Thread Rating:
  • 12 Vote(s) - 2.92 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Misc. Erotica ডাকাতের বউ by hotmirch
#6
উপলাকীর্ন এক দীর্ঘ পথ এসে মিশেছে নিবিড় বনানীর উপকন্ঠে। এই সেই দুর্ভেদ্য বিশালাক্ষীর জঙ্গল। কোন এক সময় এখানে নাকি বিশালাক্ষী মা অর্থাৎ কালীমায়ের মন্দির ছিল। ছিল এক ছোট্ট জনপদ। দূর দূরান্ত থেকে আগত ভক্তদের ও ধর্মপ্রাণ তীর্থযাত্রীদের ঢল লেগে থাকত সারা বছর জুড়ে। দেবী ছিলেন সদা জাগ্রতা। কিন্তু সেই ভক্ত কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ থেকে আজকের এই দূরলঙ্ঘনীও সুদূরপ্রসারিত জঙ্গলে রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনীও বড় বিচিত্র। সে সময়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ মহারাজ সূর্যকান্ত রায় ছিলেন মায়ের প্রধান সেবাইত এবং একনিষ্ঠ ভক্ত। সেবার ভাদ্র মাসের শুরুতে তাঁর সৈন্য সামন্ত নিয়ে মহারাজ গেছেন তার রাজ্যের উত্তরসীমানায় ভুটান রাজের আক্রমণ ঠেকাতে। এইসময় কৌষিকী অমাবস্যার দিন স্থানীয় এক প্রভাবশালী তান্ত্রিক আপন মোক্ষলাভের আশায় মায়ের মন্দিরে পূজার্চনার শেষে এক বিধবা মায়ের একমাত্র সম্বল তার শিশুপুত্রকে বলি দেয়। রাগে দেবী হন অগ্নিশর্মা।

শেষরাতের সেই মায়ের আর্তকান্নায় আশপাশের সব লোকজন ছুটে এসে দেখে এক অত্যন্ত করুণ দৃশ্য। এক ভুলুন্ঠিতা সংজ্ঞাহীন মায়ের পাশে পড়ে আছে একটি বছর দেড়েকের শিশুর সদ্য কাটা মাথা, দেহটা ঝুলছে হাড়িকাঠ থেকে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে অঙ্গন। আর একটু দূরে মোচড়াচ্ছে তান্ত্রিকের দেহ, রক্তবমি করছে সে। উপস্থিত সবার সামনেই প্রাণবায়ু নির্গত হয় তার। দেবীর অভিশাপে মহারাজ রাজ্যহারা হন, যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ যায়। দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও প্রলয়ঙ্কর প্লাবনে রাজ্য শ্বশানের রূপ ধারণ করে। সংলগ্ন জনপদ বিলুপ্ত হতে মন্দিরও ধংসস্থুপে পরিণত হয়।কল্যাণময়ীর আশীর্বাদধন্য স্থানে জন্ম নেয় আদিম দিগন্তবিস্তৃত অরণ্য। সূর্যকিরণ রুদ্ধ, ঘনসন্নিবিষ্ঠ বৃক্ষরাজির মধ্যে দিনে রাতে বিরাজ করে এক গা ছমছমে অশুভ নৈঃশব্দ্য।

