03-03-2021, 08:16 PM
আমার সমুদ্র দেখা #
দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কিভাবে কেটে গেল বুঝলাম না। রোজই বিচ্ছুর সাথে কোথাও না কোথাও গেছি। ও আমাকে এর মধ্যে একটা খুব সুন্দর ব্লু জিন্স আর টকটকে লাল টপ প্রেজেন্ট করেছে। আমি যদিও খুব একটা জিন্স পরিনা তাও ওর দেওয়া বলে খুব যত্ন করে রেখেছি, ইচ্ছে আছে বিশেষ কোনো দিনে পরার। ওকেও কিছু একটা দিতে ইচ্ছে করছে…কিন্তু কি দেবো কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না।
বেশ কয়েকদিন বাপি রোজ নিজের কি সব কাজে বেরিয়ে যেত কিন্তু আজ আর বেরোয় নি তাই আমিও কোথাও যাবো না ভাবছিলাম। দাদাই সকালে যথারীতি অফিসে চলে গেছে। আমি বম্মা আর বাপি বসে গল্প করছিলাম। বিচ্ছুটা আমাকে কিছুক্ষন জ্বালিয়ে মায়ের মিষ্টি বকুনি খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে গিটার বাজাচ্ছে।
বম্মা জিজ্ঞেস করল…অরুন…কাল বেরোবে নাকি?
কাল তো কিসের একটা যেন ছুটি আছে।
আরে তাই তো…কাল থেকে রবিবার, টানা তিন দিন ছুটি আছে…কাছাকাছি কোথাও গেলে তো ভালোই হয়। তিস্তা…মা…যা না…বাবাই কে ডেকে নিয়ে আয়…
জানলার দিকে মুখ করে বসে বিচ্ছুটা গিটার বাজাচ্ছিল খুব মন দিয়ে…বাজানোর হাত খুব সুন্দর…একেবারে নিঁখুতভাবে আমার প্রিয় একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজাচ্ছে…ওকে ডিসটার্ব না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনলাম…
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
তোমায় দেখেছি শারদ প্রাতে
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে
তোমায় দেখেছি…
হৃদি মাঝারে… ওগো বিদেশীনী
আমি আকাশে পাতিয়া কান…শুনেছি শুনেছি তোমারই গান
আমি তোমারে সপেঁছি আমার প্রান… ওগো বিদেশীনী
আমি আকাশে পাতিয়া কান…শুনেছি শুনেছি তোমারই গান
আমি তোমারে সপেঁছি আমার প্রান… ওগো বিদেশীনী
ভূবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নুতন দেশে
আমি অতিথি তোমারই দ্বারে ওগো বিদেশীনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
গানটা শেষ হয়ে গেলেও মনের ভেতরে একটা রেশ থেকে গেল…ভাবছিলাম…এ তো আমার গাওয়ার কথা…শুধু‘ওগো বিদেশীনির’ জায়গায় যদি ‘ওগো পরদেশী’ থাকতো…আমিই তো এখন ওর দ্বারে অতিথি…
ওর মাথার চুল গুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বললাম…এই…চলো…বম্মা ডাকছে…
কেন? আবার বকবে নাকি…
বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম হচ্ছে…তোমাকে দরকার…
ওঃ…কাজের সময় আমাকে চাই…আর একটু পেছন লাগলে…বকুনি খেতে হবে…যাবো না…যাও…
তাহলে গিয়ে বলি…তুমি আবার আমার পেছনে লেগেছো…আমার চুল ধরে টেনে দিয়েছো…
খুব মজা লাগছে না…বকা খাওয়াতে…
লাগছে তো…এই…চলো না…
গিটারটা হাত থেকে নাবিয়ে রেখে একপাক ঘুরে নিয়ে বলল…চলো যাই…ঘুরে আসি…পাশাপাশি…তুমি আছো…আমি আছি…
তারপর?
ভালোবাসি…
যত আওয়াজ মুখে…কাজে তো কিছু দেখছি না…
এই…কি বললে…দেখাবো নাকি চেষ্টা করে এখনই…তুমি কিন্তু আমাকে খুব আন্ডার এস্টিমেট করে যাচ্ছো…
না বাবা…আমার দেখে কি হবে…তুমি তোমার বান্ধবীদের কাছে গিয়ে দেখাও…
না না…আমি তোমাকেই দেখাবো…পারি কিনা…
আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে… না…এখন নয়… বলে দৌড় দিলাম একতলার দিকে…ও আমার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো…
দৌড়ে এসে বম্মার পাশে বসে পড়লাম…একটু পরেই ও এসে বলল…মা…তুমি আবার এই ফাজিল মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে…আমার গিটার বাজানোর দফারফা করে দিলো একেবারে…
বম্মা ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে নিয়ে বলল…গিটার পরে বাজাবি…কোথায় যাওয়া যায় বলতো…কাল থেকে টানা তিন দিন ছুটি আছে…
দীঘা নাহলে বকখালি যাওয়া যেতে পারে…
ঠিক বলেছিস…দীঘা যাই…তিস্তা কোনোদিন সমুদ্র দেখে নি…কাল সকাল সকাল বেরোনো যেতে পারে…এক কাজ কর না …তোর বাবাকে একবার ফোন কর…
যত চিন্তা তিস্তার জন্য…আমি যেন বন্যার জলে ভেসে এসেছি…বলে…উঠে গিয়ে ফোনটা নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করল…কিছুক্ষন কথা বলে ফিরে এসে বলল…বাবা বলল…আজ বেরোলে কেমন হয়…
এত তাড়াতাড়ি কি করে বেরোবো…কিছু গোছানো নেই…অরুন তুমি যেতে পারবে তো?
