27-02-2021, 11:12 AM
বাবা ,
হ্যাঁ বাবা-ই লিখলাম ড্যাড নয়।
তুমি হয়তো ভাবছো বাংলা অক্ষরগুলোকে আমি ভুলে গেছি, হয়তো ভাষাটাকেও। চমকে গেলে তো আমার চিঠি পেয়ে? হোয়াটসআপ কল নয়, রীতিমত চিঠি লিখছি দেখে নিশ্চয়ই ভাবছো
এ দেশে এসে অরিনের নিশ্চয়
মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে।
জানো বাবা কিছু কথা ফোনে নয় বাংলা শব্দে লিখে জানাতে চাই তোমায়।
জানি আমার বাংলা বড়ই দুর্বল
তবুও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
তুমিই ছোটবেলায় বলতে,
চেষ্টা করলে সাফল্য পাবই।
আপাতত আমি ফিরে যেতে চাই আমাদের কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে,
যে ফ্ল্যাটটা তোমার বড্ড অপছন্দের ছিল। তুমি মাঝে মাঝেই বলতে,
অক্সিজেনের বড় অভাব,
বুঝলি অরিন আমরা এই ফ্ল্যাটে শুধুই কার্বন ডাই অক্সাইড টানছি ফুসফুস ভরে। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম,
বাতাসের আবার পার্থক্য কি!
তুমি বলতে, জানিস, আমার বীরভূমের একতলা বাড়িটার দক্ষিণদিকে ছিল সোনাঝুড়ির জঙ্গল।
সন্ধ্যেবেলা ওই বারান্দায় দাঁড়ালে আমি ওদের কথা শুনতে পেতাম।
ওরা শনশন আওয়াজে বলতো, আরো জোরে হাওয়া দে, যাতে রাঙা মাটি এসে লাগে আমাদের পাতায়।
তুমি বলতে, অরিন, তোর এক্সামের পরে একবার যাবি আমার সাথে বীরভূমে। তোকে শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখাবো। রবীন্দ্রনাথ টেগরের পোয়েম পড়িস তো, ওনার আশ্রম দেখাবো, যাবি?
আমি ঘাড় নেড়ে বলতাম, যাবো।
ঠিক সেই সময় মা এসে বলতো,
না যাবে না। অরিন যাবে না।
সামার ভ্যাকেশনে আমরা সিঙ্গাপুর যাবো, নিদেন মানালী।
তোমার তো দার্জিলিং টুকুই দৌড়। টাকাগুলো তো তোমার বীরভূমের দুঃস্থ ছেলেদের পিছনেই খরচ করো।
আমাদের শখের কথা কবে আর ভাবলে তুমি! মায়ের গলায় ক্ষোভ থাকতো। আমার ছেলেটাকে একটু বড় স্বপ্ন দেখাতে পারো না তুমি, শুধু টেনে নিয়ে যেতে চাও গ্রামে।
তুমি চোখ নিচু করে বলতে, অরিন বীরভূম চিনবে না সুচেতনা? ও অয়ন মুখার্জীর ছেলে হয়ে বাবার ভিটে চিনবে না?
মা রাগী গলায় বলতো, অরিন পড়তে বসো।
জানো বাবা, আমারও ইচ্ছে করতো তোমার জন্মভূমিতে একবার অন্তত যাই।
তোমার চোখের দৃষ্টিতে বীরভূমকে আমি কল্পনা করতাম। যদিও ধীরে ধীরে আমি বুঝে গেলাম, আমাকে অনেক পড়তে হবে, আমাকে আমার জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে সাত সমুদ্র পাড়।
মা বলতো, বাবার মত দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার নাম বোকামি। আমি অনেক চেষ্টা করে ওকে কলকাতা নিয়ে এসেছি। তবুও দেখ, তোর বাবার গায়ে এখনো লালচে মাটি লেগে আছে। তোকে অনেক উঁচুতে উঠতে হবে, তোকে বিদেশে যেতে হবে। জানো বাবা, তখন থেকেই আমি বুঝতে শিখলাম, ইন্ডিয়াতে মানুষ থাকে না, বোকারা থাকে।
তুমি মাঝে মাঝে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আমার পাশে এসে চুপটি করে বসতে। আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ভয়ে ভয়ে বলতে, অরিন, বাংলা তো তোদের থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তাই না? একটু আধটু পড়িস তো? আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, না ড্যাড, মাম্মি বলেছে ওতে ভালো না করলেও চলবে।
তুমি ম্রিয়মান মুখে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলে, মাতৃভাষাকে ভুলে যাবি?
আমি কিছু বলার আগেই মাম্মি এসে বলেছিল, হ্যাঁ যাবে।
তুমি তো বাংলার প্রফেসর হয়েছো, কজন জানে তোমার নাম?
জীবনে তো নন্দনে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারলে না।
আমার ছেলে বিদেশে যাবে, ওখানে বাংলা ওর কি কাজে লাগবে?
তুমি অস্ফুটে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলে, কিন্তু আমি শুনতে পাইনি।
তবে আন্দাজ করেছিলাম, তুমি বলতে চেয়েছিলে, একটু শিখে রাখলে ক্ষতি কি!
