10-04-2021, 06:05 AM
(This post was last modified: 10-04-2021, 06:06 AM by modhon. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
পরিমল তার মেয়েকে ঠকায়নি। মহাজনের বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব থেকে শুরু করে গোপাল সামন্তর কুখ্যাতি, তার যতটা জানা ছিল সবটাই সে সরযূকে বলেছিল। খালি সামন্তর উদগ্র লোভ ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী বাদে। সব কিছু পরিমলের জানা সম্ভব ছিল না, বিশেষ করে গোপালের চোদনবাজ স্বভাবের কথা, আর তাছাড়া, দেশ- কাল নির্বিশেষে, কোন বাবাই পারবে না ভাবী স্বামীর পিশাচ পরিচয় তার মেয়েকে আগাম খুলে বলতে। অন্ধকার ঘরে বাপের দুই হাঁটুর ওপর মাথা রেখে সরযু একমনে সব শুনল। মা কবে সেই ছোটবেলায়ে চলে গেছে, বাবা চাইলে আরও একটা বিয়ে করতে পারত, কিন্তু কোনোদিন সে সব করে নি। বুকের ওপর পাথর চাপিয়ে একরত্তি মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে এতকাল সব কষ্ট সহ্য করেছে। জেনে বুঝে তার বাপ কোনোদিন তাকে খারাপ লোকের হাতে তুলে দিতে পারে না। যারা বড়লোক ধনী , তাদের সন্মন্ধে কুৎসা গ্রামে গঞ্জে রটেই থাকে, এ নিয়ে মাথা খারাপ করারও কিছু নেই।
আর বয়েস ?? এই ত বছর দেড়েক আগে তার ছোটবেলার সাথী পারুলের বিয়ে হল কুমারডুবি গ্রামের পাটের ব্যাবসাদার বিপত্নীক ধনপতি পোদ্দারের সাথে। সে ত পারুলের জ্যাঠার বয়সী !! তাই বলে পারুল কি সুখী হয় নি? তা হলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অমন সুন্দর চাঁদের মত ছেলে নিয়ে যে বাপের বাড়ী ঘুরে গেল, সে কি এমনি এমনিই না কি!! সরযূ ত গিয়েছিল তখন পারুলের কাছে, দুই সখীতে কত গল্প করেছিল, কানে কানে, খিলখিলিয়ে!! চুপি চুপি পারুল তখন কত কি যে বলেছিল সরযূকে…
না না আমি মোটেই আড়ি পাতিনি সেইসময়, যে আপনাদের সব কিছু খুলে বলব। আর আপনাদেরই বা অত কৌতূহল কিসের? যা বলছি চুপ চাপ শুনে যান!!
সবই ঠিক আছে, কিন্তু লোকটার চোখের দৃষ্টিটা মনে পড়তে শরীরটা যেন একটু কেঁপে উঠল সরযূর.. কেমন যেন কঠিন.. যেন নির্দয়.. তার অতীব সুন্দর চোখের কোণা থেকে দু ফোঁটা জল কাশ্মীরি আপেলের মত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
তার ভাগ্যে কি এর থেকে ভাল বর ছিল না? যে তার বন্ধু হবে, তাকে ভালবাসবে? যে তার এই দুঃখী বাবাকে কষ্টের হাত থেকে বাঁচাবে..? সরযূ নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। খাটের কোণায়ে বসে পরিমল অনুভব করল সে কান্না, তার হাঁটুর কাছে ধুতিটা ভিজে উঠল। একবার তার মনে হল – মেয়েটাকে নিয়ে কোন দূর দূরান্তে পালিয়ে যেতে..
