06-03-2021, 09:38 PM
History of South Calcutta .
মাত্র বছর দেড়েক হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেমেছে, বিনয় কৃষ্ণ বসুর বয়স বারো, সুভাষ চন্দ্র বসু তখনও কংগ্রেসে যোগ দেননি, মান্না দে-র বয়স সবে এক বছর, সত্যজিৎ রায়ের জন্ম হয়নি।
ভবানীপুরের দক্ষিণে সামান্য কিছু বসতি তৈরী হয়েছে। কালীঘাটে আগত দর্শনার্থীরা বলেন আদি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়ালে দূর থেকে নাকি বন্য জন্তুর হুঙ্কার শোনা যায় এখনও। অবশ্য ডাকাত আর এখন তেমন নেই। তবে শ্বাপদের ভারী দাপট।
কলকাতা শহর দিন দিন ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে, তাই বন জঙ্গল কেটেই কলকাতার বসতি বাড়াতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিলেন বৃটিশ গভর্নর জেনারেল জর্জ কার্জন ওরফে লর্ড কার্জন। কলকাতার রাস্তাঘাট, জলের ব্যবস্থা, পয়ঃপ্রণালী বানানো এবং তা রক্ষণাবক্ষেণের জন্য ১৯১২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ বা সি.আই.টি.।
রক্ষণাবক্ষেণের পাশাপাশি চলতে থাকল কলকাতা সম্প্রসারণের কাজও। নতুন নতুন জমি খোঁজার কাজ, যেখানে বসতি গড়া যায়।
কালীঘাট মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি ঘন জঙ্গল বেছে নেওয়া হল। এই জঙ্গলের পাশ থেকে চলে গেছে ইংরেজদের তৈরী ব্রডগেজ রেললাইন যা আরও দক্ষিণে বজবজে যায়। বৃটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল এই অঞ্চলটাকেই কেটে সাফ করে বাসযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু সে-জঙ্গল এত গভীর, তা সাফ করতে গেলে বছরের পর বছর সময় লেগে যাবে।
তাহলে এখন কী করণীয়? ঐ জঙ্গলের দক্ষিণ দিকে, মানে রেল লাইনের অপরদিকে রয়েছে বিরাট বিরাট সব জলা। ঠিক হলো ঐ জলা ভরাট করেই বসতি হবে। জঙ্গল কেটে পরিস্কার করার থেকে মাটি ফেলে জলা ভরাট করা অনেক সহজ কাজ।
কিন্তু জলা ভর্তি করতে যত মাটি লাগবে তা পাওয়া যাবে কোত্থেকে? কেন, জঙ্গল থেকে! প্রথমে জঙ্গলের গাছ কেটে মাঠ বানানো হলো আর তারপর সেখান থেকে মাটি কেটে জলা ভর্তির কাজ চলল। মোট তিয়াত্তর একর জায়গা বেছে নেওয়া হলো কাটার জন্য।
মাটি কাটার দায়িত্ব দেওয়া হলো সি.আই.টি.-র এক পদস্থ কর্মচারী সেসিল হেনরি বমপাসকে। হাজার খানেকের ওপর লোক নিয়োগ করা হল মাটি খননের জন্য। এই রাজ্যের লোক তো বটেই, পাশের রাজ্য বিহার থেকেও লোক নিয়ে আসা হল দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য। এদিকে এই জঙ্গলের মাঝবরাবর একটি ছোট্ট মসজিদ ছিল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মসজিদটা তৈরি করা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। মসজিদটি অক্ষত রেখে তার চারিদিক থেকে মাটি কেটে নেওয়া হল। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে এই বিশাল জঙ্গলের মাঝে তৈরী হয়ে গেল মনুষ্য নির্মিত এক বিশাল জলাশয়। মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল অজস্র কঙ্কাল। কলকাতার ঠগি আর ডাকাতদের কথা কে আর না শুনেছেন। সঙ্গের জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে খুন করে জঙ্গলে লাশ পুঁতে দেওয়া ছিল তাদের বাঁ হাতের কাজ। আর পাওয়া গেল বেশ কয়েকটি কামান। আসছি পরে সে-কথায়।
