23-02-2021, 08:27 PM
(This post was last modified: 23-02-2021, 08:29 PM by অনঙ্গপাল. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
।। ১২ ।।
ছেলেবেলায় কলেজ থেকে একবার সায়েন্স সিটিতে নিয়ে গিয়েছিল। আন্দাজ ক্লাস ফোর বা ফাইভে। তখন বয়স অল্প, পৃথিবীটাকে অন্য চোখে দেখতাম। সর্ব বিষয়ে জানতে চাওয়ার অদম্য কৌতূহল কাজ করত মনের ভিতর। প্রশ্নগুলো কিছুতেই আর ফুরোতে চাইত না। অনন্ত জিজ্ঞাসার মাঝে জীবনের গতি ছিল সহজ-সরল, একরৈখিক, একমাত্রিক। অনর্থক জটিলতার স্থান ছিল না কোনও, বোধকরি জটিলতা শব্দের মানেটাও আটকে ছিল সিঁড়িভাঙা অঙ্কের ধাপে ধাপে। একদিকে সুপ্ত বাসনা ছিল ‘বড় হয়ে’ দুনিয়াটাকে মুঠোয় পোরার, তেমনই বিস্মিত হতাম অল্পেতেই। তৎকালীন বাইপাসের সুনসান জনহীন প্রান্তরে বিজ্ঞান-নগরীর সুবিশাল গম্বুজাকৃতি প্রেক্ষাগৃহে বসে অপার বিস্ময়ে দেখেছিলাম আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম ভয়ঙ্কর অরণ্য সেরেঙ্গিটির বুকে বিচিত্রদর্শন হরেকরকম জীবজন্তুর কাণ্ডকারখানা। জলে-ডাঙায়-অন্তরীক্ষে তাদের বর্ণময় জীবনযাত্রার ক্যামেরাধৃত অংশবিশেষ নিরীক্ষণ করে কৈশোরের পথে পা বাড়ানো বালকের সেদিন বাক্যি হরে গিয়েছিল। কি এক অদ্ভুত ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে সন্ধে-নামা অন্ধকারে বাড়ি ফেরার পরেও সেই ঘোর কাটেনি অনেকক্ষণ। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় চোখের পাতা জুড়ে ছিল সদ্য নাম-জানা বন্য প্রাণীদের দল; তাদের শিকার ধরার রকমারি পদ্ধতি, অলস গৃহস্থালীতে বেড়ে ওঠা শাবকদের প্রতি জান্তব অপত্যস্নেহ, তপ্তখরার ঊষর দিনে জলপান বিরতিতে খাদ্য-খাদকের অদ্ভুত সহাবস্থান। অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশের এক আকাশ আলোর নীচে অবিরাম বেজে চলা আদিবাসীদের ঢাকের দ্রিমিদ্রিমি শব্দের আড়ালে কখন যেন দু’চোখে জড়িয়ে এসেছিল ঘুমের চাদর।
তারপর কেটে গিয়েছে দেড় দশকেরও বেশি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সেদিনের প্রায়-কিশোর আজ পরিণতবয়স্ক যুবা। একটার পর একটা ধাপ পেরোতে পেরোতে জীবন ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর। মুঠোয় দুনিয়াটাকে নেওয়ার অলীক স্বপ্ন সে আর দেখে না, বরং এই গ্রহেরই মত গোলাকৃতি নরম কিছুর স্পর্শে উৎফুল্ল হয় হাতের স্নায়ু-পেশীরা। জনবিরল ই.এম. বাইপাসই বা আজ কোথায়? নিত্যনতুন রেস্তোঁরা, শপিং মল আর আবাসনের বিনির্মাণে মুখ ঢেকে ফেলা সড়ককে বর্তমানে চেনা দায়। পুরনো জগতটা চোখের সামনে খোলনলচে সমেত একটু একটু করে বদলেছে, বদলেছে ভিতর-বাইরের আমিটাও। সেরেঙ্গিটি শব্দটা এখন বহুলশ্রুত, তার সম্বন্ধে কোনও কিছু জানার প্রয়োজন হলে মাউসের কয়েকটা ক্লিকেই উইকিপিডিয়া, গুগল, ইউটিউব এনে হাজির করে রাশি রাশি তথ্যের ভাণ্ডার।
গতিময় জীবনে পরিবর্তনের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া সেই আফ্রিকান ঢাকের সহসা নিনাদে হৃদয় আজ তাই স্বভাবতই উদ্বেল। মিহি সুরেলা নারীকণ্ঠে বোমাবর্ষণ হচ্ছে একের পর এক, আর বুকের মাঝে প্রলয়ঙ্কর ভূকম্পনে টালমাটাল এত বছরের সম্পর্কের ভিত। যে শক্ত জমির ওপরে দাঁড়িয়ে দু’জনে রচেছিলাম ভালবাসার যৌথ ইমারত, তার মাটি আলগা ঝুরো ঝুরো হয়ে নড়িয়ে দিচ্ছে তাজমহলের প্রতিটি মিনার। কয়েকশ’ বছরের স্থাপত্য কীর্তি বুঝি কয়েক সেকেণ্ডের প্রলয়েই ধূলিসাৎ হবে। কি অদ্ভুত নিয়ম এই ভাঙাগড়ার খেলায়!
