12-02-2021, 07:28 PM
জামা কাপড় পরে নিজেকে ভদ্রস্থ করে নিলাম । একটা জিনিস দেখে আশ্চর্য হলাম যে এখনো নাস্তা দেয়া হয়নি আমাকে । এরকম তো হয় না কখনো । সকাল আটটার আগেই নাস্তা চলে আসে আমার জন্য । আজ এখন প্রায় সোয়া নয়টা বেজে গেছে । একটা খারাপ চিন্তা মনের কোনে উকি দিতে শুরু করলো । ঝুমার সাথে তৈরি হওয়া সুন্দর সম্পর্কটা কি আমি নষ্ট করে ফেললাম ? ঝুমা কি কাল রাতের কারনে আমার উপর রাগ করেছে । কিন্তু কাল রাতে তো মনে হয়েছে ঝুমা নিজেও চাইছে ব্যাপারটা , কি জানি হয়ত সকালে উঠে কাল রাতের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে , ঠিক যেমন আমারও এই মুহূর্তে হচ্ছে ।
হঠাত করে কাল রাতে বলা ঝুমার একটি কথা আমার মনে পরে গেলো , যখন আমি ওকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম তখন বলেছিলো “ আমারও কিন্তু জানাজা হইবো না “ । এর দারা ঝুমা কি বোঝাতে চেয়েছিলো ? এটা কি কনো সতর্ক বানি ছিলো ঝুমার পক্ষ থেকে ? সব কিছু শুরু হওয়ার আগে ঝুমা কি আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো যে এর পর যা হবে তা সুধু এক রাতের জন্য যেন না হয় । এর মানে কি ? ঝুমা কি আমার সাথে নিজেকে জড়াতে চাচ্ছে ?
উফ ... কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লাম আমি । আর ভাবতে পারছি না , হ্যাঁ ঝুমার জন্য আমি এক ধরনের মমতা বোধ করি , এমনকি ওর নধর শরীরটা আমাকে টানে । কিন্তু ওর সাথে সমাজ স্বীকৃত কোন সম্পর্কে জরানো আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয় । কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না । একবার মনে হলো চুপি চুপি চলে যাই একবার দেশ ছেড়ে চলে গেলে আমাকে আর পাবে না । আমিও ঝুমার কোন খবর পাবো না , এতে করে আমাদের দুজনের জন্য ই ভালো হবে । পরক্ষনেই সেই চিন্তা বাদ দিলাম , নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো সেটা ভাবতেই কেমন জানি লাগছে । যা হবে দেখা যাবে এই ভেবে দেয়ালের সাথে লেগে থাকা বোতলে যা অবশিষ্ট ছিলো গলায় ঢেলে দিলাম ।
ঠিক তখনি ঝুমার ছেলেটা এসে দরজায় দাঁড়ালো । “ কি খান নানা হুজুর”
আমি মুখ থেকে খালি বোতল টা সরিয়ে বললাম “ ঔষধ খাচ্ছি জালাল , কি খবর তোমার “
“ মায় আপনেরে গোসল কইরা নিচে জাইতে কইসে নাস্তা খাওনের লইগা “ এই বলে জালাল আর দাঁড়ালো না চলে গেলো ।
মনে মনে ভাবলাম ব্যাপার কি , প্রতিদিন তো নাস্তা উপরে চলে আসে , আজ কেন নিচে ডাকছে । এর মানে কি মিয়াঁ বাড়ির কর্তা বলে যে সম্মান টুকু আমাকে দেখানো হতো সেটা ভুলে এখন ঝুমা আমাকে নিজের সমকক্ষ একজন মনে করছে ?
