04-03-2021, 04:56 PM
গোপন কথাটি রইলো না আর গোপনে #
বাপি বেরিয়ে গেছে সেই কোন সকালে, আমার রিজ সোনা ঘুমোচ্ছে দেখে আর ডাকিনি। চুপ করে বসে কাল রাতের কথা ভাবছি। ইস, কি ভালো লাগছিল ওর বুকের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে রেখে ফিসফিস করে ওর সাথে কথা বলে যেতে। বুকের ভেতরে যে এত কথা জমে ছিল নিজেও কি জানতাম না নাকি। ওর ওই কথাটা বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে...তিস্তা, আর আমার কোনো ভয় নেই তোমাকে হারানোর। আমি ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলাম...জানি তো। ও একটু চুপ করে থেকে বলেছিল...কি ভাবে? আমাদের কত মান অভিমান হয়েছে তবুও কি তুমি পেরেছো আমার সাথে কথা না বলে থাকতে? আমার প্রশ্নের ভেতরে থাকা উত্তরটা শুনে ও বলেছিল...আমি কি একা...তোমার সব কথা তো আমি রাখিনি... তুমিও তো পারোনি অভিমান করে থাকতে...আমার থেকে দুরে সরে যেতে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে খুব ইচ্ছে করলো ওকে একবার দেখে আসি...ওর ঘুমের যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য ভোরে উঠে গিয়ে জানলা দরজার পর্দা ভালো করে টেনে দিয়ে এসেছিলাম...বাইরে ঝকঝকে রদ্দুর থাকলেও ওর ঘরে এখোনো আলোছায়ার খেলা। ও পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে, জেগে থাকলে যে মুখে দুষ্টুমি ভরা থাকে সেখানে এখন নিস্পাপ শিশুর সরলতা...মুগ্ধ দৃষ্টিতে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা...দীঘায় ওকে ডেকে আনতে গিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু পাওয়ার আশায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম...সম্বিত ফিরে এসেছিল যখন আমি ওর দুহাতের বাঁধনে। আজও আবার সেইভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে...ঘুমের ভেতরেই ওর মুখে এক চিলতে হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলাম...তাহলে কি ও জেগে আছে...দুষ্টুমি করে ঘুমের ভান করে থেকে দেখতে চাইছে আমি কি করি? আচ্ছা, আমিও কম যাই না...তুমি যদি ভেবে থাকো আমাকে বোকা বানাবে...সে গুড়ে বালি...ভাবতে ভাবতে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি ও কি করে দেখার জন্য। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেল...ওর মুখের এক চিলতে হাসি এখন আর নেই...হাতড়ে হাতড়ে কি যেন খোঁজার চেস্টা করছে। বুঝলাম, ও ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখছে...নিশ্চয় আমাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছে। তাই হবে, ও তো মাঝে মাঝেই বলে...জানো তিস্তা, আজ আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম...খুব দুষ্টুমি করছিলে আমার সাথে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভীষন ভালো লাগলো...থাক, ওকে এখন আর ডাকবো না...আমাকে নিয়ে স্বপ্নে কি কি করছে কে জানে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম রাতের আরো একটা কথা মনে পড়ে গেলে...আমার ইচ্ছেতেই ও চেয়েছিল আরো কিছুটা কাছে আসতে...এই প্রথম ও আমার বুকে হাত রেখেছিল নিজের থেকে কিন্তু একবারের জন্যও ও নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি। সত্যিই অদ্ভুত একটা ছেলে, জানি না কি করে একটা ছেলে কোনো মেয়ের বুকে হাত দেবার সুযোগ পেলে এইভাবে নিজেকে আটকে রাখতে পারে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বন্ধুদের কাছে যা যা শুনেছি ছেলেদের ব্যাপারে এতদিন, সব কিছুই যেন ও মিথ্যে প্রমান করে দিল...ভাবতেই শিউরে উঠছি, ও কেমন ভাবে আলতো ভাবে আমাকে ছুঁয়ে থেকে ফিস ফিস করে বলেছিল...তিস্তা তুমি কি স্বর্গের দেবী? এতো সুন্দর! এত নিঁখুত! এত মসৃন! ওর আমাকে ছুঁয়ে থাকা দেখে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন কোনো শিল্পী তাঁর সৃষ্টিকে পরম মমতায় ছুঁয়ে থেকে নিজেই অনুভব করছেন তিনি কি সৃষ্টি করেছেন। ও আমাকে ছোঁয়ার আগে হয়তো চেয়েছিলাম নিজেকে বিলিয়ে দিতে কিন্তু ওর আমাকে ওইভাবে অনুভব করতে দেখে শরিরের কামনা বাসনা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে এক অপার্থিব সুখে ভেসে যাচ্ছিলাম ওর সাথে সাথে। আরো একবার মন প্রান দিয়ে ওর ভালোবাসা অনুভব করতে করতে ফিসফিস করে বলেছিলাম...আমাকে তো ঈশ্বর তোমার জন্যই নিজের হাতে গড়েছেন। বাইরের ঘরের ঘড়ির আওয়াজে ঘোরের ভেতর থেকে ফিরে এলাম, বুঝলাম সকাল ন টা বাজল। নাঃ, ওর জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসে ডেকে তুলি,অনেক কাজ পড়ে আছে...ভেবে ফিরে এলাম।
আমাকে একবারে ওর কাছ ঘেঁষে বসতে দেখে ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল...বাপি কই? ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে বললাম...বাপি নেই,বেরিয়ে গেছে...এখন শুধু তুমি আর আমি। আবার আমাকে এত কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিল দেখে আদুরে গলায় বললাম...এই রিজ, তুমি তো এত লোভী ছিলে না আগে। ও আমাকে আদর করতে করতে বলল...একটু আগে খুব দুষ্টুমি করছিলে আমার সাথে...খালি দৌড়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলে...কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না তোমাকে। ইস, পালাচ্ছিলাম না ছাই...এই তো তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম বলাতে আস্তে করে বলল...তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম। কথাটা শুনে ওকে আরো বেশী করে বুকে চেপে ধরে চোখ বুজে ভাবছিলাম...জানি তো...আমার বিচ্ছু আমাকে ছাড়া তো আর কিছু ভাবতেই পারে না।
সাড়ে এগারোটা মতো বাজে, আমি রান্নাঘরে ব্যাস্ত। ওকে একটা গল্পের বই দিয়ে এসেছি সময় কাটাবার জন্য। যতক্ষন রান্নার দিদি আসেনি আমাকে কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইছিল না, রান্নার দিদি এসে যাবার পর আর জোর করেনি। বাইরের বেলটা বেজে উঠলে ভাবলাম বাপি ফিরে এসেছে। দরজা খুলে দেখি বাপি নয়, আমার সবথেকে কাছের দুই বন্ধু চয়নিকা আর মৌলী। কাল আমি চলে যাবো জানতো, তাই ওরা চলে এসেছে দেখা করতে। আমাকে দেখতে পেয়ে দুজনেই খুব হইচই করে আমাকে ঠেলে নিজেরাই ঢুকে পড়ল ভেতরে। ওরা যে হঠাৎ আমাকে না জানিয়ে চলে আসবে ভাবতেই পারিনি, তার জন্য হয়তো একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মেয়েদের চোখ যে কি জিনিষ তা কি আর আমি বুঝি না? কোনো কিছুই হয়তো এড়িয়ে যায় না। চয়নিকা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে বলল... কি রে তিস্তা...তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমরা এসেছি বলে তোর ভালো লাগছে না? মৌলী পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বলল... উঁ হুঁ... মনে হচ্ছে অন্য কেস। কিছু একটা চাপা দিতে চাইছে। ততক্ষনে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি... আমিও কম যাই না, হেসে ফেলে বললাম... তোদের আর আমার পেছনে লাগা ছাড়া কাজ নেই নাকি?
তিনজনে মিলে খুব হইচই করছি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে। ওর দেওয়া জিন্সটা দেখে চয়ি মৌলীর কানে কানে কিছু বললে আমি ইচ্ছে করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে কান খাড়া করে রেখেছি ওরা এরপরে কি বলে শোনার জন্য। মৌলীর সোজাসুজি প্রশ্ন...এই তিস্তা, তুই তো এই জিন্সটা দেখাস নি আমাদেরকে...কবে কিনলি? যুৎসই একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, কি করে জানবো বিচ্ছুটা উঠে চলে আসবে আমার ঘরে... হঠাৎ মুখ তুলে ওকে দরজার সামনে দেখে থতমত খেয়ে গেলাম... এখুনি হয়তো কৈফিয়ত দিতে হবে ও কে...যা করার এখুনি করতে হবে ভেবে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম...কিছু লাগবে মামা? আমার মুখে মামা ডাক শুনে ও হয়তো ভেতরে ভেতরে চমকে গেল, বুদ্ধিমান ছেলে বলে কি ভাবছে বুঝতে না দিয়ে বলল...আর একবার চা পেলে ভালো হোতো। আচ্ছা যাও, আমি দিয়ে আসছি বলাতে ও ফিরে গেল। চয়ি আর মৌলী নিজেদের ভেতরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল দেখে আমি নিজের থেকে কিছু না বলে উঠে গেলাম রান্না ঘরের দিকে। দিদিকে চা বানাবার কথা বলে ফিরে আসতেই শুরু হয়ে গেল ওদের সাঁড়াসী আক্রমন। ওরাও ছাড়বে না আর আমিও হার মানবো না। ছেলেটা কে, কোত্থেকে এলো, সত্যি যদি তোর যে মামা হয় তো আগে বলিস নি কেন... কত যে প্রশ্ন ওদের কে জানে। বেশ কিছুক্ষন টানা হেঁচড়ার পর ওরা হার মেনে নিলেও মনে হোলো না খুব একটা বিশ্বাস করেছে আমাকে। তারপরেই কি মনে হল কে জানে, আর যেন পারছিলাম না আমার এতো খুশী আমার এতো কাছের বন্ধুদেরকে না জানিয়ে থাকতে। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর নিজের থেকেই ওদেরকে বললাম...এই শোন না...রাগ করবি না কিন্তু তোরা, একটা কথা বলছি...