বাপি বলল…না না…অসুবিধের কি আছে…
এখন মোটে বারোটা বাজে …সাড়ে চার কি পাঁচটায় বেরোতে পারবে না? যাওয়ার সময় বাবাকে অফিস থেকে তুলে নেবো…দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবো…
ওখানে গিয়ে এত রাতে হোটেল পাবি কি পাবি না…
আরে তুমি চিন্তা কোরো না তো মা…তুমি গুছিয়ে নাও…আমি হোটেল দেখছি…আবার উঠে গিয়ে কাকে সব যেন ফোন করে ফিরে এসে বলল…হোটেল বুক করে দিয়েছি…হোটেল সি হক…আর কোনো চিন্তা নাই…চলো যাই… ঘুরে আসি… বলেই আমার দিকে তাকালো।
আমার তো বুক ধুকপুক করছে তখন…আবার না গেয়ে ওঠে…তুমি আছো…আমি আছি…পাশাপাশি…ভালোবাসি…
বাপি আর বম্মার চোখ এড়িয়ে ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই ইশারা করে বলল…ভয় নেই…
দাদাই কে অফিস থেকে তুলে নিয়ে বেরোতে বেরোতে সাড়ে পাঁচটা বাজলো…সেকেন্ড হুগলী ব্রিজে সেদিন ওঠা হয়নি…আজ পেরোতে গিয়ে ভালো করে দেখলাম…ব্রিজের উপর থেকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে…ছোটো ছোটো নৌকো গুলো ভেসে যাচ্ছে…বেশ কিছুটা যাওয়ার পর হাইওয়েতে উঠলাম…ওটা নাকি বম্বে রোড…সৃজন গাড়ী চালাতে চালাতে বলে দিচ্ছিল এটা কি ওটা কি…পেছনে বাপি, বম্মা আর দাদাই নিজেদের ভেতরে গল্প করতে করতে খুব হাসাহাসি করছিল। বম্মা বলে দিয়েছিল গাড়ী চালাবার সময় আমি যেন সৃজনের সাথে বেশী কথা না বলি…একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই বিপদ হতে পারে। বেশীর ভাগটাই চুপচাপ এদিক ওদিক দেখছিলাম। বম্মা বলল…তিস্তা পেছনে আসবি? তোর দাদাই সামনে গিয়ে বসতে পারবে…
না না…আমি ঠিক আছি…তোমরা গল্প কর…মনে মনে ভাবলাম…মাথা খারাপ নাকি…বিচ্ছুটার পাশ থেকে উঠতে আমার বয়ে গেছে…
খুব ইচ্ছে করছিল দুষ্টু ছেলেটার হাতে সেদিনের মতো হাত রাখি…কিন্তু হবে না…আজকালকার গাড়ী গুলোর সামনের সীট দুটো আলাদা আলাদা…মাঝখানে অনেকটা খোলা থাকায় পেছন থেকে সব দেখা যায়। জানলার দিকে চেপে তেরছা হয়ে বসে ড্রাইভিং সিটের দিকে পা ছড়িয়ে বসেছিলাম যাতে পা না ব্যাথা করে আর ওকেও দেখতে পারি, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেলে পেছন থেকে বোঝা যাবে। একটুপরেই তো অন্ধকার হয়ে যাবে…আর হাইওয়েতে কোনো আলো দেখছি না…তখন একবার ওর হাতটা ধরতে পারবো…ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম…পায়ে কিসের যেন খোঁচা লাগতে কিছু না ভেবে পা সরিয়ে নিলাম…একটু পরেই আবার…নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি…বিচ্ছুটা পা সরিয়ে নিচ্ছে…আড় চোখে ওর দিকে তাকালাম…যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না এমন ভাব করে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে।
বম্মাদের কান বাঁচিয়ে…আস্তে করে বললাম…এই…কি হচ্ছে এটা…
কিছু যেন জানে না…ভাব করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…কিছু বললে?
ইশারা করে বললাম…এখন নয়…পরে…দেখতে পাবে তো।
আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে ইশারা করে বলল…আচ্ছা ঠিক আছে…
কি সাঙ্ঘাতিক ছেলে কে জানে বাবা…তার পরেই বেশ জোরে জিজ্ঞেস করল …কি দেখতে পাবে?
ইশারা করে চুপ করতে বললাম কিন্তু শুনলে তো…আবার জোরে বলে উঠল…এই তো তুমি বললে…দেখতে পাবে…
আমিও জোরে জোরে বললাম…আমি কিচ্ছু বলিনি তোমায়…গাড়ী চালাবার সময় মন দিয়ে গাড়ী চালাতে পারো না? বৃষ্টি হচ্ছে…কোথায় কি হয়ে যাবে…
গাড়ী চালাচ্ছি না তো কি দাঁড়িয়ে আছি?
