27-02-2021, 02:38 PM
(This post was last modified: 01-03-2021, 04:00 PM by bourses. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
বিঃ দ্রঃ – পরবর্তি কিছু আপডেটে আমি ছবি দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে আমার গল্পের স্থানএর একটা সুষ্পষ্ট অনুমেয়তা ধরা পড়ে… ছবিগুলী চন্দ্রকান্তার থেকেই পাওয়া… আশা করি পাঠক/পাঠিকাদের ছবি সমেত এই আপডেট ভালো লাগবে…
ধন্যবাদান্তে…
ধন্যবাদান্তে…
৮
কাউন্টেস্ অফ ব্র্যাডফিল্ডস্
বিশাল লোহার গেটের সামনে গাড়িটা এসে থামে … গাড়িটা অলিভীয়ারই… কিন্তু আজকে তার আবদার রাখতে সূর্যকেই চালিয়ে আসতে হয়েছে এখানে… প্রথমে একটু ইতঃস্থত করছিল সূর্য… কিন্তু অলিভীয়া গুনগুনিয়ে উঠেছিল… ও নাকি এত খুশিতে গাড়ি চালাতে পারবে না বলে… সূর্যের গলা জড়িয়ে আদুরে স্বরে তাকেই চালাতে অনুরোধ করেছিল সে… প্রিয়ার সে অনুরোধ ফেলতে পারেনি সূর্য… তথাস্তু বলে সেই স্টিয়ারিংএ বসেছিল আজ… লন্ডন থেকে অক্সশট… বেশি না… মেরে কেটে সতেরো থেকে আঠারো মাইল… অলিভীয়ার ফোর্ড গাড়িতে খুব বেশি হলে ঘন্টা খানেকের পথ… খুশি মনেই তাই মেনে নিয়েছিল সূর্য, অলিভীয়ার সে আবদার… কারণ আজ বড়ই খুশি তার প্রণয়নী… বাড়ি এসেছে সে… তার মনের মানুষকে সাথে নিয়ে… বাবা মায়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে…
সূর্য এই ক’দিনে অলিভীয়ার কাছ থেকে শুনেছে যে তাদের বাড়ি নাকি বেশ বড়… কিন্তু তাকে লন্ডনে ঐ এক কামরার ফ্ল্যাটে থাকতে দেখে প্রায় কিছুই আন্দাজ সে যে করতে পারে নি, সেটা বোঝে অলিভীয়ার বাড়ির গেটের সামনে পৌছে… যতটা না সে অবাক হয় বাড়িটা দেখে, তার থেকে বেশি অবাক লাগে তার অলিভীয়ার ওই ভাবে একেবারে সাধারণ ভাবে লন্ডনে জীবন যাপন করা দেখে… এই এত বড় পরিবারের মেয়ে হয়ে ওই ভাবে কেউ কাটাতে পারে? সেও খুব একটা সাধারণ বাড়ির ছেলে নয় মোটেই… তারও একটা বংশ ঐতিহ্য আছে বটে… এখন ক্ষয়িষ্ণু হলেও, সেও রাজবংশেরই ছেলে… কিন্তু তাদের সে বৈভব যে ম্লান হয়ে যায় এ হেন বিত্তের সামনে… মনে মনে একটা গর্ব ছিল সূর্যের, অস্বীকার করে লাভ নেই, যে সে দর্পনারায়ণের বংশধর বলে… তাদের কুলমর্যাদা অপরিসিম… কিন্তু এখানে এসে যদি না দেখতো সে, তাহলে বুঝতেই পারতো না হয়তো একটা এত বড় বংশের মেয়ে হয়েও কি অমায়িক এই অলিভীয়া… কখন, কোন দিন, কোন ভাবেই সেটা তাকে সে বুঝতে দেয় নি প্রকারান্তারে… তার সাথে সহজ সাবলিলতায় মিশেছে… ঘুরেছে… আনন্দ করেছে একেবারে এক সাধারণ মেয়ের মতই…
গাড়ির উন্ডস্ক্রিনের মধ্যে থেকে গেটের ফাঁক দিয়ে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে মুখ ফেরায় পাশে বসা অলিভীয়ার দিকে… সেই মুহুর্তে অলিভীয়ার মুখের ওপরে যেন হাজারটা ঝাড়বাতির আলো চকচক করছে… মনের অফুরাণ আনন্দে…
সূর্যকে তার দিকে তাকাতে দেখে ভ্রূ তোলে অলিভীয়া… “হোয়াট? আর ইয়ু নট এক্সাইটেড?” বাচ্চা মেয়ের মত হাত জড়ো করে প্রায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে… “আমি তো ভি-ই-ষ-ন এস্কাইটেড… জানো? আজকে তোমার সাথে মম্ আর ড্যাড এর আলাপ করিয়ে দেবো… বলবো… দেখো… কাকে সাথে করে এনেছি আমি… আমার মনের মানুষকে… যার হাত ধরে আমি সারাটা জীবন চলার প্রতিজ্ঞা করেছি… স্বপ্ন দেখেছি আমি তার স্ত্রী হিসাবে প্রথম দর্শনেই…”
“কিন্তু… কিন্তু তোমার মম্ ড্যাড যদি না মানে আমাদের সম্পর্ক?” অলিভীয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সূর্য… হটাৎ করেই কেন জানে না সে, কেমন একটা ভয় ভয় করছে তার মনের মধ্যে… কিরকম নিজেকে বেমানান লাগতে শুরু করেছে অলিভীয়ার পাশে… মনের মধ্যে যেন একটা কু-ডাক শুনতে পাচ্ছে সে… কেন? তা সে বলতে পারে না… কিন্তু ডাক সে শোনে…
