02-03-2021, 06:56 PM
(This post was last modified: 03-03-2021, 06:04 PM by রাজা রাম. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
তিস্তা তুমি যে অপাপবিদ্ধা
রাতের দার্জিলিং মেল #
রাত কত কে জানে … অন্ধকার চিরে দার্জিলিং মেল এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্ত্যবের দিকে…ট্রেনটা তার গন্ত্যবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নাকি আমাকে আমার গন্ত্যবের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ভেবে হাসি পেয়ে গেল…কোনোটাই ভুল নয়…দুটোই ঠিক। লোয়ার বার্থের জানলার পাশে চুপ করে বসে আছি…সবাই ঘুমোচ্ছে কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। জানলার পর্দা সরিয়ে রেখে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলকানিতে বাইরের অন্ধকার কেটে গিয়ে নিস্তব্ধ বিশ্বচরাচরের নিঃসঙ্গতা যেন আরো প্রকট করে তুলছিল।
তিস্তা…বাপির ডাকে সম্বিত ফিরে এলো।
কি বাপি?
কি রে ঘুম আসছে না? একটু ঘুমিয়ে নে মা…না হলে শরীর খারাপ করতে পারে।
বাপি…কাল সকালে আমরা কখন পৌছোবো?
সাড়ে ছয় কি সাতটার ভেতর পৌছে যাবো।
তুমি জানো তো কিভাবে যাবো আমরা ওদের বাড়ীতে?
তোর দাদাই ছেলেকে নিয়ে স্টেশনে আসবে আমাদের নিতে, ওদের নতুন বাড়ীতে আমি কোনোদিন যাইনি।
আগে বলোনি তো।
আমরা বেরোবার ঠিক আগে ফোন করে বলেছিল, তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর যেন নেমে গেল। যাকে কিছু বলার জন্য এতদুর থেকে যাচ্ছি তার সাথে আর কয়েক ঘন্টা পরেই দেখা হবেই জেনে এক অজানা আনন্দে মন ভরে উঠল। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে শুয়ে পড়লাম…চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করছি…যার কথা শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে… সে কেমন হবে? সেই আগের মতো একটু অহ্নকারী? নাকি এখন বড় হয়ে গিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে গেছে? আমাকে দেখলে তো এতোদিন বাদে চিনতে পারবে না…সেই ছোটোবেলার মতো পেছনে লাগবে? খুনসুটি করবে?…মনে অনেক প্রশ্ন…কিন্তু একটারও উত্তর জানা নেই। ওকে কি ভাবে বলবো যে আমার এই সুন্দর জীবনটা তোমারই উপহার…তুমি যদি সেদিন না থাকতে…ভাবতেই পারিনা…কি যে হোতো। এক অদ্ভুত ভালোলাগার সাথে সাথে এক অজানা অস্বস্তির কাঁটা যেন বুকে বিঁধছিল। ঠিক কিভাবে গুছিয়ে বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের উপর খুব রাগ করে নিজের মনে মনে বললাম…ধুস…আমি কি ওকে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলতে যাচ্ছি? শুধু তো থ্যাঙ্কস জানাবার জন্য যাচ্ছি…এত ভাবার কি আছে।
অনেক রাতে শুলেও খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না…আস্তে আস্তে উঠে আবার জানলার পর্দা সরিয়ে দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করলাম। ট্রেনটা বেশ জোরে দৌড়োচ্ছে… বাপির বার্থের পর্দাটা সরিয়ে… বাপি ঘুমোচ্ছে দেখে আর ডাকলাম না। চোখে মুখে জল দিয়ে এসে আবার বাইরের দিকে তাকালাম…খুব বৃষ্টি হচ্ছে বোধহয়…জানলার কাঁচটা পুরো ঝাপসা হয়ে আছে। কিছু করার নেই দেখে বালিশের উপর কম্বল টা ভাঁজ করে একটু উঁচু করে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছি। একজন একজন করে সহযাত্রীরা উঠতে শুরু করেছে। কামরার মধ্যে সেই নিঝুমভাব টা আর নেই…কফিওয়ালার থেকে একটা কফি নিয়ে চুমুক দিতে দিতে আবার বাইরের দিকে তাকালাম…এখন আর বৃষ্টি হচ্ছে না। পুব আকাশে লাল আভার মাঝখান থেকে সুর্য উঁকি মারতে শুরু করেছে। পরিবেশটা এখন আর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে না…প্রচুর বাড়ী, বাগান পুকুরের পাশ দিয়ে ট্রেনটা দৌড়োচ্ছে। মাঝে মাঝে স্টেশান গুলো পাস দিয়ে যেন হুস করে বেরিয়ে পেছনে চলে যাচ্ছে।
কিরে…এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি কেন…ঘুমিয়েছিস তো? বাপির ডাকে প্রায় চমকে উঠলাম।
হ্যাঁ…এইতো একটু আগে উঠলাম…বাপি কফি খাবে?
