03-03-2021, 08:20 PM
প্রথম স্বপ্ন #
হোটেলে ফিরে মায়ের রুমে বসে চা খেয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম…একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছে…
তিস্তা মায়ের পাশে বসে আমাকে খোঁচা মেরে বলল…এই যে বিচ্ছু ছেলে…নিজের রুমে গিয়ে ঘুমোও…আমারও ঘুম পাচ্ছে…আমি যে কদিন আছি…বম্মা শুধু আমার…একদম ভাগ বসাতে আসবে না…
ইস…বম্মা শুধু আমার…কোথাকার কে ঠিক নেই…মায়ের ভাগ আমি ছাড়ছি না…বলে মাকে জড়িয়ে ধরলাম…
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল…ও তো কদিন পরেই চলে যাবে…
অগত্যা উঠে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙ্গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম…বাবার বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে তিস্তার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
তিস্তা আর আমি ঝাউ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছি…আশে পাশে কেউ নেই…সমুদ্রের গর্জন আর ঝাউ গাছের পাতাতে হাওয়া লেগে সোঁ সোঁ আওয়াজ। তিস্তা আমার হাতটা ওর বুকের পাশে চেপে ধরে আমার পাশে পাশে হাঁটছে…আমার কাঁধে মাথা রেখে…ওর অবাধ্য চুল গুলো মাঝে মাঝে আমার মুখের উপরে চলে আসছে…দু এক বার সরিয়ে দিলাম…বার বার আসছে দেখে আর না সরিয়ে আমার গালে চেপে ধরে থাকলাম…খুব সুন্দর গন্ধ ওর চুলে…নাকের কাছে নিয়ে এসে শুঁকতে শুঁকতে জিজ্ঞেস করলাম…কি মাখো মাথায়…এত সুন্দর গন্ধ…উত্তর দিচ্ছে না দেখে চুলে একটু জোরে টান দিলাম…
উঃ মাগো…
ঘুম ভেঙ্গে গেল…তাকিয়ে দেখলাম…তিস্তা আমার পাশে বসে আছে…ওর এক গোছা চুল আমার হাতে। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম…আমি স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি…অন্য কিছু…
সত্যিই তুমি একটা বিচ্ছু…কি জোরে টানলে…লাগে না নাকি…
আমি তো স্বপ্ন দেখছিলাম…
ঘোড়ার ডিম দেখছিলে…আমার চুল হাতে নিয়ে শুঁকে কি একটা বিড় বিড় করে বললে…তারপর টান মারলে…
বিশ্বাস কর…স্বপ্ন দেখছিলাম…আমি আর তুমি হাঁটছি…তোমার চুল গুলো মাঝে মাঝে আমার মুখের উপর এসে পড়ছিল…
তাই?
হুঁ…
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে…এখন চলো…বম্মা খেতে ডাকছে…খেয়ে… আমাকে নিয়ে বাইরে যেতে বলেছে…
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি #
আমাদের ব্রেকফাস্ট করতে একটু দেরী হয়ে গেছে, ডাইনিং রুমে আমরা ছাড়া আর মাত্র কয়েকজন আছেন যারাও হয়তো আমাদের মতোই সকালে উঠে বেরিয়েছিলেন বলে খেতে আসতে দেরী হয়ে গেছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বেরোনো যাবে না বলে আর ওঠারও তাড়া ছিল না আমাদের। বেশ কিছুক্ষন নিজেদের ভেতরে গল্প করতে করতে দাদাই বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল…”বৃষ্টি থামলে তোরা একটু ঘুরে আয়”।
বিচ্ছুটা দাদাই এর কথা শুনে জিজ্ঞেস করল…”তোমরা বেরোবে না”? দাদাই মাথা নেড়ে বলল...”নাঃ…তোরা ঘুরে আয়...আমরা ঘরে বসে একটু গল্প গুজব করি”।
দাদাই যাবে না বলাতে বম্মার হাত ধরে বললাম…”ও বম্মা চলো না…ঘুরে আসি”।
বম্মা হেসে বলল...”না রে...আমরা আর বেরোবো না... যা না...তোরা ঘুরে আয়”।
একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গেলে আমরা দুজনে বেরোলাম। বাইরে বেরিয়েই সকালের মতো ওর গা ঘেঁষে হাতটা ধরে বুকের পাশে চেপে ধরতেই ও আমাকে মিষ্টি করে ধমকে দিয়ে বলল…”এই ছাড়ো…সবাই দেখতে পাচ্ছে”।
ওর মিষ্টি বকুনি শুনে...”ইস…আবার ভুলে গেছি”…বলে ওর হাতটা ছেড়ে ইচ্ছে না থাকলেও একটু দুরে সরে গেলাম। ও সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... “বারবার ভুলে গেছি…তাই না…গন্ডগোল না পাকিয়ে ছাড়বে না দেখছি”…
- বললাম তো ভুলে গেছি…এই দেখো…কান ধরছি…আর করবো না…
আমাকে কান ধরতে দেখে ও হেসে ফেলে বলল…”থাক আর সবার সামনে কান ধরতে হবে না…চলো”।
দুজনে পাশাপাশি আস্তে আস্তে হাঁটছি, হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু দুরে চলে যাবার পর ও আমার কাঁধে হাত রেখে একেবারে কাছে টেনে নিয়ে গা ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল…”কোথায় যাওয়া যায় বলো তো…বিচে বড্ড ভীড়”?
- আমি কি জানি…তুমি যেখানে নিয়ে যাবে…
- চলো…একটু দুরে একটা ঝাউ জঙ্গল আছে…খুব নিরিবিলি…বিশেষ কেউ যায়না ওদিকে…
- কিছু হবে না তো…নিরিবিলি জায়গা…খারাপ লোক থাকতে পারে…
- আমি আছি তো…ভরসা করতে পারছো না নাকি…
ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে বললাম…”ভরসা করি বলেই তো তোমার বুকে নিজেকে সঁপে দিতে পেরেছি”।
ও আমাকে ধরে থেকেই আস্তে করে আরো একটু নিজের সাথে চেপে ধরে হয়তো বোঝাতে চাইলো “তুমি আমাকে ভরসা করে কিছু ভুল করোনি”।
ও আমার কোমরে হাত রেখে ধরে আছে আর আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে আস্তে হাঁটছি। কেউ কেউ আমাদের ওইভাবে অন্তরঙ্গ অবস্থায় যেতে দেখে ফিরে ফিরে তাকালেই খুব রাগ হচ্ছিল, নিজের মনে মনে ভাবছিলাম…”আমি আমার বিচ্ছুর সাথে যা খুশি করবো…তোমাদের এত দেখার কি আছে”।
কিছুটা যাবার পর দেখলাম সামনেই একটা ঝাউ জঙ্গল আর তার সামনের বিচে প্রায় কেউ নেই, কয়েকজন জেলে নৌকো আর জাল নিয়ে কি সব করছে। আমরা আরো কিছুটা ঝাউ জঙ্গলের ভেতরে চলে গেলে, ও এদিক ওদিক দেখে বললো…”এসো...এখানেই বসি”।
ও একটা ঝাউ গাছে হেলান দিয়ে বালির উপরে পা ছড়িয়ে বসে আমার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিল। আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে ওর একটা হাত বুকে চেপে নিয়ে বসে আছি, ভীষন ভালো লাগছে…কথা বললে যদি নিজের ভালোলাগার অনুভুতিটা হারিয়ে যায় এই ভয়ে চুপ করে আছি। আমার মতোই ও চুপচাপ বসে আছে, কোনো কথা বলছে না… বোধহয় বুঝতে পেরেছিল আমার মনের ভাষা বা নিজেই হয়তো আমার মতোই নিজের ভালোলাগার অনুভুতিকে সম্পুর্ন ভাবে অনুভব করতে চাইছিল…দুজনে দুজনার স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে হারিয়ে যেতে যেতে জানি না কত সময় কেটে গেছে…ওর ডাকে মুখ তুলে তাকালাম...
