27-02-2021, 08:48 PM
- একটা টিউশনি করবে?
- কোথায়?
- ভবানিপুরে।
- ছাত্র না ছাত্রী?
- ছাত্র। ক্লাস এইট।
- ছাত্র পড়াব না।
- পুলিশ অফিসারের ছেলে। বাবা ডিআইজি। ভালো মাইনে দেবে। ভালো খাবার পাবে। আরে এতো বড়ো পুলিশের ঝাড়ুদার হতে পারাও ভাগ্যের। সুপারিশে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। দুদিন পর আইজি হবেন।
-------------------------
রাজি হয়ে যাই রাজীবের প্রস্তাবে।
রাজীব বলল, মাইনে মাসে আটশ টাকা।
সে সময় আটশ অনেক টাকা। কিন্তু টিউশনিটা রাজীব নিজে না করে কেন যে আমাকে দিচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না।
- তুমি করছ না কেন?
- আমার সময় নেই।
ডিআইজি সাহেবের ছেলের নাম অনি। ফর্সা, তবে ধবধবে নয় কিন্তু বেশ মায়াময়। বিশাল বাড়ি, বারান্দায় দামি ফুলের টব। চারিদিকে সমৃদ্ধির ছড়াছড়ি। রাজীব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ছাত্রের মুখোমুখি হলাম।
- স্যার, বেড়াল প্রথম রাতেই মেরে ফেলা উচিত। আমার কথা নয়, আমার বাবার কথা, ঠিক না?
- ঠিক। কিন্তু বেড়াল কোথায়?
- আছে স্যার, আছে। অনেক বড়ো বেড়াল।
- আমি বেড়াল মারব কেন?
- একটা কথা বলব?
- বলো।
- আগের কথা আগে বলে দেওয়া ভালো। রাখলে আমারও লাভ আপনারও লাভ। নইলে দুজনেরই ক্ষতি। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক।
- কী কথা বলে ফেল।
- আপনার মাইনের চল্লিশ পার্সেন্ট আমাকে দেবেন। আপনার মাইনে আটশ টাকা। চল্লিশ পার্সেন্টে হয় তিনশ কুড়ি টাকা। তবে আমাকে তিনশ দিলেই হবে, কুড়ি টাকা আপনার বখশিস। কী বলেন স্যার?
প্রথমে মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। ইচ্ছে করছিল ঘুরিয়ে একটা চড় দিই। হাত এগিয়ে নিয়েই থামিয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক করে ফেলি আমাকে। তারপর সহজ গলায় আদর মেখে বললাম, কম নেবে কেন বাবা?
- এমনি।
- না, আমি পুরো তিনশ কুড়িই দেব।
- তাহলে স্যার খুচরো দিতে হবে। আমি একশ টাকার নিচে খুচরো রাখি না।
- তাই হবে।
বিচিত্র অভিজ্ঞতার আশায় আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। মজার হবে টিউশনিটা, দেখি কতদূর যেতে পারে অনি। মাস শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে আমি একটি খামে করে তিনশ কুড়ি টাকা অনির হাতে তুলে দিই।
অনি যথাসময়ে টাকা পেয়ে খুশি।
হাসি মুখে বলল, স্যার, আপনি খুব ভালো মানুষ।
আমি বললাম, তুমি আমার কাছ থেকে শিখছ আর আমি শিখছি তোমার কাছ থেকে। দুজনের মাইনে ঠিক সময়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে শ্রমের মর্যাদা মাসের প্রথমদিকে হাসার সুযোগ পায়।
অনি বলল, থ্যাংক ইউ স্যার। সব মানুষ যদি আপনার মতো হতো!
চার মাস পর ডিআইজি সাহেব পড়ার রুমে এলেন। এতদিন তাকে একবারও দেখিনি, বেশ গম্ভীর চেহারা, দেখলে সমীহ আসে। চোখের চশমায়, দামটা পুলিশের পোশাকের মতো ঝিলিক মারছে, হাতের ঘড়িতে আরও বেশি।তিনি অনির একটি খাতা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, মাস্টার, আপনার মাইনে চারশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম।
- কেন স্যার?
