19-02-2021, 05:26 PM
বাড়িতে ঢুকেই আজমল চাচা হই হই করে দৌরে এলেন । উনি কোন ভাবে খবর পেয়েছিলেন আমি করিম এর বাড়ি গিয়েছি । আমাকে প্রায় ধমকে দিলেন , অবশ্য যতটা সম্ভব সম্মান বজায় রেখে । ঝুমাও ছিলো সামনেই তবে কিছু বলছিলো না । আজমল চাচার রাগ কিছুটা কমে এলে উনি আমার নাকের ব্যান্ডেজ দেখতে পেলেন ।সাথে সাথেই আবার ওনার হাহাকার শুরু হয়ে গেলো । আমাকে জিজ্ঞাস করলেন কি হয়েছিল । আমি অবশ্য মিথ্যা বললাম , বললাম পরে গেছি আর তাতেই ব্যাথা পেয়েছি । উনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না তবে আমাকে আর ঘাঁটালেন ও না । নানা ভাবে আমাকে বঝানোর চেষ্টা করলেন আমি যেন করিম আর নাল্টুর সাথে না মিশি । ওরা যে করেই হোক আমাকে খতম করে দিয়ে মিয়াঁ বাড়ির অস্তিত্ব শেষ করে দিতে চায় ।
বসে বসে অনেক্ষন যাবত আমি উনার কথা শুনলাম , তারপর ধিরে ধিরে উঠে এলাম দোতলায় । ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম , মনে মনে ভাবলাম নাল্টু যা আজ করেছে তা আরও ত্রিশ বছর আগে করলে ভালো হতো , অন্তত রাবুর জন্য ভালো হতো । নাল্টু ভালো ছেলে ওর সাথে রাবুর কিছু হলে অন্তত ঝুমা আজ এই অবস্থায় থাকতো না । ঝুমার এই অবস্থার অন্য আমি পরক্ষ ভাবে হলেও কিছুটা দাই ।
একটু পর পায়ের শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকালাম , দেখি ঝুমা এসে দারিয়েছে , হাতে আমার জন্য খাবার । “ ছোট মিয়াঁ উঠেন খাইয়া নেন” টেবিলে খাবার দিতে দিতে বলল ঝুমা ।
“ আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না ঝুমা , তুমি খাবার নিয়ে যাও “ আমি শুয়ে শুয়েই বললাম ।
“ ক্যান রাইতের খাওন কি খাইয়া আইসেন ?” ঝুমা এবার প্রস্ন করলো , আমি এখনো টেবিলে খাবার দেয়ার টুং টাং শব্দ শুনতে পাচ্ছি । প্রচণ্ড রাগ হলো আমার
“ আমি বললাম না খাবো না , যাও এখন “ একটু ঝাঁজের সাথে বললাম । এবার কাজ হলো ধিরে ধিরে আর একটি কোথাও না বলে চলে গেলো ঝুমা ।
সারারাত ঘুম হলো না আমার , বার বার মনে একটি কথাই আসতে লাগলো , রাবুর সাথে আমি যা করেছি ঝুমার সাথেও ঠিক তাই করছি । সিদ্ধান্ত নিলাম সকালে উঠেই চলে যাবো । এখানে থাকা আমার আর হবে না , যে নাড়ি একবার কাটা পরে গেছে তা আর জোড়া লাগার নয়।
ভোরের আলো ফুটতেই আমি নিজের জিসিস পত্র গোছানো শুরু করে দিলাম । সব কিছু গোছানো হয়ে গেলে আমি বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ঠিক মতো সকাল হওয়ার জন্য । অনেক আগেই ঝুমা আর আজমল চাচা উঠে গেছে । ঠিক ভোর সাতটায় আমি ঝুমা কে ডাকলাম । ঝুমা আমার ঘরে ঢুকেই থমকে গেলো , তবে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো ।
“ আমারে ডাকতেন আমি সব কিছু গুছাইয়া দিতাম “ শাড়ির আচল দিয়ে নিজের হাত মুছতে মুছতে বলল ঝুমা ।