যদিও ভেবেছিলাম ঝুমার সাথে যত কম সম্ভব দেখা করবো , কিন্তু এখন ভাবলাম না গিয়ে দেখি ঝুমার হাব ভাব কি । যদি মতি গতি খারাপ দেখি সরাসরি কথা বলবো । আমি এখনো চাই মেয়েটার জন্য কিছু করতে , কিন্তু নিজের জীবন সঙ্গি হিসেবে কোনদিন আমি ওকে মেনে নিতে পারবো না । আমি এও চাইনা ওর কোন ক্ষতি হোক , অন্তত রাবুর সাথে আমার আচরনের পুনরাবৃত্তি আমি করতে চাই না । আমার জন্য তুলে রাখা পানি দিয়ে গোসল করে আমি নিচে নেমে এলাম ।
নিচে নেমে আসতেই জালাল আমাকে একেবারে চুলার কাছে নিয়ে গেলো । সেখানে ঝুমা বসে আছে , একটা মোড়া এনে দেয়া হলো আমাকে বসার জন্য । আমি বসতেই ঝুমা চুলার উপর বসিয়ে রাখা গরম লোহার তাওয়ায় হালকা হলদে রং এর আঠালো একটা জিনিস দিয়ে পাতলা করে বিছিয়ে দিলো ।
“ এই জিনিস গরম গরম খাইতে হয় ছোট মিয়াঁ , তা নাইলে মজা লাগে না “ মুচকি হেঁসে বলল ঝুমা ,
আমি ভালো করে তাকালাম ওর দিকে , স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গোসল করেছে । এখনো চুল ভেজা ভেজা , চেহারায় সিগ্ধ একটা ভাব । মিটি মিটি একটা হাঁসি লেগে আছে ঠোঁটের কোনে , এক কথায় ভীষণ মিষ্টি লাগছে ঝুমা কে , এমন পরিস্থিতিতে আমি গত রাতের কথা তুলতে পারলাম না । চুপচাপ বসে বসে খেতে লাগলাম , দোসা টাইপ খাবার টি , যাকে গ্রাম্য ভাষায় চাপটি বলে ।
“ ছোট মিয়াঁ কি বাইর হইবেন ?” নিরবতা ভাংলো ঝুমা । ওর কথা শুনে আমি একটু চমকে উঠলাম । আমার এই চমকে ওঠা ঝুমার নজর এড়ালো না । একটু অবাক হওয়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
“ হ্যাঁ মানে আমি আসলে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম , আজ করিমের বাসায় আমার দুপুরে দাওয়াত ফিরতে ফিরতে রাত হবে “ কোন রকমে বলে আমি আবার খাওয়ায় মন দিলাম । খেতে খেতে আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম ঝুমার ঠোঁটে লেগে থাকা সেই হাঁসিটি আর নেই । মনে মনে ভাবলাম এই বুঝি শুরু হলো । কিন্তু এর পর ঝুমা এর কিছু বলল না , আমি দ্রত খাবার শেষ করে তৈরি হয়ে বেড়িয়ে গেলাম ।
জালাল আগেই আমার জন্য একটি ব্যাটারি চালিত রিক্সা ডেকে রেখেছিলো , সেটায় উঠে বসে আমি করিমের বাড়ি না গিয়ে সোজা বাস স্ট্যান্ডে চলে গেলাম , আজকাল তো এমন জন্ম নিয়ন্ত্রণ ঔষধ পাওয়া যা যেগুলি ৭২ ঘণ্টার মাঝে খেলেও কাজ হয় । আবার সেই বাম্পি রাস্তা পেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে চলে এলাম । তবে এবারের অবস্থা ভিন্ন । অনেকেই আমাকে চিনে ফেলেছে , এখন আমি আর এদের কাছে শহর থেকে আশা কোন রেন্ডম লোক নই , এই গ্রামের সবচেয়ে গণ্য মান্য এক পরিবারের কর্তা ।
আমাকে দেখে সেই প্রথম দিন দেখা দোকানী মামা দোকান থেকে নেমে চলে এলো । এসেই আমাকে সালাম দিয়ে নিজের দোকানে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা খাওয়াতে চাইলো । তার দেখাদেখি অনেকেই চলে এলো । সবাই বেশ খাতির করছে আমাকে । একটা ব্যাপার ভেবে অবাক হলাম এরা যখন জেনেই ফেলেছে আমি কে তাহলে কেউ আমার সাথে দেখা করতে গেলো না কেন ?
