19-03-2021, 08:03 PM
চিৎকার চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো , নারী কন্ঠের চিৎকার । কয়েক সেকেন্ড এর জন্য জেনো আমি চলন শক্তি হারিয়ে ফেললাম । কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না, চারিদিকে তাকালাম এখনো সকালের আলো ফোটেনি তবে
“ নানাজান এমন কইরো না তোমার পাও দুইটা ধরি” আমি ঝুমার গলার অয়ায়াজ শুনতে পেলাম ।
আমার হুস ফিরে এলো , তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম আমি । দ্রুত পাশের ঘরের দিকে গেলাম । দেখলয়াম দরজা বন্ধ আর জালাল বাইরে দারানো । কি হচ্ছে এখানে , ঝুমা কোথায় ? আর জালাল ই বা কেনো দরজার বাইরে ? ভেতরে কে ? এই মাত্র ঝুমা নানাজান বল্লো , এর মানে কি? তাহলে কি ঝুমা ঘরের ভেতর ? সাথে কি আজমল চাচা ?
আজমল চাচা অনিলার ঘরে দরজা বন্ধ করে কি করছে ? আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো । মনে হলো আমি এখনি অজ্ঞান হয়ে যাবো । তারপর হঠাত করেই আমার শরীরে জেনো অসুর এর শক্তি চলে এলো । আমি দ্রুত পায়ের দরজার সামনে গেলাম । জালাল আমাকে দেখে সরে দাঁড়ালো , বলল “ বড় আব্বা মা আর অনিলা আনটি রে মারতাসে “ জালাল এর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ।
পুরনো দিনের দরজা কয়েকটা লাথি পরতেই হাট করে খুলে গেলো । ভেতরে যা দেখলাম সেটা দেখে আমার মাথায় খুন চড়ে গেলো । আজমল অনিলাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখছে । দেখে মনে হলো ওরা এতক্ষণ ধস্তা ধস্তি করছিলো । আর ঝুমা হাট পা বাধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে । দরজা খোলার শব্দে ওরা সবাই থমকে গেছে । ঘরের ভেতর ঢুকে এমন একটা দৃশ্য দেখবো সেটা আমি চিন্তা করিনি । আমি ভাবছিলাম আজমল অনিলাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে বা এমন কিছু । কিন্তু রেপ !!!!! না না এমন কিছু আমার মাথায় আসেনি ।
আজমল প্রথম হুস ফিরে পেলো , সাথে সাথে ও অনিলাকে ছেড়ে আমার দিকে তেড়ে এলো , হাতে একটা মোটা চলা কাঠ । এসেই আমার মাথার উপর বসিয়ে দিলো ঐ চলা কাঠ । চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এলো আমার । আমি অনেক চেষ্টা করেও নিজের চোখ দুটো খোলা রাখতে পারলাম না । জ্ঞান হারানোর আগে বার বার মনে হচ্ছিলো অনিলার কি হবে ? আমার অনিলার কি হবে ?
