07-03-2021, 02:52 PM
সমীরণদা কলকাতারই একটা অন্য কাগজের এয়ারপোর্ট সংবাদদাতা। আমাকে দেখে বললো, কোথায় ছিলে বাপ, ক-দিন দেখা সাক্ষাত নেই। একবারে ফুরুত।
বললাম, কোথায় গেছিলাম।
একটু অবাক হয়ে বললো, করেছিস কি, সম্পূর্ণটা তুই একলা করেছিস!
হ্যাঁ।
চল একটু ক্যান্টিনে যাই কফি খাব। তোর কোনও তড়াহুরো নেই তো?
এই তো সবে কলকাতায় নামলাম।
সমীরণদা হাসল। আমি তোর সমস্ত নিউজগুলো পড়েছি। দারুন লিখেছিস। তোর স্পেকুলেসন সব মিলে গেছে।
হ্যাঁ, আজকে রেজাল্ট। আমি তো সকালের ফ্লাইটে বেরিয়েছিলাম, দিল্লী হয়ে আসছি। সকাল থেকে কাগজটা দেখা হয়নি।
তাই!
সমীরণদা ব্যাগ থেকে ওদের হাউসের কাগজ আর আমাদের হাউসের কাগজটা বার করলো। আমি ওপর ওপর একবার চোখ বোলালাম। কফি আর চিকেন পকোরা এলো। সকাল থেকে কিছু পেটে পড়েনি। খিদেও লেগেছিল। কয়েকটা চিকেন পাকোরা গলধোকরণ করে, কফি মুখে দিলাম। অমৃতের মতো লাগলো। সমীরণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কলকাতার হাল হকিকত বলো।
যেমন ছিল তেমনি আছে।
তাপস এলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
তুমি এখানে? তাপস আমাদের হাউসের একজন গাড়ির ড্রাইভার।
হ্যাঁ।
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলাম।
কেনো! তুই আসবি আমাকে কেউ বলে নি।
আমার কি আসার ঠিক ছিল। এই তো ঘণ্টা খানেক আগে বললো।
ও। কেন কি হয়েছে?
তোমাকে অফিসে ফেলেই, আবার রাইটার্সে দৌড়তে হবে।
আমি এখন অফিসে যাব না।
যা বাবা! সুনিতদা বললো তোমাকে নিয়ে অফিসে যেতে।
দাদা কোথায়?
দাদা তো কয়েকদিন হলো অফিসে আসছেন না।
মল্লিকদা।
মল্লিকদাও আসছেন না।
আমি তাপসের দিকে তাকালাম। সমীরণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
ঠিক আছে, তুমি কফি খাবে?
না।
গাড়ি কোথায় রেখেছো?
পার্কিংয়ে।
তুমি যাও আমি আসছি। বুঝলাম কিছু একটা গড়বর হয়েছে। নাহলে কাগজের দুই স্তম্ভ নেই। কাগজ বেড়িয়ে যাচ্ছে। আমার একটু অবাক লাগল।
ঘরের কথা বাইরে প্রকাশ করতে নেই।
সমীরণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ওর নিজের হাউসে একটা ভালো জায়গা হোল্ড করে আছে।
কিরে কি ভাবছিস?
কিছু না। পনেরো দিন ছিলাম না….।
তোদের হাউসে বেশ গণ্ডগোল চলছে।
তাই! সে তো আমাদের হাউসে লবিবাজি আছেই। আজ এই লবি স্ট্রং তো কাল ওই লবি।
সমীরণদা মুচকি হাসলো।
ঠিক আছে দাদা, আজ আসি, কাল দেখা হবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
সমীরণদার কাছে বিদায় নিয়ে লাউঞ্জ পেরিয়ে গেটের বাইরে এলাম। তাপস আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
কি ঠিক করলে।
অফিস গাড়ি পাঠিয়ছে। আগে অফিসে যাই, তারপর দেখা যাবে।
মনে হচ্ছে ঝড়ের একটা পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। তাপস আমাকে অফিসে লিফট করেই ওর কাজে চলে গেল। রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম না। একজন ছেলে কোট-টাই পরে বসে আছে।
আমাকে দেখে বললো, কাকে চান?