প্রকৃতি যখন প্রলয়ঙ্করী, মানুষ তার সামনে অসহায় শিশু। নির্বাক হয়ে দেখে চলে তাণ্ডবের উল্লাস, চোখে নামে আশঙ্কার ছায়া। সব হারানোর ভয়ে আচ্ছন্ন সত্তা হাঁটু গেড়ে করজোড়ে ভিক্ষা চায় নিঠুরা দেবীর কাছে। পুরুষ ও প্রকৃতির রসায়নও সেইরকমই অনিশ্চয়তায় ভরপুর। দৈহিক বলে বলীয়ান পুরুষ নারীকে ভাবে অবলা, নিজের হাতের ক্রীড়নক, শরীরখেলার সামগ্রী। আপন অধিকারবলে গ্রাস করতে চায় অসহায়া রমণীকে। সহসা কোনও এক বিশেষ মুহূর্তে সে মায়াবিনী নিজের জাল বিস্তার করে। তার আশ্চর্য ভোজবাজির সামনে দুর্দমনীয় পুরুষ তখন নীরব দর্শকমাত্র। নিঃসহায়, নিঃসম্বল। নতজানু হয়ে দেখে চলে স্বৈরিণীর মায়ামুকুরে নিজ প্রতিবিম্ব। সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রবহমান এ পরম্পরা... ‘সেই ট্র্যাাডিশন সমানে চলিতেছে’।
নিঃসহায় আমিও। নতজানু নই অবশ্য, আপন নারীর বাহুপাশে আবদ্ধ। নিস্পন্দ শুয়ে আছি ওর দেহের উত্তাপ গায়ে মেখে, কোমল স্তনের উষ্ণ স্পর্শে, লুটিয়ে পড়া বিস্রস্ত চুলের বেড়াজালে। শুধু বুকের ভিতর মাদলের আদিম শব্দ একটানা বেজে চলেছে। আপাতদুর্বোধ্য সে শব্দের ভাষা জানি আমি। আর জানে ও। এ ভাষার পাঠ নেই কোনও বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে, কোনও শিক্ষাপর্ষদ নিজেদের পাঠ্যক্রমে এ ভাষা অনুমোদন করেন না। তবুও আমরা তা শিখি, শিখে যাই... প্রকৃতির পাঠশালাতে। এ ভাষার নাম ঈর্ষা। বিস্তারিত অর্থে যৌনঈর্ষা। নারীর স্বেচ্ছাচারে ক্ষতবিক্ষত পুরুষের সাধ্য কি সে ভাষা ভুলে যাওয়ার!
...
‘কাঁহা খো গ্যয়ে জনাব?’
জলতরঙ্গের আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে। স্মৃতিরা একে একে ভিড় করে আসছিল... কলকাতার বাড়িতে স্নানঘরের নির্জনতা, অনুষ্ঠানবাড়ির একান্ত নিভৃতে পাওয়া বিকেলের অংশবিশেষ, চিলেকোঠার প্রায়ান্ধকারে স্কাইপ চ্যাট। কি বিচিত্র এই জীবন, কি বর্ণময় তার গতিপ্রকৃতি! মূর্খের মত কল্পনার জাল বুনে গিয়েছি একের পর এক, ঘুণাক্ষরেও যদি জানতে পারতাম বাস্তবে কি ঘটছে, ঘটতে চলেছে...
‘তুই চেয়েছিলি? না ও নিজেই...’
বাক্যটা অসমাপ্ত থেকে যায়, ইঙ্গিতটা নয়। আবারও তীব্র চোখে দেখছে আমায়। যেন বোঝার চেষ্টা কেন আমার এই জিজ্ঞাসা।
‘হোয়াই আর ইউ আস্কিং দিস?’
‘মানে কিছু না, এমনিই...’, আমতা আমতা করতে থাকি। নিজের কাছেই যে স্পষ্ট নয় প্রশ্নটা!
‘হাউ ডাজ ইট ম্যাটার টু ইউ?’
মনের গভীরে পুনরায় ডুব দিতে হয়। না, আত্মসমীক্ষার জন্য নয় একেবারেই। জুতসই কোনও জবাবের সন্ধানে।
‘আসলে ভেবেছিলাম ফিরে এসে মলম লাগিয়ে দেব, তা সে সুযোগ আর হল কই’
স্ত্রীজাতিকে বশে আনার এই এক মোক্ষম অস্ত্র। আত্মসমর্পণ করো, সাথে কিছুটা স্তাবকতা। বুঝতে সে সবই পারবে, আবার সব বুঝে নির্লজ্জ তোষামোদে গলেও যাবে ঠিক। পদ্ধতিটা অবশ্য ন্যায়সঙ্গত নয়, তা প্রেমে আর রণে সেসব কে কবে মেনেছে?