জ্ঞান ফিরে পেলাম যখন তখন আমি একটা পরিপাটি করে সাজানো ঘরে , জানালার সাদা পর্দা গুলি বাতাসে উড়ছে , হালকা রোদ সেই জানালা দিয়ে এসে পড়ছে ঘরের মেঝেতে । আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম , সাথে সাথে চোখের সামনে তাঁরা দেখতে লাগলাম , মনে হলো আমি আবার অজ্ঞান হয়ে যাবো । এমন সময় কেউ একজন দ্রুত আমাকে ধরে ফেলল , তারপর কি জেনো বলল , নারী কণ্ঠ বুঝতে পারলেও কি বলল বুঝতে পারলাম না , আমি আবার জ্ঞান হারালাম ।
দ্বিতীয় বার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি কয়েকজন ডাক্তার আর নার্স দেখতে পেলাম । ওরা নিজেদের মাঝে কথা বলছে । হঠাত আমার মনে পরলো অনিলার কথা , আমি দ্রুত আসে পাশে তাকালাম , একজন নার্স দৌরে এলো , বলল “ আপনি উথবেন না , অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে আপনার , আবার অজ্ঞান হয়ে যাবেন “
কিন্তু আমি নার্স এর কথা সুনালাম না , বার বার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম , পরিচিত কেউ আছে কিনা , কাকে জিজ্ঞাস করা যায় অনিলার কি হয়েছিলো । কিন্তু কাউকে দেখলাম না রুমে দুজন ডাক্তার আর দুজন নার্স ছাড়া ।
“ আচ্ছা এখানে আমাকে নিয়ে এসেছে কে । তাদের ডাকুন প্লিজ “ আমি নার্স কে অনুরধ করলাম ।
“ আপনি শান্ত হন আমি ডেকে দিচ্ছি “ নার্স আমাকে বলল । এর পর একটা ইনজেকশন আমার হাতে পুস করে দিলো । আমার চোখের সামনে আবার অন্ধকার হয়ে এলো ।
তৃতীয়বার যখন জ্ঞান ফিরলো ,আমার সামনে করিম দাড়িয়ে । মুখে হাঁসি ওর , আমি ছটফট করে উঠলাম , সাথে সাথে একজন নার্স এসে আমাকে ধরে ফেলল ।
“ অনিলার কিচ্ছু হয় নাই , তুই চিন্তা করিস না “ করিম আমার একটা হাট চেপে ধরে বলল ।
করিম এর কথা আমার বিশ্বাস হলো না , আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম , ঝুমা হাত পা বাধা ছিলো , নিশ্চয়ই আজমল ... আমার মাথা ব্যাথায় টনটনিয়ে উঠলো । আমি আর ভাবতে পারলাম না , এ আমি কি করলাম , নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ আমি অন্ধকার করে দিলাম । এই বয়সি একটা মেয়ে কি আর সারা জীবন এই নারকীয় ঘটনা ভুলতে পারবে ।
“ করিম সত্য করে বল , ঐদিন আজমল কি করেছিলো , অনিলা কই , আর আজমল কই “ আমি করিম এর হাত শক্ত করে ধরে বললাম ।
“ আমি একটা কথাও মিথ্যা কইতাসিনা , আমি আগেই সন্দেহ করসিলাম আজমল কিছু একটা করবো হের লইগা আমার লোক আসিলো ঐ বাড়ির আসে পাশে , ওরা সব থামাইসে , তারপর আমারে খবর দিসে , অনিলা ওর মায়ের কাসে আছে , আর আজমল পুলিশ এর কাছে “
“ তুই যদি আগেই বুঝতে পেরছিলিস তাহলে আমাকে বলিস নি কেনো “ আমি করিম এর দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালাম ।
“ ভুলটা মনে হয় আমার ই হইসিলো রে , আমি শিওর হইতে চাইসিলাম , আমি ঐ নৌকার মাঝিরে খুজতে চাইসিলাম আগে , তারপর তোরে জানাইতে চাইসিলাম , আজমল যে ঐ রাইতেই এমন কিসু করবো আমি বুঝিনাই ,” করিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ।
“ আমি আজমল কে খুন করবো “ এই বলে আমি চেচিয়ে উঠলাম
সাথে সাথে নার্স আমাকে চুপ থাকতে বল্লো , কিন্তু আমি চুপ করলাম না , বারবার চেচিয়ে উঠতে লাগলাম , তাই নার্স আমাকে আবারো ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো । আমি বিড়বিড় করে আজমল কে খুন করার প্রতিজ্ঞা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম ।
ত্রিশ বছর পর ঃ