ওরা দুজনে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে... আমি ওদেরকে একটু একটু করে বলছি আমার বিচ্ছুর কথা। ওদেরকে বলতে পেরে ভীষন হাল্কা লাগছে নিজেকে...মুখ নীচু করে বসে আছি। হঠাৎ ওদের হইচই শুনে মুখ তুলে তাকালাম... এখুনি ওদের সাথে আমার বিচ্ছুর আলাপ করিয়ে দিতে হবে। কি হোলো কে জানে আমার, সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেল হঠাৎ...লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠল...আস্তে করে বললাম...তোরা নিজেরাই যা না... ও খুব মিশুকে...
পাশের ঘর থেকে ওদের তিনজনের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। বিচ্ছুটা এইটুকু সময়ের ভেতরেই জমিয়ে ফেলেছে ওদের সাথে। আমাকে ওখানে পেলে ওরা পেছনে লাগতে ছাড়বে না ভেবে আমি কাজ আছে বলে এড়িয়ে গেছি, অবশ্য এড়িয়ে গেছি বলাটা মনে হয় ঠিক হবেনা...কিছুটা সময় আমি নিজের ভেতরে থাকতে চাইছিলাম...মাঝে একবার চয়ি আমাকে ডাকতে এসে জড়িয়ে ধরে বলেছে...এই তিস্তা, এ তো একেবারে লেডি কিলার টাইপের ছেলে রে...কি সুন্দর কথা বলতে পারে...সাবধানে রাখিস কিন্তু, ফুড়ুৎ না হয়ে যায়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসেছি আর নিজের মনে মনে বলেছি...তোরা ওকে বুঝবি না রে... একমাত্র আমিই বুঝি ওকে।
দুপুরে আর ওদেরকে বাড়ী ফিরতে দিই নি, বাপি দুপুরে ফিরে খেয়ে নিয়েই আবার বেরিয়ে যাওয়াতে আমরা যেন বাঁধন ছেঁড়া হয়ে উঠেছি...সবাই মিলে গল্প হাসি ঠাট্টা খুনসুটি কি না করেছি... চয়ী খুব করে ধরেছিল আমাদের দুজনের অন্তরঙ্গ একটা ছবি তুলে রাখবে মোবাইলে। আমি রাজী হইনি... বলেছি...না রে এখন থাক... তোরা দুজনে ছাড়া আর কেউ এখন জানলে অসুবিধা আছে...
______________________________
বিদায় #
কোলকাতা পৌছোলাম আমরা একই ফ্লাইটে, আমরা মানে বাপি, আমার উনি আর আমি। আমার জীবনের প্রথম আকাশ যাত্রা, কিছুই বুঝলাম না, এত তাড়াতাড়ি বাগডোগরা থেকে কোলকাতা পৌঁছে গেলাম যে বুঝতেই পারলাম না ঠিক কেমন লাগল। ভাবতেই পারছি না যে রাস্তা আসতে সারা রাত ট্রেনে কাটাতে হয় সেই রাস্তা যেন নিমেষে পৌঁছে গেলাম। বাপির সময় হবে না বম্মাদের ওখানে যাওয়ার, এখান থেকেই দিল্লী চলে যাবে, আমি থেকে যাবো আমার বিচ্ছুর কাছে। এত সময় ঠিক ছিল...খুব একটা কিছু মনে হয়নি। বাপির ফ্লাইটের সময় যত এগিয়ে আসছে তত যেন কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এর আগে কোনোদিন বাপিকে ছেড়ে থাকিনি। আমার বিচ্ছুর কাছে থাকতে পারার খুশী ছাপিয়ে গিয়ে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বাপিকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে ফেলেছি। বাপি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে সান্তনা দেবার চেস্টা করতে গিয়ে নিজের চোখ জলে ভরিয়ে ফেলেছে। তারপর নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছি...যতই খারাপ লাগুক না কেন আমাকে তো একদিন না একদিন বাপিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে...আমি এত কান্নাকাটি করলে তো বাপির আরো মন খারাপ হবে। আমার তো উচিত বাপিকে খুশী মনে বিদায় দেওয়া। নিজের কথা না ভেবে কান্না ভেজা চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম...ইস, বাপি তুমি কাঁদছো। ধ্যাত...সবাই কি ভাববে। নিজের হাতে ওড়না দিয়ে বাপির চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। চুমু দিলাম বাপির গালে। সাবধানে যেও...রোজ একবার করে ফোন করবো...আমার জন্য চিন্তা করবে না...আমি তো বম্মাদের কাছে আছি বলে বাপিকে সান্তনা দিলে বাপি আমাকে জড়িয়ে ধরে থেকে বলল...জানি, তাই তো আমার আর তোর জন্য কোনো চিন্তা নেই। আমার বিচ্ছু অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ও চায়নি আমাদের বাবা মেয়ের একেবারে আলাদা জগতে ঢুকে কোনোরকম অস্বস্তিতে ফেলতে। ওর এই ব্যাপারটা আমার সত্যিই ভীষন ভালো লাগে। আমারও যে একটা নিজস্ব জগৎ আছে সেটা ওকে মনে করিয়ে দিতে হয় না।
বাপিকে যেতে হবে এবারে। শেষ বারের মতো বাপি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বলল... বাবাই এর সাথে ঝগড়া করবি না কিন্তু। আমি মনে মনে বাপিকে বললাম...বাপি, তোমরা যেটা দেখতে পাও সেটা তো সত্যি নয়... তোমাকে তো এখোনো বলতে পারিনি আমি যে এখন আমার নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসি ওকে। তোমরা যেটা দেখতে পাও না সেটা ঠিক কি তা শুধু আমরা দুজনেই জানি। মনে মনে এই কথা গুলো বলে ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম ইস, বিচ্ছুটা আমার পেছনে লাগলে আমি ছেড়ে দেব নাকি? বাপি আমার পিঠ চাপড়ে হেসে ফেলে বলল...পাগলী মেয়ে আমার। আরো দু একটা কথা বলে বাপিকে ভেতরে চলে যেতে হল, দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাপিকে বারে বারে পেছন ফিরে তাকাতে দেখে আমার দুচোখ আবার জলে ভরে উঠল। হাত নেড়ে বাপিকে টাটা করতে করতে ইচ্চে করছিল দৌড়ে গিয়ে বাপিকে একবার ছুঁয়ে আসি। বাপি চোখের আড়ালে চলে গেছে...ইচ্ছেটা নিজের ভেতরেই আটকে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, চোখের জলে গাল ভিজে যাচ্ছে একটু একটু করে। ও আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিলে ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললাম। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে...আস্তে আস্তে আমার কান্না থেমে গেলেও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিলাম। আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, আমি অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছি...মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আস্তে করে বললাম...চলো...ফেরার সময় ট্যাক্সিতে ওর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে ছিলাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে থেকে আমার মতোই চুপ করে ছিল। ও জানতো আমার কথা বলতে ভালো লাগবে না এখন, তাই ও চায়নি জোর করতে।
আমার নতুন বান্ধবী #
সামনেই একটা সেমিস্টার থাকায় তিস্তাকে বেশী সময় দিতে পারছিলাম না। অবশ্য কারনটা জানা থাকায় ও নিজের থেকেই আমার কাছে বেশী আসে না। উল্টে আমি যদি ওকে কখোনো কাছে পেতে চাই তো ও বলে যে...উঁ হুঁ...এখন নয়...আগে পড়া তারপরে প্রেম। মায়ের আদরের মেয়ে তার বম্মার সাথেই বেশী সময় কাটায়...খুব নাকি মন দিয়ে রান্না শিখছে ভবিষ্যতে ওর হাসব্যান্ডকে খাওয়াবে বলে...ওর বম্মা তাই জানে কিন্তু ওর সেই ভবিষ্যতের হাসব্যান্ড যে নিজের ছেলে সেটা এখোনো জানে না। একেবারেই যে চিন্তা হয় না তা নয় তবু নানা রকম ভাবে নিজেকে বুঝিয়েছি সময় হলে কিভাবে মা বাবাকে জানাবো যে আমি আর তিস্তা বিয়ে করতে চাই। ব্যাপারটা যে খুব সোজা হবে তা নয় কিন্তু কিভাবে এগোলে ভালো হবে সেটা নিয়ে নানা রকম রাস্তা ভেবে রেখেছি। তিস্তাকে এই নিয়ে কিছু বলিনা কারন ওর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি খুব টেনশান করে। মাঝে মাঝে ওর সেই দুই বান্ধবী চয়ী আর মৌলীর সাথে আমাকেও কথা বলতে হয় ওর মোবাইলে... প্রথম প্রথম আমার থেকে ওদের উৎসাহটাই বেশী ছিল আমার সাথে কথা বলার। ওদের দুজনের সাথেই বেশ একটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে এই কদিনে। মেয়ে দুটো আর যাই হোক না কেন তিস্তাকে সত্যিই ভীষন ভালোবাসে, যাকে বলে একেবারে প্রানের বন্ধু। তাই হয়তো আমার কাছে ওদের প্রত্যাশাটা অনেক অনেক বেশী। যাই ঘটুক না কেন আমি যেন কোনো অবস্থাতেই তিস্তার পাশ থেকে সরে না যাই...এটাই চায় ওরা মন প্রান দিয়ে, শুধু তাই নয়, আমাকে মাঝে মাঝে বলেও ফেলে। তিস্তাকে কথায় কথায় জানিয়েছি ওদের মনোভাব। যদিও আমার বা তিস্তার কারুরই আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো দ্বিধা ছিল না তবুও ভালো লেগেছিল এই ভেবে যে আমাদের জন্য আরো কেউ আছে ভাবার। যারা নিঃস্বার্থ ভাবে চায় আমরা এক হই।
আজ আমার পরীক্ষা শেষ। বাড়ী ফিরে বিকেলে মা আর তিস্তাকে নিয়ে বেরোনোর কথা, গড়িয়াহাটে কেনাকাটা করতে যাবে। ক্লাস থেকে বেরোনোর আগে কলেজের অফিস থেকে খবর পাঠালো বাড়ী থেকে মায়ের ফোন এসেছিল কিছুক্ষন আগে, আমি যেন এখুনি ফোন করি। মা তো এর আগে কোনোদিন এইভাবে কলেজে ফোন করেনি, কি এমন হয়েছে ভাবতে ভাবতে এক বন্ধুর মোবাইল নিয়ে বাড়ীতে ফোন করলাম। যা শুনলাম তা মোটেও ভালো খবর নয়...মৌলীর বাবা কোলকাতা এসেছিলেন অফিসের কাজে, বাস থেকে নামতে গিয়ে পেছন থেকে একটা গাড়ীর ধাক্কা খেয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। খুব কপাল ভালো পুলিশ সময়মতো হসপিটালে ভর্তি করেছে। তিস্তা এই মুহুর্তে এখানে থাকায় আর কোলকাতায় ওদের চেনা জানা তেমন কেউ না থাকায় মৌলী ওকেই ফোন করেছে খবর পেয়ে। খবরটা শুনেই তাড়াতাড়ি এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে ওর বাইকে হসপিটালের দিকে দৌড়োলাম। মাকে বলে দিয়েছি তিস্তাকে নিয়ে চলে আসতে তাই আর আমার বাড়ী যাবার দরকার ছিল না। হসপিটালে পৌঁছে দেখলাম নিজের কেউ কাছে না থাকায় যা হবার তাই হয়েছে, ট্রিটমেন্টের তেমন কিছু তখোনো শুরু হয়নি। আইসিইউতে দেবার ব্যাবস্থা করতে গিয়ে টাকার জন্য বাবার সাহায্য নিতে হল। ওদিক থেকে মায়ের সাথে তিস্তাও পৌঁছে গেছে ততক্ষনে। তিস্তাকে দিয়ে মৌলীর মাকে ফোন করালাম, চিন্তা করার দরকার নেই..আমরা সামলে নিচ্ছি।
