বেশ কয়েকবার রেপ করা হয়েছিল। আমরা পরীক্ষা করিয়েছিলাম।
– হুম্মম্ম। আজকে লক্ষ্য রাখ মোহিত। নদির ওপার থেকে আর এ পার থেকেও।
– কিন্তু স্যার সত্যি বলতে ওই ফার্ম হাউস টা যে থানার আন্ডার এ পড়ে সেই থানার ওসি পরের দিন ই তল্লাশি চালিয়েছিল ফার্ম হাউস এ। কিন্তু ওই রাতে বন্ধু বান্ধবদেড় সাথে মদ খাওয়া ছাড়া আর কোন প্রমান ই পায় নি। ও সি এখন সাসপেন্ড হয়ে বসে আছে। আমাদের সাবধান এ কাজ করতে হবে। তবে আমি সিওর যে ওই মহিলার রেপ আর মার্ডার এর সাথে ওই ফার্ম হাউসের যোগাযোগ আছেই।
এদিকে বহুদূরে, গঙ্গার উপনদী ক্ষীরাই এর তীরে জঙ্গলের ভিতর একটা বড় মাচা বাঁধা রয়েছে। এই জঙ্গল টি খুব একটা ঘন তা কিন্তু নয়। বরং কাঁটা ঝোপ বেশী। ভীষণ সাপের উপদ্রব। সন্ধ্যের নরম সূর্যের আলোতে, ক্ষীরাই এর জলে দুব দিয়ে উঠে এলো একজন বৃদ্ধ। বয়েস প্রায় সত্তরের উপরে। কিন্তু দীর্ঘ ঋজু দেহ প্রমান করে যে এখনো তিনি যথেষ্ট শক্তিশালী। বেশ দৃঢ় পদক্ষেপ এ উঠে এলেন নদি থেকে। নিজের ভিজে যাওয়া সাদা ধুতি টা ছেড়ে শুকনো ধুতি পড়ে নিলেন। খালি পেশীবহুল গায়ে একটা সাদা কাপড় জড়িয়ে নিয়ে পাশে রাখা একটা ছোট মেশিন গান তুলে নিলেন। রিভলবার টা কোমরে গুঁজে নিয়ে উঠে পড়লেন মাচা তে। অন্ধকার নেমে এলো যেন ঝুপ করে জঙ্গলের মধ্যে। এই জঙ্গলের সুবিধা হল সুন্দর বনের শুরু এই জঙ্গল। নদী দিয়ে ঘেরা। কাঁটা গাছে পরিপূর্ণ। আর চল্লিশ কিলোমিটার আশে পাশে কোন মানুষের বসতি নেই। এই দিকে ক্ষীরাই নদী, পিছনে কপিলা নদী। আর দুটো নদী গিয়েই মিশেছে বিশাল বপু গঙ্গার সাথে। ঠিক কুড়ি মাইল গেলেই স্বয়ং বিদ্যাধরী এসে মিশেছে গঙ্গার সাথে। পুলিশ কেন সেনা বাহিনী ও ভয় পাবে এই অঞ্চলে এসে থানা গাড়তে। স্বয়ং দক্ষিনানারায়ন মাঝে মাঝেই এই অঞ্চলে পদধূলি দিয়ে যান। কাজেই মানুষের ভয় এই অঞ্চলে কম। ক্ষীরাই এ যখন জোয়ার আসে এই মাচার নীচে অবধি টইটম্বুর করে নোনা জল। মাচার উপরেই বই খাতা কলম আর বন্দুক সব নিয়েই থাকেন এই বৃদ্ধ। হাত ঘড়ি টা দেখে নিলেন বৃদ্ধ একবার, সাতটা বাজতে চলল, মানে আর বড়জোর ঘণ্টা দুয়েক। তারপরেই জোয়ার আসবে। মাচার ওপর থেকেই দেখলেন দূরে একটা টর্চের আলো জ্বলেই নিভে গেল। একটু সতর্ক হলেন উনি। আবার জ্বলেই নিভল। ঠিক দশ সেকেন্ড গুনলেন বৃদ্ধ, আবার টর্চ টা জ্বলেই নিভল। যেন একটু হাঁফ ছারলেন বৃদ্ধ। জলের ছলাত ছলাত আওয়াজ পেলেন বৃদ্ধ। অন্ধকার সয়ে যাবার ফলে একটা বিশাল বজরার অবয়ব দৃষ্টি গোচর হল বৃদ্ধর। উনি নেমে এলেন মাচা থেকে। বজরা থেমে গেল যেন ঘাটের একটু দূরে। বৃদ্ধ জলে নামলেন না। আওয়াজে বুঝলেন দুটো শব্দ হালকা হল। যেন বজরা থেকে কেউ জলে নামল। ঠিক মিনিট দশেক পড়ে দেখলাম ভুঁইফোঁড়ের মতন দুটো দীর্ঘ দেহি মানুষ এগিয়ে আসছে। উনি মুখ তা সরু করে হালকা একটা শীষ ভাসিয়ে দিলেন যেন। লোক দুটো থেমে গেল। ঠিক ওই রকম ই আরেক একটা শীষের আওয়াজ ভেসে এলো। বৃদ্ধ কিছু না বলে সরে এলেন অখান থেকে। লোক দুটো আর থামল না সোজা ঢুকে গেল জঙ্গলের ভীতরে।
– এই বারে সবাই চুপ কর”। এই কথাতে ঘরে উপস্থিত সবাই চুপ করে গেল। ঘর বলতে পাতা দিয়ে ছাওয়া একটা অস্থায়ী বাঁশের চাটাই এর ঘর মাত্র। ঘরে উপস্থিত সবাই দেখল চাটাই এর ফাঁক দিয়ে একটা হলুদ রঙের আলো অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে আসছে। ঘর বিশেষ বড় না হলেও মাত্র একটি লন্ঠন জ্বলছিল। তাতে সকলের মুখ ও ঠিক করে দেখা যাচ্ছিল না। আলো টা ঘরের কাছে আসতেই নিভে গেল। আর ঘরের মধ্যে একজন দীর্ঘদেহী পুরুষের প্রবেশ ঘটল। উপস্থিত সবাই দেখল যে বিশাল দেহি পুরুষ টির মুখ ঢাকা। এসে গুরু গম্ভীর স্বরে সবাই কে সম্বোধন করে বলতে শুরু করলেন