বম্মা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল…কি হয়েছে রে…আবার তোরা খুনসুটি করছিস?
দাদাই বলল…আরে করতে দাও না…এই বয়সে করবে না তো আর কবে করবে। দুটোতেই তো এক একা বড় হয়েছে…ভাই বোন থাকলে না হয় একটু খুনসুটি ঝগড়া করতে পারতো…
মনে মনে ভাবলাম…ইস…বিচ্ছুটার বোন হতে আমার বয়ে গেছে…
একটু পরেই রাস্তার ধারে একটা দোকানের সামনে গাড়ী দাঁড় করিয়ে বলল…মা…মেচেদা এসে গেছে…গরম গরম চপ খাবে নাকি? নিজেই নেমে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে গিয়ে কোথা থেলে একটা ছাতা ম্যানেজ করে নিয়ে এসে বলল…এক এক করে নেমে এসো…আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি…
বাপিদেরকে দোকানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে…দরজা খুলে বলল…কই এসো…
যাবো না…যাও…পাজী কোথাকার…
এই দেখো…তুমি এখানে থাকলে আমিও তো যেতে পারবো না…সবাই কি ভাববে তখন…তোমার জন্যই তো ছাতা নিয়ে এলাম…
ইস…উনি আমার জন্য ছাতা নিয়ে এসেছেন…মিথ্যুক কোথাকার…
গাড়িতে তিনটে ছাতা আছে…মা জানে না…ওগুলো বের করলে কি তোমাকে একা একা নিয়ে যেতে পারতাম নাকি…
বম্মা বুঝতে পারলে…কি হবে…
ও আমি ম্যানেজ করে নেবো…তুমি এসো তো…
আমি গাড়ী থেকে নেমে ওর পাশে দাঁড়ালাম…গাড়ির দরজাটা রিমোট লক করে দিয়ে আমার পেছন দিয়ে ডান হাতটা ঘুরিয়ে নিয়ে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল…চল…
ওর হাতে একটা আলতো ভাবে চিমটি কেটে বললাম…খুব সখ… না…সবার সামনে দিয়ে এইভাবে যাওয়া যায় নাকি?
তুমি চলো তো…বৃষ্টি হচ্ছে…কেউ দেখলেও কিছু বুঝবে না…
একটু এগিয়ে একটা পান সিগারেটের দোকানের দিকে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল…আমি ওর দিকে তাকাতেই বলল…ভাগ্যিস বৃষ্টি হচ্ছে
কি হয়েছে তাতে?
বৃষ্টি না হলে তোমাকে এতো কাছে পেতাম কি?
দোকানের ছেলেটাকে এটা আছে নাকি ওটা আছে নাকি আর তার সাথে দাম কত জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল,তারপর এক প্যাকেট সিগারেট, দেশলাই নিজের পকেটে ঢুকিয়ে আর একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল আমার হাতে দিয়ে বলল…চলো…
তুমি এই কটা জিনিষ নিতে এত সময় নিলে কেন…এমন করছিলে যেন পুরো দোকানটাই কিনে নেবে…
ছাতাটা এমনিতেই নিচু করে ধরেছিল…আরো একটু নিচু করে কানের লতিতে আলতো কামড়ে দিয়ে বলল…তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না…
আস্তে ক রে বললাম...প্লিজ… বম্মা যেন বুঝতে না পারে…পৌঁছোনোর আগে তোমার হাতটা সরিয়ে নিও…
বাপিরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ঢুকতেই বম্মা বলল…কি রে তোরা এতো সময় কোথায় ছিলি…চপ গুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…
আর বোলোনা মা…তোমার এই পাগল মেয়েকে নিয়ে আমি এবার সত্যিই পাগল হয়ে যাবো…চপ খেলে নাকি কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতেই হবে আর সেটা এক্কেবারে ঠান্ডা না হলে চলবে না…চার চারটে দোকান ঘুরে তবে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল ওর পছন্দ হল…
কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না…কি সুন্দর ম্যানেজ করল…যত রকমের দুষ্টু বুদ্ধি সব বোধহয় ওর মাথায় আছে…
চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললাম…কে তোমাকে আমার সাথে থাকতে বলেছিল…আমি একা আনতে পারতাম না নাকি…সব ব্যাপারেই মায়ের কাছ নালিশ করা চাই…
ইস…তোমাকে একা ছেড়ে এসে আমি মায়ের কাছে বকুনি খাই আর কি…
খেয়ে টেয়ে ওখান থেকে বেরোলাম যখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে…বেশ কিছুটা যাওয়ার পর আমরা হাইওয়ে থেকে ঘুরে গিয়ে একটা রাস্তায় ঢুকলাম… মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে কিছু ছোটো ছোটো দোকান ছাড়া বাকিটা ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে মনে হল রাস্তাটা গেছে…এখন আর উল্টোদিক থেকে গাড়ী প্রায় আসছেই না…আমাদের গাড়ীর ভেতরটা এখন প্রায় অন্ধকার…পেছন থেকে কোনো আওয়াজ আসছেনা দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম…সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে…
আস্তে আস্তে ডান হাতটা নিয়ে গিয়ে ওর পায়ের উপরে রাখলাম… বাঁ হাতটা স্টিয়ারিং থেকে নামিয়ে আমার হাতের উপর রেখে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনটা দেখে নিয়ে আমার হাতটা নিয়ে ওর বুকের উপর রেখে ধরে থাকল…ওর বুকের ধুক পুক আওয়াজ অনুভব করতে করতে ভাবছিলাম…কিছু কি বলতে চাইছে…চাইছে তো বলছে না কেন…
