07-03-2021, 02:54 PM
মিত্রার বাড়িতে এসে যখন পৌঁছলাম তখন রাত আটটা বেজে গেছে। গাড়ি একেবারে পর্টিকোর ভেতরে এসে দাঁড়াল। আমি গাড়ি থেকে নামতেই একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। চেনাচেনা মনে হলো। মিত্রার ওই বাড়িতে দেখেছি মনে হচ্ছে। বুড়ীমাসি?
আমাকে বললেন, মেমসাহেব ওপরের ঘরে আছেন, আপনাকে চলে যেতে বলেছেন।
আমি আটমাস আগে এই বাড়িতে এসেছিলাম। আজ আবার আটমাস পরে এলাম।
অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সব কিছু লক্ষ্য করলাম। ওপরে উঠে এলাম। মিত্রা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ওকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম।
মিত্রা একটা বাসন্তী কালারের সালোয়ার কামিজ পরেছে। দারুন লাগছে দেখতে, কলেজ লাইফের মিত্রা আর আমার বস মিত্রার মধ্যে অনেক পার্থক্য। তবু কোথায় যেন এক থেকে গেছে মিত্রা।
আয়।
আমি ওপরে উঠে এলাম। ওর পেছন পেছন গেলাম। একটা ঘরে আমাকে নিয়ে ঢুকলো। দেখলাম তিনজন ওখানে বসে আছেন। এদের মধ্যে মাত্র একজনকেই চিনতে পারলাম। আমাদের অফিসের এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মিঃ সনাতন ঘরুই।
উনি আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন। মুখে কিছু বললেন না। মিত্রা সকলের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল।
মিঃ ঘরুই বললেন, আমি ওনাকে চিনি, তবে বেশি কথা হয়নি কোনও দিন। তবে উনি যে আপনার এতোটা ক্লোজ জানতাম না।
মিত্রা বেশ গম্ভীর গলায় বললো, এর বেশি আর জানার চেষ্টা করবেন না।
মিত্রা বললো, বুবুন (আমার ডাক নাম, এই পৃথিবীতে এই নামে একমাত্র মিত্রাই ডাকে সেই কলেজ লাইফ থেকে, আর আমার মা ডাকতেন) ইনি মিঃ অরিন্দম চ্যাটার্জী, আর উনি মিঃ কিংশুক ব্যানার্জী।
সকলেই মিত্রার মুখে আমার নামটা শুনে একটু অবাক চোখে তাকাল। বিশেষ করে সনাতনবাবু। ওনার চোখ মুখ দেখে বুঝে ফেললাম উনি কিছু গেইজ করার চেষ্টা করছেন।
আমি বুকের ওপর হাত তুলে নমস্কার করলাম।
ওরাও প্রীতি নমস্কার জানালো।
আমি আজ এনাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলাম। তোকে সব বলছি, তুই সব শুনে নে, তারপর একটা ডিসিশন দে। তোর ডিসিশন আমার অনেক কাজে লাগবে।
সবাই আমার আর মিত্রার দিকে তাকাল।
মিত্রা একে একে অফিসের সমস্ত ঘটনা আমাকে বললো। আমি এতটা জানতাম না। কিছু কিছু জানতাম।
সব শোনার পর বুঝলাম, ও অনেককেই তারাবার বন্দোবস্ত করেছে। এমনকি তাদের চিঠিও সই সাবুদ হয়ে গেছে। বিশেষ করে যাদের সঙ্গে আজ দুপুর বেলায় আমার কথা কাটাকাটি হয়েছে তাদেরকেও। অমিতাভদা, মল্লিকদা যে জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই আছেন। মনে হচ্ছে আমার সঙ্গে কথা বলার পর তুরন্ত ডিসিশন চেঞ্জ করেছে।
আমি সব শুনে বললাম, এটা তুই নিজে থেকে ডিসিশন নিয়েছিস, না অন্য কারুর মতামত নিয়ে করেছিস?