– ভাই সব, আজকে আমরা এখানে মিলিত হয়েছি, তার কারন হল আমাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে সরকার এবং সরকারের প্রতিনিধি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের কেউ মা, কেউ বাবা্*, কেউ বা নিজের স্ত্রী সন্তানদের হারিয়ে সর্বস্বান্ত।আমি এখানে কোন প্রতিশোধের জ্বালায় সরকারের বিপক্ষে যাই নি। আমি চাই সরকার কে মানে আমাদের জনসাধারন কে বোঝাতে, যে যাদের ভরসায় ওরা রাতে নিশ্চিন্তে শুতে যায়, তারাই সেই মানুষ গুলোর খতিসাধনে মত্ত হয়ে ওঠে। আমি এই নিষ্ঠুর সরকারের বিপক্ষে, কিন্তু আমাদের মানুষদের বিপক্ষে নেই। তাই এটা যেন মাথায় থাকে, জন সাধারন কোন ভাবেই যেন আমাদের দ্বারা ক্ষতি গ্রস্ত না হয়। মনে রাখবেন বন্ধুরা, আমাদের সব থেকে বড় শক্তি হল আমাদের জন সাধারন। সরকারের বিপক্ষে এরাই আমাদের লড়তে সাহস আর এরাই আমাদের সাহায্য দেন। আগামী কাল শহরে বড় জনসভা আছে। কিসের জনসভা? আমাদের ভাইদের সরকার থেকে বোঝাতে আসবেন যাতে এখানকার জমি সঙ্ক্রান্ত আইন বদলান যায়। কই সরকার তো বলল না যে এই আদিম সুন্দরবনের কি ভাবে উন্নতি সাধন করা যায়? কই সরকার তো বলল না কি ভাবে এই নোনা জলে চাষ বাস করা যায়? এর থেকেই স্পষ্ট যে সরকার অন্য খেলায় মেতেছে। আমাদের বেশ কিছু কৃষিবিজ্ঞানী, বড় জামুই তে ধান উৎপন্ন করেছেন। আমি এটাই দেখাতে চাই সবাই কে যে সরকার যা পারছে না, সেটা আমরা করছি। আমাদের চাই না এই সরকারের হস্তক্ষেপ আমাদের জমিতে। কালকে যা যা প্ল্যান আছে সেই অনুযায়ী হবে। জয় হিন্দ”।
মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল ঘর টা। আবার যখন আলো জ্বলল দেখা গেল মানুষ টি আর নেই ঘরের মধ্যে।
– গাছ দাদু ও গাছ দাদু!!!
– আয় রে মিনু ঘরে আয়। দারা আসছি
– একদম আসবে না তুমি, আমি নিজেই পারব”। মিনু ধরে ধরে এগিয়ে গেল বাড়ির মধ্যে। মিনু অন্ধ। দুটো চোখেই দেখতে পায় না। জন্মান্ধ। এখন বয়েস পঁচিশ মতন। বিয়ে হয় নি। কিন্তু এই সুন্দরবনের জঙ্গলের দেশে মেয়েরা খুব ই সহজ লভ্যা। কেউ মিনু কে সংসারের লোভ দেখিয়ে ভোগ করেছিল তখন মিনু অনেক ছোট। তার ই ফলে মিনুর একটি সন্তান হয়। সেই ছেলেটি এখন ক্লাস ফাইভ এ পড়ে। পরশুরাম ওরফে পরশু এই দ্বীপের একমাত্র কলেজের একমাত্র শিক্ষক। মিনু কে পরশু পেয়েছিল ছেলে সমেত শহরের একটা নোংরা জায়গায়। সেখান থেকে নিয়ে এসেছিল এখানে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। সেই থেকে এখানেই আছে মিনু। পরশু ওকে বিধবা সুনি র কাছে থাকতে দিয়েছিল। সুনি ও না বলে নি। ওরা মা বেটি হয়ে কোন রকমে দিন চালায়। ওদের হাতে বানানো রঙ বে রঙ এর ক্রাফট পরশু শহরে দোকানে বিক্রি করে আসে।
– কই গো দাদু কি রান্না করলে আজকে?
– আজকে? আজ দারুন রেঁধেছি রে
– হি হি তোমার দারুন মানে তো আলু ভাতে আর ভাত
– ওটা কম হল নাকি রে?
– নাহ সেটা না, আমি জানতাম তুমি ওমনি একটা কিছু করবে, তাই আমি কচুশাক রেঁধেছি নিয়ে এলাম।
– বা বা বা, তবে ওই দুয়ারে রাখ”। মিনু জানে কোথায় কি আছে। ঠিক হাতড়ে হাতড়ে রেখে এলো বাটি টা দুয়ারে। প্রথম প্রথম মিনু বাড়িতে ঢুকেই চারিদিকে ঘুরে বেড়াত আর গাছের স্পর্শ পেত।
– এটা কি গাছ দাদু?
– বেগুন
– আর এটা?
– ওটা আমের চারা।
– হিহি এখানে আমের চারা? আর হলেও সে যে কি টক হবে গো দাদু। উফফ আবার একটা গাছ”। পরশু মাটি খুঁড়ছিল, হেসে তাকিয়ে বলল
– ওটা কচুর লতি
– বাঃ এই একটা কাজের কাজ করেছ। কচু লতি খেতে খুব ভাল লাগে আমার। দাদু শহরে গেলে গোটা ছোলা এনো তো”।
– বেশ আনব, তোর স্নান করা হয়েছে।
– হ্যাঁ সে কোণ সকালে, এই দেখ আবার একটা গাছ।
– ওটা তুলসী।
– ইসস পা ঠেকে গেল গো দাদু”। বলেই গর হয়ে প্রনাম করল মিনু। পরশু হেসে উঠল জোরে।
– হাসছ কেন তুমি? আজ থেকে তোমাকে আমি গাছ দাদু বলব দেখ!