প্রস্নের উত্তর পেতে দেরি হলো না , বেশ কয়েকজন আমার কাছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নালিশ করলো । আমি বুঝতে পারলাম এরা আমাকে চেয়ারম্যান করিমের শত্রু মনে করছে । তাই পরিস্থিতি না বুঝে কেউ কোন দিকে যেতে চাচ্ছে না । হয়ত দেখতে চাচ্ছে আমি কি সুধু ঘুরতে এসেছি নাকি আমার অন্য প্ল্যান আছে । হয়ত আজমল চাচা কিছু বলেছে এদের কাছে , হয়ত বলেছে সে আবার করিমের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে ।
যাই হোক , এখান থেকে কন্ট্রাসেপ্টিক পিল কেনা আমার পেক্ষে সম্ভব না । গ্রামে কথা রটে যাবে , এতে আমার চেয়ে ঝুমার ক্ষতি হবে বেশি। তাই আমি আরও দুই গ্রাম দূরে চলে গেলাম । পিল কিনে কি মনে করে কিছু কনডম ও কিনে নিলাম । কেন কিনলাম সেটা আমি জানি না , হয়ত এই কনডম গুই আর কোন কাজেই আসবে না ।
করিমের বাড়ি পউছুতে পউছুতে প্রায় ১২ তা বেজে গেলো । তাই করিম খুব রাগ করলো , বাড়ির পেছনে পুকুরে বরশী দিয়ে মাছ ধরার আয়জন করেছিলো করিম আমার জন্য সেটা এখন ভেস্তে গেলো । একে একে করিমের পরিবারের সবার সাথে পরিচয় হলো , দুই ছেলে করিমের একজন এর বয়স ১৩ অন্যজন ৯ । দুটোই দেখতে একেবারে করিমের মতো , তবে বড় ছেলেটার কথা বার্তা আচার আচরন একেবারে করিমের সাথে মিলে যাচ্ছে ।
শেষে করিমের বউ এর সাথে পরিচয় হলো । প্রথমে আমি একেবারে চিনতেই পারিনি , অনেক মোটা হয়ে গেছে পুরপুরি গিন্নি চেহারা । পরে যখন জানতে পারলাম পুরো অবাক হয়ে গেলাম । আমাদের আসাদ স্যার এর মেয়ে সোনিয়া , কত ছোট ছিলো মেয়েটা তখন । আমি যখন চলে যাই তখন ওর বয়স কত হবে ১০-১২ হবে । আর এ ভেবেও অবাক হলাম , আসাদ স্যার করিমের কাছে নিজের মেয়ে বিয়ে দিয়েছে । করিম কে স্যার দুই চক্ষে দেখতে পারত না । প্রচুর মার খেয়েছে করিম স্যার এর কাছে ।
“ আসাদ স্যার রে পটালি ক্যামনে “ সোনিয়া চলে যেতেই আমি করিম কে জিজ্ঞাস করলাম । প্রস্ন শুনে করিমের মুখে চওড়া হাঁসি । বলল
“ বাপ রে পটনের দরকার কি , মাইয়ারে পটাইয়া ফালাইসি “
করিমের উত্তর শুনে আমারা দুজনেই উচ্চ স্বরে হেঁসে ফেললাম । হাসতে হাসতে দেখলাম করিমের ছোট ছেলেটা আমাদের সামনে বসা , মিট মিট হাসছে ।
“ যাও বাবা বাইরে গিয়া খেলো , বাপ মার পীরিতের কথা শুনতে নাই “ হাঁসা শেষে করিম ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল । যা আমাকে আরও অবাক করে দিলো । এখনো করিম খাপছারা ই আছে , পশ্চিমা দেশে হয়ত বাবা মা সন্তানদের সামনে চুমু খায় । কিন্তু গ্রাম বাংলায় সন্তানের সামনে বাবা মায়ের প্রেমের কথা বলা এখনো নিশ্চয়ই খুব বত একটা TABOO । কিন্তু করিমের কথা আর ছেলের রিএকশন দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা বাবা মায়ের প্রেম দেখে অভস্থ । ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগলো বেশ ।