আমার ব্যাগটা এখানে রাখবো।
কার সঙ্গে দেখা করবেন?
কি বলি ছেলেটাকে। খুব আস্তে করে বললাম আমি এই অফিসের স্টাফ।
ছেলেটি আমার কার্ড দেখতে চাইল।
দেখালাম।
আমি আমার লাগেজটা রিসেপশন কাউন্টারের পেছনে রেখে লিফ্টের কাছে চলে এলাম।
সবাই কেমন ইতি উতি তাকাচ্ছে। ভারি অবাক লাগল।
কোনও দিকে তাকালাম না। ওপরে এসে সোজা নিউজরুমে চলে গেলাম।
এই সাত সকালে নিউজরুমে যেন হাট বসে গেছে। গিজ গিজ করছে।
প্রচুর নতুন মুখ।
সন্দীপের সঙ্গে দেখা হলো। কাছে এগিয়ে এল।
কখন এলি?
এই তো এই মাত্র।
শুনেছিস কিছু?
কি বলতো!
অফিসের হাল চাল।
না।
কথা বলতে বলতে নিজের টেবিলে এলাম। মল্লিকদার চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে। অপরজিটের চেয়ারে কয়েকজন নতুন ছেলেমেয়েকে দেখলাম। দু-একটা ভালো চামকিও চোখে পরলো। আমি আমার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সন্দীপ আমার পাশে বসলো।
সবাই আমাকে কম বেশি লক্ষ্য করছে।
টেবিলের ওপর রাশিকৃত চিঠি। সন্দীপ আমার দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আমি চিঠিগুলো একবার দেখলাম। কয়েকটা চিঠি পরিচিত জনের। বাকি আমার লেখার ওপর। এগুলো চিঠিপত্র বিভাগে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমি সন্দীপের দিকে তাকালাম। সন্দীপ বললো, চল একটু ক্যাণ্টিনে যাই।
চল।
আমি আর সন্দীপ ক্যাণ্টিনে এলাম।
বটাদাকে ডেকে ডিমটোস্ট আর চায়ের কথা বললাম। সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বললাম, বল কি বলছিলি?
আমার চাকরিটা মনে হয় গেল।
কেন!
তুই কিছু জানিস না?
না।
দাদা তোকে কিছু বলে নি!
না।
তুই কলকাতায় কবে এসেছিস?
কতবার বলবো। ঘণ্টাখানেক হবে। তাপস আনতে গেছিল, সুনিতদা নাকি গাড়ি পাঠিয়েছিল আমাকে তুলে আনার জন্য। প্রথমে অফিসে আসতে বলেছে। তারপর বাড়ি।
ও।
কেন-রে?
গিয়ে দেখা কর, সব জানতে পারবি।
কি হয়েছে বল না?
ফোনটা বেজে উঠলো। বড়োমার ফোন।
হ্যালো বলতেই অমিতাভদার গলা পেলাম।
মাথা ঠাণ্ডা রাখিস।
তুমি! বড়োমা কোথায়?
রান্নাঘরে।
তোমার ফোন কোথায়?
ব্যবহার করছি না।
ও। তা হঠাৎ মাথা ঠাণ্ডা রাখব কেন?
সন্দীপ আছে, শুনে নে।
অফিসে আসনি কেন?
সে অনেক কথা।
আমি এখানে, এটা কে বললো?
খবর এলো।
বাবাঃ নেট-ওয়ার্ক তো বেশ স্ট্রং, তাহলে এই অবস্থা কেন?
কপাল।
সাংবাদিকতা করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললে। এখন এই কথা বললে হবে।
সে তুই যা বলিস।
মল্লিকদা কোথায়?
বাড়িতে। তুই কখন আসছিস?
দেখি। কাজ শেষ হলেই চলে যাব।
বটাদা ডিম, পাঁউরুটি আর চা দিয়ে গেল। আমার দিকে একবার কট কট করে তাকাল।
ফোনটা পকেটে রাখলাম। সন্দীপের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ কি বলছিলি?
আমার চাকরিটা মনে হয় যাবে।
কেন?
সুনিতদা এখন পাওয়ারে।
তাতে কি হয়েছে!