– বলিস
সেই ঠেকে মিনু পরশু কে গাছ দাদু ই বলে। মিনু দুয়ারে বসে রইল চুপ করে। এই সন্ধ্যে রাত টা গাছ দাদুর কাছে না থাকলে মিনুর ভাল লাগে না। কেমন যেন একটা সুরক্ষিত লাগে নিজেকে।
– দাদু তোমার নাতি তো একদম পড়ছে না গো”। কথাটা শুনেই যেন চোয়াল টা শক্ত হয়ে গেল পরশু র।
– কেন পড়বে না কেন? ভালই তো করেছে এবারে টেস্ট পরীক্ষা তে ও।
– তাই? সে কি আর আমি বুঝি না কি অতও। তুমি যদি বল তাহলে ও ভালই। কিন্তু বড্ড দুষ্টুমি করে জান।
– তোর সমস্যা টা কোথায়? ও পড়ছে না নাকি ও দুষ্টুমি করছে।
– হি হি, কি বলত ওকে কোনদিন ও আমি দিতে পারিনি কিছুই। তাই মনে হয় হয়ত কি জানি ও মানুষ হচ্ছে কিনা।
– ও ভাল ছেলে মিনু”। পরশু সাইকেল টা একটু তেল দিয়ে কাজ শেষ করে উঠল উঠোন থেকে।
“গুড়ুম”, আওয়াজ টা তে চমকে উঠল পরশু। মিনু ও চমকেই উঠল। “ ও কিসের আওয়াজ গো গাছ দাদু”। চোখ আর কান টা তীক্ষ্ণ করে পরশু আন্দাজ লাগাতে চেষ্টা করল আওয়াজ টা কোণ দিক থেকে এলো। পরশু থাকে দ্বীপের ঠিক পিছন দিকে। ঠিক পিছনেই সোনাজুরি নদী। বুঝল আওয়াজ টা সামনের দিক থেকে এসেছে।
“ মিনু তুই ঘরে ঢুকে বস তো”
– কেন গো গাছ দাদু
– বস না আর লম্ফ টা নিভিয়ে দে
– হি হি দাদু দুষ্টুমি করবে নাকি??
– পাগলী যাহ্ যা বলছি কর”। মিনু হেসে ঘরে ঢুকে পড়ল লম্ফ টা নিভিয়ে দিল মিনু। পরশু এগিয়ে এসে বলল মিনু কে “শোন দরজা বন্ধ করে দে, যদি আমি আসি তবে ঠিক চারবার টোকা দেব। দুবার দুবার করে একসাথে, আর যদি এমন কিছু না হয় তবে ঠিক আমার খাটিয়ার পিছনেই একটা দরজা আছে সেখান দিয়ে বেড়িয়ে জলে ঝাপ দিবি, এখন যে দিকে স্রোত আছে ভেসে থাকবি আর কিছু দূর গিয়েই ধাক্কা খাবি বাঁশে। উঠে আসবি আমি অখানেই থাকব”।
– আচ্ছা বেশ” মিনু ঘরে ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা টা। “ গাছ দাদু আমার ছেলেটা কে দেখ”।
– ও ঠিক জায়গাতেই আছে তুই চিন্তা করিস না”।
পরশু বেড়িয়ে এলো সাবধানে। গুলি টা আবার চলল দুরেই।কোন বড় ব্যাপার হয়েছে নিশ্চিত। মুখ দিয়ে একটা মিষ্টি শীষ বের করে ভাসিয়ে দিল পরশু। কিছু ক্ষন পর থেকেই ওমনি মিষ্টি কিছু শীষের আওয়াজ ভেসে এলো চারিদিক থেকে। বেশ কিছুক্ষন চলল এই শীষের আওয়াজ। ততক্ষনে পরশু সুনির বাড়িতে গিয়ে মিনুর ছেলের হাত ধরে বেড়িয়ে এসেছে। সুনি এই সব এ অভ্যস্ত। ও কোন প্রশ্ন করল না। ততক্ষনে ভারি বুটের আওয়াজে আর আঘাতে এই সুন্দরবনের দ্বীপ টির বুক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মনে হয়।
টোকা টা অন্য রকম শুনতেই মিনু হাতড়ে খাটিয়ার ওপাশে গিয়েই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাঁশের চাটাই ধরে টানতেই দেওয়াল টা যেন খুলে এলো দরজার মতন। মিনু বেড়িয়ে এসে লাগিয়ে দিল ফের। দেওয়াল ঠিক উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। পায়ের তলায় মাটি ভিজে পেতেই বুঝল নদির একদম কাছেই ও। জলের আওয়াজে বুঝল জোয়ার ও চলছে। ও বুক অব্দি নেমে নিজেকে ভাসিয়ে দিল। যা ভয়ঙ্কর জীবন ও কাটিয়েছে ১৫ থেকে ২৫ বছর অব্দি, এই ব্যাপার গুলো মিনু কে আর ভয় দেখাতে পারে না। ও শুধু ভেসে রইল। মিনিট দশ পরেই একটা খোঁচা তে ওর শাড়ির আঁচল টা আটকে যেতেই বুঝল বাঁশঝাড় এসে গেছে। ও হাত টা বাড়াতেই বাঁশের খোঁচা তে হাত টা লাগলো। ও সেই বাঁশ টা কে ধরেই আসতে আসতে পারের দিকে আসতেই মনে হল গাছ দাদু বলল- মিনু!!! আমি, আমি তোকে দেখতে পেয়ে গেছি। তুই হাত টা বাড়া”।
– গাছ দাদু কোথায় গো আমরা এখন?
– আমরা এখন বাংলাদেশে, প্রায় সমুদ্রে
– হুম্মম, আমার ছেলেকে কোথায় রাখলে তুমি?