কিন্তু তাহলে জমি বাড়ী ছেড়ে চিরতরে তাকে চলে যেতে হবে! কোথায়ে যাবে? কার কাছে? মাধাই? সে ত বছরে, দু বছরে একবার খোঁজ নেয় কি না সন্দেহ !! পরিমলের কোন চরম বিপদ হলে অবশ্য আলাদা কথা, কিন্তু মহাজন ত তার সাথে কোনদিন খারাপ ব্যাবহার করে নি। অত্তন্ত ভদ্রভাবে নিজের বাড়ীতে ডেকে একান্তে প্রস্তাব করেছিল। কোন দাবি সে করে নি।
রাজী হল সরযূ। তবে এক শর্তে – যার কথা আপনাদের আমি আগেই বলেছি । স্বামীর বাড়ী দেখে অবাক হল সরযূ, এত বড় বাড়ীতে তাকে থাকতে হবে? ঝি-চাকরে ভর্তি ! দামী দামী আসবাব, ছাদ থেকে ঝাড় ঝুলছে, এখানে সেখানে মার্বেলের মূর্তি .. সবকটা ভাল না, স্বামীকে বলে কয়েকটা সে সরিয়ে দেবে।
রাত গভীর হয়েছে, আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। পূর্ণিমার এখনও দুদিন দেরি আছে। বিয়েবাড়ী আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এসেছে। দোতলার বিশাল শোয়ার ঘরে ফুল দিয়ে অসাধারণ সুসজ্জিত বিরাট পালঙ্কে সরযূ একা শুয়ে । তার মাথা থেকে পা অবধি সোনার গয়েনায়ে মোড়া, সামান্য তার মায়ের, বাকিটা সামন্তর দেওয়া। এইভাবে যখন সে পালকি থেকে নেমেছিল, তাকে দেখে পুরো রাঘুনাথপুর থ বনে গিয়েছিল, গোপাল সামন্তর বৌয়ের মত রূপসী আশপাশের দু তিনটে জেলার মধ্যে আর দ্বিতীয় পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!!
একতলার আসর তখন শেষ হবার মুখে। গোপাল সামন্তর নেশায় সব কিছু বেশ গোলাপি লাগছে। পাঁচুও তার দলবল নিয়ে বেশ দু পাত্তর চড়িয়েছে, বাড়ীর পেছন দিকটায়ে বসে। আজ রাতে আর পাহারার দরকার নেই।
আকাশে মেঘ নেই, উজ্জল চাঁদের আলোয়ে দিক-চরাচর ভেসে যাচ্ছে । রাত্রি যেন হটাৎ যোগিনী রূপ ধারন করেছে। এমন সময়ে একটা কালো ঘোড়ার সওয়ারির পেছু পেছু রণপা চড়ে ত্রিশটা কালি-ঝুলি মাখা বিকট মূর্তি নিঃশব্দে এসে গোপাল সামন্তর বাড়ীর পিছনের বাঁশঝাড়ে জড়ো হল।
ঘোড়ার ওপর বসে নবু সর্দার!
একদম বাছাই করা লোকদের নিয়ে এসেছে নবু ; আজকে কোন ভূল সে হতে দেবে না। প্রত্যেককে নির্দেশ দেওয়া আছে, আজকের কাজটা অন্যরকম। ঘোড়া থেকে নেমে দলের লোকদের সামনে টান হয়ে দাঁড়াল নবু, খালি গা, একটা খাটো ধুতি মালকোঁচা মেরে পরা, তার ওপর কোমরে একটা লাল কাপড় গোল করে পাকিয়ে বাঁধা। কপালে লাল সিঁদুরের তিলক, ডান হাতে ধরা নবুর অতিপ্রিয় ভীষণদর্শন রাম-দা। যার একটি কোপে বাঘের মাথাও ঘাড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে। দুই কব্জিতে মোটা সোনার বালা। আগুনের ভাঁটার মত তার দুচোখ জ্বলছে । দলের লোকদের মতো আজ কালি মাখেনি নবু, একটি বিশেষ কারণে।
