02-03-2021, 08:42 PM
সন্ধার সময় ঝুমার পিড়াপিড়িতে এক গ্লাস গরুর দুধ খেয়ে ফেলায় রাতে ঘুমাতে বেশ কষ্ট হয়েছে । গরুর দুধ খেলে আমার এসিডিটি হয় । তবে সকালে উঠে বেশ ফুরফুরে লাগলো শরীর । তাই সকাল সকাল ই অনিলা কে নিয়ে চললাম করিম এর বাড়ির দিকে । করিম এর বাড়িটা বেশ সুন্দর , পুকুরে মাছ আছে সেখানে অনিলার সময় ভালোই কাটবে । ঝুমাকেও আসতে বলেছিলাম তবে আসেনি আমাদের সাথে । জালাল আমাদের পথ দেখিয়ে নিজে যাচ্ছে । করিম এর বউ ছেলেটির ভালোই চিকিৎসা করেছে , এখন আর ওর পেট ফুলে নেই শরীর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়ছে । আমারা হেঁটে হেটেই যাচ্ছি , এতে এক ঢিলে দুই পাখি মাড়া হয়ে যাবে । অনিলাকে গ্রাম ও ঘুরিয়ে দেখানো হবে আবার আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানো ও হবে ।
আমাদের চলার গতি বেশ শ্লথ কারন অনিলা যা দেখছে তাতেই অবাক হচ্ছে , আর জালাল বিজ্ঞ লোকের মতো অনিলার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে । অনিলা জালাল কে দিয়ে নিজেক আন্টি ডাকায় , আন্টি ডাক শুনতে নাকি ওর ভালো লাগে , নিজেক বড় বড় মনে হয় । আশে পাশের লোক জোন আমাদের দিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে আর নিজেদের মাঝে কি জেনো বলা বলি করছে ।আমার মনে হয় অনিলাকে নিয়ে কথা হচ্ছে ওদের মাঝে । মিয়াঁ বাড়ির ভবিষ্যৎ উত্তরসুরি তো অনিলাই । তাই ওকে নিয়ে মানুষের মাঝে কৌতূহল থেকেই যাবে ।
আমি অনিলা আর জালাল এর পেছন পেছন হাঁটছি আর এই লোক জনের প্রতিক্রিয়া দেখছি । এর মাঝে একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এলো।
“ সালাম ছোট মিয়াঁ হুজুর আমারে চিনতে পারসেন?” লোকটা সামনে এসে আমাকে সালাম দিলো । অনেক বয়স হবে লোকটার বয়স এর ভারে পিঠ কুজো হয়ে গেছে ।
“ না চাচা আপনাকে তো চিনতে পারলাম না “ আমি বললাম । লোকটা একটু হাসল তারপর বলল
“ আমি মালেক মিয়াঁ , আপনে গো নৌকার মাঝি আসিলাম” এই বলে লোকটা হাঁসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
হ্যাঁ মনে পরলো আমার , আমার দাদাজান এর সখ ছিলো নৌকায় ঘুরে বেড়ানো , ওনার একটা নৌকা ছিলো ,অনেকটা বজড়া টাইপ , সেই নৌকায় উনি ঘুরে বেরাতেন । সুনেছিলাম , সুধু ঘুরেই বেরাতেন না নর্তকী আনিয়ে নাচ ও দেখতেন । সেই ১৯৮০ সালের দিকের ঘটনা ওসব। এর পর যখন বেশি বয়স হয়ে যায় তখন আর তেমন একটা জেতেন না নৌকায় তখন নৌকা ছিলো আমার দখলে । এই মালেক মিয়াঁ আমার অনেক কু কর্মের সাক্ষি ।
“ আরে মালেক তোমারে তো চেনাই যায় না , কি খবর তোমার “ আমি মালেক এর সামনে এগিয়ে গেলাম । মালেক এর কুঁজো হয়ে যাওয়া কাঁধে হাত রাখলাম । দেখলাম মালেক কাঁদছে একটু একটু ।
“ মালেক কান্দো ক্যান?” আমি নরম সুরে জিজ্ঞাস করলাম ।
“ পুরান দিন মনে কইরা কান্দি হুজুর , আহ কি দিন গুলান আসিলো “