জানো বাবা, আমার সেই সন্ধ্যের কথাটা খুব মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনের দিনে তুমি আমায় একটা কবিতা শিখিয়েছিলে।
বলেছিলে, অক্ষরগুলো তো চিনিস, দেখে দেখেই বলবি ওনার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে।
আমিও সকাল থেকে অনেকবার অভ্যেস করে নিয়েছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা মা বললো, ওসব নাকি খুচরো সেন্টিমেন্ট, ওসবে গুরুত্ব না দিয়ে আমি যেন পড়তে বসি।
মায়ের সাথে ওয়েস্টার্ন ডান্স শিখতে যেতাম আমি, স্প্যানিশ গিটার শিখতাম আর তুমি মাঝে মাঝেই বলতে, অরিন রবীন্দ্র সংগীত শুনবি? গিটারে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তোল না!
আমিও তখন শিখে গেছি, বাবা নামক মানুষটা আসলে বড্ড পুওর।
তাকে ড্যাড বলে ডাকলেও,
মানুষটা আসলে গুড ফর নাথিং।
তাই মায়ের মতোই আমি বলেছিলাম,
ড্যাড, আমাকে অনেক বড় হতে হবে। ইউনিভার্সিটির বাংলার প্রফেসর হয়ে থাকলে হবে না।
তুমি সেদিনও মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলে আমার ঘর থেকে।
আমার আর মায়ের জগতে তুমি ছিলে নিতান্তই ব্রাত্য।
বড্ড গেঁয়ো, স্রোতের উলটো দিকে চলা
পাবলিক। তাই আমি যতই বড় হচ্ছিলাম দূরত্ব বাড়ছিল তোমার সঙ্গে।
একই বাড়িতে বাস করেও তুমি ছিলে সম্পূর্ণ অন্য গ্রহের বাসিন্দা।
মা বলতো, প্লিজ অরিন, বাবার মত হোস না তুই। তোর বাবার জন্য আমার কোনো সাধ পূরণ হয়নি। আমি আমেরিকা যেতে পারিনি, বাংলোর মত বাড়িতে থাকতে পারিনি, জাস্ট কিছু পারিনি। তোর বাবা সারাজীবন নিজের উপার্জনের টাকা চ্যারিটি করে গেছে।
আমি জানতাম, তুমি মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারোনি তাই তার দায়িত্বও আমাকেই নিতে হবে।
জানো বাবা, তুমি মানুষটাকে আমি ধীরে ধীরে এড়িয়ে যেতে লাগলাম।
চুপচাপ বই মুখে পড়ে থাকা একটা মানুষ। দিনরাত পেন নিয়ে সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটা মানুষটা একেবারেই সোশ্যাল নয়, মিশুকে নয়। কেমন যেন খোলসের মধ্যে বাস করা একটা প্রাণী। দশটা-পাঁচটা জীবন কাটাতে যে অভ্যস্ত। খুব বড় স্বপ্ন দেখতেও যে জানে না। মা বলতো জিততে শেখেনি তোর বাবা! লুজার, হেরে যাওয়া একটা মানুষ।
যদিও তোমার চোখে কখনো হারের গ্লানি দেখিনি আমি।
মায়ের স্বপ্ন মতোই আমি বড় হচ্ছিলাম। ভালো রেজাল্ট করতে করতে আমিও এক সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, যারা সত্যিই শিক্ষিত তারা কেউ ইন্ডিয়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে না।
মা ছোট মেসোমশাইকে দেখিয়ে বলতো, দেখ মেসোকে দেখে শেখ। তিনবার লন্ডন ঘুরে এলো। বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকে তোর মেসো।
আর তোর বাবাকে দেখ, বেড়াতে যাওয়া মানে হরিদ্বার, সিমলা....
ছোট মেসো ছিল আমার আইডল।
মাসিমনির বাড়িতে গিয়ে আমি মেসোর সাথে গল্প করতাম।
স্বপ্নের দেশের ছবি আঁকতাম মনে মনে।
না বাবা, সেখানে তোমার জন্মভূমির মত লালমাটি নেই, ওখানের বাতাসে ধুলো ওড়ে না।
মেসোর অ্যালবামে বিদেশের ছবি দেখতে দেখতে মনে হতো... মা ঠিক বলছে, ওটাই জীবন।
আত্মীয়-স্বজন সকলেই দেখতাম ছোটমেসোকে আলাদা সম্মান করতো। এমনকি মামার বাড়ি গেলে দাদু পর্যন্ত বলতো, ভালো করে পড়াশোনা কর অরিন, ছোটমেসোর মত হয়ে দেখা। কেউ কখনো বলতো না বাবার মত হয়ে দেখা।
ছোটমেসোর মত আমিও সব সময় ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করতাম।
ভুল করেও বাংলা বলতাম না।
তুমি একবার বলেছিলে, অরিন পারলে আমায় বাবা বলে ডাকিস।
ড্যাড শুনলেই কেমন হাঁসফাঁস করি।
আমি তখন সদ্য বি.টেক ভর্তি হয়েছি।
বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, তোমাকে না ডাকলেই বা তোমার কি আসে যায়!
তোমার গরিব ছাত্রদের বলো,
তোমায় বাবা বলে ডাকবে।
তোমার চোখে সেদিনও অসহায়তা দেখেছিলাম।
কিন্তু ডাল-ভাত খাওয়া ভেতো বাঙালি তখন আমার দুচোখের বিষ।
ছাত্র পড়ানো ছাড়া জীবনে যে আর কিছুই করতে পারেনি তাকে শ্রদ্ধা করতে আমার বয়েই গেছে।
কলেজে সবাই একটু সমীহ করেই বলতো, অরিন তোর বাবা প্রফেসর?