“ওহ! ও… তুমি না… আগেই যত সব বাজে বাজে চিন্তা করে বোসো… ইয়ু ডোণ্ট নো মাই ফ্যামিলি… ওরা এত ভালো… এতো ভালো যে কি বলবো… আর আমায়?” বলতে বলতে আবার চকচক করে ওঠে অলিভীয়ার গভীর নীল চোখ… “আমায় যে কি ভালোবাসে ওরা… আমি ছোট্ট বেলা থেকে… জানো!... জাস্ট… একবার মুখ ফুটে বলেছি… ব্যস… সাথে সাথে আমার সামনে হাজির করে দিয়েছে… কি মম্ কি ড্যাড…” একটু থেমে ফের কলকলিয়ে ওঠে সূর্যের প্রাণভোমরা… “আমার দাদারা… ওরাও একেবারে একই রকম… বোন বলতে একেবারে অজ্ঞান… আর হবে নাই বা কেন বলো… আমি… এই আমি…” নিজের বুকের দিকে আঙুল তুলে বলে ওঠে… “একটা মাত্র বোন ওদের… বুঝতেই পারছ… কি পরিমানটাই না আমায় আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে… হি হি…”
অলিভীয়া যে বাড়ির খুবই আদুরি মেয়ে, সেটা এই মুহুর্তে তার বাড়ির গেটে গাড়িতে বসে বুঝতে অসুবিধা হয় না সূর্যর… বুঝতে অসুবিধা হয় না তার কি বিশাল বৈভবের মধ্যে দিয়ে সে বড় হয়েছে… আর সেটা বুঝেই যেন কিছুটা হীনমন্যতা এসে যায় তার মনের মধ্যে… মনে পড়ে যায় তাদের প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়ে অনিন্দীতার প্রাথমিক অভিব্যক্তি… তাকে ভারতীয় ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার… তখন হয়তো সে অলিভীয়ার সেই তাচ্ছিল্যকে গুরুত্ব দেয় নি… বরং তার সৌন্দর্যের প্রতি, তার দেহসৌষ্ঠবের প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হয়েছিল… তার স্বভাব বশে… যেটা পরবর্তী কালে প্রণয়ে রূপান্তরীত হয়ে গিয়েছে… অলিভীয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে… এখন হয়তো অলিভীয়া তাকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে, হয়তো বাই কেন… বাসে… সেটা সূর্য জানেও… অন্তত ওর ব্যবহার, তার প্রতি আকর্ষণ সেটা বারংবার প্রমানিত করে এসেছে এই ক’মাসে… কিন্তু… তাও একটা সুক্ষ্ম কিন্তু থেকেই যায় মনের মধ্যে… অলিভীয়া তাকে ভালোবাসে মানেই এই নয় যে তার পরিবারও একজন ভারতীয়কে তাদের ঘরের লোক বলে মেনে নেবে… এটা তার বাড়ি হলেও হতো না… সে জানে তারও পরিবার কি ভিষন রকম গোঁড়া এই সব বিশয়ে… নিজেদের সমাজিকতা, বংশ মর্যাদা নিয়ে কি ভিষন উন্নাসিক রুদ্রনারায়ণ… কিন্তু তার কথা আলাদা… সে পুরুষ… তার পরিবার যদি অলিভীয়াকে নিজের না করতে পারে, তাতে তার কিছু যায় আসে না… এমনিতেও সে পরিবার থেকে একটু হলেও আলাদা মানসিকতার… তার সে অহংবোধ বাকিদের মত অতটা উগ্র নয়… আর নয় বলেই অলিভীয়ার প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় নি কখনও… কিন্তু সে ভাবে নি বলেই যে অলিভীয়ার পরিবারও ভাববে না, এমনটা তো হতে পারে না… বিশেষতঃ তারা যখন এতটাই বিত্তশালী পরিবারের মানুষ… তার উপরে এদের শরীরে প্রকৃত ব্রিটিশ রক্ত বইছে… যারা কিনা এখনও ভারতীয়দের নিজেদের দাসুনাদাস ভাবতে ভোলে না… এখনও তারা ভাবে যে ভারতীয়রা তৃতীয় বিশ্বের প্রাণী… তাদের সমকক্ষ্য নয়… তাদের সে ধারণা হয়তো সর্বাজ্ঞে ভ্রান্ত… কিন্তু সে ভ্রান্তি দূর করার দায় তো সূর্যের নেই… আর নেই বলেই যেন মনের মধ্যের খচখচনিটা যায় না কিছুতেই…
“হেই… হোয়াট? কি ভাবছো? লেটস্ গো ইন্সাইড…” অলিভীয়ার সুরেলা গলার স্বরে সম্বিত ফেরে সূর্যের… ঘাড় ফিরিয়ে অলিভীয়ার দিকে তাকায় সে…
বড় সুন্দর করে সেজেছে আজ যেন অলিভীয়া… দীঘল চোখ… পাতলা ঠোঁটে রক্তিম লিপস্টিকের সুচারু টান… একটা লম্বা পা অবধি ঢাকা গাঢ় সবুজ গাউনএর মত ড্রেস পড়েছে… যার কাঁধটা অনাবৃত… পোষাকটি শুরু হয়েছে অলিভীয়ার বর্তুল ভরাট স্তন দুটিকে চাপা দিয়ে… বুকের উপরে কাপড়ের কুঁচি দিয়ে তৈরী করা ফুলের আকৃতিতে… আজকে মাথার রেশমী চুলটাও তুলে সুন্দর করে টেনে ফ্রেঞ্চ নট করে বেঁধে নিয়েছে… কানে ছোট্ট দুটো পান্না বসানো দুল… গলা জড়িয়ে রয়েছে অগুন্তি ছোট ছোট হিরে বসানো একটা চওড়া নেকলেস… আর সেই নেকলেস থেকে একটা বেশ বড় চৌকোনা পান্নার পেন্ডেট ঝুলে রয়েছে… যেটি ঠিক দুই বক্ষের বিভাজিকার মাঝে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে যেন… যার উপস্থিতিতে পোষাকের কাপড়ের উপর থেকে প্রায় উথলিয়ে বেরিয়ে আসা স্তনের অল্প কিছু উপরি অংশের ত্বকের ঔজ্জল্য আরো বর্ধিত করে তুলেছে…