“ কাইন্দো না মালেক , পুরান দিন কি আর ধইরা রাহন যায় , তোমার খবর কি সেইটা কও “
“ আমার আর খবর হুজুর , আসি কোনরকম , পোলা একটা এসে সৌদি থাকে , মাইয়া দুইটা বিয়া দিসি , আমার মায়ালক টাও মইরা গেসে , থাকি একলা একলা”
“ ক্যান পোলা আর পোলার বউ খোঁজ লয় না “ আমি জিজ্ঞাস করলাম
“ নাহ হেয় আসে বউ আর শ্বশুর বাড়ি লইয়া , টেকা পয়সা সব অইখানেই পাঠায় , আর বউ ও বাপের বাড়ি ই থাকে, মাঝে মাঝে আমারে পাঁচশো এক হাজার টেকা দেয় “
এমন সময় অনিলা আর জালাল এলো আমাদের কাছে এসে বলল “ আব্বু চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো , আমার মাছ ধরবো না”
“ এইটা আপনের মাইয়া নি ছোট হুজুর “ মালেক মাঝি জিগাস করলো
“ হ্যাঁ মালেক এইটা আমার মাইয়া “
“ খুব সুন্দর দেখতে হইসে , মিয়াঁ বাড়ির মাইয়া বইলা কথা , পোলা নাই আপনের হুজুর “ মালেক আমার দিকে তাকিয়ে প্রস্ন করলো
“ নাহ ঐ একটা মাইয়া ই আসে “ আমি হেঁসে বললাম । মালেক এর মুখ কালো হয়ে গেলো , বুঝলাম কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না।
“ হুজুর আপনে ফিরা আসছেন এহন আমাগো একটা উপায় হইবো , আমারা যারা মিয়াঁ বাড়ি কাম করতাম আমাগো দিকে একটু দেইখেন”
“ দেখবো মালেক দেখবো , এহন আমি যাই তুমি ভালো থাইকো “
এই বলে আমি মালেক কে পিছনে রেখে সামনের দিকে চললাম । মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার আমার উদাসীনতা সুধু মিয়াঁ বাড়িকেই আক্রান্ত করেনি এর সাথে জরিত আরও অনেক গুলো পরিবার আর মানুষকেও আক্রান্ত করেছে । এদের জন্য কিছু একটা করা উচিৎ আমার ।
“ আব্বু ঐ বুড়া লোকটা কে “ অনিলা জিজ্ঞাস করলো
“ ও তোমার বড় বাবার নৌকার মাঝি ছিলো মা “
‘ ওয়াও নৌকা , মাঝি ওয়ালা নৌকা” অনিলা হাত তালি দিয়ে উঠলো তারপর আবার জিজ্ঞাস করলো “ উনি নৌকা দিয়ে ই করতো”
“ এমনি ঘুরে বেড়াতো , বর্ষা কালে আমাদের গ্রামের নিচু জমি সব ডুবে যায় প্রকান্ড বিলে পরিনত হয় এই গ্রাম তখন নৌকায় ঘুরতে ভালো লাগে” আমি অনিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম ।
“ আমিও নৌকায় ঘুরবো “ অনিলা আব্দার করে বসলো
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম , “ এখন নৌকা পাবো কোথায় রে মা , আর এখন তো শীত কাল , নৌকায় ঘুরে মজা নেই”
কিন্তু কে শোনে কার কথা , নৌকা লাগবে মানে লাগবেই । এক প্রকার লাফালাফি শুরু করে দিলো । যতই বলি ওর মা শুনলে রাগ করবে , কিন্তু অনিলা আমার কথা শুনে না । এর মাঝে জালাল এসে আগুনে ঘি ঢেলে দিলো , বলল “ চেয়ারম্যান সাবের কইলে নৌকা আইনা দিবো”
আমার আর কিছুই করার থাকলো না , ঠিক হলো আগামিকাল আমারা নৌকায় ঘুরবো ।
বেশ হইহুল্লর এর সাথে চলছে মাছ ধরা , আসলে এক মাত্র জালাল বাদে আর কেউই তেমন মাছ ধরতে পারছে না , অনিলা তো একটাও ধরতে পারেনি । তবে ওর লম্ফ ঝম্ফ ই বেশি । নিজে ধরতে না পারলেও অন্যরা ধরছে তাতেই ও খুসি । আমি আর করিম মাছ ধরায় অংশ গ্রহন করিনি । এক সময় অনেক মাছ ধরেছি ।
