23-02-2021, 08:21 PM
।। ১১ ।।
জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন সামান্য একটা ভুলের জন্য চারপাশটা ওলটপালট হয়ে যায়। ছোট্ট একটা কথা, চোখের সামান্য ইশারা, অবহেলায় মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া- বদলে দিতে পারে অনেক কিছু। ক্ষণিকের প্রভাব কি সুদূরপ্রসারী! অথচ ঘটনাটা যখন ঘটছে ঠিক সেইসময় কিন্তু আঁচও পাওয়া যায় না তার। বোঝা যায় না কি হতে চলেছে এর ফলশ্রুতি। আর পাঁচটা সাধারণ মুহূর্ত থেকে তাকে আলাদা করে চিনে নেওয়া দায়। ঘটমান বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে এক পা-এক পা করে যেতে যেতে যখন চারদিকের চেনা পৃথিবীটা ক্রমশ পালটে যেতে থাকে, পরিকল্পিত ছকের বাইরে অজানা সরণী বেয়ে হাঁটতে শুরু করে জীবন, মনকে তখন প্রশ্ন করি আমরা, 'কি করে এমন হল?' সদুত্তর পেতে মন অনুসন্ধান শুরু করে, ক্ষিপ্র গোয়েন্দার মত অতীতের সমস্ত ফাইল ধুলো ঝেড়ে বার করে খুঁজতে থাকে আতিপাঁতি। অণুবীক্ষণের নীচে ফেলে যাচিয়ে নেয় প্রতিটি খণ্ডমুহূর্ত। কম্পিউটার সায়েন্সের পরিভাষাতে যা 'ব্যাকট্র্যাকিং অ্যালগরিদম', কার্যকারণ পরম্পরার সেই সূত্র ধরে অবশেষে সে উপনীত হয় কঠোর নির্মম সত্যে। বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরে সেই মুহূর্ত, যেখান থেকে জীবন বেঁকে গিয়েছিল কোনও অচেনা মোড়ে। বইতে শুরু করেছিল অন্য এক খাতে যার ঢেউগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে পরিচিত জীবনের নিশ্চিন্ত নিরাপদ গণ্ডির থেকে দূরে, আরও দূরে। দুর্নিবার স্রোতের মুখে ভেসে যাওয়ার মুহূর্তে আমরা অক্ষম প্রতিরোধের চেষ্টা করি খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। হায়, সময় যে বহতা নদী! জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি একমুখী তার যাত্রা। উৎস থেকে মোহনার দিকে সে চঞ্চলা রমণী 'নেচে চলে যেন নটিনী', কোথায় কোন অববাহিকায় কে অবহেলায় পড়ে রইল দেখার তার ফুরসত কই?
আর যার চোখের সামনে একটু একটু করে ঘটে এই অনিবার্য পরিবর্তন, কি হয় তার পরিণতি? নিষ্ফলা বালির বাঁধে যখন বাধা মানে না নির্দয়া স্রোতস্বিনী, তখন? শূন্য দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিই বা করার থাকে? সময়ের চাকা, সে তো উলটোদিকে ঘুরবে না কোনওদিন। টাইম মেশিনের অলীক প্রকৌশল বিদ্রূপভরে মুখ ভ্যাংচায় কল্পবিজ্ঞানের পাতা থেকে। কে সেই অপরাধী যার দোষে এমনটা ঘটল? মনকে চোখ ঠারা চলে না, সে জানে কার দোষে। হৃদয়ের আবছা আয়নাতে নিজেরই প্রতিফলনের দিকে চেয়ে থাকে মূক দৃষ্টি।