ভালো করে আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম , নাহ কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না , একেবারে নির্লিপ্ত , ঠিক ওর মায়ের মতো । বিদায় নেয়ার সময় ঠিক এমন নির্লিপ্ত আচরন করেছিলো আমার সাথে রাবু । ঝুমা এদিক দিয়ে ঠিক ওর মায়ের চরিত্র পেয়েছে ।
“ এদিকে এসো ঝুমা “ আমি ওকে খানে ডাকলাম , ধিরে ধিরে যখন ঝুমা আমার কাছে এসে দাঁড়ালো তখন হাতের মুঠি থেকে আমি ওকে আগের দিন কেনা ট্যাবলেট টি দিয়ে বললাম “ এটা খেয়ে নাও , তাহলে তোমার কোন সমস্যা হবে না “ । একথা বলে আমি নিজেকে তৈরি করে নিলাম , নিশ্চয়ই ঝুমা এখন রেগে যাবে , অথবা আমাকে খারাপ কিছু বলবে । কিন্তু সেরকম কিছু করলো না । বরং আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত থেকে প্যাকেট টি নিলো , তারপর আমার সামনেই সেটা খুলে মুখে পুরে আমার জন্য রাখা পানির জগ থেকে পানি দিয়ে ঔষধ টি গলধকরন করলো । পুরোটা ব্যাপার আমাকে দেখিয়ে করেছে ঝুমা , আর পুরোটা সময় জুড়ে ওর ঠোঁটে একটা মুচকি হাঁসি লেগে ছিলো । সেই হাসিতে আমি তাচ্ছিল্য দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট ।
“ আমি চলে জাচ্ছি ঝুমা , আজকেই “ ঝুমার ঔষধ খাওয়া শেষে আমি বললাম ।
“ হেইটা তো দেখতেই পাইতাসি , আর একটু পরে যান , নাস্তা এহনো বানাই নাই । আর এহন যাওনের লইগা বাস ও পাইবেন না , এক কাম করেন বারিডা ঘুইরা একবার দেইখা যান , আবার কবে আহেন হের কোন ঠিক আছে “
“ নাস্তা করবো না ঝুমা , আমার আর ভালো লাগছে না এখানে , ইচ্ছা ছিলো তোমার জন্য কিছু করার কিন্তু সময় হয়ে উঠলো না , এই নাও এইটা রাখো , তোমার ছেলের জন্য দিলাম “ এই বলে আমি ঝুমা কে হাজার পাঁচেক টাকা বের করে দিলাম । সাথে আরও বললাম “ মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেবো , তোমার ছেলেকে ভালো কলেজে দিয়ো আর শহরে নিয়েগিয়ে ভালো ডাক্তার দেখিয়ো “
ঝুমা হেঁসে ফেলল , তারপর বলল “ আপনের টেকা আমি নিমু না ছোট মিয়াঁ , ওইটা রাখেন আপনে যে আমাগো লইগা ভাবসেন এইটাই অনেক “
টাকাটা আমি পকেতে রেখে দিলাম , আমি জানি ঝুমা কিছুতেই টাকা নেবে না । ওকে এও বোঝানো সম্ভব নয় যে আমি অনেক আগে থেকেই ওর জন্য কিছু একটা করার চিন্তা করেছিলাম ।
চলে আসার সময় মনে হলো আজমল চাচা আমার চলে জাওয়াতে খুসি । আমাকে নানা রকম বুঝ দেয়ার চেষ্টা করলো । এও বলল যে এখানে আমার এখন না থাকাই ভালো । উনি যে করেই হোক মিয়াঁ বাড়ির হারানো দিন ফিরিয়ে আনবে । তখন মাঝে মাঝে আমি যেন এসে ঘুরে যাই । আজমল চাচা আর জালাল মিলে আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো । এমনকি আজমল চাচা আমার সাথে বড় রাস্তা পর্যন্ত আসতে চাইলো । কিন্তু আমি নিষেধ করলাম , শেষে আসার সময় জালাল কে বলে এলাম , একবার যেন করিমের সাথে দেখা করে আগামিকাল । আমি ঢাকা গিয়ে ওকে কল করে বলে দেবো সোনিয়া যেন জালালের চিকিৎসা করে । গ্রামে থেকে আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা করিম কে জানাতে চাইলাম না ।