“হ্যালো! হোয়ার আর ইয়ু? কি দেখছ এ ভাবে?” গাঢ় চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অলিভীয়া… সূর্য যে তারই রূপসুধা পানে ব্যস্ত সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার… আর সেটা বুঝে যেন মনে মনে আরো খুশিটা উছলিয়ে ওঠে… চকচক করে ওঠে তার গভীর নীল চোখের দ্যুতি… ঝলমলিয়ে ওঠে মনের খুশিটা তার রাঙানো ঠোঁটের কোনে…
মৃদু হাসে সূর্য অলিভীয়ার প্রশ্নে… মাথা নেড়ে চাবি ঘোরায় গাড়ির ড্যাসবোর্ডে… তারপরেই কি ভেবে মাথা ফেরায় অলিভীয়ার দিকে… “ওহো!... দাঁড়াও, তুমি বসো, আমি গেটটা আগে খুলে আসি…” বলতে বলতে গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হয় সূর্য…
তাড়াতাড়ি তার হাত টেনে ধরে অলিভীয়া… হাসতে হাসতে বলে, “আরে… ওয়েট ওয়েট… তোমায় নামতে হবে না… গেট খুলে যাবে এখুনি… তুমি জাস্ট দুবার হর্ণ বাজাও…”
হয়েও তাই… দুবার হর্ণএ আলতো করে চাপ দিতেই সত্যিই গেটটা ধীরে ধীরে নিজের থেকেই খুলে দুই পাশে সরে যায় আপনা থেকে… জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে অলিভীয়ার দিকে…
“আরে অবাক হচ্ছ কেন? ওটা অটোমেটেড গেট… অ্যাকচুয়ালি বাড়ির ভিতরে আমাদের যে সিকুউরিটি অফিসার আছে, সেই ওখান থেকে গেটটা অপরেট করে… আর ওরা চেনে আমার গাড়ি, তাই হর্ণ বাজালেই যথেষ্ট… যাক… চলো… ভেতরে যাওয়া যাক…” বলতে বলতে সিটের উপরে হেলান দিয়ে সামনে তাকিয়ে বসে অলিভীয়া… সূর্য গিয়ার বদলায়… গাড়ি ধীরে ধীরে গড়ায় সামনের পানে…
চারপাশে যেন অনন্ত সবুজ দিয়ে ঘেরা পুরো দূর্গসম অট্টালিকাটা… যাকে ক্যাসেল বলে এখানকার অধিবাসীরা… সেই গাঢ় সবুজ ঘেরাটোপের পরেই নিপুন করে ছাঁটা ঘাসের মাঠ আর সুন্দর কোয়েরি করে রাখা ফুলের গাছের ঝাড়ের মাঝখান দিয়ে বাঁধানো পথ… সেই পথের উপর দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ধবধবে সাদা বিশাল অট্টালিকার দিকে…
পুরো অট্টালিকাটি অদ্ভুত ভাবে তৈরী… একদিকে দ্বিতল, আর অপর পাশটিতে একতলা… সামনের অংশটিতে বিশাল বিশাল চারটি থামের উপরে তার দেউড়ি… বাঁধানো পথের শেষ প্রান্তে এক পাশে সুদৃশ্য গাড়ির গ্যারেজ… সূর্য দেখে গ্যারেজের সামনে আরো দুখানি গাড়ি, একটি বেন্টলী আর একটি রোলস্ রয়ালস্ দাঁড় করানো রয়েছে… সুদৃশ্য সে অট্টালিকা এতটুকুও কালের ভ্রূকুটির কোন আভাষ নেই… রীতিমত পরিচর্যার ছোঁয়া তার সমস্ত শরীরে…
সূর্য এই ক’দিনে অলিভীয়ার কাছ থেকে শুনেছে যে তাদের বাড়ি নাকি বেশ বড়… কিন্তু তাকে লন্ডনে ঐ এক কামরার ফ্ল্যাটে থাকতে দেখে প্রায় কিছুই আন্দাজ সে যে করতে পারে নি, সেটা বোঝে অলিভীয়ার বাড়ির গেটের সামনে পৌছে… যতটা না সে অবাক হয় বাড়িটা দেখে, তার থেকে বেশি অবাক লাগে তার অলিভীয়ার ওই ভাবে একেবারে সাধারণ ভাবে লন্ডনে জীবন যাপন করা দেখে… এই এত বড় পরিবারের মেয়ে হয়ে ওই ভাবে কেউ কাটাতে পারে? সেও খুব একটা সাধারণ বাড়ির ছেলে নয় মোটেই… তারও একটা বংশ ঐতিহ্য আছে বটে… এখন ক্ষয়িষ্ণু হলেও, সেও রাজবংশেরই ছেলে… কিন্তু তাদের সে বৈভব যে ম্লান হয়ে যায় এ হেন বিত্তের সামনে… মনে মনে একটা গর্ব ছিল সূর্যের, অস্বীকার করে লাভ নেই, যে সে দর্পনারায়ণের বংশধর বলে… তাদের কুলমর্যাদা অপরিসিম… কিন্তু এখানে এসে যদি না দেখতো সে, তাহলে বুঝতেই পারতো না হয়তো একটা এত বড় বংশের মেয়ে হয়েও কি অমায়িক এই অলিভীয়া… কখন, কোন দিন, কোন ভাবেই সেটা তাকে সে বুঝতে দেয় নি প্রকারান্তারে… তার সাথে সহজ সাবলিলতায় মিশেছে… ঘুরেছে… আনন্দ করেছে একেবারে এক সাধারণ মেয়ের মতই…
গাড়ির উন্ডস্ক্রিনের মধ্যে থেকে গেটের ফাঁক দিয়ে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে মুখ ফেরায় পাশে বসা অলিভীয়ার দিকে… সেই মুহুর্তে অলিভীয়ার মুখের ওপরে যেন হাজারটা ঝাড়বাতির আলো চকচক করছে… মনের অফুরাণ আনন্দে…
সূর্যকে তার দিকে তাকাতে দেখে ভ্রূ তোলে অলিভীয়া… “হোয়াট? আর ইয়ু নট এক্সাইটেড?” বাচ্চা মেয়ের মত হাত জড়ো করে প্রায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে… “আমি তো ভি-ই-ষ-ন এস্কাইটেড… জানো? আজকে তোমার সাথে মম্ আর ড্যাড এর আলাপ করিয়ে দেবো… বলবো… দেখো… কাকে সাথে করে এনেছি আমি… আমার মনের মানুষকে… যার হাত ধরে আমি সারাটা জীবন চলার প্রতিজ্ঞা করেছি… স্বপ্ন দেখেছি আমি তার স্ত্রী হিসাবে প্রথম দর্শনেই…”