এ গল্প বাল্যকালে নবীন শুনেছিল তার ঠাকুর্দার কাছে। জঙ্গলে দু-চার ঘর লোক বসতি আছে, কিন্তু তারা যে কি? তাদের পায়ের পাতা সামনের দিকে না পেছন দিকে… এব্যাপারে পরাক্রমশালী নবু সর্দারও যথেষ্ট সন্দিহান।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এই জঙ্গলের মুখে এসে ঘোড়ার গতিরোধ করল নবীন। তারপর আস্তে আস্তে প্রবেশ করল বনের মধ্যে। এই পথে সে বহুবার গেছে কিন্তু আজ পরিস্তিতি একটু অন্যরকম। আজ তার সঙ্গে নারী। উপস্থিত যে এখন ঘোড়ার আসনের অতিরিক্ত এক চাদরে তার বুকের সাথে বাঁধা। মৃণাল বাহু দিয়ে তার কন্ঠ আবদ্ধ করে পেশীবহুল বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন।
প্রভুভক্ত অশ্বকে ধীরগতিতে চালনা করে জঙ্গলের এক শুঁড়িপথ ধরলো নবীন। এখানে কিছু নীচুজাতির ঠ্যাঙাড়েদের বাস। কোন পথচারীর উপস্থিতি টের পেলেই তাকে পিটিয়ে সর্বস্বান্ত করে হরণ করাই এদের জীবিকা।
“আজ দোরে কে আছিস রে?” নবু সর্দারের ব্যাঘ্রসম কন্ঠস্বর আছড়ে পড়ল বনানীর নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে।
খানিকক্ষণ সব চুপ চাপ। তার পর এক রিনরিনে প্রেতসম কন্ঠস্বর ভেসে আসে…
“তা দিয়ে কি দরকার কত্তা? আমরা ত আর জাতের নই যে সর্দার আমাদের দলে নেবে?”
“হারামজাদা!!!” অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে নবীন। দুই পা দিয়ে চেপে ধরে ঘোড়ার পিঞ্জর, উল্কাবেগে ধাবিত করে তার অশ্ব।
সূর্যোদয়ের আগেই তাকে গৃহে পৌঁছতে হবে।
বৈকুন্ঠপুর। কোন এক সময় এ ছিল জেলার একনম্বর জনবাসস্থান। বর্তমানে বিস্তৃত ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত এক অতীব সামান্য উপনগরী ব্যতীত এ আর কিছুই নয়। যৌবনের তেজশ্মিতা তার বহুদিন অতিক্রান্ত, এখন বার্ধক্যের দিনগুলিতে নিভৃত আত্মরোমন্থনই তার সঙ্গী। দেবতাত্মা হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন ব্রহ্মপুত্র, উপলাবন্ধুর অতিদীর্ঘ পথ অনন্তকাল ধরে বয়ে এসে, এই বৈকুন্ঠপুরের পাশ দিয়ে গিয়ে সমৃদ্ধ করছে শস্য শ্যামলা বাংলার সমতলভূমিকে। মমতাময়ী পদ্মার বুকে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আগে সেও যেন কিছুটা ভাবগম্ভীর, আত্মসমাহিত।


নবীন যখন বাড়ী পৌঁছল তখন পুবাকাশে একমুঠো লাল আবির ছড়িয়ে উদয় হতে শুরু করেছেন দিবানাথ।
শান্ত ছোট্টো এবং অতিসাধারণ টালী ছাওয়া এক আলয়। কোমরসমান বেড়ার দরজা পেরিয়ে আম, কাঁঠাল ও কলাগাছ শোভিত একটুকরো ছোট্টো জমি, তারপর বাড়ী। প্রস্থে ছয় হাত এক দাওয়াবেষ্টিত, বাতায়নযুক্ত দুইটি মাঝারি মাপের কক্ষ। তার একটি ব্যবহৃত হয় শয়নকক্ষ হিসেবে। বাড়ীর পেছন দিকে বাড়ীর সঙ্গে লাগোয়া একটি টালী ছাওয়া রান্নাঘর। বর্তমানে সেটি অব্যবহৃত। একটু পাশে এক শৌচালয়, আর তার পাশ দিয়ে এক সঙ্কীর্ণ পথ নেমে গেছে নদীর ঘাটে। কিছু নাম না জানা গাছের সমারোহ সেখানে। নবীনের ডিঙিটা ঘাটে বাঁধা। পাশের বাড়ীটা হচ্ছে নিতাই ঘরামীর। নবীন যখন থাকে না তখন এ বাড়ীর দায়-দায়ীত্ব সবই এই নিতাইয়ের। তিন ধাপ সিঁড়ি সম্বলিত দাওয়াটার একটু পাশে এক ভগ্নপ্রায় তুলসীবেদি। এই দুই বাড়ীর আশে পাশে আর কোনো বাড়ী নেই। বৃক্ষশোভিত এলাকাটির অন্তরালে এই দুই গৃহ যেন এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের হাতছানি দেয়।