বাঙালী গ্রাম্য খাবারের সাথে সাথে বেশকিছু শহুরে খাবারের ও আয়জন করা হয়েছে । কম করে হলেও প্রায় ১৫ ধরনের খাবার , সবই আমাকে চেখে দেখতে হলো । তবে রান্নার হাত বেশ ভালো হওয়ায় তেমন একটা অসুবিধা হলো না খাওয়ার সময় । তবে টের পেলাম যখন খাওয়ার টেবিল থেকে উঠেতে যাবো । পেট এতটাই পূর্ণ হয়েছে যে মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে বেল্ট ফেটে যাবে ।
খাওয়ার পর আড্ডা হলো করিম আর করিমের বউয়ের সাথে । জানা গেলো আমাদের করিম ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে স্নাতক করছে । শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম । করিম কে যত নতুন করে জানছি ততই অবাক হচ্ছি । যেখানে মানুষ গ্রাম ছাড়ার জন্য ব্যাকুল সেখানে করিম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গ্রামে পরে আছে । সুধু করিম নয় সোনিয়া নিজেও উচ্চ শিক্ষিত , গ্রামের সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার হিসেবে নিয়জিত । সোনিয়াকে ডাক্তারি পড়ার জন্য সাহায্য করেছে স্বয়ং করিম ।
ভালো লাগার সাথে সাথে এক ধরনের হিংসা অনুভব করলাম আমি করিমের প্রতি । সব দিক থেকে করিমের চেয়ে বেশি সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আমার জীবনটা কত ছন্ন ছাড়া ।
বিকেলে এলো নাল্টু , এর পর সোনিয়া আর আমাদের সাথে বসলো না , তিন বন্ধুকে একা ছেড়ে নিজে চলে গেলো আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করার জন্য । নাল্টুর অবশ্য আরও আগেই আসার কথা ছিলো কিন্তু জরুরী কাজ থাকায় আসতে পারেনি । তবে এসেই বলল “ একদম রাগ করতে পারবি না আমার উপরে , জিনিস নিয়া আসছি পাক্কা জিনিস “ প্রথমে আমি বুঝতে পারলাম না , তবে করিমের চউরা হাঁসি আর ব্যাগ থেকে একটা লেবেল ছাড়া বোতল বের হতে দেখে আমার আর বুঝার বাকি রইল না কি জিনিস এসেছে ।
“ দোস্ত বিদেশে তো বিদেশি খাও এইবার আমাগো লগে দেশি খাঁটি জিনিস এর স্বাদ লইয়া দেখো “ আমার পিঠে একটা এক মন ওজনের থাবা মেরে বলল করিম । ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম আমি , বললাম “ শালা এই অভ্যাস এহনো গেলো না তর “
মনে মনে চিন্তা করলাম , একজন সফল ব্যাবসায়ি আর একজন শিক্ষিত লোক যদি এই জিনিস খেতে পাড়ে তবে আমি কেন পারবো না । দেখা যাক খেয়ে , নিশ্চয়ই অ্যামেরিকা থাকাটা আমাকে ওদের চেয়ে উচু স্থানে নিয়ে যায়নি । বরং এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে ওরা দুজন আমার চেয়ে বেশি অর্জন করতে পেরেছে । ওদের সবচেয়ে বড় অর্জন ওদের হাঁসি খুসি পরিবার ।
হঠাত করে কাল রাতে বলা ঝুমার একটি কথা আমার মনে পরে গেলো , যখন আমি ওকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম তখন বলেছিলো “ আমারও কিন্তু জানাজা হইবো না “ । এর দারা ঝুমা কি বোঝাতে চেয়েছিলো ? এটা কি কনো সতর্ক বানি ছিলো ঝুমার পক্ষ থেকে ? সব কিছু শুরু হওয়ার আগে ঝুমা কি আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো যে এর পর যা হবে তা সুধু এক রাতের জন্য যেন না হয় । এর মানে কি ? ঝুমা কি আমার সাথে নিজেকে জড়াতে চাচ্ছে ?