তুই খেয়েছিস?
তোমার সাথে আর একবার খাবো…বাপি… আমরা কদিন থাকবো?
আমার তো দিন পনেরো লাগবে সব কাজ শেষ হতে। কেন রে বন্ধুদের জন্য মন খারাপ করছে নাকি?
নাঃ…ভাবছিলাম তুমি তো কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে…আমি একা একা কি করবো।
তুই একা থাকবি কেন…তোর বম্মা, বাবাই… ওরা তো আছে। আমি তোর বম্মাকে বলে রেখেছি…বাবাই তোকে কলকাতায় সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাবে। ওর এখন ছুটি আছে, অসুবিধা হবে না।
ওর তো কিছু কাজ থাকতে পারে, আমার জন্য শুধু শুধু আবার সেগুলোর ক্ষতি হতে পারে।
বাপি পাশে বসে কাঁধে হাত দিয়ে বললেন…আমার মেয়েটা এক্কেবারে পাগল…তোকে এত চিন্তা করতে হবে না…আসার আগে এত লাফালাফি করলি আর এখন মন খারাপ করছিস।
বাপির কাঁধে মাথা রেখে বাপির হাত টা নিজের হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম…আমার তো থাকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কেমন যেন ভয় লাগছে…ওরা যদি আমাকে পছন্দ না করে।
ওরা ভীষন ভালো রে …তুই অনেক ছোটোবেলায় দেখেছিস তো…অনেক কিছুই ভুলে গেছিস…তাই বুঝতে পারছিস না…আমার তিস্তার মতো মিষ্টি মেয়েকে পছন্দ না করে কেউ থাকতে পারবেই না…আমার তো ভয় হচ্ছে…তুই আবার না বলিস যে আর ফিরবো না…আমাকে কোলকাতার কলেজে ভর্তি করে দাও…
বাপির গালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললাম…আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোই না…
সারা জীবন কি আমার কাছে থাকবি নাকি? এরপর তো পড়াশোনার জন্য বাইরে যেতে হবে…তারপর চাকরী নিয়ে কোথায় যেতে হবে তার ঠিক নেই…সেটল হয়ে গেলে তোর বিয়ে দিতে হবে না?
ধ্যাত…আমি কি বিয়ে করবো বলেছি?
তুই না বললে কি তোর বিয়ে দিতে হবে না…সব মেয়েকেই এক সময় মা বাবাকে ছেড়ে যেতে হয়…
ভালো লাগছিল না… আর কিছু না বলে চুপ করে বসে আছি…বাপিকে ছেড়ে যেতে হবে একদিন না একদিন ভাবলেই কান্না পেয়ে যায়…আমি ছাড়া যে বাপির আর কেউ নেই…দু চোখের কোন আস্তে আস্তে ভিজে যাচ্ছিল। বাপি হয়তো খেয়াল করে নি আমার চোখে জল… না হলে নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে আদর করতো…আমার মনটাকে ঠিক করার জন্য। ট্রেনটা আগের মতো জোরে এগোচ্ছে না দেখে বাপি বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল… আর কিছুক্ষনের ভেতরেই পৌঁছে যাবো। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠলাম… ফ্রেস হতে হবে। রাতের জামাকাপড় পালটে এখন একটা হালকা সবুজ…কচি কলাপাতা টপ আর তার সাথে দুধসাদা গাউন পরে নিয়েছি, দুটো রং ই আমার ভীষন প্রিয়…আর কি করা যায় ভাবতে ভাবতে কপালে হালকা সবুজ ছোট্ট একটা টিপ লাগিয়ে আয়নায় দেখলাম…কেমন লাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবছি…ও আমাকে দেখে পছন্দ করবে তো? নিজেকেই বকুনি দিয়ে বললাম… পছন্দ করুক বা না করুক…কি আসে যায় তাতে… কাল রাতেই তো বোঝালাম… প্রেম করতে যাচ্ছি না।
বাপি মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন…খুব সুন্দর লাগছে।
ঠিক বলছো তো নাকি আমাকে ভোলাবার জন্য?