“কিন্তু… কিন্তু তোমার মম্ ড্যাড যদি না মানে আমাদের সম্পর্ক?” অলিভীয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সূর্য… হটাৎ করেই কেন জানে না সে, কেমন একটা ভয় ভয় করছে তার মনের মধ্যে… কিরকম নিজেকে বেমানান লাগতে শুরু করেছে অলিভীয়ার পাশে… মনের মধ্যে যেন একটা কু-ডাক শুনতে পাচ্ছে সে… কেন? তা সে বলতে পারে না… কিন্তু ডাক সে শোনে…
“ওহ! ও… তুমি না… আগেই যত সব বাজে বাজে চিন্তা করে বোসো… ইয়ু ডোণ্ট নো মাই ফ্যামিলি… ওরা এত ভালো… এতো ভালো যে কি বলবো… আর আমায়?” বলতে বলতে আবার চকচক করে ওঠে অলিভীয়ার গভীর নীল চোখ… “আমায় যে কি ভালোবাসে ওরা… আমি ছোট্ট বেলা থেকে… জানো!... জাস্ট… একবার মুখ ফুটে বলেছি… ব্যস… সাথে সাথে আমার সামনে হাজির করে দিয়েছে… কি মম্ কি ড্যাড…” একটু থেমে ফের কলকলিয়ে ওঠে সূর্যের প্রাণভোমরা… “আমার দাদারা… ওরাও একেবারে একই রকম… বোন বলতে একেবারে অজ্ঞান… আর হবে নাই বা কেন বলো… আমি… এই আমি…” নিজের বুকের দিকে আঙুল তুলে বলে ওঠে… “একটা মাত্র বোন ওদের… বুঝতেই পারছ… কি পরিমানটাই না আমায় আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে… হি হি…”
অলিভীয়া যে বাড়ির খুবই আদুরি মেয়ে, সেটা এই মুহুর্তে তার বাড়ির গেটে গাড়িতে বসে বুঝতে অসুবিধা হয় না সূর্যর… বুঝতে অসুবিধা হয় না তার কি বিশাল বৈভবের মধ্যে দিয়ে সে বড় হয়েছে… আর সেটা বুঝেই যেন কিছুটা হীনমন্যতা এসে যায় তার মনের মধ্যে… মনে পড়ে যায় তাদের প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়ে অনিন্দীতার প্রাথমিক অভিব্যক্তি… তাকে ভারতীয় ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার… তখন হয়তো সে অলিভীয়ার সেই তাচ্ছিল্যকে গুরুত্ব দেয় নি… বরং তার সৌন্দর্যের প্রতি, তার দেহসৌষ্ঠবের প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হয়েছিল… তার স্বভাব বশে… যেটা পরবর্তী কালে প্রণয়ে রূপান্তরীত হয়ে গিয়েছে… অলিভীয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে… এখন হয়তো অলিভীয়া তাকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে, হয়তো বাই কেন… বাসে… সেটা সূর্য জানেও… অন্তত ওর ব্যবহার, তার প্রতি আকর্ষণ সেটা বারংবার প্রমানিত করে এসেছে এই ক’মাসে… কিন্তু… তাও একটা সুক্ষ্ম কিন্তু থেকেই যায় মনের মধ্যে… অলিভীয়া তাকে ভালোবাসে মানেই এই নয় যে তার পরিবারও একজন ভারতীয়কে তাদের ঘরের লোক বলে মেনে নেবে… এটা তার বাড়ি হলেও হতো না… সে জানে তারও পরিবার কি ভিষন রকম গোঁড়া এই সব বিশয়ে… নিজেদের সমাজিকতা, বংশ মর্যাদা নিয়ে কি ভিষন উন্নাসিক রুদ্রনারায়ণ… কিন্তু তার কথা আলাদা… সে পুরুষ… তার পরিবার যদি অলিভীয়াকে নিজের না করতে পারে, তাতে তার কিছু যায় আসে না… এমনিতেও সে পরিবার থেকে একটু হলেও আলাদা মানসিকতার… তার সে অহংবোধ বাকিদের মত অতটা উগ্র নয়… আর নয় বলেই অলিভীয়ার প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় নি কখনও… কিন্তু সে ভাবে নি বলেই যে অলিভীয়ার পরিবারও ভাববে না, এমনটা তো হতে পারে না… বিশেষতঃ তারা যখন এতটাই বিত্তশালী পরিবারের মানুষ… তার উপরে এদের শরীরে প্রকৃত ব্রিটিশ রক্ত বইছে… যারা কিনা এখনও ভারতীয়দের নিজেদের দাসুনাদাস ভাবতে ভোলে না… এখনও তারা ভাবে যে ভারতীয়রা তৃতীয় বিশ্বের প্রাণী… তাদের সমকক্ষ্য নয়… তাদের সে ধারণা হয়তো সর্বাজ্ঞে ভ্রান্ত… কিন্তু সে ভ্রান্তি দূর করার দায় তো সূর্যের নেই… আর নেই বলেই যেন মনের মধ্যের খচখচনিটা যায় না কিছুতেই…
“হেই… হোয়াট? কি ভাবছো? লেটস্ গো ইন্সাইড…” অলিভীয়ার সুরেলা গলার স্বরে সম্বিত ফেরে সূর্যের… ঘাড় ফিরিয়ে অলিভীয়ার দিকে তাকায় সে…