“ নাল্টুর খবর কি ও কি জানে আমি আবার আইসি” কথার এক পর্যায়ে আমি করিম কে জিজ্ঞাস করলাম
“ হো জানে , তয় কিছু কয় নাই , আমি কইসিলাম ওরে আজকা আইতে কোন উত্তর দেয় নাই “ করিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষন তাপর বললাম “ ওরে বলিস ঐদিন যা হইসে সেইটা আমি মনে রাখি নাই , ওইটা আমার পাওনা আসিলো”
করিম কোন উত্তর দিলো না । তারপর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “ আগের দিন কত ভালা আসিলো রে পলাপান আসিলাম ঝামেলা আসিলো কম , যা মন চাইতো তাই করতাম “
“ ঠিক কইসস “ আমি ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম ।
“ আজমল চাচায় নাকি তোর বিয়া ঠিক করসে “ হঠাত করিম জানতে চাইলো । আমি তো ওর কথা শুনে অবাক , বিয়ে ঠিক করেছে মানে!!
“ কি কস ব্যাটা বিয়া ঠিক করসে মানে” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম করিম এর দিকে
“ কি কস তুই জানোস না , আজমল চাচা তো সবারে কইয়া বেরাইতাসে মির্জা পুর এর চেয়ারম্যান এর মাইয়ার লগে তোর বিয়া “
“ ধুর আমাকে তো গতকাল একটা ছবি দেখাইলো , খুব চাপা চাপি করলো তাই বলসি ভেবে দেখবো , এখানে সবাইকে বলে বেরানোর কি হইলো”
“ সাবধান জামিল , এইটা কিন্তু বড় সমস্যা হইবো , ঐ চেয়ারম্যান কিন্তু ডেঞ্জেরাস লোক , আজমল চাচা যদি সত্যি সত্যি ঐ লোকরে কথা দিয়া থাকে আর পড়ে যদি বিয়া না হয় ঐ কিন্তু তোরে ছারবো না “ করিম এর কথা শুনে আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি বললাম
“তোর লগে কথা হয় না ঐ লোকের , তুই ওনারে বুঝাইয়া বল যে আমি বিয়ে সাদির মাঝে নাই “
“ কথা হয় , তবে আমার কথা হুনবো না মনে হয় , ঐ লোক মনে করবো আমি তোর শত্রু তাই ইয়া ভাঙতে চাই” করিম এর কপালে চিন্তার রেখা দেখতে পেলাম ।
“ তাহলে কি করা যায় ?” ভীষণ চিন্তা হতে লাগলো আমার , অনিলা আরও অন্তত দিন পাঁচেক এখানে থাকতে চায় । আর যে হাড়ে আজমল চাচা এগুচ্ছে নিশ্চয়ই এর মাঝে কিছু একটা করে ফেলবে । দেখা যাবে আমি গ্রাম থেকেই বেরুতে পারবো না । অনিলাকে নিয়ে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম , আর এমন জেদি মেয়ে ওকে নিয়ে চলেও যাওয়া যাবে না ।
“ যা করার তোর ই করতে হইবো , সাহায্য যা লাগে আমি করমু , আজমল রে ভালা কইরা ধর ওরে বেশি লাই দিস না , খালি বিয়া না ঐ সক্কল কে কইয়া বেরাইতাসে আগামি ইলেকশনে তুই নাকি ওরে আবার খারাইতে কইসস”
করিম এর কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম । বলে কি করিম
“ দ্যাখ আমার চেয়ারম্যান না হইতে পারলেও চলবো , কিন্তু আজমল এর মতোন খারাপ লোক আবার চেয়ারম্যান হউক সেইটা আমি হইতে দিমু না “
“ করিম আমার এই সব ব্যাপারে কোন আগ্রহ নাই , আমি মেয়ে নিয়া ঘুরতে আসছি , ঘুরা শেষে চলে যাবো ,আমি আর এই গ্রামের মানুষ নাই তাই এই গ্রাম নিয়া আমি আর ভাবিও না “ আমি করিম এর কাছে নিজের সাফাই তুলে ধরলাম । করিম কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো তারপর বলল