যেহেতু সেসিল বমপাসের তত্বাবধানেই এই জলাশয় তৈরি হয়েছিল, তাই জলাশয়টির নাম দেওয়া হল বম্পাস লেক। ঠিক যেমন উইলিয়াম টলি নতুন করে আদি গঙ্গা সংস্কার করেন বলে তাঁর নামেই সেই স্থানের নামকরণ করা হয় টলিগঞ্জ। সে গল্পও শোনাব আরেকদিন। লেক সংলগ্ন অঞ্চল বলে মাটি বুজিয়ে রেল লাইনের পাশের যে জায়গাটা বাসযোগ্য করে তোলা হল তার নাম রাখা হলো লেক কলোনি। এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যদের একটি ছাঁউনি বা ব্যারাক বানানো হয়েছিল। তখন একে কলোনিই বলা হতো।
সিরাজ-উদ-দৌল্লার মৃত্যুর পরে, বাংলার নবাব মির-জাফরের কাছ থেকে পঞ্চান্নটি গ্রাম খুবই সামান্য অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই গ্রামগুলোকে বলা হত ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম। এই পঞ্চান্নখানি গ্রামের তেত্রিশটি ছিল কলকাতায় আর বাকিগুলো হাওড়া এবং হুগলিতে। হাওড়ার বেতড়, সালকিয়া এসব জায়গা ছিল এই পঞ্চান্ন গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের ওপরে সেই পঞ্চান্নগ্রামের একটি ছোট্ট অংশ এখনও নাম অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
যাকগে, ফিরি আসল কথায়। এই গ্রামগুলোর একটিতে ছিল বিরাট বালির বাজার। সেই বালি কোথা থেকে আসতো, তা লিখব অন্য একটি পর্বে। ‘মারাঠা ডিচ’ ভরাট করতে এখান থেকেই বালি নিয়ে যাওয়া হতো। ‘মারাঠা ডিচ’ নিয়েও দুলাইন বলতে হবে কি? আচ্ছা। বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের শাসনকালে বর্গী, অর্থাৎ মারাঠারা কলকাতা আক্রমণ করবে এইরকম একটা খবর রটে যায়। তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সেই ১৭৪২ সালে, কলকাতাকে কেন্দ্রে রেখে তার চারিধারে পরিখা তৈরির কাজ শুরু হয়। পরিখা কাটার কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু মারাঠারা আর আসবে না জানার পরে এই কাজ আর শেষ করা হয়নি। ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আবার এই পরিখা বুজিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময় পঞ্চান্নগ্রামের ওই বিশেষ গ্রাম থেকে বালি আনিয়ে মারাঠা ডিচ বুজিয়ে ফেলা হলো। সেই বুজিয়ে ফেলা পরিখা আজকের আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড।
এদিকে বালি বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের বাসিন্দারা বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। গ্রামে বেশ কিছু কোঠা বাড়ি উঠল। বালির সওদা হয় বলে গ্রামের নাম রাখা হয়েছিল বালিগঞ্জ (উচ্চারণ করা হত বালিগঞ্জো’)।
ইংরেজরা ১৮৬২ সালে শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং অবধি রেল চলাচল ব্যবস্থা চালু করে দেয়। যাতায়াতের সুবিধার্থে সমৃদ্ধ গ্রাম বালিগঞ্জে একটি স্টেশন বানায় তারা। এরও আঠাশ বছর পরে ১৮৯০ সালে বালিগঞ্জ থেকে ডানদিকের জলা আর জঙ্গলের পাশ থেকে পাতা হলো নতুন ট্রেন লাইন, বজবজ পর্যন্ত। উল্লেখ্য এই রেলপথ দিয়েই স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালে আমেরিকা ভ্রমণ সেরে কলকাতা ফেরেন।