বড় সুন্দর করে সেজেছে আজ যেন অলিভীয়া… দীঘল চোখ… পাতলা ঠোঁটে রক্তিম লিপস্টিকের সুচারু টান… একটা লম্বা পা অবধি ঢাকা গাঢ় সবুজ গাউনএর মত ড্রেস পড়েছে… যার কাঁধটা অনাবৃত… পোষাকটি শুরু হয়েছে অলিভীয়ার বর্তুল ভরাট স্তন দুটিকে চাপা দিয়ে… বুকের উপরে কাপড়ের কুঁচি দিয়ে তৈরী করা ফুলের আকৃতিতে… আজকে মাথার রেশমী চুলটাও তুলে সুন্দর করে টেনে ফ্রেঞ্চ নট করে বেঁধে নিয়েছে… কানে ছোট্ট দুটো পান্না বসানো দুল… গলা জড়িয়ে রয়েছে অগুন্তি ছোট ছোট হিরে বসানো একটা চওড়া নেকলেস… আর সেই নেকলেস থেকে একটা বেশ বড় চৌকোনা পান্নার পেন্ডেট ঝুলে রয়েছে… যেটি ঠিক দুই বক্ষের বিভাজিকার মাঝে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে যেন… যার উপস্থিতিতে পোষাকের কাপড়ের উপর থেকে প্রায় উথলিয়ে বেরিয়ে আসা স্তনের অল্প কিছু উপরি অংশের ত্বকের ঔজ্জল্য আরো বর্ধিত করে তুলেছে…
“হ্যালো! হোয়ার আর ইয়ু? কি দেখছ এ ভাবে?” গাঢ় চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অলিভীয়া… সূর্য যে তারই রূপসুধা পানে ব্যস্ত সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার… আর সেটা বুঝে যেন মনে মনে আরো খুশিটা উছলিয়ে ওঠে… চকচক করে ওঠে তার গভীর নীল চোখের দ্যুতি… ঝলমলিয়ে ওঠে মনের খুশিটা তার রাঙানো ঠোঁটের কোনে…
মৃদু হাসে সূর্য অলিভীয়ার প্রশ্নে… মাথা নেড়ে চাবি ঘোরায় গাড়ির ড্যাসবোর্ডে… তারপরেই কি ভেবে মাথা ফেরায় অলিভীয়ার দিকে… “ওহো!... দাঁড়াও, তুমি বসো, আমি গেটটা আগে খুলে আসি…” বলতে বলতে গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হয় সূর্য…
তাড়াতাড়ি তার হাত টেনে ধরে অলিভীয়া… হাসতে হাসতে বলে, “আরে… ওয়েট ওয়েট… তোমায় নামতে হবে না… গেট খুলে যাবে এখুনি… তুমি জাস্ট দুবার হর্ণ বাজাও…”
হয়েও তাই… দুবার হর্ণএ আলতো করে চাপ দিতেই সত্যিই গেটটা ধীরে ধীরে নিজের থেকেই খুলে দুই পাশে সরে যায় আপনা থেকে… জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে অলিভীয়ার দিকে…
“আরে অবাক হচ্ছ কেন? ওটা অটোমেটেড গেট… অ্যাকচুয়ালি বাড়ির ভিতরে আমাদের যে সিকুউরিটি অফিসার আছে, সেই ওখান থেকে গেটটা অপরেট করে… আর ওরা চেনে আমার গাড়ি, তাই হর্ণ বাজালেই যথেষ্ট… যাক… চলো… ভেতরে যাওয়া যাক…” বলতে বলতে সিটের উপরে হেলান দিয়ে সামনে তাকিয়ে বসে অলিভীয়া… সূর্য গিয়ার বদলায়… গাড়ি ধীরে ধীরে গড়ায় সামনের পানে…
চারপাশে যেন অনন্ত সবুজ দিয়ে ঘেরা পুরো দূর্গসম অট্টালিকাটা… যাকে ক্যাসেল বলে এখানকার অধিবাসীরা… সেই গাঢ় সবুজ ঘেরাটোপের পরেই নিপুন করে ছাঁটা ঘাসের মাঠ আর সুন্দর কোয়েরি করে রাখা ফুলের গাছের ঝাড়ের মাঝখান দিয়ে বাঁধানো পথ… সেই পথের উপর দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ধবধবে সাদা বিশাল অট্টালিকার দিকে…
পুরো অট্টালিকাটি অদ্ভুত ভাবে তৈরী… একদিকে দ্বিতল, আর অপর পাশটিতে একতলা… সামনের অংশটিতে বিশাল বিশাল চারটি থামের উপরে তার দেউড়ি… বাঁধানো পথের শেষ প্রান্তে এক পাশে সুদৃশ্য গাড়ির গ্যারেজ… সূর্য দেখে গ্যারেজের সামনে আরো দুখানি গাড়ি, একটি বেন্টলী আর একটি রোলস্ রয়ালস্ দাঁড় করানো রয়েছে… সুদৃশ্য সে অট্টালিকা এতটুকুও কালের ভ্রূকুটির কোন আভাষ নেই… রীতিমত পরিচর্যার ছোঁয়া তার সমস্ত শরীরে…
বাড়িটির একটু দূরেই আর একটি আউট হাউস চোখে পড়ে সূর্যর… হয়তো সেটি অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন বা থাকবার জন্য রাখা রয়েছে… সেটিও যে যথেষ্ট যত্ন করেই রাখা, তা দেখলেই বোঝা যায়… মোটামুটি গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে এদিক সেদিক তাকিয়ে সূর্য যা বোঝে, তাতে এটা তার কাছে স্পষ্ট যে অলিভীয়ার বাড়িটি প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বিঘার উপরে অবস্থিত… হয়তো আরো বেশি বই কম নয়…
তাদের গাড়ি দোড়গোড়ায় দাঁড়াতেই কোথা থেকে দৌড়ে আসে ধোপদূরস্ত পোষাকে পরিহিত এক ভদ্রলোক… হন্তদন্ত হয়ে অলিভীয়ার দিকে এসে তার দরজা খুলে ধরে সে… অলিভীয়া গাড়ি থেকে নেমে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে ওঠে, “থ্যাঙ্কস্ ডেভিড্… ড্যাড আছে?”