- তিস্তা…
- উঁ…
- গান শোনাবে…
- উঁ হঁ…
- কেন?
- তুমি তো বলোনি…কেমন লেগেছিল সেদিন…বলার সময় কি এখোনো হয়নি?
- ভীষন ভালো লেগেছিল…
- আর কিছু মনে হয়নি?
- “তোমার অঝোর ধারায় ভিজে…আমি নতুন হলাম নিজে”…গানের এই কথা গুলোর ভেতর দিয়ে কি তুমি কিছু বোঝাতে চেয়েছিলে?
ওর প্রশ্নটা শুনে একটু সময় চুপ করে থেকে বললাম…”চেয়েছিলাম”...
- কি…
ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম...”আমার বিচ্ছুর সাথে দেখা হওয়ার আগের তিস্তা আর দেখা হওয়ার পরের তিস্তা যে এক ছিল না…বৃষ্টিতে ভিজে তিস্তা যদি নিজেকে নতুন করে না নেয়… বিচ্ছু তাকে কি করে নিজের করে নেবে বলো”? আমার উত্তর শুনে কিছু বুঝলো কিনা জানি না, ওকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম…”বুঝেছো”? ও আস্তে করে বলল...”না”।
আমি আগের মতোই ওর কাঁধে মাথা রেখে বললাম..”এখোনো সময় আসে নি বলার…পরে কোনোদিন বলব…বলো…কি গাইবো”...
- তুমি বলো…
ও আমার উপরেই ছেড়ে দিল দেখে ভাবছিলাম কি গাই, কিছুক্ষন ভেবে ভেবে কোনোটাই মনে ধরছিল না…তারপর আরো একটু ভেবে মনে হল...’আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলার আর শোনার পরে বোধহয়…’কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি’ গাওয়া সবথেকে ভালো হবে… মনে মনে নিজেকে তৈরী করে নিয়ে চোখ বুজে নিচু গলায় গাইতে শুরু করলাম, চাই না ও ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউ শুনুক আমার গান…
______________________________
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি…
কিছুতেই পাই না ভেবে…কে প্রথম ভালোবেসেছি…
তুমি না… আমি…
ডেকেছি কে আগে…কে দিয়েছে সাড়া
কার অনুরাগে…কে গো দিশাহারা…
ডেকেছি কে আগে…কে দিয়েছে সাড়া
কার অনুরাগে…কে গো দিশাহারা…
কে প্রথম মন জাগানোর সুখে ভেসেছি…
তুমি না… আমি
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি…
কিছুতেই পাই না ভেবে…কে প্রথম ভালোবেসেছি…
তুমি না… আমি…
কে প্রথম কথা দিয়েছি…
দুজনার এ দুটি হৃদয়…একাকার করে নিয়েছি…
শুরু হল কবে এত চাওয়া পাওয়া…
একই অনুভবে… একই গান গাওয়া…
শুরু হল কবে এত চাওয়া পাওয়া…
একই অনুভবে… একই গান গাওয়া…
কে প্রথম মন হারানোর… স্রোতে ভেসেছি
তুমি না… আমি…
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি…
কিছুতেই পাই না ভেবে…কে প্রথম ভালোবেসেছি…
তুমি না… আমি…
গানটা গাওয়ার পর নিজেরই মনে হচ্ছিল এত মন প্রান দিয়ে বোধহয় এর আগে কোনোদিন গাইনি। চুপ করে বসে থেকে অপেক্ষা করছিলাম ও কি বলে শোনার জন্য। ও আরো কিছুক্ষন উদাস হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল…”তুমিই আগে কাছে এসেছো, আমি পারিনি আগে আসতে”।
ওর কথাটা শুনে মনে হল...ওর কথাটা কিছুটা হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়...ও আমাকে কাছে আসার সুযোগ না দিলে কি আমিও এত তাড়াতাড়ি বলতে পারতাম...”আমি তোমাকে ভালোবাসি”।
নিজের বুকের ভেতরের কথা গুলো নিজের ভেতরেই আটকে রেখে আস্তে করে বললাম...”হয়তো আমরা দুজনেই একসাথে এসেছি”।
______________________________
প্রথম চুম্বন #
কতক্ষন বসে আছি আমরা পাশাপাশি জানি না, চারিদিকে কেউ নেই, শুধু আমরা দুজন দুজনের উষ্ণ সান্নিদ্ধ অনুভব করছি হৃদয় দিয়ে। ওর ডাকে যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে বললাম…”বলো”।
ও আস্তে করে বলল...”আমার দিকে তাকাও”।
মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম, ওর দু চোখে স্বপ্নের ছোঁয়া। আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কিছু যেন বলতে চাইছে…জানি না কি বলতে চাইছে তাই আবার বললাম…”বলো”।
ও স্বপ্নের ভেতর থেকে ফিরে এসে বলল… “চলো না…আরো একটু দুরে”।
দুজনে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছি, ও ধীর স্থির…আমার কিশোরী মনটা ফিরে এসেছে অতীত থেকে। ভীষন খুশীতে ছটপট করছি, নিজেই জানি না কি চাইছি …শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি নিজের বুকের ভেতরে পারছি না ধরে রাখতে এই খুশী… আজ আমি আর একা নই…কেউ আমাকে তার মনটা চুরি করতে দিয়েছে খুশী হয়ে…আমি লুকিয়ে রাখবো সেই চুরি করা মনটা আমার বুকের গভীরে…আর কেউ জানবে না সেই খবর…শুধু ও ছাড়া। ইস, শুধু কি আমি ওর মন চুরি করেছি? ওকেও তো দিয়েছি আমার এতদিনের সযত্নে আগলে রাখা মনটা...এত খুশীতে নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না...কখনও ওকে কাছে টেনে নিচ্ছি…কখোনো অকারনে নেচে উঠছি…কখনো বা গুনগুন করে কিছু গেয়ে উঠছি…নিজেই জানি না কি করতে চাইছি আর কেনই বা করতে চাইছি। শুধু বুঝতে পারছি ও আমাকে অবাক হয়ে দেখছে…বোঝার চেষ্টা করছে...এ কোন তিস্তা...তিস্তার এই রুপ তো আগে দেখিনি...উচ্ছল হতে দেখেছি ওকে কিন্তু এ যেন অন্যরকমের উচ্ছলতা। আরো কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও একটা ঝাউ গাছে হেলান দিয়ে…আমার দিকে তাকিয়ে আছে হাসি মুখে। ওর ওই পৃথিবী ভোলানো মন পাগল করা হাসিতে জানি না কি হ’ল আমার…ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো… কখন ওর চোখে চোখ রেখে আরো কাছে চলে গেছি জানিনা…দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কোনো কিছু পাবার আশায় মুখ তুলে তাকিয়ে আছি… ওর প্রশস্ত বুকে আমার শরীরের আলতো ছোঁয়া…ওর দুহাত আমার কাঁধে…ও আস্তে আস্তে মুখ নামিয়ে নিয়ে এলো... কিছু পাওয়ার আশায় আমার চোখ বুজে আসছে আপনা হতে...আমি চাইলেও পারবো না আর তাকিয়ে থাকতে... ওর ঠোঁট স্পর্শ করল আমার তির তির করে কেঁপে যাওয়া ঠোঁট দুটোকে। শিউরে উঠলাম জীবনের প্রথম ভালোবাসার চুম্বনে। শরীর মন ভরে উঠল ওই আলতো ঠোঁটের ছোঁয়ায়, যাতে নেই সব কিছু তছনছ করে দেবার কোনো ইচ্ছে…শুধু আছে হৃদয় ভরানো মিষ্টি অনুভুতি। নিজেকে সম্পুর্নভাবে সঁপে দিয়েছি ওর বুকে...চাই না আমি এই সুখের অনুভুতি হারিয়ে যাক।
______________________________
প্রথম সমুদ্রে স্নান #
হোটেলে ফিরে এসে দেখলাম মায়ের রুমে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আমাদেরকে ফিরে আসতে দেখে মা বলল…আরে তোরা আবার এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি কেন? কোথায় মেয়েটাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসবি তা নয়, গেলি আর এলি…কি রে তিস্তা…বাবাই নিশ্চয় তোর পেছনে লেগেছিল আবার? তিস্তা মায়ের পাসে বসে পড়ে জড়িয়ে ধরে বলল…না গো বম্মা…তোমার বিচ্ছু ছেলেটা আজ একটু ভালো হয়ে গেছে। মা কে বললাম…স্নান করতে যাবে তো নাকি…না হলে তো আর একটু পরেই আসা যেত…
- না না…তোরা যা…আমরা আজ কেউ বেরোচ্ছি না…দেখছিস না কেমন সুন্দর গল্প করছি…
- আচ্ছা…ফাজিল মেয়েটার দায় দায়িত্ব সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা বেশ মজা করা হচ্ছে…
বাবা পাশ থেকে হেসে বলল…আমরা তো এতদিন দায় দায়িত্ব নিয়েছি…বড় হয়েছো…দুদিন পর চাকরি বাকরি আর তারপর ঘর সংসার করতে হবে তো নাকি…এখন থেকে একটু আধটু অভ্যাস করাই ভালো। তিস্তা পাশ থেকে ফুট কাটলো…ঠিক বলেছো দাদাই…এখন থেকে অভ্যেস না করলে পরে ঝামেলায় পড়ে যাবে।
- দেখেছো মা…আমি কিছু বলেছি ওকে...এখন আমার পেছনে কেন লাগছে?