উফ ... কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লাম আমি । আর ভাবতে পারছি না , হ্যাঁ ঝুমার জন্য আমি এক ধরনের মমতা বোধ করি , এমনকি ওর নধর শরীরটা আমাকে টানে । কিন্তু ওর সাথে সমাজ স্বীকৃত কোন সম্পর্কে জরানো আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয় । কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না । একবার মনে হলো চুপি চুপি চলে যাই একবার দেশ ছেড়ে চলে গেলে আমাকে আর পাবে না । আমিও ঝুমার কোন খবর পাবো না , এতে করে আমাদের দুজনের জন্য ই ভালো হবে । পরক্ষনেই সেই চিন্তা বাদ দিলাম , নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো সেটা ভাবতেই কেমন জানি লাগছে । যা হবে দেখা যাবে এই ভেবে দেয়ালের সাথে লেগে থাকা বোতলে যা অবশিষ্ট ছিলো গলায় ঢেলে দিলাম ।
ঠিক তখনি ঝুমার ছেলেটা এসে দরজায় দাঁড়ালো । “ কি খান নানা হুজুর”
আমি মুখ থেকে খালি বোতল টা সরিয়ে বললাম “ ঔষধ খাচ্ছি জালাল , কি খবর তোমার “
“ মায় আপনেরে গোসল কইরা নিচে জাইতে কইসে নাস্তা খাওনের লইগা “ এই বলে জালাল আর দাঁড়ালো না চলে গেলো ।
মনে মনে ভাবলাম ব্যাপার কি , প্রতিদিন তো নাস্তা উপরে চলে আসে , আজ কেন নিচে ডাকছে । এর মানে কি মিয়াঁ বাড়ির কর্তা বলে যে সম্মান টুকু আমাকে দেখানো হতো সেটা ভুলে এখন ঝুমা আমাকে নিজের সমকক্ষ একজন মনে করছে ?
যদিও ভেবেছিলাম ঝুমার সাথে যত কম সম্ভব দেখা করবো , কিন্তু এখন ভাবলাম না গিয়ে দেখি ঝুমার হাব ভাব কি । যদি মতি গতি খারাপ দেখি সরাসরি কথা বলবো । আমি এখনো চাই মেয়েটার জন্য কিছু করতে , কিন্তু নিজের জীবন সঙ্গি হিসেবে কোনদিন আমি ওকে মেনে নিতে পারবো না । আমি এও চাইনা ওর কোন ক্ষতি হোক , অন্তত রাবুর সাথে আমার আচরনের পুনরাবৃত্তি আমি করতে চাই না । আমার জন্য তুলে রাখা পানি দিয়ে গোসল করে আমি নিচে নেমে এলাম ।
নিচে নেমে আসতেই জালাল আমাকে একেবারে চুলার কাছে নিয়ে গেলো । সেখানে ঝুমা বসে আছে , একটা মোড়া এনে দেয়া হলো আমাকে বসার জন্য । আমি বসতেই ঝুমা চুলার উপর বসিয়ে রাখা গরম লোহার তাওয়ায় হালকা হলদে রং এর আঠালো একটা জিনিস দিয়ে পাতলা করে বিছিয়ে দিলো ।
“ এই জিনিস গরম গরম খাইতে হয় ছোট মিয়াঁ , তা নাইলে মজা লাগে না “ মুচকি হেঁসে বলল ঝুমা ,
আমি ভালো করে তাকালাম ওর দিকে , স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গোসল করেছে । এখনো চুল ভেজা ভেজা , চেহারায় সিগ্ধ একটা ভাব । মিটি মিটি একটা হাঁসি লেগে আছে ঠোঁটের কোনে , এক কথায় ভীষণ মিষ্টি লাগছে ঝুমা কে , এমন পরিস্থিতিতে আমি গত রাতের কথা তুলতে পারলাম না । চুপচাপ বসে বসে খেতে লাগলাম , দোসা টাইপ খাবার টি , যাকে গ্রাম্য ভাষায় চাপটি বলে ।
“ ছোট মিয়াঁ কি বাইর হইবেন ?” নিরবতা ভাংলো ঝুমা । ওর কথা শুনে আমি একটু চমকে উঠলাম । আমার এই চমকে ওঠা ঝুমার নজর এড়ালো না । একটু অবাক হওয়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
“ হ্যাঁ মানে আমি আসলে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম , আজ করিমের বাসায় আমার দুপুরে দাওয়াত ফিরতে ফিরতে রাত হবে “ কোন রকমে বলে আমি আবার খাওয়ায় মন দিলাম । খেতে খেতে আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম ঝুমার ঠোঁটে লেগে থাকা সেই হাঁসিটি আর নেই । মনে মনে ভাবলাম এই বুঝি শুরু হলো । কিন্তু এর পর ঝুমা এর কিছু বলল না , আমি দ্রত খাবার শেষ করে তৈরি হয়ে বেড়িয়ে গেলাম ।
জালাল আগেই আমার জন্য একটি ব্যাটারি চালিত রিক্সা ডেকে রেখেছিলো , সেটায় উঠে বসে আমি করিমের বাড়ি না গিয়ে সোজা বাস স্ট্যান্ডে চলে গেলাম , আজকাল তো এমন জন্ম নিয়ন্ত্রণ ঔষধ পাওয়া যা যেগুলি ৭২ ঘণ্টার মাঝে খেলেও কাজ হয় । আবার সেই বাম্পি রাস্তা পেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে চলে এলাম । তবে এবারের অবস্থা ভিন্ন । অনেকেই আমাকে চিনে ফেলেছে , এখন আমি আর এদের কাছে শহর থেকে আশা কোন রেন্ডম লোক নই , এই গ্রামের সবচেয়ে গণ্য মান্য এক পরিবারের কর্তা ।
আমাকে দেখে সেই প্রথম দিন দেখা দোকানী মামা দোকান থেকে নেমে চলে এলো । এসেই আমাকে সালাম দিয়ে নিজের দোকানে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা খাওয়াতে চাইলো । তার দেখাদেখি অনেকেই চলে এলো । সবাই বেশ খাতির করছে আমাকে । একটা ব্যাপার ভেবে অবাক হলাম এরা যখন জেনেই ফেলেছে আমি কে তাহলে কেউ আমার সাথে দেখা করতে গেলো না কেন ?