– আছে ভাল জায়গাতেই।
– ওখানে ওর পড়াশোনা হবে?
– হবে, আমার ছাত্র ও। তোর ছেলেকে শহরে নিয়ে যাবে। অখানেই ও মানুষ হবে। তোর কষ্ট হলেও তোকে সহ্য করতে হবে। আমি তো তোকেও বললাম যেতে।
– না গো গাছ দাদু, আমার ছেলে একা থাকুক। আমি অন্ধ মানুষ। তুমি আমাকে সহ্য কর বলে কি সবাই করবে? ও পড়ুক। ও পড়ুক।
নৌকার পাটাতনে বসে ছাউনি তে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ টা করে রইল মিনু। যেন মাপছে আকাশের উচ্চতা কে। কিন্তু হায় রে পোড়াকপাল। মিনু কে মন দিয়েই মাপ্তে হয় আকাশের উচ্চতা। ওর খুব আশা ওর ছেলে একদিন ফিরে আসবে আকাশের উচ্চতা নিয়েই। সেদিন আর নিস্ফলের মতন তাকিয়ে থাকতে হবে না মিনু কে আকাশের দিকে। ছেলে কে বুকে টেনে নিলেই আকাশ কে পেয়ে যাবে মিনু। রাতের অন্ধকারে মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল মিনুর ঠোঁটে।
– আজকে তুই অনেক সাহস দেখিয়েছিস
– হি হি কেন আজকে কেন যেদিন আমাকে নিয়ে এলে ওই নোংরা বস্তি থেকে সেদিন সাহস দেখনি আমার , গাছ দাদু?
– তোর ভয় লাগে নি জলে ঝাপ দিতে?
– উঁহু, জানতাম তুমি তো আছ
– আমাকে এতো ভরসা করিস?
– হুম্ম করি।
– তোর শাড়ি টা ভিজে গেছে, ছেড়ে নে।
– আমার আর শাড়ি কোথায় গো? আজ সন্ধ্যে থেকে তুমি দুষ্টুমি ভাঁজছ”। মনে মনে ভাবল পরশু মিনুর কথা শুনে যে মিনু হয়ত মজা করে ওর সাথে। কি জানি বাবা মেয়েদের মনে কি যে চলে কে জানে। নৌকার ছাউনির ভীতরে গিয়ে শাড়ি টা ছেড়ে ফেলল মিনু। হাত বাড়িয়ে গাছ দাদুর একটা ধুতি পড়ে ফেলল মিনু। একটু ভাল লাগছে এখন। অনেকক্ষণ ছিল ভিজে শাড়ি তে।
প্রায় তিন দিন পড়ে মিনু পরশুর হাত ধরে একটা ছোট বাড়িতে ঢুকল। “এটা কোথায় গো দাদু”।
মিনুর প্রশ্নে পরশু ব্যাগ রাখতে রাখতে বলল “ এটা তোর ছেলের থেকে দূরে নয় রে”।
– ছেলের নাম করে ফেললে তো? ওকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব ই আমার
– সে তো আমার ও করে রে।
– দাদু একটা কথা বলবে?
– বল
– আচ্ছা তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?
– কেন তোর আমার সাথে পালাতে কোন অসুবিধা আছে?
– হি হি দেখলে আমি জানতাম তুমি দুষ্টুমির প্ল্যান করছ।
– হাহাহা তোর মুখে কি কিছু আটকায় না?
– এতে আটকানোর কি আছে শুনি? তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। আমার ছেলেকে পড়াচ্ছ। এ টুকু তুমি করতেই পার
– হাহাহাহাহা খুব পাকা হয়েছিস না”? মিনু হেসে গড়িয়ে পড়ল পরশুর কথায়। যেন কত হাসির কথা বলে ফেলেছে ওর গাছ দাদু।
– পনের বছরে আমার পেটে বাচ্চা এসেছে গাছ দাদু। পাকতে কি বয়েস লাগে ?
– হুম্ম সে তো তোর কোন হাত ছিল না রে।
– যাক ছাড়, যেখানে আমাকে তুল্লে সেখানে কি আলুভাতে খেয়েই থাকবে নাকি কিছু রান্না বাড়ির ব্যবস্থা আছে?
– আছে সব ই ব্যবস্থা
– ইসসস দেখলে কচুর শাকের বাটি টা তোমার দুয়ারেই পড়ে আছে গো”। কথাটা মাথায় ছিল না। পুলিশ আগে অনেক বার এসেছে ওই বাড়িতে। হানা দিয়েছে, কিন্তু যদি ওরা ওই বাটি টা দেখতে পায় তবে এটা ওরা বুঝে যাবে যে ওখানে যে থাকত সে পুলিশের ভয়েই পালিয়েছে। যদি সুনি সরিয়ে ফেলে তো ভাল কথা না হলে মুশকিল।
রাকা ফোন টা রেখে জাল টানা দেখছিল। নাহ পুকুরে নেই। মোহিত বলল – স্যার পুকুরে নেই আমি সিওর।
– হুম্ম আমিও সিওর। পুকুরে নেই।
– স্যার কিছুদিন আগে বারুইপুরের একটি বাড়িতে চুরি হয়েছিল। আমাদের থানার আন্ডার এ নয়। সেখানেও ওই হাজার পাঁচেক টাকা চুরি হয়েছিল, কিন্তু ওদের বাড়ির বড় বউ পরের দিন সকাল থেকে মিসিং হয়ে যায়”। রাকা শুনেছিল ঘটনা টা। কিন্তু দুটো ঘটনায় অনেক সামঞ্জস্য থাকলেও দুটো কে এক করার সময় আসে নি এখনো। যদি এক রকম হয় ও তার মানে একটাই হয় যে চুরি করা কোন উদ্দেশ্য নয়। বাড়ির দুজন বয়স্কা মহিলার গায়েব হয়ে যাওয়া টা খুব একটা সমাপতন নয়। রাকা মোহিত কে বলল “ ঠিক আছে তুমি একটা মিসিং ডায়রি নাও এদের কাছ থেকে”।
– ওকে স্যার, স্যার আরেক টা কথা, জানিনা এই ঘটনার সাথে এই মিসিং গুলোর কোন রিলেশন আছে কিনা, কিন্তু কথা টা না বলেও পারছি না
– কি? রাকা চুপ করে গেল , মোহিতের কথা টার জন্য ওয়েট করতে লাগলো।
– স্যার, আমাদের খাদ্য মন্ত্রীর ছেলে, রকি ।
– হুম্ম ওর কি?