অল্প ঝুঁকে বেড়ার অর্গলটা খুলে ফেলল নবীন, তারপর ঘোড়াকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল ঘরে ঢোকার দাওয়াটার সামনে। চাদর খুলে সাবধানে সরযূকে পাঁজাকোলা করে ঘোড়া থেকে অবতরণ করলো। তারপর সেইভাবে ধরে গিয়ে শুইয়ে দিল শয়নকক্ষের বিছানায় পরমযত্নভরে। খুলে দিল ঘরের জানলা। উন্মুক্ত বাতায়নপথে নদীর তাজা বাতাসে ঘর হল শুদ্ধ। ভোরের কুয়াশা মাখা স্নিগ্ধ আলোয় এক অপরূপা পরিপূর্ণ রমণী বিস্তস্ত্র বেশে নরম বালিশে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, সিন্দুরচর্চিত ললাট সমেত এক প্রগাড় সুখচ্ছবি তার নিদ্রাসুপ্ত মুখমন্ডলে। জীবনের প্রথম রতিক্রিয়ার সমস্ত চিহ্ন বিদ্যমান। কোঁচকানো বিছানার চাদরে কিছু দলিত মথিত গোলাপের পাঁপড়িই যা একমাত্র অনুপস্থিত…!!!
উদ্গত হৃদয়াবেগ চেপে নবীন চাদর দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল সরযূকে। কার্ত্তিক মাসের ঠান্ডা বাতাস তার রমণীকে যেন কাতর না করে।
ঘুমোও রাজকুমারী, ঘুমোও।
ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপিসারে বাইরে বেরিয়ে এল নবীন। প্রভুভক্ত অশ্ব পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল নবীন। আসাধ্য সাধন করেছে তার বাহন। দু দিনের রাস্তা একটা রাতের মধ্যে অতিক্রম করেছে সে। ফেনা গড়াচ্ছে তার কষ বেয়ে। সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। ঘোড়ার মুখ থেকে বল্গা খুলে নিল নবীন। সরিয়ে দিল তার পীঠের আস্তরণ, ধীরে ধীরে নিয়ে গেল নদীর ঘাটে। আঁজলা ভরে জল দিয়ে ধুইয়ে দিল তার পা গুলো।শীতল জল ছিটিয়ে দিল তার সর্বাঙ্গে। তারপর তাকে নিয়ে এল বাড়ীর সামনের দিকে খড়ে ছাওয়া তার আস্তানায়। স্নেহভরে সর্বাঙ্গ মুছিয়ে দিল। রান্নাঘরের পেছনের কূয়ো থেকে জল তুলে তাতে কিছু বিচালি ছড়িয়ে এনে দিল তৃষ্ণার্ত অশ্বের কাছে।
এবার ফিরে গেল নদের ঘাটে। উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইল খানিক্ষণ।
আঁজলা ভরে জল খেল। ব্রহ্মপুত্রের জলে ধুয়ে ফেলল তার লেপ্টে যাওয়া কপালের সিঁদুর তিলক। আর কোনোদিন তার কপালে সিঁদুর উঠবে না। গতরাতে চরের মাঠে মৃত্যু হয়েছে নবু সর্দারের।


হাতের বালাজোড়া খুলে সিক্ত বসন পাল্টাতে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল নবীন, এমন সময় দেখা পেল নিতাইয়ের। নিমের দাঁতন মুখে লিকলিকে কালো বেতের মতো চেহারাটা দেখলে কারোরই ভয় ভক্তি কিছুই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একমাত্র নবীনই জানে নিতাইয়ের আসল গুণের কথা। নবীনকে বাদ দিলে, নিতাইয়ের মতো লাঠিয়াল দু চারটে জেলার মধ্যে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! বন্দুকের গুলিও বোধহয় আটকে দিতে পারে তার হাতের লাঠি!!!

