21-03-2021, 09:22 AM
ধর্ম
গরমটা বেজায় পড়েছে। মাথার তালু পর্যন্ত তেতে যাচ্ছে যেন!
ঘাম মুছতে মুছতে সেকথাই ভাবছিলেন বিরিঞ্চিপুরের নির্বাচনের প্রার্থী অমিয়বাবু।
অবশ্য প্রার্থী উনি একেবারেই শেষ মুহূর্তে হয়েছেন। ওই অনাদিরা কিসব বোঝালো, উনি রাজি হয়ে গেলেন। নইলে ওনাকে আর কে চেনে! তবে, রাজি হয়ে পড়েছেন আসল বিপদে। রোজ সকাল থেকে রাত চরে বেড়াতে হচ্ছে নির্বাচন কেন্দ্রের এদিক থেকে ওদিকে। এই গরমে! আজ আবার প্রচার হবে লোকাল ট্রেনে। ওনার প্রচারের কাজ দেখে যে ছেলেটি, সে বুঝিয়েছে যে রাস্তায় ঘুরে প্রচারের থেকে লোকাল ট্রেনে একসাথে অনেক মানুষকে পাওয়া যাবে, আবার বেশ অভিনব ব্যাপার ও হবে, তাই মিডিয়াও সুন্দর করে কভারেজ দেবে। সাথে আজ বিশেষ কেউ নেই, শুধু আড়ালে একজন ফটোগ্রাফার আছে, যে কিনা সুযোগ বুঝে ফটো তুলে নেবে...বাকি সব প্রচারের ছেলেটিই করবে যা করার। যারা এখনও ওনাকে চেনে না, তারাও চিনে যাবে আজ ই।
ট্রেন আসছে। হাতের লস্যির প্যাকেটে শেষ চুমুকটা দিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে ফেললেন অমিয়বাবু। বেড়ে বুদ্ধিটা দিয়েছে ছোকরা। প্রচার কে প্রচার, আবার উনি যে কত মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ, সেটাও বোঝা যাবে। নইলে ধর্ম, বর্ণ এসবের ভিত্তিতে ভোট আজকাল আর ভাগ হয় না। কম চেষ্টা তো আর করা হয়নি!
ভাবতে ভাবতেই ট্রেন এসে গেল। একটা জেনারেল কামরায় উঠে পড়লেন অমিয় বাবু। এবার আলাপ জমাবেন সবার সাথে। বুঝিয়ে দেবেন, উনি কত ভাল, যোগ্য।
ট্রেনে উঠে অভ্যাস মতো একটু দেঁতো হাসি দিলেন অমিয়বাবু। হাসি হাসি মুখে ফটো ভাল আসে! আর ওনাকে পইপই করে বলা হয়েছে কোনও বয়স্ক মানুষ, বা বাচ্চাদের সাথে ভাল করে কথা বলতে, যাতে সেই ছবি তোলা যায়। কিন্তু...এই কামরায় তো সেরকম কাউকে...
ভাবতে ভাবতে চোখ ঘুরিয়ে দেখেন একজন ভদ্রলোক বসে আছেন একটি সিটের তৃতীয় আসনে। হাতে একটা টুকরি। অনেকটা কালিঘাট বা দক্ষিনেশ্বরে পুজো দিলে যেরকম টুকরিতে প্রসাদ পাওয়া যায়, সেরকম। এই তো ভাল ছবি! ওনার কাছ থেকে প্রসাদ চেয়ে নিতে হবে, আর সেই ছবি উঠবে।
কয়েকজনকে টপকে সেইদিকে চলে এলেন অমিয় বাবু। এবার আবার মুখ হাসি হাসি করার পালা।
কিন্তু এ কি! এই লোক আগে থেকেই টুকরিটা খুলছে কেন? কিভাবে জানতে পারল যে উনি প্রসাদ চাইতেই যাচ্ছেন?
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন অমিয় বাবু...হঠাৎ দেখলেন ভদ্রলোক টুকরি থেকে কয়েকটা মিষ্টি বের করে ওনার সামনে বসা দুটো বাচ্চাকে দিলেন...যাঁরা "ক্ষিধে পেয়েছে...ও আব্বু ক্ষিধে পেয়েছে..." বলে একটানা ঘ্যানঘেনে সুরে কাঁদছিল অনেকক্ষণ ধরে...আর, মলিন পোষাক পরা আব্বু বলছিলেন "চুপ যাও বা'জান! বাড়ি গিয়ে খাবা!" স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, কিছু কিনে দেবার পরসা নেই ওঁর কাছে। আর তাই, সামনের ভদ্রলোক মিষ্টি বাড়িয়ে দিলেন ওদের দিকে। আহা, এর পর জল খেয়ে পেটটা একটু ঠান্ডা হবে বাছাদের...। কিন্তু...চলন্ত ট্রেনে জল ই বা কোথায়...