দুর থেকে আলো দেখতে পেলে ওর বুকের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আবার অন্ধকার হয়ে গেলে ওকে ছুঁয়ে বসে থাকছিলাম…ওকে এইভাবে লুকোচুরি করে ছুঁতে ছুঁতে ভীষন ইচ্ছে হচ্ছিল একবার জড়িয়ে ধরি…নিজেই নিজেকে বকুনি দিচ্ছিলাম…খুব সাহস না…
ঘন্টা দুয়েক পর বলল…মায়েদের কে ডেকে দাও…প্রায় পৌছে গেছি…মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল…আর ওকে ছুঁতে পারবো না ভেবে…
হোটেলে ঢুকে ঘড়ি দেখলাম… প্রায় দশটা বাজে। হোটেলটা বেশ সুন্দর…আমাদের তিনটে রুম…আমাকে আর বম্মাকে একটা রুমে পৌছে দিয়ে বলল…তোমরা ফ্রেস হয়ে নাও…আমরা একটু পরে আসছি…তারপর কে কোথায় শোবে আর ডিনারের ব্যাপারটা ঠিক করা যাবে।
ইস…এতদুর থেকে এলাম সমুদ্র দেখবো বলে…
বম্মা বললো…সামনেই সমুদ্র…খেয়ে নিয়ে তারপর সবাই যাবো…
সবাই ফ্রেস হয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম…বম্মা মেনু দেখে অর্ডার দেবার আগে কে কি খাবে জিজ্ঞেস করতে বাপি আর দাদাই দুজনেই বললো…তুমি দেখে বলে দাও না…এখানকার স্পেশাল কিছু যদি থাকে। বম্মা ওয়েটারকে ডেকে মুচমুচে আলু ভাজা, মুগ ডাল, পার্শে মাছের ভাজা, সরষে চিংড়ি আর দই ইলিশ দিতে বলে দিল।
বাপি খেতে খেতে বম্মাকে বলল…দারুন রান্না করেছে কিন্তু…ভালো রান্না তো খাওয়ার সুযোগই পাই না…তোমাদের কাছে এসে কতদিন পর ভালো মন্দ খেতে পাচ্ছি।
দাদাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল…কি রে তিস্তা…তোর বম্মার কাছে রান্না শিখবি নাকি…বাপিকে মাঝে মাঝে রেঁধে খাওয়াতে পারবি…
আমি আলু ভাজা আর ডাল বানাতে পারি কিন্তু…
বম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল…আমার মেয়ে এর মধ্যে একটা শিখে নিয়েছে…কাল সারাক্ষন তো আমার সাথে রান্না ঘরে কাটালো…কি রে মা…বাপিকে রান্না করে খাওয়াবি তো…
বিচ্ছুটা মাঝখান থেকে ফুট কাটলো…এখন বাপিকে খাওয়াবে আর ভবিষ্যতে বরকে খাওয়াতে হবে কিন্তু…যে কদিন আছো…মায়ের কাছে সব শিখে নিও…
এই…ভালো হবে না বলছি…দেখেছো বম্মা…আবার আমার পেছনে লাগছে…
খাওয়ার পর সবাই মিলে বেরোলাম…আকাশে এখন আর ঘন মেঘ নেই…ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে…মনে হয় পূর্নিমা…আমাদের হোটেলটা একেবারে বিচের পাশেই…হোটেলের বাগান থেকেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে…চাঁদের আলোতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল…একটার পর একটা ঢেউ গর্জন করতে করতে পাড়ের দিকে এসে আছড়ে পড়ছিল…অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম…
দশটার পরে নাকি বিচে যেতে দেয় না তাই হোটেলের বাগানের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাপিরা কিছুক্ষন বসে গল্প করার পর বলল…চলো…এবারে শুতে যাই…এত রাস্তাগাড়ী জার্নি করে এসে ক্লান্ত লাগছে…
আমার উঠতে ইচ্ছে করছিল না…বাপির হাত জড়িয়ে ধরে বললাম…বাপি আর একটু বোসো না…
বম্মা বলল…আচ্ছা ঠিক আছে তুই বোস…বাবাই থাকুক…খুব বেশী দেরী করবি না কিন্তু…
সবাই চলে যাবার পর বিচ্ছুটা আমার থেকে একটু দুরে বসে সিগারেট হাতে নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল…হঠাৎ আবার কি হল কে জানে…একটু আগেও তো সবার সাথে কথা বলছিল…এখন দেখে মনে হচ্ছে আমাকে চেনেই না…ভীষন খারাপ লাগতে সুরু করল…আমি কার জন্য থাকবো বললাম এখানে…আমি কি জানতাম না নাকি যে আমি আরো কিছুটা সময় থাকবো বললে ওকে আমার কাছে রেখে সবাই ফিরে যাবে…ভীষন কান্না পেয়ে গেল…
দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কিভাবে কেটে গেল বুঝলাম না। রোজই বিচ্ছুর সাথে কোথাও না কোথাও গেছি। ও আমাকে এর মধ্যে একটা খুব সুন্দর ব্লু জিন্স আর টকটকে লাল টপ প্রেজেন্ট করেছে। আমি যদিও খুব একটা জিন্স পরিনা তাও ওর দেওয়া বলে খুব যত্ন করে রেখেছি, ইচ্ছে আছে বিশেষ কোনো দিনে পরার। ওকেও কিছু একটা দিতে ইচ্ছে করছে…কিন্তু কি দেবো কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না।
বেশ কয়েকদিন বাপি রোজ নিজের কি সব কাজে বেরিয়ে যেত কিন্তু আজ আর বেরোয় নি তাই আমিও কোথাও যাবো না ভাবছিলাম। দাদাই সকালে যথারীতি অফিসে চলে গেছে। আমি বম্মা আর বাপি বসে গল্প করছিলাম। বিচ্ছুটা আমাকে কিছুক্ষন জ্বালিয়ে মায়ের মিষ্টি বকুনি খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে গিটার বাজাচ্ছে।
বম্মা জিজ্ঞেস করল…অরুন…কাল বেরোবে নাকি?