বালিগঞ্জ সমৃদ্ধ গ্রাম হওয়াতে সেখানে বড় বড় জমিদার, ধনী লোকেরা বিঘে বিঘে জমি কিনে তাঁদের বাগান বাড়ি তৈরি করতে শুরু করলেন। প্রমোদভবন আরকি। উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীরাও এখানে বাগানবাড়ির তৈরী করলেন। তাঁদের সেইসব বিরাট বিরাট বাগানওয়ালা বাড়িগুলোর নামের সঙ্গে একখানা করে গার্ডেন জুড়ে দেওয়া হতো। এইরকমই একটি বাগানবাড়ির মালিক ছিলেন তদানীন্তন জেলা শাসক জর্জ ম্যান্ডেভিলা। তাঁর বাগানবাড়ির নাম হলো জর্জ ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন। আজকের ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন। এরকম আরেকটি বাগানবাড়ি ছিল কর্ণেল গিলবার্ট আয়রনসাইডেরও। তবে আজ আর আয়রনসাইড গার্ডেন নেই, বর্তমান নাম আয়রনসাইড রোড।
এদিকে চারিদিকে এত ‘গার্ডেন গার্ডেন’ দেখে লেক কলোনির বাসিন্দারা বললো তারাও লেক কলোনি নাম নেবে না। কলোনি নাম তাদের পছন্দ নয়। তাদেরও ‘গার্ডেন’ নাম চাই। তখন লেক কলোনির পরিবর্তে স্থানটির নাম রাখা হল লেক গার্ডেন্স।
লেকগার্ডেন্সে ছোট্ট জনপদ তৈরী হতেই ইংরেজ সরকার তখনকার নামি ব্যবসায়ী মঙ্গনিরাম বাঙুরকে দায়িত্ব দিল সেই জনপদের আরও দক্ষিণ দিক বাসযোগ্য করে তোলার। মঙনিরাম তা-ই করলেন। সেই অঞ্চলেও গড়ে উঠল বসতি। টিপু সুলতানের পরিবারের সদস্যরাও সেখানে খাপছাড়া ভাবে বসবাস করতেন। মঙনিরাম সাজিয়ে তুললেন অঞ্চলটা। আজকের এম.আর. বাঙুর হাসপাতাল তাঁর নামেই।
আর সেই বমপাস লেকের নাম হয় ঢাকুরিয়া লেক, বর্তমানের রবীন্দ্র সরোবর। তাহলে কি বমপাসের নাম ইতিহাস থেকে পুরোপুরি মুছে গেল? না, লোকে তাঁকে মনে না রাখলেও একটি রাস্তা তাঁর নামে রয়ে গেছে। দেশপ্রাণ শাসমল রোড থেকে সাদার্ন এভিনিউতে ঢুকে একটু এগোলেই বাঁ-হাতে পেয়ে যাবেন বমপাস রোড। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে কিরণশঙ্কর রায় রোড দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে লেক মার্কেট।
রবীন্দ্র সরোবর নিয়ে আরও দুটো কথা বলে রাখি। সেই যে মসজিদটির কথা বলেছিলাম, সেটি দ্বীপের মতো জলের মাঝখানে আজও আছে। ১৯২৬ সালে হাওড়ার বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড পাড় থেকে মসজিদ অবধি একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করে দেয়। এর ঠিক পেছন দিকেই ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। সিপাহি বিদ্রোহের পরেই, ১৮৫৮ সালে ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে বম্পাস লেকের কাজ শুরু হয় ১৯২০। তাহলে তো হিসেব মিলছে না! মিলে যাবে, পরের লাইনটি পড়লেই হিসেব মিলে যাবে। ১৮৫৮ সালে ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়, স্ট্র্যান্ড রোডের পাড়ে গঙ্গার দিকে। পরে সরোবর তৈরি হলে পাকাপাকিভাবে এখানে উঠে আসে।
সব শেষে বলি, রবীন্দ্র সরোবরে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন সরোবরের পশ্চিমপাড়ে বেশ কয়েকটা বড় বড় কামান রাখা আছে। এই কামানগুলো ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লার ব্যবহৃত কামান। মাটি খোঁড়ার সময় এগুলো পাওয়া গিয়েছিল!