বাইরে অপেক্ষা করছি, ডাক্তারবাবু বেরোলে কথা বলে জানতে হবে পেশেন্টের অবস্থা ঠিক কিরকম। তিস্তা মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে আছে। মাঝে মাঝে চোখের জল মুছতে দেখে মা ওকে বোঝাবার চেস্টা করছে। বেশ কিছুক্ষন পর ডাক্তারবাবু বেরোলে কথা বলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল... প্রানের ভয় নেই তবে হাত পায়ের হাড় ভেঙ্গেছে। খবরটা পাওয়ার পর আবার মৌলীদেরকে জানালে ওরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল, ওর মা আমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবেন বুঝতেই পারছিলেন না। বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে এসেছিলেন, তিস্তা আর মাকে নিয়ে বাড়ী ফিরে গেছেন। আমাকে রাতে থেকে যেতে হল হসপিটালে, যোগাযোগ রাখার জন্য মায়ের মোবাইলটা আমার কাছে থাকছে। দুদিন পর মেজর অপারেশন, হাতে পায়ে প্লেট বসাতে হবে। মৌলী পরের দিন সকালে এসে গেল, সাথে ওর মা আর ভাই। আমাদের বাড়ীতেই থাকবেন ওনারা যতদিন প্রয়োজন।
অপারেশন ভালো ভাবেই হয়েছে। মৌলীর বাবা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছেন তবে আরো কিছুদিন সময় লাগবে ছাড়া পেতে। আমাদের দিক থেকে এতটা সাহায্য পেয়ে শুধু মৌলীরা নয় তিস্তাও ভীষন কৃতজ্ঞ, বারে বারে সেটা বোঝানোর চেস্টা করেছে আমাদেরকে। নতুন করে একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়ায় মা বাবারাও খুব খুশী। ওদের তিন জনের এত বন্ধুত্বের কথা শুনে মা বলেছে শুধু তিস্তা নয়, চাইলে মৌলী আর চয়নিকাও আমাদের এখানে থেকে পড়াশোনা করতে পারে...ছেলে বাড়ীতে থাকবে না...মা নাকি তিন মেয়েকে নিয়ে বেশ থাকবে। আমি কথাটা শুনে যথারীতি মাকে বলেছি... আমি বাড়ী ফিরলে তোমার মেয়েরা আবার তাড়িয়ে দেবে না তো? তিস্তা ভেংচি কেটে বলেছে... তাড়ানোর তো প্রশ্নই উঠছে না কারন ঢুকতেই তো দেবো না...
______________________________
আমি যে নিঃস্ব হতে চাই #
বম্মা আর দাদাই নেই, আজ বাড়ীতে শুধু আমি আর আমার বিচ্ছুটা আছি…মনটা সকাল থেকেই উড়ু উড়ু, কি যেন একটা পেতে ইচ্ছে করছে আজ। বাথরুম নাকি মেয়েদের একান্ত নিজস্ব জায়গা যেখানে নিজের সাথে মন প্রান খুলে কথা বলা যায়…আজ নিজেকে দিয়ে তার প্রমান পেলাম…ঠান্ডা জলে নিজেকে ভিজিয়ে নিতে নিতে ভাবছিলাম…যা চাইছি সেটা কি ঠিক? বুকের ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল…কেন ঠিক নয়? মন বললো আমি কোনো কিছু মানি না…আমার মনে হয়েছে এটাই ঠিক…আর কতদিন অপেক্ষা করবো? বোঝাতে পারলাম না ওকে…মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি করার আছে…চোখ বুজে নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে করতে ইচ্ছে হল নিজেকে একবার দেখার…আয়নায় মধ্যে নিজের নগ্নতায় নিজেই লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকলাম…যেন এই প্রথম নিজেকে দেখছি…মসৃন ত্বকের গা বেয়ে জলের ধারা পিছলে নেবে যেতে যেতে যেন আমাকে বলে যাচ্ছে…নিজেকে উজ়াড় করে দেবার সময় তো হল…আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছিস…মনে হল…আজ যাকে দেখছি সে আমি নই …অন্য কেউ…আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম…ইস…কি ভীষন লজ্জা করবে যখন ও আমাকে দেখবে…আমাকে ছোঁবে…ভেজা চুল বুকের উপরে ফেলে ঢেকে দিয়ে বললাম…এখন থেকে তোমরা আর তিস্তার নয়…অন্য কেউ আসার সময় হয়েছে যেই শুধু তোমাদেরকে দেখবে…ছোঁবে…আদর করবে…মনে হল ওরা আড়ালে থাকতে রাজী নয় …চুলের ফাঁক দিয়ে নিজেদের ঔদ্ধত্ব আর সৌন্দর্য প্রকাশ করতে করতে যেন বলল আমায়…তুমি কি জানতে না যে আমরা তোমার নই... অন্য কারুর…এত দিন বোকার মতো আমাদেরকে নিজের ভেবে খুশী হয়েছো…বোকা মেয়ে কোথাকার। পাহাড় চুড়ায় বসে থাকা ছোট্ট বিচ্ছু দুটো যেন আরো দুষ্টু…কাঠবেড়ালীর মতো টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে যেন বোঝাতে চাইছে তারা এভারেষ্ট জয় করে ফেলেছে…দুটোকেই খুব করে বকুনি দিলাম…খুব মজা তাই না…ওর কথা ভাবছি দেখেই লাফিয়ে উঠেছো? আমাকে পাত্তাই দিলো না। ইস, বয়ে গেল আমার…দুষ্টুটার হাতে যখন পড়বে তখন বুঝবে তোমরা…কুট কুট করে ও যখন কামড়াবে, সব অহ্নকার তখন উধাও হয়ে যাবে। আমার মনের কথা কি করে ওরা বুঝলো কে জানে… আমাকে যেন বলতে চাইলো কি বোকা গো তুমি? তুমি কি বোঝো না…কি ভালো লাগবে তোমার ও যখন আমাদেরকে আলতো করে কামড়াবে…দেখবে, তুমি কেমন শিউরে শিউরে উঠবে তখন। চুল দিয়ে না হয় ওদেরকে আড়াল করলাম…তা সে যতই উঁকি দিক না কেন…আরো তো একজন আছে তাকে কিভাবে আড়াল করি? সে তো আরো দুষ্টু…মাঝে মাঝেই খুব জ্বালাতন করে মারে…কাকে যেন ওর চাই বলে আমার পেছনে লাগে। ওকেও বলে দি…তুমি যখন আমার নয়…একেবারে আমাকে জ্বালাবে না আর…দেখি তো কি করছে ভেবে তাকালাম……যা ভেবেছি তাই…ছিঃ ছিঃ একটুও লজ্জা নেই...নিঃর্লজ্জের মতো নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা না করে দেখানোর ইচ্ছে নিয়ে নিজের সগর্ব উপস্থিতি ঘোষনা করছে…লজ্জা নেই তো কি হয়েছে রুপ যেন ফেটে পড়ছে...নিজে মেয়ে হয়েও ওর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হতে বললাম…এই যে, দুষ্টু…তুমি কি জানো…তুমি কার? তুমি এতদিন যার কথা ভাবতে সে আসছে…তুমি তৈরী তো তাকে সাদরে আহ্বান জানাতে…পারবে তো তোমার উষ্ণ কোমল আলিঙ্গনে আটকে রেখে তাকে খুশী করতে, যাতে সে বারে বারে তোমার কাছে ফিরে আসে। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে খুব অহঙ্কারের সাথে জানালো…সময় হলেই দেখতে পাবে।
ঠোঁট দুটো বলে উঠল তুমি কি ভাবছো আমরা তোমার? মোটেও না…সাথে সাথে বাকি সবাইও এক সাথে বলে উঠল…আমরা কেউ তোমার নই…ওদেরকে বকুনি দিলাম… চুপ ক’র সবাই…আমি নিজেই যখন ওর তাহলে কি আর আমার বলে কিছু থাকলো? আমার সাথে সাথে তোমার সবাইও ওর…সবাই যেন বলে উঠল…ঠিকই তো…কিন্তু তুমি তো এখোনো বলে উঠতে পারলে না…যে তুমি ওকে কিছু দিতে চাও…কিছু পেতে চাও ওর কাছ থেকে। ওদেরকে বললাম…আমাকে তো দিতেই হবে…আমি যে আমার সব কিছু ওকে উজাড় করে দিয়ে নিঃস্ব হতে চাই…
প্রথম রাত #
সকাল থেকেই ছিল আকাশ জ়োড়া ঘন কালো মেঘের আনাগোনা, দুপুর থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি, সাথে দমকা হাওয়া। বিকেল হয়ে গেল তবু থামার নাম নেই...অবশ্য থামার কথাও নয়। বঙ্গোপোসাগরে গভীর নিম্নচাপ ঘনীভুত হয়েছে…টিভিতে বার বার ঘোষনা করছে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার লোকজন যেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়, গভীর সমুদ্রে থাকা নিরাপদ নয়। বাড়ীতে শুধু আমি আর তিস্তা, মা-কে নিয়ে বাবা কল্যানীতে এক অফিস কলিগ বোস কাকুর বাড়ীতে গেছে আজ সকালে, ফিরবে কাল বিকেলে। বোস কাকুর মেয়ে তানা-দির বিয়ের পাকা দেখার জন্য ছেলের বাড়ি থেকে আসবে আজ। আমারও যাবার কথা ছিল কিন্তু তিস্তা থাকায় আমার যাওয়া হয়নি। মা ভোর রাতে উঠে রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু তিস্তা মাকে জড়িয়ে ধরে বায়না করে বলেছে…ও করে নেবে। মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। দুজনে মিলে রান্না করেছি…আমি মোটামুটি কাজ চালানোর মতো রান্না জানতাম…এর ভেতরে ও আরো কিছু শিখেছে, তাই আর খুব একটা অসুবিধা হয়নি তবে মাত্র সাত বার ও মায়ের মোবাইলে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে এটা কি করবো, ওটা কি করবো গো বম্মা আর আমি তাই নিয়ে ওর পেছনে লাগতে গিয়ে তাড়া খেয়েছি... ও খুন্তি হাতে আমাকে তাড়া করে এলে মিথ্যে ভয় পাওয়ার ভান করে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছি মায়ের ঘরের ওয়ার্ড্রোবের পেছনে। ও আমাকে খুঁজেছে সারা ঘরে, পায়নি। বারে বারে ডেকেছে, আমি সাড়া দিইনি...তারপরেই ও অভিমানে প্রায় কেঁদে ফেলছে দেখে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এলাম। ও দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে আর আমি ওর সামনে হাসি মুখে বলেছি ওদিকে যে সব পুড়ে গেল, কি খাবো আমরা...ও অভিমান ভরা গলায় বলেছে... যাক পুড়ে সব, তোমাকে ওই খাওয়াবো আজ। আমি ওর মুখ তুলে ধরে জিজ্ঞেস করেছি...আমি তো না হয় পোড়া খাবো...তুমি কি খাবে? ও আস্তে করে বলেছে...তুমি পোড়া খেলে আমাকেও তাই খেতে হবে... তারপরেও আমার অভিমানিনীর মান ভাঙ্গাতে আমাকে আদর করতে হয়েছে, অনেক চুমু দিতে হয়েছে...