আমি বলতাম, হ্যাঁ বাংলার। আমার ড্যাড, বাংলা ছাড়া আর কিছুই জানে না।
জীবনে কোনোদিন ভুল করেও আমার বাবার মুখে কোনো ইংরেজি শুনিনি। এমনকি আমার বাবা ভুল করলে সরি বলতো না, দুঃখিত বলতো।
বন্ধুরা হেসে বলতো, ভেতো বাঙালী।
মাম্মি বলতো, অরিন , বন্ধুরা বাবা কি করেন জিজ্ঞেস করলে শুধু বলো, বাবা প্রফেসর, কোন সাবজেক্টের সেটা বলার দরকার নেই। লোকে শুনলে হাসবে।
একটা মানুষ ইংরেজীর ই না জেনেই
জীবন কাটাচ্ছে জানলে সভ্য মানুষরা হার্টফেল করবে।
তুমি মুচকি হেসে বলতে, সুচেতনা নিজের ভাষাকে অসম্মান করো না। অন্য ভাষা শেখ দোষ নেই, কিন্তু মাকে অপমান করো না।
মা ব্যঙ্গ করে বলতো, জানো অয়ন, মাঝে মাঝে তোমাকে দেখে করুণা হয়।
তোমার দেশ ভক্তি দেখে হাসি পায়।
আসলে কি বলতো, যারা জীবনে মারাত্মক ভাবে ব্যর্থ হয়, তারাই দেশের মাটি আগলে পড়ে থাকে আর নিজের ল্যাঙ্গুয়েজের প্রতি ভালোবাসা দেখায়।
এটাও একটা মুখোশ বুঝলে।
নিজের অক্ষমতা ঢাকার মুখোশ। দেশভক্তির মুখোশ পরে তুমি নিজের অক্ষমতা ঢাকছো নিজের সন্তানের কাছেও। হেরে যাওয়া মানুষরা এভাবেই নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দেয়।
রঞ্জনকে দেখে শেখ। সে কেমন বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করছে।
ওদেশে ওর কত সম্মান।
নামি কোম্পানিতে জব করছে।
এক গাদা স্যালারি পাচ্ছে।
বউ, মেয়েকে সুখে রেখেছে।
রঞ্জনের নাম করলেই আমার মনেও আলাদা শ্রদ্ধা কাজ করতো, কারণ ছোটমেসো ছিল আমার কাছে ভগবান।
মা বলেছিল, কতটা যোগ্যতা থাকলে এতগুলো দেশে সম্মান পাওয়া যায়!
মামাবাড়িতে গেলেও দেখতাম,
তোমাকে সবাই জিজ্ঞেস করতো,
অয়ন, সারাটা জীবন ইউনিভার্সিটি
আর বাড়ি করেই কাটিয়ে দিলে?
তুমি বলতে, ছাত্র তৈরি করলাম। ভবিষ্যতের মুখ গড়লাম।
ওরাই আমাদের দেশকে উজ্জ্বল করবে।
দাদু ব্যঙ্গ করে বলতো, আমারই ভুল। আমিই প্রফেসর দেখে সুচেতনার বিয়ে দিয়ে ফেললাম। আমার বোঝা উচিত ছিল অরিজিনটা সেই বীরভূমের।
সুচেতনা যতই চেষ্টা করুক, গা থেকে মাটির গন্ধ ধুয়ে ফেলতে পারেনি এখনো।
তুমি হেসে বলতে,
পুরো গন্ধ না ওঠাই ভালো বাবা,
আবার তো মাটিতেই মিশতে হবে।
আই টি জয়েন করার পরেই আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া।
মা বলতো, জীবনে তো তোর বাবাকে নিয়ে গর্ব করতে পারিনি,
এবারে তোকে নিয়ে করবো।
বেশিদিন সময় লাগেনি, আমার ইউ কে পাড়ি জমাতে।
প্রায় বছর খানেক হলো আমি বিদেশের মাটিতে।
একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, এদেশের কিছু মানুষ ইন্ডিয়ানদের দেখলে একটু যেন করুনার চোখেই তাকায়।
ভাবখানা এমন যেন, ওরা ছিল বলে আমরা করে খাচ্ছি।
অপমানিত বোধ করি মাঝে মাঝে।
মায়ের কথাই ঠিক, বাংলা আমার কোনো কাজেই লাগে না। সারাদিনে আমি একটাও বাংলায় কথা বলি না।
মা ফোনে সেদিন বললো, ভিডিও কল করতে। ছোটমাসি আর ছোটমেসোর অহংকার নাকি এতদিনে মা ভাঙতে পেরেছে।
মাকে জেতাতে পেরে আমিও জিতলাম।
জানো বাবা, তোমাকে তো তাও তোমার দুশো জন ছাত্র সম্মান করতো,
কিন্তু এদেশে আলাদা করে
আমাকে কেউ সম্মান করে না।
চাকরি করি, মাইনে পাই।
স্যালারিটাই যা আকর্ষণীয়।
তার মানে ছোটমেসোকেও এসব দেশে আলাদা করে কেউ সম্মান করতো না। কারণ ছোটমেসোও তো চাকুরীজীবীই ছিল।
মায়ের ধারণা ভুল ছিল। স্যালারির সাথে সম্মানের কোনো যোগসূত্র নেই।
এখানে আমার বেশ কিছু বন্ধু হয়েছে।
এরা অবশ্য ইন্ডিয়ান বলে আলাদা একটু সম্মান করে।
এরা বলে, আমি রবীন্দ্রনাথ টেগরের দেশের লোক।
আমি বিবেকানন্দের দেশের লোক, তাই ....