নারে…সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে তোকে।
প্রতীক্ষার অবসান #
ট্রেনটা শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছোবার পর এক এক করে সবাই নেবে যাচ্ছিল…চারদিকে হই হট্টগোল…এত লোকে কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায় কে জানে ভাবতে ভাবতে বাপির দিকে তাকিয়ে দেখলাম… আরাম করে বসে আছে…যেন নামার ইচ্ছে নেই…
বাপি চলো…আমরা কি এখানে বসে থাকবো নাকি।
সবাই নেবে যাক…ওরা আমাদের কামরার কাছে আসবে বলেছে…
জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে লোকজনের যাওয়া আসা দেখছি…সারা প্ল্যাটফরম টা লোকে গিজগিজ করছে…তার মাঝখান দিয়ে দুজনকে আমাদের কামরার দিকে আসতে দেখলাম…ভীড়ের মাঝখান দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে এগোচ্ছে…একজন বাপির বয়সী বা একটু বেশী হবে আর সাথের ছেলেটি হয়তো কুড়ি বাইশ হবে। খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। জানলার পাশে এসে ছেলেটা বোধহয় ওর বাবাকে কিছু একটা বলছিল…ততক্ষনে বাপিও ওদের কে দেখতে পেয়ে গেছে…হাত নেড়ে বাপি চেঁচিয়ে বলল…মেশোমশায়…এই তো আমরা…এই তিস্তা চল…ওরা এসে গেছে…
বাপি…তুমি না…ওরা শুনতে পাবে নাকি?
ওঃ…খুব ভুল হয়ে গেছে রে…খেয়ালই নেই আমরা এসি তে আছি।
বাপি উঠে ব্যাগ গুলো এক জায়গায় করতে করতে ওরা চলে এলো…ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম হয়েছে তো…বেশ লম্বা…কি সুন্দর চোখ দুটো…একটু যেন দুষ্টুমিতে ভরা…ব্লু জিন্স আর লালের উপর সাদা স্ট্রাইপ টি সার্টে দারুন দেখাচ্ছে…ওর সাথে একবার চোখাচুখি হতেই মুখ নাবিয়ে নিলাম…বুকের ভেতরটা একটু যেন কেঁপে উঠল। দাদাই… বেশ খুশীর সাথে আমার দিকে তাকিয়ে বলল… তিস্তা? আমাদের সেই ছোট্ট তিস্তা…কত বড় হয়ে গেছিস… চিনতেই পারছি না।
হেসে বললাম… তোমাকে দেখে আমিও চিনতে পারিনি।
আর…পারবি কি করে… কত বছর পর দেখা।
বাপি আর দাদাই যেন ভুলেই গেছে আর কেউ আছে…খুশী যেন আর ধরছে না ওদের, দুজনেই বকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আর বোধ হয় কোনোদিন দেখা হবে না। এখনই সব কথা শেষ করতে হবে।
ছেলেটা পাশ থেকে বলল …বাবা আমি একটা কুলি নিয়ে আসছি…তোমরা বোসো। ভীড় কমে এসেছে…এবার যাওয়া যাবে…
ব্যাগ গুলো কুলির মাথায় তোলা হয়ে গেলে ট্রেন থেকে নামলাম…ছেলেটা বলল…বাবা তোমরা ধীরে সুস্থে এসো…এ ব্যাটা কুলির সাথে তোমরা দৌড়োতে পারবে না…আমি গাড়িতে থাকবো…বলেই কুলির সাথে হনহন করে এগিয়ে গেল।
বাপির হাত ধরে এগোচ্ছি… খুব অভিমান হচ্ছিল…কি অহ্নকারী ছেলেরে বাবা…একটুও পাত্তা দিলো না… সাথে করে তো নিয়ে যেতে পারতো…বাপির তো খেয়ালই নেই যে মেয়ে সাথে আছে…যাকগে ও পাত্তা না দিলে আমিও পাত্তা দেবো না…বয়ে গেছে আমার ওর সাথে কথা বলতে।
রাতের দার্জিলিং মেল #
রাত কত কে জানে … অন্ধকার চিরে দার্জিলিং মেল এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্ত্যবের দিকে…ট্রেনটা তার গন্ত্যবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নাকি আমাকে আমার গন্ত্যবের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ভেবে হাসি পেয়ে গেল…কোনোটাই ভুল নয়…দুটোই ঠিক। লোয়ার বার্থের জানলার পাশে চুপ করে বসে আছি…সবাই ঘুমোচ্ছে কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। জানলার পর্দা সরিয়ে রেখে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলকানিতে বাইরের অন্ধকার কেটে গিয়ে নিস্তব্ধ বিশ্বচরাচরের নিঃসঙ্গতা যেন আরো প্রকট করে তুলছিল।
তিস্তা…বাপির ডাকে সম্বিত ফিরে এলো।
কি বাপি?