সসন্মানে অলিভীয়ার থেকে একটু তফাতে সরে গিয়ে উত্তর দেয় ভদ্রলোক, “হ্যা, আছেন, তবে একটু ব্যস্ত… লাইব্রেরিতে রয়েছেন…”
“ওহ!... সেটা আর নতুন কি? ড্যাড এমনি বসে আছে, এটা তো ভাবাই দুষ্কর…” হেসে বলে ওঠে অলিভীয়া… তারপরেই প্রশ্ন করে সে, “অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট মম্?”
ফের একই রকম বিনয়ের সাথে উত্তর দেয় ডেভিড্ নাম্মি ভদ্রলোক… “কাউন্টেস্ বেরিয়েছেন… আজকে ওনার রয়াল প্যালেসে একটা মিটিং আছে, সেটার জন্য… তবে উনি এসে পড়বেন খুব শিঘ্রই…”
‘কাউন্টেস্’ কথাটা কানে লাগে সূর্যের… মনে মনে একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করে অলিভীয়ার পিতা মাতার… চেষ্টা করে কাউন্ট কাউন্টেস্ কে কেমন দেখতে হবে বা তাদের স্বভাব কি রকম হতে পারে বলে… লন্ডন আসা ইস্তক অনেক মানুষের সাথেই তার আলাপ হয়েছে… তাদের মধ্যে অনেক ধনী ব্যক্তিও আছে… কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন কাউন্ট বা কাউন্টেসের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য ঘটে নি… অলিভীয়ার দৌলতে তাহলে সেটাও হয়ে যাবে… ভাবতে ভাবতে মনে মনে হাসে সূর্য… গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে…
“হুম… বুঝলাম…” বলে ওঠে অলিভীয়া, তারপর গাড়ির দিকে ফিরে স্মিত হেসে বলে ওঠে সূর্যকে লক্ষ্য করে, “হেই সূর্য… দিস্ ইজ ডেভিড…” তারপর ডেভিডের দিকে ফিরে বলে, “অ্যান্ড দেয়ার হি ইজ… মাই সুইটহার্ট… সূর্য…”
সূর্যের দিকে মাথা ঝোঁকায় ডেভিড নাম্নি ভদ্রলোক সসন্মানে… “হ্যালো স্যর…” অভিবাদন জানায় ঘাড় ঝুঁকিয়ে সামান্য… সূর্য বোঝে ডেভিড এ বাড়ির শফিউর…
তাদের কথা মধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরেক ধোপদূরস্থ পোষাকের ভদ্রলোক… ডেভিডের থেকে একটু বেশিই বয়ষ্ক… দেখে অন্তত ষাট বাষট্টির কাছেকাছি বলে মনে হলো সূর্যের… ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আগের মতই ডেভিডের কায়দায় অভিবাদন জানায় অলিভীয়াকে… অলিভীয়া তার দিকেও স্মিত হেসে হাত তুলে বলে ওঠে, “হ্যালো টম্…”
টম্ নাম্মি ভদ্রলোক বিগলিত হাসি হেসে বলে ওঠে, “আপনি আসবেন সেটা তো বলেন নি আগে… তাহলে স্যরকে বলে রাখতাম…”
উত্তর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অলিভীয়া… হাসার সাথে যেন তার শরীরটাও একই রকম ভাবে হেসে ওঠে উচ্ছলতায়… “না না… আগে ঠিক ছিল না টম্… হটাৎ করেই ভাবলাম চলে আসি বাড়িতে একবার…”
টম্ অলিভীয়ার কথায় মাথা নেড়ে উত্তর দেয়, “তা বেশ করেছেন… কিন্তু স্যর তো এখন একটু ব্যস্ত রয়েছেন… আপনি ততক্ষন না হয় আপনার ঘরেই বিশ্রাম করুন, আমি বলে দিচ্ছি ভেতরে…”
“ইটস্ ওকে টম্… অত ব্যস্ত হতে হবে না তোমায়…” তারপর সূর্যের দিকে ফিরে বলে, “সূর্য… এ হচ্ছে টম্… আমাদের বাড়ির বাট্লার… তুমি জানো? আমায় সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে ও…” তারপর টম্ এর দিকে ফিরে বলে, “আর টম্… আজ কিন্তু আমি একা আসিনি… সাথে আমার মনের মানুষও এসেছে… তাই দেখো…”
অলিভীয়ার মুখের কথা শেষ হয় না, টম্ ভদ্রলোকটি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, “এ নিয়ে কিছু ভাববেন না ম্যাম্… আমি সব বন্দোবস্থ করে দেবো…”
অলিভীয়ার কথায় মনের মধ্যে বাবামশাইয়ের খাস লোক, যদুর মুখটা ভেসে ওঠে সূর্যের মনের মধ্যে… সরল সাধাসিধে মানুষ যদু… ছোটবেলা থেকে একই রকম দেখে আসছে তাকে… সেই হাঁটুর কাছে উঁচু করে পরা ধুতি আর গায়ে একটা ফতুয়া… শীতকালে ফতুয়ার উপরে বড়জোড় একটা মোটা শাল, সেটাও হয়তো বাবামশাইয়েরই দেওয়া… খালি পায়ে এদিক সেদিন দৌড়ে বেড়াচ্ছে সে বাবামশায়ের মুখের একটা কথায়… আজ পর্যন্ত কোন দিন যদুদার মুখে কখনও বিরক্তির কোন ভাব দেখেনি সে… নিজের হাতে যেন বাড়ির সকলের দায়িত্ব নিয়ে রেখেছে একা, কাঁধের উপরে… আর অলিভীয়ার বাড়ির বাট্লার… টম্… ধোপদূরস্থ কেতার পোষাক পরিহিত… দেখে যেন তাকেই বাড়ির কর্তা মনে হয়…
টম্ এর কথায় খুশি হয় অলিভীয়া… হেসে বলে, “ইয়েস… দ্যট আই নো ইয়ু উইল…” তারপরেই সূর্যের দিকে ফিরে বলে, “চলো? ভিতরে চলো… এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?”