জানো বাবা, আমাদের অফিসে দুদিনের ছুটি ছিল, আমি আর আমার আরেক বন্ধু গিয়েছিলাম অক্সফোর্ড ঘুরতে।
ওখানে এক প্রফেসরের সাথে আমাদের পরিচয় হলো।
অভিক চক্রবর্তী। ও বাঙালী।
আমাদের যাদবপুরের ছেলে।
ওখান থেকে ফিরেই তোমায় লিখতে বসলাম।
ওখানে দেখা একটা অভিজ্ঞতার কথা তোমায় লিখতে ইচ্ছে হলো।
অভিক অক্সফোর্ডের প্রফেসর।
ও আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল ওদের লাইব্রেরিটা।
হঠাৎ অভিক বলে উঠলো, জানো অরিন,
আমাদের উনিভার্সিটিতে বাঙালি রাইটারের লেখা বই পড়ানো হয়।
ছাত্র- ছাত্রীদের উজ্জীবিত করার জন্য এই বইটা গত বছর থেকে পাঠ্য তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। আগ্রহের বশেই তাকালাম ওর হাতের বইটার দিকে।
কেন জানিনা বহুদিন পরে বাঙালি শব্দটা শুনে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম। বাঙালীর লেখা বই অক্সফোর্ডে পড়ানো হচ্ছে! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল শুনে।
The winner
Written by
Dr. Ayan mukharjee
নামটা তোমার সাথে মিল আছে বলেই বইটা হাতে নিলাম।
পাতা ওল্টাতেই দেখলাম, তোমার সেই সাদা আর আকাশি পাঞ্জাবী পরা ছবিটা।
তোমার মুখে সেই কিচ্ছু জানিনার বোকা বোকা হাসিটা।
যেটা দেখে মা বলতো, চূড়ান্ত আনস্মার্ট।
চারশো পাতার একটা বই জুড়ে তুমি বুঝিয়েছো, কাদের উইনার বলা হয়। জীবনে কারা জেতে। আর কারা হেরে গিয়েও জিতে গেছি ভেবে উল্লাস করে।
তুমি লিখেছো জিতে যাওয়া কার নাম! কি ভাবে হারতে হারতেও বিজয়ী হওয়া যায়। তোমার বইটা পড়তে পড়তে নিজেকে বড্ড লুজার মনে হচ্ছিল।
না বাবা, আমি উইনার নই।
এত সুন্দর ইংরেজী লেখো তুমি! সারাজীবন কনভেন্টে পড়েও তো আমি এমন একটা বাক্যও গঠন করতে পারবো না বাবা।
কাজ চালানো ইংরেজী আর অনুভূতি দিয়ে গড়া একটা বাক্যের মধ্যে কত পার্থক্য!
তবে আমরা যে জানতাম, তুমি বাংলা ছাড়া আর কিছুই পারো না?
তুমি অবশ্য মাঝে মাঝেই বলতে, জানিস অরিন, অনেকেই জানে না, গীতাঞ্জলির অনেক ইংরেজীই কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। পরে অবশ্য অনুবাদ করা হয়।
বাবা, তুমি কেন মামার বাড়িতে, রঞ্জন মেসোর সামনে এসব বলোনি?
মাকেও বলোনি কেন বাবা?
কেন সারাটা জীবন সব জেনেও
না জানার অভিনয় করে গেছো?
অবশ্য তোমার দ্য উইনার পড়তে পড়তে আমি বুঝেছি জয়ীর সংজ্ঞাটা কি! পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্টের ওপরে তোমার লেখা এমন যে একটা বই থাকতে পারে আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
অথচ মা সারাজীবন বললো,
তোর বাবার কোনো পার্সোনালিটি নেই।
বাবা, দেখো তো আমিও কিন্তু বাংলাটাকে ভুলিনি।
হয়তো তোমার মত অমন ভাষায় লিখতে পারলাম না, কিন্তু তুমিই তো বলেছো, যে জয় করতে পারে তার ভিতরের আনন্দটা কাউকে দেখানোর প্রয়োজন হয় না, একমাত্র সেই উপলব্ধি করতে পারে।
আজও বাংলায় চিঠি লিখে আর তোমাকে বাবা ডেকে আমি কিন্তু উইনার হলাম বাবা। আমার এতটাই আনন্দ হচ্ছে, যে আমার চোখ দিয়ে সে আনন্দ গাল বেয়ে চিবুক ছুঁতে যাচ্ছে।
একটা কথা সত্যি করে বলতো বাবা,
বছর দুই আগে দিন পনেরোর জন্য তুমি ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলে।
আমরা কেউ তোমায় ফোনে পাইনি।
ফিরে এসে তুমি বলেছিলে, ইউনিভার্সিটির কাজে গেছো।
আমার দৃঢ় ধারণা, তুমি তখন তোমার রাঙামাটির দেশে পালিয়েছিলে।
নিজের শিকড়ের সন্ধানে।
জানো বাবা, আমি অভিক চক্রবর্তীকে বললাম, এই অয়ন মুখার্জীই আমার বাবা।
দ্য উইনার।
খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি বাবা।
ড্যাড নয়, বাবা বলেই ডাকবো তোমায়। বাবা, আমি খুব দুঃখিত,
তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
না, সরি নয়, দুঃখিত।
এবারে ফিরেই আমি তোমার সাথে বীরভূম যাবো।
নিয়ে যাবে তো?