কি রে ঘুম আসছে না? একটু ঘুমিয়ে নে মা…না হলে শরীর খারাপ করতে পারে।
বাপি…কাল সকালে আমরা কখন পৌছোবো?
সাড়ে ছয় কি সাতটার ভেতর পৌছে যাবো।
তুমি জানো তো কিভাবে যাবো আমরা ওদের বাড়ীতে?
তোর দাদাই ছেলেকে নিয়ে স্টেশনে আসবে আমাদের নিতে, ওদের নতুন বাড়ীতে আমি কোনোদিন যাইনি।
আগে বলোনি তো।
আমরা বেরোবার ঠিক আগে ফোন করে বলেছিল, তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর যেন নেমে গেল। যাকে কিছু বলার জন্য এতদুর থেকে যাচ্ছি তার সাথে আর কয়েক ঘন্টা পরেই দেখা হবেই জেনে এক অজানা আনন্দে মন ভরে উঠল। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে শুয়ে পড়লাম…চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করছি…যার কথা শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে… সে কেমন হবে? সেই আগের মতো একটু অহ্নকারী? নাকি এখন বড় হয়ে গিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে গেছে? আমাকে দেখলে তো এতোদিন বাদে চিনতে পারবে না…সেই ছোটোবেলার মতো পেছনে লাগবে? খুনসুটি করবে?…মনে অনেক প্রশ্ন…কিন্তু একটারও উত্তর জানা নেই। ওকে কি ভাবে বলবো যে আমার এই সুন্দর জীবনটা তোমারই উপহার…তুমি যদি সেদিন না থাকতে…ভাবতেই পারিনা…কি যে হোতো। এক অদ্ভুত ভালোলাগার সাথে সাথে এক অজানা অস্বস্তির কাঁটা যেন বুকে বিঁধছিল। ঠিক কিভাবে গুছিয়ে বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের উপর খুব রাগ করে নিজের মনে মনে বললাম…ধুস…আমি কি ওকে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলতে যাচ্ছি? শুধু তো থ্যাঙ্কস জানাবার জন্য যাচ্ছি…এত ভাবার কি আছে।
অনেক রাতে শুলেও খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না…আস্তে আস্তে উঠে আবার জানলার পর্দা সরিয়ে দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করলাম। ট্রেনটা বেশ জোরে দৌড়োচ্ছে… বাপির বার্থের পর্দাটা সরিয়ে… বাপি ঘুমোচ্ছে দেখে আর ডাকলাম না। চোখে মুখে জল দিয়ে এসে আবার বাইরের দিকে তাকালাম…খুব বৃষ্টি হচ্ছে বোধহয়…জানলার কাঁচটা পুরো ঝাপসা হয়ে আছে। কিছু করার নেই দেখে বালিশের উপর কম্বল টা ভাঁজ করে একটু উঁচু করে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছি। একজন একজন করে সহযাত্রীরা উঠতে শুরু করেছে। কামরার মধ্যে সেই নিঝুমভাব টা আর নেই…কফিওয়ালার থেকে একটা কফি নিয়ে চুমুক দিতে দিতে আবার বাইরের দিকে তাকালাম…এখন আর বৃষ্টি হচ্ছে না। পুব আকাশে লাল আভার মাঝখান থেকে সুর্য উঁকি মারতে শুরু করেছে। পরিবেশটা এখন আর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে না…প্রচুর বাড়ী, বাগান পুকুরের পাশ দিয়ে ট্রেনটা দৌড়োচ্ছে। মাঝে মাঝে স্টেশান গুলো পাস দিয়ে যেন হুস করে বেরিয়ে পেছনে চলে যাচ্ছে।
কিরে…এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি কেন…ঘুমিয়েছিস তো? বাপির ডাকে প্রায় চমকে উঠলাম।
হ্যাঁ…এইতো একটু আগে উঠলাম…বাপি কফি খাবে?