তুই সত্যি একটা গাণ্ডু।
হেসে ফেললাম।
হাসিস না। তোর ওই হাসিটা দেখলে গা জ্বলে যায়।
আচ্ছা আচ্ছা হাসব না।
তোর চাকরিটা থাকবে।
যাক তাহলে রক্ষে।
অমিতাভদা এবং মল্লিকদাকে এখন ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে।
তাই! এককেবারে ছুটি।
ন্যাকামো করিস না। অমিতাভদার ঘরে এখন সুনিতদা বসছে।
ও তাহলে এডিটর, কি বল।
ওই রকমই বলতে পারিস। এখনও খাতা কলমে নয়। তবে বকলমে কাজ চালাচ্ছে।
ও।
সব নতুন নতুন ছেলেমেয়ে আমদানি করেছে।
বেশ ভালো।
সন্দীপ কট কট করে আমার দিকে তাকাল।
একজন উর্দিপরা ভদ্রোলোক এসে বললেন, আপনাকে সুনিতবাবু ডাকছেন।
ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম। উনি চলে গেলেন। সন্দীপের দিকে তাকালাম।
এখন অনেক সিকুরিটি গার্ড এসেছে। এরাই এখন অফিসের দেখভাল করে।
হরিদা কোথায় গেল?
অমিতাভদা যেদিন থেকে আসা বন্ধ করেছেন, হরিদাকে প্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওখানে কি করছে!
কাগজ বইছে।
ওই বয়স্ক মানুষটা কাগজ বইছে!
হ্যাঁ। না হলে কাজ থেকে ছুটি নিতে বলা হয়েছে।
বেচারা।
আমি অবাক হয়ে সন্দীপের কথা শুনছি। বাকিটা নিজে নিজেই আঁচ করে নিচ্ছি।
এই অফিসের মালকিন আমার পূর্ব পরিচিতা এটা এখানকার কেউ জানে না। একমাত্র অমিতাভদা, মল্লিকদা ছাড়া। তবে মল্লিকদার স্ত্রীই যে আমার ছোটোমা আর অমিতাভদার স্ত্রী আমার বড়োমা এটা সংঘমিত্রা জানে না।
তারমানে অনেক জল এই পনেরো দিনে গড়িয়ে গেছে। এই বয়সে এত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্যকরেও দাদা-মল্লিকদা কেউ কোনও কথা বলেনি। শুধু আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করেছে। এই বয়সে এটা ওদের প্রাপ্য ছিল না। আমি নিজে খুব ভালোকরে জানি এই কাগজটাকে আজ কলকাতায় শীর্ষে তোলার জন্য ওরা দুজনে কি না করেছে।
কি ভাবছিস?
না কিছু না। চল ওঠা যাক। নতুন সাহেবের সঙ্গে কোথায় দেখা করবো।
অমিতাভদার ঘরে।
ক্যান্টিন থেকে সোজা নীচে চলে এলাম। সন্দীপ নিউজরুমে গেল আমি এডিটর রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ঢোকার মুখে দেখলাম একজন সিকুরিটি গার্ডের মতোন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকতে যেতেই আমাকে বাধা দিল। কি প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করলো। তারপর বললো, ওই খানে গিয়ে স্লিপ নিয়ে আসতে।
জায়গাটা নতুন তৈরি হয়েছে মনে হচ্ছে।
দেখলাম, নিচে যে রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা বসতেন তিনি বসে আছেন। কাদের সঙ্গে যেন কথা বলছেন। আমি বাধ্য ছেলের মতোন হাজির হলাম, আমাকে দেখেই ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে বলে উঠলেন, আরে অনিবাবু যে, কি দরকার?