প্রস্নের উত্তর পেতে দেরি হলো না , বেশ কয়েকজন আমার কাছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নালিশ করলো । আমি বুঝতে পারলাম এরা আমাকে চেয়ারম্যান করিমের শত্রু মনে করছে । তাই পরিস্থিতি না বুঝে কেউ কোন দিকে যেতে চাচ্ছে না । হয়ত দেখতে চাচ্ছে আমি কি সুধু ঘুরতে এসেছি নাকি আমার অন্য প্ল্যান আছে । হয়ত আজমল চাচা কিছু বলেছে এদের কাছে , হয়ত বলেছে সে আবার করিমের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে ।
যাই হোক , এখান থেকে কন্ট্রাসেপ্টিক পিল কেনা আমার পেক্ষে সম্ভব না । গ্রামে কথা রটে যাবে , এতে আমার চেয়ে ঝুমার ক্ষতি হবে বেশি। তাই আমি আরও দুই গ্রাম দূরে চলে গেলাম । পিল কিনে কি মনে করে কিছু কনডম ও কিনে নিলাম । কেন কিনলাম সেটা আমি জানি না , হয়ত এই কনডম গুই আর কোন কাজেই আসবে না ।
করিমের বাড়ি পউছুতে পউছুতে প্রায় ১২ তা বেজে গেলো । তাই করিম খুব রাগ করলো , বাড়ির পেছনে পুকুরে বরশী দিয়ে মাছ ধরার আয়জন করেছিলো করিম আমার জন্য সেটা এখন ভেস্তে গেলো । একে একে করিমের পরিবারের সবার সাথে পরিচয় হলো , দুই ছেলে করিমের একজন এর বয়স ১৩ অন্যজন ৯ । দুটোই দেখতে একেবারে করিমের মতো , তবে বড় ছেলেটার কথা বার্তা আচার আচরন একেবারে করিমের সাথে মিলে যাচ্ছে ।
শেষে করিমের বউ এর সাথে পরিচয় হলো । প্রথমে আমি একেবারে চিনতেই পারিনি , অনেক মোটা হয়ে গেছে পুরপুরি গিন্নি চেহারা । পরে যখন জানতে পারলাম পুরো অবাক হয়ে গেলাম । আমাদের আসাদ স্যার এর মেয়ে সোনিয়া , কত ছোট ছিলো মেয়েটা তখন । আমি যখন চলে যাই তখন ওর বয়স কত হবে ১০-১২ হবে । আর এ ভেবেও অবাক হলাম , আসাদ স্যার করিমের কাছে নিজের মেয়ে বিয়ে দিয়েছে । করিম কে স্যার দুই চক্ষে দেখতে পারত না । প্রচুর মার খেয়েছে করিম স্যার এর কাছে ।
“ আসাদ স্যার রে পটালি ক্যামনে “ সোনিয়া চলে যেতেই আমি করিম কে জিজ্ঞাস করলাম । প্রস্ন শুনে করিমের মুখে চওড়া হাঁসি । বলল
“ বাপ রে পটনের দরকার কি , মাইয়ারে পটাইয়া ফালাইসি “
করিমের উত্তর শুনে আমারা দুজনেই উচ্চ স্বরে হেঁসে ফেললাম । হাসতে হাসতে দেখলাম করিমের ছোট ছেলেটা আমাদের সামনে বসা , মিট মিট হাসছে ।
“ যাও বাবা বাইরে গিয়া খেলো , বাপ মার পীরিতের কথা শুনতে নাই “ হাঁসা শেষে করিম ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল । যা আমাকে আরও অবাক করে দিলো । এখনো করিম খাপছারা ই আছে , পশ্চিমা দেশে হয়ত বাবা মা সন্তানদের সামনে চুমু খায় । কিন্তু গ্রাম বাংলায় সন্তানের সামনে বাবা মায়ের প্রেমের কথা বলা এখনো নিশ্চয়ই খুব বত একটা TABOO । কিন্তু করিমের কথা আর ছেলের রিএকশন দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা বাবা মায়ের প্রেম দেখে অভস্থ । ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগলো বেশ ।