সুইজারলেন্ড এর একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল হোম কাম ওল্ড হোম । এক লক্ষ ডলার এর বিনিময়ে এর আমার বাকি জীবন এর দায়িত্ব নিয়েছে । প্রায় বছর পাঁচেক যাবত আছি এখানে আমি । অন্ত্রে ক্যানসার ধরা পড়েছে আমার হয়ত আর মাস ছয়েক এর মতো আছি এই দুনিয়ায় ।
এই একা একা আত্মীয় পরিজন ছাড়া দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে , মনে হলেই কান্না পায় । মাঝে মাঝে মনে হয় এমনটা কি চেয়েছিলাম আমি? কিন্তু আজ যা হচ্ছে তা হয়ত আমারি কর্ম ফল । যৌবনে অনিয়ন্ত্রিত জীবন জাপন আজ আমাকে এখানে এনে ফেলেছে । এখন আমার বাবার কথা প্রায় মনে পড়ে , উনিও এক ছেলে থাকা সত্ত্বেও এমনি এক ওল্ড হোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন । নিজের শেকড় এর প্রতি, আসে পাশের মানুষ গুলির প্রতি উনিও ছিলেন উদাসীন ।
আমার স্ত্রী ছিলো , সন্তান ছিলো , কিন্তু আমি সেই মানুষ গুলিকে সেই সম্পর্ক গুলি কে যথাযথ মর্যাদা দেইনি । তাই সময় আমাকে যথাযথ প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছে । হ্যাঁ আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়া হয়েছিলো , কিন্তু আমি সেটাও কাজে লাগাতে পারিনি । নতুন করে নিজের মানুষ গুলিকে আপন করে নেয়ার একটা সুযোগ আমাকে দেয়া হয়েছিলো ।
যখন আমি ত্রিশ বছর আগে সফিপুর গিয়েছিলাম , এমনকি আমার একটি অজানা অতীত কে আমার চোখের সামনে নিয়ে এসেছিলো নতুন করে । কিন্তু আমি আমার সেই নতুন অতিতকে আমার ভবিষ্যৎ এর সাথে জুড়তে পারিনি বলে আজ আমাকে সেই পুরনো ভবিষ্যৎ নিয়েও শেষ এর প্রহর গুনতে হচ্ছে । অনুভিতির ভুল ব্যাখ্যা আমাকে সেই নতুন করে আবিস্কার করা অতীত কে তখনকার বর্তমান এর সাথে মিলিয়ে এক নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে দেয়নি ।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয় , তখন যদি আমি বুঝতে পারতাম ? তাহলে আজ কি হতে পারত ।
হসপিটালে যখন আমি একটু সুস্থ হয়ে উথেছিলাম তখন লিজা এসেছিলো আমার কাছে । ওর কাছে জানতে পেরেছিলাম , অনিলা প্রচণ্ড মানসিক শক পেয়েছে । ওকে একজন মনো চিকিৎসক এর অধিনে নিয়মিত চিকিৎসা করা হচ্ছে । চিকিৎসক আশ্বাস দিয়েছেন , যদি ঐ ঘটনার সাথে জরিত কারো সাথে অনিলার দেখা না হয় তবে অনিলা ধিরে ধিরে হয়ত সেই ঘটনা ভুলে যাবে ।
যাওয়ার সময় লিজা আমার হাত ধরে বলেছিলো “ জামিল তুমি যখন ছিলে না , অনিলার একটুও সমস্যা হয়নি , বিশ্বাস করো , তুমি কি চাও না অনিলা সুস্থ জীবন জাপন করুক , যদি চাও , তাহলে মেয়ের সাথে আর যোগাযোগ করো না “
ইচ্ছা হচ্ছিলো কিছু বলি , কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না । এমন কি অনিলার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত করা হয়নি , অনলার সামাজিক যোগাযোগ মাদ্ধম এর প্লাটফর্ম গুলতেও আমি নেই । তবে খোঁজ পাই আমি , জতদিন লিজা বেঁচে ছিলো ততদিন লিজাই খোঁজ দিতো । এখন খোঁজ দেয় করিম এর বড় ছেলে । ছেলটা বাবার মতো হয়েছে , পর উপকারি । অনিলার বয়স এখন ৪৬ একটা নারী সংগঠন চালায় । দুইবার বিয়ে করেছিলো একটাও টেকেনি। এক ছেলে আছে । এখন কলেজ এ পড়ে । মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভেবে মাঝে মাঝে মনটা খারাপ হয়ে যায় । যখন বয়স হবে তখন কি আমার মতো একেকি হয়ে যাবে ? এই চিন্তা মাঝে মাঝে মনে উদয় হয় । মিয়াঁ বাড়ির প্রতি অনিলার কোন আগ্রহ নেই , এমন কি সম্পদ ও নেয়নি । কোনদিন সফিপুর গ্রামে ও যায়নি ও ।