কাল তো কিসের একটা যেন ছুটি আছে।
আরে তাই তো…কাল থেকে রবিবার, টানা তিন দিন ছুটি আছে…কাছাকাছি কোথাও গেলে তো ভালোই হয়। তিস্তা…মা…যা না…বাবাই কে ডেকে নিয়ে আয়…
জানলার দিকে মুখ করে বসে বিচ্ছুটা গিটার বাজাচ্ছিল খুব মন দিয়ে…বাজানোর হাত খুব সুন্দর…একেবারে নিঁখুতভাবে আমার প্রিয় একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজাচ্ছে…ওকে ডিসটার্ব না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনলাম…
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
তোমায় দেখেছি শারদ প্রাতে
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে
তোমায় দেখেছি…
হৃদি মাঝারে… ওগো বিদেশীনী
আমি আকাশে পাতিয়া কান…শুনেছি শুনেছি তোমারই গান
আমি তোমারে সপেঁছি আমার প্রান… ওগো বিদেশীনী
আমি আকাশে পাতিয়া কান…শুনেছি শুনেছি তোমারই গান
আমি তোমারে সপেঁছি আমার প্রান… ওগো বিদেশীনী
ভূবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নুতন দেশে
আমি অতিথি তোমারই দ্বারে ওগো বিদেশীনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী
তুমি থাকো সিন্ধুপারে ওগো বিদেশীনী
গানটা শেষ হয়ে গেলেও মনের ভেতরে একটা রেশ থেকে গেল…ভাবছিলাম…এ তো আমার গাওয়ার কথা…শুধু‘ওগো বিদেশীনির’ জায়গায় যদি ‘ওগো পরদেশী’ থাকতো…আমিই তো এখন ওর দ্বারে অতিথি…
ওর মাথার চুল গুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বললাম…এই…চলো…বম্মা ডাকছে…
কেন? আবার বকবে নাকি…
বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম হচ্ছে…তোমাকে দরকার…
ওঃ…কাজের সময় আমাকে চাই…আর একটু পেছন লাগলে…বকুনি খেতে হবে…যাবো না…যাও…
তাহলে গিয়ে বলি…তুমি আবার আমার পেছনে লেগেছো…আমার চুল ধরে টেনে দিয়েছো…
খুব মজা লাগছে না…বকা খাওয়াতে…
লাগছে তো…এই…চলো না…
গিটারটা হাত থেকে নাবিয়ে রেখে একপাক ঘুরে নিয়ে বলল…চলো যাই…ঘুরে আসি…পাশাপাশি…তুমি আছো…আমি আছি…
তারপর?
ভালোবাসি…
যত আওয়াজ মুখে…কাজে তো কিছু দেখছি না…
এই…কি বললে…দেখাবো নাকি চেষ্টা করে এখনই…তুমি কিন্তু আমাকে খুব আন্ডার এস্টিমেট করে যাচ্ছো…
না বাবা…আমার দেখে কি হবে…তুমি তোমার বান্ধবীদের কাছে গিয়ে দেখাও…
না না…আমি তোমাকেই দেখাবো…পারি কিনা…
আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে… না…এখন নয়… বলে দৌড় দিলাম একতলার দিকে…ও আমার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো…
দৌড়ে এসে বম্মার পাশে বসে পড়লাম…একটু পরেই ও এসে বলল…মা…তুমি আবার এই ফাজিল মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে…আমার গিটার বাজানোর দফারফা করে দিলো একেবারে…
বম্মা ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে নিয়ে বলল…গিটার পরে বাজাবি…কোথায় যাওয়া যায় বলতো…কাল থেকে টানা তিন দিন ছুটি আছে…
দীঘা নাহলে বকখালি যাওয়া যেতে পারে…
ঠিক বলেছিস…দীঘা যাই…তিস্তা কোনোদিন সমুদ্র দেখে নি…কাল সকাল সকাল বেরোনো যেতে পারে…এক কাজ কর না …তোর বাবাকে একবার ফোন কর…
যত চিন্তা তিস্তার জন্য…আমি যেন বন্যার জলে ভেসে এসেছি…বলে…উঠে গিয়ে ফোনটা নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করল…কিছুক্ষন কথা বলে ফিরে এসে বলল…বাবা বলল…আজ বেরোলে কেমন হয়…
এত তাড়াতাড়ি কি করে বেরোবো…কিছু গোছানো নেই…অরুন তুমি যেতে পারবে তো?