বারবার করে পার্টির সবাই বলে দিয়েছে হাসি মুখে থাকতে, তাও যে কেন চোখ ঝাপসা হয়ে যায় ছাই! কেন যে গলার কাছটা ভারি হয়ে আসে...
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে অমিয় বাবু। তারপর পাঞ্জাবির পকেটে রাখা ছোট্ট জলের বোতল বের করে ওদের হাতে দিলেন।
বাচ্চা দুটো গোগ্রাসে মিষ্টি খাচ্ছে তখন।
বোতল দেখে ওঁর দিকে একবার তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।
আহা, কী ক্ষুধার আর্তি ভরা চোখ!
না জানি কত তৃষ্ণা জমে আছে ওই ছোট্ট বুকদুটিতে!
অবিকল যেন ওঁর নিজের মুখ... যখন দুবেলা ভাত খাওয়াই ছিল বড় লড়াই।
আর এই পোড়া দেশে তো খাবারের জন্য, জলের জন্যও...খুন করা যায় নির্বিচারে...
কী যে হলো অমিয়বাবুর...হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন ওদের সামনে। বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলেন "আজ বুঝেছি বাবারা...পেটের আগুনের চেয়ে বড় ধর্ম আর কিচ্ছু নেই। আর কিচ্ছু লাগবে না...দুটো খেয়ে - পরে বাঁচুক সবাই...আর কিচ্ছু না... অনেক দেরিতে মনে পড়ল সব আবার, বা'জানেরা...ক্ষমা করে দে আমাকে..."
অন্য কোনো দিকে চোখ ছিল না অমিয়বাবুর... থাকলে দেখতে পারতেন কামরার সবাই ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছে...আর তাদের দৃষ্টি দিয়ে ঝরে পড়ছে একজন ভালো মানুষকে কাছে পাবার আনন্দ...
গরমটা বেজায় পড়েছে। মাথার তালু পর্যন্ত তেতে যাচ্ছে যেন!
ঘাম মুছতে মুছতে সেকথাই ভাবছিলেন বিরিঞ্চিপুরের নির্বাচনের প্রার্থী অমিয়বাবু।
অবশ্য প্রার্থী উনি একেবারেই শেষ মুহূর্তে হয়েছেন। ওই অনাদিরা কিসব বোঝালো, উনি রাজি হয়ে গেলেন। নইলে ওনাকে আর কে চেনে! তবে, রাজি হয়ে পড়েছেন আসল বিপদে। রোজ সকাল থেকে রাত চরে বেড়াতে হচ্ছে নির্বাচন কেন্দ্রের এদিক থেকে ওদিকে। এই গরমে! আজ আবার প্রচার হবে লোকাল ট্রেনে। ওনার প্রচারের কাজ দেখে যে ছেলেটি, সে বুঝিয়েছে যে রাস্তায় ঘুরে প্রচারের থেকে লোকাল ট্রেনে একসাথে অনেক মানুষকে পাওয়া যাবে, আবার বেশ অভিনব ব্যাপার ও হবে, তাই মিডিয়াও সুন্দর করে কভারেজ দেবে। সাথে আজ বিশেষ কেউ নেই, শুধু আড়ালে একজন ফটোগ্রাফার আছে, যে কিনা সুযোগ বুঝে ফটো তুলে নেবে...বাকি সব প্রচারের ছেলেটিই করবে যা করার। যারা এখনও ওনাকে চেনে না, তারাও চিনে যাবে আজ ই।
ট্রেন আসছে। হাতের লস্যির প্যাকেটে শেষ চুমুকটা দিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে ফেললেন অমিয়বাবু। বেড়ে বুদ্ধিটা দিয়েছে ছোকরা। প্রচার কে প্রচার, আবার উনি যে কত মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ, সেটাও বোঝা যাবে। নইলে ধর্ম, বর্ণ এসবের ভিত্তিতে ভোট আজকাল আর ভাগ হয় না। কম চেষ্টা তো আর করা হয়নি!