অলিভীয়ার দিকে ম্লান হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ে সূর্য… পড়ন্ত রোদে যেন তখন ঝলমল করছে অলিভীয়ার মুখটা… পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডেভিডএর দিকে তাকাতেই শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে ডেভিড… “ইয়েস ম্যাম্… আপনি ভেতরে যান, আমি গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে দেবো…”
ডেভিডের কথায় তাকে এক উজ্জল হাসি উপহার দিয়ে হাত বাড়িয়ে সূর্যের বাহু ধরে হাঁটা লাগায় বাড়ির দিকে… পেছন পেছন টম্ আসে শশব্যস্ততায়…
তাদের গাড়ি দোড়গোড়ায় দাঁড়াতেই কোথা থেকে দৌড়ে আসে ধোপদূরস্ত পোষাকে পরিহিত এক ভদ্রলোক… হন্তদন্ত হয়ে অলিভীয়ার দিকে এসে তার দরজা খুলে ধরে সে… অলিভীয়া গাড়ি থেকে নেমে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে ওঠে, “থ্যাঙ্কস্ ডেভিড্… ড্যাড আছে?”
সসন্মানে অলিভীয়ার থেকে একটু তফাতে সরে গিয়ে উত্তর দেয় ভদ্রলোক, “হ্যা, আছেন, তবে একটু ব্যস্ত… লাইব্রেরিতে রয়েছেন…”
“ওহ!... সেটা আর নতুন কি? ড্যাড এমনি বসে আছে, এটা তো ভাবাই দুষ্কর…” হেসে বলে ওঠে অলিভীয়া… তারপরেই প্রশ্ন করে সে, “অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট মম্?”
ফের একই রকম বিনয়ের সাথে উত্তর দেয় ডেভিড্ নাম্মি ভদ্রলোক… “কাউন্টেস্ বেরিয়েছেন… আজকে ওনার রয়াল প্যালেসে একটা মিটিং আছে, সেটার জন্য… তবে উনি এসে পড়বেন খুব শিঘ্রই…”
‘কাউন্টেস্’ কথাটা কানে লাগে সূর্যের… মনে মনে একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করে অলিভীয়ার পিতা মাতার… চেষ্টা করে কাউন্ট কাউন্টেস্ কে কেমন দেখতে হবে বা তাদের স্বভাব কি রকম হতে পারে বলে… লন্ডন আসা ইস্তক অনেক মানুষের সাথেই তার আলাপ হয়েছে… তাদের মধ্যে অনেক ধনী ব্যক্তিও আছে… কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন কাউন্ট বা কাউন্টেসের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য ঘটে নি… অলিভীয়ার দৌলতে তাহলে সেটাও হয়ে যাবে… ভাবতে ভাবতে মনে মনে হাসে সূর্য… গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে…
“হুম… বুঝলাম…” বলে ওঠে অলিভীয়া, তারপর গাড়ির দিকে ফিরে স্মিত হেসে বলে ওঠে সূর্যকে লক্ষ্য করে, “হেই সূর্য… দিস্ ইজ ডেভিড…” তারপর ডেভিডের দিকে ফিরে বলে, “অ্যান্ড দেয়ার হি ইজ… মাই সুইটহার্ট… সূর্য…”
সূর্যের দিকে মাথা ঝোঁকায় ডেভিড নাম্নি ভদ্রলোক সসন্মানে… “হ্যালো স্যর…” অভিবাদন জানায় ঘাড় ঝুঁকিয়ে সামান্য… সূর্য বোঝে ডেভিড এ বাড়ির শফিউর…
তাদের কথা মধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরেক ধোপদূরস্থ পোষাকের ভদ্রলোক… ডেভিডের থেকে একটু বেশিই বয়ষ্ক… দেখে অন্তত ষাট বাষট্টির কাছেকাছি বলে মনে হলো সূর্যের… ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আগের মতই ডেভিডের কায়দায় অভিবাদন জানায় অলিভীয়াকে… অলিভীয়া তার দিকেও স্মিত হেসে হাত তুলে বলে ওঠে, “হ্যালো টম্…”
টম্ নাম্মি ভদ্রলোক বিগলিত হাসি হেসে বলে ওঠে, “আপনি আসবেন সেটা তো বলেন নি আগে… তাহলে স্যরকে বলে রাখতাম…”
উত্তর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অলিভীয়া… হাসার সাথে যেন তার শরীরটাও একই রকম ভাবে হেসে ওঠে উচ্ছলতায়… “না না… আগে ঠিক ছিল না টম্… হটাৎ করেই ভাবলাম চলে আসি বাড়িতে একবার…”
টম্ অলিভীয়ার কথায় মাথা নেড়ে উত্তর দেয়, “তা বেশ করেছেন… কিন্তু স্যর তো এখন একটু ব্যস্ত রয়েছেন… আপনি ততক্ষন না হয় আপনার ঘরেই বিশ্রাম করুন, আমি বলে দিচ্ছি ভেতরে…”
“ইটস্ ওকে টম্… অত ব্যস্ত হতে হবে না তোমায়…” তারপর সূর্যের দিকে ফিরে বলে, “সূর্য… এ হচ্ছে টম্… আমাদের বাড়ির বাট্লার… তুমি জানো? আমায় সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে ও…” তারপর টম্ এর দিকে ফিরে বলে, “আর টম্… আজ কিন্তু আমি একা আসিনি… সাথে আমার মনের মানুষও এসেছে… তাই দেখো…”