- আমরা পুলিশের লোক। গুণীর কদর করতে জানি। এ পর্যন্ত কোনো মাস্টার আমার ছেলের কাছে দুই মাসের বেশি টেকেনি। প্রত্যেকে আমার ছেলেকে বকা দিয়েছে, মেরেছে, অশ্রাব্য কথা বলেছে। ছেলে কেবল আপনারই প্রশংসা করেছে। আপনি নাকি ভালো পড়ান।
তিনি একটা কলম ও একটা ডায়েরি আমার হাতে দিয়ে বলেন, এগুলোর আপনার।
- থ্যাংক ইউ স্যার।
কলমটা ছিল সম্ভবত পার্কার। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ওই সময় পার্কার ছিল আমাদের কাছে স্মার্ট ফোনের মতো লোভনীয়।
সাহেব চলে যেতে অনি বলল : স্যার।
- তুমি কী কলম আর ডায়েরি হতেও ভাগ চাইছ?
অনি হেসে বলল, না স্যার। ও সবে আমার আগ্রহ নেই। টাকা হলে সব পাওয়া যায়।
- তবে?
- আমার পাওনা এখন চারশ আশি টাকা। আমি আশি টাকা নেব না, একশ টাকা নেব। তার মানে পাঁচশ টাকা।
- ঠিক আছে। তুমি আমার টিচার, তোমাকে কুড়ি টাকা বেশি দিতে না পারলে আমার জ্ঞান অর্জন হবে কীভাবে?
অনির হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। কমিশন নিলেও পড়াপাড়ি বেশ ভালোই হচ্ছে। আরও তিন মাস কেটে যায়। এরমধ্যে, আমার মাইনে আরও দুশ টাকা বেড়ে গেছে। অনিকে এখন টাকা দিতে কষ্ট হচ্ছে না।
সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। অনিকে অন্যদিনের চেয়ে বেশ আনমনা মনে হচ্ছে।
বললাম, কী হয়েছে?
- স্যার, আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।
- কী কাজ?
- একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।
- চিঠি তো লিখেই দিই।
- কলেজের চিঠি নয়।
- কোন চিঠি?
- আমার প্রেমিকা, সরি স্যার বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য।
- কী লিখব?
- আপনার মতো করে আপনি লিখে দেবেন। আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে না দেখলে বুকটা কেমন মোচড় খায়। কিছু ভালো লাগে না। সে খুব সুন্দর।
চিঠি লিখে দিলাম গভীর ভাষায়, প্রেমের মমতায়।
রাস্তায় এসে ইচ্ছেমতো হাসলাম। অনি আর রেহাই পাচ্ছে না।
-
খবর পাঠিয়েছে, শুক্রবার তাদের বাড়ি যেতে হবে। অনির জন্মদিন।
কী নিয়ে যাই?
অনেক চিন্তাভাবনা করে অনির বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি লিখি।
অনি চিঠি পড়ে এত খুশি হয় যে, সে মাসের পুরো কমিশনটাই আমাকে ফেরত দিয়ে দেয়।
অবাক হয়ে বললাম, ফেরত দিলে যে?
অনি আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল : আপনার লেখার সম্মানি। স্যার, চিঠিটা একদম ফাটাফাটি হয়েছে।
লেখার সম্মানি! আমি চমকে উঠি। লেখার প্রথম আয়, এ তো মস্ত ব্যাপার! তাহলে কেন এতদিন লিখিনি! অনির উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে পত্রিকায় লেখা শুরু করি। তারপর আস্তে আস্তে লেখা আমার নেশা হয়ে যায়।
-
যতই গল্প করি, যতই প্রেমপত্র লিখে দিই না কেন, লেখপড়ায় অনিকে এমন কৌশলে ব্যস্ত রাখি যে, সে ধীরে ধীরে বইয়ে ঝুঁকে পড়ে, তার সব আনন্দ অন্যান্য জায়গা থেকে বইয়ের পাতায় এসে ভীড় করতে শুরু করে। আগে তার বাবাকে বলত চকলেটের কথা, এখন বলে বইয়ের কথা। আগে ইলেকট্রনিক্স জিনিসে তার আলমারি ছিল ভর্তি; এখন সেখানে ঠাঁই পেয়েছে বই, পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের নানা বই। আমার কাছ থেকে নাম নিয়ে যায় বইয়ের, নিয়ে আসে তার বাবাকে দিয়ে। দেশে না পেলে বিদেশ থেকে। কত দামি দামি বই, আমার কাছে মনে হতো, সামর্থ্যবানদের ইচ্ছাই প্রাপ্তি।
আরও তিন মাস পর আমার মাইনে হয় পনেরশ টাকা। অনেক সরকারি অফিসারও তখন এত মাইনে পেতেন না। এখন অনির পাওনা গিয়ে দাঁড়ায় ছয়শ টাকায়।
মাসের শেষদিন অনিকে ছয়শ টাকা দিতে যাই। লজ্জায় চোখটা নিচু করে ফেলে সে। আগের মতো দ্রুত হাত এগিয়ে দিচ্ছে না।
- সরি স্যার।
- নাও তোমার টাকা।
- লাগবে না স্যার।
- আরে নাও। আমি অত টাকা দিয়ে কী করব?