আবার সেই মোটর বসানো রিক্সা আর ভাঙ্গা রাস্তা , তারপর সেই মামা ভাগিনার দোকানে বসে বাসের জন্য অপেক্ষা । এবার অবশ্য বিশেষ যত্ন পেলাম । আমি চলে জাচ্ছি শুনে কিছু লোক ও জড় হলো । প্রাত্য মিনিট পনেরো অপেক্ষার পর একটি বাস এসে থামল । সবাই মিলে আমাকে বাসে তুলে দিলো । একটি পুরো সিট বরাদ্দ করা হলো আমার জন্য , কাউকে পাশে বসতে দেয়া হলো না । এমনকি হেল্পার কে ভালো করে বলে দেয়া হলো , নামানর সময় যেন ভালো করে নামিয়ে দেয় আমাকে । এই লোক গুলি আমাকে যে ধরনের খাতির যত্ন করছে তা আমার প্রাপ্য নয় , তাই এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলাম ।
নড়বরে দরজায় হেল্পারের দুইটি থাবা মারার ইংগিত পেয়ে ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিলো । ধিরে ধিরে পেছনে পরে যাচ্ছে সফিপুর , সাথে সাথে কিছু মানুষ আর একটি পুরনো বাড়ি । যাদের কেউ আর আমার আপন নয় , যাদের সাথে আমার এতটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে যে হাত বাড়িয়ে নাগাল পাওয়া আর কোনদিন সম্ভব নয় । আর অসম্ভব কিছুর পেছনে ছোটা সুধু দুঃখই বাড়ায় ।
ঢাকা এসে একটা হোটেলে উঠলাম আমার টিকিত আরও প্রায় তিনদিন পর । টিকিট এর তারিখ পরিবর্তন করতে গিয়ে জানতে পারলাম সেটা সম্ভব নয় । এই তিনদিন আমাকে ঢাকাতেই থাকতে হবে । কোনরকম তিনদিন পার করলাম , ভেবে ছিলাম পাঁচ তারা হোটেলের দামি মদ , রমরমা জুয়ার আসর আর ঢাকার টপ ক্লাস বেশ্যা আমাকে সফিপুর নামক জায়গা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে । কিন্তু আমার সেই চিন্তা চুরান্ত ভাবে ভুল প্রমানিত হয়েছিলো । বার বার মনে হচ্ছিলো আমি কিছু একটা পেছনে ফেলে জাচ্ছি । ত্রিশ বছর আগেও এমনটা হয়ে ছিলো কিন্তু এবারের টা আরও বেশি শক্তিশালী ।
কাজ আর কাজ , প্রচুর কাজ করেছি গত তিন মাস , আমাকে যারা ভালো করে চেনে তারা সবাই অবাক হয়ে গেছে আমাকে দেখে । বাঙালী কেউ কেউ তো মজা করে বলেই ফেলে দেশ থেকে আমার কাঁধে চড়ে একটা কর্মঠ ভুত এসেছে , যে আমাকে দিয়ে এতো কাজ করিয়ে নিচ্ছে । জীবনে আমি এতো কাজ করিনি , তবে আমার ভালোই লাগে কাজ করতে এখন ।
দেশ থেকে আসার পর বান্ধবি ক্যাথরিন এর সাথে সম্পর্ক চুকে গেছে । ওর অভিযোগ আমি আর আগের মতো নেই । এই পশ্চিমা মেয়ে গুলিকে আমার দারুন লাগে , এরা কথা বলতে জানে , কোন কিছু মন মতো না হলেই বলে রাস্তা মাপো । এতে করে মনের মাঝে কোন ক্লেশ থাকে না । অথচ আমাদের বাঙালী মেয়ে গুলি অন্য রকম এরা রহস্য করে , যত দুরেই চলে আসিনা কেন এদের ভোলা যায় না ।