চোখের সমান্তরালে, ফুটকয়েক উঁচুতে স্থাবর সিলিঙ। খাট থেকে বোবা চোখ মেলে তাকিয়ে আছি সেদিকে। কয়েক ঘণ্টা আগে ঐ সিলিঙই নীরব সাক্ষী ছিল আমাদের উদ্দাম ভালবাসাবাসির। এখন সেখানে ক্যালেইডোস্কোপের খেলা। মেঘের আড়াল থেকে একটু একটু করে পরিস্ফুট হওয়া সকালের আলো জানলার গ্রিলের মধ্যে দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে কারওর অনুমতির তোয়াক্কা না করে। পেশাদার জাদুকরের মত নিজের ভোজবাজি দেখাতে ব্যস্ত, তার রঙ্গমঞ্চ ঘরের দেওয়াল বা মাথার ওপরের সিলিঙ। সিলিঙটাও বোধহয় স্বস্তি পেয়েছে এমন নির্দোষ সভ্যভব্য ‘আট থেকে আশি’-মার্কা চালচিত্র দেখে। স্বাভাবিক,ভোর ইস্তক একঘেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ছবি চোখের সামনে চলছে, কাঁহাতক আর ভাল লাগে! স্বাদবদলের প্রয়োজন সবারই আছে, সে মানুষ হোক বা ঘরের সিলিঙ।
খাটে একা একা শুয়ে এসবই ভেবে চলেছি। অবান্তর, আবোল-তাবোল। কিছুই নয়, মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর ব্যর্থ চেষ্টামাত্র। বিক্ষুব্ধ অবচেতন তোলপাড় হচ্ছে সেই মুহূর্তটার কথা ভেবে। যদি ফিরে যাওয়া যেত আবার, যদি ফিরিয়ে নেওয়া যেত প্রশ্নটা? যে প্রশ্ন প্রেমিকাকে করা অনুচিত, প্রেমশাস্ত্রের পাঠে যে প্রশ্ন ঘোরতর নিষিদ্ধ। আর... কে না জানে নিষিদ্ধের হাতছানি কি প্রবল। সে অদম্য আকর্ষণ উপেক্ষা করব এতটা বীতস্পৃহ আমি নই। কিন্তু এতবড় নির্বোধও তো নই যে অমন অন্তরঙ্গ সময়ে ওরকম একটা প্রশ্ন...
অনবধানে জ্যামুক্ত তীর ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ধনুর্ধরের থাকে না, তার কাজ তখন কম্পিতবক্ষে আগুয়ান শরকে লক্ষ্য করা। এ পর্যন্ত সকলেই জানে। প্রবাদবাক্য সাধারণত মিথ্যে হয় না। সাধারণত... কিন্তু তীর যদি লক্ষ্যভেদ করে? যদি অজ্ঞাত কারণে শরাহত হয় কোনও অজানা শত্রু যার অস্তিত্বই ছিল কার্মুকের অগোচর? ঠিক কেমন হয় তখন তার মনের অবস্থা? বিস্মিত? পুলকিত? চমৎকৃত? নাকি এ সবই মিলেমিশে থাকে অথবা... অথবা, এর বাইরে ব্যাখ্যাতীত কোনও অনুভূতি? যেমনটা আমার হয়েছিল স্নানঘরে...
...
কি করে ফেললাম? কেন জিজ্ঞেস করতে গেলাম এটা? অতি বড় মূর্খও এমন ভুল করবে না আর আমি কি না... ও ঠায় চেয়ে আছে আমার চোখের দিকে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে মিশে অপার বিস্ময়, তার সাথে নীরব ভর্ৎসনা। এখনও আমাদের দেহ পরস্পরে সম্পৃক্ত, ঝিরিঝিরি বারিধারা শাওয়ার থেকে নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে একবিন্দুতে মিশে থাকা আলাদা দুটো শরীরকে। ওর নরম জমিতে দৃঢ়প্রোথিত হয়ে আমার উত্তুঙ্গ পৌরুষ, ছন্দোবদ্ধ মিলনের গতিতে যান্ত্রিকভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছি দুজনেই। দাঁড়িয়ে থাকার দরুণ সম্ভব ছিল না স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মিলিত হওয়া, ওর কোমল তনু তাই ঢলে পড়েছে স্নানঘরের বাষ্পসিক্ত দেওয়ালে, সুগঠিত বাম জঙ্ঘা পরম আদরে বেষ্টন করে দয়িতের