সংগৃহিত
মাত্র বছর দেড়েক হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেমেছে, বিনয় কৃষ্ণ বসুর বয়স বারো, সুভাষ চন্দ্র বসু তখনও কংগ্রেসে যোগ দেননি, মান্না দে-র বয়স সবে এক বছর, সত্যজিৎ রায়ের জন্ম হয়নি।
ভবানীপুরের দক্ষিণে সামান্য কিছু বসতি তৈরী হয়েছে। কালীঘাটে আগত দর্শনার্থীরা বলেন আদি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়ালে দূর থেকে নাকি বন্য জন্তুর হুঙ্কার শোনা যায় এখনও। অবশ্য ডাকাত আর এখন তেমন নেই। তবে শ্বাপদের ভারী দাপট।
কলকাতা শহর দিন দিন ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে, তাই বন জঙ্গল কেটেই কলকাতার বসতি বাড়াতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিলেন বৃটিশ গভর্নর জেনারেল জর্জ কার্জন ওরফে লর্ড কার্জন। কলকাতার রাস্তাঘাট, জলের ব্যবস্থা, পয়ঃপ্রণালী বানানো এবং তা রক্ষণাবক্ষেণের জন্য ১৯১২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ বা সি.আই.টি.।
রক্ষণাবক্ষেণের পাশাপাশি চলতে থাকল কলকাতা সম্প্রসারণের কাজও। নতুন নতুন জমি খোঁজার কাজ, যেখানে বসতি গড়া যায়।
কালীঘাট মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি ঘন জঙ্গল বেছে নেওয়া হল। এই জঙ্গলের পাশ থেকে চলে গেছে ইংরেজদের তৈরী ব্রডগেজ রেললাইন যা আরও দক্ষিণে বজবজে যায়। বৃটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল এই অঞ্চলটাকেই কেটে সাফ করে বাসযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু সে-জঙ্গল এত গভীর, তা সাফ করতে গেলে বছরের পর বছর সময় লেগে যাবে।
তাহলে এখন কী করণীয়? ঐ জঙ্গলের দক্ষিণ দিকে, মানে রেল লাইনের অপরদিকে রয়েছে বিরাট বিরাট সব জলা। ঠিক হলো ঐ জলা ভরাট করেই বসতি হবে। জঙ্গল কেটে পরিস্কার করার থেকে মাটি ফেলে জলা ভরাট করা অনেক সহজ কাজ।
কিন্তু জলা ভর্তি করতে যত মাটি লাগবে তা পাওয়া যাবে কোত্থেকে? কেন, জঙ্গল থেকে! প্রথমে জঙ্গলের গাছ কেটে মাঠ বানানো হলো আর তারপর সেখান থেকে মাটি কেটে জলা ভর্তির কাজ চলল। মোট তিয়াত্তর একর জায়গা বেছে নেওয়া হলো কাটার জন্য।
মাটি কাটার দায়িত্ব দেওয়া হলো সি.আই.টি.-র এক পদস্থ কর্মচারী সেসিল হেনরি বমপাসকে। হাজার খানেকের ওপর লোক নিয়োগ করা হল মাটি খননের জন্য। এই রাজ্যের লোক তো বটেই, পাশের রাজ্য বিহার থেকেও লোক নিয়ে আসা হল দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য। এদিকে এই জঙ্গলের মাঝবরাবর একটি ছোট্ট মসজিদ ছিল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মসজিদটা তৈরি করা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। মসজিদটি অক্ষত রেখে তার চারিদিক থেকে মাটি কেটে নেওয়া হল। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে এই বিশাল জঙ্গলের মাঝে তৈরী হয়ে গেল মনুষ্য নির্মিত এক বিশাল জলাশয়। মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল অজস্র কঙ্কাল। কলকাতার ঠগি আর ডাকাতদের কথা কে আর না শুনেছেন। সঙ্গের জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে খুন করে জঙ্গলে লাশ পুঁতে দেওয়া ছিল তাদের বাঁ হাতের কাজ। আর পাওয়া গেল বেশ কয়েকটি কামান। আসছি পরে সে-কথায়।
