Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
মোম রঙের বাক্স
©ঐন্দ্রিল ভৌমিক
 
শীত অনেকেরই প্রিয় ঋতু সকালের নরম কুয়াশা, খেজুর রস, বনভোজন, হাজার একটা মেলা শীত আমাদের সরকারি চিকিৎসকদের কাছেও প্রিয় তবে তার কারণটা অন্য
 
শীতকালে আউটডোর আর ইন্ডোরে রোগীর ভিড় বেশ কমে আউটডোর রোগী একধাক্কায় সাতশো- আটশো থেকে তিনশ- চারশোয় নেমে আসে ফুরফুরে মেজাজে রোগী দেখা যায় এমনকি নাইট ডিউটির সময়ে তিন-চার ঘন্টা ঘুমিয়েও নেওয়া যায় রাত বারোটার পর খুব এমারজেন্সি ছাড়া রোগী আসে না
 
এমনই এক শীতের সকালে আউটডোর করছিলাম মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম হাসপাতালে বিশেষ তাড়া নেই রোগী প্রায় শেষ করে এনেছি সামনের রোববার হাসপাতালের সব স্টাফকে নিয়ে একটা পিকনিক করার পরিকল্পনা হচ্ছে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে তাই নিয়ে পীযূষদার সাথে আলোচনা করছি পীযূষদা অর্থাৎ ডাঃ পীযূষ কান্তি পাল পাশের টেবিলে রোগী দেখছে তার সামনেও রোগীর তেমন ভিড় নেই
 
রোগীর লাইনে একটি তেরো- চৌদ্দ বছরের মেয়ে অত্যন্ত রোগা অপুষ্টিতে ভোগা চেহারা চোখের নীচে কালি তবু মেয়েটিকে দেখতে ভালো লাগছে তার একটাই কারণ মেয়েটির মুখে এখনও শৈশবের ছাপ রয়েছে
 
জিজ্ঞসা করলাম, ‘কি হয়েছেরে মনা?’
 
মেয়েটি অত্যন্ত লাজুক ভাবে ফিসফিস করে বলল, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার শরীর খারাপ হয়নি
 
শরীর খারাপ হয়নি তো হাসপাতালে এসেছিস কেন? যা... পালা
 
মেয়েটি চলে গেল না দূরে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ বাদে ডাকলাম, ‘কিছু বলবি? দাঁড়িয়ে রইলি যে বড়!’
 
মেয়েটি আবার বলল, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, এমাসে আমার শরীর খারাপ হয়নি
 
এতক্ষণে মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা বললাম, ‘বয়স কত তোর?’
 
আজ্ঞে, চৌদ্দ
 
সঙ্গে কে এসেছে?’
 
একা এয়েচি
 
চোখের নীচের পাতা টেনে দেখলাম ফ্যাকাশে রক্ত কোথায় যে মাসিক হবে বললাম, ‘শরীর খারাপ কতদিন শুরু হয়েছে?’
 
আজ্ঞে, বছর দুয়েক হবে
 
আমি বললাম, ‘প্রথম প্রথম এরকম একটু সমস্যা হয় অতো টেনশন করিস না এমাসে হয়নি পরের মাসে হবে
 
তবু মেয়েটি যায় না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না
 
ডাক্তারদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অনেক সময় চিকিৎসককে সঠিক রোগ নির্ণয় করতে সাহায্য করে যদিও ক্রেতা সুরক্ষা আইন আর এভিডেন্স বেসড মেডিসিনের যুগে আস্তে আস্তে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দূর্বল হয়ে যাচ্ছে
 
যাই হোক, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে উঠল কিছু একটা গন্ডোগোল আছে একটা ছোটো কাগজে লিখলাম, “ইউরিন ফর প্রেগনেন্সি টেস্ট বললাম, ‘উপরের তলায় একদম মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকে যাবি ওখানে যে সিস্টার দিদি থাকবেন তাঁকে কাগজটা দেখাবি
 
কে জানে কোন সিস্টার ডিউটিতে আছেন? তেমন কেউ থাকলে এইটুকু মেয়ের প্রেগনেন্সি টেস্ট পাঠানোর জন্য ঝাড় খেতে হবে
 
খানিকক্ষণ বাদে দেখি শিল্পীদি মেয়েটিকে নিয়ে আসছেন আমি আতঙ্কিত হলাম সর্বনাশ করেছে টুকু মেয়ের সামনেই আমাকে না ঝাড় খেতে হয়!
 