– ওকে আমি ওদের ফার্ম হাউস এ প্রতি রাতে যেতে দেখি ওর প্রাইভেট গাড়ি করে।
– তাতে কি হয়েছে?
– স্যার সেদিন যে মহিলা টি মিসিং হয়েছিল, তার ডেড বডি ওই ফার্ম হাউসের পিছনে যে নদি টা আছে সেই নদির একটা খাড়ি তে ফার্ম হাউস থেকে ঠিক এক কিমি দূরে পাওয়া গেছিল। আর মহিলাকে বেশ কয়েকবার রেপ করা হয়েছিল। আমরা পরীক্ষা করিয়েছিলাম।
– হুম্মম্ম। আজকে লক্ষ্য রাখ মোহিত। নদির ওপার থেকে আর এ পার থেকেও।
– কিন্তু স্যার সত্যি বলতে ওই ফার্ম হাউস টা যে থানার আন্ডার এ পড়ে সেই থানার ওসি পরের দিন ই তল্লাশি চালিয়েছিল ফার্ম হাউস এ। কিন্তু ওই রাতে বন্ধু বান্ধবদেড় সাথে মদ খাওয়া ছাড়া আর কোন প্রমান ই পায় নি। ও সি এখন সাসপেন্ড হয়ে বসে আছে। আমাদের সাবধান এ কাজ করতে হবে। তবে আমি সিওর যে ওই মহিলার রেপ আর মার্ডার এর সাথে ওই ফার্ম হাউসের যোগাযোগ আছেই।
এদিকে বহুদূরে, গঙ্গার উপনদী ক্ষীরাই এর তীরে জঙ্গলের ভিতর একটা বড় মাচা বাঁধা রয়েছে। এই জঙ্গল টি খুব একটা ঘন তা কিন্তু নয়। বরং কাঁটা ঝোপ বেশী। ভীষণ সাপের উপদ্রব। সন্ধ্যের নরম সূর্যের আলোতে, ক্ষীরাই এর জলে দুব দিয়ে উঠে এলো একজন বৃদ্ধ। বয়েস প্রায় সত্তরের উপরে। কিন্তু দীর্ঘ ঋজু দেহ প্রমান করে যে এখনো তিনি যথেষ্ট শক্তিশালী। বেশ দৃঢ় পদক্ষেপ এ উঠে এলেন নদি থেকে। নিজের ভিজে যাওয়া সাদা ধুতি টা ছেড়ে শুকনো ধুতি পড়ে নিলেন। খালি পেশীবহুল গায়ে একটা সাদা কাপড় জড়িয়ে নিয়ে পাশে রাখা একটা ছোট মেশিন গান তুলে নিলেন। রিভলবার টা কোমরে গুঁজে নিয়ে উঠে পড়লেন মাচা তে। অন্ধকার নেমে এলো যেন ঝুপ করে জঙ্গলের মধ্যে। এই জঙ্গলের সুবিধা হল সুন্দর বনের শুরু এই জঙ্গল। নদী দিয়ে ঘেরা। কাঁটা গাছে পরিপূর্ণ। আর চল্লিশ কিলোমিটার আশে পাশে কোন মানুষের বসতি নেই। এই দিকে ক্ষীরাই নদী, পিছনে কপিলা নদী। আর দুটো নদী গিয়েই মিশেছে বিশাল বপু গঙ্গার সাথে। ঠিক কুড়ি মাইল গেলেই স্বয়ং বিদ্যাধরী এসে মিশেছে গঙ্গার সাথে। পুলিশ কেন সেনা বাহিনী ও ভয় পাবে এই অঞ্চলে এসে থানা গাড়তে। স্বয়ং দক্ষিনানারায়ন মাঝে মাঝেই এই অঞ্চলে পদধূলি দিয়ে যান। কাজেই মানুষের ভয় এই অঞ্চলে কম। ক্ষীরাই এ যখন জোয়ার আসে এই মাচার নীচে অবধি টইটম্বুর করে নোনা জল। মাচার উপরেই বই খাতা কলম আর বন্দুক সব নিয়েই থাকেন এই বৃদ্ধ। হাত ঘড়ি টা দেখে নিলেন বৃদ্ধ একবার, সাতটা বাজতে চলল, মানে আর বড়জোর ঘণ্টা দুয়েক। তারপরেই জোয়ার আসবে। মাচার ওপর থেকেই দেখলেন দূরে একটা টর্চের আলো জ্বলেই নিভে গেল। একটু সতর্ক হলেন উনি। আবার জ্বলেই নিভল। ঠিক দশ সেকেন্ড গুনলেন বৃদ্ধ, আবার টর্চ টা জ্বলেই নিভল। যেন একটু হাঁফ ছারলেন বৃদ্ধ। জলের ছলাত ছলাত আওয়াজ পেলেন বৃদ্ধ। অন্ধকার সয়ে যাবার ফলে একটা বিশাল বজরার অবয়ব দৃষ্টি গোচর হল বৃদ্ধর। উনি নেমে এলেন মাচা থেকে। বজরা থেমে গেল যেন ঘাটের একটু দূরে। বৃদ্ধ জলে নামলেন না। আওয়াজে বুঝলেন দুটো শব্দ হালকা হল। যেন বজরা থেকে কেউ জলে নামল। ঠিক মিনিট দশেক পড়ে দেখলাম ভুঁইফোঁড়ের মতন দুটো দীর্ঘ দেহি মানুষ এগিয়ে আসছে। উনি মুখ তা সরু করে হালকা একটা শীষ ভাসিয়ে দিলেন যেন। লোক দুটো থেমে গেল। ঠিক ওই রকম ই আরেক একটা শীষের আওয়াজ ভেসে এলো। বৃদ্ধ কিছু না বলে সরে এলেন অখান থেকে। লোক দুটো আর থামল না সোজা ঢুকে গেল জঙ্গলের ভীতরে।