যেহেতু সেসিল বমপাসের তত্বাবধানেই এই জলাশয় তৈরি হয়েছিল, তাই জলাশয়টির নাম দেওয়া হল বম্পাস লেক। ঠিক যেমন উইলিয়াম টলি নতুন করে আদি গঙ্গা সংস্কার করেন বলে তাঁর নামেই সেই স্থানের নামকরণ করা হয় টলিগঞ্জ। সে গল্পও শোনাব আরেকদিন। লেক সংলগ্ন অঞ্চল বলে মাটি বুজিয়ে রেল লাইনের পাশের যে জায়গাটা বাসযোগ্য করে তোলা হল তার নাম রাখা হলো লেক কলোনি। এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যদের একটি ছাঁউনি বা ব্যারাক বানানো হয়েছিল। তখন একে কলোনিই বলা হতো।
সিরাজ-উদ-দৌল্লার মৃত্যুর পরে, বাংলার নবাব মির-জাফরের কাছ থেকে পঞ্চান্নটি গ্রাম খুবই সামান্য অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই গ্রামগুলোকে বলা হত ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম। এই পঞ্চান্নখানি গ্রামের তেত্রিশটি ছিল কলকাতায় আর বাকিগুলো হাওড়া এবং হুগলিতে। হাওড়ার বেতড়, সালকিয়া এসব জায়গা ছিল এই পঞ্চান্ন গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের ওপরে সেই পঞ্চান্নগ্রামের একটি ছোট্ট অংশ এখনও নাম অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
যাকগে, ফিরি আসল কথায়। এই গ্রামগুলোর একটিতে ছিল বিরাট বালির বাজার। সেই বালি কোথা থেকে আসতো, তা লিখব অন্য একটি পর্বে। ‘মারাঠা ডিচ’ ভরাট করতে এখান থেকেই বালি নিয়ে যাওয়া হতো। ‘মারাঠা ডিচ’ নিয়েও দুলাইন বলতে হবে কি? আচ্ছা। বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের শাসনকালে বর্গী, অর্থাৎ মারাঠারা কলকাতা আক্রমণ করবে এইরকম একটা খবর রটে যায়। তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সেই ১৭৪২ সালে, কলকাতাকে কেন্দ্রে রেখে তার চারিধারে পরিখা তৈরির কাজ শুরু হয়। পরিখা কাটার কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু মারাঠারা আর আসবে না জানার পরে এই কাজ আর শেষ করা হয়নি। ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আবার এই পরিখা বুজিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময় পঞ্চান্নগ্রামের ওই বিশেষ গ্রাম থেকে বালি আনিয়ে মারাঠা ডিচ বুজিয়ে ফেলা হলো। সেই বুজিয়ে ফেলা পরিখা আজকের আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড।
এদিকে বালি বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের বাসিন্দারা বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। গ্রামে বেশ কিছু কোঠা বাড়ি উঠল। বালির সওদা হয় বলে গ্রামের নাম রাখা হয়েছিল বালিগঞ্জ (উচ্চারণ করা হত বালিগঞ্জো’)।
ইংরেজরা ১৮৬২ সালে শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং অবধি রেল চলাচল ব্যবস্থা চালু করে দেয়। যাতায়াতের সুবিধার্থে সমৃদ্ধ গ্রাম বালিগঞ্জে একটি স্টেশন বানায় তারা। এরও আঠাশ বছর পরে ১৮৯০ সালে বালিগঞ্জ থেকে ডানদিকের জলা আর জঙ্গলের পাশ থেকে পাতা হলো নতুন ট্রেন লাইন, বজবজ পর্যন্ত। উল্লেখ্য এই রেলপথ দিয়েই স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালে আমেরিকা ভ্রমণ সেরে কলকাতা ফেরেন।