কত সহজেই না ঝুমা আমাকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছিলো , আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে কতই না মহান একটি মেয়ে । কিন্তু সত্যি কি তাই ? একদম না , সারা জীবনের জন্য আমাকে বন্দি করে রেখে দিয়েছে , ঠিক ওর মায়ের মতো । একটা অদৃশ্য অপরাধ বোধ এর সেঁকল আমার পায়ে বেধে দিয়েছে । যতক্ষণ কাজের মাঝে থাকি ততক্ষন নির্ভেজাল থাকি জখনি একটু অবসর আসে , সাথে সাথে ঝুমাও চলে আসে । দাঁত বের করে হাসে , বলে দেখছেন ছোট মিয়াঁ কিমুন শাস্তি দিতাসি আপনেরে ।
আমি এখনো ঝুমার প্রতি আমার এই টানের কারন খুঁজে পাই না । এমন নয় যে ঝুমা দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে । এও নয় ঝুমাকে আমি বিয়ে করতে চাই । তাহলে কেন ঐ মেয়েটাকে আমার সারাক্ষন মনে পরে কে জানে । হ্যাঁ মেয়েটা দুঃখী এর জন্য প্রতি মাসে আমি টাকা পাঠাই । তারপরেও মনে শান্তি পাচ্ছি না । সারাক্ষন মনে হয় মেয়েটা আমাকে ডাকছে , আর সেই ডাকে আমার সারা দেয়া উচিৎ ।
তবে ঝুমা আমার একটা উপকার করেছে , আমার মেয়ের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করেছে । ঝুমার একটা কথা আমাকে নিজের মেয়ের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করতে বাধ্য করেছে । একদিন ঝুমাকে অনিলার কথা বলতে ও বলেছিলো
“ সব বাপ রাই কি এমুন হয় , জন্ম দিয়া ভুইলা যায় “ আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ঝুমার কথায় , ওর তো বাবা মারা গিয়েছে , তার প্রতি তো ঝুমার এমন অভিমান থাকার কথা নয় । জিজ্ঞাস করেছিলাম “ তোমার বাবা তো আর আমার মতো না , নি তো মারা গেছে না হয় নিশ্চয়ই তোমার খোঁজ নিতো “
আমার এই কথা শুনে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলেছিলো ঝুমা তারপর বলেছিলো “ আমার একটা কথা সবসময় মনে হয় জানেন , কাউরে অবশ্য কই না , আপনেরে কইতাসি , আমার মনে হয় আমার বাপ মড়ে নাই , হেয় দূরে কোন খানে গেসে গা “
যদিও আজমল চাচা আমাকে বলেছে ঝুমার বাবা মারা গেছে । কিন্তু ঝুমার কথা শুনে মনে হয়েছিলো ও হেয়ালি করে কথা গুলি বলেনি । কথা গুলি ও মন থেকে বিশ্বাস করে । কেন বিশ্বাস করে সেটা অবশ্য বুঝতে পারিনি ।
তবে ঝুমার ঐ বেদনার্ত মুখ যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন আমার অনিলার কথা মনে পরে , মনে হয় অনিলাও নিশ্চয়ই আমার উপর অভিমান করে আছে । ঝুমার চেয়ে অনিলার অভিমান আরও বেশি হওয়ার কথা কারন ও জানে ওর বাবা জীবিত আছে । আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম সুধু রাবু আর ঝুমা নয় আমি অনিলার সাথেও একি রকম আচরন করেছি । দূরে চলে যাওয়ায় নিজেকে বোঝা মুক্ত মনে করেছিলাম । তাই ধিরে ধিরে অনিলার সাথে একটা সম্পর্ক পুনরায় তৈরি করে নিয়েছি ।