অলিভীয়ার মুখের কথা শেষ হয় না, টম্ ভদ্রলোকটি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, “এ নিয়ে কিছু ভাববেন না ম্যাম্… আমি সব বন্দোবস্থ করে দেবো…”
অলিভীয়ার কথায় মনের মধ্যে বাবামশাইয়ের খাস লোক, যদুর মুখটা ভেসে ওঠে সূর্যের মনের মধ্যে… সরল সাধাসিধে মানুষ যদু… ছোটবেলা থেকে একই রকম দেখে আসছে তাকে… সেই হাঁটুর কাছে উঁচু করে পরা ধুতি আর গায়ে একটা ফতুয়া… শীতকালে ফতুয়ার উপরে বড়জোড় একটা মোটা শাল, সেটাও হয়তো বাবামশাইয়েরই দেওয়া… খালি পায়ে এদিক সেদিন দৌড়ে বেড়াচ্ছে সে বাবামশায়ের মুখের একটা কথায়… আজ পর্যন্ত কোন দিন যদুদার মুখে কখনও বিরক্তির কোন ভাব দেখেনি সে… নিজের হাতে যেন বাড়ির সকলের দায়িত্ব নিয়ে রেখেছে একা, কাঁধের উপরে… আর অলিভীয়ার বাড়ির বাট্লার… টম্… ধোপদূরস্থ কেতার পোষাক পরিহিত… দেখে যেন তাকেই বাড়ির কর্তা মনে হয়…
টম্ এর কথায় খুশি হয় অলিভীয়া… হেসে বলে, “ইয়েস… দ্যট আই নো ইয়ু উইল…” তারপরেই সূর্যের দিকে ফিরে বলে, “চলো? ভিতরে চলো… এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?”
অলিভীয়ার দিকে ম্লান হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ে সূর্য… পড়ন্ত রোদে যেন তখন ঝলমল করছে অলিভীয়ার মুখটা… পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডেভিডএর দিকে তাকাতেই শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে ডেভিড… “ইয়েস ম্যাম্… আপনি ভেতরে যান, আমি গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে দেবো…”
ডেভিডের কথায় তাকে এক উজ্জল হাসি উপহার দিয়ে হাত বাড়িয়ে সূর্যের বাহু ধরে হাঁটা লাগায় বাড়ির দিকে… পেছন পেছন টম্ আসে শশব্যস্ততায়…
বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই বাইরের তাপ যেন নিমেশে উধাও হয়ে যায়… বেশ আরামদায়ক মনরম আবহাওয়া… চকমিলানো মেঝে… বেশ বড় বৈঠকখানা… অনেকটা তারই যেন বেলাডাঙায় এসে পড়ে সূর্য… কিন্তু তাদের বেলাডাঙার চৌধুরীবাড়ি আজ কালের কবলে অনেকটাই ক্ষইষ্ণু… যেটা এখানে তার কোন ছাপ নেই কোথাও… আসবাব পত্র প্রায় সবই সাবেকি, কাঠের, মূল্যবান… কিন্তু সঠিক পরিচর্যার ছোঁয়া সর্বত্র… কেমন তার মনে হয় যেন হটাৎ করে বিংশ শতাব্দী থেকে এক ঝটকায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে ঢুকলো সে… পালিশ করা কাঠের সিড়ি বৈঠকখানার শেষ প্রান্ত থেকে উঠে গিয়েছে উপর তলের পানে… এক দিকে সম্ভবত লাইব্রেরীই হবে… সূর্যের ওখানে দাঁড়িয়ে তাইই মনে হয়… দূর থেকে খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতরে দেওয়াল আলমারী জোড়া প্রচুর বইয়ের সারি চোখে পড়ে… বৈঠকখানায় অনেকগুলি মখমলের গদি মোড়া কেদারা পাতা রয়েছে… একটা কালো কাঠের কারুকার্য করা টেবিলের চার ধারে… ঘরের প্রতিটা কোনায় একটি করে মূর্তি রাখা… ধাতুরই হবে… বেশ বড় বড়… মাথার উপর থেকে একটা বড় ঝাড় বাতি ঝুলছে… এটা অবস্য তাদের বাড়িতেও বর্তমান… তাদের প্রতিটা ঘরে এখনও ঝাড়বাতি ঝোলে… সে দিক দিয়ে তারাও যে কম কিছু না এদের থেকে সেটা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না সূর্যের… আর সেটা বুঝে যেন মনে মনে আগের সেই অস্বস্থিটা অনেকটা হ্রাস পায় তার… হ্যা, এটা ঠিক… অলিভীয়া যথেষ্ট উচ্চবংশের মেয়ে… বিত্তশীলও বটে তার পরিবার… কিন্তু সেখানে তুল্যমূল্য বিচার করতে গেলে সেও কোন যে সে বংশ থেকে আসেনি… তারও পরিবারে রাজরক্তের ছোঁয়া রয়েছে বইকি… শুধু একটাই তফাৎ, তাদের সে বৈভব পড়ন্ত বেলায় পৌঁছেছে, আর অলিভীয়াদের এখনও সেই ঠাঁট বাঁট বজায় রেখে চলছে… আর বেশি কিছু নয়…