এডিটর সাহেবের সঙ্গে দেখা করবো।
ওঃ এই সিকুরিটিটাকে নিয়ে পারা যাবে না। সবাইকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
কি আর করা যাবে, ও তো আর আমাকে চেনে না।
চিনবে না কেন। আপনি এই হাউসের স্টাফ।
আজ আমাকে প্রথম দেখছে।
ঠিক আছে চলুন, আমি বলে দিচ্ছি।
আপনি একটা স্লিপ লিখে পাঠিয়ে দিন।
না না, এটা হয় না।
কেন হয় না, যেটা অফিসের ডেকরাম সেটা তো মানতে হবেই।
ভদ্রমহিলা আমার মুখের দিকে তাকালেন। কি যেন ভাবলেন। হয় তো শেষের কয়টা কথা বেশ কঠিন হয়েগেছিল। খুব খলবলি ভদ্রমহিলা। আমি খুব একটা পাত্তা দিই না। তবে অফিসের অনেকেই ওকে পাত্তা দেয়। দেখতে শুনতেও খারাপ নয়। ভেতরে গিয়ে ইন্টারকমে ফোন করতেই আমার যাবার ডাক এলো।
এডিটর রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দেখলাম সুনিতদা তার দলবল নিয়ে বসে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই বললো, আয় আয়।
ওদের ওইভাবে বসে থাকতে দেখে মাথাটা গরম হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দাদার কথাটা মনে পড়েগেল, মাথা ঠাণ্ডা রাখিস।
আমি পার্মিশনের তোয়াক্কা না করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
ঘরের সবাই কেমন ভাবে যেন আমাকে টেরিয়ে দেখলো।
কেমন আছিস?
ভালো।
চা খাবি?
না। ক্যান্টিন থেকে সবেমাত্র আসছি।
আমার কাট কাট উত্তরে সবাই আমার দিকে বিস্ময়ে তাকাচ্ছে।
তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা ছিল।
বলো।
তুই আজ সবে মাত্র ফিরলি।
তাতে কি হয়েছে। এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠালে আমাকে ধরে আনার জন্য….।
না মানে। তোকে আমি চেন্নাইয়ের ব্যুরো চিফ করেছি।
কার অনুমতি নিয়ে?
আমিই ঠিক করেছি। তবে ম্যানেজমেন্ট সেটায় সায় দিয়েছে।
আজকাল কি তুমি এসব ঠিক করছো নাকি?
না ম্যানেজমেন্ট গত সপ্তাহে আমাকে দায়িত্ব তুলে দিয়েছে।
আমাকে কেউ এখনও জানায়নি।
এই তো, আমি জানাচ্ছি।
সুনিতদা জানে আমার মতো খারুয়া ছেলে এই হাউসে একটাও নেই। মাঝে মাঝে অমিতাভদা পর্যন্ত ফেল মেরে যেত। কিন্তু আমি বেঁচে যাই শুধুমাত্র আমার লেখার জন্য।
সুনিতদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ম্যানেজমেন্টকে বলো আমার সঙ্গে কথা বলতে।
সেটা কি করে হয়!
কেন! যাবে কে, তুমি না আমি?
তুই।
তাহলে আমার সঙ্গে একবার আলোচনা করা উচিত ছিল।
সেটা ঠিক, তবে আমি জানি তুই….।
সরি। আমি যেতে পারছি না। তাছাড়া আমি এতো বেশি অভিজ্ঞ নই যে একটা অফিস চালাব। তার চেয়ে বরং তুমি চলে যাও। তা না হলে আমার থেকেও অনেক সিনিয়ার জার্নালিস্ট এই হাউসে আছে। তাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করো।
তাহলে তুই যাচ্ছিস না?
না।
সবাই আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। একটু যেন অবাক হয়েছে। ওদের চোখে মুখেই তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। ঘরটা নিস্তব্ধ। সুনিতদা আমার মুখের দিকে তাকাল। কিছু হয়তো বলবে ঠিক করেছিল তার আগেই আমি উঠে দাঁড়ালাম।
আর কিছু বলার আছে?