- মা কে বলে কিচ্ছু হবে না…শোধবোধ হয়ে গেল…তুমি আমাকে রান্না করে বর কে খাওয়াতে বলেছিলে না?
মা হেসে ফেলে বলল…আচ্ছা ঠিক আছে যা…তোরা স্নান করে আয়…ওকে একা ছাড়বি না কিন্তু…
আমি জামাকাপড় বদলে আসছি বলে বেরিয়ে আমাদের রুমে এলাম। তিস্তা পাশে ছিল বলে সিগারেট খেতে পারিনি। সর্টস টা পরে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম, একটু পরেই বেল বেজে উঠতে ফিরে গিয়ে দরজা খুলে দিলে তিস্তা ভেতরে এসে আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছুক্ষন দেখে বললো...খুব হ্যন্ডসাম লাগছে কিন্তু তোমাকে…আমার কিন্তু টেনশান বেড়ে যাচ্ছে। ওর টেনশানের কারন বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে কেন জিজ্ঞেস করাতে হাসি মুখে বলল...চারদিকে এত মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে…তাদের হাত থেকে তোমাকে সামলে রাখতে হবে তো। ওর কাঁধে দুহাত রেখে ওকে একটু কাছে টেনে নিয়ে বললাম…সুন্দরী…তোমার চিন্তা করিবার কারন নাই…আমি সারা জীবন আমার তিস্তাতেই অবগাহন করিতে চাই…অন্য কোনো নদীতে নামিবার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই। তারপরেই গেয়ে উঠলাম…আমি তোমারে সঁপেছি প্রান…ওগো…নর্থ বেঙ্গল বাসিনী। আমার মজা করে বলা কথা গুলো শুনে ও হেসে ফেলে বলল…তুমি না সত্যিই একটা পাজী…বম্মা ঠিকই বলে। ওর চোখে চোখ রেখে আস্তে করে বললাম...এই পাজীটাকেই কিন্তু ভালোবেসেছো। তিস্তা মুখটা একটু গোমড়া করে বলল…কি আর করা যাবে বলো…নিজেকে কত করে বোঝালাম…পাজিটার পাল্লায় পড়িস না…মন কিছুতেই বুঝলো না…তার নাকি তোমাকেই চাই। আমার মতোই ওকেও মজা করতে দেখে আমি হেসে ফেলাতে তিস্তাও হেসে ফেলে বলল…এই…দেরী হয়ে যাবে…চলো। হু...চলো বলাতে তিস্তা একটু থমকে গিয়ে চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…স্নান তো করবো…কিন্তু কি পরে যাই বলোতো…সালোয়ার কামিজ ভিজে গেলে বড্ড গায়ে সেঁটে যায়। একটু ভেবে বললাম…তুমি আমার একটা হাফ প্যান্ট আর টি সার্ট পরতে পারো…
- ধ্যাত…
- আরে…পরেই দেখো না…না ভালো লাগলে পরবে না…
আমার ব্যাগ থেকে ওকে কি কি দেওয়া যায় দেখে বের করে দিতে তিস্তা বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো। ওর টুকটুকে ফরসা শরীরে নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট আর টি সার্ট ভীষন ভালো মানিয়েছে…এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেলেদের পোষাক পরেও ওকে যেন আরো বেশি মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল। নিজেকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল...কেমন লাগছে…বাইরে যাওয়া যাবে তো? আমি মুগ্ধ চোখে ওকে দেখতে দেখতে আস্তে করে বললাম...একদম পারফেক্ট…তুমি যা পরো না কেন তোমাকে ভীষন মানিয়ে যায়…এরকম ড্রেস করলে আমি রোজ নতুন করে তোমার প্রেমে পড়তে রাজী আছি। ও নিজেকে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল…যাঃ…বাড়িয়ে বোলো না। আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম…একটাই জিনিস চেক করার আছে আর…
- কি?
- ব্রেসিয়ার আর প্যান্টি কি লাইট কালারের?
আমার প্রশ্ন শুনে ও একটু লজ্জা পেয়ে গেল…কিছু বললো না দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রেখে বললাম…বলো না…
- ডিপ ব্ল্যাক…
- পারফেক্ট…
তিস্তা আয়নার ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…কেন…তোমার কি দেখতে ইচ্ছে করছে?
- উঁ হুঁ…আমি আমার দেখার জন্য বলছি না…টি সার্ট আর প্যান্ট ভিজে গেলে…লাইট কালারের ব্রেসিয়ার আর প্যান্টি সব্বাইকে বলে দেবে তারা কোথায় আছে…
- আচ্ছা…এইসব দেখা হয়… না…অসভ্য কোথাকার…
- কি করবো বলো…চোখ তো আর আমার সব কথা শুনে চলে না…তার যেদিকে ইচ্ছে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে… আর…কেউ যদি নিজের থেকে দেখাতে চায়…আমি কি করতে পারি বলো…
মায়ের রুমে চাবি দিতে গিয়ে মাকে বললাম…মা দেখো তো…তিস্তাকে কেমন লাগছে…কিছুতেই পরতে চাইছিল না…ওকে নাকি বিচ্ছিরি লাগছে। মা ওর দিকে তাকিয়ে বলল...এ মা… কে বলেছে বিচ্ছিরি লাগছে…খুব ভালো মানিয়েছে তোকে। মা ভালো বলাতে ও খুব খুশী হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল…থ্যাঙ্ক ইউ বম্মা…
ও যেন এত সময় বাইরে বেরোবার অপেক্ষায় ছিল, হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়ে যথারীতি ও আবার আমার গায়ে সেঁটে গেছে। কিছুটা এদিক ওদিক ঘুরে একটু দূরে চলে গেলাম যেখানে খুব বেশী লোকজনের ভীড় নেই। ওর হাতটা ভালো ভাবে ধরে একটু একটু করে জলের দিকে এগোচ্ছিলাম…আমার ওকে ধরে থাকার হয়তো দরকার ছিল না, যে ভাবে আমাকে শক্ত করে ধরে গায়ের সাথে আটকে রেখেছে তাতে আলাদা হয়ে যাবার কোনো চান্স ছিল না। সেটা যতটা না প্রথম সমুদ্রে নামার ভয় তার থেকে বেশী আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য। ওকে নিয়ে খুব বেশী দূরে যাওয়া যাবে না, এই প্রথম সমুদ্রে নামছে…বিপদ হয়ে যেতে পারে। যদিও ওর ভয় পাওয়ার কথা কিন্তু আমি ওর সাথে আছি ভেবে হয়তো ওর মনে কোনো চিন্তা নেই, ও জানে আমি কোনো অবস্থাতেই ওর কিছু হতে দেবো না। একটা করে ঢেউ এসে আমাদেরকে ভেজাচ্ছে আর ও আমাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠছে…যেই ঢেউ ফিরে যাচ্ছে ওমনি আমাকে টেনে নিয়ে ঢেউ এর পেছন পেছন যাবার চেষ্টা করছে…আবার যেই ঢেউ আসছে আমাকে টেনে পেছনের দিকে চলে আসছে। কিছুক্ষন পর হাঁফিয়ে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো…
একটু পিছিয়ে এসে ওকে পাশে বসিয়ে জলের মধ্যে বসলাম। ও ওখানেই ঢেউ এর সাথে হুটোপুটি শুরু করে দিলে আমাকেও ওর সাথে তাল মেলাতে হচ্ছিল। ভীষন ভালো লাগছিল ওকে এইভাবে খুশী হতে দেখে। বেশ কিছুক্ষন স্নান করার পরে একটু একটু ঠান্ডা লাগছিল…ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল…শীত করছে…
- চলো এবারে উঠি...এর পরে কিন্তু আরো শীত করবে…
- করুক…আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না…বেশী শীত করলে তুমি আছো তো…
- আমি কি করবো?