দ্য লুজার
অরিন
হ্যাঁ বাবা-ই লিখলাম ড্যাড নয়।
তুমি হয়তো ভাবছো বাংলা অক্ষরগুলোকে আমি ভুলে গেছি, হয়তো ভাষাটাকেও। চমকে গেলে তো আমার চিঠি পেয়ে? হোয়াটসআপ কল নয়, রীতিমত চিঠি লিখছি দেখে নিশ্চয়ই ভাবছো
এ দেশে এসে অরিনের নিশ্চয়
মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে।
জানো বাবা কিছু কথা ফোনে নয় বাংলা শব্দে লিখে জানাতে চাই তোমায়।
জানি আমার বাংলা বড়ই দুর্বল
তবুও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
তুমিই ছোটবেলায় বলতে,
চেষ্টা করলে সাফল্য পাবই।
আপাতত আমি ফিরে যেতে চাই আমাদের কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে,
যে ফ্ল্যাটটা তোমার বড্ড অপছন্দের ছিল। তুমি মাঝে মাঝেই বলতে,
অক্সিজেনের বড় অভাব,
বুঝলি অরিন আমরা এই ফ্ল্যাটে শুধুই কার্বন ডাই অক্সাইড টানছি ফুসফুস ভরে। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম,
বাতাসের আবার পার্থক্য কি!
তুমি বলতে, জানিস, আমার বীরভূমের একতলা বাড়িটার দক্ষিণদিকে ছিল সোনাঝুড়ির জঙ্গল।
সন্ধ্যেবেলা ওই বারান্দায় দাঁড়ালে আমি ওদের কথা শুনতে পেতাম।
ওরা শনশন আওয়াজে বলতো, আরো জোরে হাওয়া দে, যাতে রাঙা মাটি এসে লাগে আমাদের পাতায়।
তুমি বলতে, অরিন, তোর এক্সামের পরে একবার যাবি আমার সাথে বীরভূমে। তোকে শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখাবো। রবীন্দ্রনাথ টেগরের পোয়েম পড়িস তো, ওনার আশ্রম দেখাবো, যাবি?
আমি ঘাড় নেড়ে বলতাম, যাবো।
ঠিক সেই সময় মা এসে বলতো,
না যাবে না। অরিন যাবে না।
সামার ভ্যাকেশনে আমরা সিঙ্গাপুর যাবো, নিদেন মানালী।
তোমার তো দার্জিলিং টুকুই দৌড়। টাকাগুলো তো তোমার বীরভূমের দুঃস্থ ছেলেদের পিছনেই খরচ করো।
আমাদের শখের কথা কবে আর ভাবলে তুমি! মায়ের গলায় ক্ষোভ থাকতো। আমার ছেলেটাকে একটু বড় স্বপ্ন দেখাতে পারো না তুমি, শুধু টেনে নিয়ে যেতে চাও গ্রামে।
তুমি চোখ নিচু করে বলতে, অরিন বীরভূম চিনবে না সুচেতনা? ও অয়ন মুখার্জীর ছেলে হয়ে বাবার ভিটে চিনবে না?
মা রাগী গলায় বলতো, অরিন পড়তে বসো।
জানো বাবা, আমারও ইচ্ছে করতো তোমার জন্মভূমিতে একবার অন্তত যাই।
তোমার চোখের দৃষ্টিতে বীরভূমকে আমি কল্পনা করতাম। যদিও ধীরে ধীরে আমি বুঝে গেলাম, আমাকে অনেক পড়তে হবে, আমাকে আমার জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে সাত সমুদ্র পাড়।
মা বলতো, বাবার মত দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার নাম বোকামি। আমি অনেক চেষ্টা করে ওকে কলকাতা নিয়ে এসেছি। তবুও দেখ, তোর বাবার গায়ে এখনো লালচে মাটি লেগে আছে। তোকে অনেক উঁচুতে উঠতে হবে, তোকে বিদেশে যেতে হবে। জানো বাবা, তখন থেকেই আমি বুঝতে শিখলাম, ইন্ডিয়াতে মানুষ থাকে না, বোকারা থাকে।
তুমি মাঝে মাঝে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আমার পাশে এসে চুপটি করে বসতে। আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ভয়ে ভয়ে বলতে, অরিন, বাংলা তো তোদের থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তাই না? একটু আধটু পড়িস তো? আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, না ড্যাড, মাম্মি বলেছে ওতে ভালো না করলেও চলবে।
তুমি ম্রিয়মান মুখে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলে, মাতৃভাষাকে ভুলে যাবি?
আমি কিছু বলার আগেই মাম্মি এসে বলেছিল, হ্যাঁ যাবে।
তুমি তো বাংলার প্রফেসর হয়েছো, কজন জানে তোমার নাম?
জীবনে তো নন্দনে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারলে না।
আমার ছেলে বিদেশে যাবে, ওখানে বাংলা ওর কি কাজে লাগবে?
তুমি অস্ফুটে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলে, কিন্তু আমি শুনতে পাইনি।
তবে আন্দাজ করেছিলাম, তুমি বলতে চেয়েছিলে, একটু শিখে রাখলে ক্ষতি কি!