তুই একবার ভেবে দেখতে পারিস।
সরি।
তাহলে আমার কিছু করার নেই।
হাসলাম। তোমার ম্যানেজমেন্ট আমারও ম্যানেজমেন্ট তাদের সঙ্গে আমি বসবো। তাতে তোমার আপত্তি কোথায়? তোমার ব্যাক্তিগত আপত্তি থাকলে আলাদা কথা।
না, তুই হয় তো সব জানিস না।
সে তো হতেই পারে। পনেরো দিন পরে ফিরলাম। ঘণ্টা খানেক হলো অফিসে ঢুকেছি। আমার সমস্ত ব্যাপার না জানারই কথা।
ঠিক আছে তুই যা।
আমি বেরিয়ে এলাম। এটুকু জানি আমাকে এই হাউস থেকে সরান খুব মুস্কিল। তাহলে অনেক ঝড় উঠবে। সেটা সুনিতদা ভালোকরে জানে। চম্পকদা আঁচ করে, তাছাড়া মিত্রা এসব কি করলো! কার কথায় ও উঠছে বসছে! সুনিতদার কথায়! মুখে থেকে একটা খিস্তি বেরিয়ে এলো, কালকা জোগী গাঁড় মে বোলতা হ্যায় জটা।
নিউজরুমে চলে এলাম।
নিজের টেবিলে এসে বসলাম।
সন্দীপ এলো। কিরে কি বললো?
শালা চেন্নাইয়ের ব্যুরো চিফ বানিয়েছে।
আমি জানি ডি এইচ এ এম এন এ নিশ্চই একটা প্ল্যান ভেঁজেছ।
সেটা আবার কিরে!
বউ বলেছে কাউকে গালাগালি দিতে হলে বানান করে দেবে।
আমি মনে মনে উচ্চারণ করে হেসে ফেললাম।
শালা অমিতাভদার সবকটা হ্যান্ডসকে এক সপ্তাহের মধ্যে এখানে ওখানে সরিয়ে দিয়েছে। তুই কি বললি?
যাবনা বলে দিয়েছি।
ব্যাস হয়ে গেল। তোর চাকরি নট।
তো।
এরপর কি করবি?
কোনও কাগজের এডিটর হবো।
তোর দম আছে।
হাসলাম।
অনি আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করিস।
সন্দীপ আমার হাতটা ধরে ফেললো।
কেন? তোর চাকরি চলে গেছে?
যায় নি, তবে চলে যাবে।
কি করে বুঝলি?
খবর নিয়েছি কাগজপত্র তৈরি।
পিটিআই, ইউএনআই কে সামলাবে?
লোক এসে গেছে। আমি সাতদিন ধরে আসছি আর চলে যাচ্ছি।
হাজিরা খাতায় সই মারছিস?
হ্যাঁ।
কোনও নিউজ করিসনি?
না।
কেন?
দেয় নি।
ও।
অনিববু কে আছেন। একজন সিকুরিটি এসে সামনে দাঁড়াল। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম, ভালোকরে মাপলাম, ভদ্রলোক নয় একটা বাচ্চা ছেলে। সন্দীপ আমাকে দেখিয়ে বললো, উনি।
আপনাকে একবার মেমসাহেব ডাকছেন।
কে।
খিঁচিয় উঠলাম। বলাটা একটু জোড়ে হয়েগেছিল। নিউজরুমের সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে।
মেমসাহেব।
সে আবার কে!
ছেলেটি আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।
ঠিক আছে, নিচে ভিজিটারস রুমে বসতে বলো।
আপনাকে এখুনি ডাকছেন।
সন্দীপের মুখের দিকে তাকালাম। সন্দীপ ইশারায় বললো মালকিন।
তোমার মেমসাহেবকে গিয়ে বলো, আমি একটু পড়ে যাচ্ছি।
জরুরি দরকার আছে।
আরি বাবা, আচ্ছাই তো, এ তো ঘোরায় জিন দিয়ে এসেছে।
চেঁচিয়ে উঠলাম, নিউজরুমের সবাই আমার দিকে হাঁ করে দেখছে।
আমি উঠে পরলাম। গট গট করে ওর পেছন পেছন নিউজরুমের বাইরে বেরিয়ে এলাম। এই চেম্বারটাও আগে ছিল না নতুন হয়েছে। এই পনেরো দিনে অফিসের হাল-হকিকত একেবারে বদলে গেছে। দোষ আমার। কেননা আমি অফিসে খুব বেশিক্ষণ থাকতাম না। বেশির ভাগটাই বাইরে বাইরে কাটাতাম। তাছাড়া মাথার ওপর ভাববার লোক ছিল। তাই নিজের লেখালিখি নিয়েই থাকতাম।
দোতলায় মালকিনের ঘরের সামনে আসতে দেখলাম বেশ ভিড়। আমাকে দেখে ভিড়টার মধ্যে সামান্য গুঞ্জন। কট কট করে একবার সকলের দিকে তাকালাম।