জিজ্ঞাসু মুখে দাঁড়িয়ে পড়তেই নিতাই এসে নতজানু হয়ে পেন্নাম করল নবীনকে। তারপর চাপাস্বরে মুখ নীচু করে বলল “একটু জিরিয়ে নাও কত্তা। বউ রান্না চাপিয়েছে। তোমার আর মা ঠাকরুনের খাবার এই এল বলে। আমি ততক্ষনে জল তুলে দিই গে।”
তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল নবীনের মুখে। রাম-দা টা হাতে করে সে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। শয়নকক্ষের বন্ধ দরজাটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়াল অন্য ঘরটার এক বহু পুরাতন দেরাজের সামনে। হাতের অস্ত্রটাকে দেরাজের পেছনে রেখে নিঃশব্দে খুলে ফেলল তার পাল্লা। কাপড়চোপড়ে ঠাসা দেরাজ। বেশীর ভাগই তার মায়ের। রুচিসম্পন্না সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ছিলেন নবীনের মা। দেরাজের নীচের থেকে ধুতি বার করে পাল্টে নিল নিজের বসন। তারপর বেছে বেছে একটা ভাল শাড়ী জামা তুলে নিল।শোয়ার ঘরের দরজা খুলে সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকল সে। হাতের কাপড়্গুলো খাটের বাজুতে রেখে তাকাল নিদ্রামগ্ন সরজূর দিকে। জানলার দিকে ফিরে অকাতরে ঘুমচ্ছে সরজূ। স্বপ্নালু দৃষ্টিতে একটুক্ষণ দেখে ঘরের কোণ থেকে গুটিয়ে রাখা মাদুরটা নিয়ে পাতলো ঘরের মেঝেতে। তার লৌহময় শরীরেও ক্লান্তিটা এবার ভালই টের পেলো নবীন। মাদুরের ওপর দেহটা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।


নবীন কি স্বপ্ন দেখছে? এক উজ্জ্বল আলোর বৃত্ত মঞ্জিরধ্বনিতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কালিমা সরিয়ে নির্মল আলোকময় করে তুলছে তার সমগ্র স্বত্তাকে। মোহাবিষ্ট করে তুলছে…
এমন সময় এক বেসুরো চাপা কাশির আওয়াজ ভেসে এল তার কানে! চোখ কচলে উঠে বসল সে। আবার চাপা কাশির আওয়াজ হল বন্ধ দরজার বাইরে থেকে।
নিতাই শালা খেতে ডাকছে!
খাটের দিকে নজর ফেরাতেই স্তব্দ হয়ে গেল নবীন। উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের দুই হাতের ওপর মুখ রেখে দুটি অনিন্দ্যসুন্দর চোখে নিস্পন্দ ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে রমণী। সামান্য বিস্ময় মেশানো বিভোর দৃষ্টি।
চোখ নীচু করে নিল নবীন। উঠে দাঁড়িয়ে নীচু স্বরে বলল “খেতে ডাকছে, ..এসো” বলেই ঘরের বাইরে গিয়ে দরজাটা টেনে দিল।
একগলা ঘোমটা টেনে পরমা নেত্যর পাশে দাঁড়িয়ে। নবীন বেরতেই গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে পেন্নাম করল। বড় ভাল মেয়েটা। নবীন নিজে দেখে বিয়ে দিয়েছিল নিতাইয়ের সাথে। উর্বর মাটির গন্ধ মাখা সরল হাসিখুসি গ্রাম্যবধূ। চাপা রং, একটু চঞ্চল, এই যা। তা হোক, স্বামীর বুকে নিজেকে সঁপে দিয়ে দারিদ্রতার মধ্যেও সুখে আছে।


দেরাজের ঘরটার মেঝেতে পরিপাটি করে আহারের ব্যবস্থা করেছে, পাশাপাশি দুটি পিঁড়ি পেতে সামনে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের থালা, তার পাশে গোটা তিনেক বাটি, গেলাসে জল। একপাশে চাপা দেওয়া একটা ভাতের হাঁড়ি, দুটো ঢাকা দেওয়া কড়াই দুটো হাতা। আরো একটা থালা কাত করে রাখা।
নবীন দেখে প্রীত হল।
“যা ভেতরে যা, দেখ যদি…” বলে শোয়ার ঘরের দিকে দেখাল পরমাকে। তারপর এগিয়ে গেল খাবার ঘরের দিকে।
মাথা নীচু করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল পরমা। ভেতর থেকে দরজা ভেজিয়ে দিল।
“ও-মা!!! একেবারে দু-গ্-গা ঠাকুর গো?! এইরকম না হলে কি আমাদের বাবাঠাকুরের পাশে মানায়??? নাও মা ওঠো, সোনার প্রতিমা যে কালি হয়ে গেছে! শিগগির কাপড় পাল্টে, মুখে চোখে জল দিয়ে চাড্ডি খাবে চলো!”