দুপুরে খেতে বসে খুব মজা করেছি…কোনোটায় নুন কম তো কোনোটায় ঝাল বেশী। ও বায়না করেছিল আজ ও আমার হাতে ছাড়া খাবেই না…ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে পাশাপাশি বসে খাচ্ছিলাম…ওকে খাইয়ে দিতে গেলে মাঝে মাঝেই আমার আঙ্গুল মুখে নিয়ে চুষেছে, ক খোনো বা কুট কুট করে কামড়ে দিয়েছে…’উঃ লাগছে তো’ বললে শুনতে হয়েছে... এই টুকুতেই উঃ করে উঠছো? আরো কতো জ্বালাবো তার ঠিক আছে নাকি…এখোনো তো সারা জীবনটা পড়ে আছে সামনে…পারবে তো আমাকে নিয়ে সংসার করতে?
ইচ্ছে ছিল দুপুরে ওকে খুব করে আদর করবো কিন্তু বিধি বাম থাকলে যা হয়। এই বিচ্ছিরি ওয়েদারের ভেতরেও আমাদের কাজের মাসী এসে হাজির। এমনিতে যখন তখন কামাই করে কিন্তু আজ যে কেন ওর এত ভালো সার্ভিস বুঝলাম না। নিজে তো এসেছে আবার সাথে করে বাচ্চাটাকেও নিয়ে এসেছে। সারা বাড়ি ঝাঁট দেবে, মুছবে, বাসন ধোবে...মাথা গরম হয়ে গেলেও কিছু বলতে পারলাম না। তিস্তা বোধহয় আমার মনের কথা বুঝে গিয়েছিল... আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচে দিয়ে চলে গেল টিভি দেখতে। কি আর করবো...নিজের ঘরে গিয়ে গিটারটা নিয়ে বসলাম। কাজ হয়ে গেলেও মাসীকে অপেক্ষা করতে বলতে হল...বৃষ্টির জোর বেড়েছে। একটু না কমলে বাচ্চা নিয়ে বেরোতে দেওয়া ঠিক হবে না।
সন্ধে সাতটা প্রায় বাজে। বসার ঘরে সোফাতে বসে টিভি দেখছি, তিস্তা আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে …ওর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে দেখলাম টিভি দেখছে না, চোখ বুজে কিছু ভাবছে হয়তো দেখে ওকে ডাকলাম…
- এই…তিস্তা…
আমার ডাকে ও সাড়া দিলো কিন্তু কি বললো বুঝলাম না। মুখ নিচু করে বললাম…কিছু ভাবছো?
- হুঁ…
- কি…
- আজ আমরা ছাড়া আর কেউ নেই বাড়ীতে…
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম...কি হয়েছে তাতে…তোমার কি ভয় করছে নাকি?
- নাঃ…ভয় করবে কেন…
- তাহলে?
ও পাশ ফিরে সোজা হয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকালো… হাত বাড়িয়ে আমার গালে আলতো ভাবে আঙ্গুল ছুঁইয়ে রেখে বলল…তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখানে…
- হু...তা নেই...
- বাইরে ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে…
- হচ্ছে...
- রজনীগন্ধার গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে আছে…
- আছে...
- কি রোমান্টিক …তাই না…
ওর আবেগ ভরা কথা গুলো শুনে মনে হল ও কিছু বলতে চাইছে এই কথা গুলোর ভেতর দিয়ে...চুপ করে ভাবছিলাম…কি বলতে চাইছে…হঠাৎই যেন বুঝতে পারলাম ও কি চাইছে… ভাবছিলাম…ইস…আমি সত্যিই একটা আস্ত বুদ্ধুরাম…আমারই ওকে বলা উচিত ছিল আজ…ওর হাতের উপরে হাত রেখে আমার গালে ওর আঙ্গুল চেপে ধরে বললাম…একটু ওঠো না…
- কেন…
- না উঠলে বলবো কিভাবে…
ইচ্ছে না থাকলেও ও উঠে আমার পাশে বসলো…আমি সোফা থেকে নেমে ওর পায়ের কাছে হাঁটুতে ভর বসে দুহাত দিয়ে ওর ডান হাতের আঙ্গুল ধরে মুখ নিচু করে চুমু খেয়ে মুখ তুলে তাকালাম... ও আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে...ওর টানা টানা কাজল কালো চোখে স্বপ্নের আবেশ...অনুনয়ের স্বরে বললাম…রাজকুমারী…এই অধমের কিছু আর্জি আছে…পেশ করার অনুমতি চাই…
আমাকে ওইভাবে অভিনয় করতে দেখে ও ফিক করে হেসে ফেলল…তারপরে মুখ গম্ভির করে বলল…অনুমতি দিলাম…
- রাজকুমারী…যদি সম্ভব হয় আজ রাতে কি এই অধম তার প্রেয়সীকে কি খুব কাছে পেতে পারে?
- বুঝলাম না…কাছে বলতে ঠিক কি বলতে চাওয়া হচ্ছে…
- কাছে মানে... ওই আর কি…
ও আমার দুচোখে কিছু যেন খোঁজার চেস্টা করে বলল...হুম…বুঝেছি…শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে...
- কি শর্ত রাজকুমারী?
- প্রথমত…বাগান থেকে টাটকা রজনীগন্ধা তুলে নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত…তোমার প্রেয়সীর এখন সেফ পিরিয়ড চলছে না…তার ব্যাবস্থা করতে হবে...
যথা আজ্ঞা রাজকুমারী …বলে আমি আবার ওর হাতে চুমু খেয়ে উঠে এসে ওর পাশে বসতেই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল…তুমি একটা পাজী…দুষ্টু…শয়তান…
- উমমম...কেন...আমি আবার কি করলাম...
- ইস...কি করলাম...আমাকেই সব কিছু বলতে হবে আগে?
ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললাম…তুমি যদি কিছু মনে কর, ভেবে আর বলতে পারি না। ও আমার বুকের এক দিকে মাথা রেখে আর একদিকে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল…তুমি কিছু চাইলে আমি কি না করতে পারি? আমি তো চাই তুমি নিজের থেকে আমাকে বলো আমার কাছে তুমি কি চাও। মুখ নিচু করে মৃদু স্বরে বললাম…মাঝে মাঝে আমার খুব ভয় করে তিস্তা, আমার কোনো ভুলের জন্য তুমি যদি দূরে চলে যাও। ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো…তোমার ভালোবাসা দিয়ে পারবে না আমাকে দূর থেকে ফিরিয়ে আনতে? ওকে বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বললাম…পারবো। তারপর কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে ছিলাম। ও আমার বুকের উপর থেকে মাথা তুলে কাঁধে উপরে রেখে বলল…এই…আমার না খুব ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে আজ। খাওয়াবে? কেমন যেন একটা ঘোরের ভেতরে ছিলাম ওকে আজ রাতে একান্ত ভাবে পাবো ভাবতে ভাবতে...তার ভেতরে ওর ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছের কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল…কোথায় আমি ভাবছি…আমাদের জীবনের প্রথম রাত কিভাবে স্মরনীয় করে রাখা যায় আর ওর এখন ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে…হাসি চেপে বললাম…যথা আজ্ঞা রাজকুমারী…
বাপি বেরিয়ে গেছে সেই কোন সকালে, আমার রিজ সোনা ঘুমোচ্ছে দেখে আর ডাকিনি। চুপ করে বসে কাল রাতের কথা ভাবছি। ইস, কি ভালো লাগছিল ওর বুকের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে রেখে ফিসফিস করে ওর সাথে কথা বলে যেতে। বুকের ভেতরে যে এত কথা জমে ছিল নিজেও কি জানতাম না নাকি। ওর ওই কথাটা বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে...তিস্তা, আর আমার কোনো ভয় নেই তোমাকে হারানোর। আমি ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলাম...জানি তো। ও একটু চুপ করে থেকে বলেছিল...কি ভাবে? আমাদের কত মান অভিমান হয়েছে তবুও কি তুমি পেরেছো আমার সাথে কথা না বলে থাকতে? আমার প্রশ্নের ভেতরে থাকা উত্তরটা শুনে ও বলেছিল...আমি কি একা...তোমার সব কথা তো আমি রাখিনি... তুমিও তো পারোনি অভিমান করে থাকতে...আমার থেকে দুরে সরে যেতে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে খুব ইচ্ছে করলো ওকে একবার দেখে আসি...ওর ঘুমের যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য ভোরে উঠে গিয়ে জানলা দরজার পর্দা ভালো করে টেনে দিয়ে এসেছিলাম...বাইরে ঝকঝকে রদ্দুর থাকলেও ওর ঘরে এখোনো আলোছায়ার খেলা। ও পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে, জেগে থাকলে যে মুখে দুষ্টুমি ভরা থাকে সেখানে এখন নিস্পাপ শিশুর সরলতা...মুগ্ধ দৃষ্টিতে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা...দীঘায় ওকে ডেকে আনতে গিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু পাওয়ার আশায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম...সম্বিত ফিরে এসেছিল যখন আমি ওর দুহাতের বাঁধনে। আজও আবার সেইভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে...ঘুমের ভেতরেই ওর মুখে এক চিলতে হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলাম...তাহলে কি ও জেগে আছে...দুষ্টুমি করে ঘুমের ভান করে থেকে দেখতে চাইছে আমি কি করি? আচ্ছা, আমিও কম যাই না...তুমি যদি ভেবে থাকো আমাকে বোকা বানাবে...সে গুড়ে বালি...ভাবতে ভাবতে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি ও কি করে দেখার জন্য। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেল...ওর মুখের এক চিলতে হাসি এখন আর নেই...হাতড়ে হাতড়ে কি যেন খোঁজার চেস্টা করছে। বুঝলাম, ও ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখছে...নিশ্চয় আমাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছে। তাই হবে, ও তো মাঝে মাঝেই বলে...জানো তিস্তা, আজ আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম...খুব দুষ্টুমি করছিলে আমার সাথে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভীষন ভালো লাগলো...থাক, ওকে এখন আর ডাকবো না...আমাকে নিয়ে স্বপ্নে কি কি করছে কে জানে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম রাতের আরো একটা কথা মনে পড়ে গেলে...আমার ইচ্ছেতেই ও চেয়েছিল আরো কিছুটা কাছে আসতে...এই প্রথম ও আমার বুকে হাত রেখেছিল নিজের থেকে কিন্তু একবারের জন্যও ও নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি। সত্যিই অদ্ভুত একটা ছেলে, জানি না কি করে একটা ছেলে কোনো মেয়ের বুকে হাত দেবার সুযোগ পেলে এইভাবে নিজেকে আটকে রাখতে পারে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বন্ধুদের কাছে যা যা শুনেছি ছেলেদের ব্যাপারে এতদিন, সব কিছুই যেন ও মিথ্যে প্রমান করে দিল...ভাবতেই শিউরে উঠছি, ও কেমন ভাবে আলতো ভাবে আমাকে ছুঁয়ে থেকে ফিস ফিস করে বলেছিল...তিস্তা তুমি কি স্বর্গের দেবী? এতো সুন্দর! এত নিঁখুত! এত মসৃন! ওর আমাকে ছুঁয়ে থাকা দেখে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন কোনো শিল্পী তাঁর সৃষ্টিকে পরম মমতায় ছুঁয়ে থেকে নিজেই অনুভব করছেন তিনি কি সৃষ্টি করেছেন। ও আমাকে ছোঁয়ার আগে হয়তো চেয়েছিলাম নিজেকে বিলিয়ে দিতে কিন্তু ওর আমাকে ওইভাবে অনুভব করতে দেখে শরিরের কামনা বাসনা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে এক অপার্থিব সুখে ভেসে যাচ্ছিলাম ওর সাথে সাথে। আরো একবার মন প্রান দিয়ে ওর ভালোবাসা অনুভব করতে করতে ফিসফিস করে বলেছিলাম...আমাকে তো ঈশ্বর তোমার জন্যই নিজের হাতে গড়েছেন। বাইরের ঘরের ঘড়ির আওয়াজে ঘোরের ভেতর থেকে ফিরে এলাম, বুঝলাম সকাল ন টা বাজল। নাঃ, ওর জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসে ডেকে তুলি,অনেক কাজ পড়ে আছে...ভেবে ফিরে এলাম।
আমাকে একবারে ওর কাছ ঘেঁষে বসতে দেখে ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল...বাপি কই? ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে বললাম...বাপি নেই,বেরিয়ে গেছে...এখন শুধু তুমি আর আমি। আবার আমাকে এত কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিল দেখে আদুরে গলায় বললাম...এই রিজ, তুমি তো এত লোভী ছিলে না আগে। ও আমাকে আদর করতে করতে বলল...একটু আগে খুব দুষ্টুমি করছিলে আমার সাথে...খালি দৌড়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলে...কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না তোমাকে। ইস, পালাচ্ছিলাম না ছাই...এই তো তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম বলাতে আস্তে করে বলল...তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম। কথাটা শুনে ওকে আরো বেশী করে বুকে চেপে ধরে চোখ বুজে ভাবছিলাম...জানি তো...আমার বিচ্ছু আমাকে ছাড়া তো আর কিছু ভাবতেই পারে না।
সাড়ে এগারোটা মতো বাজে, আমি রান্নাঘরে ব্যাস্ত। ওকে একটা গল্পের বই দিয়ে এসেছি সময় কাটাবার জন্য। যতক্ষন রান্নার দিদি আসেনি আমাকে কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইছিল না, রান্নার দিদি এসে যাবার পর আর জোর করেনি। বাইরের বেলটা বেজে উঠলে ভাবলাম বাপি ফিরে এসেছে। দরজা খুলে দেখি বাপি নয়, আমার সবথেকে কাছের দুই বন্ধু চয়নিকা আর মৌলী। কাল আমি চলে যাবো জানতো, তাই ওরা চলে এসেছে দেখা করতে। আমাকে দেখতে পেয়ে দুজনেই খুব হইচই করে আমাকে ঠেলে নিজেরাই ঢুকে পড়ল ভেতরে। ওরা যে হঠাৎ আমাকে না জানিয়ে চলে আসবে ভাবতেই পারিনি, তার জন্য হয়তো একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মেয়েদের চোখ যে কি জিনিষ তা কি আর আমি বুঝি না? কোনো কিছুই হয়তো এড়িয়ে যায় না। চয়নিকা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে বলল... কি রে তিস্তা...তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমরা এসেছি বলে তোর ভালো লাগছে না? মৌলী পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বলল... উঁ হুঁ... মনে হচ্ছে অন্য কেস। কিছু একটা চাপা দিতে চাইছে। ততক্ষনে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি... আমিও কম যাই না, হেসে ফেলে বললাম... তোদের আর আমার পেছনে লাগা ছাড়া কাজ নেই নাকি?
তিনজনে মিলে খুব হইচই করছি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে। ওর দেওয়া জিন্সটা দেখে চয়ি মৌলীর কানে কানে কিছু বললে আমি ইচ্ছে করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে কান খাড়া করে রেখেছি ওরা এরপরে কি বলে শোনার জন্য। মৌলীর সোজাসুজি প্রশ্ন...এই তিস্তা, তুই তো এই জিন্সটা দেখাস নি আমাদেরকে...কবে কিনলি? যুৎসই একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, কি করে জানবো বিচ্ছুটা উঠে চলে আসবে আমার ঘরে... হঠাৎ মুখ তুলে ওকে দরজার সামনে দেখে থতমত খেয়ে গেলাম... এখুনি হয়তো কৈফিয়ত দিতে হবে ও কে...যা করার এখুনি করতে হবে ভেবে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম...কিছু লাগবে মামা? আমার মুখে মামা ডাক শুনে ও হয়তো ভেতরে ভেতরে চমকে গেল, বুদ্ধিমান ছেলে বলে কি ভাবছে বুঝতে না দিয়ে বলল...আর একবার চা পেলে ভালো হোতো। আচ্ছা যাও, আমি দিয়ে আসছি বলাতে ও ফিরে গেল। চয়ি আর মৌলী নিজেদের ভেতরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল দেখে আমি নিজের থেকে কিছু না বলে উঠে গেলাম রান্না ঘরের দিকে। দিদিকে চা বানাবার কথা বলে ফিরে আসতেই শুরু হয়ে গেল ওদের সাঁড়াসী আক্রমন। ওরাও ছাড়বে না আর আমিও হার মানবো না। ছেলেটা কে, কোত্থেকে এলো, সত্যি যদি তোর যে মামা হয় তো আগে বলিস নি কেন... কত যে প্রশ্ন ওদের কে জানে। বেশ কিছুক্ষন টানা হেঁচড়ার পর ওরা হার মেনে নিলেও মনে হোলো না খুব একটা বিশ্বাস করেছে আমাকে। তারপরেই কি মনে হল কে জানে, আর যেন পারছিলাম না আমার এতো খুশী আমার এতো কাছের বন্ধুদেরকে না জানিয়ে থাকতে। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর নিজের থেকেই ওদেরকে বললাম...এই শোন না...রাগ করবি না কিন্তু তোরা, একটা কথা বলছি...