যত সময় যাচ্ছে আমার অনিলার সম্পর্ক অনেক সহজ হয়ে উঠেছে । অনেক কথা হয় মেয়ে আর আমার মাঝে । মাঝে মাঝে ওর কথায় বুঝতে পারি কতটা অভিমান আমার জন্য ওর মনে তৈরি হয়েছিলো । সফিপুর থেকে চলে আসার পর এই একটা জিনিস ই আমাকে সত্যিকারের আনন্দ দিয়েছে । আর এই অনিলার জন্যই আমাকে আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। মেয়ে আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছে ।
বসে বসে অনেক্ষন যাবত আমি উনার কথা শুনলাম , তারপর ধিরে ধিরে উঠে এলাম দোতলায় । ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম , মনে মনে ভাবলাম নাল্টু যা আজ করেছে তা আরও ত্রিশ বছর আগে করলে ভালো হতো , অন্তত রাবুর জন্য ভালো হতো । নাল্টু ভালো ছেলে ওর সাথে রাবুর কিছু হলে অন্তত ঝুমা আজ এই অবস্থায় থাকতো না । ঝুমার এই অবস্থার অন্য আমি পরক্ষ ভাবে হলেও কিছুটা দাই ।
একটু পর পায়ের শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকালাম , দেখি ঝুমা এসে দারিয়েছে , হাতে আমার জন্য খাবার । “ ছোট মিয়াঁ উঠেন খাইয়া নেন” টেবিলে খাবার দিতে দিতে বলল ঝুমা ।
“ আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না ঝুমা , তুমি খাবার নিয়ে যাও “ আমি শুয়ে শুয়েই বললাম ।
“ ক্যান রাইতের খাওন কি খাইয়া আইসেন ?” ঝুমা এবার প্রস্ন করলো , আমি এখনো টেবিলে খাবার দেয়ার টুং টাং শব্দ শুনতে পাচ্ছি । প্রচণ্ড রাগ হলো আমার
“ আমি বললাম না খাবো না , যাও এখন “ একটু ঝাঁজের সাথে বললাম । এবার কাজ হলো ধিরে ধিরে আর একটি কোথাও না বলে চলে গেলো ঝুমা ।
সারারাত ঘুম হলো না আমার , বার বার মনে একটি কথাই আসতে লাগলো , রাবুর সাথে আমি যা করেছি ঝুমার সাথেও ঠিক তাই করছি । সিদ্ধান্ত নিলাম সকালে উঠেই চলে যাবো । এখানে থাকা আমার আর হবে না , যে নাড়ি একবার কাটা পরে গেছে তা আর জোড়া লাগার নয়।
ভোরের আলো ফুটতেই আমি নিজের জিসিস পত্র গোছানো শুরু করে দিলাম । সব কিছু গোছানো হয়ে গেলে আমি বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ঠিক মতো সকাল হওয়ার জন্য । অনেক আগেই ঝুমা আর আজমল চাচা উঠে গেছে । ঠিক ভোর সাতটায় আমি ঝুমা কে ডাকলাম । ঝুমা আমার ঘরে ঢুকেই থমকে গেলো , তবে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো ।
“ আমারে ডাকতেন আমি সব কিছু গুছাইয়া দিতাম “ শাড়ির আচল দিয়ে নিজের হাত মুছতে মুছতে বলল ঝুমা ।
ভালো করে আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম , নাহ কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না , একেবারে নির্লিপ্ত , ঠিক ওর মায়ের মতো । বিদায় নেয়ার সময় ঠিক এমন নির্লিপ্ত আচরন করেছিলো আমার সাথে রাবু । ঝুমা এদিক দিয়ে ঠিক ওর মায়ের চরিত্র পেয়েছে ।