জানো বাবা, আমার সেই সন্ধ্যের কথাটা খুব মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনের দিনে তুমি আমায় একটা কবিতা শিখিয়েছিলে।
বলেছিলে, অক্ষরগুলো তো চিনিস, দেখে দেখেই বলবি ওনার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে।
আমিও সকাল থেকে অনেকবার অভ্যেস করে নিয়েছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা মা বললো, ওসব নাকি খুচরো সেন্টিমেন্ট, ওসবে গুরুত্ব না দিয়ে আমি যেন পড়তে বসি।
মায়ের সাথে ওয়েস্টার্ন ডান্স শিখতে যেতাম আমি, স্প্যানিশ গিটার শিখতাম আর তুমি মাঝে মাঝেই বলতে, অরিন রবীন্দ্র সংগীত শুনবি? গিটারে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তোল না!
আমিও তখন শিখে গেছি, বাবা নামক মানুষটা আসলে বড্ড পুওর।
তাকে ড্যাড বলে ডাকলেও,
মানুষটা আসলে গুড ফর নাথিং।
তাই মায়ের মতোই আমি বলেছিলাম,
ড্যাড, আমাকে অনেক বড় হতে হবে। ইউনিভার্সিটির বাংলার প্রফেসর হয়ে থাকলে হবে না।
তুমি সেদিনও মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলে আমার ঘর থেকে।
আমার আর মায়ের জগতে তুমি ছিলে নিতান্তই ব্রাত্য।
বড্ড গেঁয়ো, স্রোতের উলটো দিকে চলা
পাবলিক। তাই আমি যতই বড় হচ্ছিলাম দূরত্ব বাড়ছিল তোমার সঙ্গে।
একই বাড়িতে বাস করেও তুমি ছিলে সম্পূর্ণ অন্য গ্রহের বাসিন্দা।
মা বলতো, প্লিজ অরিন, বাবার মত হোস না তুই। তোর বাবার জন্য আমার কোনো সাধ পূরণ হয়নি। আমি আমেরিকা যেতে পারিনি, বাংলোর মত বাড়িতে থাকতে পারিনি, জাস্ট কিছু পারিনি। তোর বাবা সারাজীবন নিজের উপার্জনের টাকা চ্যারিটি করে গেছে।
আমি জানতাম, তুমি মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারোনি তাই তার দায়িত্বও আমাকেই নিতে হবে।
জানো বাবা, তুমি মানুষটাকে আমি ধীরে ধীরে এড়িয়ে যেতে লাগলাম।
চুপচাপ বই মুখে পড়ে থাকা একটা মানুষ। দিনরাত পেন নিয়ে সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটা মানুষটা একেবারেই সোশ্যাল নয়, মিশুকে নয়। কেমন যেন খোলসের মধ্যে বাস করা একটা প্রাণী। দশটা-পাঁচটা জীবন কাটাতে যে অভ্যস্ত। খুব বড় স্বপ্ন দেখতেও যে জানে না। মা বলতো জিততে শেখেনি তোর বাবা! লুজার, হেরে যাওয়া একটা মানুষ।
যদিও তোমার চোখে কখনো হারের গ্লানি দেখিনি আমি।
মায়ের স্বপ্ন মতোই আমি বড় হচ্ছিলাম। ভালো রেজাল্ট করতে করতে আমিও এক সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, যারা সত্যিই শিক্ষিত তারা কেউ ইন্ডিয়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে না।
মা ছোট মেসোমশাইকে দেখিয়ে বলতো, দেখ মেসোকে দেখে শেখ। তিনবার লন্ডন ঘুরে এলো। বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকে তোর মেসো।
আর তোর বাবাকে দেখ, বেড়াতে যাওয়া মানে হরিদ্বার, সিমলা....
ছোট মেসো ছিল আমার আইডল।
মাসিমনির বাড়িতে গিয়ে আমি মেসোর সাথে গল্প করতাম।
স্বপ্নের দেশের ছবি আঁকতাম মনে মনে।
না বাবা, সেখানে তোমার জন্মভূমির মত লালমাটি নেই, ওখানের বাতাসে ধুলো ওড়ে না।
মেসোর অ্যালবামে বিদেশের ছবি দেখতে দেখতে মনে হতো... মা ঠিক বলছে, ওটাই জীবন।
আত্মীয়-স্বজন সকলেই দেখতাম ছোটমেসোকে আলাদা সম্মান করতো। এমনকি মামার বাড়ি গেলে দাদু পর্যন্ত বলতো, ভালো করে পড়াশোনা কর অরিন, ছোটমেসোর মত হয়ে দেখা। কেউ কখনো বলতো না বাবার মত হয়ে দেখা।
ছোটমেসোর মত আমিও সব সময় ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করতাম।
ভুল করেও বাংলা বলতাম না।
তুমি একবার বলেছিলে, অরিন পারলে আমায় বাবা বলে ডাকিস।
ড্যাড শুনলেই কেমন হাঁসফাঁস করি।
আমি তখন সদ্য বি.টেক ভর্তি হয়েছি।
বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, তোমাকে না ডাকলেই বা তোমার কি আসে যায়!
তোমার গরিব ছাত্রদের বলো,
তোমায় বাবা বলে ডাকবে।
তোমার চোখে সেদিনও অসহায়তা দেখেছিলাম।
কিন্তু ডাল-ভাত খাওয়া ভেতো বাঙালি তখন আমার দুচোখের বিষ।
ছাত্র পড়ানো ছাড়া জীবনে যে আর কিছুই করতে পারেনি তাকে শ্রদ্ধা করতে আমার বয়েই গেছে।
কলেজে সবাই একটু সমীহ করেই বলতো, অরিন তোর বাবা প্রফেসর?