তার চোখের ঈশারায় খাস স্যাঙাৎ কালিপদ নিঃশব্দে আরও দু-তিন জনের সাথে গোপাল সামন্তর বাড়ীর পিছনের দেওয়ালের গায়ে রণপার লম্বা বাঁশগুলো একটু আড়াআড়ি ভাবে দাঁড় করিয়ে দিল। এমনভাবে যাতে বাঁশের ওপর
দাঁড়ালে দুই হাত ওপরে পাঁচিলের সীমাটা নাগালে এসে যাবে।
নবুর কালো বাঘের মত শরীরটা নিশ্চুপে বাঁশটা বেয়ে উঠে দুই হাত বাড়িয়ে পাঁচিলের ওপরটা চেপে ধরল, তারপর দু হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে উঠে গেল দেওয়ালের মাথায়। চওড়া দেয়ালের ওপর হামাগুড়ির ভঙ্গীতে বসে চার- পাশটা দেখে নিল। তারপর উঁকি দিল নিচের দিকে। দলের বাকিরা তখন পাঁচিলের কাছে এসে মুখ উঁচু করে সর্দারের ঈশারার অপেক্ষায়।
গোপাল সামন্তর বাড়ীর উত্তর দিকের দেয়ালের গায়ে একসারি ঘর, এগুলো ব্যাবহার হয় কাজের লোকদের । তার পর বেশ বড় ও চওড়া শান বাঁধানো উঠোন তারপর মূল দালান। এরকমই একটা ঘরের সামনে নবুর দিকে পেছন করে পাঁচু দাঁড়িয়ে হুঁকো টানছে। মৌতাত তার ভালই জমেছে, তামাকটা খেয়ে সে শুতে যাবে। হটাৎ তার মনে হল যেন বাঁশঝাড়ের নিকষ কালো অন্ধকারটা তার ওপর নেমে এল। মাথায়ে ভারী কিছুর একটা আঘাত, আর সঙ্গে সঙ্গে দু চোখের পাতা ভারী হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। কোথা দিয়ে কি হল বোঝার আগেই তার ষাঁড়ের মত দেহটা শান বাঁধানো মেঝের উপর সপাটে আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাল । কাজটা নিচু হয়ে দেখে নিয়ে মুখে দু আঙ্গুল ঢুকিয়ে তীব্র শিস দিল নবু। মুহূর্তের মধ্যে তার দলের লোকেরা গগনভেদী হা-রে-রে-রে-রে চীৎকারে নিশুতি রাতের নিঝুমতাকে খান খান করে পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে লাফিয়ে পড়ল সামন্তর বাড়ীর ভিতর।
আচমকা এক ভয়ানক শিস আর তারপর ডাকাতদের এই ভয়ংকর গর্জন, গোপাল সামন্ত সমেত সারা বাড়ীর লোকজনকে তটস্থ করে তুলল। যে , যে অবস্থায়ে ছিল, হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে এল ডাকাতদের ঠেকাতে।
নবুর নির্দেশে কালিপদ পাঁচুর শরীরটা পিছমোড়া করে বাঁধল; তারপর দলের বাকি লোকদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সামন্তর বাড়ীর ওপর। শুরু হল দরজা জানলা ভাঙ্গা, ঝাড় সুদ্ধু বড় বড় আলোর বাতিগুলো লাঠির এবং বল্লমের আঘাতে গুঁড়িয়ে পড়ল, তার জায়গাএ জ্বলে উঠল ডাকাতদের মশাল। শুরু হল দু পক্ষের ধুন্ধুমার লড়াই!!