“ এদিকে এসো ঝুমা “ আমি ওকে খানে ডাকলাম , ধিরে ধিরে যখন ঝুমা আমার কাছে এসে দাঁড়ালো তখন হাতের মুঠি থেকে আমি ওকে আগের দিন কেনা ট্যাবলেট টি দিয়ে বললাম “ এটা খেয়ে নাও , তাহলে তোমার কোন সমস্যা হবে না “ । একথা বলে আমি নিজেকে তৈরি করে নিলাম , নিশ্চয়ই ঝুমা এখন রেগে যাবে , অথবা আমাকে খারাপ কিছু বলবে । কিন্তু সেরকম কিছু করলো না । বরং আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত থেকে প্যাকেট টি নিলো , তারপর আমার সামনেই সেটা খুলে মুখে পুরে আমার জন্য রাখা পানির জগ থেকে পানি দিয়ে ঔষধ টি গলধকরন করলো । পুরোটা ব্যাপার আমাকে দেখিয়ে করেছে ঝুমা , আর পুরোটা সময় জুড়ে ওর ঠোঁটে একটা মুচকি হাঁসি লেগে ছিলো । সেই হাসিতে আমি তাচ্ছিল্য দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট ।
“ আমি চলে জাচ্ছি ঝুমা , আজকেই “ ঝুমার ঔষধ খাওয়া শেষে আমি বললাম ।
“ হেইটা তো দেখতেই পাইতাসি , আর একটু পরে যান , নাস্তা এহনো বানাই নাই । আর এহন যাওনের লইগা বাস ও পাইবেন না , এক কাম করেন বারিডা ঘুইরা একবার দেইখা যান , আবার কবে আহেন হের কোন ঠিক আছে “
“ নাস্তা করবো না ঝুমা , আমার আর ভালো লাগছে না এখানে , ইচ্ছা ছিলো তোমার জন্য কিছু করার কিন্তু সময় হয়ে উঠলো না , এই নাও এইটা রাখো , তোমার ছেলের জন্য দিলাম “ এই বলে আমি ঝুমা কে হাজার পাঁচেক টাকা বের করে দিলাম । সাথে আরও বললাম “ মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেবো , তোমার ছেলেকে ভালো কলেজে দিয়ো আর শহরে নিয়েগিয়ে ভালো ডাক্তার দেখিয়ো “
ঝুমা হেঁসে ফেলল , তারপর বলল “ আপনের টেকা আমি নিমু না ছোট মিয়াঁ , ওইটা রাখেন আপনে যে আমাগো লইগা ভাবসেন এইটাই অনেক “
টাকাটা আমি পকেতে রেখে দিলাম , আমি জানি ঝুমা কিছুতেই টাকা নেবে না । ওকে এও বোঝানো সম্ভব নয় যে আমি অনেক আগে থেকেই ওর জন্য কিছু একটা করার চিন্তা করেছিলাম ।
চলে আসার সময় মনে হলো আজমল চাচা আমার চলে জাওয়াতে খুসি । আমাকে নানা রকম বুঝ দেয়ার চেষ্টা করলো । এও বলল যে এখানে আমার এখন না থাকাই ভালো । উনি যে করেই হোক মিয়াঁ বাড়ির হারানো দিন ফিরিয়ে আনবে । তখন মাঝে মাঝে আমি যেন এসে ঘুরে যাই । আজমল চাচা আর জালাল মিলে আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো । এমনকি আজমল চাচা আমার সাথে বড় রাস্তা পর্যন্ত আসতে চাইলো । কিন্তু আমি নিষেধ করলাম , শেষে আসার সময় জালাল কে বলে এলাম , একবার যেন করিমের সাথে দেখা করে আগামিকাল । আমি ঢাকা গিয়ে ওকে কল করে বলে দেবো সোনিয়া যেন জালালের চিকিৎসা করে । গ্রামে থেকে আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা করিম কে জানাতে চাইলাম না ।