বাপি বলল…না না…অসুবিধের কি আছে…
এখন মোটে বারোটা বাজে …সাড়ে চার কি পাঁচটায় বেরোতে পারবে না? যাওয়ার সময় বাবাকে অফিস থেকে তুলে নেবো…দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবো…
ওখানে গিয়ে এত রাতে হোটেল পাবি কি পাবি না…
আরে তুমি চিন্তা কোরো না তো মা…তুমি গুছিয়ে নাও…আমি হোটেল দেখছি…আবার উঠে গিয়ে কাকে সব যেন ফোন করে ফিরে এসে বলল…হোটেল বুক করে দিয়েছি…হোটেল সি হক…আর কোনো চিন্তা নাই…চলো যাই… ঘুরে আসি… বলেই আমার দিকে তাকালো।
আমার তো বুক ধুকপুক করছে তখন…আবার না গেয়ে ওঠে…তুমি আছো…আমি আছি…পাশাপাশি…ভালোবাসি…
বাপি আর বম্মার চোখ এড়িয়ে ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই ইশারা করে বলল…ভয় নেই…
দাদাই কে অফিস থেকে তুলে নিয়ে বেরোতে বেরোতে সাড়ে পাঁচটা বাজলো…সেকেন্ড হুগলী ব্রিজে সেদিন ওঠা হয়নি…আজ পেরোতে গিয়ে ভালো করে দেখলাম…ব্রিজের উপর থেকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে…ছোটো ছোটো নৌকো গুলো ভেসে যাচ্ছে…বেশ কিছুটা যাওয়ার পর হাইওয়েতে উঠলাম…ওটা নাকি বম্বে রোড…সৃজন গাড়ী চালাতে চালাতে বলে দিচ্ছিল এটা কি ওটা কি…পেছনে বাপি, বম্মা আর দাদাই নিজেদের ভেতরে গল্প করতে করতে খুব হাসাহাসি করছিল। বম্মা বলে দিয়েছিল গাড়ী চালাবার সময় আমি যেন সৃজনের সাথে বেশী কথা না বলি…একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই বিপদ হতে পারে। বেশীর ভাগটাই চুপচাপ এদিক ওদিক দেখছিলাম। বম্মা বলল…তিস্তা পেছনে আসবি? তোর দাদাই সামনে গিয়ে বসতে পারবে…
না না…আমি ঠিক আছি…তোমরা গল্প কর…মনে মনে ভাবলাম…মাথা খারাপ নাকি…বিচ্ছুটার পাশ থেকে উঠতে আমার বয়ে গেছে…
খুব ইচ্ছে করছিল দুষ্টু ছেলেটার হাতে সেদিনের মতো হাত রাখি…কিন্তু হবে না…আজকালকার গাড়ী গুলোর সামনের সীট দুটো আলাদা আলাদা…মাঝখানে অনেকটা খোলা থাকায় পেছন থেকে সব দেখা যায়। জানলার দিকে চেপে তেরছা হয়ে বসে ড্রাইভিং সিটের দিকে পা ছড়িয়ে বসেছিলাম যাতে পা না ব্যাথা করে আর ওকেও দেখতে পারি, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেলে পেছন থেকে বোঝা যাবে। একটুপরেই তো অন্ধকার হয়ে যাবে…আর হাইওয়েতে কোনো আলো দেখছি না…তখন একবার ওর হাতটা ধরতে পারবো…ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম…পায়ে কিসের যেন খোঁচা লাগতে কিছু না ভেবে পা সরিয়ে নিলাম…একটু পরেই আবার…নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি…বিচ্ছুটা পা সরিয়ে নিচ্ছে…আড় চোখে ওর দিকে তাকালাম…যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না এমন ভাব করে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে।
বম্মাদের কান বাঁচিয়ে…আস্তে করে বললাম…এই…কি হচ্ছে এটা…
কিছু যেন জানে না…ভাব করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…কিছু বললে?
ইশারা করে বললাম…এখন নয়…পরে…দেখতে পাবে তো।
আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে ইশারা করে বলল…আচ্ছা ঠিক আছে…
কি সাঙ্ঘাতিক ছেলে কে জানে বাবা…তার পরেই বেশ জোরে জিজ্ঞেস করল …কি দেখতে পাবে?
ইশারা করে চুপ করতে বললাম কিন্তু শুনলে তো…আবার জোরে বলে উঠল…এই তো তুমি বললে…দেখতে পাবে…
আমিও জোরে জোরে বললাম…আমি কিচ্ছু বলিনি তোমায়…গাড়ী চালাবার সময় মন দিয়ে গাড়ী চালাতে পারো না? বৃষ্টি হচ্ছে…কোথায় কি হয়ে যাবে…
গাড়ী চালাচ্ছি না তো কি দাঁড়িয়ে আছি?