- কিচ্ছু করতে হবে না…শুধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকবে…
মাথাটা একটু গরম হয়ে গেলে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল…তোমার কি মাথা খারাপ…এখানে সবার সামনে কি করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। ভাবছিলাম কি অবুঝ মেয়ে কে জানে, আমরা যেন বন্ধ ঘরের মধ্যে আছি যে ইচ্ছে হলেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরবো। চারদিকে কিছু হলেও লোকজন রয়েছে, তার মাঝে কি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরা ঠিক হবে? আমি তো চাইনা কেউ তা দেখে ভাবুক…ইস কি নির্লজ্জ মেয়ে। আমার গলার আওয়াজে হয়তো বুঝতে পেরেছিল আমি রেগে গেছি…একটু যেন আহত হল মনে মনে, আমাকে ছেড়ে একটু দুরে সরে গিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…চলো। খুব খারাপ লাগলো ওর খারাপ লেগেছে বুঝে। ভাবলাম ওই ভাবেই না বলে ওকে অন্যভাবে বোঝানো যেতে পারতো। ওর হাতটা ধরে কাছে টানলাম…নিজেকে শক্ত করে রেখে বলল…ছাড়ো। ওর এত খুশী আমি কিভাবে নষ্ট করলাম ভেবে নিজেকে অভিশাপ দিতে ইচ্চে করছিল। মুখ নিচু করে ভাবছিলাম কি করি এখন…একটু পরে তাকিয়ে দেখলাম ও অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। যা করার আমাকেই করতে হবে ভেবে ওর পাশে সরে গিয়ে বললাম…তিস্তা…প্লিজ…আমার দিকে তাকাও। ও আগের মতোই মুখ ঘুরিয়ে থাকলো, একটু যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীরটা। বুঝলাম না কাঁদছে নাকি শীত করছে ওর। মনে মনে ভাবলাম…ধুস…যে দেখবে দেখুক…যা খুশী ভাবুক…ওর কাঁধে হাত দিয়ে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বুকে টেনে নিলাম, ও নিজেকে তখোনো শক্ত করে রেখেছে দেখে বললাম…তিস্তা…প্লিজ...আমি বুঝতে পারিনি। ও দু হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকলো দেখে আর কিছু না বলে ওকে স্বাভাবিক হতে সময় দিলাম। অনেকটা সময় কেটে গেলেও কিছু বলছে না দেখে আস্তে আস্তে ডাকলাম…তিস্তা। আমার ডাক শুনেও চুপ করে থাকলো দেখে বুঝলাম না সমুদ্রের আওয়াজের মাঝে শুনতে পেয়েছে কিনা…আবার ডাকলাম…তিস্তা। এবারেও কোনো সাড়া নেই, শুধু একবার আমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে আবার আগের মতো রাখলো আর তার সাথে সাথে আমার বুকে নিজেকে আরো একটু জোরে চেপে ধরে বোঝালো ও নিজের মধ্যেই থাকতে চাইছে। একটু পরে আমার বুক থেকে নিজেকে আলাদা করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…আর একটু থাকবো?
- কোথায়?
ও আমার বুকে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে বোঝালো…আমার বুকে থাকতে চাইছে ও। মনে মনে বললাম…তোমাকে আমি সারা জীবনের মতো এখানে আটকে রাখতে চাই। আমার নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে ও আবার নিজেকে আমার বুকের সাথে মিশিয়ে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে আমার কাঁধ মাথা রাখলো…
ফেরার সময় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আসছিলাম, আমার হাত ওর হাতের বাঁধনে। ওর স্বভাব মতো বকবক করে যাচ্ছে এক নাগাড়ে যার সাথে তাল মেলানো খুব মুশকিল হচ্ছিল। মনেই হচ্ছিল না একটু আগে ও মন খারাপ করে বসেছিল। আমাকে হুঁ হাঁ করে উত্তর দিতে দেখে কি ভাবলো কে জানে…হটাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল…এই, তুমি কি এখোনো আমার উপরে রেগে আছো? কি মেয়ে কে জানে বাবা…কোথায় আমি ওকে বলব যে আমি বকেছিলাম বলে তুমি কিন্তু মনে রেখে দিওনা। উল্টে ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি রেগে আছি কিনা। আমার উত্তর দিতে একটু দেরী হচ্ছিল দেখে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল…ঠিক আছে…বুঝেছি…তুমি এখোনো আমার উপর রেগে আছো…আমি না সত্যিই খুব বোকা…কখন কি করা উচিত বুঝি না…কি করবো…বলো…তোমাকে কাছে পেলে আমার কেমন যেন মাথার ভেতরে সব গোলমাল পাকিয়ে যায়…এই…প্লিজ…আর কক্ষোনো ভুল হবে না। ওর কথা শুনে ভালো লাগার সাথে সাথে খুব হাসি পেয়ে গেল…মেয়েটা কি পাগল নাকি অন্য কিছু…আমি ওর হাতটা ধরে একটু গম্ভীর হয়ে বললাম…আর একটাও কথা নয়…লক্ষী মেয়ের মতো চলো…আমি কিন্তু খুব রেগে আছি…আর যদি একটা কথা বলেছো…আমি আরো রেগে যাবো। আমার সাথে এগোতে এগোতে একটু যেন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল…তুমি খুব রেগে আছো? আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না…হো হো করে হেসে বললাম…তোমাকে নিয়ে আমি যে কি করবো বুঝতে পারছি না…কোথায় আমি তোমাকে বকেছি বলে নিজের খারাপ লাগছে…কি বলা যায় তোমাকে ভাবছিলাম…তুমি উল্টে ভাবছো…আমি রেগে আছি। ও যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না আমি রাগ করে নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই বললাম…আর কোনো কথা নয়…ভেজা জামাকাপড়ে বেশী সময় থেকে জ্বর এসে গেলে… কাল তো আর জলে নামতে পারবে না …তখন কিন্তু তোমার বম্মা আমার হাল খারাপ করে দেবে…আমার না হয় যা হবে দেখা যাবে…তুমি কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাবে না…সেটা কি ভালো হবে?