“ তুই গ্রামে থাকবি না থাকবি না সেইটা নিয়া আমি তোরে কিসু বলবো না , তয় এই গেরাম এর প্রতি যদি একটু ও ভালোবাসা তোর থাকে তুই আজমল রে থামা , ওরে দেখতে ভালা মানুষ মনে হইলেও ও কিন্তু অনেক ডেঞ্জারাস “
করিম এর কথা শুনে আমি চুপ করে রইলাম , হঠাত করে আমি কিভাবে আজমল চাচার সাথে লাগবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না । তার উপর আমার সাথে এখন অনিলা আছে । এখন কিছু করলে আজমল চাচা যদি অনিলার কিছু ক্ষতি করে ।
“ আমার সাথে এখন অনিলা আছে করিম , আমি এই রকম কিছু করতে পারবো না “
আমার কথা শুনে করিম একটু হাসল তারপর বলল “ তুই কি আসলেই জামিল নাকি অন্য কেউ “
আমি চুপ করে রইলাম কারন এর উত্তর আমার কাছে নেই ।
সারাদিন থাকলাম করিম এর বাড়ি । অনিলা খুব আনন্দ পেয়েছে , কিন্তু আমার মনে কোন সুখ পেলাম না । মনটা সারাদিন অস্থির হয়ে রইলো । আমার বাড়ির এক আস্রিত বেক্তির কাছে নিজেকে জিম্মি মনে হচ্ছে । যখন চলে আসছিলাম তখন করিম ডেকে এক সাইডে নিয়ে গেলো আমাকে তারপর পকেট থেকে একটা মোটা খাম বের করে দিলো
“ কি আছে এতে “ আমি জজ্ঞাস করলাম
“ দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা , তুই এতদিন ঝুমার লইগা যে টাকা পাঠাইসস হের এক টেকাও ঝুমা নেয় নাই , আর তোরে বলতেও নিষেধ করসে ,আমারে কইসিলো কোন কামে লাগাইয়া ফেলতে , কিন্তু তোর টাকা এই গেরাম এর কামে লাগাইতে আমার আর রুচি হইতাসে না”
আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম । কিন্তু টাকা নিলাম না । করিম আর দুই একবার সাধলে বললাম
“ এই টাকা তো আর আমার না এইটা ঝুমার টাকা তুই চাইলে কাজে লাগাতে পাসির “ এই বলে আমি আর দাঁড়ালাম না চলে এলাম অনিলাকে আর জালাল কে নিয়ে ।
আমাদের চলার গতি বেশ শ্লথ কারন অনিলা যা দেখছে তাতেই অবাক হচ্ছে , আর জালাল বিজ্ঞ লোকের মতো অনিলার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে । অনিলা জালাল কে দিয়ে নিজেক আন্টি ডাকায় , আন্টি ডাক শুনতে নাকি ওর ভালো লাগে , নিজেক বড় বড় মনে হয় । আশে পাশের লোক জোন আমাদের দিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে আর নিজেদের মাঝে কি জেনো বলা বলি করছে ।আমার মনে হয় অনিলাকে নিয়ে কথা হচ্ছে ওদের মাঝে । মিয়াঁ বাড়ির ভবিষ্যৎ উত্তরসুরি তো অনিলাই । তাই ওকে নিয়ে মানুষের মাঝে কৌতূহল থেকেই যাবে ।
আমি অনিলা আর জালাল এর পেছন পেছন হাঁটছি আর এই লোক জনের প্রতিক্রিয়া দেখছি । এর মাঝে একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এলো।
“ সালাম ছোট মিয়াঁ হুজুর আমারে চিনতে পারসেন?” লোকটা সামনে এসে আমাকে সালাম দিলো । অনেক বয়স হবে লোকটার বয়স এর ভারে পিঠ কুজো হয়ে গেছে ।
“ না চাচা আপনাকে তো চিনতে পারলাম না “ আমি বললাম । লোকটা একটু হাসল তারপর বলল