বম্মা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল…কি হয়েছে রে…আবার তোরা খুনসুটি করছিস?
দাদাই বলল…আরে করতে দাও না…এই বয়সে করবে না তো আর কবে করবে। দুটোতেই তো এক একা বড় হয়েছে…ভাই বোন থাকলে না হয় একটু খুনসুটি ঝগড়া করতে পারতো…
মনে মনে ভাবলাম…ইস…বিচ্ছুটার বোন হতে আমার বয়ে গেছে…
একটু পরেই রাস্তার ধারে একটা দোকানের সামনে গাড়ী দাঁড় করিয়ে বলল…মা…মেচেদা এসে গেছে…গরম গরম চপ খাবে নাকি? নিজেই নেমে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে গিয়ে কোথা থেলে একটা ছাতা ম্যানেজ করে নিয়ে এসে বলল…এক এক করে নেমে এসো…আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি…
বাপিদেরকে দোকানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে…দরজা খুলে বলল…কই এসো…
যাবো না…যাও…পাজী কোথাকার…
এই দেখো…তুমি এখানে থাকলে আমিও তো যেতে পারবো না…সবাই কি ভাববে তখন…তোমার জন্যই তো ছাতা নিয়ে এলাম…
ইস…উনি আমার জন্য ছাতা নিয়ে এসেছেন…মিথ্যুক কোথাকার…
গাড়িতে তিনটে ছাতা আছে…মা জানে না…ওগুলো বের করলে কি তোমাকে একা একা নিয়ে যেতে পারতাম নাকি…
বম্মা বুঝতে পারলে…কি হবে…
ও আমি ম্যানেজ করে নেবো…তুমি এসো তো…
আমি গাড়ী থেকে নেমে ওর পাশে দাঁড়ালাম…গাড়ির দরজাটা রিমোট লক করে দিয়ে আমার পেছন দিয়ে ডান হাতটা ঘুরিয়ে নিয়ে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল…চল…
ওর হাতে একটা আলতো ভাবে চিমটি কেটে বললাম…খুব সখ… না…সবার সামনে দিয়ে এইভাবে যাওয়া যায় নাকি?
তুমি চলো তো…বৃষ্টি হচ্ছে…কেউ দেখলেও কিছু বুঝবে না…
একটু এগিয়ে একটা পান সিগারেটের দোকানের দিকে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল…আমি ওর দিকে তাকাতেই বলল…ভাগ্যিস বৃষ্টি হচ্ছে
কি হয়েছে তাতে?
বৃষ্টি না হলে তোমাকে এতো কাছে পেতাম কি?
দোকানের ছেলেটাকে এটা আছে নাকি ওটা আছে নাকি আর তার সাথে দাম কত জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল,তারপর এক প্যাকেট সিগারেট, দেশলাই নিজের পকেটে ঢুকিয়ে আর একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল আমার হাতে দিয়ে বলল…চলো…
তুমি এই কটা জিনিষ নিতে এত সময় নিলে কেন…এমন করছিলে যেন পুরো দোকানটাই কিনে নেবে…
ছাতাটা এমনিতেই নিচু করে ধরেছিল…আরো একটু নিচু করে কানের লতিতে আলতো কামড়ে দিয়ে বলল…তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না…
আস্তে ক রে বললাম...প্লিজ… বম্মা যেন বুঝতে না পারে…পৌঁছোনোর আগে তোমার হাতটা সরিয়ে নিও…
বাপিরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ঢুকতেই বম্মা বলল…কি রে তোরা এতো সময় কোথায় ছিলি…চপ গুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…
আর বোলোনা মা…তোমার এই পাগল মেয়েকে নিয়ে আমি এবার সত্যিই পাগল হয়ে যাবো…চপ খেলে নাকি কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতেই হবে আর সেটা এক্কেবারে ঠান্ডা না হলে চলবে না…চার চারটে দোকান ঘুরে তবে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল ওর পছন্দ হল…
কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না…কি সুন্দর ম্যানেজ করল…যত রকমের দুষ্টু বুদ্ধি সব বোধহয় ওর মাথায় আছে…
চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললাম…কে তোমাকে আমার সাথে থাকতে বলেছিল…আমি একা আনতে পারতাম না নাকি…সব ব্যাপারেই মায়ের কাছ নালিশ করা চাই…
ইস…তোমাকে একা ছেড়ে এসে আমি মায়ের কাছে বকুনি খাই আর কি…
খেয়ে টেয়ে ওখান থেকে বেরোলাম যখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে…বেশ কিছুটা যাওয়ার পর আমরা হাইওয়ে থেকে ঘুরে গিয়ে একটা রাস্তায় ঢুকলাম… মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে কিছু ছোটো ছোটো দোকান ছাড়া বাকিটা ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে মনে হল রাস্তাটা গেছে…এখন আর উল্টোদিক থেকে গাড়ী প্রায় আসছেই না…আমাদের গাড়ীর ভেতরটা এখন প্রায় অন্ধকার…পেছন থেকে কোনো আওয়াজ আসছেনা দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম…সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে…