নবু এর মধ্যে একতলার কার্নিশ বেয়ে উঠে দোতলার বারান্দার রেলিং টপকে দোতলার সিঁড়ির মুখে গিয়ে হাজির হল। বাড়ীতে ডাকাত পড়াতে গোপাল সামন্ত প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন, কার এতবড় সাহস যে বাঘের ঘরে হানা দেয়? পরমুহূর্তে পাঁচুর নাম ধরে চীৎকার করে তিনি দৌড়লেন দোতলার শোয়ার ঘর থেকে বন্দুকটা আনতে। সবে তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে শোয়ার ঘরের দিকে ঘুরতে যাবেন, এমন সময় এক ভীষণ ছায়ামূর্তি তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ওদিকে তখন একতলায়ে মারাত্বক লড়াই লেগেছে ডাকাতদের সঙ্গে। লাঠালাঠি, চীৎকার, মানুষের আর্তনাদ মিলিয়ে এক হুলুস্থুল কান্ড!! ডাকাতরা বাড়ীর ভেতর ঢুকে পড়েছে! কালিপদ কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে দোতলায়ে উঠে এল; প্রত্যেকের হাতে খোলা তরোয়াল, উঠে দেখে দোতলার দালানে এক ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে সর্দার আর সামন্তর মধ্যে … কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, আচমকা নবীনের এক অদ্ভুত প্যাঁচে সামন্তর শরীরটা দলা পাকিয়ে সজোরে ছিটকে পড়ল দালানের এক মোটা থামের গায়ে। পুরো দেহটা কুঁকড়ে গেল যন্ত্রণায়ে; কাছে এসে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সামন্তকে দেখল নবু, তারপর তার লোকদের হুকুম দিল লোকটাকে তুলে থামের সাথে পিছমোড়া করে বাঁধতে।
বাঁধা হলে কাছে গিয়ে গোপাল সামন্তর বুকের ওপর ঝুলে পড়া মুখটা বাঁ হাতে তুলে ধরল নবু , মশালের আলোয়ে সামন্ত ধীরে ধীরে চোখ তুলল সামনে দাঁড়ান ডাকাত সর্দারের জ্বলজ্বলে চোখের দিকে। বিস্ফারিত হয়ে উঠল তাঁর চোখের দৃষ্টি..!
‘নবীন?… তুই??’
‘চিনতে পেরেছ তাহলে!!” এক চরম বাঁকা হাসিতে জবাব দেয় নবু সর্দার।
‘তোকে আমি…..” এক প্রচণ্ড চীৎকার বেরোয়ে গোপাল সামন্তর বুক চিরে ।
“থামো!!!” গর্জে ওঠে নবীন, তারপর সামন্তর মুখের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে..
“মনে পড়ে?? বারো বছর আগের কথা? সেদিন বিশালাক্ষীর জঙ্গলের ধারে আমিও তোমার পায়ে পড়েছিলাম!! শুনেছিলে তুমি?? মুখে লাথি মেরে অজ্ঞান করে সব কিছু শেষ করে দিয়েছিলে! আজ সেই অন্যায়ের শোধ তুলব!
তোমার ঘর – দোর জ্বালিয়ে তোমার চোখের সামনে দিয়ে তোমার বিয়ে করা সুন্দরী বউকে তুলে নিয়ে যাব!! দেখব তুমি আমার কি করতে পার!!”
নবীনের শেষ কথাগুলো যেন সাপের হিসহিসানির মতো শোনাল।
আর বয়েস ?? এই ত বছর দেড়েক আগে তার ছোটবেলার সাথী পারুলের বিয়ে হল কুমারডুবি গ্রামের পাটের ব্যাবসাদার বিপত্নীক ধনপতি পোদ্দারের সাথে। সে ত পারুলের জ্যাঠার বয়সী !! তাই বলে পারুল কি সুখী হয় নি? তা হলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অমন সুন্দর চাঁদের মত ছেলে নিয়ে যে বাপের বাড়ী ঘুরে গেল, সে কি এমনি এমনিই না কি!! সরযূ ত গিয়েছিল তখন পারুলের কাছে, দুই সখীতে কত গল্প করেছিল, কানে কানে, খিলখিলিয়ে!! চুপি চুপি পারুল তখন কত কি যে বলেছিল সরযূকে…
না না আমি মোটেই আড়ি পাতিনি সেইসময়, যে আপনাদের সব কিছু খুলে বলব। আর আপনাদেরই বা অত কৌতূহল কিসের? যা বলছি চুপ চাপ শুনে যান!!