আমি বলতাম, হ্যাঁ বাংলার। আমার ড্যাড, বাংলা ছাড়া আর কিছুই জানে না।
জীবনে কোনোদিন ভুল করেও আমার বাবার মুখে কোনো ইংরেজি শুনিনি। এমনকি আমার বাবা ভুল করলে সরি বলতো না, দুঃখিত বলতো।
বন্ধুরা হেসে বলতো, ভেতো বাঙালী।
মাম্মি বলতো, অরিন , বন্ধুরা বাবা কি করেন জিজ্ঞেস করলে শুধু বলো, বাবা প্রফেসর, কোন সাবজেক্টের সেটা বলার দরকার নেই। লোকে শুনলে হাসবে।
একটা মানুষ ইংরেজীর ই না জেনেই
জীবন কাটাচ্ছে জানলে সভ্য মানুষরা হার্টফেল করবে।
তুমি মুচকি হেসে বলতে, সুচেতনা নিজের ভাষাকে অসম্মান করো না। অন্য ভাষা শেখ দোষ নেই, কিন্তু মাকে অপমান করো না।
মা ব্যঙ্গ করে বলতো, জানো অয়ন, মাঝে মাঝে তোমাকে দেখে করুণা হয়।
তোমার দেশ ভক্তি দেখে হাসি পায়।
আসলে কি বলতো, যারা জীবনে মারাত্মক ভাবে ব্যর্থ হয়, তারাই দেশের মাটি আগলে পড়ে থাকে আর নিজের ল্যাঙ্গুয়েজের প্রতি ভালোবাসা দেখায়।
এটাও একটা মুখোশ বুঝলে।
নিজের অক্ষমতা ঢাকার মুখোশ। দেশভক্তির মুখোশ পরে তুমি নিজের অক্ষমতা ঢাকছো নিজের সন্তানের কাছেও। হেরে যাওয়া মানুষরা এভাবেই নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দেয়।
রঞ্জনকে দেখে শেখ। সে কেমন বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করছে।
ওদেশে ওর কত সম্মান।
নামি কোম্পানিতে জব করছে।
এক গাদা স্যালারি পাচ্ছে।
বউ, মেয়েকে সুখে রেখেছে।
রঞ্জনের নাম করলেই আমার মনেও আলাদা শ্রদ্ধা কাজ করতো, কারণ ছোটমেসো ছিল আমার কাছে ভগবান।
মা বলেছিল, কতটা যোগ্যতা থাকলে এতগুলো দেশে সম্মান পাওয়া যায়!
মামাবাড়িতে গেলেও দেখতাম,
তোমাকে সবাই জিজ্ঞেস করতো,
অয়ন, সারাটা জীবন ইউনিভার্সিটি
আর বাড়ি করেই কাটিয়ে দিলে?
তুমি বলতে, ছাত্র তৈরি করলাম। ভবিষ্যতের মুখ গড়লাম।
ওরাই আমাদের দেশকে উজ্জ্বল করবে।
দাদু ব্যঙ্গ করে বলতো, আমারই ভুল। আমিই প্রফেসর দেখে সুচেতনার বিয়ে দিয়ে ফেললাম। আমার বোঝা উচিত ছিল অরিজিনটা সেই বীরভূমের।
সুচেতনা যতই চেষ্টা করুক, গা থেকে মাটির গন্ধ ধুয়ে ফেলতে পারেনি এখনো।
তুমি হেসে বলতে,
পুরো গন্ধ না ওঠাই ভালো বাবা,
আবার তো মাটিতেই মিশতে হবে।
আই টি জয়েন করার পরেই আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া।
মা বলতো, জীবনে তো তোর বাবাকে নিয়ে গর্ব করতে পারিনি,
এবারে তোকে নিয়ে করবো।
বেশিদিন সময় লাগেনি, আমার ইউ কে পাড়ি জমাতে।
প্রায় বছর খানেক হলো আমি বিদেশের মাটিতে।
একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, এদেশের কিছু মানুষ ইন্ডিয়ানদের দেখলে একটু যেন করুনার চোখেই তাকায়।
ভাবখানা এমন যেন, ওরা ছিল বলে আমরা করে খাচ্ছি।
অপমানিত বোধ করি মাঝে মাঝে।
মায়ের কথাই ঠিক, বাংলা আমার কোনো কাজেই লাগে না। সারাদিনে আমি একটাও বাংলায় কথা বলি না।
মা ফোনে সেদিন বললো, ভিডিও কল করতে। ছোটমাসি আর ছোটমেসোর অহংকার নাকি এতদিনে মা ভাঙতে পেরেছে।
মাকে জেতাতে পেরে আমিও জিতলাম।
জানো বাবা, তোমাকে তো তাও তোমার দুশো জন ছাত্র সম্মান করতো,
কিন্তু এদেশে আলাদা করে
আমাকে কেউ সম্মান করে না।
চাকরি করি, মাইনে পাই।
স্যালারিটাই যা আকর্ষণীয়।
তার মানে ছোটমেসোকেও এসব দেশে আলাদা করে কেউ সম্মান করতো না। কারণ ছোটমেসোও তো চাকুরীজীবীই ছিল।
মায়ের ধারণা ভুল ছিল। স্যালারির সাথে সম্মানের কোনো যোগসূত্র নেই।
এখানে আমার বেশ কিছু বন্ধু হয়েছে।
এরা অবশ্য ইন্ডিয়ান বলে আলাদা একটু সম্মান করে।
এরা বলে, আমি রবীন্দ্রনাথ টেগরের দেশের লোক।
আমি বিবেকানন্দের দেশের লোক, তাই ....