– এই বারে সবাই চুপ কর”। এই কথাতে ঘরে উপস্থিত সবাই চুপ করে গেল। ঘর বলতে পাতা দিয়ে ছাওয়া একটা অস্থায়ী বাঁশের চাটাই এর ঘর মাত্র। ঘরে উপস্থিত সবাই দেখল চাটাই এর ফাঁক দিয়ে একটা হলুদ রঙের আলো অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে আসছে। ঘর বিশেষ বড় না হলেও মাত্র একটি লন্ঠন জ্বলছিল। তাতে সকলের মুখ ও ঠিক করে দেখা যাচ্ছিল না। আলো টা ঘরের কাছে আসতেই নিভে গেল। আর ঘরের মধ্যে একজন দীর্ঘদেহী পুরুষের প্রবেশ ঘটল। উপস্থিত সবাই দেখল যে বিশাল দেহি পুরুষ টির মুখ ঢাকা। এসে গুরু গম্ভীর স্বরে সবাই কে সম্বোধন করে বলতে শুরু করলেন
– ভাই সব, আজকে আমরা এখানে মিলিত হয়েছি, তার কারন হল আমাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে সরকার এবং সরকারের প্রতিনিধি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের কেউ মা, কেউ বাবা্*, কেউ বা নিজের স্ত্রী সন্তানদের হারিয়ে সর্বস্বান্ত।আমি এখানে কোন প্রতিশোধের জ্বালায় সরকারের বিপক্ষে যাই নি। আমি চাই সরকার কে মানে আমাদের জনসাধারন কে বোঝাতে, যে যাদের ভরসায় ওরা রাতে নিশ্চিন্তে শুতে যায়, তারাই সেই মানুষ গুলোর খতিসাধনে মত্ত হয়ে ওঠে। আমি এই নিষ্ঠুর সরকারের বিপক্ষে, কিন্তু আমাদের মানুষদের বিপক্ষে নেই। তাই এটা যেন মাথায় থাকে, জন সাধারন কোন ভাবেই যেন আমাদের দ্বারা ক্ষতি গ্রস্ত না হয়। মনে রাখবেন বন্ধুরা, আমাদের সব থেকে বড় শক্তি হল আমাদের জন সাধারন। সরকারের বিপক্ষে এরাই আমাদের লড়তে সাহস আর এরাই আমাদের সাহায্য দেন। আগামী কাল শহরে বড় জনসভা আছে। কিসের জনসভা? আমাদের ভাইদের সরকার থেকে বোঝাতে আসবেন যাতে এখানকার জমি সঙ্ক্রান্ত আইন বদলান যায়। কই সরকার তো বলল না যে এই আদিম সুন্দরবনের কি ভাবে উন্নতি সাধন করা যায়? কই সরকার তো বলল না কি ভাবে এই নোনা জলে চাষ বাস করা যায়? এর থেকেই স্পষ্ট যে সরকার অন্য খেলায় মেতেছে। আমাদের বেশ কিছু কৃষিবিজ্ঞানী, বড় জামুই তে ধান উৎপন্ন করেছেন। আমি এটাই দেখাতে চাই সবাই কে যে সরকার যা পারছে না, সেটা আমরা করছি। আমাদের চাই না এই সরকারের হস্তক্ষেপ আমাদের জমিতে। কালকে যা যা প্ল্যান আছে সেই অনুযায়ী হবে। জয় হিন্দ”।
মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল ঘর টা। আবার যখন আলো জ্বলল দেখা গেল মানুষ টি আর নেই ঘরের মধ্যে।
– গাছ দাদু ও গাছ দাদু!!!
– আয় রে মিনু ঘরে আয়। দারা আসছি
– একদম আসবে না তুমি, আমি নিজেই পারব”। মিনু ধরে ধরে এগিয়ে গেল বাড়ির মধ্যে। মিনু অন্ধ। দুটো চোখেই দেখতে পায় না। জন্মান্ধ। এখন বয়েস পঁচিশ মতন। বিয়ে হয় নি। কিন্তু এই সুন্দরবনের জঙ্গলের দেশে মেয়েরা খুব ই সহজ লভ্যা। কেউ মিনু কে সংসারের লোভ দেখিয়ে ভোগ করেছিল তখন মিনু অনেক ছোট। তার ই ফলে মিনুর একটি সন্তান হয়। সেই ছেলেটি এখন ক্লাস ফাইভ এ পড়ে। পরশুরাম ওরফে পরশু এই দ্বীপের একমাত্র কলেজের একমাত্র শিক্ষক। মিনু কে পরশু পেয়েছিল ছেলে সমেত শহরের একটা নোংরা জায়গায়। সেখান থেকে নিয়ে এসেছিল এখানে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। সেই থেকে এখানেই আছে মিনু। পরশু ওকে বিধবা সুনি র কাছে থাকতে দিয়েছিল। সুনি ও না বলে নি। ওরা মা বেটি হয়ে কোন রকমে দিন চালায়। ওদের হাতে বানানো রঙ বে রঙ এর ক্রাফট পরশু শহরে দোকানে বিক্রি করে আসে।
– কই গো দাদু কি রান্না করলে আজকে?
– আজকে? আজ দারুন রেঁধেছি রে
– হি হি তোমার দারুন মানে তো আলু ভাতে আর ভাত
– ওটা কম হল নাকি রে?