সবই ঠিক আছে, কিন্তু লোকটার চোখের দৃষ্টিটা মনে পড়তে শরীরটা যেন একটু কেঁপে উঠল সরযূর.. কেমন যেন কঠিন.. যেন নির্দয়.. তার অতীব সুন্দর চোখের কোণা থেকে দু ফোঁটা জল কাশ্মীরি আপেলের মত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
তার ভাগ্যে কি এর থেকে ভাল বর ছিল না? যে তার বন্ধু হবে, তাকে ভালবাসবে? যে তার এই দুঃখী বাবাকে কষ্টের হাত থেকে বাঁচাবে..? সরযূ নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। খাটের কোণায়ে বসে পরিমল অনুভব করল সে কান্না, তার হাঁটুর কাছে ধুতিটা ভিজে উঠল। একবার তার মনে হল – মেয়েটাকে নিয়ে কোন দূর দূরান্তে পালিয়ে যেতে..
কিন্তু তাহলে জমি বাড়ী ছেড়ে চিরতরে তাকে চলে যেতে হবে! কোথায়ে যাবে? কার কাছে? মাধাই? সে ত বছরে, দু বছরে একবার খোঁজ নেয় কি না সন্দেহ !! পরিমলের কোন চরম বিপদ হলে অবশ্য আলাদা কথা, কিন্তু মহাজন ত তার সাথে কোনদিন খারাপ ব্যাবহার করে নি। অত্তন্ত ভদ্রভাবে নিজের বাড়ীতে ডেকে একান্তে প্রস্তাব করেছিল। কোন দাবি সে করে নি।
রাজী হল সরযূ। তবে এক শর্তে – যার কথা আপনাদের আমি আগেই বলেছি । স্বামীর বাড়ী দেখে অবাক হল সরযূ, এত বড় বাড়ীতে তাকে থাকতে হবে? ঝি-চাকরে ভর্তি ! দামী দামী আসবাব, ছাদ থেকে ঝাড় ঝুলছে, এখানে সেখানে মার্বেলের মূর্তি .. সবকটা ভাল না, স্বামীকে বলে কয়েকটা সে সরিয়ে দেবে।
রাত গভীর হয়েছে, আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। পূর্ণিমার এখনও দুদিন দেরি আছে। বিয়েবাড়ী আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এসেছে। দোতলার বিশাল শোয়ার ঘরে ফুল দিয়ে অসাধারণ সুসজ্জিত বিরাট পালঙ্কে সরযূ একা শুয়ে । তার মাথা থেকে পা অবধি সোনার গয়েনায়ে মোড়া, সামান্য তার মায়ের, বাকিটা সামন্তর দেওয়া। এইভাবে যখন সে পালকি থেকে নেমেছিল, তাকে দেখে পুরো রাঘুনাথপুর থ বনে গিয়েছিল, গোপাল সামন্তর বৌয়ের মত রূপসী আশপাশের দু তিনটে জেলার মধ্যে আর দ্বিতীয় পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!!
একতলার আসর তখন শেষ হবার মুখে। গোপাল সামন্তর নেশায় সব কিছু বেশ গোলাপি লাগছে। পাঁচুও তার দলবল নিয়ে বেশ দু পাত্তর চড়িয়েছে, বাড়ীর পেছন দিকটায়ে বসে। আজ রাতে আর পাহারার দরকার নেই।
আকাশে মেঘ নেই, উজ্জল চাঁদের আলোয়ে দিক-চরাচর ভেসে যাচ্ছে । রাত্রি যেন হটাৎ যোগিনী রূপ ধারন করেছে। এমন সময়ে একটা কালো ঘোড়ার সওয়ারির পেছু পেছু রণপা চড়ে ত্রিশটা কালি-ঝুলি মাখা বিকট মূর্তি নিঃশব্দে এসে গোপাল সামন্তর বাড়ীর পিছনের বাঁশঝাড়ে জড়ো হল।
ঘোড়ার ওপর বসে নবু সর্দার!