শিল্পীদি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ডাঃ ভৌমিক, একটু উঠে আসুন এক্সরের ঘরে চলুন
 
এটা একদিক থেকে ভালো ফিল্মের অভাবে আপাতত এক্স রে বন্ধ আছে ঘরটা ফাঁকাই থাকে অতএব ওই ঘরে ঝাড় খেলে কেউ জানতেও পারবে না
 
এক্সরের ঘরে ঢুকে বললাম, ‘কি বলবেন, বলুন
 
দিদির গলায় অবিশ্বাস, ‘ডাঃ ভৌমিক আপনি কার্ডটা দেখুন
 
হাতে নিয়ে দেখলাম দুটো দাগ এই দুটো দাগ নবদম্পতির জীবনে সবচেয়ে খুশি নিয়ে আসে আর এই বালিকার জীবনে ঝড় তুলবে
 
আমি বললাম, ‘দেখেছেন কাণ্ড আজকালকার মেয়েগুলো কি জিনিস এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয়, ওদিকে...’
 
এইবার সত্যি সত্যি ঝাড় খেলাম শিল্পীদি বললেন, ‘থামুন যা জানেন না, তাই নিয়ে বড় বড় কথা বলবেন না সব মেয়েদের দোষ, তাই না? আপনি জানেন ঘটনাটা কি?’
 
ঘাড় নাড়লাম সত্যিই কিছু জানিনা
 
দিদি বললেন, ‘দিনের পর দিন একটা নোংরা, কুৎসিত, মাঝ বয়সী লোক ছোট্ট মেয়েটাকে ;., করেছে সম্পর্কে লোকটি ওর জামাইবাবু হয় নিজের জামাইবাবু মেয়েটির বাবা নেই শুধু মা আর দুই মেয়ে সকলে জামাইবাবুর কাছেই থাকে মেয়েটা মা কে, দিদিকে অনেকবার বলেছে কেউ বিশ্বাস করেনি অথবা বিশ্বাস করলেও প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি দুবেলা দুমুঠো ভাতের দাম নিজের পেটের মেয়ের দামের থেকে বেশী
 
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েটিকে আবার দেখলাম ওর দুচোখে গভীর আতঙ্ক শরীর থেকে শৈশব যাওয়ার বহু আগেই ওর মন থেকে শৈশব বিদায় নিয়েছে
 
শিল্পীদি বললেন, ‘আমি ওকে একটু উপরে নিয়ে যাচ্ছি একটু কাউন্সিলিং করে দি আর ওর মাকে বিকালে আপনার সাথে দেখা করতে বলছি
 
সেদিন বিকালেই মেয়েটির মা কোয়ার্টারে এলেন চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এনার হিমোগ্লোবিন মেয়েটির চেয়েও কম বয়স যাই হোক কৃশ শরীর থেকে নারীত্বের সব চিহ্নই অকালে বিদায় নিয়েছে
 
আমার কাছে সব শুনে তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন 
 
বললাম, ‘চুপ করে রইলেন কেন? কিছুতো করতেই হবে তাড়াতাড়ি এবরশন না করলে পরে অসুবিধা হবে
 
মহিলা বললেন, ‘ওই হতভাগা মেয়ে মরলে আমার হাড় জুড়ায়
 
আমি ধমক দিলাম বললাম, ‘উল্টোপাল্টা না বকে সমাধান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন কান্দিতে আমার চেনা একজন গাইনোকোলোজিস্ট আছেন ডাঃ অর্জুন গুপ্ত ওনাকে বলে দেব আপনি গিয়ে সোজা হাসপাতালে যোগাযোগ করুন
 