অদ্ভুত সুখস্বপ্নে নিমগ্ন ছিলো সরযূ। সে দাঁড়িয়ে আছে এক ফুলের উপতক্যায়। মায়াবী আলো ভরে রেখেছে চারিধার। দূর থেকে এক অশ্বের হ্রেষাধ্বনি ভেসে আসে তার কানে। সে চোখ তুলে দেখে এক অতীব তেজস্বী কালো ঘোড়ার সওয়ার হয়ে এক দৃপ্ত পুরুষ তার দিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে।কাছে এসে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামল সে। দীর্ঘ শরীর, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, অত্যন্ত পৌরুষদীপ্ত অথচ কমনীয় মুখমন্ডল। কালো পাথরে কোঁদা নগ্ন গাত্রে পেশীগুলি যেন সাপের মতো খেলে বেড়াচ্ছে। ধীর শান্ত পদক্ষেপে তার সামনে এসে নতজানু হল। কোমরের খাপ থেকে তরোয়াল বের করে দুইহাতে রাখলো তার পায়ের কাছে। মোহগ্রস্তের মতো তার দিকে এগিয়ে গেল সরযূ, বাহু ধরে দাঁড় করাল তাকে… কন্ঠলগ্না হলো তার…… তারপর পাখীর কলকাকলিতে ঘুম গেল ভেঙ্গে। অজানা জায়গায়, আচেনা খাট-বিছানা…! শুয়ে শুয়ে অবাক বিস্ময় দেখতে থাকে। ছিমছাম একটি ঘর, জানলা দিয়ে মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে নরম বিছানায়। কখন সে এখানে এসেছে? কার সাথে…? গতরাতে, প্রথমে ডাকাতের আক্রমণ, তারপর…! মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সরযূ। এক চকিত সুখতরঙ্গ যেন বয়ে গেল তার দেহ-মন জুড়ে। এঘরে আরো কেউ আছে!

লম্বা নিঃশ্বাস পড়ছে, বোধহয় ঘুমোচ্ছে। কে দেখি তো? গড়িয়ে খাটের পাশের দিকে যেতেই নজরে পড়ল মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা নিদ্রামগ্ন নবীনকে। মাথা সামান্য এদিকে কাত করে শুয়ে আছে। বাঁ হাত ভাঁজ করে রাখা বুকের ওপর।ডান হাত অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে শরীরের পাশে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ পেশীবহুল দীর্ঘ দেহ। মাথার চুলগুলি ঘন কোঁকড়ানো, ছড়িয়ে আছে মুখের চারপাশে। প্রবল ব্যাক্তিত্তময় আকর্ষক মুখ। খাড়া নাক, প্রসস্ত ললাট, বন্ধ চোখদুটির আকার দেখলে মনে হয় যে সেগুলো যথেষ্ট বড়। নিখুঁত ভাবে ছাঁটা সুদৃশ গোঁফ সুকুমার মুখে একেবারে মানানসই। চাপা মসৃণ গাল, পুরুষ্টু ঠোঁট দুটো গাড় খয়েরি রঙ্গের। সামান্য দৃঢ় আকৃতির চোয়াল। এই কি সেই লোক? কিন্তু কই একে দেখে ত ভয়, আতঙ্ক কিছুই হচ্ছে না! সরযূর গভীর নিভৃত দৃষ্টি নেমে এল নবীনের গলা, বুক, মেদহীন পেট বেয়ে…, কোমরে সহজ ভাবে পরা ধুতিটা একটু গুটিয়ে এলোমেলো হয়ে আছে। অল্প উঁচু হয়ে আছে একজায়গা…।