ঝিনুকের মালা নয়, এ যে মুক্তোর মালা #
হোটেলে ফিরে মায়ের রুমে বসে চা খেয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম…একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছে…
তিস্তা মায়ের পাশে বসে আমাকে খোঁচা মেরে বলল…এই যে বিচ্ছু ছেলে…নিজের রুমে গিয়ে ঘুমোও…আমারও ঘুম পাচ্ছে…আমি যে কদিন আছি…বম্মা শুধু আমার…একদম ভাগ বসাতে আসবে না…
ইস…বম্মা শুধু আমার…কোথাকার কে ঠিক নেই…মায়ের ভাগ আমি ছাড়ছি না…বলে মাকে জড়িয়ে ধরলাম…
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল…ও তো কদিন পরেই চলে যাবে…
অগত্যা উঠে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙ্গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম…বাবার বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে তিস্তার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
তিস্তা আর আমি ঝাউ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছি…আশে পাশে কেউ নেই…সমুদ্রের গর্জন আর ঝাউ গাছের পাতাতে হাওয়া লেগে সোঁ সোঁ আওয়াজ। তিস্তা আমার হাতটা ওর বুকের পাশে চেপে ধরে আমার পাশে পাশে হাঁটছে…আমার কাঁধে মাথা রেখে…ওর অবাধ্য চুল গুলো মাঝে মাঝে আমার মুখের উপরে চলে আসছে…দু এক বার সরিয়ে দিলাম…বার বার আসছে দেখে আর না সরিয়ে আমার গালে চেপে ধরে থাকলাম…খুব সুন্দর গন্ধ ওর চুলে…নাকের কাছে নিয়ে এসে শুঁকতে শুঁকতে জিজ্ঞেস করলাম…কি মাখো মাথায়…এত সুন্দর গন্ধ…উত্তর দিচ্ছে না দেখে চুলে একটু জোরে টান দিলাম…
উঃ মাগো…
ঘুম ভেঙ্গে গেল…তাকিয়ে দেখলাম…তিস্তা আমার পাশে বসে আছে…ওর এক গোছা চুল আমার হাতে। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম…আমি স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি…অন্য কিছু…
সত্যিই তুমি একটা বিচ্ছু…কি জোরে টানলে…লাগে না নাকি…
আমি তো স্বপ্ন দেখছিলাম…
ঘোড়ার ডিম দেখছিলে…আমার চুল হাতে নিয়ে শুঁকে কি একটা বিড় বিড় করে বললে…তারপর টান মারলে…
বিশ্বাস কর…স্বপ্ন দেখছিলাম…আমি আর তুমি হাঁটছি…তোমার চুল গুলো মাঝে মাঝে আমার মুখের উপর এসে পড়ছিল…
তাই?
হুঁ…
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে…এখন চলো…বম্মা খেতে ডাকছে…খেয়ে… আমাকে নিয়ে বাইরে যেতে বলেছে…
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি #
আমাদের ব্রেকফাস্ট করতে একটু দেরী হয়ে গেছে, ডাইনিং রুমে আমরা ছাড়া আর মাত্র কয়েকজন আছেন যারাও হয়তো আমাদের মতোই সকালে উঠে বেরিয়েছিলেন বলে খেতে আসতে দেরী হয়ে গেছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বেরোনো যাবে না বলে আর ওঠারও তাড়া ছিল না আমাদের। বেশ কিছুক্ষন নিজেদের ভেতরে গল্প করতে করতে দাদাই বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল…”বৃষ্টি থামলে তোরা একটু ঘুরে আয়”।
বিচ্ছুটা দাদাই এর কথা শুনে জিজ্ঞেস করল…”তোমরা বেরোবে না”? দাদাই মাথা নেড়ে বলল...”নাঃ…তোরা ঘুরে আয়...আমরা ঘরে বসে একটু গল্প গুজব করি”।
দাদাই যাবে না বলাতে বম্মার হাত ধরে বললাম…”ও বম্মা চলো না…ঘুরে আসি”।
বম্মা হেসে বলল...”না রে...আমরা আর বেরোবো না... যা না...তোরা ঘুরে আয়”।
একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গেলে আমরা দুজনে বেরোলাম। বাইরে বেরিয়েই সকালের মতো ওর গা ঘেঁষে হাতটা ধরে বুকের পাশে চেপে ধরতেই ও আমাকে মিষ্টি করে ধমকে দিয়ে বলল…”এই ছাড়ো…সবাই দেখতে পাচ্ছে”।
ওর মিষ্টি বকুনি শুনে...”ইস…আবার ভুলে গেছি”…বলে ওর হাতটা ছেড়ে ইচ্ছে না থাকলেও একটু দুরে সরে গেলাম। ও সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... “বারবার ভুলে গেছি…তাই না…গন্ডগোল না পাকিয়ে ছাড়বে না দেখছি”…
- বললাম তো ভুলে গেছি…এই দেখো…কান ধরছি…আর করবো না…
আমাকে কান ধরতে দেখে ও হেসে ফেলে বলল…”থাক আর সবার সামনে কান ধরতে হবে না…চলো”।
দুজনে পাশাপাশি আস্তে আস্তে হাঁটছি, হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু দুরে চলে যাবার পর ও আমার কাঁধে হাত রেখে একেবারে কাছে টেনে নিয়ে গা ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল…”কোথায় যাওয়া যায় বলো তো…বিচে বড্ড ভীড়”?
- আমি কি জানি…তুমি যেখানে নিয়ে যাবে…
- চলো…একটু দুরে একটা ঝাউ জঙ্গল আছে…খুব নিরিবিলি…বিশেষ কেউ যায়না ওদিকে…
- কিছু হবে না তো…নিরিবিলি জায়গা…খারাপ লোক থাকতে পারে…
- আমি আছি তো…ভরসা করতে পারছো না নাকি…
ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে বললাম…”ভরসা করি বলেই তো তোমার বুকে নিজেকে সঁপে দিতে পেরেছি”।
ও আমাকে ধরে থেকেই আস্তে করে আরো একটু নিজের সাথে চেপে ধরে হয়তো বোঝাতে চাইলো “তুমি আমাকে ভরসা করে কিছু ভুল করোনি”।
ও আমার কোমরে হাত রেখে ধরে আছে আর আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে আস্তে হাঁটছি। কেউ কেউ আমাদের ওইভাবে অন্তরঙ্গ অবস্থায় যেতে দেখে ফিরে ফিরে তাকালেই খুব রাগ হচ্ছিল, নিজের মনে মনে ভাবছিলাম…”আমি আমার বিচ্ছুর সাথে যা খুশি করবো…তোমাদের এত দেখার কি আছে”।
কিছুটা যাবার পর দেখলাম সামনেই একটা ঝাউ জঙ্গল আর তার সামনের বিচে প্রায় কেউ নেই, কয়েকজন জেলে নৌকো আর জাল নিয়ে কি সব করছে। আমরা আরো কিছুটা ঝাউ জঙ্গলের ভেতরে চলে গেলে, ও এদিক ওদিক দেখে বললো…”এসো...এখানেই বসি”।
ও একটা ঝাউ গাছে হেলান দিয়ে বালির উপরে পা ছড়িয়ে বসে আমার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিল। আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে ওর একটা হাত বুকে চেপে নিয়ে বসে আছি, ভীষন ভালো লাগছে…কথা বললে যদি নিজের ভালোলাগার অনুভুতিটা হারিয়ে যায় এই ভয়ে চুপ করে আছি। আমার মতোই ও চুপচাপ বসে আছে, কোনো কথা বলছে না… বোধহয় বুঝতে পেরেছিল আমার মনের ভাষা বা নিজেই হয়তো আমার মতোই নিজের ভালোলাগার অনুভুতিকে সম্পুর্ন ভাবে অনুভব করতে চাইছিল…দুজনে দুজনার স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে হারিয়ে যেতে যেতে জানি না কত সময় কেটে গেছে…ওর ডাকে মুখ তুলে তাকালাম...