ওরা দুজনে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে... আমি ওদেরকে একটু একটু করে বলছি আমার বিচ্ছুর কথা। ওদেরকে বলতে পেরে ভীষন হাল্কা লাগছে নিজেকে...মুখ নীচু করে বসে আছি। হঠাৎ ওদের হইচই শুনে মুখ তুলে তাকালাম... এখুনি ওদের সাথে আমার বিচ্ছুর আলাপ করিয়ে দিতে হবে। কি হোলো কে জানে আমার, সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেল হঠাৎ...লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠল...আস্তে করে বললাম...তোরা নিজেরাই যা না... ও খুব মিশুকে...
পাশের ঘর থেকে ওদের তিনজনের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। বিচ্ছুটা এইটুকু সময়ের ভেতরেই জমিয়ে ফেলেছে ওদের সাথে। আমাকে ওখানে পেলে ওরা পেছনে লাগতে ছাড়বে না ভেবে আমি কাজ আছে বলে এড়িয়ে গেছি, অবশ্য এড়িয়ে গেছি বলাটা মনে হয় ঠিক হবেনা...কিছুটা সময় আমি নিজের ভেতরে থাকতে চাইছিলাম...মাঝে একবার চয়ি আমাকে ডাকতে এসে জড়িয়ে ধরে বলেছে...এই তিস্তা, এ তো একেবারে লেডি কিলার টাইপের ছেলে রে...কি সুন্দর কথা বলতে পারে...সাবধানে রাখিস কিন্তু, ফুড়ুৎ না হয়ে যায়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসেছি আর নিজের মনে মনে বলেছি...তোরা ওকে বুঝবি না রে... একমাত্র আমিই বুঝি ওকে।
দুপুরে আর ওদেরকে বাড়ী ফিরতে দিই নি, বাপি দুপুরে ফিরে খেয়ে নিয়েই আবার বেরিয়ে যাওয়াতে আমরা যেন বাঁধন ছেঁড়া হয়ে উঠেছি...সবাই মিলে গল্প হাসি ঠাট্টা খুনসুটি কি না করেছি... চয়ী খুব করে ধরেছিল আমাদের দুজনের অন্তরঙ্গ একটা ছবি তুলে রাখবে মোবাইলে। আমি রাজী হইনি... বলেছি...না রে এখন থাক... তোরা দুজনে ছাড়া আর কেউ এখন জানলে অসুবিধা আছে...
______________________________
বিদায় #
কোলকাতা পৌছোলাম আমরা একই ফ্লাইটে, আমরা মানে বাপি, আমার উনি আর আমি। আমার জীবনের প্রথম আকাশ যাত্রা, কিছুই বুঝলাম না, এত তাড়াতাড়ি বাগডোগরা থেকে কোলকাতা পৌঁছে গেলাম যে বুঝতেই পারলাম না ঠিক কেমন লাগল। ভাবতেই পারছি না যে রাস্তা আসতে সারা রাত ট্রেনে কাটাতে হয় সেই রাস্তা যেন নিমেষে পৌঁছে গেলাম। বাপির সময় হবে না বম্মাদের ওখানে যাওয়ার, এখান থেকেই দিল্লী চলে যাবে, আমি থেকে যাবো আমার বিচ্ছুর কাছে। এত সময় ঠিক ছিল...খুব একটা কিছু মনে হয়নি। বাপির ফ্লাইটের সময় যত এগিয়ে আসছে তত যেন কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এর আগে কোনোদিন বাপিকে ছেড়ে থাকিনি। আমার বিচ্ছুর কাছে থাকতে পারার খুশী ছাপিয়ে গিয়ে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বাপিকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে ফেলেছি। বাপি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে সান্তনা দেবার চেস্টা করতে গিয়ে নিজের চোখ জলে ভরিয়ে ফেলেছে। তারপর নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছি...যতই খারাপ লাগুক না কেন আমাকে তো একদিন না একদিন বাপিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে...আমি এত কান্নাকাটি করলে তো বাপির আরো মন খারাপ হবে। আমার তো উচিত বাপিকে খুশী মনে বিদায় দেওয়া। নিজের কথা না ভেবে কান্না ভেজা চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম...ইস, বাপি তুমি কাঁদছো। ধ্যাত...সবাই কি ভাববে। নিজের হাতে ওড়না দিয়ে বাপির চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। চুমু দিলাম বাপির গালে। সাবধানে যেও...রোজ একবার করে ফোন করবো...আমার জন্য চিন্তা করবে না...আমি তো বম্মাদের কাছে আছি বলে বাপিকে সান্তনা দিলে বাপি আমাকে জড়িয়ে ধরে থেকে বলল...জানি, তাই তো আমার আর তোর জন্য কোনো চিন্তা নেই। আমার বিচ্ছু অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ও চায়নি আমাদের বাবা মেয়ের একেবারে আলাদা জগতে ঢুকে কোনোরকম অস্বস্তিতে ফেলতে। ওর এই ব্যাপারটা আমার সত্যিই ভীষন ভালো লাগে। আমারও যে একটা নিজস্ব জগৎ আছে সেটা ওকে মনে করিয়ে দিতে হয় না।
বাপিকে যেতে হবে এবারে। শেষ বারের মতো বাপি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বলল... বাবাই এর সাথে ঝগড়া করবি না কিন্তু। আমি মনে মনে বাপিকে বললাম...বাপি, তোমরা যেটা দেখতে পাও সেটা তো সত্যি নয়... তোমাকে তো এখোনো বলতে পারিনি আমি যে এখন আমার নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসি ওকে। তোমরা যেটা দেখতে পাও না সেটা ঠিক কি তা শুধু আমরা দুজনেই জানি। মনে মনে এই কথা গুলো বলে ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম ইস, বিচ্ছুটা আমার পেছনে লাগলে আমি ছেড়ে দেব নাকি? বাপি আমার পিঠ চাপড়ে হেসে ফেলে বলল...পাগলী মেয়ে আমার। আরো দু একটা কথা বলে বাপিকে ভেতরে চলে যেতে হল, দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাপিকে বারে বারে পেছন ফিরে তাকাতে দেখে আমার দুচোখ আবার জলে ভরে উঠল। হাত নেড়ে বাপিকে টাটা করতে করতে ইচ্চে করছিল দৌড়ে গিয়ে বাপিকে একবার ছুঁয়ে আসি। বাপি চোখের আড়ালে চলে গেছে...ইচ্ছেটা নিজের ভেতরেই আটকে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, চোখের জলে গাল ভিজে যাচ্ছে একটু একটু করে। ও আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিলে ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললাম। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে...আস্তে আস্তে আমার কান্না থেমে গেলেও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিলাম। আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, আমি অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছি...মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আস্তে করে বললাম...চলো...ফেরার সময় ট্যাক্সিতে ওর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে ছিলাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে থেকে আমার মতোই চুপ করে ছিল। ও জানতো আমার কথা বলতে ভালো লাগবে না এখন, তাই ও চায়নি জোর করতে।
আমার নতুন বান্ধবী #
সামনেই একটা সেমিস্টার থাকায় তিস্তাকে বেশী সময় দিতে পারছিলাম না। অবশ্য কারনটা জানা থাকায় ও নিজের থেকেই আমার কাছে বেশী আসে না। উল্টে আমি যদি ওকে কখোনো কাছে পেতে চাই তো ও বলে যে...উঁ হুঁ...এখন নয়...আগে পড়া তারপরে প্রেম। মায়ের আদরের মেয়ে তার বম্মার সাথেই বেশী সময় কাটায়...খুব নাকি মন দিয়ে রান্না শিখছে ভবিষ্যতে ওর হাসব্যান্ডকে খাওয়াবে বলে...ওর বম্মা তাই জানে কিন্তু ওর সেই ভবিষ্যতের হাসব্যান্ড যে নিজের ছেলে সেটা এখোনো জানে না। একেবারেই যে চিন্তা হয় না তা নয় তবু নানা রকম ভাবে নিজেকে বুঝিয়েছি সময় হলে কিভাবে মা বাবাকে জানাবো যে আমি আর তিস্তা বিয়ে করতে চাই। ব্যাপারটা যে খুব সোজা হবে তা নয় কিন্তু কিভাবে এগোলে ভালো হবে সেটা নিয়ে নানা রকম রাস্তা ভেবে রেখেছি। তিস্তাকে এই নিয়ে কিছু বলিনা কারন ওর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি খুব টেনশান করে। মাঝে মাঝে ওর সেই দুই বান্ধবী চয়ী আর মৌলীর সাথে আমাকেও কথা বলতে হয় ওর মোবাইলে... প্রথম প্রথম আমার থেকে ওদের উৎসাহটাই বেশী ছিল আমার সাথে কথা বলার। ওদের দুজনের সাথেই বেশ একটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে এই কদিনে। মেয়ে দুটো আর যাই হোক না কেন তিস্তাকে সত্যিই ভীষন ভালোবাসে, যাকে বলে একেবারে প্রানের বন্ধু। তাই হয়তো আমার কাছে ওদের প্রত্যাশাটা অনেক অনেক বেশী। যাই ঘটুক না কেন আমি যেন কোনো অবস্থাতেই তিস্তার পাশ থেকে সরে না যাই...এটাই চায় ওরা মন প্রান দিয়ে, শুধু তাই নয়, আমাকে মাঝে মাঝে বলেও ফেলে। তিস্তাকে কথায় কথায় জানিয়েছি ওদের মনোভাব। যদিও আমার বা তিস্তার কারুরই আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো দ্বিধা ছিল না তবুও ভালো লেগেছিল এই ভেবে যে আমাদের জন্য আরো কেউ আছে ভাবার। যারা নিঃস্বার্থ ভাবে চায় আমরা এক হই।
আজ আমার পরীক্ষা শেষ। বাড়ী ফিরে বিকেলে মা আর তিস্তাকে নিয়ে বেরোনোর কথা, গড়িয়াহাটে কেনাকাটা করতে যাবে। ক্লাস থেকে বেরোনোর আগে কলেজের অফিস থেকে খবর পাঠালো বাড়ী থেকে মায়ের ফোন এসেছিল কিছুক্ষন আগে, আমি যেন এখুনি ফোন করি। মা তো এর আগে কোনোদিন এইভাবে কলেজে ফোন করেনি, কি এমন হয়েছে ভাবতে ভাবতে এক বন্ধুর মোবাইল নিয়ে বাড়ীতে ফোন করলাম। যা শুনলাম তা মোটেও ভালো খবর নয়...মৌলীর বাবা কোলকাতা এসেছিলেন অফিসের কাজে, বাস থেকে নামতে গিয়ে পেছন থেকে একটা গাড়ীর ধাক্কা খেয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। খুব কপাল ভালো পুলিশ সময়মতো হসপিটালে ভর্তি করেছে। তিস্তা এই মুহুর্তে এখানে থাকায় আর কোলকাতায় ওদের চেনা জানা তেমন কেউ না থাকায় মৌলী ওকেই ফোন করেছে খবর পেয়ে। খবরটা শুনেই তাড়াতাড়ি এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে ওর বাইকে হসপিটালের দিকে দৌড়োলাম। মাকে বলে দিয়েছি তিস্তাকে নিয়ে চলে আসতে তাই আর আমার বাড়ী যাবার দরকার ছিল না। হসপিটালে পৌঁছে দেখলাম নিজের কেউ কাছে না থাকায় যা হবার তাই হয়েছে, ট্রিটমেন্টের তেমন কিছু তখোনো শুরু হয়নি। আইসিইউতে দেবার ব্যাবস্থা করতে গিয়ে টাকার জন্য বাবার সাহায্য নিতে হল। ওদিক থেকে মায়ের সাথে তিস্তাও পৌঁছে গেছে ততক্ষনে। তিস্তাকে দিয়ে মৌলীর মাকে ফোন করালাম, চিন্তা করার দরকার নেই..আমরা সামলে নিচ্ছি।