আস্তে আস্তে ডান হাতটা নিয়ে গিয়ে ওর পায়ের উপরে রাখলাম… বাঁ হাতটা স্টিয়ারিং থেকে নামিয়ে আমার হাতের উপর রেখে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনটা দেখে নিয়ে আমার হাতটা নিয়ে ওর বুকের উপর রেখে ধরে থাকল…ওর বুকের ধুক পুক আওয়াজ অনুভব করতে করতে ভাবছিলাম…কিছু কি বলতে চাইছে…চাইছে তো বলছে না কেন…
দুর থেকে আলো দেখতে পেলে ওর বুকের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আবার অন্ধকার হয়ে গেলে ওকে ছুঁয়ে বসে থাকছিলাম…ওকে এইভাবে লুকোচুরি করে ছুঁতে ছুঁতে ভীষন ইচ্ছে হচ্ছিল একবার জড়িয়ে ধরি…নিজেই নিজেকে বকুনি দিচ্ছিলাম…খুব সাহস না…
ঘন্টা দুয়েক পর বলল…মায়েদের কে ডেকে দাও…প্রায় পৌছে গেছি…মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল…আর ওকে ছুঁতে পারবো না ভেবে…
হোটেলে ঢুকে ঘড়ি দেখলাম… প্রায় দশটা বাজে। হোটেলটা বেশ সুন্দর…আমাদের তিনটে রুম…আমাকে আর বম্মাকে একটা রুমে পৌছে দিয়ে বলল…তোমরা ফ্রেস হয়ে নাও…আমরা একটু পরে আসছি…তারপর কে কোথায় শোবে আর ডিনারের ব্যাপারটা ঠিক করা যাবে।
ইস…এতদুর থেকে এলাম সমুদ্র দেখবো বলে…
বম্মা বললো…সামনেই সমুদ্র…খেয়ে নিয়ে তারপর সবাই যাবো…
সবাই ফ্রেস হয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম…বম্মা মেনু দেখে অর্ডার দেবার আগে কে কি খাবে জিজ্ঞেস করতে বাপি আর দাদাই দুজনেই বললো…তুমি দেখে বলে দাও না…এখানকার স্পেশাল কিছু যদি থাকে। বম্মা ওয়েটারকে ডেকে মুচমুচে আলু ভাজা, মুগ ডাল, পার্শে মাছের ভাজা, সরষে চিংড়ি আর দই ইলিশ দিতে বলে দিল।
বাপি খেতে খেতে বম্মাকে বলল…দারুন রান্না করেছে কিন্তু…ভালো রান্না তো খাওয়ার সুযোগই পাই না…তোমাদের কাছে এসে কতদিন পর ভালো মন্দ খেতে পাচ্ছি।
দাদাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল…কি রে তিস্তা…তোর বম্মার কাছে রান্না শিখবি নাকি…বাপিকে মাঝে মাঝে রেঁধে খাওয়াতে পারবি…
আমি আলু ভাজা আর ডাল বানাতে পারি কিন্তু…
বম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল…আমার মেয়ে এর মধ্যে একটা শিখে নিয়েছে…কাল সারাক্ষন তো আমার সাথে রান্না ঘরে কাটালো…কি রে মা…বাপিকে রান্না করে খাওয়াবি তো…
বিচ্ছুটা মাঝখান থেকে ফুট কাটলো…এখন বাপিকে খাওয়াবে আর ভবিষ্যতে বরকে খাওয়াতে হবে কিন্তু…যে কদিন আছো…মায়ের কাছে সব শিখে নিও…
এই…ভালো হবে না বলছি…দেখেছো বম্মা…আবার আমার পেছনে লাগছে…
খাওয়ার পর সবাই মিলে বেরোলাম…আকাশে এখন আর ঘন মেঘ নেই…ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে…মনে হয় পূর্নিমা…আমাদের হোটেলটা একেবারে বিচের পাশেই…হোটেলের বাগান থেকেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে…চাঁদের আলোতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল…একটার পর একটা ঢেউ গর্জন করতে করতে পাড়ের দিকে এসে আছড়ে পড়ছিল…অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম…
দশটার পরে নাকি বিচে যেতে দেয় না তাই হোটেলের বাগানের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাপিরা কিছুক্ষন বসে গল্প করার পর বলল…চলো…এবারে শুতে যাই…এত রাস্তাগাড়ী জার্নি করে এসে ক্লান্ত লাগছে…
আমার উঠতে ইচ্ছে করছিল না…বাপির হাত জড়িয়ে ধরে বললাম…বাপি আর একটু বোসো না…
বম্মা বলল…আচ্ছা ঠিক আছে তুই বোস…বাবাই থাকুক…খুব বেশী দেরী করবি না কিন্তু…
সবাই চলে যাবার পর বিচ্ছুটা আমার থেকে একটু দুরে বসে সিগারেট হাতে নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল…হঠাৎ আবার কি হল কে জানে…একটু আগেও তো সবার সাথে কথা বলছিল…এখন দেখে মনে হচ্ছে আমাকে চেনেই না…ভীষন খারাপ লাগতে সুরু করল…আমি কার জন্য থাকবো বললাম এখানে…আমি কি জানতাম না নাকি যে আমি আরো কিছুটা সময় থাকবো বললে ওকে আমার কাছে রেখে সবাই ফিরে যাবে…ভীষন কান্না পেয়ে গেল…