- তিস্তা…
- উঁ…
- গান শোনাবে…
- উঁ হঁ…
- কেন?
- তুমি তো বলোনি…কেমন লেগেছিল সেদিন…বলার সময় কি এখোনো হয়নি?
- ভীষন ভালো লেগেছিল…
- আর কিছু মনে হয়নি?
- “তোমার অঝোর ধারায় ভিজে…আমি নতুন হলাম নিজে”…গানের এই কথা গুলোর ভেতর দিয়ে কি তুমি কিছু বোঝাতে চেয়েছিলে?
ওর প্রশ্নটা শুনে একটু সময় চুপ করে থেকে বললাম…”চেয়েছিলাম”...
- কি…
ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম...”আমার বিচ্ছুর সাথে দেখা হওয়ার আগের তিস্তা আর দেখা হওয়ার পরের তিস্তা যে এক ছিল না…বৃষ্টিতে ভিজে তিস্তা যদি নিজেকে নতুন করে না নেয়… বিচ্ছু তাকে কি করে নিজের করে নেবে বলো”? আমার উত্তর শুনে কিছু বুঝলো কিনা জানি না, ওকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম…”বুঝেছো”? ও আস্তে করে বলল...”না”।
আমি আগের মতোই ওর কাঁধে মাথা রেখে বললাম..”এখোনো সময় আসে নি বলার…পরে কোনোদিন বলব…বলো…কি গাইবো”...
- তুমি বলো…
ও আমার উপরেই ছেড়ে দিল দেখে ভাবছিলাম কি গাই, কিছুক্ষন ভেবে ভেবে কোনোটাই মনে ধরছিল না…তারপর আরো একটু ভেবে মনে হল...’আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলার আর শোনার পরে বোধহয়…’কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি’ গাওয়া সবথেকে ভালো হবে… মনে মনে নিজেকে তৈরী করে নিয়ে চোখ বুজে নিচু গলায় গাইতে শুরু করলাম, চাই না ও ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউ শুনুক আমার গান…
______________________________
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি…
কিছুতেই পাই না ভেবে…কে প্রথম ভালোবেসেছি…
তুমি না… আমি…
ডেকেছি কে আগে…কে দিয়েছে সাড়া
কার অনুরাগে…কে গো দিশাহারা…
ডেকেছি কে আগে…কে দিয়েছে সাড়া
কার অনুরাগে…কে গো দিশাহারা…
কে প্রথম মন জাগানোর সুখে ভেসেছি…
তুমি না… আমি
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি…
কিছুতেই পাই না ভেবে…কে প্রথম ভালোবেসেছি…
তুমি না… আমি…
কে প্রথম কথা দিয়েছি…
দুজনার এ দুটি হৃদয়…একাকার করে নিয়েছি…
শুরু হল কবে এত চাওয়া পাওয়া…
একই অনুভবে… একই গান গাওয়া…
শুরু হল কবে এত চাওয়া পাওয়া…
একই অনুভবে… একই গান গাওয়া…
কে প্রথম মন হারানোর… স্রোতে ভেসেছি
তুমি না… আমি…
কে প্রথম কাছে এসেছি…কে প্রথম চেয়ে দেখেছি…
কিছুতেই পাই না ভেবে…কে প্রথম ভালোবেসেছি…
তুমি না… আমি…
গানটা গাওয়ার পর নিজেরই মনে হচ্ছিল এত মন প্রান দিয়ে বোধহয় এর আগে কোনোদিন গাইনি। চুপ করে বসে থেকে অপেক্ষা করছিলাম ও কি বলে শোনার জন্য। ও আরো কিছুক্ষন উদাস হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল…”তুমিই আগে কাছে এসেছো, আমি পারিনি আগে আসতে”।
ওর কথাটা শুনে মনে হল...ওর কথাটা কিছুটা হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়...ও আমাকে কাছে আসার সুযোগ না দিলে কি আমিও এত তাড়াতাড়ি বলতে পারতাম...”আমি তোমাকে ভালোবাসি”।
নিজের বুকের ভেতরের কথা গুলো নিজের ভেতরেই আটকে রেখে আস্তে করে বললাম...”হয়তো আমরা দুজনেই একসাথে এসেছি”।
______________________________
প্রথম চুম্বন #
কতক্ষন বসে আছি আমরা পাশাপাশি জানি না, চারিদিকে কেউ নেই, শুধু আমরা দুজন দুজনের উষ্ণ সান্নিদ্ধ অনুভব করছি হৃদয় দিয়ে। ওর ডাকে যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে বললাম…”বলো”।
ও আস্তে করে বলল...”আমার দিকে তাকাও”।
মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম, ওর দু চোখে স্বপ্নের ছোঁয়া। আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কিছু যেন বলতে চাইছে…জানি না কি বলতে চাইছে তাই আবার বললাম…”বলো”।
ও স্বপ্নের ভেতর থেকে ফিরে এসে বলল… “চলো না…আরো একটু দুরে”।
দুজনে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছি, ও ধীর স্থির…আমার কিশোরী মনটা ফিরে এসেছে অতীত থেকে। ভীষন খুশীতে ছটপট করছি, নিজেই জানি না কি চাইছি …শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি নিজের বুকের ভেতরে পারছি না ধরে রাখতে এই খুশী… আজ আমি আর একা নই…কেউ আমাকে তার মনটা চুরি করতে দিয়েছে খুশী হয়ে…আমি লুকিয়ে রাখবো সেই চুরি করা মনটা আমার বুকের গভীরে…আর কেউ জানবে না সেই খবর…শুধু ও ছাড়া। ইস, শুধু কি আমি ওর মন চুরি করেছি? ওকেও তো দিয়েছি আমার এতদিনের সযত্নে আগলে রাখা মনটা...এত খুশীতে নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না...কখনও ওকে কাছে টেনে নিচ্ছি…কখোনো অকারনে নেচে উঠছি…কখনো বা গুনগুন করে কিছু গেয়ে উঠছি…নিজেই জানি না কি করতে চাইছি আর কেনই বা করতে চাইছি। শুধু বুঝতে পারছি ও আমাকে অবাক হয়ে দেখছে…বোঝার চেষ্টা করছে...এ কোন তিস্তা...তিস্তার এই রুপ তো আগে দেখিনি...উচ্ছল হতে দেখেছি ওকে কিন্তু এ যেন অন্যরকমের উচ্ছলতা। আরো কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও একটা ঝাউ গাছে হেলান দিয়ে…আমার দিকে তাকিয়ে আছে হাসি মুখে। ওর ওই পৃথিবী ভোলানো মন পাগল করা হাসিতে জানি না কি হ’ল আমার…ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো… কখন ওর চোখে চোখ রেখে আরো কাছে চলে গেছি জানিনা…দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কোনো কিছু পাবার আশায় মুখ তুলে তাকিয়ে আছি… ওর প্রশস্ত বুকে আমার শরীরের আলতো ছোঁয়া…ওর দুহাত আমার কাঁধে…ও আস্তে আস্তে মুখ নামিয়ে নিয়ে এলো... কিছু পাওয়ার আশায় আমার চোখ বুজে আসছে আপনা হতে...আমি চাইলেও পারবো না আর তাকিয়ে থাকতে... ওর ঠোঁট স্পর্শ করল আমার তির তির করে কেঁপে যাওয়া ঠোঁট দুটোকে। শিউরে উঠলাম জীবনের প্রথম ভালোবাসার চুম্বনে। শরীর মন ভরে উঠল ওই আলতো ঠোঁটের ছোঁয়ায়, যাতে নেই সব কিছু তছনছ করে দেবার কোনো ইচ্ছে…শুধু আছে হৃদয় ভরানো মিষ্টি অনুভুতি। নিজেকে সম্পুর্নভাবে সঁপে দিয়েছি ওর বুকে...চাই না আমি এই সুখের অনুভুতি হারিয়ে যাক।
______________________________
প্রথম সমুদ্রে স্নান #
হোটেলে ফিরে এসে দেখলাম মায়ের রুমে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আমাদেরকে ফিরে আসতে দেখে মা বলল…আরে তোরা আবার এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি কেন? কোথায় মেয়েটাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসবি তা নয়, গেলি আর এলি…কি রে তিস্তা…বাবাই নিশ্চয় তোর পেছনে লেগেছিল আবার? তিস্তা মায়ের পাসে বসে পড়ে জড়িয়ে ধরে বলল…না গো বম্মা…তোমার বিচ্ছু ছেলেটা আজ একটু ভালো হয়ে গেছে। মা কে বললাম…স্নান করতে যাবে তো নাকি…না হলে তো আর একটু পরেই আসা যেত…
- না না…তোরা যা…আমরা আজ কেউ বেরোচ্ছি না…দেখছিস না কেমন সুন্দর গল্প করছি…
- আচ্ছা…ফাজিল মেয়েটার দায় দায়িত্ব সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা বেশ মজা করা হচ্ছে…
বাবা পাশ থেকে হেসে বলল…আমরা তো এতদিন দায় দায়িত্ব নিয়েছি…বড় হয়েছো…দুদিন পর চাকরি বাকরি আর তারপর ঘর সংসার করতে হবে তো নাকি…এখন থেকে একটু আধটু অভ্যাস করাই ভালো। তিস্তা পাশ থেকে ফুট কাটলো…ঠিক বলেছো দাদাই…এখন থেকে অভ্যেস না করলে পরে ঝামেলায় পড়ে যাবে।
- দেখেছো মা…আমি কিছু বলেছি ওকে...এখন আমার পেছনে কেন লাগছে?