বাইরে অপেক্ষা করছি, ডাক্তারবাবু বেরোলে কথা বলে জানতে হবে পেশেন্টের অবস্থা ঠিক কিরকম। তিস্তা মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে আছে। মাঝে মাঝে চোখের জল মুছতে দেখে মা ওকে বোঝাবার চেস্টা করছে। বেশ কিছুক্ষন পর ডাক্তারবাবু বেরোলে কথা বলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল... প্রানের ভয় নেই তবে হাত পায়ের হাড় ভেঙ্গেছে। খবরটা পাওয়ার পর আবার মৌলীদেরকে জানালে ওরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল, ওর মা আমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবেন বুঝতেই পারছিলেন না। বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে এসেছিলেন, তিস্তা আর মাকে নিয়ে বাড়ী ফিরে গেছেন। আমাকে রাতে থেকে যেতে হল হসপিটালে, যোগাযোগ রাখার জন্য মায়ের মোবাইলটা আমার কাছে থাকছে। দুদিন পর মেজর অপারেশন, হাতে পায়ে প্লেট বসাতে হবে। মৌলী পরের দিন সকালে এসে গেল, সাথে ওর মা আর ভাই। আমাদের বাড়ীতেই থাকবেন ওনারা যতদিন প্রয়োজন।
অপারেশন ভালো ভাবেই হয়েছে। মৌলীর বাবা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছেন তবে আরো কিছুদিন সময় লাগবে ছাড়া পেতে। আমাদের দিক থেকে এতটা সাহায্য পেয়ে শুধু মৌলীরা নয় তিস্তাও ভীষন কৃতজ্ঞ, বারে বারে সেটা বোঝানোর চেস্টা করেছে আমাদেরকে। নতুন করে একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়ায় মা বাবারাও খুব খুশী। ওদের তিন জনের এত বন্ধুত্বের কথা শুনে মা বলেছে শুধু তিস্তা নয়, চাইলে মৌলী আর চয়নিকাও আমাদের এখানে থেকে পড়াশোনা করতে পারে...ছেলে বাড়ীতে থাকবে না...মা নাকি তিন মেয়েকে নিয়ে বেশ থাকবে। আমি কথাটা শুনে যথারীতি মাকে বলেছি... আমি বাড়ী ফিরলে তোমার মেয়েরা আবার তাড়িয়ে দেবে না তো? তিস্তা ভেংচি কেটে বলেছে... তাড়ানোর তো প্রশ্নই উঠছে না কারন ঢুকতেই তো দেবো না...
______________________________
আমি যে নিঃস্ব হতে চাই #
বম্মা আর দাদাই নেই, আজ বাড়ীতে শুধু আমি আর আমার বিচ্ছুটা আছি…মনটা সকাল থেকেই উড়ু উড়ু, কি যেন একটা পেতে ইচ্ছে করছে আজ। বাথরুম নাকি মেয়েদের একান্ত নিজস্ব জায়গা যেখানে নিজের সাথে মন প্রান খুলে কথা বলা যায়…আজ নিজেকে দিয়ে তার প্রমান পেলাম…ঠান্ডা জলে নিজেকে ভিজিয়ে নিতে নিতে ভাবছিলাম…যা চাইছি সেটা কি ঠিক? বুকের ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল…কেন ঠিক নয়? মন বললো আমি কোনো কিছু মানি না…আমার মনে হয়েছে এটাই ঠিক…আর কতদিন অপেক্ষা করবো? বোঝাতে পারলাম না ওকে…মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি করার আছে…চোখ বুজে নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে করতে ইচ্ছে হল নিজেকে একবার দেখার…আয়নায় মধ্যে নিজের নগ্নতায় নিজেই লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকলাম…যেন এই প্রথম নিজেকে দেখছি…মসৃন ত্বকের গা বেয়ে জলের ধারা পিছলে নেবে যেতে যেতে যেন আমাকে বলে যাচ্ছে…নিজেকে উজ়াড় করে দেবার সময় তো হল…আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছিস…মনে হল…আজ যাকে দেখছি সে আমি নই …অন্য কেউ…আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম…ইস…কি ভীষন লজ্জা করবে যখন ও আমাকে দেখবে…আমাকে ছোঁবে…ভেজা চুল বুকের উপরে ফেলে ঢেকে দিয়ে বললাম…এখন থেকে তোমরা আর তিস্তার নয়…অন্য কেউ আসার সময় হয়েছে যেই শুধু তোমাদেরকে দেখবে…ছোঁবে…আদর করবে…মনে হল ওরা আড়ালে থাকতে রাজী নয় …চুলের ফাঁক দিয়ে নিজেদের ঔদ্ধত্ব আর সৌন্দর্য প্রকাশ করতে করতে যেন বলল আমায়…তুমি কি জানতে না যে আমরা তোমার নই... অন্য কারুর…এত দিন বোকার মতো আমাদেরকে নিজের ভেবে খুশী হয়েছো…বোকা মেয়ে কোথাকার। পাহাড় চুড়ায় বসে থাকা ছোট্ট বিচ্ছু দুটো যেন আরো দুষ্টু…কাঠবেড়ালীর মতো টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে যেন বোঝাতে চাইছে তারা এভারেষ্ট জয় করে ফেলেছে…দুটোকেই খুব করে বকুনি দিলাম…খুব মজা তাই না…ওর কথা ভাবছি দেখেই লাফিয়ে উঠেছো? আমাকে পাত্তাই দিলো না। ইস, বয়ে গেল আমার…দুষ্টুটার হাতে যখন পড়বে তখন বুঝবে তোমরা…কুট কুট করে ও যখন কামড়াবে, সব অহ্নকার তখন উধাও হয়ে যাবে। আমার মনের কথা কি করে ওরা বুঝলো কে জানে… আমাকে যেন বলতে চাইলো কি বোকা গো তুমি? তুমি কি বোঝো না…কি ভালো লাগবে তোমার ও যখন আমাদেরকে আলতো করে কামড়াবে…দেখবে, তুমি কেমন শিউরে শিউরে উঠবে তখন। চুল দিয়ে না হয় ওদেরকে আড়াল করলাম…তা সে যতই উঁকি দিক না কেন…আরো তো একজন আছে তাকে কিভাবে আড়াল করি? সে তো আরো দুষ্টু…মাঝে মাঝেই খুব জ্বালাতন করে মারে…কাকে যেন ওর চাই বলে আমার পেছনে লাগে। ওকেও বলে দি…তুমি যখন আমার নয়…একেবারে আমাকে জ্বালাবে না আর…দেখি তো কি করছে ভেবে তাকালাম……যা ভেবেছি তাই…ছিঃ ছিঃ একটুও লজ্জা নেই...নিঃর্লজ্জের মতো নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা না করে দেখানোর ইচ্ছে নিয়ে নিজের সগর্ব উপস্থিতি ঘোষনা করছে…লজ্জা নেই তো কি হয়েছে রুপ যেন ফেটে পড়ছে...নিজে মেয়ে হয়েও ওর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হতে বললাম…এই যে, দুষ্টু…তুমি কি জানো…তুমি কার? তুমি এতদিন যার কথা ভাবতে সে আসছে…তুমি তৈরী তো তাকে সাদরে আহ্বান জানাতে…পারবে তো তোমার উষ্ণ কোমল আলিঙ্গনে আটকে রেখে তাকে খুশী করতে, যাতে সে বারে বারে তোমার কাছে ফিরে আসে। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে খুব অহঙ্কারের সাথে জানালো…সময় হলেই দেখতে পাবে।
ঠোঁট দুটো বলে উঠল তুমি কি ভাবছো আমরা তোমার? মোটেও না…সাথে সাথে বাকি সবাইও এক সাথে বলে উঠল…আমরা কেউ তোমার নই…ওদেরকে বকুনি দিলাম… চুপ ক’র সবাই…আমি নিজেই যখন ওর তাহলে কি আর আমার বলে কিছু থাকলো? আমার সাথে সাথে তোমার সবাইও ওর…সবাই যেন বলে উঠল…ঠিকই তো…কিন্তু তুমি তো এখোনো বলে উঠতে পারলে না…যে তুমি ওকে কিছু দিতে চাও…কিছু পেতে চাও ওর কাছ থেকে। ওদেরকে বললাম…আমাকে তো দিতেই হবে…আমি যে আমার সব কিছু ওকে উজাড় করে দিয়ে নিঃস্ব হতে চাই…
প্রথম রাত #
সকাল থেকেই ছিল আকাশ জ়োড়া ঘন কালো মেঘের আনাগোনা, দুপুর থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি, সাথে দমকা হাওয়া। বিকেল হয়ে গেল তবু থামার নাম নেই...অবশ্য থামার কথাও নয়। বঙ্গোপোসাগরে গভীর নিম্নচাপ ঘনীভুত হয়েছে…টিভিতে বার বার ঘোষনা করছে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার লোকজন যেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়, গভীর সমুদ্রে থাকা নিরাপদ নয়। বাড়ীতে শুধু আমি আর তিস্তা, মা-কে নিয়ে বাবা কল্যানীতে এক অফিস কলিগ বোস কাকুর বাড়ীতে গেছে আজ সকালে, ফিরবে কাল বিকেলে। বোস কাকুর মেয়ে তানা-দির বিয়ের পাকা দেখার জন্য ছেলের বাড়ি থেকে আসবে আজ। আমারও যাবার কথা ছিল কিন্তু তিস্তা থাকায় আমার যাওয়া হয়নি। মা ভোর রাতে উঠে রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু তিস্তা মাকে জড়িয়ে ধরে বায়না করে বলেছে…ও করে নেবে। মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। দুজনে মিলে রান্না করেছি…আমি মোটামুটি কাজ চালানোর মতো রান্না জানতাম…এর ভেতরে ও আরো কিছু শিখেছে, তাই আর খুব একটা অসুবিধা হয়নি তবে মাত্র সাত বার ও মায়ের মোবাইলে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে এটা কি করবো, ওটা কি করবো গো বম্মা আর আমি তাই নিয়ে ওর পেছনে লাগতে গিয়ে তাড়া খেয়েছি... ও খুন্তি হাতে আমাকে তাড়া করে এলে মিথ্যে ভয় পাওয়ার ভান করে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছি মায়ের ঘরের ওয়ার্ড্রোবের পেছনে। ও আমাকে খুঁজেছে সারা ঘরে, পায়নি। বারে বারে ডেকেছে, আমি সাড়া দিইনি...তারপরেই ও অভিমানে প্রায় কেঁদে ফেলছে দেখে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এলাম। ও দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে আর আমি ওর সামনে হাসি মুখে বলেছি ওদিকে যে সব পুড়ে গেল, কি খাবো আমরা...ও অভিমান ভরা গলায় বলেছে... যাক পুড়ে সব, তোমাকে ওই খাওয়াবো আজ। আমি ওর মুখ তুলে ধরে জিজ্ঞেস করেছি...আমি তো না হয় পোড়া খাবো...তুমি কি খাবে? ও আস্তে করে বলেছে...তুমি পোড়া খেলে আমাকেও তাই খেতে হবে... তারপরেও আমার অভিমানিনীর মান ভাঙ্গাতে আমাকে আদর করতে হয়েছে, অনেক চুমু দিতে হয়েছে...