হাসপাতালে ভর্তি হলে জানাজানি হবে জামাই কিছুতেই তা করতে দেবে না
 
মনের রাগ চেপে রেখে বললাম, ‘তাহলে প্রাইভেটে ওনার সাথে যোগাযোগ করুন
 
প্রাইভেটে তো অনেক পয়সা লাগবে
 
বললাম, ‘আমার নাম বলবেন, কম পয়সা নেবেন ঠিক আছে, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি’ 
 
অর্জুনদাকে ফোন করলাম, ‘একটা এম টি পি করতে হবে চৌদ্দ বছর বয়েসে এক্সিডেন্টাল প্রেগনেন্সি বাড়ির লোক সরকারি জায়গায় লোক জানাজানির ভয়ে করতে চায়না প্রাইভেটে করাবে এদিকে আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ
 
আটশো টাকা দিতে পারবে?’
 
অ্যাঁ... কত?’
 
বলছি, আটশো টাকা খরচ করতে পারবে আমার আর এনাস্থেটিক্সের খরচ লাগবে না শুধু নার্সিং হোমের ওটির ভাড়া আর ওষুধপত্র সকালে আনলে বিকেলেই ছেড়ে দেব আর যদি তাও না পারে তাহলে আমার অ্যাডমিশান ডে দিন পাঠিয়ে দে তুই একটা চিঠি লিখে দিস আমি ডি সি করে সেদিনই ছেড়ে দেব’ 
 
আমি বললাম, ‘আটশো টাকা জোগাড় করতে নিশ্চয়ই পারবে মেয়েটার জীবন মরনের ব্যাপার ঠিক আছে, আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলছি
 
মেয়েটির মাকে সব বুঝিয়ে বললাম অর্জুনদার কাছে একটা চিঠিও লিখে দিলাম ওই অমানুষ জামাইকে ছেড়ে মা আর মেয়েদের কোনও আশ্রমে চলে যাওয়ার জন্য বলতে গেছিলাম মহিলা এমন প্যানপ্যানে কান্না আরম্ভ করল যে সে চেষ্টায় বিরতি দিলাম যাগগে, ওর মেয়ে যা ভালো বোঝে করুক
 
দুটোদিন কেটে গেছে এক রাত্রিরে পীযূষদা আমায় ডেকে তুলল বলল, ‘ঐন্দ্রিল, খুব বাজে পেশেন্ট এসেছে
 
আমি পাশ ফিরে শুলাম বললাম, ‘তোমার নাইট ডিউটি ভালো হোক, বাজে হোক, তোমার পেশেন্ট তুমি সামলাও না সামলাতে পারলে কান্দি রেফার কর আমাকে ডাকছ কেন?’
 
পীযুষদা বলল, ‘ঐন্দ্রিল, ওই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে ওই যে চৌদ্দ বছরের প্রেগনেন্ট মেয়েটা আজ সন্ধ্যে থেকে ব্লিডিং পার ভ্যাজাইনা হচ্ছে ওর জামাইবাবু নাকি কি কবিরাজি ওষুধ এনে খাইয়েছে যে ভ্যানে করে এনেছে, সেই ভ্যান রক্তে ভেসে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি চল
 
মুশকিলের ব্যাপার হল এই হাসপাতালে আমিই একমাত্র গাইনিতে হাউস স্টাফ শিপ করা লোক পীযূষদা গাইনি রোগী নিয়ে সমস্যায় পড়লেই আমাকে ডেকে তোলে আমিও অবশ্য কোনও বাচ্চা নিয়ে সমস্যায় পড়লে পীযূষদাকে ডাকতাম যাইহোক গজ গজ করতে করতে হাসপাতালে ছুটলাম
 
লেবার রুমে ঢুকে দেখি প্রকৃত অর্থেই রক্তারক্তি ব্যাপার লেবার টেবিলে শুয়ে মেয়েটি ঠক ঠক করে কাঁপছে আমি চোখ টেনে দেখলাম, একেবারে ফ্যাকাশে নাড়ী অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলছে বললাম, ‘সিস্টার শিগ্রী জেটে আরএল চালান
 
পীযুষদা বলল, ‘ঐন্দ্রিল, এখানে ডি সি করে দিবি?’
 