- স্যার, একমাসে যতটাকা আপনাকে দিই, আমি একদিনে তার চেয়ে অনেক বেশি দামের চকলেট খাই। একটা চকলেটের দাম একশ টাকা, দিনে কুড়িটা চকলেট আমি একাই খাই। বাবার হুকুমে সুইজারল্যান্ড থেকে আসে।
তারপরও আমি বললাম, নাও।
- লাগবে না স্যার।
- আগে লাগত কেন?
- তাস খেলতাম, ওকে দিতাম। এখন তাস খেলা সময় নষ্ট মনে হয়, বই পড়ি।
আমি সাফল্যের হাসি নিয়ে বের হয়ে আসি।
অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর অনির ওখানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সাহেব বলেছেন এক মাস পর থেকে আবার পড়ানো শুরু করতে। আমার মতো ভালো মাস্টারকে তিনি ছাড়বেন না। বদলি হলে সেখানে নিয়ে যাবেন।
পনের দিন পর দেখি আমার মেস বাড়ির সামনে একটা বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে।
হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসি।
অনি আর তার বাবা নামছেন।
সাহেব বললেন, মাস্টার আমার ছেলে থার্ড হয়েছে। এর আগে কোনোদিন পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার ছেলেটাকে বদলে দিয়েছেন।
ডিআইজি সাহেব আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন, আমার ছোট ভাই আমার জন্য সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। আপনাকে দিলাম। এটি কোনো বিনিময় নয়, উপহার; ভালোবাসার নিদর্শন।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন এমন উপহার দেননি।
অনি আমায় প্রণাম করে বলল, স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেনে।
- মাস্টার, অনি আমাকেও পাত্তা দিত না। এ ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল টাকার ঝুড়ি। আপনি তাকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
বললাম, ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
- আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?
- ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
টিউশনি এবং ভালোবাসা
ঘটনার সময়কাল : জানুয়ারি ১৯৮৬।...
-
বিশিষ্ট লেখক ড. আমিন।
"ভালবাসা, শুধুই ভালবাসা'' গ্রন্থে তার জীবনের সত্য ঘটনার অবলম্বনে ।
- কোথায়?
- ভবানিপুরে।
- ছাত্র না ছাত্রী?
- ছাত্র। ক্লাস এইট।
- ছাত্র পড়াব না।
- পুলিশ অফিসারের ছেলে। বাবা ডিআইজি। ভালো মাইনে দেবে। ভালো খাবার পাবে। আরে এতো বড়ো পুলিশের ঝাড়ুদার হতে পারাও ভাগ্যের। সুপারিশে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। দুদিন পর আইজি হবেন।
-------------------------
রাজি হয়ে যাই রাজীবের প্রস্তাবে।
রাজীব বলল, মাইনে মাসে আটশ টাকা।
সে সময় আটশ অনেক টাকা। কিন্তু টিউশনিটা রাজীব নিজে না করে কেন যে আমাকে দিচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না।
- তুমি করছ না কেন?
- আমার সময় নেই।
ডিআইজি সাহেবের ছেলের নাম অনি। ফর্সা, তবে ধবধবে নয় কিন্তু বেশ মায়াময়। বিশাল বাড়ি, বারান্দায় দামি ফুলের টব। চারিদিকে সমৃদ্ধির ছড়াছড়ি। রাজীব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ছাত্রের মুখোমুখি হলাম।
- স্যার, বেড়াল প্রথম রাতেই মেরে ফেলা উচিত। আমার কথা নয়, আমার বাবার কথা, ঠিক না?
- ঠিক। কিন্তু বেড়াল কোথায়?
- আছে স্যার, আছে। অনেক বড়ো বেড়াল।
- আমি বেড়াল মারব কেন?
- একটা কথা বলব?
- বলো।
- আগের কথা আগে বলে দেওয়া ভালো। রাখলে আমারও লাভ আপনারও লাভ। নইলে দুজনেরই ক্ষতি। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক।
- কী কথা বলে ফেল।
- আপনার মাইনের চল্লিশ পার্সেন্ট আমাকে দেবেন। আপনার মাইনে আটশ টাকা। চল্লিশ পার্সেন্টে হয় তিনশ কুড়ি টাকা। তবে আমাকে তিনশ দিলেই হবে, কুড়ি টাকা আপনার বখশিস। কী বলেন স্যার?