আবার সেই মোটর বসানো রিক্সা আর ভাঙ্গা রাস্তা , তারপর সেই মামা ভাগিনার দোকানে বসে বাসের জন্য অপেক্ষা । এবার অবশ্য বিশেষ যত্ন পেলাম । আমি চলে জাচ্ছি শুনে কিছু লোক ও জড় হলো । প্রাত্য মিনিট পনেরো অপেক্ষার পর একটি বাস এসে থামল । সবাই মিলে আমাকে বাসে তুলে দিলো । একটি পুরো সিট বরাদ্দ করা হলো আমার জন্য , কাউকে পাশে বসতে দেয়া হলো না । এমনকি হেল্পার কে ভালো করে বলে দেয়া হলো , নামানর সময় যেন ভালো করে নামিয়ে দেয় আমাকে । এই লোক গুলি আমাকে যে ধরনের খাতির যত্ন করছে তা আমার প্রাপ্য নয় , তাই এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলাম ।
নড়বরে দরজায় হেল্পারের দুইটি থাবা মারার ইংগিত পেয়ে ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিলো । ধিরে ধিরে পেছনে পরে যাচ্ছে সফিপুর , সাথে সাথে কিছু মানুষ আর একটি পুরনো বাড়ি । যাদের কেউ আর আমার আপন নয় , যাদের সাথে আমার এতটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে যে হাত বাড়িয়ে নাগাল পাওয়া আর কোনদিন সম্ভব নয় । আর অসম্ভব কিছুর পেছনে ছোটা সুধু দুঃখই বাড়ায় ।
ঢাকা এসে একটা হোটেলে উঠলাম আমার টিকিত আরও প্রায় তিনদিন পর । টিকিট এর তারিখ পরিবর্তন করতে গিয়ে জানতে পারলাম সেটা সম্ভব নয় । এই তিনদিন আমাকে ঢাকাতেই থাকতে হবে । কোনরকম তিনদিন পার করলাম , ভেবে ছিলাম পাঁচ তারা হোটেলের দামি মদ , রমরমা জুয়ার আসর আর ঢাকার টপ ক্লাস বেশ্যা আমাকে সফিপুর নামক জায়গা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে । কিন্তু আমার সেই চিন্তা চুরান্ত ভাবে ভুল প্রমানিত হয়েছিলো । বার বার মনে হচ্ছিলো আমি কিছু একটা পেছনে ফেলে জাচ্ছি । ত্রিশ বছর আগেও এমনটা হয়ে ছিলো কিন্তু এবারের টা আরও বেশি শক্তিশালী ।
কাজ আর কাজ , প্রচুর কাজ করেছি গত তিন মাস , আমাকে যারা ভালো করে চেনে তারা সবাই অবাক হয়ে গেছে আমাকে দেখে । বাঙালী কেউ কেউ তো মজা করে বলেই ফেলে দেশ থেকে আমার কাঁধে চড়ে একটা কর্মঠ ভুত এসেছে , যে আমাকে দিয়ে এতো কাজ করিয়ে নিচ্ছে । জীবনে আমি এতো কাজ করিনি , তবে আমার ভালোই লাগে কাজ করতে এখন ।
দেশ থেকে আসার পর বান্ধবি ক্যাথরিন এর সাথে সম্পর্ক চুকে গেছে । ওর অভিযোগ আমি আর আগের মতো নেই । এই পশ্চিমা মেয়ে গুলিকে আমার দারুন লাগে , এরা কথা বলতে জানে , কোন কিছু মন মতো না হলেই বলে রাস্তা মাপো । এতে করে মনের মাঝে কোন ক্লেশ থাকে না । অথচ আমাদের বাঙালী মেয়ে গুলি অন্য রকম এরা রহস্য করে , যত দুরেই চলে আসিনা কেন এদের ভোলা যায় না ।
কত সহজেই না ঝুমা আমাকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছিলো , আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে কতই না মহান একটি মেয়ে । কিন্তু সত্যি কি তাই ? একদম না , সারা জীবনের জন্য আমাকে বন্দি করে রেখে দিয়েছে , ঠিক ওর মায়ের মতো । একটা অদৃশ্য অপরাধ বোধ এর সেঁকল আমার পায়ে বেধে দিয়েছে । যতক্ষণ কাজের মাঝে থাকি ততক্ষন নির্ভেজাল থাকি জখনি একটু অবসর আসে , সাথে সাথে ঝুমাও চলে আসে । দাঁত বের করে হাসে , বলে দেখছেন ছোট মিয়াঁ কিমুন শাস্তি দিতাসি আপনেরে ।