নিশ্চুপে এক নিষিদ্ধ হাসি খেলে গেল সরযূর মুখে। তার মুখমন্ডল রক্তাভ হয়ে উঠতে লাগলো। সুললিত বাহু ভাঁজ করে দুইকরতলের উল্টপীঠের ওপর চিবুক রেখে অতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নবীনের ঘুমন্ত মুখের দিকে।
অবাক চোখে পরমাকে দেখল সরযূ। গোলগাল হাসিখুসি মুখ। হাসি বা বাচনভঙ্গীতে কোন ছলনা নেই। কেমন একটা আন্তরিকতা প্রকাশ পায় তার কথায়। যেন মনে যা ভাবে তাই বলে। বানিয়ে গুছিয়ে মনের ভাব সে প্রকাশ করতে শেখেনি।
হাল্কা মনে আলস্য কাটিয়ে শয্যা ত্যাগ করল সরযূ।


তৃপ্তি করে খেলো নবীন। নদীর অববাহিকার মাটি খুবই উর্বর, অতি উৎকৃষ্ট মানের চাল উৎপন্ন করে। সেই চালের ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, দু রকম ব্যাঞ্জন ও একবাটি তাজা মাছের ঝোল। আহ – প্রাণ জুড়িয়ে গেল! পাশে বসে সারাক্ষণ নজরে রাখলো নিতাই। খেয়ে দেয়ে উত্তরীয়টা কাঁধে ফেলে বাইরের দাওয়ায় এসে বসল নবীন।
“নে, একছিলিম তামাক সাজা। অনেকদিন তোর হাতে তামাক খাই নি।”
একান ওকান জুড়ে হাসল নিতাই, হাসি ত নয় যেন কোদালের দোকান খুলে বসেছে!
খাওয়ার পরে এঁটো বাসন নিয়ে পরমার সাথে নদীর ঘাটে গেল সরযূ। কিছু কিছু কথা হল তার সঙ্গে, যেমন – এটা কোন জায়গা, জায়গার নাম কি, এ বাড়ী কার, পরমার পরিচয়, তার স্বামীর পরিচয়, এই নদের নাম কি। এত বড় নদ আগে দেখেনি সরযূ। এবং শেষ-মেশ লজ্জায় লাল হয়ে পরমার বাবাঠাকুরের নাম!


সরযূ একটা দুটো প্রশ্ন করে আর পরমা চুরাশি-পঁচাশিটা কথায় তার উত্তর দেয়। মাত্র ঘন্টাখানেকের আলাপেই পরমার বিয়ের গল্প থেকে শুরু করে, তার বাপের বাড়ীর গল্প, ব্রহ্মপুত্র নদের গল্প, বৈকুন্ঠপুরের যাবতীয় খুঁটিনাটি, কখন কোথায় বাজার বসে, কোনটা বড় হাট, মায় গেল বছর তার দুধেল গাইয়ের এঁড়ে বাছুর হওয়া পর্যন্ত সরযূ সব জেনে গেল!! পরম কৌতুকে শুনল সে। একা থেকে থেকে হয়ত কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিল মেয়েটা, এখন প্রায় সমবয়সী একজনকে পেয়ে তার উচ্ছ্বাসের বাণ ডেকেছে।
আর একটা ব্যাপার কথাবার্তার ফাঁকে লক্ষ্য করল সরযূ, তা হলো বাবাঠাকুর-অর্থাৎ নবীন গোঁসাই বলে বিশেষ একজনের প্রতি অকুন্ঠ বিনম্র শ্রদ্ধা।


দুজনে মিলে এসে ঢুকল রান্নাঘরে। মা-ঠাকুরানিকে তার সংসারের হাঁড়ি-হেঁসেল সব বুঝিয়ে তবে না শান্তি!!!
রসদ মোটামুটি আছে, টুকটাক কটা জিনিষ আনিয়ে নিলেই হবে। পরমা আবার আসবে ওবেলা। সরযূ স্নান সেরে চুপ চাপ সারা বাড়ীটা ঘুরে ঘুরে দেখল। নবীনের দেখা নেই, গেছে হয়ত কোথাও…। রাতের অলঙ্কার সব খুলে পুঁটলি পাকিয়ে দেরাজের ঘরে রেখে দিয়েছে। এখন খালি দুই টুকটুকে হাতে শাঁখা নোয়া আর একগাছা করে চুড়ি। গলায় সোনার হার, নাকে নথ, নিটোল পায়ে নূপুর। পরনের শাড়ীটা পুরনো হলেও বেশ ভাল… কার কে জানে?