আসতে পারি, বলে দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম, যারা কয়েকদিন আগেও অমিতাভদাকে তেল দিত, তারা এখন ম্যানেজমেন্টের কাছের লোক। ঘর ভর্তি। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মিত্রা একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে ও একটু অবাক হলো। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিল না। আমার পায়ের নোখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভালোকরে মাপলো। দেখলাম সুনিতদা ম্যাডামের পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছে। আমাকে দেখেই মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি। ব্যাপারটা এরকম কেমন মজা দেখ।
আসুন। মিত্রা আস্তে করে বললো।
ভেতরে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
সুনিতদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, ম্যাডাম এই হচ্ছে অনি।
আমি মিত্রার চোখে চোখ রেখেই বুকের সামনে হাত তুললাম।
চম্পকদা বললেন আরে অনিবাবু, ভাইজ্যাক কেমন কাটালে।
রাগে তখন আমার শরীর জ্বলছে। খাড়ুয়ার মতো উত্তর দিলাম।
ভালো।
তোমার আর্টিকেলগুলো কিন্তু এবার খুব একটা জমে নি।
আমি চম্পকদার দিকে একবার তাকালাম। সামান্য হেসে বললাম, চম্পকদা আমি জানতাম আপনি এ্যাডের লোক, সাংবাদ নিয়ে কবে থেকে মাথা ঘামাতে শুরু করলেন।
আমার কথায় ঘরটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না আমি চম্পকদার মতো একজন সিনিয়ার মোস্ট লোককে এইভাবে কথাটা বলবো।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। বললো না। হেলান দিয়ে চুপচাপ বসেছিল। আর একদৃষ্টে আমাকে দেখে যাচ্ছিল।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম, হ্যাঁ ম্যাডাম বলুন আমাকে কেন ডেকেছিলেন?
সুনিতদা আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো, ওই ব্যাপারটা।
আমি বেশ গম্ভীর হয়ে বললাম, তোমাকে আমার ডিসিশন জানিয়ে দিয়েছি। লেবু কচলালে তেতো হয়ে যায়। নতুন কিছু থাকলে বলতে পারো।
সেটা আমরা মানতে পারছি না।
সুনিতদা, তুমি বর্তমানে এই হাউসের কোন পজিশনে আছ আমি জানি না। তবে বাইরে যাওয়ার আগে আমার যিনি রিসেন্ট বস কাম এডিটর ছিলেন, তাঁকে আমি এই হাউসে যখন ঢুকি, তখন বলেই ঢুকেছিলাম, আমার একটা পা হাউসের বাইরে থাকবে সব সময়। প্রয়োজন পরলে, যে পা-টা ভেতরে আছে, সেটাও বাইরে বার করে নেব।
তুই কি বলতে চাইছিস।
তুমি একজন চিফ রিপোর্টার ছিলে, গোদা বাংলাটাও ঠিক মতো বুঝতে পারছো না। আবার বাংলা কাগজে সর্বোচ্চ পদে কাজ করতে চলেছো।
হেয়ালী রাখ।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বুকের কাছে হাতজোড় করে বললাম, ম্যাডাম আমি আসছি।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল। ওর চোখে অনেক না বলা কথা। কিন্তু বুঝতে পারছি এদের সামনে কিছুতেই বলতে পারছে না।
আমাকে চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসুন।
সুনিতবাবু আপনারা এখন যান। আমি ওনার সঙ্গে পার্শোনালি কথা বলে নিচ্ছি।
এক ঘর ভর্তি লোক সবাই এই কথায় কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। একে অপরের মুখের দিকে তাকাল।
আমি বসলাম।
একে একে সবাই ঘরের বাইরে চলে গেল। মিত্রা বেলবাজাতেই সেই ছেলেটিকে দেখলাম। যে আমায় ডাকতে গিয়েছিল। চোখ দু-টো ভীষন জ্বালা জ্বালা করছে।
কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। বেল বাজালে একমাত্র তুমি আসবে।
ঠিক আছে ম্যাডাম। ছেলেটি বেড়িয়ে গেল।