বাঙালী গ্রাম্য খাবারের সাথে সাথে বেশকিছু শহুরে খাবারের ও আয়জন করা হয়েছে । কম করে হলেও প্রায় ১৫ ধরনের খাবার , সবই আমাকে চেখে দেখতে হলো । তবে রান্নার হাত বেশ ভালো হওয়ায় তেমন একটা অসুবিধা হলো না খাওয়ার সময় । তবে টের পেলাম যখন খাওয়ার টেবিল থেকে উঠেতে যাবো । পেট এতটাই পূর্ণ হয়েছে যে মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে বেল্ট ফেটে যাবে ।
খাওয়ার পর আড্ডা হলো করিম আর করিমের বউয়ের সাথে । জানা গেলো আমাদের করিম ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে স্নাতক করছে । শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম । করিম কে যত নতুন করে জানছি ততই অবাক হচ্ছি । যেখানে মানুষ গ্রাম ছাড়ার জন্য ব্যাকুল সেখানে করিম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গ্রামে পরে আছে । সুধু করিম নয় সোনিয়া নিজেও উচ্চ শিক্ষিত , গ্রামের সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার হিসেবে নিয়জিত । সোনিয়াকে ডাক্তারি পড়ার জন্য সাহায্য করেছে স্বয়ং করিম ।
ভালো লাগার সাথে সাথে এক ধরনের হিংসা অনুভব করলাম আমি করিমের প্রতি । সব দিক থেকে করিমের চেয়ে বেশি সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আমার জীবনটা কত ছন্ন ছাড়া ।
বিকেলে এলো নাল্টু , এর পর সোনিয়া আর আমাদের সাথে বসলো না , তিন বন্ধুকে একা ছেড়ে নিজে চলে গেলো আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করার জন্য । নাল্টুর অবশ্য আরও আগেই আসার কথা ছিলো কিন্তু জরুরী কাজ থাকায় আসতে পারেনি । তবে এসেই বলল “ একদম রাগ করতে পারবি না আমার উপরে , জিনিস নিয়া আসছি পাক্কা জিনিস “ প্রথমে আমি বুঝতে পারলাম না , তবে করিমের চউরা হাঁসি আর ব্যাগ থেকে একটা লেবেল ছাড়া বোতল বের হতে দেখে আমার আর বুঝার বাকি রইল না কি জিনিস এসেছে ।
“ দোস্ত বিদেশে তো বিদেশি খাও এইবার আমাগো লগে দেশি খাঁটি জিনিস এর স্বাদ লইয়া দেখো “ আমার পিঠে একটা এক মন ওজনের থাবা মেরে বলল করিম । ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম আমি , বললাম “ শালা এই অভ্যাস এহনো গেলো না তর “
মনে মনে চিন্তা করলাম , একজন সফল ব্যাবসায়ি আর একজন শিক্ষিত লোক যদি এই জিনিস খেতে পাড়ে তবে আমি কেন পারবো না । দেখা যাক খেয়ে , নিশ্চয়ই অ্যামেরিকা থাকাটা আমাকে ওদের চেয়ে উচু স্থানে নিয়ে যায়নি । বরং এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে ওরা দুজন আমার চেয়ে বেশি অর্জন করতে পেরেছে । ওদের সবচেয়ে বড় অর্জন ওদের হাঁসি খুসি পরিবার ।