কোমর। ঈষৎ তির্যক দেহভঙ্গির কারণে উন্নত স্তনেরা কি মোহময়ী এক বিভঙ্গে আমার বক্ষলগ্না। কবোষ্ণ জলের মনোরম স্পর্শে জাগ্রত দুই বৃন্ত বারংবার আছড়ে পড়ছে প্রেমিকের বলিষ্ঠ বুকে। সুডৌল দুই হাত পেলব আলিঙ্গনে আলতো করে জড়িয়ে। নমনীয়, অথচ দৃঢ় সে আলিঙ্গন। পুরুষকে যা নিশ্চিতভাবে বেঁধে ফেলে নারীর চিরন্তন বাহুপাশে। রতিক্রীড়ার তালে তালে সঙ্গতি রেখে সুপুষ্ট নিতম্ব আঘাত হানছে ওয়ালপেপারের গায়ে, বিচিত্র শব্দ তুলে। সবই মুহূর্ত কয়েক আগের মত, শুধু... আবেশে বোজা চোখের পাতারা এখন উন্মীলিত। সপ্রশ্ন দৃষ্টি সরাসরি নিবদ্ধ আমার দৃষ্টিতে। মর্মভেদী চাহনি যেন আমার চামড়া-অস্থি-স্নায়ু বিদীর্ণ করে দেখে নিচ্ছে মনের অতল অবধি। একটাও কথা বলেনি ও, কিন্তু নিরুচ্চার জিজ্ঞাসায় প্রতিধ্বনিত বুকের ভিতরটা। ঐ চোখের চাওয়ার সামনে বেশিক্ষণ প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই। অথচ... কি কৈফিয়ত দেব এই অমার্জনীয় অপরাধের?
"জাস্ট কিডিং", নিজের মুখ থেকে বেরোনো কথাগুলো নিজেরই কানে কি ভীষণ হাস্যকর শোনালো! ও কিছু বলছে না। তপ্ত শরীর এখনও নিয়মিত গতিতে পৌরুষের লাঞ্ছনা ধারণে ব্যস্ত, চোখজোড়া ঠায় চেয়ে আমার মুখের দিকে। আর ফেরবার পথ নেই, যা থাকে কপালে। মিথ্যেটাকে যে কোনও মূল্যে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে মরিয়া আমি, ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করি।
"তুই সত্যিই সিরিয়াসলি নিলি কথাটা? পারিসও বটে"
পরিস্থিতি লঘু করার এর থেকে ভাল উপায় মাথায় আসছে না। এই ঠুনকো আশ্বাসে কাজ হবে কোনও? দুরুদুরু বুকে প্রতীক্ষা করি, আমার কাঠিন্য তখনও ওকে অখণ্ড মনযোগে গেঁথে চলেছে। একটা হাত আপনা থেকে উঠে যায় পুরুষ্টু বোঁটায়, উদ্বেল বৃন্তকে পীড়ন করে। কোনও প্রত্যুত্তর আসে না ওর থেকে, আয়ত চোখদু'টি আবারও মুদে যায়, টানা টানা আঁখিপল্লবে ফের রতিসুখের প্রতিভাস। অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে আমার। যাক, এখনকার মত ফাঁড়াটা কেটেছে। বেমক্কা প্রশ্নটার কথা ভেবে এবার নিজের ওপরে রাগ হচ্ছে। এসবই গত এক সপ্তাহব্যাপী অদ্ভুতুড়ে চিন্তাগুলোর বহিঃপ্রকাশ। কি যে ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসেছে! আগের রবিবার দুপুরে আচমকা ভেসে ওঠা দৃশ্যকল্প থেকে শুরু, তারপরের কদিন নিয়মিতভাবে সেই চিন্তাকে প্রশ্রয় দিয়ে আজ এই দুরবস্থা। যতবার মনকে শাসন করতে গিয়েছি ফল হয়েছে উলটো। অসুস্থ ভাবনারা আরও বেশি করে ভিড় করেছে মনের ভিতর, চেতন-অবচেতনকে গ্রাস করেছে ধীরে ধীরে। বিশেষত সেদিন রাতে ওর আধখোলা বুকের চুড়োয় সঞ্জীবের দশনচিহ্ন দেখার পর... প্রতিবর্তেই বুঝি দৃষ্টি চলে গেল সেই বিশেষ স্থানটিতে। এতক্ষণে জলধারায় ভিজতে ভিজতে দু'জনেরই শরীরময় স্বচ্ছ আস্তরণ, ভাল ঠাহর হচ্ছে না। তাও এত কাছ থেকে তো ভুল হওয়ার কথা নয়। কোথায় সে দংশনের দাগ? নিষ্কলঙ্ক বিপুল বক্ষদেশ লুটিয়ে পড়ছে আমার বুকের ঘন জঙ্গলে। যেন জোড়া দুই পায়রা ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে থেকে থেকে। ওখানেই সঞ্জীব... আঃ আবারও সেই! বিকৃত চিন্তারা ফিরে আসছে, মস্তিষ্কের দখলদারি ধীরনিশ্চিত গতিতে তাদের অধিকারে। মাথার ভিতর অসংখ্য পোকা কিলবিলিয়ে উঠছে, কুরে কুরে খাচ্ছে আমার যুক্তি-বুদ্ধি-বোধ। রমণের মাঝেই চোখ বন্ধ করে ফেলি, ও যেন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে আমার মনের অবস্থা। বন্ধ চোখের পাতায় আবার সেই দৃশ্যপট, সঞ্জীবের সাথে ও... আর ভাবতে পারি না। কে ঐ প্রেমিক, যে ওকে নির্দয়ভাবে আদর করে চলেছে? ওটা কি সঞ্জীব, না আমি? এখন কার সাথে ও কামকেলিতে মত্ত জলের অবিরাম বর্ষণের মাঝে? আমি, নাকি... ? মস্তিষ্কময় বিস্ফোরণ হতে থাকে ছোট-বড়, আর আমার বোধবুদ্ধি ঘুলিয়ে যায়। রমণের গতিবেগ বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমশ। ওর আতপ্ত যোনিপাত্রে আমূল বিদ্ধ লৌহশলাকা বাড়তে থাকে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে-আয়তনে, বাড়তে থাকে তার তাপমাত্রা। লোহিত-তপ্ত... শ্বেততপ্ত। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য পুরুষ উন্মাদের মত ছিন্নভিন্ন করে চলে নারীর কোমল অভ্যন্তর। ভীমগতিতে সে মন্থন করে আমার একান্ত আপন প্রেমিকাকে... কে ও? আমি? সঞ্জীব? মনের মধ্যে বিদ্যুচ্চমকের মত উদয় হয় মারাত্মক এক প্রশ্নেরঃ তবে কি আমিই এখন সঞ্জীব? সহস্র অচেনা কণ্ঠ সম্মিলিত সাড়া দেয়- "হ্যাঁ"। কে ওকে এমন তীব্রভাবে নিষ্পেষণ করছে? আবারও সমস্বরে জবাব আসে- "সঞ্জীব"। হৃদয়ের অচেনা গলিঘুঁজিতে অনুরণিত হতে থাকে সে উত্তর। হাজার ডেসিবেলের আর্তনাদে কানে তালা লেগে যায়। সহসা এই বধিরতায় আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে আমার। উদ্ভ্রান্তের মত চোখ খুলি। দেখি সেই আগেরই মত রমণের ছন্দে স্পন্দিত হচ্ছে প্রিয়তমা, তালে তালে দুলে উঠছে ওর নগ্নদেহ। অবিশ্রান্ত বারিধারায়, প্রিয়মিলনের তৃপ্তিতে, যৌনসুখের বিহ্বলতায় সারা অঙ্গে তার রূপের মাধুরী ছড়িয়ে পড়েছে। ধন্দে পড়ে যাই, এ কি কোনও শাপগ্রস্তা কিন্নরী, না আমারই প্রেয়সী? আমার, নাকি... না আমার নয়, এই মুহূর্তে স্নানঘরের একান্ত ঘেরাটোপে কোথাও আমার অস্তিত্ব নেই। নামহীন এক বোধ জন্ম নেয় মনের গহিনে। এখন আমি সঞ্জীব। যার ওটা নাকি... "বিগার দ্যান ইয়োরস", মধুক্ষরা সলজ্জ স্বর কানের মধ্যে বেজে ওঠে। তবে তো এই সামান্য রতিক্রীড়ায় কাজ হবে না! যে পৌরুষের দর্প যত বেশি তার আস্ফালনও ততোধিক হওয়া উচিত। আজই ওকে হাতেনাতে সে প্রমাণ দেব।
(পরবর্তী পোস্টে বাকি অংশ...)