মিত্রা বললো, অন্যের মতামত নিয়ে এতদিন কাজ করেছিলাম, এখন আমি আমার ডিসিশনে চলছি।
আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, তুই যা আগে করে ফেলেছিলি, এখন সেইরকম রাখ।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল!
চেঞ্জ করিস না।
কেন বলছিস বল?
অনেক সমস্যা তৈরি হবে।
মিত্রার চোখে মুখে হাসির রেখা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
বরং দুটো নতুন পদ ক্রিয়েট কর।
বল।
অমিতাভদার জায়গায় তুই সম্পাদক হয়ে যা।
আমি!
হ্যাঁ।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল।
খাতা কলমে।
অমিতাভদাকে প্রধান সম্পাদক কর, মল্লিকদাকে মুখ্য সম্পাদক বানিয়ে দে। আর বাকি সবাইকে যুগ্ম সম্পাদক বানিয়ে দে। তোর নামটা চেঞ্জ করে নে সম্পাদকের জায়গায়।
যাঃ তা হয় না।
না হবার কি আছে, তুই মালিক।
এই কাগজের একটা ঐতিহ্য আছে।
ওই কথাটা মাথায় রেখেই তোকে বলছি।
সম্ভব নয়।
এটা যদি করতে পারিস, তাহলে আর কারুর কিছু বলার থাকবে না। তবে তোর খরচ বারবে, দুটো নতুন ঘর তোকে বানাতে হবে।
সেটা এমন কোনও ব্যাপার নয়।
ঘরুইবাবুকে বলে দে কাল থেকে কাজ শুরু করে দিক।
ঘর কার কার জন্য।
সুনিতদা এখন যে ঘরে আছে সেই ঘরেই থাকুক।
একটা অমিতাভদার জন্য আর একটা মল্লিকদার জন্য। তবে ঘর দুটো তোকে নিউজ রুমের মধ্যে করতে হবে। আলাদা জায়গায় করলে হবে না।
কেন!
নিউজের ছেলেগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন কথা না বললে ওদের ভাত হজম হবে না। ওরা নিউজ খায়, নিউজ দিয়ে স্নান করে, ওদের জগৎটা সব কিছুই নিউজ ময়।
সবাই আমার কথায় হাসলো।
ঘরুইবাবু আমার কথা শুনে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, অনি ঠিক কথা বলেছে ম্যাডাম।
তাহলে আপনি এতদিন কি করছিলেন?
ওদের যা চাপ, তারপর সবাই আপনাকে ঘিরে থাকে সব সময়। বলবো কখন।
আমি ঘরুইবাবুর দিকে তাকালাম, মনে মনে বললাম, ঘরুই তুমি বহুত ঘোরেল মাল।
দিল্লী ব্যুরোকে জানিয়ে দে, তোর নামটা কাল পর্শুর মধ্যে চেঞ্জ করে পাঠিয়ে দিতে, কি ঘরুইবাবু হবে না?
নিশ্চই হবে।
আর এই কয়দিন যেমন চলছে তেমন চলুক। এরমধ্যে ঘরুইবাবু সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলুক।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
তুই কয়েকদিন অফিসে যাস না। মাথায় রাখিস, যে ঝড়টা উঠেছে সহজে থামবে না।
ঠিক আছে।
নিউজরুমের বুড়ো গুলোকে সামলাবার দায়িত্ব আমি নেব, ওটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।
আবার সবাই হাসলো।
আপনি ভালো কথা বলেছেন। যত সমস্যা ওই এডিটর পদটাকে নিয়ে। অরিন্দমবাবু বললেন।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল।
আমি ঘরুইবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ঘরুইবাবু অফিসে আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ একটা কথা হয় না। কিন্তু আপনি আমার সম্বন্ধে অনেক খোঁজ খবর রাখেন।
ঘরুইবাবু আমার মুখের দিকে বিষ্ময় চোখে তাকালেন।
আপনার স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে মিত্রা যতটা না জানে, তার থেকে আমি অনেক বেশি জানি। শুধু এইটুকু ব্যাপার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।
ঘরুইবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। উনি ভাবতে পারেন নি এই ঘরে মিত্রার সামনে ওনাকে আমি এই ধরনের কথা বলতে পারি।
এ আপনি কি বলছেন অনিবাবু!
আপনি নিশ্চই জানেন, আমি কতোদূর দৌড়তে পারি।
হ্যাঁ হ্যাঁ তা কি বলতে।
দুপুরে একঘর ভর্তি লোকের সামনে আমি মিত্রাকে কি বলেছিলাম সেটা নিশ্চই শুনেছিলেন। ওটা এমনি এমনি বলা যায় না। কলজের দম থাকতে হয়।
ঘরুইবাবু আমার মুখের দিকে ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছেন।
ওনাদের আমি চিনি না, (সামনে বসা দুজন নতুন ব্যক্তিকে দেখিয়ে) তাই এই মুহূর্তে কিছু বলছি না। (হাতজোড় করে) তবে আপনাদেরও জানাই মিত্রা আমার কলজের বন্ধু, শুধু বন্ধু নয় বিয়ের আগে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। ওর বাবা-মা সকলেই আমার বিশেষ পরিচিত। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। মিত্রার কোনও ক্ষতি হবে এটা আমি মেনে নেব না। ও আপনাদের যে দায়িত্ব দিচ্ছে। তা ঠিক ঠিক ভাবে পালন করবেন। আর এই মুহূর্তে যা বললাম তা যেন পাঁচকান না হয়।
মিত্রা চুপচাপ বসেছিল। ওরা আমার কথা শোনার পর কেউ আর কোনও কথা বললো না।
মিত্রা যখন আপনাদের এখানে ডেকে এনেছেন, সঙ্গে আমাকে, তখন আমি বুঝে নেব আপনারা ব্যবসায়িক দিক থেকে মিত্রার খুব কাছের লোকই হবেন।
সকলেই আমার মুখের দিকে তাকাল।
মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম, ওনাদের পার্পাশটা আমাকে একটু বলবি?
চম্পকবাবুকে আমি রাখব না ভেবেছিলাম।
কেন?
ওনার চালচলন আমার ভালো লাগছে না। ওনার জায়গায় অরিন্দমবাবুকে নিয়ে এলাম।
এ ভুলটা করিস না। চম্পকদা থাকুক। চম্পকদার ওপরে ওনাকে বসা।
অরিন্দমবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার একটু অসুবিধে হবে কাজ করতে।
কি কারনে বলছেন?
সাবতাজ হতে পারে।
আপনি যখন এতটাই জানেন, তখন এই টুকু নিশ্চই বুঝতে পারছেন। কেন বলছি।
অরিন্দমবাবু চুপচাপ।
অরিন্দমবাবু আপনি আগে কোথায় ছিলেন?
একটা সর্বভারতীয় ইংরাজী দৈনিকের কথা বললেন।
মিত্রার সঙ্গে আপনার পরিচয়?
মিত্রা বললো, আমার ক্লাবের মিঃ রায় ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ছেন।
আপনাদের ওখানে মৈনাক আছে না।
অরিন্দমবাবুর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
মিত্রা বললো, কে মৈনাক?
আমাদের সঙ্গে ইংরাজী ডিপার্টমেন্টে পড়তো।
ফর্সামতো ছেলেটা। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা।
হ্যাঁ।
তোর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে!
ভাইজ্যাক যাওয়ার দু-চারদিন আগে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
অরিন্দমবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, চম্পকদাকে এখন সরানো যাবে না। আপনি নিজে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন।
অরিন্দমবাবু চুপচাপ বসে রইলেন।
মিত্রার দিকে তকিয়ে বললাম, কিংশুকবাবু।
ওনাকে আমি ম্যানেজমেন্ট দেখার জন্য অনুরোধ করেছি।
ভালো।
তবে তুই একটা কাজ কর, দায়িত্বটা সকলকে ভাগা ভাগি করে দে।
তোর মতামতটা বল।
আজ হবে না। দাদা কি এখানে আছেন?
সবাই আমার মুখের দিকে তাকাল।
না। মুম্বাই গেছে।
কবে আসবেন?
দু-একদিন দেরি হবে।
দাদাকে আসতে দে। দাদার সঙ্গে একবার আলোচনা করার দরকার আছে।
ঠিক আছে।
মিত্রা ওদের দিকে তাকিয়ে বললো যে ভাবে বুবুন বললো, ওই ভাবে কাল থেকে কাজ শুরু করে দিন। কিংশুকবাবু আর অরিন্দমবাবুর দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাদের ঘরটা রেডি হোক তারপর অফিসে আসবেন। আপনারা আপনাদের মতো কাজ শুরু করে দিন। ঘরুইবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা যা ডিসিশন হলো সেই মতো কাজ শুরু করুণ। আগামী সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলার চেষ্টা করুণ।
ঘরুইবাবু একটু আমতা আমতা করে বললেন, আর কয়েকটা দিন আমাকে সময় দিন।
ঠিক আছে তাই হোক।
সুনিতবাবু যদি কিছু বলেন?
সুনিতবাবু কিছু বললে পাত্তা দেবার দরকার নেই। বাকিটা কি করে কি করতে হয়, আপনাক নিশ্চই বুঝিয়ে বলার দরকার নেই?
ঘরুইবাবু মাথা নিচু করে বললেন, না ম্যাডাম আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।
সবাই বিদায় নিল।
মিত্রা ওদের নিচে ছেড়ে দিয়ে এসে বললো, কি খাবি?
বেলা করে বড়োমা অনেক খাইয়েছে, আর খেতে ভালোলাগছে না।
তাহলে আমিও খাব না।
সেকিরে! ঠিক আছে খাব, অল্প করে।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
দুজনে নিচে এলাম। বুড়ীমাসিকে দেখতে পেলাম না। বরং আর একটি মেয়েকে দেখলাম। ডাইনিং টেবিলে সব সাজান। মিত্রা আমি দুজনে বসলাম। খেতেখেতে কলেজ লাইফের ছেঁড়াছেঁড়া কিছু কথা ছাড়া শুধু জিজ্ঞাসা করলাম মাসিমা-মেসোমশাই কেমন আছেন।
মিত্রা একটু গম্ভীর হয়ে গেল, আস্তে করে বললো, দু-জনেই গত। তারপর থেকে সব হরির লুটের মতো চলছে।
একটু থেমে অভিমানভরা কণ্ঠে বলে উঠলো, তুই তো আমার কোনও খোঁজ খবর রাখিস না। তোকে বলেই বা আর কি হবে।
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। কোনও কথা বললাম না। মিত্রা মিত্রার মতো কিছুক্ষণ বকে গেল। খাওয়া শেষ করে দুজনেই ওপরে উঠে এলাম।
মিত্রাদের বাড়িটা বিরাট জায়গা নিয়ে। সামনে বিশাল বাগান। গেটের ঠিক মুখে এই বাড়ির কাজের লোকেদের থাকার জায়গা। এই মুহূর্তে তাদের ঘরের লাইট নিভে গেছে। বাগানের রাস্তাটায় তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি বারান্দার রেলিংয়ে কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালাম।
কলকাতা শহরের মতো জায়গায় এই রাতেও ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ভারি ভালোলাগছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। বাগান পেরিয়ে বড় রাস্তা। নিওন আলোয় চকচক করছে রাস্তাটা। কিছুক্ষণ আগে একজন কাজের মেয়ে এসে আমার ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে গেছে। বিছানাপত্র সব ঠিক ঠাক করে দিয়ে গেছে।
ঘুম আসছে না। সকাল থেকে ভীষণ ধকল গেল। মিত্রা মাঝে একবার নিজে থেকে অমিতাভদাকে ফোন করে সব জানিয়েছে। অমিতাভদা রাজি হয়েছে। বড়োমার সঙ্গে আমার ফোনে সামান্য কথা হয়েছে। বলেছি কাল গিয়ে সব বলবো।