দুপুরে খেতে বসে খুব মজা করেছি…কোনোটায় নুন কম তো কোনোটায় ঝাল বেশী। ও বায়না করেছিল আজ ও আমার হাতে ছাড়া খাবেই না…ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে পাশাপাশি বসে খাচ্ছিলাম…ওকে খাইয়ে দিতে গেলে মাঝে মাঝেই আমার আঙ্গুল মুখে নিয়ে চুষেছে, ক খোনো বা কুট কুট করে কামড়ে দিয়েছে…’উঃ লাগছে তো’ বললে শুনতে হয়েছে... এই টুকুতেই উঃ করে উঠছো? আরো কতো জ্বালাবো তার ঠিক আছে নাকি…এখোনো তো সারা জীবনটা পড়ে আছে সামনে…পারবে তো আমাকে নিয়ে সংসার করতে?
ইচ্ছে ছিল দুপুরে ওকে খুব করে আদর করবো কিন্তু বিধি বাম থাকলে যা হয়। এই বিচ্ছিরি ওয়েদারের ভেতরেও আমাদের কাজের মাসী এসে হাজির। এমনিতে যখন তখন কামাই করে কিন্তু আজ যে কেন ওর এত ভালো সার্ভিস বুঝলাম না। নিজে তো এসেছে আবার সাথে করে বাচ্চাটাকেও নিয়ে এসেছে। সারা বাড়ি ঝাঁট দেবে, মুছবে, বাসন ধোবে...মাথা গরম হয়ে গেলেও কিছু বলতে পারলাম না। তিস্তা বোধহয় আমার মনের কথা বুঝে গিয়েছিল... আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচে দিয়ে চলে গেল টিভি দেখতে। কি আর করবো...নিজের ঘরে গিয়ে গিটারটা নিয়ে বসলাম। কাজ হয়ে গেলেও মাসীকে অপেক্ষা করতে বলতে হল...বৃষ্টির জোর বেড়েছে। একটু না কমলে বাচ্চা নিয়ে বেরোতে দেওয়া ঠিক হবে না।
সন্ধে সাতটা প্রায় বাজে। বসার ঘরে সোফাতে বসে টিভি দেখছি, তিস্তা আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে …ওর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে দেখলাম টিভি দেখছে না, চোখ বুজে কিছু ভাবছে হয়তো দেখে ওকে ডাকলাম…
- এই…তিস্তা…
আমার ডাকে ও সাড়া দিলো কিন্তু কি বললো বুঝলাম না। মুখ নিচু করে বললাম…কিছু ভাবছো?
- হুঁ…
- কি…
- আজ আমরা ছাড়া আর কেউ নেই বাড়ীতে…
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম...কি হয়েছে তাতে…তোমার কি ভয় করছে নাকি?
- নাঃ…ভয় করবে কেন…
- তাহলে?
ও পাশ ফিরে সোজা হয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকালো… হাত বাড়িয়ে আমার গালে আলতো ভাবে আঙ্গুল ছুঁইয়ে রেখে বলল…তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখানে…
- হু...তা নেই...
- বাইরে ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে…
- হচ্ছে...
- রজনীগন্ধার গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে আছে…
- আছে...
- কি রোমান্টিক …তাই না…
ওর আবেগ ভরা কথা গুলো শুনে মনে হল ও কিছু বলতে চাইছে এই কথা গুলোর ভেতর দিয়ে...চুপ করে ভাবছিলাম…কি বলতে চাইছে…হঠাৎই যেন বুঝতে পারলাম ও কি চাইছে… ভাবছিলাম…ইস…আমি সত্যিই একটা আস্ত বুদ্ধুরাম…আমারই ওকে বলা উচিত ছিল আজ…ওর হাতের উপরে হাত রেখে আমার গালে ওর আঙ্গুল চেপে ধরে বললাম…একটু ওঠো না…
- কেন…
- না উঠলে বলবো কিভাবে…
ইচ্ছে না থাকলেও ও উঠে আমার পাশে বসলো…আমি সোফা থেকে নেমে ওর পায়ের কাছে হাঁটুতে ভর বসে দুহাত দিয়ে ওর ডান হাতের আঙ্গুল ধরে মুখ নিচু করে চুমু খেয়ে মুখ তুলে তাকালাম... ও আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে...ওর টানা টানা কাজল কালো চোখে স্বপ্নের আবেশ...অনুনয়ের স্বরে বললাম…রাজকুমারী…এই অধমের কিছু আর্জি আছে…পেশ করার অনুমতি চাই…
আমাকে ওইভাবে অভিনয় করতে দেখে ও ফিক করে হেসে ফেলল…তারপরে মুখ গম্ভির করে বলল…অনুমতি দিলাম…
- রাজকুমারী…যদি সম্ভব হয় আজ রাতে কি এই অধম তার প্রেয়সীকে কি খুব কাছে পেতে পারে?
- বুঝলাম না…কাছে বলতে ঠিক কি বলতে চাওয়া হচ্ছে…
- কাছে মানে... ওই আর কি…
ও আমার দুচোখে কিছু যেন খোঁজার চেস্টা করে বলল...হুম…বুঝেছি…শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে...
- কি শর্ত রাজকুমারী?
- প্রথমত…বাগান থেকে টাটকা রজনীগন্ধা তুলে নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত…তোমার প্রেয়সীর এখন সেফ পিরিয়ড চলছে না…তার ব্যাবস্থা করতে হবে...
যথা আজ্ঞা রাজকুমারী …বলে আমি আবার ওর হাতে চুমু খেয়ে উঠে এসে ওর পাশে বসতেই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল…তুমি একটা পাজী…দুষ্টু…শয়তান…
- উমমম...কেন...আমি আবার কি করলাম...
- ইস...কি করলাম...আমাকেই সব কিছু বলতে হবে আগে?
ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললাম…তুমি যদি কিছু মনে কর, ভেবে আর বলতে পারি না। ও আমার বুকের এক দিকে মাথা রেখে আর একদিকে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল…তুমি কিছু চাইলে আমি কি না করতে পারি? আমি তো চাই তুমি নিজের থেকে আমাকে বলো আমার কাছে তুমি কি চাও। মুখ নিচু করে মৃদু স্বরে বললাম…মাঝে মাঝে আমার খুব ভয় করে তিস্তা, আমার কোনো ভুলের জন্য তুমি যদি দূরে চলে যাও। ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো…তোমার ভালোবাসা দিয়ে পারবে না আমাকে দূর থেকে ফিরিয়ে আনতে? ওকে বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বললাম…পারবো। তারপর কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে ছিলাম। ও আমার বুকের উপর থেকে মাথা তুলে কাঁধে উপরে রেখে বলল…এই…আমার না খুব ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে আজ। খাওয়াবে? কেমন যেন একটা ঘোরের ভেতরে ছিলাম ওকে আজ রাতে একান্ত ভাবে পাবো ভাবতে ভাবতে...তার ভেতরে ওর ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছের কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল…কোথায় আমি ভাবছি…আমাদের জীবনের প্রথম রাত কিভাবে স্মরনীয় করে রাখা যায় আর ওর এখন ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে…হাসি চেপে বললাম…যথা আজ্ঞা রাজকুমারী…