একদম বাছাই করা লোকদের নিয়ে এসেছে নবু ; আজকে কোন ভূল সে হতে দেবে না। প্রত্যেককে নির্দেশ দেওয়া আছে, আজকের কাজটা অন্যরকম। ঘোড়া থেকে নেমে দলের লোকদের সামনে টান হয়ে দাঁড়াল নবু, খালি গা, একটা খাটো ধুতি মালকোঁচা মেরে পরা, তার ওপর কোমরে একটা লাল কাপড় গোল করে পাকিয়ে বাঁধা। কপালে লাল সিঁদুরের তিলক, ডান হাতে ধরা নবুর অতিপ্রিয় ভীষণদর্শন রাম-দা। যার একটি কোপে বাঘের মাথাও ঘাড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে। দুই কব্জিতে মোটা সোনার বালা। আগুনের ভাঁটার মত তার দুচোখ জ্বলছে । দলের লোকদের মতো আজ কালি মাখেনি নবু, একটি বিশেষ কারণে।
তার চোখের ঈশারায় খাস স্যাঙাৎ কালিপদ নিঃশব্দে আরও দু-তিন জনের সাথে গোপাল সামন্তর বাড়ীর পিছনের দেওয়ালের গায়ে রণপার লম্বা বাঁশগুলো একটু আড়াআড়ি ভাবে দাঁড় করিয়ে দিল। এমনভাবে যাতে বাঁশের ওপর
দাঁড়ালে দুই হাত ওপরে পাঁচিলের সীমাটা নাগালে এসে যাবে।
নবুর কালো বাঘের মত শরীরটা নিশ্চুপে বাঁশটা বেয়ে উঠে দুই হাত বাড়িয়ে পাঁচিলের ওপরটা চেপে ধরল, তারপর দু হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে উঠে গেল দেওয়ালের মাথায়। চওড়া দেয়ালের ওপর হামাগুড়ির ভঙ্গীতে বসে চার- পাশটা দেখে নিল। তারপর উঁকি দিল নিচের দিকে। দলের বাকিরা তখন পাঁচিলের কাছে এসে মুখ উঁচু করে সর্দারের ঈশারার অপেক্ষায়।
গোপাল সামন্তর বাড়ীর উত্তর দিকের দেয়ালের গায়ে একসারি ঘর, এগুলো ব্যাবহার হয় কাজের লোকদের । তার পর বেশ বড় ও চওড়া শান বাঁধানো উঠোন তারপর মূল দালান। এরকমই একটা ঘরের সামনে নবুর দিকে পেছন করে পাঁচু দাঁড়িয়ে হুঁকো টানছে। মৌতাত তার ভালই জমেছে, তামাকটা খেয়ে সে শুতে যাবে। হটাৎ তার মনে হল যেন বাঁশঝাড়ের নিকষ কালো অন্ধকারটা তার ওপর নেমে এল। মাথায়ে ভারী কিছুর একটা আঘাত, আর সঙ্গে সঙ্গে দু চোখের পাতা ভারী হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। কোথা দিয়ে কি হল বোঝার আগেই তার ষাঁড়ের মত দেহটা শান বাঁধানো মেঝের উপর সপাটে আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাল । কাজটা নিচু হয়ে দেখে নিয়ে মুখে দু আঙ্গুল ঢুকিয়ে তীব্র শিস দিল নবু। মুহূর্তের মধ্যে তার দলের লোকেরা গগনভেদী হা-রে-রে-রে-রে চীৎকারে নিশুতি রাতের নিঝুমতাকে খান খান করে পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে লাফিয়ে পড়ল সামন্তর বাড়ীর ভিতর।
আচমকা এক ভয়ানক শিস আর তারপর ডাকাতদের এই ভয়ংকর গর্জন, গোপাল সামন্ত সমেত সারা বাড়ীর লোকজনকে তটস্থ করে তুলল। যে , যে অবস্থায়ে ছিল, হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে এল ডাকাতদের ঠেকাতে।
নবুর নির্দেশে কালিপদ পাঁচুর শরীরটা পিছমোড়া করে বাঁধল; তারপর দলের বাকি লোকদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সামন্তর বাড়ীর ওপর। শুরু হল দরজা জানলা ভাঙ্গা, ঝাড় সুদ্ধু বড় বড় আলোর বাতিগুলো লাঠির এবং বল্লমের আঘাতে গুঁড়িয়ে পড়ল, তার জায়গাএ জ্বলে উঠল ডাকাতদের মশাল। শুরু হল দু পক্ষের ধুন্ধুমার লড়াই!!