ভাবতে ভাবতেই ট্রেন এসে গেল। একটা জেনারেল কামরায় উঠে পড়লেন অমিয় বাবু। এবার আলাপ জমাবেন সবার সাথে। বুঝিয়ে দেবেন, উনি কত ভাল, যোগ্য।
ট্রেনে উঠে অভ্যাস মতো একটু দেঁতো হাসি দিলেন অমিয়বাবু। হাসি হাসি মুখে ফটো ভাল আসে! আর ওনাকে পইপই করে বলা হয়েছে কোনও বয়স্ক মানুষ, বা বাচ্চাদের সাথে ভাল করে কথা বলতে, যাতে সেই ছবি তোলা যায়। কিন্তু...এই কামরায় তো সেরকম কাউকে...
ভাবতে ভাবতে চোখ ঘুরিয়ে দেখেন একজন ভদ্রলোক বসে আছেন একটি সিটের তৃতীয় আসনে। হাতে একটা টুকরি। অনেকটা কালিঘাট বা দক্ষিনেশ্বরে পুজো দিলে যেরকম টুকরিতে প্রসাদ পাওয়া যায়, সেরকম। এই তো ভাল ছবি! ওনার কাছ থেকে প্রসাদ চেয়ে নিতে হবে, আর সেই ছবি উঠবে।
কয়েকজনকে টপকে সেইদিকে চলে এলেন অমিয় বাবু। এবার আবার মুখ হাসি হাসি করার পালা।
কিন্তু এ কি! এই লোক আগে থেকেই টুকরিটা খুলছে কেন? কিভাবে জানতে পারল যে উনি প্রসাদ চাইতেই যাচ্ছেন?
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন অমিয় বাবু...হঠাৎ দেখলেন ভদ্রলোক টুকরি থেকে কয়েকটা মিষ্টি বের করে ওনার সামনে বসা দুটো বাচ্চাকে দিলেন...যাঁরা "ক্ষিধে পেয়েছে...ও আব্বু ক্ষিধে পেয়েছে..." বলে একটানা ঘ্যানঘেনে সুরে কাঁদছিল অনেকক্ষণ ধরে...আর, মলিন পোষাক পরা আব্বু বলছিলেন "চুপ যাও বা'জান! বাড়ি গিয়ে খাবা!" স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, কিছু কিনে দেবার পরসা নেই ওঁর কাছে। আর তাই, সামনের ভদ্রলোক মিষ্টি বাড়িয়ে দিলেন ওদের দিকে। আহা, এর পর জল খেয়ে পেটটা একটু ঠান্ডা হবে বাছাদের...। কিন্তু...চলন্ত ট্রেনে জল ই বা কোথায়...
বারবার করে পার্টির সবাই বলে দিয়েছে হাসি মুখে থাকতে, তাও যে কেন চোখ ঝাপসা হয়ে যায় ছাই! কেন যে গলার কাছটা ভারি হয়ে আসে...
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে অমিয় বাবু। তারপর পাঞ্জাবির পকেটে রাখা ছোট্ট জলের বোতল বের করে ওদের হাতে দিলেন।
বাচ্চা দুটো গোগ্রাসে মিষ্টি খাচ্ছে তখন।
বোতল দেখে ওঁর দিকে একবার তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।
আহা, কী ক্ষুধার আর্তি ভরা চোখ!
না জানি কত তৃষ্ণা জমে আছে ওই ছোট্ট বুকদুটিতে!
অবিকল যেন ওঁর নিজের মুখ... যখন দুবেলা ভাত খাওয়াই ছিল বড় লড়াই।
আর এই পোড়া দেশে তো খাবারের জন্য, জলের জন্যও...খুন করা যায় নির্বিচারে...
কী যে হলো অমিয়বাবুর...হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন ওদের সামনে। বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলেন "আজ বুঝেছি বাবারা...পেটের আগুনের চেয়ে বড় ধর্ম আর কিচ্ছু নেই। আর কিচ্ছু লাগবে না...দুটো খেয়ে - পরে বাঁচুক সবাই...আর কিচ্ছু না... অনেক দেরিতে মনে পড়ল সব আবার, বা'জানেরা...ক্ষমা করে দে আমাকে..."
অন্য কোনো দিকে চোখ ছিল না অমিয়বাবুর... থাকলে দেখতে পারতেন কামরার সবাই ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছে...আর তাদের দৃষ্টি দিয়ে ঝরে পড়ছে একজন ভালো মানুষকে কাছে পাবার আনন্দ...