তুই খেয়েছিস?
তোমার সাথে আর একবার খাবো…বাপি… আমরা কদিন থাকবো?
আমার তো দিন পনেরো লাগবে সব কাজ শেষ হতে। কেন রে বন্ধুদের জন্য মন খারাপ করছে নাকি?
নাঃ…ভাবছিলাম তুমি তো কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে…আমি একা একা কি করবো।
তুই একা থাকবি কেন…তোর বম্মা, বাবাই… ওরা তো আছে। আমি তোর বম্মাকে বলে রেখেছি…বাবাই তোকে কলকাতায় সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাবে। ওর এখন ছুটি আছে, অসুবিধা হবে না।
ওর তো কিছু কাজ থাকতে পারে, আমার জন্য শুধু শুধু আবার সেগুলোর ক্ষতি হতে পারে।
বাপি পাশে বসে কাঁধে হাত দিয়ে বললেন…আমার মেয়েটা এক্কেবারে পাগল…তোকে এত চিন্তা করতে হবে না…আসার আগে এত লাফালাফি করলি আর এখন মন খারাপ করছিস।
বাপির কাঁধে মাথা রেখে বাপির হাত টা নিজের হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম…আমার তো থাকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কেমন যেন ভয় লাগছে…ওরা যদি আমাকে পছন্দ না করে।
ওরা ভীষন ভালো রে …তুই অনেক ছোটোবেলায় দেখেছিস তো…অনেক কিছুই ভুলে গেছিস…তাই বুঝতে পারছিস না…আমার তিস্তার মতো মিষ্টি মেয়েকে পছন্দ না করে কেউ থাকতে পারবেই না…আমার তো ভয় হচ্ছে…তুই আবার না বলিস যে আর ফিরবো না…আমাকে কোলকাতার কলেজে ভর্তি করে দাও…
বাপির গালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললাম…আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোই না…
সারা জীবন কি আমার কাছে থাকবি নাকি? এরপর তো পড়াশোনার জন্য বাইরে যেতে হবে…তারপর চাকরী নিয়ে কোথায় যেতে হবে তার ঠিক নেই…সেটল হয়ে গেলে তোর বিয়ে দিতে হবে না?
ধ্যাত…আমি কি বিয়ে করবো বলেছি?
তুই না বললে কি তোর বিয়ে দিতে হবে না…সব মেয়েকেই এক সময় মা বাবাকে ছেড়ে যেতে হয়…
ভালো লাগছিল না… আর কিছু না বলে চুপ করে বসে আছি…বাপিকে ছেড়ে যেতে হবে একদিন না একদিন ভাবলেই কান্না পেয়ে যায়…আমি ছাড়া যে বাপির আর কেউ নেই…দু চোখের কোন আস্তে আস্তে ভিজে যাচ্ছিল। বাপি হয়তো খেয়াল করে নি আমার চোখে জল… না হলে নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে আদর করতো…আমার মনটাকে ঠিক করার জন্য। ট্রেনটা আগের মতো জোরে এগোচ্ছে না দেখে বাপি বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল… আর কিছুক্ষনের ভেতরেই পৌঁছে যাবো। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠলাম… ফ্রেস হতে হবে। রাতের জামাকাপড় পালটে এখন একটা হালকা সবুজ…কচি কলাপাতা টপ আর তার সাথে দুধসাদা গাউন পরে নিয়েছি, দুটো রং ই আমার ভীষন প্রিয়…আর কি করা যায় ভাবতে ভাবতে কপালে হালকা সবুজ ছোট্ট একটা টিপ লাগিয়ে আয়নায় দেখলাম…কেমন লাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবছি…ও আমাকে দেখে পছন্দ করবে তো? নিজেকেই বকুনি দিয়ে বললাম… পছন্দ করুক বা না করুক…কি আসে যায় তাতে… কাল রাতেই তো বোঝালাম… প্রেম করতে যাচ্ছি না।
বাপি মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন…খুব সুন্দর লাগছে।
ঠিক বলছো তো নাকি আমাকে ভোলাবার জন্য?