নবু এর মধ্যে একতলার কার্নিশ বেয়ে উঠে দোতলার বারান্দার রেলিং টপকে দোতলার সিঁড়ির মুখে গিয়ে হাজির হল। বাড়ীতে ডাকাত পড়াতে গোপাল সামন্ত প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন, কার এতবড় সাহস যে বাঘের ঘরে হানা দেয়? পরমুহূর্তে পাঁচুর নাম ধরে চীৎকার করে তিনি দৌড়লেন দোতলার শোয়ার ঘর থেকে বন্দুকটা আনতে। সবে তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে শোয়ার ঘরের দিকে ঘুরতে যাবেন, এমন সময় এক ভীষণ ছায়ামূর্তি তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ওদিকে তখন একতলায়ে মারাত্বক লড়াই লেগেছে ডাকাতদের সঙ্গে। লাঠালাঠি, চীৎকার, মানুষের আর্তনাদ মিলিয়ে এক হুলুস্থুল কান্ড!! ডাকাতরা বাড়ীর ভেতর ঢুকে পড়েছে! কালিপদ কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে দোতলায়ে উঠে এল; প্রত্যেকের হাতে খোলা তরোয়াল, উঠে দেখে দোতলার দালানে এক ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে সর্দার আর সামন্তর মধ্যে … কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, আচমকা নবীনের এক অদ্ভুত প্যাঁচে সামন্তর শরীরটা দলা পাকিয়ে সজোরে ছিটকে পড়ল দালানের এক মোটা থামের গায়ে। পুরো দেহটা কুঁকড়ে গেল যন্ত্রণায়ে; কাছে এসে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সামন্তকে দেখল নবু, তারপর তার লোকদের হুকুম দিল লোকটাকে তুলে থামের সাথে পিছমোড়া করে বাঁধতে।
বাঁধা হলে কাছে গিয়ে গোপাল সামন্তর বুকের ওপর ঝুলে পড়া মুখটা বাঁ হাতে তুলে ধরল নবু , মশালের আলোয়ে সামন্ত ধীরে ধীরে চোখ তুলল সামনে দাঁড়ান ডাকাত সর্দারের জ্বলজ্বলে চোখের দিকে। বিস্ফারিত হয়ে উঠল তাঁর চোখের দৃষ্টি..!
‘নবীন?… তুই??’
‘চিনতে পেরেছ তাহলে!!” এক চরম বাঁকা হাসিতে জবাব দেয় নবু সর্দার।
‘তোকে আমি…..” এক প্রচণ্ড চীৎকার বেরোয়ে গোপাল সামন্তর বুক চিরে ।
“থামো!!!” গর্জে ওঠে নবীন, তারপর সামন্তর মুখের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে..
“মনে পড়ে?? বারো বছর আগের কথা? সেদিন বিশালাক্ষীর জঙ্গলের ধারে আমিও তোমার পায়ে পড়েছিলাম!! শুনেছিলে তুমি?? মুখে লাথি মেরে অজ্ঞান করে সব কিছু শেষ করে দিয়েছিলে! আজ সেই অন্যায়ের শোধ তুলব!
তোমার ঘর – দোর জ্বালিয়ে তোমার চোখের সামনে দিয়ে তোমার বিয়ে করা সুন্দরী বউকে তুলে নিয়ে যাব!! দেখব তুমি আমার কি করতে পার!!”
নবীনের শেষ কথাগুলো যেন সাপের হিসহিসানির মতো শোনাল।