বালিগঞ্জ সমৃদ্ধ গ্রাম হওয়াতে সেখানে বড় বড় জমিদার, ধনী লোকেরা বিঘে বিঘে জমি কিনে তাঁদের বাগান বাড়ি তৈরি করতে শুরু করলেন। প্রমোদভবন আরকি। উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীরাও এখানে বাগানবাড়ির তৈরী করলেন। তাঁদের সেইসব বিরাট বিরাট বাগানওয়ালা বাড়িগুলোর নামের সঙ্গে একখানা করে গার্ডেন জুড়ে দেওয়া হতো। এইরকমই একটি বাগানবাড়ির মালিক ছিলেন তদানীন্তন জেলা শাসক জর্জ ম্যান্ডেভিলা। তাঁর বাগানবাড়ির নাম হলো জর্জ ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন। আজকের ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন। এরকম আরেকটি বাগানবাড়ি ছিল কর্ণেল গিলবার্ট আয়রনসাইডেরও। তবে আজ আর আয়রনসাইড গার্ডেন নেই, বর্তমান নাম আয়রনসাইড রোড।
এদিকে চারিদিকে এত ‘গার্ডেন গার্ডেন’ দেখে লেক কলোনির বাসিন্দারা বললো তারাও লেক কলোনি নাম নেবে না। কলোনি নাম তাদের পছন্দ নয়। তাদেরও ‘গার্ডেন’ নাম চাই। তখন লেক কলোনির পরিবর্তে স্থানটির নাম রাখা হল লেক গার্ডেন্স।
লেকগার্ডেন্সে ছোট্ট জনপদ তৈরী হতেই ইংরেজ সরকার তখনকার নামি ব্যবসায়ী মঙ্গনিরাম বাঙুরকে দায়িত্ব দিল সেই জনপদের আরও দক্ষিণ দিক বাসযোগ্য করে তোলার। মঙনিরাম তা-ই করলেন। সেই অঞ্চলেও গড়ে উঠল বসতি। টিপু সুলতানের পরিবারের সদস্যরাও সেখানে খাপছাড়া ভাবে বসবাস করতেন। মঙনিরাম সাজিয়ে তুললেন অঞ্চলটা। আজকের এম.আর. বাঙুর হাসপাতাল তাঁর নামেই।
আর সেই বমপাস লেকের নাম হয় ঢাকুরিয়া লেক, বর্তমানের রবীন্দ্র সরোবর। তাহলে কি বমপাসের নাম ইতিহাস থেকে পুরোপুরি মুছে গেল? না, লোকে তাঁকে মনে না রাখলেও একটি রাস্তা তাঁর নামে রয়ে গেছে। দেশপ্রাণ শাসমল রোড থেকে সাদার্ন এভিনিউতে ঢুকে একটু এগোলেই বাঁ-হাতে পেয়ে যাবেন বমপাস রোড। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে কিরণশঙ্কর রায় রোড দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে লেক মার্কেট।
রবীন্দ্র সরোবর নিয়ে আরও দুটো কথা বলে রাখি। সেই যে মসজিদটির কথা বলেছিলাম, সেটি দ্বীপের মতো জলের মাঝখানে আজও আছে। ১৯২৬ সালে হাওড়ার বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড পাড় থেকে মসজিদ অবধি একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করে দেয়। এর ঠিক পেছন দিকেই ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। সিপাহি বিদ্রোহের পরেই, ১৮৫৮ সালে ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে বম্পাস লেকের কাজ শুরু হয় ১৯২০। তাহলে তো হিসেব মিলছে না! মিলে যাবে, পরের লাইনটি পড়লেই হিসেব মিলে যাবে। ১৮৫৮ সালে ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়, স্ট্র্যান্ড রোডের পাড়ে গঙ্গার দিকে। পরে সরোবর তৈরি হলে পাকাপাকিভাবে এখানে উঠে আসে।
সব শেষে বলি, রবীন্দ্র সরোবরে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন সরোবরের পশ্চিমপাড়ে বেশ কয়েকটা বড় বড় কামান রাখা আছে। এই কামানগুলো ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লার ব্যবহৃত কামান। মাটি খোঁড়ার সময় এগুলো পাওয়া গিয়েছিল!
সংগৃহিত