ভাবছেন মিয়াঁ বাড়ির কি হলো তাহলে ? হ্যাঁ মিয়াঁ বাড়ি আছে , শেষ বার আমি যেমন দেখে এসেছিলাম তার চেয়ে বহুগুন ভালো অবস্থায় আছে । বাড়ি কত্রী আছে একজন , ছেলে ছেলের বউ আর নাতি নাতনী নিয়ে সুখেই জীবন জাপন করছে এখন । গ্রামের লোক অবশ্য তাদের তেমন পছন্দ করে না । গ্রামের লোকদের অভিযোগ হচ্ছে এরা মিয়াঁ বাড়ির চাকর সুযোগে মিয়াঁ বাড়ির সম্পদ দখন করে নিয়েছে। তবে গ্রামবাসীর অপবাদে বর্তমান মিয়াঁ বাড়ির বাসিন্দাদের কিছু আসে যায় না । এরা নীরবে সফিপুর গ্রাম বাসির সেবা করে যাচ্ছে ।
মিয়াঁ বাড়ির সম্পদ এর উপার্জন থেকে গ্রামে আধুনিক হসপিটাল আর কলেজ চলছে একটা । এছাড়া রয়েছে অসহায় দুস্তদের সাহায্য করার জন্য একটি ট্রাস্ট যেখান থেকে বিনা সুদে ঋণ দেয়া হয় ।
অনেকেই জিজ্ঞাস করে আমি কেনো মিয়াঁ বাড়ি থেকে গেলাম না । ওখানে থেকে গেলেই তো পারতাম । এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না সুধু মুচকি হাঁসি । আসল ঘটনা সুধু আমি আর করিম জানি । এখন করিম এই দুনিয়ায় নেই তাই সুধু আমি জানি । আর কিছুদিন পর ঐ ঘটনা আমার সাথে দুনিয়া থেকে চিরতরে মুছে যাবে ।
হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি গিয়েছিলাম , আজমল নামক সেই বিষাক্ত সাপের সাথে দেখা করতে । আমার খুব জানার ইচ্ছা ছিলো কেনো ও এমন করেছিলো , আমি কি ক্ষতি করেছিলাম ওর ।
“ নানাজান এমন কইরো না তোমার পাও দুইটা ধরি” আমি ঝুমার গলার অয়ায়াজ শুনতে পেলাম ।
আমার হুস ফিরে এলো , তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম আমি । দ্রুত পাশের ঘরের দিকে গেলাম । দেখলয়াম দরজা বন্ধ আর জালাল বাইরে দারানো । কি হচ্ছে এখানে , ঝুমা কোথায় ? আর জালাল ই বা কেনো দরজার বাইরে ? ভেতরে কে ? এই মাত্র ঝুমা নানাজান বল্লো , এর মানে কি? তাহলে কি ঝুমা ঘরের ভেতর ? সাথে কি আজমল চাচা ?
আজমল চাচা অনিলার ঘরে দরজা বন্ধ করে কি করছে ? আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো । মনে হলো আমি এখনি অজ্ঞান হয়ে যাবো । তারপর হঠাত করেই আমার শরীরে জেনো অসুর এর শক্তি চলে এলো । আমি দ্রুত পায়ের দরজার সামনে গেলাম । জালাল আমাকে দেখে সরে দাঁড়ালো , বলল “ বড় আব্বা মা আর অনিলা আনটি রে মারতাসে “ জালাল এর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ।
পুরনো দিনের দরজা কয়েকটা লাথি পরতেই হাট করে খুলে গেলো । ভেতরে যা দেখলাম সেটা দেখে আমার মাথায় খুন চড়ে গেলো । আজমল অনিলাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখছে । দেখে মনে হলো ওরা এতক্ষণ ধস্তা ধস্তি করছিলো । আর ঝুমা হাট পা বাধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে । দরজা খোলার শব্দে ওরা সবাই থমকে গেছে । ঘরের ভেতর ঢুকে এমন একটা দৃশ্য দেখবো সেটা আমি চিন্তা করিনি । আমি ভাবছিলাম আজমল অনিলাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে বা এমন কিছু । কিন্তু রেপ !!!!! না না এমন কিছু আমার মাথায় আসেনি ।
আজমল প্রথম হুস ফিরে পেলো , সাথে সাথে ও অনিলাকে ছেড়ে আমার দিকে তেড়ে এলো , হাতে একটা মোটা চলা কাঠ । এসেই আমার মাথার উপর বসিয়ে দিলো ঐ চলা কাঠ । চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এলো আমার । আমি অনেক চেষ্টা করেও নিজের চোখ দুটো খোলা রাখতে পারলাম না । জ্ঞান হারানোর আগে বার বার মনে হচ্ছিলো অনিলার কি হবে ? আমার অনিলার কি হবে ?