জানো বাবা, আমাদের অফিসে দুদিনের ছুটি ছিল, আমি আর আমার আরেক বন্ধু গিয়েছিলাম অক্সফোর্ড ঘুরতে।
ওখানে এক প্রফেসরের সাথে আমাদের পরিচয় হলো।
অভিক চক্রবর্তী। ও বাঙালী।
আমাদের যাদবপুরের ছেলে।
ওখান থেকে ফিরেই তোমায় লিখতে বসলাম।
ওখানে দেখা একটা অভিজ্ঞতার কথা তোমায় লিখতে ইচ্ছে হলো।
অভিক অক্সফোর্ডের প্রফেসর।
ও আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল ওদের লাইব্রেরিটা।
হঠাৎ অভিক বলে উঠলো, জানো অরিন,
আমাদের উনিভার্সিটিতে বাঙালি রাইটারের লেখা বই পড়ানো হয়।
ছাত্র- ছাত্রীদের উজ্জীবিত করার জন্য এই বইটা গত বছর থেকে পাঠ্য তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। আগ্রহের বশেই তাকালাম ওর হাতের বইটার দিকে।
কেন জানিনা বহুদিন পরে বাঙালি শব্দটা শুনে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম। বাঙালীর লেখা বই অক্সফোর্ডে পড়ানো হচ্ছে! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল শুনে।
The winner
Written by
Dr. Ayan mukharjee
নামটা তোমার সাথে মিল আছে বলেই বইটা হাতে নিলাম।
পাতা ওল্টাতেই দেখলাম, তোমার সেই সাদা আর আকাশি পাঞ্জাবী পরা ছবিটা।
তোমার মুখে সেই কিচ্ছু জানিনার বোকা বোকা হাসিটা।
যেটা দেখে মা বলতো, চূড়ান্ত আনস্মার্ট।
চারশো পাতার একটা বই জুড়ে তুমি বুঝিয়েছো, কাদের উইনার বলা হয়। জীবনে কারা জেতে। আর কারা হেরে গিয়েও জিতে গেছি ভেবে উল্লাস করে।
তুমি লিখেছো জিতে যাওয়া কার নাম! কি ভাবে হারতে হারতেও বিজয়ী হওয়া যায়। তোমার বইটা পড়তে পড়তে নিজেকে বড্ড লুজার মনে হচ্ছিল।
না বাবা, আমি উইনার নই।
এত সুন্দর ইংরেজী লেখো তুমি! সারাজীবন কনভেন্টে পড়েও তো আমি এমন একটা বাক্যও গঠন করতে পারবো না বাবা।
কাজ চালানো ইংরেজী আর অনুভূতি দিয়ে গড়া একটা বাক্যের মধ্যে কত পার্থক্য!
তবে আমরা যে জানতাম, তুমি বাংলা ছাড়া আর কিছুই পারো না?
তুমি অবশ্য মাঝে মাঝেই বলতে, জানিস অরিন, অনেকেই জানে না, গীতাঞ্জলির অনেক ইংরেজীই কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। পরে অবশ্য অনুবাদ করা হয়।
বাবা, তুমি কেন মামার বাড়িতে, রঞ্জন মেসোর সামনে এসব বলোনি?
মাকেও বলোনি কেন বাবা?
কেন সারাটা জীবন সব জেনেও
না জানার অভিনয় করে গেছো?
অবশ্য তোমার দ্য উইনার পড়তে পড়তে আমি বুঝেছি জয়ীর সংজ্ঞাটা কি! পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্টের ওপরে তোমার লেখা এমন যে একটা বই থাকতে পারে আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
অথচ মা সারাজীবন বললো,
তোর বাবার কোনো পার্সোনালিটি নেই।
বাবা, দেখো তো আমিও কিন্তু বাংলাটাকে ভুলিনি।
হয়তো তোমার মত অমন ভাষায় লিখতে পারলাম না, কিন্তু তুমিই তো বলেছো, যে জয় করতে পারে তার ভিতরের আনন্দটা কাউকে দেখানোর প্রয়োজন হয় না, একমাত্র সেই উপলব্ধি করতে পারে।
আজও বাংলায় চিঠি লিখে আর তোমাকে বাবা ডেকে আমি কিন্তু উইনার হলাম বাবা। আমার এতটাই আনন্দ হচ্ছে, যে আমার চোখ দিয়ে সে আনন্দ গাল বেয়ে চিবুক ছুঁতে যাচ্ছে।
একটা কথা সত্যি করে বলতো বাবা,
বছর দুই আগে দিন পনেরোর জন্য তুমি ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলে।
আমরা কেউ তোমায় ফোনে পাইনি।
ফিরে এসে তুমি বলেছিলে, ইউনিভার্সিটির কাজে গেছো।
আমার দৃঢ় ধারণা, তুমি তখন তোমার রাঙামাটির দেশে পালিয়েছিলে।
নিজের শিকড়ের সন্ধানে।
জানো বাবা, আমি অভিক চক্রবর্তীকে বললাম, এই অয়ন মুখার্জীই আমার বাবা।
দ্য উইনার।
খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি বাবা।
ড্যাড নয়, বাবা বলেই ডাকবো তোমায়। বাবা, আমি খুব দুঃখিত,
তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
না, সরি নয়, দুঃখিত।
এবারে ফিরেই আমি তোমার সাথে বীরভূম যাবো।
নিয়ে যাবে তো?
দ্য লুজার
অরিন