“ আমি মালেক মিয়াঁ , আপনে গো নৌকার মাঝি আসিলাম” এই বলে লোকটা হাঁসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
হ্যাঁ মনে পরলো আমার , আমার দাদাজান এর সখ ছিলো নৌকায় ঘুরে বেড়ানো , ওনার একটা নৌকা ছিলো ,অনেকটা বজড়া টাইপ , সেই নৌকায় উনি ঘুরে বেরাতেন । সুনেছিলাম , সুধু ঘুরেই বেরাতেন না নর্তকী আনিয়ে নাচ ও দেখতেন । সেই ১৯৮০ সালের দিকের ঘটনা ওসব। এর পর যখন বেশি বয়স হয়ে যায় তখন আর তেমন একটা জেতেন না নৌকায় তখন নৌকা ছিলো আমার দখলে । এই মালেক মিয়াঁ আমার অনেক কু কর্মের সাক্ষি ।
“ আরে মালেক তোমারে তো চেনাই যায় না , কি খবর তোমার “ আমি মালেক এর সামনে এগিয়ে গেলাম । মালেক এর কুঁজো হয়ে যাওয়া কাঁধে হাত রাখলাম । দেখলাম মালেক কাঁদছে একটু একটু ।
“ মালেক কান্দো ক্যান?” আমি নরম সুরে জিজ্ঞাস করলাম ।
“ পুরান দিন মনে কইরা কান্দি হুজুর , আহ কি দিন গুলান আসিলো “
“ কাইন্দো না মালেক , পুরান দিন কি আর ধইরা রাহন যায় , তোমার খবর কি সেইটা কও “
“ আমার আর খবর হুজুর , আসি কোনরকম , পোলা একটা এসে সৌদি থাকে , মাইয়া দুইটা বিয়া দিসি , আমার মায়ালক টাও মইরা গেসে , থাকি একলা একলা”
“ ক্যান পোলা আর পোলার বউ খোঁজ লয় না “ আমি জিজ্ঞাস করলাম
“ নাহ হেয় আসে বউ আর শ্বশুর বাড়ি লইয়া , টেকা পয়সা সব অইখানেই পাঠায় , আর বউ ও বাপের বাড়ি ই থাকে, মাঝে মাঝে আমারে পাঁচশো এক হাজার টেকা দেয় “
এমন সময় অনিলা আর জালাল এলো আমাদের কাছে এসে বলল “ আব্বু চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো , আমার মাছ ধরবো না”
“ এইটা আপনের মাইয়া নি ছোট হুজুর “ মালেক মাঝি জিগাস করলো
“ হ্যাঁ মালেক এইটা আমার মাইয়া “
“ খুব সুন্দর দেখতে হইসে , মিয়াঁ বাড়ির মাইয়া বইলা কথা , পোলা নাই আপনের হুজুর “ মালেক আমার দিকে তাকিয়ে প্রস্ন করলো
“ নাহ ঐ একটা মাইয়া ই আসে “ আমি হেঁসে বললাম । মালেক এর মুখ কালো হয়ে গেলো , বুঝলাম কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না।
“ হুজুর আপনে ফিরা আসছেন এহন আমাগো একটা উপায় হইবো , আমারা যারা মিয়াঁ বাড়ি কাম করতাম আমাগো দিকে একটু দেইখেন”
“ দেখবো মালেক দেখবো , এহন আমি যাই তুমি ভালো থাইকো “
এই বলে আমি মালেক কে পিছনে রেখে সামনের দিকে চললাম । মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার আমার উদাসীনতা সুধু মিয়াঁ বাড়িকেই আক্রান্ত করেনি এর সাথে জরিত আরও অনেক গুলো পরিবার আর মানুষকেও আক্রান্ত করেছে । এদের জন্য কিছু একটা করা উচিৎ আমার ।
“ আব্বু ঐ বুড়া লোকটা কে “ অনিলা জিজ্ঞাস করলো
“ ও তোমার বড় বাবার নৌকার মাঝি ছিলো মা “
‘ ওয়াও নৌকা , মাঝি ওয়ালা নৌকা” অনিলা হাত তালি দিয়ে উঠলো তারপর আবার জিজ্ঞাস করলো “ উনি নৌকা দিয়ে ই করতো”
“ এমনি ঘুরে বেড়াতো , বর্ষা কালে আমাদের গ্রামের নিচু জমি সব ডুবে যায় প্রকান্ড বিলে পরিনত হয় এই গ্রাম তখন নৌকায় ঘুরতে ভালো লাগে” আমি অনিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম ।
“ আমিও নৌকায় ঘুরবো “ অনিলা আব্দার করে বসলো
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম , “ এখন নৌকা পাবো কোথায় রে মা , আর এখন তো শীত কাল , নৌকায় ঘুরে মজা নেই”
কিন্তু কে শোনে কার কথা , নৌকা লাগবে মানে লাগবেই । এক প্রকার লাফালাফি শুরু করে দিলো । যতই বলি ওর মা শুনলে রাগ করবে , কিন্তু অনিলা আমার কথা শুনে না । এর মাঝে জালাল এসে আগুনে ঘি ঢেলে দিলো , বলল “ চেয়ারম্যান সাবের কইলে নৌকা আইনা দিবো”
আমার আর কিছুই করার থাকলো না , ঠিক হলো আগামিকাল আমারা নৌকায় ঘুরবো ।
বেশ হইহুল্লর এর সাথে চলছে মাছ ধরা , আসলে এক মাত্র জালাল বাদে আর কেউই তেমন মাছ ধরতে পারছে না , অনিলা তো একটাও ধরতে পারেনি । তবে ওর লম্ফ ঝম্ফ ই বেশি । নিজে ধরতে না পারলেও অন্যরা ধরছে তাতেই ও খুসি । আমি আর করিম মাছ ধরায় অংশ গ্রহন করিনি । এক সময় অনেক মাছ ধরেছি ।
“ নাল্টুর খবর কি ও কি জানে আমি আবার আইসি” কথার এক পর্যায়ে আমি করিম কে জিজ্ঞাস করলাম
“ হো জানে , তয় কিছু কয় নাই , আমি কইসিলাম ওরে আজকা আইতে কোন উত্তর দেয় নাই “ করিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষন তাপর বললাম “ ওরে বলিস ঐদিন যা হইসে সেইটা আমি মনে রাখি নাই , ওইটা আমার পাওনা আসিলো”
করিম কোন উত্তর দিলো না । তারপর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “ আগের দিন কত ভালা আসিলো রে পলাপান আসিলাম ঝামেলা আসিলো কম , যা মন চাইতো তাই করতাম “
“ ঠিক কইসস “ আমি ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম ।
“ আজমল চাচায় নাকি তোর বিয়া ঠিক করসে “ হঠাত করিম জানতে চাইলো । আমি তো ওর কথা শুনে অবাক , বিয়ে ঠিক করেছে মানে!!
“ কি কস ব্যাটা বিয়া ঠিক করসে মানে” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম করিম এর দিকে
“ কি কস তুই জানোস না , আজমল চাচা তো সবারে কইয়া বেরাইতাসে মির্জা পুর এর চেয়ারম্যান এর মাইয়ার লগে তোর বিয়া “
“ ধুর আমাকে তো গতকাল একটা ছবি দেখাইলো , খুব চাপা চাপি করলো তাই বলসি ভেবে দেখবো , এখানে সবাইকে বলে বেরানোর কি হইলো”
“ সাবধান জামিল , এইটা কিন্তু বড় সমস্যা হইবো , ঐ চেয়ারম্যান কিন্তু ডেঞ্জেরাস লোক , আজমল চাচা যদি সত্যি সত্যি ঐ লোকরে কথা দিয়া থাকে আর পড়ে যদি বিয়া না হয় ঐ কিন্তু তোরে ছারবো না “ করিম এর কথা শুনে আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি বললাম
“তোর লগে কথা হয় না ঐ লোকের , তুই ওনারে বুঝাইয়া বল যে আমি বিয়ে সাদির মাঝে নাই “
“ কথা হয় , তবে আমার কথা হুনবো না মনে হয় , ঐ লোক মনে করবো আমি তোর শত্রু তাই ইয়া ভাঙতে চাই” করিম এর কপালে চিন্তার রেখা দেখতে পেলাম ।
“ তাহলে কি করা যায় ?” ভীষণ চিন্তা হতে লাগলো আমার , অনিলা আরও অন্তত দিন পাঁচেক এখানে থাকতে চায় । আর যে হাড়ে আজমল চাচা এগুচ্ছে নিশ্চয়ই এর মাঝে কিছু একটা করে ফেলবে । দেখা যাবে আমি গ্রাম থেকেই বেরুতে পারবো না । অনিলাকে নিয়ে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম , আর এমন জেদি মেয়ে ওকে নিয়ে চলেও যাওয়া যাবে না ।
“ যা করার তোর ই করতে হইবো , সাহায্য যা লাগে আমি করমু , আজমল রে ভালা কইরা ধর ওরে বেশি লাই দিস না , খালি বিয়া না ঐ সক্কল কে কইয়া বেরাইতাসে আগামি ইলেকশনে তুই নাকি ওরে আবার খারাইতে কইসস”
করিম এর কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম । বলে কি করিম
“ দ্যাখ আমার চেয়ারম্যান না হইতে পারলেও চলবো , কিন্তু আজমল এর মতোন খারাপ লোক আবার চেয়ারম্যান হউক সেইটা আমি হইতে দিমু না “
“ করিম আমার এই সব ব্যাপারে কোন আগ্রহ নাই , আমি মেয়ে নিয়া ঘুরতে আসছি , ঘুরা শেষে চলে যাবো ,আমি আর এই গ্রামের মানুষ নাই তাই এই গ্রাম নিয়া আমি আর ভাবিও না “ আমি করিম এর কাছে নিজের সাফাই তুলে ধরলাম । করিম কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো তারপর বলল
“ তুই গ্রামে থাকবি না থাকবি না সেইটা নিয়া আমি তোরে কিসু বলবো না , তয় এই গেরাম এর প্রতি যদি একটু ও ভালোবাসা তোর থাকে তুই আজমল রে থামা , ওরে দেখতে ভালা মানুষ মনে হইলেও ও কিন্তু অনেক ডেঞ্জারাস “
করিম এর কথা শুনে আমি চুপ করে রইলাম , হঠাত করে আমি কিভাবে আজমল চাচার সাথে লাগবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না । তার উপর আমার সাথে এখন অনিলা আছে । এখন কিছু করলে আজমল চাচা যদি অনিলার কিছু ক্ষতি করে ।
“ আমার সাথে এখন অনিলা আছে করিম , আমি এই রকম কিছু করতে পারবো না “
আমার কথা শুনে করিম একটু হাসল তারপর বলল “ তুই কি আসলেই জামিল নাকি অন্য কেউ “
আমি চুপ করে রইলাম কারন এর উত্তর আমার কাছে নেই ।
সারাদিন থাকলাম করিম এর বাড়ি । অনিলা খুব আনন্দ পেয়েছে , কিন্তু আমার মনে কোন সুখ পেলাম না । মনটা সারাদিন অস্থির হয়ে রইলো । আমার বাড়ির এক আস্রিত বেক্তির কাছে নিজেকে জিম্মি মনে হচ্ছে । যখন চলে আসছিলাম তখন করিম ডেকে এক সাইডে নিয়ে গেলো আমাকে তারপর পকেট থেকে একটা মোটা খাম বের করে দিলো
“ কি আছে এতে “ আমি জজ্ঞাস করলাম
“ দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা , তুই এতদিন ঝুমার লইগা যে টাকা পাঠাইসস হের এক টেকাও ঝুমা নেয় নাই , আর তোরে বলতেও নিষেধ করসে ,আমারে কইসিলো কোন কামে লাগাইয়া ফেলতে , কিন্তু তোর টাকা এই গেরাম এর কামে লাগাইতে আমার আর রুচি হইতাসে না”
আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম । কিন্তু টাকা নিলাম না । করিম আর দুই একবার সাধলে বললাম
“ এই টাকা তো আর আমার না এইটা ঝুমার টাকা তুই চাইলে কাজে লাগাতে পাসির “ এই বলে আমি আর দাঁড়ালাম না চলে এলাম অনিলাকে আর জালাল কে নিয়ে ।