– নাহ সেটা না, আমি জানতাম তুমি ওমনি একটা কিছু করবে, তাই আমি কচুশাক রেঁধেছি নিয়ে এলাম।
– বা বা বা, তবে ওই দুয়ারে রাখ”। মিনু জানে কোথায় কি আছে। ঠিক হাতড়ে হাতড়ে রেখে এলো বাটি টা দুয়ারে। প্রথম প্রথম মিনু বাড়িতে ঢুকেই চারিদিকে ঘুরে বেড়াত আর গাছের স্পর্শ পেত।
– এটা কি গাছ দাদু?
– বেগুন
– আর এটা?
– ওটা আমের চারা।
– হিহি এখানে আমের চারা? আর হলেও সে যে কি টক হবে গো দাদু। উফফ আবার একটা গাছ”। পরশু মাটি খুঁড়ছিল, হেসে তাকিয়ে বলল
– ওটা কচুর লতি
– বাঃ এই একটা কাজের কাজ করেছ। কচু লতি খেতে খুব ভাল লাগে আমার। দাদু শহরে গেলে গোটা ছোলা এনো তো”।
– বেশ আনব, তোর স্নান করা হয়েছে।
– হ্যাঁ সে কোণ সকালে, এই দেখ আবার একটা গাছ।
– ওটা তুলসী।
– ইসস পা ঠেকে গেল গো দাদু”। বলেই গর হয়ে প্রনাম করল মিনু। পরশু হেসে উঠল জোরে।
– হাসছ কেন তুমি? আজ থেকে তোমাকে আমি গাছ দাদু বলব দেখ!
– বলিস
সেই ঠেকে মিনু পরশু কে গাছ দাদু ই বলে। মিনু দুয়ারে বসে রইল চুপ করে। এই সন্ধ্যে রাত টা গাছ দাদুর কাছে না থাকলে মিনুর ভাল লাগে না। কেমন যেন একটা সুরক্ষিত লাগে নিজেকে।
– দাদু তোমার নাতি তো একদম পড়ছে না গো”। কথাটা শুনেই যেন চোয়াল টা শক্ত হয়ে গেল পরশু র।
– কেন পড়বে না কেন? ভালই তো করেছে এবারে টেস্ট পরীক্ষা তে ও।
– তাই? সে কি আর আমি বুঝি না কি অতও। তুমি যদি বল তাহলে ও ভালই। কিন্তু বড্ড দুষ্টুমি করে জান।
– তোর সমস্যা টা কোথায়? ও পড়ছে না নাকি ও দুষ্টুমি করছে।
– হি হি, কি বলত ওকে কোনদিন ও আমি দিতে পারিনি কিছুই। তাই মনে হয় হয়ত কি জানি ও মানুষ হচ্ছে কিনা।
– ও ভাল ছেলে মিনু”। পরশু সাইকেল টা একটু তেল দিয়ে কাজ শেষ করে উঠল উঠোন থেকে।
“গুড়ুম”, আওয়াজ টা তে চমকে উঠল পরশু। মিনু ও চমকেই উঠল। “ ও কিসের আওয়াজ গো গাছ দাদু”। চোখ আর কান টা তীক্ষ্ণ করে পরশু আন্দাজ লাগাতে চেষ্টা করল আওয়াজ টা কোণ দিক থেকে এলো। পরশু থাকে দ্বীপের ঠিক পিছন দিকে। ঠিক পিছনেই সোনাজুরি নদী। বুঝল আওয়াজ টা সামনের দিক থেকে এসেছে।
“ মিনু তুই ঘরে ঢুকে বস তো”
– কেন গো গাছ দাদু
– বস না আর লম্ফ টা নিভিয়ে দে
– হি হি দাদু দুষ্টুমি করবে নাকি??
– পাগলী যাহ্ যা বলছি কর”। মিনু হেসে ঘরে ঢুকে পড়ল লম্ফ টা নিভিয়ে দিল মিনু। পরশু এগিয়ে এসে বলল মিনু কে “শোন দরজা বন্ধ করে দে, যদি আমি আসি তবে ঠিক চারবার টোকা দেব। দুবার দুবার করে একসাথে, আর যদি এমন কিছু না হয় তবে ঠিক আমার খাটিয়ার পিছনেই একটা দরজা আছে সেখান দিয়ে বেড়িয়ে জলে ঝাপ দিবি, এখন যে দিকে স্রোত আছে ভেসে থাকবি আর কিছু দূর গিয়েই ধাক্কা খাবি বাঁশে। উঠে আসবি আমি অখানেই থাকব”।
– আচ্ছা বেশ” মিনু ঘরে ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা টা। “ গাছ দাদু আমার ছেলেটা কে দেখ”।
– ও ঠিক জায়গাতেই আছে তুই চিন্তা করিস না”।
পরশু বেড়িয়ে এলো সাবধানে। গুলি টা আবার চলল দুরেই।কোন বড় ব্যাপার হয়েছে নিশ্চিত। মুখ দিয়ে একটা মিষ্টি শীষ বের করে ভাসিয়ে দিল পরশু। কিছু ক্ষন পর থেকেই ওমনি মিষ্টি কিছু শীষের আওয়াজ ভেসে এলো চারিদিক থেকে। বেশ কিছুক্ষন চলল এই শীষের আওয়াজ। ততক্ষনে পরশু সুনির বাড়িতে গিয়ে মিনুর ছেলের হাত ধরে বেড়িয়ে এসেছে। সুনি এই সব এ অভ্যস্ত। ও কোন প্রশ্ন করল না। ততক্ষনে ভারি বুটের আওয়াজে আর আঘাতে এই সুন্দরবনের দ্বীপ টির বুক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মনে হয়।
টোকা টা অন্য রকম শুনতেই মিনু হাতড়ে খাটিয়ার ওপাশে গিয়েই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাঁশের চাটাই ধরে টানতেই দেওয়াল টা যেন খুলে এলো দরজার মতন। মিনু বেড়িয়ে এসে লাগিয়ে দিল ফের। দেওয়াল ঠিক উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। পায়ের তলায় মাটি ভিজে পেতেই বুঝল নদির একদম কাছেই ও। জলের আওয়াজে বুঝল জোয়ার ও চলছে। ও বুক অব্দি নেমে নিজেকে ভাসিয়ে দিল। যা ভয়ঙ্কর জীবন ও কাটিয়েছে ১৫ থেকে ২৫ বছর অব্দি, এই ব্যাপার গুলো মিনু কে আর ভয় দেখাতে পারে না। ও শুধু ভেসে রইল। মিনিট দশ পরেই একটা খোঁচা তে ওর শাড়ির আঁচল টা আটকে যেতেই বুঝল বাঁশঝাড় এসে গেছে। ও হাত টা বাড়াতেই বাঁশের খোঁচা তে হাত টা লাগলো। ও সেই বাঁশ টা কে ধরেই আসতে আসতে পারের দিকে আসতেই মনে হল গাছ দাদু বলল- মিনু!!! আমি, আমি তোকে দেখতে পেয়ে গেছি। তুই হাত টা বাড়া”।
– গাছ দাদু কোথায় গো আমরা এখন?