আমি এখনো ঝুমার প্রতি আমার এই টানের কারন খুঁজে পাই না । এমন নয় যে ঝুমা দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে । এও নয় ঝুমাকে আমি বিয়ে করতে চাই । তাহলে কেন ঐ মেয়েটাকে আমার সারাক্ষন মনে পরে কে জানে । হ্যাঁ মেয়েটা দুঃখী এর জন্য প্রতি মাসে আমি টাকা পাঠাই । তারপরেও মনে শান্তি পাচ্ছি না । সারাক্ষন মনে হয় মেয়েটা আমাকে ডাকছে , আর সেই ডাকে আমার সারা দেয়া উচিৎ ।
তবে ঝুমা আমার একটা উপকার করেছে , আমার মেয়ের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করেছে । ঝুমার একটা কথা আমাকে নিজের মেয়ের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করতে বাধ্য করেছে । একদিন ঝুমাকে অনিলার কথা বলতে ও বলেছিলো
“ সব বাপ রাই কি এমুন হয় , জন্ম দিয়া ভুইলা যায় “ আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ঝুমার কথায় , ওর তো বাবা মারা গিয়েছে , তার প্রতি তো ঝুমার এমন অভিমান থাকার কথা নয় । জিজ্ঞাস করেছিলাম “ তোমার বাবা তো আর আমার মতো না , নি তো মারা গেছে না হয় নিশ্চয়ই তোমার খোঁজ নিতো “
আমার এই কথা শুনে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলেছিলো ঝুমা তারপর বলেছিলো “ আমার একটা কথা সবসময় মনে হয় জানেন , কাউরে অবশ্য কই না , আপনেরে কইতাসি , আমার মনে হয় আমার বাপ মড়ে নাই , হেয় দূরে কোন খানে গেসে গা “
যদিও আজমল চাচা আমাকে বলেছে ঝুমার বাবা মারা গেছে । কিন্তু ঝুমার কথা শুনে মনে হয়েছিলো ও হেয়ালি করে কথা গুলি বলেনি । কথা গুলি ও মন থেকে বিশ্বাস করে । কেন বিশ্বাস করে সেটা অবশ্য বুঝতে পারিনি ।
তবে ঝুমার ঐ বেদনার্ত মুখ যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন আমার অনিলার কথা মনে পরে , মনে হয় অনিলাও নিশ্চয়ই আমার উপর অভিমান করে আছে । ঝুমার চেয়ে অনিলার অভিমান আরও বেশি হওয়ার কথা কারন ও জানে ওর বাবা জীবিত আছে । আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম সুধু রাবু আর ঝুমা নয় আমি অনিলার সাথেও একি রকম আচরন করেছি । দূরে চলে যাওয়ায় নিজেকে বোঝা মুক্ত মনে করেছিলাম । তাই ধিরে ধিরে অনিলার সাথে একটা সম্পর্ক পুনরায় তৈরি করে নিয়েছি ।
যত সময় যাচ্ছে আমার অনিলার সম্পর্ক অনেক সহজ হয়ে উঠেছে । অনেক কথা হয় মেয়ে আর আমার মাঝে । মাঝে মাঝে ওর কথায় বুঝতে পারি কতটা অভিমান আমার জন্য ওর মনে তৈরি হয়েছিলো । সফিপুর থেকে চলে আসার পর এই একটা জিনিস ই আমাকে সত্যিকারের আনন্দ দিয়েছে । আর এই অনিলার জন্যই আমাকে আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। মেয়ে আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছে ।