02-03-2021, 07:07 PM
খুনসুটি #
দুপুরে সবাই এক সাথে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। বেশির ভাগটাই আমার ছোটোবেলা নিয়ে। আমার ছোটোবেলার দুষ্টুমির কথা শুনতে ভীষন ভালো লাগছিল আবার লজ্জাও পাচ্ছিলাম ওর সামনে। বম্মা বলল…এই বাবাই…আমি কিন্তু বলে দিয়েছি…তিস্তা যতদিন থাকবে, তুই ওকে কলকাতার সবকিছু দেখিয়ে নিয়ে আসবি। ও খুব মন দিয়ে মাছের কাঁটা চুষতে চুষতে বলল…আমি পারছি না বাবা…তুমি ওকে নিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে…
কেন শুনি…তোর অসুবিধাটা কি?
ও মায়ের কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে আবার কাঁটা চোষায় মন দিল।
বম্মা দাদাই এর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল…তোমার ছেলে এক্কেবারে পেকে গেছে…কি বলছে জানো…ও নাকি তিস্তার মতো সুন্দরী মেয়েকে কে নিয়ে বেরোলে পাড়ার সব মেয়ে গুলো হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে আর তিস্তাকে অভিশাপ দেবে…
শুনে সবাই যখন হাসছে দেখে ভীষন লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ফেললাম…তারপরই ওর দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলাম…ও আমার উলটো দিকে বসেছিল…পা বাড়িয়ে পায়ের নিজের বুড়ো আঙ্গুলের নখটা দিয়ে ওর পায়ে হঠাৎ খোঁছা মারতেই… উঃ করে উঠল।
বম্মা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…কি রে … কি হল?
নাঃ কিছু না…মাছের কাঁটাটা জিবে ফুটে গেল…
হেসে উঠে বললাম…দেখলে তো…আমাকে নিয়ে মজা করার কেমন শাশ্তি পেয়ে গেলে সাথে সাথে…
মা দেখো…তোমার মেয়ে কত ভালো…আমার কাঁটা ফুটে গেল আর ও কেমন মজা করছে…
বেশ করেছি…তুমি ওরকম বললে কেন…আমি তোমার সাথে বেরোবোই না…আমি আমার বম্মার সাথে বেরোবো…
বেঁচে যাবো বাবা…
বম্মা আমাদের কথা শুনে বলল…থাক…আর খুনসুটি করতে হবে না…তিস্তা আমার সাথে নয়…তোর সাথেই বেরোবে…
ঠিক আছে…তুমি এতো করে বললে আর কি করা যাবে…যেতেই হবে…বম্মার আদরের মেয়ে বলে কথা…কি কপাল আমার…আমার এতদিনের মা…কোথাকার কে একটা মেয়ে এসে ছিনিয়ে নিলো…
কি অদ্ভুত ছেলে… কত সহজে মিশে যায়… কাছে টেনে নেয়… ভাবতে ভাবতে মুখ নীচু করে খাচ্চিলাম… বম্মা জিজ্ঞেস করল…কি রে তিস্তা…চুপ করে গেলি?
না গো বম্মা…এমনিই…
প্রথম একা পাওয়া #
বিচ্ছুটা গাড়ী চালাতে চালাতে গুন গুন করে কি একটা গান গাইছিল…
ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম…কি হল…তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে না নাকি? আমি বোবার মতো বসে আছি আর উনি গান গাইছেন মজা করে।
কি করি বল…তুমি যেভাবে মুখ শুকনো করে গাড়ীতে উঠলে…মনে হচ্ছে…আমি বুঝি তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি…
বুদ্ধির ঢেঁকি…
মানে?
মানে তুমি একটা আস্ত বুদ্ধুরাম…সবার সামনে দিয়ে আমি আনন্দে নেচে নেচে বেরোই আর সবাই ভাবুক যে আমি তোমার সাথে বেরুচ্ছি বলে খুশিতে ফেটে পড়ছি…
তার মানে…তুমি আমার সাথে বেরোনোটা খুব এক্সপেক্ট করছিলে…
আড়চোখে তাকিয়ে বললাম…তোমরা ছেলেরা কোনোদিনই মেয়েরা কি চায়… বুঝলে না…
কি করে বুঝবো বল…তোমার সাথে তো আগে কোনোদিন দেখা হয়নি…আমার জীবনে মেয়ে বলতে…বাড়ীতে মা…আর কলেজ কলেজের কিছু বান্ধবী। মাকে বাদ দিয়ে থাকে বান্ধবী রা…ওদের কে গভীর ভাবে বোঝার কোনো প্রয়োজন পড়েনি…
প্রয়োজন পড়েনি নাকি তুমি প্রয়োজন মনে করনি…এরকম কি একেবারেই হয়নি যে কেউ তোমাকে কিছু বলার চেষ্টা করেনি?
মাই গড…তুমি তো আমাকে পুলিশের মতো জেরা করতে শুরু করলে…আবার হাসি পেয়ে গেলে হিহি করে হেসে বললাম…তুমি চোর…আমি পুলিশ…তারপর গলাটা গম্ভীর করে বললাম…উত্তর দাও…এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই…
মেয়ে পুলিশ কিন্তু ছেলেদের হাতকড়া পরাতে পারে না… জানো তো…
আমার বয়ে গেছে জানতে…আমার ইচ্ছে হলেই পরাবো…তবে…একমাত্র তুমি যদি চোর হও…
হুমমম…তোমার হাতে বন্দী হওয়ার জন্য আমি চোর কেন…ডাকাত হতেও রাজি আছি…
তাহলে এখনই চাই তোমাকে বন্দী করতে…
কি ভাবে…
কি বলা যায় ভাবতে ভাবতে বললাম…হুমমম…পেয়ে গেছি…তুমি গিয়ারের উপর হাত টা রাখো…
কেন?
আরে বাবা রাখো না…বড্ড বেশী প্রশ্ন কর তুমি…জানো না …সুন্দরী মেয়েরা কোনো কথা বললে সেটা চুপচাপ মেনে নিতে হয়…
ও আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে গিয়ারে হাত রাখল…দুহাতে মুখ ঢেকে কিছু একটা ভাবলাম…তারপরেই ডান হাতটা ওর হাতের উপর চেপে ধরে বললাম…এই আমি তোমাকে বন্দী করলাম…
আমার হাতের উষ্ণতা হয়তো ওর শরীরে কেমন একটা শিহরন জাগিয়ে তুলল…মনে হল ওর হাতটা কেঁপে উঠল…গাড়ীটা আস্তে আস্তে সাইড করে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে…ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালো…আমি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম…
তিস্তা…প্লিজ হাতটা সরিয়ে নাও…
শুধু ওর শরীরে শিহরন আসেনি…আমার ও কেমন যেন লাগছিল ওকে ছুঁতে পেয়ে…অস্ফুট স্বরে বললাম…বাড়ীতে তো তোমাকে একা পাবো না…একটু তোমার হাতটা ধরে থাকি না… ভীষন ইচ্ছে করছে…
ফেরার সময় একগোছা রজনীগন্ধার স্টিক কিনলাম বম্মার জন্য…ফিরলাম যখন…প্রায় সাতটা বাজে। বসার ঘরে মা বাবারা বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। বাপির কপালে চুমু খেয়ে বললাম…বাপি আমি এখুনি আসছি…কত ঘুরলাম আমরা…তোমাকে না বললে বিশ্বাসই করবে না…
ভেতরে যাবার আগে তাড়াতাড়ি বম্মার হাতে রজনীগন্ধার স্টিকগুলো দিয়ে বললাম…বম্মা…তোমার জন্য…বম্মা…খুব ক্ষিদে পেয়েছে…কিছু খেতে দাও না…তোমার ছেলে আমাকে কিচ্ছু খাওয়ালো না…হাওয়া খেয়ে কি পেট ভরে বলো…
বম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল…তোরা হাত মুখ ধুয়ে আয়…খেতে দিচ্ছি। কি রে বাবাই…মেয়েটাকে কিছু খেতে দিস নি?
না বললে…আমি কি ভাবে বুঝবো ওর ক্ষিধে পেয়েছে…
তুই একটা আস্ত গাধা…তুই ওকে নিয়ে গেছিস…তোরই ওকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল…
ঠিক আছে…এর পরে বেরোলে আমি খাওয়ার সাথে নিয়ে বেরোবো…সাথে জলের বোতল…ন্যাপকিন…পেপার সোপ…সব থাকবে…যাতে তোমার আদরের মেয়ের কোনো অসুবিধা না হয়…
দাঁড়া তো…তোকে দেখাচ্ছি মজা…বলে বম্মা উঠতে যেতেই… বাবার পাশে বসে পড়ে বলল…বাবা…মাকে থামাও না…মেরে ফেলবে আজ মনে হচ্ছে…দূর্গা দূর্গতিনাশিনী না হয়ে আজ বোধ হয় দুর্গতিদায়িনী হয়ে গেছে…
সবাই ওর কথা শুনে হাসছে যখন আমি ভাবছিলাম কেমন সুন্দর জমিয়ে রাখতে পারে … ও কাছে থাকলে সত্যিই মনে রাগ দুঃখ কিছু থাকা সম্ভব নয়।
______________________________
বৃষ্টি তুমি কত মিষ্টি #
বাপির পাশে বসে বাচ্চা মেয়ের মতো খুশিতে ডগমগ করতে করতে বকে যাচ্ছিলাম…জানো তো…সন্ধের পর দুর থেকে সেকেন্ড হুগলী ব্রিজটা কি সুন্দর লাগে…বাবুঘাটে গঙ্গার ধারে বসে ভীষন ভালো লাগছিল…ছোটো ছোটো নৌকো গুলো কেমন জলের ধাক্কায় এদিক ওদিক করতে করতে ভেসে যাচ্ছিল। আমাকে এমন খুশী হতে দেখে বাপির বুকটা ভরে উঠলো হয়তো… আনন্দে…আমাকে কে জড়িয়ে ধরে বললেন…কি…বলেছিলাম না…এখানে এলে তোর ভালো লাগবে। তুই তো আসতেই চাইছিলি না…
ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম…আমি কি জানতাম নাকি…বম্মা এতো ভালোবাসে আমাকে…দাদাই কি ভালো…আমাদেরকে কত ভালোবাসে…সব সময়…কি খাবো…কোথায় যাবো…এই সব করছে…
বাবাই কি খারাপ নাকি…আমাদের জন্য কত কিছু করছে…আমার সোনা মেয়েকে নিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো…
বাপির ঘাড়ে মাথা রেখে কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বললাম…ওটা একটা বিচ্ছু ছেলে…খালি আমার পেছনে লাগে…
পেছনে লাগে তো কি হয়েছে…তোকে ভালোবাসে না নাকি…
কি জানি…ওকে ঠিক বোঝা যায় না…
তোর জন্য খুব চিন্তা হয় রে…ওর মতো একটা ছেলে যদি পেতাম…তোর বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম…
বাপি…তুমি আবার সেই শুরু করলে?...আমাকে তাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো…তোমাকে কতবার বলেছি আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না…তুমি কক্ষোনো আমাকে বিয়ের কথা বলবে না…
সকালের মতো আমার দুচোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে জল বেরিয়ে আসছিল…আমাকে আদর করতে করতে বাপি বললেন…আচ্ছা বাবা ঠিক আছে…আর বলবো না…তোর যখন ইচ্ছে হবে আমাকে বলবি…
বিচ্ছুটা কি একটা কাজে ঘরে ঢুকে আমাকে বাবার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে দেখে ফিরে যাচ্ছিল… চোখ মুছে ওকে ডেকে একটু ভারী গলায় বললাম…কি হল…চলে যাচ্ছো কেন…আমি কাঁদছি তো তোমার কি?
কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। হয়তো ভাবছিল …কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা…কখন কাঁদে…কখন হাঁসে আর কখন যে রেগে যায় বোঝা মুশকিল।
বাপি বলল…বাবাই বোসো…আমার মেয়েটা একটা পাগল…কিছু মনে কোরো না…
আমি পাগল?…তুমি আমাকে কাঁদাবে আর আমি কাঁদলেই যত দোষ…
রাতে খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ মুখ নীচু করে বসতেই…আমার থমথমে মুখ দেখে বম্মা জিজ্ঞেস করল…কি রে তিস্তা…তোর কি হয়েছে…বাবাই আবার তোর পেছনে লেগেছিল নাকি?
বাপি বলল…না না…বাবাই কিছু করে নি…ও আমার উপর রেগে আছে…বিয়ের কথা বলেছিলাম বলে কান্নাকাটি করেছে…
বম্মা আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল…মা…রাগ করিস না বাপির উপর…বড় হচ্ছিস…এখনই বিয়ে দেবার সময় না হলেও…তোর বাপির একটা চিন্তা থাকবেই…তুই ছাড়া তোর বাপির আর কে আছে বল? তোর মা থেকেও তো নেই।
তুমি জানো না বম্মা…আমি কতবার বাপিকে বলেছি…তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না…তবুও আমার পেছনে লাগবে…ভালো ছেলে কোথায় পাবো…ভালো ফ্যামিলি না পেলে যে কি হবে…
আচ্ছা বাবা…ঠিক আছে…বলুক না…এখন একটু মাথা ঠান্ডা করে খেয়ে নে…খাওয়ার সময় রাগ করতে নেই…
মায়ের কথা ওঠায় খুব ইচ্ছে করছিল বম্মাকে জড়িয়ে ধরতে… জড়িয়ে ধরে বললাম…বম্মা…আজ আমাকে খাইয়ে দাও না…
তুই একটু বোস…আমি ওদের কে দিয়ে তোকে খাইয়ে দিচ্ছি…
আমাকে আবার আগের মত হাসিখুশি দেখে সবারই ভালো লাগছিল…বম্মার হাতে খেতে খেতে মাঝে মাঝে সৃজনের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম…ভাবখানা যেন এরকম…দেখো…আমি কেমন মজা করে মায়ের হাতে খাচ্ছি…একটু পরেই অন্যদিকে তাকিয়ে ওর পায়ে খোঁচা মেরে বললাম…বম্মা দেখো…তুমি আমাকে খাইয়ে দিচ্ছো বলে তোমার ছেলে কেমন মুখ গোমড়া করে আছে…ভীষন হিংসুটে…
আমার বয়ে গেছে হিংসে করতে…মা আমাকেও খাইয়ে দেয়…
এ মা…বুড়ো ছেলে…এখোনো মায়ের হাতে খায়…
আচ্ছা…আমি বুড়ো ছেলে…তুমি কি নার্শারিতে পড়া কচি খুকি নাকি?
আমি তোমার থেকে চার বছরের ছোটো…অতএব…তোমার সাথে আমার তুলনা করা যাচ্ছে না…ইস…বুড়ো ছেলেকে বুড়ো বললে আবার রাগ করে…
আমাদেরকে আবার খুনসুটি করতে দেখে সবাই মুখ টিপে হাসতে শুরু করল। সবার প্রায় খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও আমার বাকি ছিল… বললাম…দাদাই…বাপি…তোমরা উঠে পড়…আমি বম্মাকে খাইয়ে তারপর উঠবো…বম্মা…আমি কিন্তু তোমাকে খাইয়ে দেবো আজ…
বম্মা হেসে বলল…ঠিক আছে…সেই কোন ছোটোবেলায় মায়ের হাতে খেয়েছি…আজ আবার আমি আমার ছোটো মায়ের হাতে খাবো।
দাদাই ওঠার সময় জিজ্ঞেস করল…ছাদে কিছু নেই তো…আকাশের যা অবস্থা… মনে হয় ঝড় বৃষ্টি হতে পারে…
বম্মা বলল…না…সে রকম কিছু নেই…বাবাই… পাঁচিলের টব গুলোকে নামিয়ে দে না বাবা…ঝড়ে পড়ে যেতে পারে…
কিছুক্ষন পর ও ফিরে এসে বললো…টব গুলো নাবিয়ে দিয়েছি…বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে…সহজ়ে থামবে বলে মনে হয় না…
সবাই চলে যাবার পর আমি বম্মাকে খাইয়ে দিচ্ছিলাম…বৃষ্টি হচ্ছে শুনে বললাম... বম্মা…আজ না…বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে…তুমি বকবে না তো?
খাওয়ার পর বৃষ্টিতে ভিজবি…ঠান্ডা লেগে যাবে তো…
বম্মা…প্লিজ…হ্যাঁ…বল…খুব ইচ্ছে করছে…কিচ্ছু হবে না…তুমি আছো তো…ঠান্ডা লাগলে…সেই ছোটোবেলার মতো তেল গরম করে মালিশ করে দেবে…
তুই কি করে জানলি? তুই তো খুব ছোটো ছিলি তখন…
বাপি আমাকে সব বলেছে…বম্মা…প্লিজ…
আচ্ছা বাবা…ঠিক আছে…কিন্তু…রাত হয়েছে…খোলা ছাদে একা থাকবি?…আমারও আবার শরীরটা ভালো নেই…সেই কোন সকালে উঠেছি…
তোমার ছেলেকে বলো না…আমার সাথে যেতে…একদিন না হয় দেরীতে ঘুমোবে…
ঠিক আছে…তুই কিন্তু…বাপিকে বলে যাবি…
বাপিকে না বলে আমি কিচ্ছু করিনা…তুমি তো জানো…বাপি আমার শুধু বাবা নয়…মা ও…
বিচ্ছুটা বিছানায় বসে গিটারটা নিয়ে কিছু একটা সুর বাজাবার চেষ্টা করছিল…বম্মার হাত ধরে ভেতরে ঢুকলেও ও অন্যদিকে মুখ করে থাকায় বুঝতে পারলো না।
এই বাবাই…মায়ের ডাকে ফিরে তাকাতেই আমার সাথে চোখাচুখি হয়ে গেল…ইশারা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু বুঝলো কিনা কে জানে…মাকে বলল… বলো…মা।
তিস্তা কে নিয়ে ছাদে যাবি?...মেয়ের আমার ইচ্ছে হয়েছে বৃষ্টিতে ভেজার…
তুমি যাও না…
আমার শরীরটা ভালো নেই রে…ঘুমোতে হবে…
ঠিক আছে…তোমার মেয়েকে বলে দাও…নিজে ভিজুক…আমাকে যেন না ডাকে…
ঠোট উলটে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বললাম…ইস…আমাকে যেন না ডাকে…আমার বয়ে গেছে তোমাকে ডাকতে…নেহাত রাত হয়েছে…খোলা ছাদে একা একা ভয় লাগবে…না হলে একাই যেতাম…
দেখেছো মা…কি রকম ঝগড়ুটে মেয়ে…আমি ওকে কিছু বলেছি?
এই দেখো…আবার দুটোতে ঝগড়া শুরু করে দিলো…তোরা যা…আমি শুতে যাচ্ছি…তিস্তা ফিরে এসে কিন্তু স্নান করবি…না হলে জ্বর এসে যাবে…
ঠিক আছে বম্মা…তুমি চিন্তা কোরো না।
বম্মা বেরিয়ে যাবার পর ও আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…সত্যিই ভিজবে নাকি…অন্য কিছু ইচ্ছে আছে?
হাসি হাসি মুখ করে বললাম…কি আবার ইচ্ছে হবে…
কি জানি বাবা…তোমাকে বোঝা খুব মুশকিল…কখন যে কি করে বসবে…
বোঝার চেষ্টা করলেই বুঝবে…চলো না…বৃষ্টি থেমে গেলে আমার আর ভেজা হবে না…
ছাদের দরজার পরেও বেশ কিছুটা শেড আছে…সৃজন ওর তলায় দাঁড়িয়ে বলল…যাও…তুমি ভেজো…আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি…
কি সুন্দর লাগছে না…ঝমঝম করে বৃষ্টিতে গাছগুলো কেমন সুন্দর ভিজছে…হাওয়ার সাথে দোল খেতে খেতে…ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই আস্তে আস্তে ছাদের মাঝে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফুল গাছগুলো কে পরম মমতায় ছুঁয়ে যেন আদর করছি…রাতের মেঘে ভরা আকাশের অল্প আলোতে নিজেকে যেন মায়াবী কোনো কিছুর মতো লাগছিল…
ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলাম…এই…তুমি গান শুনতে চেয়েছিলে না…গাইবো?
আমি কখন ওর সামনে এসে ওকে কিছু বলেছি বোধ হয় বুঝতে পারেনি…অবাক হয়ে আমার বৃষ্টি ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম…এই দুষ্টূ ছেলে…মেয়েদের বৃষ্টি ভেজা শরীরের দিকে তাকাতে নেই…জানো না…মন খারাপ করে…এই…বলো না…গান শুনবে কি না…
গাও…
চলো…বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গান শোনাবো…
আমাকেও যেতে হবে?
আমার সাথে না গেলে…কিভাবে আমি গান শোনাবো… বলো…
ওর হাত ধরে ছাদের মাঝে নিয়ে গিয়ে বললাম… এখানে দাঁড়াও…
ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার দিকে তাকিয়ে …আমি জুঁই ফুলের গাছটাকে আলতো ছুঁয়ে যেতে যেতে গাইছি…
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি…এ কোন অপরুপ সৃষ্টি…
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি…আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি…
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি…এ কোন অপরুপ সৃষ্টি…
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি…আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি…
এত মেঘের কোনে কোনে এলো বাতাস হু হু সনে
এত মেঘের কোনে কোনে এলো বাতাস হু হু সনে
রিম ঝিম ঝিম রিম বৃষ্টি
তোমার অঝোর ধারায় ভিজে…আমি নতুন হলাম নিজে……
মা মাপাধাপা নি আজ হারিয়ে গেছি আমি
বৃষ্টি তুমি এতো কেন মিষ্টি
হয়তো ও ভাবছিল…এ কোন তিস্তা…আজ সারাদিনের সেই তিস্তা যেন অন্য কেউ…হয়তো ওর ভীষন ভালো লাগছিল…বৃষ্টিতে ভিজে এত সুন্দর গান শুনতে…এক অজানা জগতে হারিয়ে যেতে যেতে শুনলো…
কই…বললে না তো…কেমন লাগলো…
সম্বিত ফিরে পেয়ে আমার দিকে তাকালো…আমি ওর দিকে এক অপরুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি…আমার ভেজা ঠোঁট দুটো যেন কিছু বলতে চাইছে…ওকে
দুহাত বাড়িয়ে আমার মুখটা আলতো ভাবে ধরে কপালে ওর ঠোঁটটা ছুঁইয়ে ফিস ফিস করে বলল…আজ নয়…যদি কোনো দিন সুযোগ আসে…তুমি যদি শুনতে চাও…সেদিন বোলবো…কেমন লাগলো…
থরথর করে কেঁপে উঠলাম…কিছু বলতে আর কিছু শুনতে চাইলেও… না পাওয়ার ব্যাথায় ক্ষনিকের জন্য বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল…নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম…চলো…অনেক রাত হয়েছে…
দুপুরে সবাই এক সাথে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। বেশির ভাগটাই আমার ছোটোবেলা নিয়ে। আমার ছোটোবেলার দুষ্টুমির কথা শুনতে ভীষন ভালো লাগছিল আবার লজ্জাও পাচ্ছিলাম ওর সামনে। বম্মা বলল…এই বাবাই…আমি কিন্তু বলে দিয়েছি…তিস্তা যতদিন থাকবে, তুই ওকে কলকাতার সবকিছু দেখিয়ে নিয়ে আসবি। ও খুব মন দিয়ে মাছের কাঁটা চুষতে চুষতে বলল…আমি পারছি না বাবা…তুমি ওকে নিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে…
কেন শুনি…তোর অসুবিধাটা কি?
ও মায়ের কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে আবার কাঁটা চোষায় মন দিল।
বম্মা দাদাই এর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল…তোমার ছেলে এক্কেবারে পেকে গেছে…কি বলছে জানো…ও নাকি তিস্তার মতো সুন্দরী মেয়েকে কে নিয়ে বেরোলে পাড়ার সব মেয়ে গুলো হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে আর তিস্তাকে অভিশাপ দেবে…
শুনে সবাই যখন হাসছে দেখে ভীষন লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ফেললাম…তারপরই ওর দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলাম…ও আমার উলটো দিকে বসেছিল…পা বাড়িয়ে পায়ের নিজের বুড়ো আঙ্গুলের নখটা দিয়ে ওর পায়ে হঠাৎ খোঁছা মারতেই… উঃ করে উঠল।
বম্মা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…কি রে … কি হল?
নাঃ কিছু না…মাছের কাঁটাটা জিবে ফুটে গেল…
হেসে উঠে বললাম…দেখলে তো…আমাকে নিয়ে মজা করার কেমন শাশ্তি পেয়ে গেলে সাথে সাথে…
মা দেখো…তোমার মেয়ে কত ভালো…আমার কাঁটা ফুটে গেল আর ও কেমন মজা করছে…
বেশ করেছি…তুমি ওরকম বললে কেন…আমি তোমার সাথে বেরোবোই না…আমি আমার বম্মার সাথে বেরোবো…
বেঁচে যাবো বাবা…
বম্মা আমাদের কথা শুনে বলল…থাক…আর খুনসুটি করতে হবে না…তিস্তা আমার সাথে নয়…তোর সাথেই বেরোবে…
ঠিক আছে…তুমি এতো করে বললে আর কি করা যাবে…যেতেই হবে…বম্মার আদরের মেয়ে বলে কথা…কি কপাল আমার…আমার এতদিনের মা…কোথাকার কে একটা মেয়ে এসে ছিনিয়ে নিলো…
কি অদ্ভুত ছেলে… কত সহজে মিশে যায়… কাছে টেনে নেয়… ভাবতে ভাবতে মুখ নীচু করে খাচ্চিলাম… বম্মা জিজ্ঞেস করল…কি রে তিস্তা…চুপ করে গেলি?
না গো বম্মা…এমনিই…
প্রথম একা পাওয়া #
বিচ্ছুটা গাড়ী চালাতে চালাতে গুন গুন করে কি একটা গান গাইছিল…
ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম…কি হল…তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে না নাকি? আমি বোবার মতো বসে আছি আর উনি গান গাইছেন মজা করে।
কি করি বল…তুমি যেভাবে মুখ শুকনো করে গাড়ীতে উঠলে…মনে হচ্ছে…আমি বুঝি তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি…
বুদ্ধির ঢেঁকি…
মানে?
মানে তুমি একটা আস্ত বুদ্ধুরাম…সবার সামনে দিয়ে আমি আনন্দে নেচে নেচে বেরোই আর সবাই ভাবুক যে আমি তোমার সাথে বেরুচ্ছি বলে খুশিতে ফেটে পড়ছি…
তার মানে…তুমি আমার সাথে বেরোনোটা খুব এক্সপেক্ট করছিলে…
আড়চোখে তাকিয়ে বললাম…তোমরা ছেলেরা কোনোদিনই মেয়েরা কি চায়… বুঝলে না…
কি করে বুঝবো বল…তোমার সাথে তো আগে কোনোদিন দেখা হয়নি…আমার জীবনে মেয়ে বলতে…বাড়ীতে মা…আর কলেজ কলেজের কিছু বান্ধবী। মাকে বাদ দিয়ে থাকে বান্ধবী রা…ওদের কে গভীর ভাবে বোঝার কোনো প্রয়োজন পড়েনি…
প্রয়োজন পড়েনি নাকি তুমি প্রয়োজন মনে করনি…এরকম কি একেবারেই হয়নি যে কেউ তোমাকে কিছু বলার চেষ্টা করেনি?
মাই গড…তুমি তো আমাকে পুলিশের মতো জেরা করতে শুরু করলে…আবার হাসি পেয়ে গেলে হিহি করে হেসে বললাম…তুমি চোর…আমি পুলিশ…তারপর গলাটা গম্ভীর করে বললাম…উত্তর দাও…এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই…
মেয়ে পুলিশ কিন্তু ছেলেদের হাতকড়া পরাতে পারে না… জানো তো…
আমার বয়ে গেছে জানতে…আমার ইচ্ছে হলেই পরাবো…তবে…একমাত্র তুমি যদি চোর হও…
হুমমম…তোমার হাতে বন্দী হওয়ার জন্য আমি চোর কেন…ডাকাত হতেও রাজি আছি…
তাহলে এখনই চাই তোমাকে বন্দী করতে…
কি ভাবে…
কি বলা যায় ভাবতে ভাবতে বললাম…হুমমম…পেয়ে গেছি…তুমি গিয়ারের উপর হাত টা রাখো…
কেন?
আরে বাবা রাখো না…বড্ড বেশী প্রশ্ন কর তুমি…জানো না …সুন্দরী মেয়েরা কোনো কথা বললে সেটা চুপচাপ মেনে নিতে হয়…
ও আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে গিয়ারে হাত রাখল…দুহাতে মুখ ঢেকে কিছু একটা ভাবলাম…তারপরেই ডান হাতটা ওর হাতের উপর চেপে ধরে বললাম…এই আমি তোমাকে বন্দী করলাম…
আমার হাতের উষ্ণতা হয়তো ওর শরীরে কেমন একটা শিহরন জাগিয়ে তুলল…মনে হল ওর হাতটা কেঁপে উঠল…গাড়ীটা আস্তে আস্তে সাইড করে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে…ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালো…আমি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম…
তিস্তা…প্লিজ হাতটা সরিয়ে নাও…
শুধু ওর শরীরে শিহরন আসেনি…আমার ও কেমন যেন লাগছিল ওকে ছুঁতে পেয়ে…অস্ফুট স্বরে বললাম…বাড়ীতে তো তোমাকে একা পাবো না…একটু তোমার হাতটা ধরে থাকি না… ভীষন ইচ্ছে করছে…
ফেরার সময় একগোছা রজনীগন্ধার স্টিক কিনলাম বম্মার জন্য…ফিরলাম যখন…প্রায় সাতটা বাজে। বসার ঘরে মা বাবারা বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। বাপির কপালে চুমু খেয়ে বললাম…বাপি আমি এখুনি আসছি…কত ঘুরলাম আমরা…তোমাকে না বললে বিশ্বাসই করবে না…
ভেতরে যাবার আগে তাড়াতাড়ি বম্মার হাতে রজনীগন্ধার স্টিকগুলো দিয়ে বললাম…বম্মা…তোমার জন্য…বম্মা…খুব ক্ষিদে পেয়েছে…কিছু খেতে দাও না…তোমার ছেলে আমাকে কিচ্ছু খাওয়ালো না…হাওয়া খেয়ে কি পেট ভরে বলো…
বম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল…তোরা হাত মুখ ধুয়ে আয়…খেতে দিচ্ছি। কি রে বাবাই…মেয়েটাকে কিছু খেতে দিস নি?
না বললে…আমি কি ভাবে বুঝবো ওর ক্ষিধে পেয়েছে…
তুই একটা আস্ত গাধা…তুই ওকে নিয়ে গেছিস…তোরই ওকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল…
ঠিক আছে…এর পরে বেরোলে আমি খাওয়ার সাথে নিয়ে বেরোবো…সাথে জলের বোতল…ন্যাপকিন…পেপার সোপ…সব থাকবে…যাতে তোমার আদরের মেয়ের কোনো অসুবিধা না হয়…
দাঁড়া তো…তোকে দেখাচ্ছি মজা…বলে বম্মা উঠতে যেতেই… বাবার পাশে বসে পড়ে বলল…বাবা…মাকে থামাও না…মেরে ফেলবে আজ মনে হচ্ছে…দূর্গা দূর্গতিনাশিনী না হয়ে আজ বোধ হয় দুর্গতিদায়িনী হয়ে গেছে…
সবাই ওর কথা শুনে হাসছে যখন আমি ভাবছিলাম কেমন সুন্দর জমিয়ে রাখতে পারে … ও কাছে থাকলে সত্যিই মনে রাগ দুঃখ কিছু থাকা সম্ভব নয়।
______________________________
বৃষ্টি তুমি কত মিষ্টি #
বাপির পাশে বসে বাচ্চা মেয়ের মতো খুশিতে ডগমগ করতে করতে বকে যাচ্ছিলাম…জানো তো…সন্ধের পর দুর থেকে সেকেন্ড হুগলী ব্রিজটা কি সুন্দর লাগে…বাবুঘাটে গঙ্গার ধারে বসে ভীষন ভালো লাগছিল…ছোটো ছোটো নৌকো গুলো কেমন জলের ধাক্কায় এদিক ওদিক করতে করতে ভেসে যাচ্ছিল। আমাকে এমন খুশী হতে দেখে বাপির বুকটা ভরে উঠলো হয়তো… আনন্দে…আমাকে কে জড়িয়ে ধরে বললেন…কি…বলেছিলাম না…এখানে এলে তোর ভালো লাগবে। তুই তো আসতেই চাইছিলি না…
ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম…আমি কি জানতাম নাকি…বম্মা এতো ভালোবাসে আমাকে…দাদাই কি ভালো…আমাদেরকে কত ভালোবাসে…সব সময়…কি খাবো…কোথায় যাবো…এই সব করছে…
বাবাই কি খারাপ নাকি…আমাদের জন্য কত কিছু করছে…আমার সোনা মেয়েকে নিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো…
বাপির ঘাড়ে মাথা রেখে কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বললাম…ওটা একটা বিচ্ছু ছেলে…খালি আমার পেছনে লাগে…
পেছনে লাগে তো কি হয়েছে…তোকে ভালোবাসে না নাকি…
কি জানি…ওকে ঠিক বোঝা যায় না…
তোর জন্য খুব চিন্তা হয় রে…ওর মতো একটা ছেলে যদি পেতাম…তোর বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম…
বাপি…তুমি আবার সেই শুরু করলে?...আমাকে তাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো…তোমাকে কতবার বলেছি আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না…তুমি কক্ষোনো আমাকে বিয়ের কথা বলবে না…
সকালের মতো আমার দুচোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে জল বেরিয়ে আসছিল…আমাকে আদর করতে করতে বাপি বললেন…আচ্ছা বাবা ঠিক আছে…আর বলবো না…তোর যখন ইচ্ছে হবে আমাকে বলবি…
বিচ্ছুটা কি একটা কাজে ঘরে ঢুকে আমাকে বাবার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে দেখে ফিরে যাচ্ছিল… চোখ মুছে ওকে ডেকে একটু ভারী গলায় বললাম…কি হল…চলে যাচ্ছো কেন…আমি কাঁদছি তো তোমার কি?
কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। হয়তো ভাবছিল …কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা…কখন কাঁদে…কখন হাঁসে আর কখন যে রেগে যায় বোঝা মুশকিল।
বাপি বলল…বাবাই বোসো…আমার মেয়েটা একটা পাগল…কিছু মনে কোরো না…
আমি পাগল?…তুমি আমাকে কাঁদাবে আর আমি কাঁদলেই যত দোষ…
রাতে খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ মুখ নীচু করে বসতেই…আমার থমথমে মুখ দেখে বম্মা জিজ্ঞেস করল…কি রে তিস্তা…তোর কি হয়েছে…বাবাই আবার তোর পেছনে লেগেছিল নাকি?
বাপি বলল…না না…বাবাই কিছু করে নি…ও আমার উপর রেগে আছে…বিয়ের কথা বলেছিলাম বলে কান্নাকাটি করেছে…
বম্মা আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল…মা…রাগ করিস না বাপির উপর…বড় হচ্ছিস…এখনই বিয়ে দেবার সময় না হলেও…তোর বাপির একটা চিন্তা থাকবেই…তুই ছাড়া তোর বাপির আর কে আছে বল? তোর মা থেকেও তো নেই।
তুমি জানো না বম্মা…আমি কতবার বাপিকে বলেছি…তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না…তবুও আমার পেছনে লাগবে…ভালো ছেলে কোথায় পাবো…ভালো ফ্যামিলি না পেলে যে কি হবে…
আচ্ছা বাবা…ঠিক আছে…বলুক না…এখন একটু মাথা ঠান্ডা করে খেয়ে নে…খাওয়ার সময় রাগ করতে নেই…
মায়ের কথা ওঠায় খুব ইচ্ছে করছিল বম্মাকে জড়িয়ে ধরতে… জড়িয়ে ধরে বললাম…বম্মা…আজ আমাকে খাইয়ে দাও না…
তুই একটু বোস…আমি ওদের কে দিয়ে তোকে খাইয়ে দিচ্ছি…
আমাকে আবার আগের মত হাসিখুশি দেখে সবারই ভালো লাগছিল…বম্মার হাতে খেতে খেতে মাঝে মাঝে সৃজনের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম…ভাবখানা যেন এরকম…দেখো…আমি কেমন মজা করে মায়ের হাতে খাচ্ছি…একটু পরেই অন্যদিকে তাকিয়ে ওর পায়ে খোঁচা মেরে বললাম…বম্মা দেখো…তুমি আমাকে খাইয়ে দিচ্ছো বলে তোমার ছেলে কেমন মুখ গোমড়া করে আছে…ভীষন হিংসুটে…
আমার বয়ে গেছে হিংসে করতে…মা আমাকেও খাইয়ে দেয়…
এ মা…বুড়ো ছেলে…এখোনো মায়ের হাতে খায়…
আচ্ছা…আমি বুড়ো ছেলে…তুমি কি নার্শারিতে পড়া কচি খুকি নাকি?
আমি তোমার থেকে চার বছরের ছোটো…অতএব…তোমার সাথে আমার তুলনা করা যাচ্ছে না…ইস…বুড়ো ছেলেকে বুড়ো বললে আবার রাগ করে…
আমাদেরকে আবার খুনসুটি করতে দেখে সবাই মুখ টিপে হাসতে শুরু করল। সবার প্রায় খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও আমার বাকি ছিল… বললাম…দাদাই…বাপি…তোমরা উঠে পড়…আমি বম্মাকে খাইয়ে তারপর উঠবো…বম্মা…আমি কিন্তু তোমাকে খাইয়ে দেবো আজ…
বম্মা হেসে বলল…ঠিক আছে…সেই কোন ছোটোবেলায় মায়ের হাতে খেয়েছি…আজ আবার আমি আমার ছোটো মায়ের হাতে খাবো।
দাদাই ওঠার সময় জিজ্ঞেস করল…ছাদে কিছু নেই তো…আকাশের যা অবস্থা… মনে হয় ঝড় বৃষ্টি হতে পারে…
বম্মা বলল…না…সে রকম কিছু নেই…বাবাই… পাঁচিলের টব গুলোকে নামিয়ে দে না বাবা…ঝড়ে পড়ে যেতে পারে…
কিছুক্ষন পর ও ফিরে এসে বললো…টব গুলো নাবিয়ে দিয়েছি…বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে…সহজ়ে থামবে বলে মনে হয় না…
সবাই চলে যাবার পর আমি বম্মাকে খাইয়ে দিচ্ছিলাম…বৃষ্টি হচ্ছে শুনে বললাম... বম্মা…আজ না…বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে…তুমি বকবে না তো?
খাওয়ার পর বৃষ্টিতে ভিজবি…ঠান্ডা লেগে যাবে তো…
বম্মা…প্লিজ…হ্যাঁ…বল…খুব ইচ্ছে করছে…কিচ্ছু হবে না…তুমি আছো তো…ঠান্ডা লাগলে…সেই ছোটোবেলার মতো তেল গরম করে মালিশ করে দেবে…
তুই কি করে জানলি? তুই তো খুব ছোটো ছিলি তখন…
বাপি আমাকে সব বলেছে…বম্মা…প্লিজ…
আচ্ছা বাবা…ঠিক আছে…কিন্তু…রাত হয়েছে…খোলা ছাদে একা থাকবি?…আমারও আবার শরীরটা ভালো নেই…সেই কোন সকালে উঠেছি…
তোমার ছেলেকে বলো না…আমার সাথে যেতে…একদিন না হয় দেরীতে ঘুমোবে…
ঠিক আছে…তুই কিন্তু…বাপিকে বলে যাবি…
বাপিকে না বলে আমি কিচ্ছু করিনা…তুমি তো জানো…বাপি আমার শুধু বাবা নয়…মা ও…
বিচ্ছুটা বিছানায় বসে গিটারটা নিয়ে কিছু একটা সুর বাজাবার চেষ্টা করছিল…বম্মার হাত ধরে ভেতরে ঢুকলেও ও অন্যদিকে মুখ করে থাকায় বুঝতে পারলো না।
এই বাবাই…মায়ের ডাকে ফিরে তাকাতেই আমার সাথে চোখাচুখি হয়ে গেল…ইশারা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু বুঝলো কিনা কে জানে…মাকে বলল… বলো…মা।
তিস্তা কে নিয়ে ছাদে যাবি?...মেয়ের আমার ইচ্ছে হয়েছে বৃষ্টিতে ভেজার…
তুমি যাও না…
আমার শরীরটা ভালো নেই রে…ঘুমোতে হবে…
ঠিক আছে…তোমার মেয়েকে বলে দাও…নিজে ভিজুক…আমাকে যেন না ডাকে…
ঠোট উলটে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বললাম…ইস…আমাকে যেন না ডাকে…আমার বয়ে গেছে তোমাকে ডাকতে…নেহাত রাত হয়েছে…খোলা ছাদে একা একা ভয় লাগবে…না হলে একাই যেতাম…
দেখেছো মা…কি রকম ঝগড়ুটে মেয়ে…আমি ওকে কিছু বলেছি?
এই দেখো…আবার দুটোতে ঝগড়া শুরু করে দিলো…তোরা যা…আমি শুতে যাচ্ছি…তিস্তা ফিরে এসে কিন্তু স্নান করবি…না হলে জ্বর এসে যাবে…
ঠিক আছে বম্মা…তুমি চিন্তা কোরো না।
বম্মা বেরিয়ে যাবার পর ও আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…সত্যিই ভিজবে নাকি…অন্য কিছু ইচ্ছে আছে?
হাসি হাসি মুখ করে বললাম…কি আবার ইচ্ছে হবে…
কি জানি বাবা…তোমাকে বোঝা খুব মুশকিল…কখন যে কি করে বসবে…
বোঝার চেষ্টা করলেই বুঝবে…চলো না…বৃষ্টি থেমে গেলে আমার আর ভেজা হবে না…
ছাদের দরজার পরেও বেশ কিছুটা শেড আছে…সৃজন ওর তলায় দাঁড়িয়ে বলল…যাও…তুমি ভেজো…আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি…
কি সুন্দর লাগছে না…ঝমঝম করে বৃষ্টিতে গাছগুলো কেমন সুন্দর ভিজছে…হাওয়ার সাথে দোল খেতে খেতে…ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই আস্তে আস্তে ছাদের মাঝে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফুল গাছগুলো কে পরম মমতায় ছুঁয়ে যেন আদর করছি…রাতের মেঘে ভরা আকাশের অল্প আলোতে নিজেকে যেন মায়াবী কোনো কিছুর মতো লাগছিল…
ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলাম…এই…তুমি গান শুনতে চেয়েছিলে না…গাইবো?
আমি কখন ওর সামনে এসে ওকে কিছু বলেছি বোধ হয় বুঝতে পারেনি…অবাক হয়ে আমার বৃষ্টি ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম…এই দুষ্টূ ছেলে…মেয়েদের বৃষ্টি ভেজা শরীরের দিকে তাকাতে নেই…জানো না…মন খারাপ করে…এই…বলো না…গান শুনবে কি না…
গাও…
চলো…বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গান শোনাবো…
আমাকেও যেতে হবে?
আমার সাথে না গেলে…কিভাবে আমি গান শোনাবো… বলো…
ওর হাত ধরে ছাদের মাঝে নিয়ে গিয়ে বললাম… এখানে দাঁড়াও…
ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার দিকে তাকিয়ে …আমি জুঁই ফুলের গাছটাকে আলতো ছুঁয়ে যেতে যেতে গাইছি…
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি…এ কোন অপরুপ সৃষ্টি…
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি…আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি…
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি…এ কোন অপরুপ সৃষ্টি…
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি…আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি…
এত মেঘের কোনে কোনে এলো বাতাস হু হু সনে
এত মেঘের কোনে কোনে এলো বাতাস হু হু সনে
রিম ঝিম ঝিম রিম বৃষ্টি
তোমার অঝোর ধারায় ভিজে…আমি নতুন হলাম নিজে……
মা মাপাধাপা নি আজ হারিয়ে গেছি আমি
বৃষ্টি তুমি এতো কেন মিষ্টি
হয়তো ও ভাবছিল…এ কোন তিস্তা…আজ সারাদিনের সেই তিস্তা যেন অন্য কেউ…হয়তো ওর ভীষন ভালো লাগছিল…বৃষ্টিতে ভিজে এত সুন্দর গান শুনতে…এক অজানা জগতে হারিয়ে যেতে যেতে শুনলো…
কই…বললে না তো…কেমন লাগলো…
সম্বিত ফিরে পেয়ে আমার দিকে তাকালো…আমি ওর দিকে এক অপরুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি…আমার ভেজা ঠোঁট দুটো যেন কিছু বলতে চাইছে…ওকে
দুহাত বাড়িয়ে আমার মুখটা আলতো ভাবে ধরে কপালে ওর ঠোঁটটা ছুঁইয়ে ফিস ফিস করে বলল…আজ নয়…যদি কোনো দিন সুযোগ আসে…তুমি যদি শুনতে চাও…সেদিন বোলবো…কেমন লাগলো…
থরথর করে কেঁপে উঠলাম…কিছু বলতে আর কিছু শুনতে চাইলেও… না পাওয়ার ব্যাথায় ক্ষনিকের জন্য বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল…নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম…চলো…অনেক রাত হয়েছে…