- মা কে বলে কিচ্ছু হবে না…শোধবোধ হয়ে গেল…তুমি আমাকে রান্না করে বর কে খাওয়াতে বলেছিলে না?
মা হেসে ফেলে বলল…আচ্ছা ঠিক আছে যা…তোরা স্নান করে আয়…ওকে একা ছাড়বি না কিন্তু…
আমি জামাকাপড় বদলে আসছি বলে বেরিয়ে আমাদের রুমে এলাম। তিস্তা পাশে ছিল বলে সিগারেট খেতে পারিনি। সর্টস টা পরে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম, একটু পরেই বেল বেজে উঠতে ফিরে গিয়ে দরজা খুলে দিলে তিস্তা ভেতরে এসে আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছুক্ষন দেখে বললো...খুব হ্যন্ডসাম লাগছে কিন্তু তোমাকে…আমার কিন্তু টেনশান বেড়ে যাচ্ছে। ওর টেনশানের কারন বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে কেন জিজ্ঞেস করাতে হাসি মুখে বলল...চারদিকে এত মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে…তাদের হাত থেকে তোমাকে সামলে রাখতে হবে তো। ওর কাঁধে দুহাত রেখে ওকে একটু কাছে টেনে নিয়ে বললাম…সুন্দরী…তোমার চিন্তা করিবার কারন নাই…আমি সারা জীবন আমার তিস্তাতেই অবগাহন করিতে চাই…অন্য কোনো নদীতে নামিবার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই। তারপরেই গেয়ে উঠলাম…আমি তোমারে সঁপেছি প্রান…ওগো…নর্থ বেঙ্গল বাসিনী। আমার মজা করে বলা কথা গুলো শুনে ও হেসে ফেলে বলল…তুমি না সত্যিই একটা পাজী…বম্মা ঠিকই বলে। ওর চোখে চোখ রেখে আস্তে করে বললাম...এই পাজীটাকেই কিন্তু ভালোবেসেছো। তিস্তা মুখটা একটু গোমড়া করে বলল…কি আর করা যাবে বলো…নিজেকে কত করে বোঝালাম…পাজিটার পাল্লায় পড়িস না…মন কিছুতেই বুঝলো না…তার নাকি তোমাকেই চাই। আমার মতোই ওকেও মজা করতে দেখে আমি হেসে ফেলাতে তিস্তাও হেসে ফেলে বলল…এই…দেরী হয়ে যাবে…চলো। হু...চলো বলাতে তিস্তা একটু থমকে গিয়ে চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…স্নান তো করবো…কিন্তু কি পরে যাই বলোতো…সালোয়ার কামিজ ভিজে গেলে বড্ড গায়ে সেঁটে যায়। একটু ভেবে বললাম…তুমি আমার একটা হাফ প্যান্ট আর টি সার্ট পরতে পারো…
- ধ্যাত…
- আরে…পরেই দেখো না…না ভালো লাগলে পরবে না…
আমার ব্যাগ থেকে ওকে কি কি দেওয়া যায় দেখে বের করে দিতে তিস্তা বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো। ওর টুকটুকে ফরসা শরীরে নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট আর টি সার্ট ভীষন ভালো মানিয়েছে…এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেলেদের পোষাক পরেও ওকে যেন আরো বেশি মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল। নিজেকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল...কেমন লাগছে…বাইরে যাওয়া যাবে তো? আমি মুগ্ধ চোখে ওকে দেখতে দেখতে আস্তে করে বললাম...একদম পারফেক্ট…তুমি যা পরো না কেন তোমাকে ভীষন মানিয়ে যায়…এরকম ড্রেস করলে আমি রোজ নতুন করে তোমার প্রেমে পড়তে রাজী আছি। ও নিজেকে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল…যাঃ…বাড়িয়ে বোলো না। আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম…একটাই জিনিস চেক করার আছে আর…
- কি?
- ব্রেসিয়ার আর প্যান্টি কি লাইট কালারের?
আমার প্রশ্ন শুনে ও একটু লজ্জা পেয়ে গেল…কিছু বললো না দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রেখে বললাম…বলো না…
- ডিপ ব্ল্যাক…
- পারফেক্ট…
তিস্তা আয়নার ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…কেন…তোমার কি দেখতে ইচ্ছে করছে?
- উঁ হুঁ…আমি আমার দেখার জন্য বলছি না…টি সার্ট আর প্যান্ট ভিজে গেলে…লাইট কালারের ব্রেসিয়ার আর প্যান্টি সব্বাইকে বলে দেবে তারা কোথায় আছে…
- আচ্ছা…এইসব দেখা হয়… না…অসভ্য কোথাকার…
- কি করবো বলো…চোখ তো আর আমার সব কথা শুনে চলে না…তার যেদিকে ইচ্ছে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে… আর…কেউ যদি নিজের থেকে দেখাতে চায়…আমি কি করতে পারি বলো…
মায়ের রুমে চাবি দিতে গিয়ে মাকে বললাম…মা দেখো তো…তিস্তাকে কেমন লাগছে…কিছুতেই পরতে চাইছিল না…ওকে নাকি বিচ্ছিরি লাগছে। মা ওর দিকে তাকিয়ে বলল...এ মা… কে বলেছে বিচ্ছিরি লাগছে…খুব ভালো মানিয়েছে তোকে। মা ভালো বলাতে ও খুব খুশী হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল…থ্যাঙ্ক ইউ বম্মা…
ও যেন এত সময় বাইরে বেরোবার অপেক্ষায় ছিল, হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়ে যথারীতি ও আবার আমার গায়ে সেঁটে গেছে। কিছুটা এদিক ওদিক ঘুরে একটু দূরে চলে গেলাম যেখানে খুব বেশী লোকজনের ভীড় নেই। ওর হাতটা ভালো ভাবে ধরে একটু একটু করে জলের দিকে এগোচ্ছিলাম…আমার ওকে ধরে থাকার হয়তো দরকার ছিল না, যে ভাবে আমাকে শক্ত করে ধরে গায়ের সাথে আটকে রেখেছে তাতে আলাদা হয়ে যাবার কোনো চান্স ছিল না। সেটা যতটা না প্রথম সমুদ্রে নামার ভয় তার থেকে বেশী আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য। ওকে নিয়ে খুব বেশী দূরে যাওয়া যাবে না, এই প্রথম সমুদ্রে নামছে…বিপদ হয়ে যেতে পারে। যদিও ওর ভয় পাওয়ার কথা কিন্তু আমি ওর সাথে আছি ভেবে হয়তো ওর মনে কোনো চিন্তা নেই, ও জানে আমি কোনো অবস্থাতেই ওর কিছু হতে দেবো না। একটা করে ঢেউ এসে আমাদেরকে ভেজাচ্ছে আর ও আমাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠছে…যেই ঢেউ ফিরে যাচ্ছে ওমনি আমাকে টেনে নিয়ে ঢেউ এর পেছন পেছন যাবার চেষ্টা করছে…আবার যেই ঢেউ আসছে আমাকে টেনে পেছনের দিকে চলে আসছে। কিছুক্ষন পর হাঁফিয়ে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো…
একটু পিছিয়ে এসে ওকে পাশে বসিয়ে জলের মধ্যে বসলাম। ও ওখানেই ঢেউ এর সাথে হুটোপুটি শুরু করে দিলে আমাকেও ওর সাথে তাল মেলাতে হচ্ছিল। ভীষন ভালো লাগছিল ওকে এইভাবে খুশী হতে দেখে। বেশ কিছুক্ষন স্নান করার পরে একটু একটু ঠান্ডা লাগছিল…ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল…শীত করছে…
- চলো এবারে উঠি...এর পরে কিন্তু আরো শীত করবে…
- করুক…আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না…বেশী শীত করলে তুমি আছো তো…
- আমি কি করবো?