প্রথমে মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। ইচ্ছে করছিল ঘুরিয়ে একটা চড় দিই। হাত এগিয়ে নিয়েই থামিয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক করে ফেলি আমাকে। তারপর সহজ গলায় আদর মেখে বললাম, কম নেবে কেন বাবা?
- এমনি।
- না, আমি পুরো তিনশ কুড়িই দেব।
- তাহলে স্যার খুচরো দিতে হবে। আমি একশ টাকার নিচে খুচরো রাখি না।
- তাই হবে।
বিচিত্র অভিজ্ঞতার আশায় আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। মজার হবে টিউশনিটা, দেখি কতদূর যেতে পারে অনি। মাস শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে আমি একটি খামে করে তিনশ কুড়ি টাকা অনির হাতে তুলে দিই।
অনি যথাসময়ে টাকা পেয়ে খুশি।
হাসি মুখে বলল, স্যার, আপনি খুব ভালো মানুষ।
আমি বললাম, তুমি আমার কাছ থেকে শিখছ আর আমি শিখছি তোমার কাছ থেকে। দুজনের মাইনে ঠিক সময়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে শ্রমের মর্যাদা মাসের প্রথমদিকে হাসার সুযোগ পায়।
অনি বলল, থ্যাংক ইউ স্যার। সব মানুষ যদি আপনার মতো হতো!
চার মাস পর ডিআইজি সাহেব পড়ার রুমে এলেন। এতদিন তাকে একবারও দেখিনি, বেশ গম্ভীর চেহারা, দেখলে সমীহ আসে। চোখের চশমায়, দামটা পুলিশের পোশাকের মতো ঝিলিক মারছে, হাতের ঘড়িতে আরও বেশি।তিনি অনির একটি খাতা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, মাস্টার, আপনার মাইনে চারশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম।
- কেন স্যার?
- আমরা পুলিশের লোক। গুণীর কদর করতে জানি। এ পর্যন্ত কোনো মাস্টার আমার ছেলের কাছে দুই মাসের বেশি টেকেনি। প্রত্যেকে আমার ছেলেকে বকা দিয়েছে, মেরেছে, অশ্রাব্য কথা বলেছে। ছেলে কেবল আপনারই প্রশংসা করেছে। আপনি নাকি ভালো পড়ান।
তিনি একটা কলম ও একটা ডায়েরি আমার হাতে দিয়ে বলেন, এগুলোর আপনার।
- থ্যাংক ইউ স্যার।
কলমটা ছিল সম্ভবত পার্কার। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ওই সময় পার্কার ছিল আমাদের কাছে স্মার্ট ফোনের মতো লোভনীয়।
সাহেব চলে যেতে অনি বলল : স্যার।
- তুমি কী কলম আর ডায়েরি হতেও ভাগ চাইছ?
অনি হেসে বলল, না স্যার। ও সবে আমার আগ্রহ নেই। টাকা হলে সব পাওয়া যায়।
- তবে?
- আমার পাওনা এখন চারশ আশি টাকা। আমি আশি টাকা নেব না, একশ টাকা নেব। তার মানে পাঁচশ টাকা।
- ঠিক আছে। তুমি আমার টিচার, তোমাকে কুড়ি টাকা বেশি দিতে না পারলে আমার জ্ঞান অর্জন হবে কীভাবে?
অনির হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। কমিশন নিলেও পড়াপাড়ি বেশ ভালোই হচ্ছে। আরও তিন মাস কেটে যায়। এরমধ্যে, আমার মাইনে আরও দুশ টাকা বেড়ে গেছে। অনিকে এখন টাকা দিতে কষ্ট হচ্ছে না।
সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। অনিকে অন্যদিনের চেয়ে বেশ আনমনা মনে হচ্ছে।
বললাম, কী হয়েছে?
- স্যার, আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।
- কী কাজ?
- একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।
- চিঠি তো লিখেই দিই।
- কলেজের চিঠি নয়।
- কোন চিঠি?
- আমার প্রেমিকা, সরি স্যার বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য।
- কী লিখব?
- আপনার মতো করে আপনি লিখে দেবেন। আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে না দেখলে বুকটা কেমন মোচড় খায়। কিছু ভালো লাগে না। সে খুব সুন্দর।
চিঠি লিখে দিলাম গভীর ভাষায়, প্রেমের মমতায়।
রাস্তায় এসে ইচ্ছেমতো হাসলাম। অনি আর রেহাই পাচ্ছে না।
-
খবর পাঠিয়েছে, শুক্রবার তাদের বাড়ি যেতে হবে। অনির জন্মদিন।
কী নিয়ে যাই?