– আমরা এখন বাংলাদেশে, প্রায় সমুদ্রে
– হুম্মম, আমার ছেলেকে কোথায় রাখলে তুমি?
– আছে ভাল জায়গাতেই।
– ওখানে ওর পড়াশোনা হবে?
– হবে, আমার ছাত্র ও। তোর ছেলেকে শহরে নিয়ে যাবে। অখানেই ও মানুষ হবে। তোর কষ্ট হলেও তোকে সহ্য করতে হবে। আমি তো তোকেও বললাম যেতে।
– না গো গাছ দাদু, আমার ছেলে একা থাকুক। আমি অন্ধ মানুষ। তুমি আমাকে সহ্য কর বলে কি সবাই করবে? ও পড়ুক। ও পড়ুক।
নৌকার পাটাতনে বসে ছাউনি তে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ টা করে রইল মিনু। যেন মাপছে আকাশের উচ্চতা কে। কিন্তু হায় রে পোড়াকপাল। মিনু কে মন দিয়েই মাপ্তে হয় আকাশের উচ্চতা। ওর খুব আশা ওর ছেলে একদিন ফিরে আসবে আকাশের উচ্চতা নিয়েই। সেদিন আর নিস্ফলের মতন তাকিয়ে থাকতে হবে না মিনু কে আকাশের দিকে। ছেলে কে বুকে টেনে নিলেই আকাশ কে পেয়ে যাবে মিনু। রাতের অন্ধকারে মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল মিনুর ঠোঁটে।
– আজকে তুই অনেক সাহস দেখিয়েছিস
– হি হি কেন আজকে কেন যেদিন আমাকে নিয়ে এলে ওই নোংরা বস্তি থেকে সেদিন সাহস দেখনি আমার , গাছ দাদু?
– তোর ভয় লাগে নি জলে ঝাপ দিতে?
– উঁহু, জানতাম তুমি তো আছ
– আমাকে এতো ভরসা করিস?
– হুম্ম করি।
– তোর শাড়ি টা ভিজে গেছে, ছেড়ে নে।
– আমার আর শাড়ি কোথায় গো? আজ সন্ধ্যে থেকে তুমি দুষ্টুমি ভাঁজছ”। মনে মনে ভাবল পরশু মিনুর কথা শুনে যে মিনু হয়ত মজা করে ওর সাথে। কি জানি বাবা মেয়েদের মনে কি যে চলে কে জানে। নৌকার ছাউনির ভীতরে গিয়ে শাড়ি টা ছেড়ে ফেলল মিনু। হাত বাড়িয়ে গাছ দাদুর একটা ধুতি পড়ে ফেলল মিনু। একটু ভাল লাগছে এখন। অনেকক্ষণ ছিল ভিজে শাড়ি তে।
প্রায় তিন দিন পড়ে মিনু পরশুর হাত ধরে একটা ছোট বাড়িতে ঢুকল। “এটা কোথায় গো দাদু”।
মিনুর প্রশ্নে পরশু ব্যাগ রাখতে রাখতে বলল “ এটা তোর ছেলের থেকে দূরে নয় রে”।
– ছেলের নাম করে ফেললে তো? ওকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব ই আমার
– সে তো আমার ও করে রে।
– দাদু একটা কথা বলবে?
– বল
– আচ্ছা তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?
– কেন তোর আমার সাথে পালাতে কোন অসুবিধা আছে?
– হি হি দেখলে আমি জানতাম তুমি দুষ্টুমির প্ল্যান করছ।
– হাহাহা তোর মুখে কি কিছু আটকায় না?
– এতে আটকানোর কি আছে শুনি? তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। আমার ছেলেকে পড়াচ্ছ। এ টুকু তুমি করতেই পার
– হাহাহাহাহা খুব পাকা হয়েছিস না”? মিনু হেসে গড়িয়ে পড়ল পরশুর কথায়। যেন কত হাসির কথা বলে ফেলেছে ওর গাছ দাদু।
– পনের বছরে আমার পেটে বাচ্চা এসেছে গাছ দাদু। পাকতে কি বয়েস লাগে ?
– হুম্ম সে তো তোর কোন হাত ছিল না রে।
– যাক ছাড়, যেখানে আমাকে তুল্লে সেখানে কি আলুভাতে খেয়েই থাকবে নাকি কিছু রান্না বাড়ির ব্যবস্থা আছে?
– আছে সব ই ব্যবস্থা
– ইসসস দেখলে কচুর শাকের বাটি টা তোমার দুয়ারেই পড়ে আছে গো”। কথাটা মাথায় ছিল না। পুলিশ আগে অনেক বার এসেছে ওই বাড়িতে। হানা দিয়েছে, কিন্তু যদি ওরা ওই বাটি টা দেখতে পায় তবে এটা ওরা বুঝে যাবে যে ওখানে যে থাকত সে পুলিশের ভয়েই পালিয়েছে। যদি সুনি সরিয়ে ফেলে তো ভাল কথা না হলে মুশকিল।