আমি বললাম, ‘তুমি কি পাগল! মেয়েটার কিছু হলে পাষণ্ড জামাই লোকজন নিয়ে আমার ছাল তুলে দেবে জেটে ফ্লুইড চালিয়ে স্টেবেল করে একে কান্দি সাব ডিভিশানাল হাসপাতালে পাঠাও রক্তেরও দরকার হতে পারে
 
মেয়েটির মা মাথা নিচু করে লেবার রুমের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে বলল, ‘আমি কোথাও নেবোনা মেয়ে মরলে মরুক মরলে ওর বড় দিদি আর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি
 
ইন্দ্রাণীদি ডিউটি করছিলেন তিনি বললেন, ‘একদম বাজে কথা বলবে না তুমি আগে লেবার রুম থেকে বেরোও বেরোও বলছি...ইন্দ্রাণীদি প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েই মেয়েটির মাকে ঘর থেকে বের করলেন
 
আমার আর কিছু করার নেই চোখের সামনে একটা মেয়েকে তো মরতে দেখা যায় না শেষ চেষ্টা করে দেখি
 
ওটি ড্রেস পরে নিলাম ইন্দ্রাণীদি ডি সি সেট তৈরী করে ফেলেছেন স্পেকুলাম ঢুকিয়ে ভলসেলাম দিয়ে সার্ভিক্স ধরতেই মেয়েটি ছট ফট করে উঠল ইন্দ্রানীদি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘পাঁচটা মিনিট সহ্য কর মা এখুনি হয়ে যাবে
 
আমি পিযূষদাকে বললাম, ‘লিগনোকেন টানো সার্ভিক্সে একটু লোকাল দিয়ে করে দি পালসের যা অবস্থা ফোর্ট উইন, ক্যাম্পোজ দিতে সাহস হচ্ছে না
 
কিউরেটর দিয়ে অতি সাবধানে জরায়ুর দেওয়াল থেকে এক অমানুষের লালসা চেঁচে বার করছি নিদারুণ যন্ত্রণায় মেয়েটি কঁকিয়ে উঠছে লোকাল অ্যানাস্থেসিয়ার সাথে আমার ভোকাল অ্যানাস্থেসিয়াও চলছে
 
এই মেয়ে, তোর কি খেতে ভালো লাগে? কালকে সকালে এই দিদি তোকে চপ আর মুড়ি খাওয়াবে তুই একসাথে কটা চপ খেতে পারবি? আর একটু... নড়িস না... তোর কি লাগবে বল? তুই যা চাইবি, তাই দেবো
 
দূর্বল কন্ঠে মেয়েটি বলল, ‘সত্যিই দেবে?’
 
হ্যাঁ... হ্যাঁ তুই বলেই দেখনা
 
আমাকে একটা রঙের বাক্স দেবে? ওই যেটাতে বারোটা মোম রঙ থাকে আর একটা আঁকার খাতা আঁকতে আমার খুব ভালো লাগে
 
ইন্দ্রাণীদির চোখের কোন থেকে জল গড়াচ্ছে পীযূষদা লেবার রুম থেকে বেরিয়ে গেল আমার চোখ ঝাপসা হলে চলবে না আর কয়েকটা মিনিট আবেগকে বাগে রাখতে হবে
 
আমি পিছনে টর্চ ধরে দাঁড়ানো আয়া মাসীকে জোর ধমক দিলাম, ‘ঠিক করে আলো ফেলো আলো এতো নড়ছে কেন!’
★★★★★★★★★★★★★★★
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 02-03-2021, 12:04 PM



Users browsing this thread: 17 Guest(s)