যথারীতি কাজ হল। উদ্ধত ভাব প্রশমিত, আয়ত চোখের তারায় কৌতুকের আভাস। যেন জরিপ করতে চাইছে পুরুষের আর্তির গভীরতা।
‘ওওও, অন্তুবাবুর রাগ হয়েছে অন্যকে দিয়ে কাজটা করিয়েছি বলে?’
‘রাগ কেন হবে, তবে এটা এক্সপেক্ট করিনি”, এবারে আমি অকপট’
‘কি এক্সপেক্ট করিসনি? পরপুরুষকে নিজের বুকে হাত দিতে দেব?’
‘ঠিক তা নয়, তবে তোর যা ইমেজ...’, চোখ বড় বড় করছে দেখে পাদপূরণে ইচ্ছাকৃত খোঁচা দিই সামান্য, ‘হাজার হোক সতীরানী বলে কথা!’
একটু থমকাল। ‘সতীরানী’ সম্বোধনের চিরকালীন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নেই, দূরমনস্ক চোখে কি যেন ভাবছে। ব্যাপারটা কি? রহস্যময়ী যে ক্রমশ আরও রহস্যের আবর্তে নিয়ে যাচ্ছে! নাঃ, এই উৎকণ্ঠা আর নেওয়া যায় না। উত্তরের আশায় অল্প ফোলা বাম স্তনের ওপর মৃদু চাপ দিই। আঙুলে লাগে কি এক অজানা উষ্ণতার ছোঁয়া।
‘মে বি নট এনিমোর’, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে ওর কণ্ঠস্বর।
‘মানে?’
‘আই থিংক ইউ মে নাউ স্টপ কলিং মি দ্যাট’
‘কল ইউ হোয়াট, সতীরানী?’, নীরবে ঘাড়ের ঈষৎ সঞ্চালনে বুঝিয়ে দেয় সম্মতি। ওর দৃষ্টি এখনও নিবদ্ধ দূরে কোথাও।
এ যে ক্রমাগত বিষয়টা জটিল করে তুলছে! আর তো পারা যায় না, একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। বোঝাপড়ার অভিপ্রায়ে পাশ ফিরে শুই। আমার নিঃশ্বাস এখন সরাসরি ওর গালের লালচে আভায়। সদ্যস্নাত পবিত্র মুখটাতে কি এক দ্বন্দ্ব অবিরাম খেলা করে বেড়ায়। চোখের কোণে সংশয়ের পাণ্ডুরতা। বাঙ্ময় হয়ে উঠতে চাওয়া ঠোঁটগুলো তিরতির কাঁপছে। অবাধ্য চুলের ঊর্ণনাভে ঢেকে থাকা এই কুহকিনীর আকর্ষণ আজও ফিকে হল না এতটুকু। নিষ্পলক চেয়ে থাকি। বুকের ভিতর থেকে একদলা আবেগ এসে ধাক্কা মারে কণ্ঠনালীতে। গলার কাছটা শুকিয়ে গেছে, একটু জল খেতে পারলে ভাল হত। অদম্য পিপাসার বশেই কিনা কে জানে, ওর পূর্ণযুবতী স্তনের ওপর আরও দৃঢ় হয় আমার মুঠি। যেন প্রাণপণে ঘোষণা করতে চাইছে নিজ অধিকার। কি চায় মন? খানিক আগেই যাকে অন্য পুরুষ হয়ে রমণ করেছি উন্মাদের মত, তার শরীরে বিজাতীয় স্পর্শের সম্ভাবনায় আপাদমস্তক অস্থির হয়ে উঠছে কেন? ঈর্ষায় ছটফটিয়ে ওঠে হৃদয়, চেনা নারীদেহের উপত্যকায় পুনর্বার আক্রমণের ইচ্ছে চাগাড় দেয় ভিতর থেকে। কিন্তু... উপায় নেই যে!
অস্থিরতাটা বোধহয় সঞ্চারিত হয়েছে এক মন থেকে আরেক মনে। দৃষ্টি না ফিরিয়েই আবার ও কৈফিয়তের পাতা ওল্টালো।
‘তুই চাইতিস তো আমি অন্যদের সাথে... দ্যাট আই ইন্ট্যার্যাক্ট উইদ আদার মেন মোর ওপেনলি। ওয়েল পারহ্যাপ্স আই হ্যাভ ক্রস্ড দ্য ব্যারিয়ার বাই আ ফিউ মাইলস’
হেঁয়ালির আবরণ ছাড়িয়ে একটা আপাত অসম্ভব সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে নাকি? অশান্ত হয়ে উঠতে থাকা মনকে কোনওমতে সামলাই, মুখের রেখায় অবশ্য তার প্রভাব পড়ে না তেমন। নির্নিমেষ চাহনিতে জিজ্ঞাসা ফুটে থাকে। ও-ও বুঝতে পেরেছে সেটা। আগের কথার খেই হারিয়ে কিঞ্চিৎ অসংলগ্নভাবেই বলে চলে...
(পরবর্তী পোস্টে বাকি অংশ...)