- কিচ্ছু করতে হবে না…শুধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকবে…
মাথাটা একটু গরম হয়ে গেলে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল…তোমার কি মাথা খারাপ…এখানে সবার সামনে কি করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। ভাবছিলাম কি অবুঝ মেয়ে কে জানে, আমরা যেন বন্ধ ঘরের মধ্যে আছি যে ইচ্ছে হলেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরবো। চারদিকে কিছু হলেও লোকজন রয়েছে, তার মাঝে কি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরা ঠিক হবে? আমি তো চাইনা কেউ তা দেখে ভাবুক…ইস কি নির্লজ্জ মেয়ে। আমার গলার আওয়াজে হয়তো বুঝতে পেরেছিল আমি রেগে গেছি…একটু যেন আহত হল মনে মনে, আমাকে ছেড়ে একটু দুরে সরে গিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…চলো। খুব খারাপ লাগলো ওর খারাপ লেগেছে বুঝে। ভাবলাম ওই ভাবেই না বলে ওকে অন্যভাবে বোঝানো যেতে পারতো। ওর হাতটা ধরে কাছে টানলাম…নিজেকে শক্ত করে রেখে বলল…ছাড়ো। ওর এত খুশী আমি কিভাবে নষ্ট করলাম ভেবে নিজেকে অভিশাপ দিতে ইচ্চে করছিল। মুখ নিচু করে ভাবছিলাম কি করি এখন…একটু পরে তাকিয়ে দেখলাম ও অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। যা করার আমাকেই করতে হবে ভেবে ওর পাশে সরে গিয়ে বললাম…তিস্তা…প্লিজ…আমার দিকে তাকাও। ও আগের মতোই মুখ ঘুরিয়ে থাকলো, একটু যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীরটা। বুঝলাম না কাঁদছে নাকি শীত করছে ওর। মনে মনে ভাবলাম…ধুস…যে দেখবে দেখুক…যা খুশী ভাবুক…ওর কাঁধে হাত দিয়ে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বুকে টেনে নিলাম, ও নিজেকে তখোনো শক্ত করে রেখেছে দেখে বললাম…তিস্তা…প্লিজ...আমি বুঝতে পারিনি। ও দু হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকলো দেখে আর কিছু না বলে ওকে স্বাভাবিক হতে সময় দিলাম। অনেকটা সময় কেটে গেলেও কিছু বলছে না দেখে আস্তে আস্তে ডাকলাম…তিস্তা। আমার ডাক শুনেও চুপ করে থাকলো দেখে বুঝলাম না সমুদ্রের আওয়াজের মাঝে শুনতে পেয়েছে কিনা…আবার ডাকলাম…তিস্তা। এবারেও কোনো সাড়া নেই, শুধু একবার আমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে আবার আগের মতো রাখলো আর তার সাথে সাথে আমার বুকে নিজেকে আরো একটু জোরে চেপে ধরে বোঝালো ও নিজের মধ্যেই থাকতে চাইছে। একটু পরে আমার বুক থেকে নিজেকে আলাদা করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…আর একটু থাকবো?
- কোথায়?
ও আমার বুকে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে বোঝালো…আমার বুকে থাকতে চাইছে ও। মনে মনে বললাম…তোমাকে আমি সারা জীবনের মতো এখানে আটকে রাখতে চাই। আমার নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে ও আবার নিজেকে আমার বুকের সাথে মিশিয়ে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে আমার কাঁধ মাথা রাখলো…
ফেরার সময় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আসছিলাম, আমার হাত ওর হাতের বাঁধনে। ওর স্বভাব মতো বকবক করে যাচ্ছে এক নাগাড়ে যার সাথে তাল মেলানো খুব মুশকিল হচ্ছিল। মনেই হচ্ছিল না একটু আগে ও মন খারাপ করে বসেছিল। আমাকে হুঁ হাঁ করে উত্তর দিতে দেখে কি ভাবলো কে জানে…হটাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল…এই, তুমি কি এখোনো আমার উপরে রেগে আছো? কি মেয়ে কে জানে বাবা…কোথায় আমি ওকে বলব যে আমি বকেছিলাম বলে তুমি কিন্তু মনে রেখে দিওনা। উল্টে ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি রেগে আছি কিনা। আমার উত্তর দিতে একটু দেরী হচ্ছিল দেখে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল…ঠিক আছে…বুঝেছি…তুমি এখোনো আমার উপর রেগে আছো…আমি না সত্যিই খুব বোকা…কখন কি করা উচিত বুঝি না…কি করবো…বলো…তোমাকে কাছে পেলে আমার কেমন যেন মাথার ভেতরে সব গোলমাল পাকিয়ে যায়…এই…প্লিজ…আর কক্ষোনো ভুল হবে না। ওর কথা শুনে ভালো লাগার সাথে সাথে খুব হাসি পেয়ে গেল…মেয়েটা কি পাগল নাকি অন্য কিছু…আমি ওর হাতটা ধরে একটু গম্ভীর হয়ে বললাম…আর একটাও কথা নয়…লক্ষী মেয়ের মতো চলো…আমি কিন্তু খুব রেগে আছি…আর যদি একটা কথা বলেছো…আমি আরো রেগে যাবো। আমার সাথে এগোতে এগোতে একটু যেন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল…তুমি খুব রেগে আছো? আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না…হো হো করে হেসে বললাম…তোমাকে নিয়ে আমি যে কি করবো বুঝতে পারছি না…কোথায় আমি তোমাকে বকেছি বলে নিজের খারাপ লাগছে…কি বলা যায় তোমাকে ভাবছিলাম…তুমি উল্টে ভাবছো…আমি রেগে আছি। ও যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না আমি রাগ করে নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই বললাম…আর কোনো কথা নয়…ভেজা জামাকাপড়ে বেশী সময় থেকে জ্বর এসে গেলে… কাল তো আর জলে নামতে পারবে না …তখন কিন্তু তোমার বম্মা আমার হাল খারাপ করে দেবে…আমার না হয় যা হবে দেখা যাবে…তুমি কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাবে না…সেটা কি ভালো হবে?
ঝিনুকের মালা নয়, এ যে মুক্তোর মালা #