অনেক চিন্তাভাবনা করে অনির বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি লিখি।
অনি চিঠি পড়ে এত খুশি হয় যে, সে মাসের পুরো কমিশনটাই আমাকে ফেরত দিয়ে দেয়।
অবাক হয়ে বললাম, ফেরত দিলে যে?
অনি আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল : আপনার লেখার সম্মানি। স্যার, চিঠিটা একদম ফাটাফাটি হয়েছে।
লেখার সম্মানি! আমি চমকে উঠি। লেখার প্রথম আয়, এ তো মস্ত ব্যাপার! তাহলে কেন এতদিন লিখিনি! অনির উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে পত্রিকায় লেখা শুরু করি। তারপর আস্তে আস্তে লেখা আমার নেশা হয়ে যায়।
-
যতই গল্প করি, যতই প্রেমপত্র লিখে দিই না কেন, লেখপড়ায় অনিকে এমন কৌশলে ব্যস্ত রাখি যে, সে ধীরে ধীরে বইয়ে ঝুঁকে পড়ে, তার সব আনন্দ অন্যান্য জায়গা থেকে বইয়ের পাতায় এসে ভীড় করতে শুরু করে। আগে তার বাবাকে বলত চকলেটের কথা, এখন বলে বইয়ের কথা। আগে ইলেকট্রনিক্স জিনিসে তার আলমারি ছিল ভর্তি; এখন সেখানে ঠাঁই পেয়েছে বই, পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের নানা বই। আমার কাছ থেকে নাম নিয়ে যায় বইয়ের, নিয়ে আসে তার বাবাকে দিয়ে। দেশে না পেলে বিদেশ থেকে। কত দামি দামি বই, আমার কাছে মনে হতো, সামর্থ্যবানদের ইচ্ছাই প্রাপ্তি।
আরও তিন মাস পর আমার মাইনে হয় পনেরশ টাকা। অনেক সরকারি অফিসারও তখন এত মাইনে পেতেন না। এখন অনির পাওনা গিয়ে দাঁড়ায় ছয়শ টাকায়।
মাসের শেষদিন অনিকে ছয়শ টাকা দিতে যাই। লজ্জায় চোখটা নিচু করে ফেলে সে। আগের মতো দ্রুত হাত এগিয়ে দিচ্ছে না।
- সরি স্যার।
- নাও তোমার টাকা।
- লাগবে না স্যার।
- আরে নাও। আমি অত টাকা দিয়ে কী করব?
- স্যার, একমাসে যতটাকা আপনাকে দিই, আমি একদিনে তার চেয়ে অনেক বেশি দামের চকলেট খাই। একটা চকলেটের দাম একশ টাকা, দিনে কুড়িটা চকলেট আমি একাই খাই। বাবার হুকুমে সুইজারল্যান্ড থেকে আসে।
তারপরও আমি বললাম, নাও।
- লাগবে না স্যার।
- আগে লাগত কেন?
- তাস খেলতাম, ওকে দিতাম। এখন তাস খেলা সময় নষ্ট মনে হয়, বই পড়ি।
আমি সাফল্যের হাসি নিয়ে বের হয়ে আসি।
অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর অনির ওখানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সাহেব বলেছেন এক মাস পর থেকে আবার পড়ানো শুরু করতে। আমার মতো ভালো মাস্টারকে তিনি ছাড়বেন না। বদলি হলে সেখানে নিয়ে যাবেন।
পনের দিন পর দেখি আমার মেস বাড়ির সামনে একটা বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে।
হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসি।
অনি আর তার বাবা নামছেন।
সাহেব বললেন, মাস্টার আমার ছেলে থার্ড হয়েছে। এর আগে কোনোদিন পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার ছেলেটাকে বদলে দিয়েছেন।
ডিআইজি সাহেব আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন, আমার ছোট ভাই আমার জন্য সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। আপনাকে দিলাম। এটি কোনো বিনিময় নয়, উপহার; ভালোবাসার নিদর্শন।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন এমন উপহার দেননি।
অনি আমায় প্রণাম করে বলল, স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেনে।
- মাস্টার, অনি আমাকেও পাত্তা দিত না। এ ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল টাকার ঝুড়ি। আপনি তাকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
বললাম, ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
- আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?
- ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
টিউশনি এবং ভালোবাসা
ঘটনার সময়কাল : জানুয়ারি ১৯৮৬।...
-
বিশিষ্ট লেখক ড. আমিন।
"ভালবাসা, শুধুই ভালবাসা'' গ্রন্থে তার জীবনের সত্য ঘটনার অবলম্বনে ।