জ্ঞান ফিরে পেলাম যখন তখন আমি একটা পরিপাটি করে সাজানো ঘরে , জানালার সাদা পর্দা গুলি বাতাসে উড়ছে , হালকা রোদ সেই জানালা দিয়ে এসে পড়ছে ঘরের মেঝেতে । আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম , সাথে সাথে চোখের সামনে তাঁরা দেখতে লাগলাম , মনে হলো আমি আবার অজ্ঞান হয়ে যাবো । এমন সময় কেউ একজন দ্রুত আমাকে ধরে ফেলল , তারপর কি জেনো বলল , নারী কণ্ঠ বুঝতে পারলেও কি বলল বুঝতে পারলাম না , আমি আবার জ্ঞান হারালাম ।
দ্বিতীয় বার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি কয়েকজন ডাক্তার আর নার্স দেখতে পেলাম । ওরা নিজেদের মাঝে কথা বলছে । হঠাত আমার মনে পরলো অনিলার কথা , আমি দ্রুত আসে পাশে তাকালাম , একজন নার্স দৌরে এলো , বলল “ আপনি উথবেন না , অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে আপনার , আবার অজ্ঞান হয়ে যাবেন “
কিন্তু আমি নার্স এর কথা সুনালাম না , বার বার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম , পরিচিত কেউ আছে কিনা , কাকে জিজ্ঞাস করা যায় অনিলার কি হয়েছিলো । কিন্তু কাউকে দেখলাম না রুমে দুজন ডাক্তার আর দুজন নার্স ছাড়া ।
“ আচ্ছা এখানে আমাকে নিয়ে এসেছে কে । তাদের ডাকুন প্লিজ “ আমি নার্স কে অনুরধ করলাম ।
“ আপনি শান্ত হন আমি ডেকে দিচ্ছি “ নার্স আমাকে বলল । এর পর একটা ইনজেকশন আমার হাতে পুস করে দিলো । আমার চোখের সামনে আবার অন্ধকার হয়ে এলো ।
তৃতীয়বার যখন জ্ঞান ফিরলো ,আমার সামনে করিম দাড়িয়ে । মুখে হাঁসি ওর , আমি ছটফট করে উঠলাম , সাথে সাথে একজন নার্স এসে আমাকে ধরে ফেলল ।
“ অনিলার কিচ্ছু হয় নাই , তুই চিন্তা করিস না “ করিম আমার একটা হাট চেপে ধরে বলল ।
করিম এর কথা আমার বিশ্বাস হলো না , আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম , ঝুমা হাত পা বাধা ছিলো , নিশ্চয়ই আজমল ... আমার মাথা ব্যাথায় টনটনিয়ে উঠলো । আমি আর ভাবতে পারলাম না , এ আমি কি করলাম , নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ আমি অন্ধকার করে দিলাম । এই বয়সি একটা মেয়ে কি আর সারা জীবন এই নারকীয় ঘটনা ভুলতে পারবে ।
“ করিম সত্য করে বল , ঐদিন আজমল কি করেছিলো , অনিলা কই , আর আজমল কই “ আমি করিম এর হাত শক্ত করে ধরে বললাম ।
“ আমি একটা কথাও মিথ্যা কইতাসিনা , আমি আগেই সন্দেহ করসিলাম আজমল কিছু একটা করবো হের লইগা আমার লোক আসিলো ঐ বাড়ির আসে পাশে , ওরা সব থামাইসে , তারপর আমারে খবর দিসে , অনিলা ওর মায়ের কাসে আছে , আর আজমল পুলিশ এর কাছে “
“ তুই যদি আগেই বুঝতে পেরছিলিস তাহলে আমাকে বলিস নি কেনো “ আমি করিম এর দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালাম ।
“ ভুলটা মনে হয় আমার ই হইসিলো রে , আমি শিওর হইতে চাইসিলাম , আমি ঐ নৌকার মাঝিরে খুজতে চাইসিলাম আগে , তারপর তোরে জানাইতে চাইসিলাম , আজমল যে ঐ রাইতেই এমন কিসু করবো আমি বুঝিনাই ,” করিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ।
“ আমি আজমল কে খুন করবো “ এই বলে আমি চেচিয়ে উঠলাম
সাথে সাথে নার্স আমাকে চুপ থাকতে বল্লো , কিন্তু আমি চুপ করলাম না , বারবার চেচিয়ে উঠতে লাগলাম , তাই নার্স আমাকে আবারো ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো । আমি বিড়বিড় করে আজমল কে খুন করার প্রতিজ্ঞা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম ।
ত্রিশ বছর পর ঃ
সুইজারলেন্ড এর একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল হোম কাম ওল্ড হোম । এক লক্ষ ডলার এর বিনিময়ে এর আমার বাকি জীবন এর দায়িত্ব নিয়েছে । প্রায় বছর পাঁচেক যাবত আছি এখানে আমি । অন্ত্রে ক্যানসার ধরা পড়েছে আমার হয়ত আর মাস ছয়েক এর মতো আছি এই দুনিয়ায় ।
এই একা একা আত্মীয় পরিজন ছাড়া দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে , মনে হলেই কান্না পায় । মাঝে মাঝে মনে হয় এমনটা কি চেয়েছিলাম আমি? কিন্তু আজ যা হচ্ছে তা হয়ত আমারি কর্ম ফল । যৌবনে অনিয়ন্ত্রিত জীবন জাপন আজ আমাকে এখানে এনে ফেলেছে । এখন আমার বাবার কথা প্রায় মনে পড়ে , উনিও এক ছেলে থাকা সত্ত্বেও এমনি এক ওল্ড হোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন । নিজের শেকড় এর প্রতি, আসে পাশের মানুষ গুলির প্রতি উনিও ছিলেন উদাসীন ।
আমার স্ত্রী ছিলো , সন্তান ছিলো , কিন্তু আমি সেই মানুষ গুলিকে সেই সম্পর্ক গুলি কে যথাযথ মর্যাদা দেইনি । তাই সময় আমাকে যথাযথ প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছে । হ্যাঁ আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়া হয়েছিলো , কিন্তু আমি সেটাও কাজে লাগাতে পারিনি । নতুন করে নিজের মানুষ গুলিকে আপন করে নেয়ার একটা সুযোগ আমাকে দেয়া হয়েছিলো ।
যখন আমি ত্রিশ বছর আগে সফিপুর গিয়েছিলাম , এমনকি আমার একটি অজানা অতীত কে আমার চোখের সামনে নিয়ে এসেছিলো নতুন করে । কিন্তু আমি আমার সেই নতুন অতিতকে আমার ভবিষ্যৎ এর সাথে জুড়তে পারিনি বলে আজ আমাকে সেই পুরনো ভবিষ্যৎ নিয়েও শেষ এর প্রহর গুনতে হচ্ছে । অনুভিতির ভুল ব্যাখ্যা আমাকে সেই নতুন করে আবিস্কার করা অতীত কে তখনকার বর্তমান এর সাথে মিলিয়ে এক নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে দেয়নি ।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয় , তখন যদি আমি বুঝতে পারতাম ? তাহলে আজ কি হতে পারত ।