যেন সাক্ষাৎ হিমালয়কন্যা ভোলানাথের ঘরদোর ঘুরে ঘুরে দেখছে!!!
নবীন বাড়ী ফিরল বেলা দ্বিপ্রহরে। শোয়ার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, সরযূ বিছানায় শুয়ে। ডান হাত ভাঁজ করে চোখের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা। ঘুমচ্ছে কিনা কে জানে?!


সে স্নান করে নিল, তারপর অন্য ঘরটাতে মাদুরটা এনে বেছাল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন একটা ব্যাপারে সে কোন উত্তর খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। আর পাচ্ছে না বলেই আরো চিন্তান্বিত আরও গম্ভীর হয়ে পড়েছে। গতরাতে তার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা তার জীবনটাকেই অন্য পথে নিয়ে চলে গেছে। নিজেকে সে কোনোদিন ঠকায় নি, আজও পারবে না। এক জঘন্য চরিত্র নিজের খেয়ালে তার জীবন নিয়ে খেলা করেছে। প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধকে ভালবাসতে শেখা এক কোমল মনের মানুষকে এক ভয়ঙ্কর আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। প্রতিশোধের অনির্বাণ আগুন ভেতরে নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য করেছে নিশুতি রাতের বনে বাদাড়ে। দীর্ঘ বারটা বছর..বড় কম কথা নয়। চিতাভস্ব হাতে নিয়ে সে যা প্রতিজ্ঞা করেছিল তা সে পালন করেছে। কিন্তু এই মারামারি, ডাকাতি, হিংস্রতার সঙ্গে এই অসামান্য রূপসী নারীর উপস্থিতিটাই সে খাপ খাওয়াতে পারছে না। নারীসংশ্রব সে সযত্নে এড়িয়েই এসেছে এতদিন। এ বিষয়ে তার নিজের কোনো গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না তা নিয়েও কখনও ভাবেনি। আর ভাববেই বা কি করে? যার বুক থেকে হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে নেওয়ার মতো সদ্য বিয়ে করা সুন্দরী নববধূকে তার চোখের সামনে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যাকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলে রেখে যাওয়া হয় জঙ্গলের প্রান্তে, যার বাপ মাকে ঘরে বন্ধ করে সেইসুদ্ধু সব কিছু জ্বালিয়ে খাক করে দেওয়া হয় এক নিছক ভুল খবরের পরিপ্রেক্ষিতে….. তার পক্ষে কোনও রমণীর দিকে চোখ তুলে তাকানো বা ভাবা একেবারেই সম্ভব নয়।

জীবনের প্রথম যৌনতা সে চরমভাবে উপভোগ করেছে। কাঁটাবিহীন তাজা গোলাপগুচ্ছের মতো দেহার্ঘ্য তাকে সমর্পণ করেছে রমণী, রতিসুখের বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দস্রোতে ভেসে গেছে তার সাথে। কিন্তু তারপর?
চোখ জ্বালা করে ওঠে নবীনের, মাথার ভেতর ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। উঠে পড়ল নবীন। গিয়ে বসল নদীর ঘাটে। কুল ছাপানো ব্রহ্মপুত্র আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে, তরঙ্গায়িত জলরাশি ছলাক ছলাক শব্দে নবীনের পায়ের কাছের পাড়ে এক সুরেলা কলস্রোত তুলছে… আচ্ছা; এ ত অনেক দেখেছে, অনেক জেনেছে, নীরব না থেকে এ কি পারে না এক রিক্ত প্রাণের সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে??? পারে না এক আকুলিত হৃদয়ের কি করনীয় তাকে বলে দিতে???
এক মাতাল দমকা হাওয়া ভেসে আসে। শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায় নবীনকে, কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না।
[+] 7 users Like modhon's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ডাকাতের বউ by hotmirch - by modhon - 10-04-2021, 06:14 AM



Users browsing this thread: 4 Guest(s)