নারে…সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে তোকে।
প্রতীক্ষার অবসান #
ট্রেনটা শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছোবার পর এক এক করে সবাই নেবে যাচ্ছিল…চারদিকে হই হট্টগোল…এত লোকে কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায় কে জানে ভাবতে ভাবতে বাপির দিকে তাকিয়ে দেখলাম… আরাম করে বসে আছে…যেন নামার ইচ্ছে নেই…
বাপি চলো…আমরা কি এখানে বসে থাকবো নাকি।
সবাই নেবে যাক…ওরা আমাদের কামরার কাছে আসবে বলেছে…
জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে লোকজনের যাওয়া আসা দেখছি…সারা প্ল্যাটফরম টা লোকে গিজগিজ করছে…তার মাঝখান দিয়ে দুজনকে আমাদের কামরার দিকে আসতে দেখলাম…ভীড়ের মাঝখান দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে এগোচ্ছে…একজন বাপির বয়সী বা একটু বেশী হবে আর সাথের ছেলেটি হয়তো কুড়ি বাইশ হবে। খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। জানলার পাশে এসে ছেলেটা বোধহয় ওর বাবাকে কিছু একটা বলছিল…ততক্ষনে বাপিও ওদের কে দেখতে পেয়ে গেছে…হাত নেড়ে বাপি চেঁচিয়ে বলল…মেশোমশায়…এই তো আমরা…এই তিস্তা চল…ওরা এসে গেছে…
বাপি…তুমি না…ওরা শুনতে পাবে নাকি?
ওঃ…খুব ভুল হয়ে গেছে রে…খেয়ালই নেই আমরা এসি তে আছি।
বাপি উঠে ব্যাগ গুলো এক জায়গায় করতে করতে ওরা চলে এলো…ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম হয়েছে তো…বেশ লম্বা…কি সুন্দর চোখ দুটো…একটু যেন দুষ্টুমিতে ভরা…ব্লু জিন্স আর লালের উপর সাদা স্ট্রাইপ টি সার্টে দারুন দেখাচ্ছে…ওর সাথে একবার চোখাচুখি হতেই মুখ নাবিয়ে নিলাম…বুকের ভেতরটা একটু যেন কেঁপে উঠল। দাদাই… বেশ খুশীর সাথে আমার দিকে তাকিয়ে বলল… তিস্তা? আমাদের সেই ছোট্ট তিস্তা…কত বড় হয়ে গেছিস… চিনতেই পারছি না।
হেসে বললাম… তোমাকে দেখে আমিও চিনতে পারিনি।
আর…পারবি কি করে… কত বছর পর দেখা।
বাপি আর দাদাই যেন ভুলেই গেছে আর কেউ আছে…খুশী যেন আর ধরছে না ওদের, দুজনেই বকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আর বোধ হয় কোনোদিন দেখা হবে না। এখনই সব কথা শেষ করতে হবে।
ছেলেটা পাশ থেকে বলল …বাবা আমি একটা কুলি নিয়ে আসছি…তোমরা বোসো। ভীড় কমে এসেছে…এবার যাওয়া যাবে…
ব্যাগ গুলো কুলির মাথায় তোলা হয়ে গেলে ট্রেন থেকে নামলাম…ছেলেটা বলল…বাবা তোমরা ধীরে সুস্থে এসো…এ ব্যাটা কুলির সাথে তোমরা দৌড়োতে পারবে না…আমি গাড়িতে থাকবো…বলেই কুলির সাথে হনহন করে এগিয়ে গেল।
বাপির হাত ধরে এগোচ্ছি… খুব অভিমান হচ্ছিল…কি অহ্নকারী ছেলেরে বাবা…একটুও পাত্তা দিলো না… সাথে করে তো নিয়ে যেতে পারতো…বাপির তো খেয়ালই নেই যে মেয়ে সাথে আছে…যাকগে ও পাত্তা না দিলে আমিও পাত্তা দেবো না…বয়ে গেছে আমার ওর সাথে কথা বলতে।