হসপিটালে যখন আমি একটু সুস্থ হয়ে উথেছিলাম তখন লিজা এসেছিলো আমার কাছে । ওর কাছে জানতে পেরেছিলাম , অনিলা প্রচণ্ড মানসিক শক পেয়েছে । ওকে একজন মনো চিকিৎসক এর অধিনে নিয়মিত চিকিৎসা করা হচ্ছে । চিকিৎসক আশ্বাস দিয়েছেন , যদি ঐ ঘটনার সাথে জরিত কারো সাথে অনিলার দেখা না হয় তবে অনিলা ধিরে ধিরে হয়ত সেই ঘটনা ভুলে যাবে ।
যাওয়ার সময় লিজা আমার হাত ধরে বলেছিলো “ জামিল তুমি যখন ছিলে না , অনিলার একটুও সমস্যা হয়নি , বিশ্বাস করো , তুমি কি চাও না অনিলা সুস্থ জীবন জাপন করুক , যদি চাও , তাহলে মেয়ের সাথে আর যোগাযোগ করো না “
ইচ্ছা হচ্ছিলো কিছু বলি , কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না । এমন কি অনিলার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত করা হয়নি , অনলার সামাজিক যোগাযোগ মাদ্ধম এর প্লাটফর্ম গুলতেও আমি নেই । তবে খোঁজ পাই আমি , জতদিন লিজা বেঁচে ছিলো ততদিন লিজাই খোঁজ দিতো । এখন খোঁজ দেয় করিম এর বড় ছেলে । ছেলটা বাবার মতো হয়েছে , পর উপকারি । অনিলার বয়স এখন ৪৬ একটা নারী সংগঠন চালায় । দুইবার বিয়ে করেছিলো একটাও টেকেনি। এক ছেলে আছে । এখন কলেজ এ পড়ে । মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভেবে মাঝে মাঝে মনটা খারাপ হয়ে যায় । যখন বয়স হবে তখন কি আমার মতো একেকি হয়ে যাবে ? এই চিন্তা মাঝে মাঝে মনে উদয় হয় । মিয়াঁ বাড়ির প্রতি অনিলার কোন আগ্রহ নেই , এমন কি সম্পদ ও নেয়নি । কোনদিন সফিপুর গ্রামে ও যায়নি ও ।
ভাবছেন মিয়াঁ বাড়ির কি হলো তাহলে ? হ্যাঁ মিয়াঁ বাড়ি আছে , শেষ বার আমি যেমন দেখে এসেছিলাম তার চেয়ে বহুগুন ভালো অবস্থায় আছে । বাড়ি কত্রী আছে একজন , ছেলে ছেলের বউ আর নাতি নাতনী নিয়ে সুখেই জীবন জাপন করছে এখন । গ্রামের লোক অবশ্য তাদের তেমন পছন্দ করে না । গ্রামের লোকদের অভিযোগ হচ্ছে এরা মিয়াঁ বাড়ির চাকর সুযোগে মিয়াঁ বাড়ির সম্পদ দখন করে নিয়েছে। তবে গ্রামবাসীর অপবাদে বর্তমান মিয়াঁ বাড়ির বাসিন্দাদের কিছু আসে যায় না । এরা নীরবে সফিপুর গ্রাম বাসির সেবা করে যাচ্ছে ।
মিয়াঁ বাড়ির সম্পদ এর উপার্জন থেকে গ্রামে আধুনিক হসপিটাল আর কলেজ চলছে একটা । এছাড়া রয়েছে অসহায় দুস্তদের সাহায্য করার জন্য একটি ট্রাস্ট যেখান থেকে বিনা সুদে ঋণ দেয়া হয় ।
অনেকেই জিজ্ঞাস করে আমি কেনো মিয়াঁ বাড়ি থেকে গেলাম না । ওখানে থেকে গেলেই তো পারতাম । এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না সুধু মুচকি হাঁসি । আসল ঘটনা সুধু আমি আর করিম জানি । এখন করিম এই দুনিয়ায় নেই তাই সুধু আমি জানি । আর কিছুদিন পর ঐ ঘটনা আমার সাথে দুনিয়া থেকে চিরতরে মুছে যাবে ।
হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি গিয়েছিলাম , আজমল নামক সেই বিষাক্ত সাপের সাথে দেখা করতে । আমার খুব জানার ইচ্ছা ছিলো কেনো ও এমন করেছিলো , আমি কি ক্ষতি করেছিলাম ওর ।